সময়টি ১৯৪৫ সাল, দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শেষ হলো মাত্র। মানুষের কষ্টের, দুর্দশার, অভাবের, হাহাকার সর্বোপরি দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে পৃথিবীর মানুষ। বিশ^যুদ্ধের কালো সময় শেষ হতে না হতেই ভারতবর্ষের রাজনীতিতে আসে ধর্মভিত্তিক দেশভাগ – ভারত এবং দ্বিখণ্ডিত পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান; কিন্তু ভাষা এবং সংস্কৃতির দিক থেকে দুই অঞ্চলের ছিল বিস্তর ব্যবধান।
১৯৪৫ সালের ২১শে জানুয়ারি রোববার পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশের) খুলনা জেলার বাগেরহাট অঞ্চলের শ্রীফলতলা গ্রামের শিক্ষানুরাগী, উদ্যোক্তা, সমাজসেবক ডা. জহুরুল হক ও সাহেবুন-নেছার দ্বিতীয় পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। তার নাম রাখা হয় মাহমুদুল হক।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে পাশ করে জনাকয়েক মেধাবী শিল্পীসহ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন চলে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় – নতুন স্বপ্ন নিয়ে। ১৯৪৮ সালে শিল্পাচার্য তাঁর সহ-শিল্পী আনোয়ারুল হক, সফিউদ্দীন আহমেদ, কামরুল হাসান, শফিকুল আমিন, হাবিবুর রহমান প্রমুখকে নিয়ে গড়ে তোলেন ঢাকা আর্ট স্কুল, যা ১৯৫৬ সালে স্থানান্তরিত হয়ে জনসন রোড থেকে চলে আসে আজকের শাহবাগের অবস্থানে। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের এক অনন্য সৃষ্টি ঢাকা আর্ট স্কুল পরবর্তীকালে ২০০৮ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে রূপান্তরিত হয়।
প্রাণচঞ্চল, দুর্বার বালক মাহমুদুল হক গ্রামে সবার খুবই প্রিয় ছিলেন। ভালো ফুটবল খেলতেন। লেখাপড়ায় ছিল তাঁর প্রচণ্ড অনীহা। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতে যাত্রা-পালাগান দেখতে ছুটে যেতেন। তবে যেটুকু লেখাপড়া করতেন, তাতে ভালো ফলই করতেন ক্লাসে। পিতা তাঁকে বেশ স্নেহ ও আদর করতেন। পিতাকে তাঁর বিভিন্ন সমাজ উন্নয়নের কাজে সহায়তা করতেন। পিতার স্বপ্ন ছিল, শিক্ষাবিবর্জিত, অন্ধকারাচ্ছন্ন শ্রীফলতলা গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার। সেই উদ্যোগে তিনি সফল হয়েছিলেন। ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন এবং তারপর এন্ট্রান্স পাশের জন্য মাহমুদুল হককে পি. সি. কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। সে-সময় লজিং থেকে তিনি লেখাপড়া করতেন এবং দুবার এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। তাঁর শিল্পীমন কোনোভাবেই আর পড়ালেখায় বসেনি। তিনি বরং ছুটে যেতেন কোনো বাড়িতে বিয়ের জন্য রঙিন কাগজে নকশা কাটার জন্য, কারো ব্যবহারিক খাতায় বিজ্ঞানের ড্রইং করার জন্য। পিতা বুঝতে পারলেন, এই ছেলেকে দিয়ে স্বপ্নের ডাক্তারি পড়ানো আর হবে না। একসময় মাহমুদুল হক নিজ উদ্যোগে চলে আসেন ঢাকায় আর্ট কলেজে ভর্তির উদ্দেশ্যে। ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তির সময় ভাইভা পদ্ধতি ছিল এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন যেহেতু অধ্যক্ষ, তাই নিয়মানুযায়ী তিনিই ভাইভা নিতেন। শিল্পাচার্য কথা প্রসঙ্গে শুধু জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আবদুর রউফকে চেনো?’ উত্তরে মাহমুদুল হক বলেছিলেন, ‘স্যার, চিনি। তিনি আমার সম্পর্কে ভগ্নিপতি হন।’ জয়নুল আবেদিন বললেন, ‘যাও, তাহলে কাল থেকে ক্লাস শুরু করো।’ আবদুর রউফ ছিলেন সে-সময়ে গ্রাফিক্স শিল্পী, যাঁর হাতের লেখায় বাংলাদেশের সংবিধান লিপিবদ্ধ হয়েছিল।
১৯৫৩ সালে ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং বিষয়ে ভর্তি হন মাহমুদুল হক। বড় ভাই নুরুল হক ছিলেন গ্রামে তাঁদের বাবার প্রতিষ্ঠিত স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি তাঁর মাইনে থেকে মাহমুদের পড়ালেখার খরচ বহন করতেন।
আর্ট কলেজে ভর্তির পর ঢাকা শহরে থাকার কোনো ব্যবস্থা ছিল না মাহমুদুল হকের। এসময় সন্ধান পেলেন সদরঘাটের এক সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের। সেখানে পরিবারের সন্তানদের পড়ানোর বিনিময়ে থাকা-খাওয়া নিশ্চিত হলো। সদরঘাট থেকে কখনো হেঁটে, কখনো বা সাইকেলে চড়ে তিনি কলেজে আসা-যাওয়া করতেন। শিল্পী হাশেম খান ছিলেন তাঁর শিক্ষক এবং তিনি তাঁকে আরো মনোযোগ দিয়ে কাজ করার জন্য উৎসাহ দিতেন।
ছাত্রাবস্থাতেই ১৯৬৬ সালে খুলনায় প্রথম চিত্র-প্রদর্শনী করেন মাহমুদুল হক। শিল্পী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার প্রয়াসে তিনি সবসময়ই সচেতন ছিলেন। তখন শ্রেণিকক্ষের কাজ ছাড়াও প্রকৃতি নিয়ে তিনি অনেক ছবি আঁকতেন। ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের বিষয়ও তিনি তাঁর ক্যানভাসে তুলে এনেছেন।
১৯৬৮ সালে চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় থেকে অংকন ও চিত্রায়ণ বিভাগ থেকে সফলতার সঙ্গে বিএফএ ডিগ্রি লাভ করেন মাহমুদুল হক। তাঁর দক্ষতা ও অনুশীলন প্রক্রিয়া দেখে শিল্পাচার্য আর্ট কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে তাঁকে প্রস্তাব দেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ টেলিভিশনেও তাঁর চাকরির প্রস্তাব আসে; কিন্তু তিনি তা ফিরিয়ে দিয়ে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চাকরিতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৯ সালে শিক্ষক হিসেবে তিনি আর্ট কলেজে যোগদান করেন। শুরু হয় নতুন জীবনের এক মোড় – শিল্পী হিসেবে নিজেকে তৈরি করার আরেক প্রয়াস এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শিল্প-শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। এ-বছরই কলেজ প্রাঙ্গণের নিজস্ব গ্যালারিতে একক প্রদর্শনী করেন শিল্পী মাহমুদুল হক।
