গত কয়েক বছর ধরে যিনি আমাদের ঘরের মানুষ হয়ে গেছিলেন, সেই আনিসুজ্জামান সাহেবকে আমরা হারিয়েছি কিছুদিন আগেই। প্রিয়জনের বিচ্ছেদ-বেদনা আমাদের কাতর করে তুলেছে। বছর দশেক আগেই আমাদের আলাপ, কিন্তু এর মধ্যেই তিনি কবে ডক্টর আনিসুজ্জামান থেকে আনিসদা হয়ে গেছেন এবং গোটা পরিবারই আমাদের ঘরের লোক হয়ে গেছেন, তা সঠিক মনে পড়ে না। তবে জানি এপার বাংলা ওপার বাংলা জুড়ে বহু মানুষের তিনি আনিসদা বা শুধু স্যার।
কলকাতা এবং ঢাকা মিলিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে কয়েকবার এ-কয় বছরে। সম্ভবত আমার বন্ধু দেবজ্যোতি ছিল প্রথম যোগসূত্র। ঢাকায় আমার বন্ধু আহবাব এবং জাহাঙ্গিরভাইও দেখেছি তাঁর গুণমুগ্ধ। ঢাকার বাড়িতে, ঢাকা ক্লাব বা অন্যত্র এবং কলকাতায় বইমেলায়, ক্লাবে বা বাড়িতে দেখা হয়েছে বারবার। সহজভাবে মিশে গেছেন আমাদের সকলের সঙ্গে। অথচ জানি যে সাহিত্য, ধর্মচেতনা, ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানে তাঁর মতন পণ্ডিত মানুষ দুই বাংলা মিলিয়ে বোধহয় আর পাওয়া যাবে না। দুই দেশেরই সর্বোচ্চ সম্মান তিনি পেয়েছেন আর পেয়েছেন বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ স্বীকৃতি। শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক এবং বাংলা একাডেমির সভাপতি। এছাড়াও কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন এবং তাঁর অনুরোধেই এই বিশিষ্ট পত্রিকায় ২০১৪ সালে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম, ময়মনসিংহ জেলা ও উপেন্দ্রকিশোরের সম্পর্ক নিয়ে। আবার এতদিন পরে হাসনাত সাহেবের অনুরোধে লিখতে হচ্ছে এই ছোট্ট স্মরণিকা। ভাবতে অবাক লাগে যে, ১৯৪৭ সালে তিনি কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন বরিশালে (আমার শ্বশুরবাড়ির দেশ) আর আমার বাবা-মা ওই ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট বাঁকা ছেড়ে চলে এসেছিলেন কলকাতায়, অবশ্য আমার জন্ম তার পরের বছর।
আজ মনে পড়ছে তাঁর আনন্দ পুরস্কার লাভের দিনটি (২০১৭)। সেবার তিনি এই বিশেষ সম্মান পেয়েছিলেন বিপুলা পৃথিবী নামের আত্মজীবনীর জন্য। তিনি একজন বিরল মানুষ যিনি দুবার এই সম্মানলাভ করেছেন ১৯৯৪তে ও ২০১৭ সালে। প্রথমবার পেয়েছিলেন সাধারণ সাহিত্যকৃতির জন্য। অবশ্য তিনি ছাড়া এই সৌভাগ্য হয়েছে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, তসলিমা নাসরিন, কেতকী কুশারী ডাইসন, জয় গোস্বামী, সন্তোষকুমার ঘোষ, সুকুমার সেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্টজনের। রবীন্দ্রচর্চাকেন্দ্র (Tagore Research Institute) নামে একটি ছোট সংস্থার সঙ্গে যুক্ত আছি, যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অধ্যাপক সোমেন্দ্রনাথ বসু ৫৪ বছর আগে। ২০১৫ সালে এই সংস্থা তাঁকে রবীন্দ্র-গবেষণার জন্য রবীন্দ্রতত্বাচার্য নামক বিশেষ সম্মান জ্ঞাপন করে। আমার সুযোগ হয় আনিসদাকে এই সম্মানের জন্য প্রস্তাবটি পেশ করা, তাঁর অনুমতি সংগ্রহ করা এবং তাঁর মানপত্রটি লিখে দেবার। আনিসদা এত বুঝদার মানুষ যে আমাদের সংস্থার আর্থিক অবস্থা বুঝে সেইসঙ্গে অন্য কাজ এমনভাবে জুড়ে নিয়েছিলেন যে তাঁর যাতায়াত বা থাকা-খাওয়ার কোনো খরচই আমাদের বহন করতে হয়নি। সেই বিশেষ দিনে সুযোগ হয়েছিল ১৯৫২ সালের বাংলাভাষা আন্দোলন থেকে রবীন্দ্র-শতবর্ষ এবং মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চার দীর্ঘ ইতিহাসের কাহিনি শোনা। বাস্তবেই বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চার তিনি ছিলেন প্রাণপুরুষ। আবার এর দু-বছর বাদে আনন্দ পুরস্কার উপলক্ষে তাঁর অসাধারণ বক্তৃতা শুনেছি, যাতে এই কাহিনি জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে।
এই কয়েক বছরের মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছি সিদ্দিকা ভাবিকেও, যাঁকে আমরা বেবি বউদি বলেই ডাকি। এই অসাধারণ মানুষটিকে খুব কাছ থেকেই দেখেছি, দেখেছি তাঁকে একাধিক কঠিন অসুখ আর প্রিয়জন হারানোর বেদনা সহ্য করতে। বেশকয়েক বছর তিনি উগ্রবাদীদের কাছ থেকে মৃত্যুর হুমকিও পাচ্ছিলেন, তবু তাতে কর্ণপাতও করেননি। শেষপর্যন্ত করোনার থাবা কেড়ে নিয়ে গেল তাঁকে, দূর থেকে স্তম্ভিত হয়ে শোনা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
তবু আপসোস রয়ে গেল। তাঁর সঙ্গে একুশের বইমেলা দেখা হলো না। যাওয়া হলো না বরিশালে কামিনী রায়ের বাড়ি দেখতে। কত গল্পই না-শোনা রয়ে গেল। আমার অতিপ্রিয় ঢাকা শহরের স্বাদটাই কেমন যেন পানসে হয়ে গেল। দূর থেকেই তাঁকে আদাব জানাই। জানি না এই আদাবের স্পর্শ তিনি পাচ্ছেন কি না।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.