আনিসভাই স্মৃতিচারণ

কবে, কখন, কোথায় কী পরিস্থিতিতে তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, তা আমার মনে নেই। একদিকে এই স্মৃতিভ্রান্তি সম্ভবত ক্ষমার অযোগ্য, অন্যদিকে সেই ভরাট স্মৃতি বারংবার বলছে যে, আমাদের প্রতিটি সাক্ষাৎ ও সংলাপ ছিল মধুময় আন্তরিকতায় পূর্ণ।
আনিসভাইকে যখন বললাম যে, আমি প্রসিদ্ধ কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রচনা নিয়ে গবেষণা করব, তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি ঠিক লেখককেই বেছেছো। ওঁর ওপর গবেষণার আলো ফেলা একটি অতিপ্রয়োজনীয় ও জরুরি কাজ।’ লেখা শুরু করার পর, আমি প্রতিটি পরিচ্ছেদ তাঁকে পাঠাতাম ও তিনি তাঁর দিক থেকে মতামত লিপিবদ্ধ করে পরিচ্ছেদগুলি ফেরত পাঠাতেন। খোয়াবনামা বা elegy-বিষয়ক মূল্যায়নটি পাঠ করে তিনি আমায় ফোন করেন এবং বলেন, ‘শুভ, এই যে elegy-র কথা তুমি বলছো, এটি আসলে বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবাহ; ইলিয়াসের elegy-ও এই ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত, যদিও তাঁর elegy বা খোয়াব ছিল অন্য প্রকৃতির।’
ইলিয়াসের শোকগাথায় স্থান করে নিয়েছে মজনু শাহ ও ভবানী সন্ন্যাসীর বিপ্লবী অভ্যুত্থান, যেখানে অন্যদের শোকগাথায় স্থান করে নিয়েছে মুসলিম একাধিপত্য ও গৌরবের ভাঙন ও সমাপ্তি। বন্ধু-প্রকাশক মাহরুখ মহিউদ্দীন তাঁর প্রকাশনা ইউপিএল থেকে আমার গবেষণাগ্রন্থটি বের করেন। এবং পেছনের প্রচ্ছদে শঙ্খ ঘোষ ও আলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের প্রশংসাসহ আনিসভাইয়ের মন্তব্যটিও প্রকাশ করেন। দুটি সন্ধ্যায় বইটি পড়া শেষ করে তিনি তাঁর প্রশংসাসূচক মন্তব্যটি লিখে দেন।
এক কথায়, আমি তাঁর কাছে ঋণী। বাংলাদেশে, বাংলা একাডেমিতে, তিন বছর আগে যে বিরাট আন্তর্জাতিক সাহিত্য সমাবেশ ঘটেছিল, সেই অনুষ্ঠানে আনিসভাই ব্যক্তিগত উদ্যোগ নিয়ে আমাকে নিমন্ত্রণ করেন। তাঁকে যখন এই নিমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি ও জানতে চাই কী বিষয় নির্বাচন করব ভাষণদানের জন্য, তিনি এক মুহূর্ত দেরি না করে উত্তর দেন – ‘কেন ইলিয়াসের উপন্যাস ও তাঁর সাম্যবাদী চেতনা নিয়ে বলবে।’ ও, বলতে ভুলে গেছি, আনিসভাই আমাকে মহামূল্যবান লিরিক পত্রিকার ইলিয়াস সংখ্যাটি দেন। যাঁরাই ইলিয়াসের ওপর কাজ করেছেন তাঁরাই এই বিশেষ সংখ্যাটির গুরুত্ব অনুধাবন করেছেন। বলা বাহুল্য আমিও। অতিবিনয়ের দ্বারস্থ না হয়েও আমি নির্দ্বিধায় দাবি করতে পারি যে, আনিসভাইয়ের সাহায্য ও সহযোগিতা ব্যতিরেকে আমার ইলিয়াস-গবেষণা শেষ হতো না।
দু-বছর পর আমি যখন আনিসভাইকে জানাই যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে আমি ইউরোপীয় সাহিত্য বিষয়ে একাধিক লেকচার দেবো অতিথি-অধ্যাপক বা guest professor-এর ভূমিকায়, তিনি খুবই খুশি হয়েছিলেন। খবরটা শুনে তিনি আমায় যা বলেছিলেন, তা আমার চিত্তে মুদ্রিত হয়ে রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘শুভ, অন্য সমালোচকরা কী মন্তব্য করেছেন, কী মূল্যায়ন করেছেন – এসবের মধ্যে যেও না। চারটে অবিস্মরণীয় সৃজনমূলক রচনা নির্বাচন করো এবং তারপরে এই বইগুলির ওপর নিজস্ব আলোক ফেলো, Deconstruct these books thoroughly from your own individual angle।’ আমি ঠিক সেটাই করেছিলাম। যখন তাঁকে আমার নির্বাচন সম্পর্কে বললাম – বোদলেয়ারের কবিতা, বের্টোল্ ব্রেশটের নাটক আর গুন্টার গ্রাসের উপন্যাস – তিনি শুধু বলেছিলেন, ‘A remarkable selection, এবারে এগিয়ে যাও।’
এভাবেই তিনি বারংবার আমাকে উৎসাহ প্রদান করেছিলেন। শুধু আমি নই, আমার ‘দিদি’ ইতিহাসের অধ্যাপক মৈত্রেয়ী সেনগুপ্ত ঝাঁসিরাণি রেজিমেন্টের ওপর একটি বিরাট মর্মগ্রাহী নিবন্ধন লিখেছিলেন। কে এত বড় লেখা প্রকাশ করবে। সেই নিয়ে আমাদের চিন্তা ছিল। আমরা লেখাটা সটান পাঠিয়ে দিই আনিসভাইকে। তিনি পুরো নিবন্ধটি পড়ে বলেন, ‘অতীব মূল্যবান লেখা। কালি ও কলম এই লেখটি প্রকাশ করবে। কোনো সম্পাদনা না করেই অর্থাৎ সম্পূর্ণ নিবন্ধটি ছাপা হবে।’
ঠিক এই ছন্দে আনিসভাই শুধু আমাকে আর আমার দিদিকে নয়, বহু মানুষকে সাহায্য করেছেন। আমি পণ্ডিত আনিসভাই বা শিক্ষক আনিসভাই সম্পর্কে লেখার যোগ্যই নই। আমি শুধু তাঁর চরিত্র ও মানসিকতার এই বিশেষ সাহায্যপ্রমুখ দিকটি এবং হৃদয়ী অন্তরঙ্গতার দিকটি তুলে ধরতে চেয়েছি এই ক্ষুদ্র রচনায়। ভাবতে গিয়ে বেদনার্ত বোধ করছি যে, ঢাকায় গেলে আনিসভাইয়ের সঙ্গে আমার আর দেখাও হবে না, কথাও হবে না। আমার এবং বহু অন্য মানুষের স্মৃতিতেই তিনি অম্লান ও অটুট থাকবেন। তাঁর বিরাট হৃদয় অকুণ্ঠ সহযোগিতার হস্তপ্রসারণ আমাদের স্মৃতিতে, হৃদয়ে, চিত্তে স্থান করে নিয়েছে। আমাদের কৃতজ্ঞতানির্ভর উত্তরাধিকার তিনিই নির্ণয় করে গেছেন।