শিক্ষকতা করতে গিয়ে তিনি খুঁজে পেলেন নতুন আরেক আকর্ষণ – ছাপচিত্রের প্রতি। সাদাকালোতে রং ও রেখার নতুন বিন্যাস সৃষ্টিতে তিনি একাগ্র হন। এ-বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য পাড়ি জমান জাপানে, ১৯৮০ সালে। প্রথমে জাপানি ভাষা শেখা এবং পরে ১৯৮১-৮২ – এই দু-বছর ছাপচিত্রের ওপর জাপানি শিল্পী অধ্যাপক শিরোকি তুসোকির তত্ত্বাবধানে গবেষণাকর্ম নিরীক্ষা করেন। পরবর্তীকালে আরো দুই বছর ধরে মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করেন।
প্রথমে এচিং এবং পরবর্তী সময়ে জাপানি ২০০ বছরের পুরনো প্রথা মেজোটিন্ট মাধ্যমে শিল্পী মাহমুদুল হক বেশ কিছু কাজ করেছিলেন। পরিপূর্ণ বাস্তবধর্মী নয়, বরং বাস্তবের অভিজ্ঞতায় নিজস্ব একটি অনুভবের শৈলীতে তিনি রচনা করেন তাঁর বেশ কিছু কাজ। ÔStone on StoneÕ- ‘পাথরের ওপর পাথর’ সিরিজের বেশ কিছু বড় কাজ তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করেছেন। শিল্পী তাঁর ছাপচিত্র সম্পর্কে বলেছেন, ‘রঙের প্রাচুর্যে ছবির মূল বক্তব্য হয়তো হারিয়ে যেতে পারে, বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের গভীরতাও ক্ষুণ্ন হতে পারে।’
এই আশঙ্কায় তাঁর ছাপচিত্রে সাদা-কালোর প্রভাব বেশি। ছাপচিত্র সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা তিনি পেয়েছিলেন শিক্ষক-শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ ও মোহাম্মদ কিবরিয়ার কাছ থেকে। এরপর ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের করাচিতে আয়োজিত পাকিস্তান-আমেরিকান সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচিতে আমেরিকার ছাপচিত্রশিল্পী মাইকেল পন্স-ডি-লিওনের তত্ত্বাবধানে একটি কর্মশালায় সাফল্যের সঙ্গে শিল্পী মাহমুদুল হক ছাপচিত্র তৈরি করেন এবং পাকিস্তানের একটি পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় তাঁর ছবি ছাপানোর মধ্য দিয়ে তা বেশ প্রশংসিত হয়।
জাপানের বর্ণিল শিক্ষাজীবন শিল্পী মাহমুদুল হককে আরো পরিমিতি এবং রং-ব্যবহারে সচেতন করে তোলে। স্পেস বা পরিসর কীভাবে সার্থকভাবে ব্যবহার করতে হবে, তাও তিনি আয়ত্তে আনেন। প্রথমদিকে পূর্বসূরিদের অনুকরণ থাকলেও পরবর্তীকালে একটি স্বকীয়তা নিয়ে চিত্র-রচনায় পরিপক্ব হতে থাকেন শিল্পী মাহমুদুল হক। শুরুতে তাঁর কাজে প্রাথমিক এবং বিপরীত রঙের ব্যবহারের প্রাধান্য ছিল। পরে মাধ্যমিক রঙের ব্যবহার ও বিভিন্ন টেক্সচারসহ তিনি নিরীক্ষাধর্মী ছবি আঁকতেন।
ষাটের দশকে তাঁর শিল্পে বিষয়বস্তুর প্রাধান্য সুস্পষ্ট। ধীরে ধীরে কখনো আধাবিমূর্ত, মূর্ত বা সর্বনিম্নে যা না থাকলেই নয়, অর্থাৎ মিনিম্যালিজম, তার প্রকাশও পরিলক্ষিত হয়।
মাহমুদুল হক একজন প্রকৃতিপ্রেমী শিল্পী ছিলেন। প্রতিদিন প্রতিটি ক্ষণের অভিজ্ঞতাকে আত্মস্থ করে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিত্র রচনা করতেন তিনি।
