আবুল হাসনাত, কিছু স্মৃতি

আমি অশ্রুপ্লাবিত চোখে আজ আবুল হাসনাতের কথা লিখতে বসেছি। অথচ ব্যাপারটা হওয়ার কথা ছিল ঠিক উলটো। বয়সের কথা ভাবলে আমাকে নিয়েই তাঁর আজ লেখার কথা। সাহিত্যের বর্ণময় জগতে চিরজীবন স্বমহিমায় বেঁচে থেকে তাঁর হঠাৎ এভাবে তিরোহিত হওয়া আমরা এখনো মেনে নিতে পারিনি, পারছি না। মানা সম্ভবও নয়। ইদানীং করোনায় আমরা একের পর এক আমাদের প্রিয়জনদের হারাচ্ছি।

আমাদের চোখের পানি মুছতে না মুছতেই হাসনাতের এভাবে চলে যাওয়াটা মেনে নেওয়া খুব কষ্টের। করোনায় আক্রান্ত না হয়েও তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন – এটা মেনে নেওয়া যেন একেবারে সম্ভব নয়। তিনি আমার বয়ঃকনিষ্ঠ ছিলেন। তবু আমি তাঁকে মনে মনে অনেক বড় বলে মানতাম। সম্পাদক হিসেবে তাঁর মুন্শিয়ানাকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। আর শুধু আমি কেন, অনেকেই শ্রদ্ধা করতেন। জীবদ্দশায় একের পর এক তিনি বই সম্পাদনা করে গেছেন। সাহিত্যকে মনে-প্রাণে ভালো না বাসলে এভাবে কাজ করা সম্ভব ছিল না। বিগত আশির দশকে বিদেশ থেকে ফিরে এসে তাঁকে আমি একদিন বিশিষ্ট লেখক ও প্রকাশক, পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সংগঠক মফিদুল হকের অফিসে প্রথম দেখি। এবং তাঁর সঙ্গে পরিচিত হই। সেটি ছিল ১৯৮৪ সাল। সেদিন প্রায় এক ঘণ্টা ধরে তাঁর সঙ্গে শিল্পসাহিত্য নিয়ে কথা বলি। খুব সম্ভব তখন তিনি সংবাদের সাহিত্যপাতার সম্পাদক। আর আমি বিদেশ থেকে ফিরে নিজেকে সাহিত্যের জগতে পুনঃপ্রবিষ্ট করার চেষ্টায় রত। তখন মনে আছে প্রায়ই আমি বিভিন্ন সাহিত্য সম্পাদকের দফতরে গিয়ে হাজির হতাম। নিজের লেখা সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম। কারণ তখন আধুনিক প্রযুক্তির যুগ ছিল না। নিজের লেখা নিজেকেই টেনে নিয়ে বেড়াতে হতো। কাজটা খুব কঠিন ছিল সন্দেহ নেই। সাহিত্যের একাকী নির্জন পথে ছিল আমার বিচরণ। মনে আছে লেখা টেনে নিয়ে গিয়েছিলাম মফিদুল হকের কাছে। এবং সেখানেই পরিচিত হয়েছিলাম সম্পাদক আবুল হাসনাতের সঙ্গে। তরুণ এই মানুষটির কথা শুনে খুবই উপকৃত হয়েছিলাম মনে আছে। সেদিন বাসায় ফিরে এসে সৈয়দ শামসুল হক সাহেবের মুখে আবুল হাসনাতের প্রশংসা শুনি। তারপর কতবার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। কালি ও কলমে যেদিন থেকে তিনি যোগ দেন তারপর থেকে কতবার তাঁর সঙ্গে আমার কথা ও দেখা হয়েছে। তিনি কখনোই দরকারের বেশি এক মুহূর্ত কথা বলতেন না। আর সেজন্য আমরা লেখকেরা মনে মনে তাঁর ওপরে ক্ষ্যাপা ছিলাম। এখন বুঝি যে সময় ক্ষেপণ করার সময় তাঁর ছিল না। এক হাতে তাঁকে দশজনের কাজ করতে হতো। তাঁর সম্পাদিত কালি ও কলমেই আমার কবিতা ছাপা হয়। তিনি ছিলেন আমাদের শিল্পের পরিবারের মানুষ। সাহিত্যের পরিমণ্ডলে তিনি ছিলেন এক তারকার মতো। তবু নিজেকে নিয়ে তাঁর কোনো আত্মঅহংকার ছিল না, বরং কোথাও তাঁকে নিয়ে শোরগোল হওয়ার ভয়ে তিনি সে-জায়গাতেই যেতেন না। সময়জ্ঞান এবং শৃঙ্খলা ছিল তাঁর মজ্জাগত। একবার তিনি মুক্তিযুদ্ধের গল্প সংকলিত করবেন বলে আমাকে একটা গল্প দিতে বলেছিলেন। গাফিলতি করে আমি সে-গল্প দিতে পারিনি। পরে তাঁর সংকলিত বইটি দেখে আমার খুব আফসোস হয়েছিল। এরপর থেকে আমি আর কোনোদিন তিনি লেখা চাইলে দেরি করিনি! তাঁর আনুকূল্যেই বেঙ্গল থেকে আমার দু-খানা বই বেরিয়েছে। একটি সংকলনে তিনি আমার নারীবিষয়ক প্রবন্ধ ছেপেছেন। প্রতিবছর বইমেলার আগে একটি বিশেষ সংখ্যায় আমার লেখা তিনি চাইতেন। এতে করে আমি নিজেকে খুবই গৌরবান্বিত মনে করতাম। 

