আবুল মনসুর আহমদ : অনালোকে আলোকিত জন

সৌম্য সালেক
‘Here sleeps Adu Mia who was promoted
from class VII to class VIII’
একদিকে শে­ষ এবং অন্যদিকে অনুত্তীর্ণ-অধপতিতের জন্য বেদনাবোধ যা আবুল মনসুর আহমদের রচনার অন্যতম শিল্পরূপ। কেউ কেউ থাকেন জীবনকে যাঁরা দেখেন সত্যের দুর্বিনীত আলোয়। সময়ের অন্ধকারকে দুহাতে তাড়িয়ে হয়ে ওঠেন তিমিরবিনাশী, আবুল মনসুর আহমদ আমাদের উপমহাদেশের ভূগোলে তেমনি এক ব্যতিক্রম নাম। খোলা তরবারি নিয়ে লড়ার মতোই তিনি লেখনীতে শান দিয়েছেন। রাজনীতি, সাহিত্য, সমাজ, ধর্ম ও মানুষকে তিনি দেখেছেন ভিন্ন আলোয়। সে-আলোটি এখন দুষ্প্রাপ্য; আলোকে এখন গিলতে বসেছে অন্ধকার। রাজনীতি ও ধর্মের নামে এখন মানুষকে বন্দি করা হচ্ছে হিংস্র অমানিশায় এবং ক্ষমতার ঘেরাটোপে। এই অসংযত, নষ্ট-আবহে মনসুর আহমদের আয়না, ফুড কনফারেন্স ও আসমানী পর্দা গল্পগ্রন্থগুলো হতে পারে শক্তিমান অস্ত্র যা ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে আজকের মিথ্যাচার, ধসে পড়া কপট নৈতিকতার দেয়াল এবং এতে প্রকটভাবে বেরিয়ে আসতে পারে আমাদের অন্তর্গত কুসংস্কার ও নগ্ন রাজনীতির রূপ। আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন আমাদের দেশ ও জাতির প্রতিষ্ঠাতা পিতৃপুরুষদের একজন, যাঁরা এই জাতির জন্য পাহাড় কেটে, গিরি-মরুকান্তার পাড়ি দিয়ে নির্মাণ করেছেন জাতিসত্তার বুনিয়াদ – মনসুর আহমদ তাঁদের অগ্রদূত। তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, সমাজচিন্তক, রাষ্ট্রনীতিবিদ ও আইনজীবী। আবুল মনসুর আহমদ বাংলা সাহিত্যের অন্যসব আবর্তন-বৃত্ত থেকে আলাদা, তাঁর কণ্ঠস্বর ভিন্ন এবং স্বতন্ত্র। ব্যঙ্গাত্মক রচনার ক্ষেত্রে ইংরেজি সাহিত্যে যেমন জোনাথন সুইফট, বাটলার, পোপ, অরওয়েল এবং বার্নাড শ’রা আছেন, তেমনি আমাদের সাহিত্যে আছেন আবুল মনসুর আহমদ, প্রমথ চৌধুরী, সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখ। তবে ইংরেজি সাহিত্যে জোনাথন সুইফটের সে-স্থান বাংলা সাহিত্যে আবুল মনসুর আহমদের স্থান তার চেয়ে বৃহৎ এবং ভিন্ন রকমের। সুইফটের প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে তাঁর স্বরভঙ্গির রয়েছে স্পষ্ট প্রভেদ; সুইফট-কল্পিত দৃশ্যপট নির্মাণ করে শাসনব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে আবুল মনসুর আহমদ বাস্তব ভিত্তির ওপর থেকে অত্যন্ত যৌক্তিক ও বস্ত্তনিষ্ঠতার সঙ্গে বিভিন্ন অসঙ্গতি সম্পর্কে সরস বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, যেখানে তাঁর তুলনা কেবল তিনিই। ইমরান মাহফুজ-সম্পাদিত ছোট কাগজ কালের ধ্বনি ‘অমর একুশে বইমেলা ২০১৫’ প্রকাশ করেছে দুর্লভ কথক আবুল মনসুর আহমদ শিরোনামের একটি মূল্যবান সংখ্যা। তিয়াত্তরটি প্রবন্ধ এবং দুটি পরিশিষ্টের মাধ্যমে সাজানো কাগজটিতে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ফুটে উঠেছে