প্রথমাবস্থায় তাঁর চিত্রের আঙ্গিক বিষয়বস্তুতে জাপানের শিল্পী হিদোওয়া হাগিওয়ারা ও নদা তেতসুইরারের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মোহাম্মদ কিবরিয়ার মধ্যে দিয়ে যে বিমূর্ত শিল্পের প্রকাশ ঘটেছে এ-অঞ্চলে তার প্রকাশ পশ্চিমে অনেক শিল্পীর কাজে দেখা গেছে, যেমন – মার্ক রথকো, রবার্ট রৌসেনবার্গ, জর্জিয়া ও কাফি, থমাস হার্ট বেন্টন প্রমুখ। তাঁদের কাজের সঙ্গে মাহমুদুল হকের পরিচয় জাপান যাওয়ার আগেই হয়েছে। তাছাড়া মোহাম্মদ কিবরিয়ার বিমূর্ত ছবি, তার পেছনে আছে হিদোওয়া হাগিওয়ারার প্রভাব, মাহমুদুল হককেও প্রভাবিত করে। একই সঙ্গে তাঁর কাজে এন্তোনীয় ক্লাভ, ওয়াকিতাসা প্রমুখেরও প্রভাব দেখা যায়।
মাহমুদুল হক ১৯৮৪ সালে জাপানের সুকুবা বিশ^বিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে ফিরে আসেন নিজ শিক্ষাঙ্গনে – ঢাকা আর্ট কলেজে। এ-সময়ে তাঁকে গণ্য করা হতো একজন পরিপক্ব শিল্পী হিসেবে। জাপানের অভিজ্ঞতাকে ছাত্রদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসে নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছিলেন তিনি। বর্ণ-বিভাজনের বৈপরীত্য ও দ্বন্দ্ব সৃজনের ক্ষেত্রে সাদা-কালোর প্রবল শক্তি তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। সুকুবা বিশ^বিদ্যালয়ের
শিল্পী-শিক্ষক শিরোকির কাজ তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল। মাহমুদুল হক খুবই সচেতনতার সঙ্গে কল্পনা, আবেগ, অনুভূতি সর্বোপরি শিল্পের সকল অনুষঙ্গ-ব্যবহারে যথেষ্ট যত্নবান হন। রং-বিন্যাসে দক্ষ চিত্রকর, সহজ স্বাচ্ছন্দ্য চিত্র রচনায় বাংলাদেশের তৃতীয় প্রজন্মের অন্যতম প্রধান শিল্পী হয়ে ওঠেন মাহমুদুল হক। এ-সময়ে তিনি দেশে এবং জাপানে প্রচুর প্রদর্শনী করেছেন। এছাড়া ভারত, ওমান, আমেরিকা, কানাডা, পোল্যান্ড, কোরিয়া, তাইওয়ান, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড বিভিন্ন দেশে পেইন্টিং ও ছাপচিত্রের প্রদর্শনী করেছেন।
নিষ্ঠাবান ও আত্মবিশ্লেষী আধুনিক শিল্পী মাহমুদুল হক প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আরো সম্মানিত হতে থাকলেন এই দশকে। ১৯৯৩ সালে করাচির ইন্দোজভ্যালি স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড আর্কিটেকচারে ‘ভিজিটিং প্রফেসর’ হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯৩-৯৪ সালে ‘ভিজিটিং প্রফেসর’ হিসেবে জাপানের সুকুবা বিশ^বিদ্যালয়ে যোগদান করেন তিনি।
শুধু জাপান নয়, ১৯৯৬ সালে আর্টিস্ট ইন রেসিডেন্স হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নেব্রাস্কা বিশ^বিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন তিনি। দেশে-বিদেশে তাঁর সুখ্যাতিও বিস্তৃত হয় এই সময়কালে। তবে শিল্প রচনার পাশাপাশি মাহমুদুল হকের ছিল জানার ব্যাপক আগ্রহ এবং মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার প্রত্যয়। পিতার মতো মাহমুদুল হক নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিলেন। নিজের গ্রামে গড়ে তোলেন ‘আমার গ্রাম’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে অবহেলিত নারীরা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। বাংলাদেশের শিল্পকলাকে কীভাবে