আবুল হাসনাতের প্রতি শ্রদ্ধা

গুরু বলে কারে প্রণাম করবি আমার মন

তোর অতীত গুরু, পথিক গুরু, গুরু অগণন

 – সুধারাম বাউল

দীর্ঘ, সর্পিল সাহিত্যযাত্রা আমার। মেডিক্যালের ছাত্র পথ ভুলে চলে এসেছিলাম সাহিত্যের পাকচক্রে, সাহিত্যকে করে তুলেছি জীবনযাত্রার অনিবার্য অংশ। সেই  পথচলায় কতবার, কত জায়গায় পথ হারিয়েছি। কোনো কোনো বাঁকে নেপথ্যে শুনেছি কে যেন বলছে ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো?  তারপর  হাত বাড়িয়ে পথের নিশানা দেখিয়েছে। তেমনি একটি বাড়ানো হাত আবুল হাসনাতের। 

সেই আশির দশকে ছাত্রাবস্থায় চট্টগ্রামের লিটল ম্যাগাজিনের ক্ষুদ্র পরিসরের লেখক আমি। সংবাদের সাপ্তাহিক সাহিত্যপাতা তখন আমার অবশ্যপাঠ্য সাপ্তাহিক কাজ। এই প্রিয় পাতায় নিজের একটা লেখা ছাপানোর লোভ তখন মনে। একদিন পাঠিয়ে দিই ছোট একটা  লেখা। একটা বিখ্যাত মঞ্চনাটকের সমালোচনা সম্ভবত। লেখাটি ছাপিয়েছিলেন তিনি এবং এক পরিচিতের মাধ্যমে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পরিচিত হতে চেয়েছিলেন। দেখা করেছি বংশালের সংবাদ অফিসে। মৃদু, অনুচ্চস্বরে অনুরোধ করেছেন আমি যেন নিয়মিত সংবাদে লিখি। সেই উৎসাহে লিখতে থাকি নানা বিষয়ের লেখা। অনুবাদ, সাহিত্য-আলোচনা, নিবন্ধ। সেগুলো হাসনাতভাই যত্ন করে ছাপিয়েছেন সংবাদ সাময়িকীতে একের পর এক। তখনো আমার সাহিত্য-অভিমুখ ঠিক নির্দিষ্ট নয়। লেখার আনন্দে লিখে চলেছি বিচিত্র প্রসঙ্গে। আমার উদ্ভ্রান্ত, নাজুক সেই তারুণ্যে অক্ষর প্রেমের সলতেতে তিনি ঘি ঢেলেছেন অবিরাম। একসময় গল্প লিখতে শুরু করি। আমার প্রথম গল্প ছাপা হয় ভিন্ন একটি দৈনিকের সাহিত্যপাতায়। সেই গল্প পড়ে সৈয়দ শামসুল হক প্রশংসা করে লেখেন সংবাদের নিয়মিত তাঁর জনপ্রিয় কলাম ‘হৃৎকলমের টানে’তে। নবীন লেখকের জন্য সেটি ছিল অনুপ্রেরণার। সেই গল্প পড়ে হাসনাতভাই আমাকে চিঠি লিখলেন অভিনন্দন জানিয়ে, অনুরোধ করলেন সংবাদে গল্প পাঠাতে। আমি ততদিনে ডাক্তারি পাশ করে নানা মফস্বল শহরে চাকরিসূত্রে ঘুরছি। ইতোমধ্যে হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে চিঠির যোগাযোগ শুরু হয়েছে। চিঠি মারফত পাঠিয়ে দিই গল্প, ছাপা হয় সংবাদে। তাঁর সঙ্গে অনিয়মিত কিন্তু ধারাবাহিক সাক্ষাৎ ঘটে আমার। 