একবার (২০১৮) আবুল হাসনাত, দিলারা হাফিজ ও আমি আমেরিকার বিশ্বজিত সাহার আমন্ত্রণে বইমেলায় গিয়েছিলাম। সেখানে তিনি বইয়ের স্টল দিয়েছিলেন। এবং আমিও আর কোনো প্রকাশকের স্টলে না ঢুকে তাঁর কাছেই সারাটা সময় বসেছিলাম এবং পাঠকদের কাছে বেঙ্গল-প্রকাশিত বইয়ের ক্যানভাসিং করছিলাম! সেখানে আবুল হাসনাতের সঙ্গে আমরা কয়েকটা দিন একসঙ্গে কাটাবার সময় পেয়েছিলাম। জাহাজে একসঙ্গে ভ্রমণ করেছিলাম। সেই সফরে আবুল হাসনাতকে আমার আরো ভালো করে চেনার সুযোগ হয়েছিল। মুখচোরা আবুল হাসনাত সহজে মুখ খুলতেন না, কিন্তু একবার কথা বলতে শুরু করলে সুন্দরভাবে কথা গুছিয়ে বলতেন। তখন তাঁর জ্ঞানের পরিধি দেখে আমরা মনে মনে আশ্চর্য হয়ে যেতাম। জীবন সম্পর্কে তিনি ছিলেন সিরিয়াস। তবে তাঁর আবেগাপ্লুত মনটিকে তিনি সবসময় লুকিয়ে রাখতে পারতেন না। তাঁর যে আরেকটি পরিচয় ছিল, যেটি ছিল তাঁর নিজস্ব লেখক ও কবি সত্তা, সেই পরিচয়টিকে আবুল হাসনাত চিরকাল মানুষের কাছ থেকে গোপন রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। অনেক পরে আমি জানতে পারি যে তিনি কতবড় একজন সৃজনশীল লেখক। মাহমুদ আল জামান নামে তিনি লিখতেন। লিখতেন কবিতা ও শিশুতোষ রচনা। সেখানে তাঁর কবিপ্রতিভা স্বমহিমায় জাজ্বল্যমান হয়ে আছে। তাঁর শিশুতোষ রচনাগুলিও শিশুসাহিত্যের একটি বিস্ময়কর ভাণ্ডার। শুধু তাই নয়, চারুশিল্প সমালোচনার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান বিস্ময়করভাবে পরিশীলিত। তিনি শুধু চিত্রসমালোচনাই করেননি, শিল্পীদের জীবনী রচনাতেও ছিলেন অদ্বিতীয়। বস্তুত তাঁর জীবন যেন শিল্পের জগতেই ক্রমাগত পরিভ্রমণ করে বেড়াত। তিনি ছিলেন শিল্পের জগতে একজন অনিসন্ধিৎসু পরিব্রাজক। 