দেশের বাইরে প্রচার করা যায়, তা নিয়েও তিনি ভাবতেন। ১৯৯৩ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনারের আয়োজনে অনুষ্ঠিতব্য প্রথম আর্ট ক্যাম্পের নেপথ্যে ছিলেন শিল্পী মাহমুদুল হক। বাংলাদেশ থেকে সেই ক্যাম্পে যোগ দিয়েছিলেন শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া, মুর্তজা বশীর, শাহাবউদ্দিন আহমেদ, সমরজিৎ রায় চৌধুরী ও মাহমুদুল হক। আর ভারত থেকে ছিলেন – বিকাশ কর্মকার, বিকাশ ভট্টাচার্য, পরিতোষ সেন, সুনীল দাস, শ্যামল দত্ত রায়, যোগেন চৌধুরী, গণেশ হালুই, শুভাপ্রসন্ন, অমিতাভ সেনগুপ্ত ও প্রকাশ কর্মকার। শুধু চিত্রকলাই এর অংশ ছিল, তা নয়, পাশাপাশি ছিল বইয়ের একটি বড় স্টল আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ১৯৯৩ সালে খুলনা বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ও জার্মান কালচারাল সেন্টারের উদ্যোগে উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে ‘শিল্পী ও পরিবেশ’ শীর্ষক চিত্রকলা প্রদর্শনীতে বিশেষ অতিথি হিসেবে থেকে এ-বিষয়ে গণসচেতনতা গঠনে দৃঢ় ভূমিকা পালন করেন মাহমুদুল হক।
বিমূর্ত ভাবনায় একধরনের মূর্ততার বহিঃপ্রকাশ ঘটান শিল্পী মাহমুদুল হক। ড্যাম্প বা নোনাধরা, ক্ষয়ে যাওয়া দেয়ালের দাগ, অজস্র কালচে ফুটি, জলজ আবিষ্টতায় স্নিগ্ধ নমিত ও উজ্জ্বলতার সঙ্গে জড়িয়ে তিনি ‘বৃষ্টি’ সিরিজের কাজ নিয়ে আসেন। বৃষ্টির ধারা, ধূসর প্রকৃতি, জমিনের অস্পষ্টতা কখনো জ্যামিতিক, কখনো-বা আয়ত অথবা বর্গাকার বিন্যাসে তাঁর চিত্রে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। শহুরে নাগরিক জীবনের অট্টালিকার উল্লম্ব ও আনুভূমিক অবস্থান এবং এর দেয়ালের ক্ষয়ে যাওয়া রং, প্লাস্টার যেন জীবনের নানা সময়ের প্রতিফলন। ‘বৃষ্টি’ সিরিজটি তাঁর একটি অনবদ্য সৃষ্টি। বিভিন্ন ঋতুতে বৃষ্টি কেমন হয়, জানালার কাঁচের ওপর কীভাবে আর্দ্রতা জমে, তার রং, রূপ, রস এবং মানবজীবনে বৃষ্টির কী প্রভাব পড়ে – তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে তিনি তার বহিঃপ্রকাশ ঘটান ক্যানভাসে। নির্বস্তুক প্রকাশবাদী বিমূর্ত রীতির কাজে অগ্রসর শিল্পী মাহমুদুল হক নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এদেশে প্রকাশবাদী বিমূর্ত রীতির একজন সফল শিল্পী হয়ে ওঠেন। তাঁর একটি প্রণিধানযোগ্য উক্তি হলো –
ÔI paint nature in horizontal lines|Õ
মাহমুদুল হক বলেছিলেন, ‘আমার কাছে সাদা ক্যানভাসই সর্বোৎকৃষ্ট শিল্পকর্ম। কারণ তুলির আঁচড় টানার আগে পর্যন্ত অনেক পরিকল্পনা আর ভাবের খেলা চলে। কিন্তু যেই আঁকা হয়ে যায়, এক অতৃপ্তি এসে ভর করে। মনে হয়, আরো ভালো কিছু হতেও পারতো। সেই অতৃপ্তি থেকেই আবার আঁকতে বসি।’
১৯৯২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার ও শ্রেষ্ঠ পেইন্টিংয়ের জন্য জাপানের সুচিউরা সিটি পুরস্কার লাভ করেন মাহমুদুল হক। এর পরের বছর, ১৯৯৩ সালে, ষষ্ঠ এশিয়ান বিয়েনালে তিনি সম্মানজনক পদক লাভ করেন।