মনসুর আহমদের প্রজ্ঞা এবং চিন্তাধারার অভিজ্ঞান। যার মধ্যে – সাহিত্য মূল্যায়ন, ব্যঙ্গশিল্পের মূল্যায়ন, রাজনৈতিক বিশে­ষণ, সংবাদ ও সাংবাদিকতা, জীবনদর্শন, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা : ভাষা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা : ধর্ম-দর্শন, আইনজীবী, নাট্যাঙ্গনে, স্মৃতিকথা ও মূল্যায়ন : পরিবার, স্মৃতিচারণ বিষয়ক রচনা উলে­খযোগ্য। এ-সংখ্যাটির প্রচ্ছদ করার কথা ছিল সম্প্রতি গত হওয়া বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর, তবে প্রচ্ছদের পুরো কাজটি তিনি শেষ করে যেতে না পারলেও একটি স্কেচ তিনি করেছিলেন এবং এটি তাঁর শেষ কাজ ছিল, যা কাগজটির প্রথম পৃষ্ঠায় পত্রস্থ হয়েছে। চমৎকার অঙ্গসৌষ্ঠব এবং মাসুক হেলালের নান্দনিক প্রচ্ছদে কালের ধ্বনির এ-সংখ্যাটি অনন্য একটি প্রকাশনা। সংখ্যাটি উৎসর্গ করা হয়েছে সম্প্রতি হারানো আমাদের সাতজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বকে। তাঁরা হলেন – কবি মোহাম্মদ মাহফুজ উল­vহ, কবি ফজল শাহাবুদ্দীন, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, সাংবাদিক এ বি এম মূসা, অধ্যাপক জিল­yর রহমান সিদ্দিকী, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী এবং কবি তিতাশ চৌধুরী।
ভাষার সংশয় কিংবা জড়তা ছিল না মনসুর আহমদের বক্তব্যে। আমাদের বর্তমান রাজনীতি-চর্চা কিংবা রাজনীতিবিদদের জন্য রয়েছে তাঁর চিন্তার-চর্চার বা দৃষ্টিভঙ্গির অনুসরণযোগ্য অনুষঙ্গ। রাজনীতিতে সব সময় জনসাধারণের সঙ্গে ছিলেন। যতটা সম্ভব ছিল তাঁর অবস্থানের মধ্য থেকে। রাজনীতি কখনো আসেনি তাঁর কাছে একটি বিশেষ পেশা হিসেবে কিংবা অনেকের কাছে যেমন এসেছে, তাঁর কাছে তেমনি সুবিধাজনক ব্যবসা হিসেবে। তিনি মন্ত্রী হয়েছেন কিন্তু তাঁর পরিচয় মন্ত্রিত্ব দিয়ে নয়। জনতার শত্রু কে, কে-ই বা মিত্র সেটা চিনতে ভুল হয়নি তাঁর; রক্তলুলোপ পামের মুখোশ উন্মোচনে কখনো তিনি অলসতা দেখাননি। রাজনীতিকে যারা ব্যবসা মনে করেন, সেই রাজনীতিবিদদের লজ্জা দিয়ে তাঁর সম্পূর্ণ জীবন, অবশ্য যদি তাদের লজ্জা পাবার ক্ষমতা থাকে। সাহিত্যকে যারা রাজনীতি-নিরপেক্ষ বলে মনে করেন, তাদের সে-ধারণার প্রতি প্রবল প্রতিবাদী তাঁর রচনাবলি। আজকের এই দ্বিধাবিভক্ত রাজনৈতিক আবহে যেন আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেন তিনি। এমন অস্থির বিভক্ত সময়ে আবুল মনসুর আহমদের রাজনীতিচর্চা, চিন্তাধারা, জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেম যে কতটা প্রাসঙ্গিক তা সুধিজন মাত্রই বোধ করবেন। এমনই যথার্থ সময়ে কালের ধ্বনির আবুল মনসুর আহমদকে নিয়ে প্রায় ছয়শো পৃষ্ঠার আয়োজন একই সঙ্গে সময়োপযোগী এবং সাহসী পদক্ষেপ। সংখ্যাটিতে অল্পকিছু বানান প্রমাদ থাকা সত্ত্বেও সম্পাদক ইমরান মাহফুজের ধৈর্যনিষ্ঠ কর্মযজ্ঞ সময়ের প্রয়োজন মেটাতে চমৎকারভাবে সমর্থ।