কিন্তু নিজের ব্যাপারে তিনি ছিলেন উদাসীন। কথাসাহিত্যিক ও কবি হিসেবে নিজেকে সাহিত্যজগতে অনায়াস স্থাপন করাটাকে তিনি যেন সজোরে প্রত্যাখ্যান করতেন। অথচ তাঁর ধমনীতে অবিরত বহে চলত ধ্রপদী লেখনীর কলকল্লোল। নিজেকে একেবারে যেন লুকিয়ে ফেলেই সারাটা জীবন করে গেছেন শিল্পসাহিত্যের চর্চা। 

সম্পাদনা সাহিত্যে তিনি ছিলেন একজন পথিকৃৎ। সংবাদ পত্রিকায় থাকাকালে সাহিত্যপাতা সম্পাদনার এক নতুন দিগন্ত তিনি খুলে ধরেছিলেন। সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী এবং বেঙ্গলের কালি ও কলমেও তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। সাহিত্য পত্রিকা বা পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী তাঁর হাতের মহিমায় যেন উজ্জল ঝকঝকে হয়ে, সুচারুশিল্পিত হয়ে পাঠকের হাতে উপস্থিত হতো। এক কথায় তাঁকে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। তবু পাঠক হিসেবে আমাদের একটা আক্ষেপ রয়ে গেল। আর সেটি হলো, নিজের ঈশ্বর-প্রদত্ত কবি প্রতিভাকে তিনি চিরদিন মানুষের চোখের আড়ালে রেখে যাওয়ার প্রয়াস পেলেন। কবিতায় এবং শিশুসাহিত্য রচনায় নিজের সৃজনী প্রতিভাকে মূল্যায়ন করার সুযোগ দিলেন না কাউকে। নিজের ব্যাপারে তিনি ছিলেন যেন নির্লোভ ও নির্বিকার। তিনি যে একজন কতবড় কবি ও কতবড় শিশুসাহিত্য রচয়িতা এই পরিচয়টি তিনি সারাজীবন পাঠকদের চোখের আড়ালে রেখে গেলেন। গুরুগম্ভীর সম্পাদনার আড়ালে তিনি তাঁর কবিসত্তাকে যেন সমাধিস্থ করে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত কবিপ্রতিভাকে তিনি একপ্রকার অস্বীকার করে যেন চলে গেলেন। জীবদ্দশায় তিনি বিশেষ কোনো পদক বা পদবিতে ভূষিত  হননি, সেসব পাওয়ার জন্য তাঁর কোনো আকাঙ্ক্ষাও কোনোদিন ছিল না, তবু কিন্তু তাতে কিছু আসে-যায় না, মানুষের সৃজনপ্রতিভার মূল্যায়ন তো কোনোদিন থেমে থাকবে না। নিরন্তর এই প্রয়াস সর্বদাই সাহিত্যের পরিমণ্ডলে এসে আঘাত করবে। আবুল হাসনাত ওরফে মাহমুদ আল জামান কবি ও সাহিত্যিক হিসেবেও গৌরবের সঙ্গে সাহিত্যজগতে মূল্যায়িত হবেন।

জানি তিনি যেখানে গেছেন সেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না, আমাদের হাজার প্রার্থনা এবং অশ্রুক্ষরণও তাঁকে আর ফেরাতে পারবে না, তিনি এভাবে চলে যাওয়ায় কালি ও কলম পত্রিকার সকলেই শোকগ্রস্ত। মাত্র কিছুদিন আগেই আমরা হারিয়েছি কালি ও কলমের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি উপমহাদেশখ্যাত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে। সেই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই হারালাম সম্পাদক আবুল হাসনাতকে। আমার হয়তো এটুকুই সান্ত্বনা যে, গতবছরের বইমেলায় আমার লেখা বৃষ্টির ভেতরে রবীন্দ্রনাথ বইটি তাঁর নামে উৎসর্গ করে মেলার মাঠে তাঁর হাতেই বইটি তুলে দিতে পেরেছিলাম। সেই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। এখন আমাদের সাহিত্যজগৎটিকে যেন শূন্য করে দিয়ে তিনি চলে গেলেন; তবু কেবল তিনিই আমাদের মনোজগতে আবুল হাসনাত হয়ে চিরঅম্লান হয়ে বেঁচে থাকবেন।