বংশালের সংবাদ অফিস থেকে, উত্তরার কালি ও কলম অফিস হয়ে সর্বশেষ ধানমণ্ডির অফিসে গিয়ে বসেছি তাঁর টেবিলটার সামনে। এত মৃদু, এমন সজ্জন, অদ্ভুত লাজুক মানুষ তিনি মনে হয় যেন অন্য কোনো গ্রহের, অন্য কোনো শতাব্দীর ধুলো লেগে আছে তাঁর গায়ে। তাঁর সান্নিধ্যে গেলে মনে হতো পর্দা সরিয়ে এমন একটা পৃথিবীতে ঢোকা গেল যেখানে কেবল সাহিত্যই একমাত্র সত্য। ‘জগৎ সংসার মিছে সব, মিছে এ জীবনের কলরব।’ দেশের সাহিত্যজগতের নানা ক্রান্তি নিয়ে কথা বলেছেন অবিরাম। কালি ও কলমে অনেক লেখা ছাপিয়েছেন আমার। ছাপিয়েছেন আমার বেশ কিছু  বইয়ের আলোচনা। ডাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন সেইসব সংখ্যা আমার নামে। আমি যখন উপন্যাস একজন কমলালেবু লিখছি তখন  দীর্ঘ আলাপ হয়েছে হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে।  তিনি তখন ভূমেন্দ্র গুহের সঙ্গে মিলে ‘বেঙ্গল’ থেকে জীবনানন্দের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি প্রকাশের কাজ করছেন। সঞ্জয় ভট্টাচার্য আর জীবনানন্দের সম্পর্ক বিষয়ে দুর্লভ লেখা সরবরাহ করেছেন আমাকে। ভূমেন্দ্র গুহ ছিলেন জীবনানন্দের ঘরের মানুষ। ভূমেন্দ্রের মুখে শোনা জীবনানন্দের জীবনের নানা নেপথ্য গল্প শুনি হাসনাতভাই মারফত। আমি কলকাতায় যাচ্ছি শুনে তিনি আমাকে হাতে গুঁজে দিলেন ভূমেন্দ্র গুহের টেলিফোন নাম্বার। যেদিন কলকাতায় পৌঁছালাম দৈবের মতো সেদিনই মারা গেলেন ভূমেন্দ্র গুহ। হাসনাতভাই ভূমেন্দ্র গুহকে নিয়ে লিখলেন চমৎকার এক লেখা, লিখলেন ভূমেন্দ্র জীবনানন্দকে দ্বিতীয় জীবন দিয়েছিলেন।

বেঙ্গলের প্রকাশনার দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বরাবর তাগাদা দিয়েছেন একটি পাণ্ডুলিপি দেবার। শেষে হাসনাতভাইয়ের তত্ত্বাবধানে বেঙ্গল থেকে ছাপা হয়েছে আমার ক্যাডেট জীবনের ছায়া অবলম্বনে উপন্যাস খাকি চত্বরের খোঁয়ারি। বেঙ্গল থেকে আমার গল্পসংগ্রহের ই-ভার্সনও প্রকাশ করেছেন তিনি। কালি ও কলমের কোনো বিশেষ সংখ্যার আগে বিদেশে বসে ফোন পেয়েছি বরাবর লেখার অনুরোধ নিয়ে, ঢাকা গিয়ে প্রতিবার দেখা না হলেও ফোনে কথা হয়েছে অন্তত। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে মনে পড়ছিল, বেঙ্গল-আয়োজিত উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠানে রাতভর গান শুনতে শুনতে হঠাৎ দেখি সামনের সারি থেকে পেছনে আমার পাশের চেয়ারটায় বসেছেন হাসনাতভাই। হালকা শীতের রাতে গায়ে চাদরটা ঠিক করতে করতে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছেন, ‘আপনার নামে বেঙ্গলের কিছু রয়্যালটির বিল আছে, একসময় এসে নিয়ে যাবেন।’ আমি আমার নির্বাচিত গল্প বইটা উৎসর্গ করেছিলাম হাসনাতভাইকে। নিজ হাতে তুলে দিয়ে এসেছিলাম তাঁকে। তাঁর মৃত্যুর শোকের ভেতর এইটুকু স্বস্তি রইল মনে। আমার তিন দশকের অধিক সময়ের সাহিত্যযাত্রায় তিনি নিরন্তর পাশে ছিলেন আমার। মনে ভাবি নিজেকে দ্রষ্টব্য করে তোলার নানা আড়ম্বরের এই পৃথিবীতে নিভৃতে সলতে জ্বালানো এই মানুষগুলো ডোডো পাখির মতো ক্রমশ বিলুপ্তই হবে বুঝিবা।