১৯৯৬ সালে ঢাকার ‘গ্যালারি টোন’ আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও সাফল্যের জন্য শিল্পী মাহমুদুল হককে সংবর্ধনা প্রদান করে। ওই বছরই ১২তম কুয়েত আন্তর্জাতিক দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীতে পুরস্কার লাভ করেন তিনি। এছাড়া ষষ্ঠ ও সপ্তম দ্বিবার্ষিক এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে তিনি পরপর দুবার সম্মানসূচক পুরস্কার লাভ করেন।
মাহমুদুল হকের শিল্পচর্চা সত্য ও সুন্দরের পিয়াসী। শিল্পীর অনুভূতিতে দিগন্তবিস্তৃত সপ্তবর্ণের বিস্তার, নিসর্গের মায়া এবং রং ও রেখার অনুভূতি বিরাজমান ছিল। প্রকৃত শিল্পীর যে-কাজ – সম্ভাবনার কথা বলা – তা থেকে তিনি বিচ্যুত
হননি। শিল্পীর দায়বদ্ধতার প্রশ্নেও তিনি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তা নয়,
বরং মেধাবী শিল্পী-শিক্ষার্থীদের নিয়েও তাঁর প্রচেষ্টা এবং
প্রত্যয় লক্ষ করা যায়।
শিল্পের একটি কাঠামো থাকে এবং তা ছবির নানা তলের মধ্যে একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং ক্রমে কেন্দ্রীভূত হয়। প্রতিটি ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র থাকে, যাকে ঘিরে সকল আয়োজন পরিচালিত হয়। ছবির সমস্ত কাঠামোকে সেই কেন্দ্রের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। ছবির কেন্দ্রটি নান্দনিক অনুভূতির, আবেগের, সৃজন কল্পনার বা বিচারবুদ্ধির। শিল্পী মাহমুদুল হকের ছবিতে এই কেন্দ্রমুখী আয়োজন বাস্তব অভিজ্ঞতার অনুভূতি যেভাবে ফুটিয়ে তোলে, তেমনি নান্দনিকতার নানা প্রকাশ ঘটায়। শিল্পে বাস্তব-অভিজ্ঞতার অনুভূতি আর নান্দনিকতার বিশুদ্ধ মিশ্রণে নিরেট এক শাস্ত্রীয় বিমূর্ত শিল্প পরিলক্ষিত হয়।
মাহমুদুল হক ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ঢাকায় চারুকলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ছিলেন। সে-সময়ে তিনি জাপান সরকারের সহায়তা নিয়ে বহু উন্নয়নমূলক কাজ করেন। ২০০৪ সালে যোগ দেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক হিসেবে। সেখানে দায়িত্ব পালন করেন ২০০৬ সাল পর্যন্ত। জাতীয় জাদুঘরের সার্ভিস রুলস থেকে শুরু করে মাস্টার রোলে চাকরি স্থায়ীকরণ ও আবাসনের ব্যবস্থাও তিনি করেন। পাশাপাশি তিনি ওঈঙগ-এরও পরিচালক ছিলেন। দেশে-বিদেশে বহু সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন।
২০০৫ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর থেকে ‘আর্ট ফর আর্টিস্ট’ শিরোনামে সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশি শিল্পীদের চিত্রকর্মসহ রিকশাশিল্পীদের চিত্রকর্ম, ধামরাইয়ের কাঁসার শিল্পীদের তৈরি ভাস্কর্য ও শিশুদের আঁকা চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করেন শিল্পী-শিক্ষক মাহমুদুল হক।
মাহমুদুল হক ব্যক্তিজীবনে যেমন ছিলেন পরিবর্তনশীল, তেমনি চিত্র-রচনাতেও পরিবর্তন, পরিমার্জনের প্রয়াসী ছিলেন। তাঁর চিত্রে কাঠামো, টেক্সচার, রং এবং স্পেস গুরুত্বের সঙ্গে গভীরতা বাড়ায়, পরিসর বাড়ায় এবং আলোছায়ার এক মুগ্ধকর বিভ্রম ঘটায়। বিমূর্ত শিল্পের যে-ধারা আমেরিকা-ইউরোপে পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত হয়েছিল, তার মধ্যে দুটি ধারা ছিল উল্লেখযোগ্য – অ্যাকশন পেইন্টিং ও কালার ফিল্ড পেইন্টিং। মাহমুদুল হক কালার ফিল্ড বা রঙের মাঠ ধারায় অবগাহন করেন।
তাঁর চিত্রে ধরা পড়েছে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষ। ভাবনা ও কল্পনাপ্রবণ শিল্পী মাহমুদুল হক একসময় ঋড়ষরধমব বা কলাপাতাকে উপজীব্য করে ছবি নির্মাণ করেছিলেন। প্রকৃতিতে একটি কলাপাতা যেভাবে জন্ম লাভ করে এবং সময় শেষে পাতার গায়ে চিড় ধরে ঝরে পড়ে, তা তিনি গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেন এবং তাকে নানা আঙ্গিকে রূপ দিয়েছেন তাঁর শিল্পচর্চায়।
মাহমুদুল হক সবসময় ছাত্রছাত্রীদের শিল্প শিক্ষায় উৎসাহ ও প্রেরণা দিতেন। স্কুলপর্যায়ে চারুকলা বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করতে তিনি সফল হন।
তিনি ২০০৬ সালে এস. এম সুলতান পদক, ফরেন সার্ভিস একাডেমি সম্মাননা, রাশিয়ান পররাষ্ট্র সম্মাননা পান। ২০১৬ সালে কিবরিয়া প্রিন্ট ফেয়ার আজীবন সম্মাননা এবং ‘ফরেন মিনিস্ট্রি ক্যমেনডেশন’ জাপান সরকার কর্তৃক সম্মাননা অর্জন করেন। বাংলাদেশ-জাপান বন্ধুত্বের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য এ-সম্মাননা প্রদান করা হয়। ২০১৭ সালে বার্জার পেইন্টসের পক্ষ থেকে সম্মানসূচক আজীবন সম্মাননা এবং পরবর্তীকালে ২০১৯ সালে জাপান-বাংলাদেশ দু-দেশে আধুনিক শিল্পকলা শিক্ষা-সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ‘দি অর্ডার অব দ্য রাইজিং সান’ – জাপানের সর্বোচ্চ তৃতীয় নাগরিক সম্মাননা – লাভ করেন।
নির্বস্তুক প্রকাশবাদী বিমূর্ত রীতির ও আধুনিক জীবন বোধের শিল্প-শিক্ষক ও শিল্পী মাহমুদুল হক নিভৃতে তাঁর শিল্পচর্চা ও পরিবার নিয়ে বসবাস করেছিলেন ঢাকার উত্তরায় নিজ বাসভবনে। শিল্পচর্চায় একনিষ্ঠ থেকে সুস্থ জীবনযাপনই করছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই অসুস্থ বোধ করলে তাঁকে ৬ই জানুয়ারি ২০২২ তারিখ রাত ২টায় জরুরি বিভাগ হয়ে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসক বলেন, নিউমোনিয়াসহ কার্ডিয়াক সমস্যা। পরবর্তীকালে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন। অনেক চেষ্টা করেও আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়নি এই গুণী শিল্পীকে। ১১ই জানুয়ারি ২০২২ তারিখে অনন্তের পথে পাড়ি জমান তিনি।
১২ই জানুয়ারি ২০২২ তারিখে নিজ গ্রাম শ্রীফলতলায় পৈতৃক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয় – তবে দৃষ্টিসীমার আড়াল হলেও শিল্পী মাহমুদুল হক তাঁর কর্ম, শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা, পরোপকারিতা এবং সমাজহিতৈষী নানা উদ্যোগের জন্য আজীবন মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.