আমাদের সফিউদ্দীন স্যার

কাইয়ুম চৌধুরী
আমাদের পরম সৌভাগ্য আমাদের চিত্রবিদ্যাশিক্ষা যাঁদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল তাঁরা সবাই উপমহাদেশের খ্যাতনামা শিল্পী। ভারত বিভাগের পর ঢাকায় ১৯৪৮ সালে চারুকলা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। কলকাতা আর্ট স্কুল থেকে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে একদল শিল্পী, যাঁরা কলকাতা আর্ট স্কুলের শিক্ষকও ছিলেন কেউ কেউ, চলে আসেন ঢাকায়। জয়নুল আবেদিন স্বয়ং, সফিউদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, খাজা শফিক আহমেদ, শফিকুল আমীন, হাবিবুর রহমান, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ ঢাকার আর্ট স্কুলের শিক্ষকতার ভার গ্রহণ করেন। তাঁরাই পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের চিত্রকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ। একদঙ্গল নতুন প্রজন্মের শিল্পী তাঁদের হাত ধরেই তৈরি হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁদের ভূমিকাও যথেষ্ট শক্তিশালী। প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষকদের মধ্যে ইতোমধ্যে অনেকেই লোকান্তরিত হয়েছেন। ছিলেন শুধু সফিউদ্দীন আহমেদ।
শেষ পর্যন্ত আমাদের সফিউদ্দীন স্যারও চলে গেলেন। বাংলাদেশের ছাপচিত্রের পথিকৃৎ উপমহাদেশের স্বনামখ্যাত ছাপচিত্রী ৯০ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন। আমরা ২০১২ সালের ২৩ জুন তাঁর নববইতম জন্মদিন পালন করলাম। অবশ্যই তিনি দীর্ঘজীবন পেয়েছিলেন, তবু ভেতরে শূন্যতা অনুভব করি একজন প্রতিভাবান সৃষ্টিশীল শিল্পীর প্রয়াণে। যদিও জীবনের শেষ প্রান্তে সৃষ্টিশীল ছিলেন না শারীরিক অক্ষমতার কারণে – দুর্ঘটনায় প্রায় পঙ্গু, শয্যাশায়ী – যখনই দেখা করতে গেছি, সেই অবস্থার মধ্যেও কথা বলেছেন শিল্প সম্পর্কে, শিল্পী সম্পর্কে। শিল্পের নানা অলিগলিতে ঘুরেছেন আমাদের নিয়ে। ঋদ্ধ করেছেন আমাদের। পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে গেছি, শিল্প সম্পর্কে তার নানা অনুসন্ধিৎসা হাসিমুখে মিটিয়েছেন। সেসব মধুর স্মরণীয় মুহূর্তের স্মৃতি মনকে বিষণ্ণ করে তোলে।
সেই ১৯৪৯ সালের মে মাসে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গেছি। ভিক্টোরিয়া পার্কের সন্নিকটে ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের দুটি কক্ষে তখন আর্ট স্কুল। একটি কক্ষে আমরা নয়-দশজন ডংকিতে গোল হয়ে বসি। মাঝখানে একটি মাটির কলসি রাখা। পেনসিলে রেখার সাহায্যে কলসিটি অাঁকতে হবে। শিক্ষক আনোয়ারুল হক আমাকে ড্রয়িং বোর্ড ও কাগজ-পেনসিল দিয়ে বসিয়ে দিলেন। সময় এক ঘণ্টা। সবার অাঁকা শেষ হয়। আমার হয় না। পেছনে দাঁড়িয়ে একজন তাড়া দিলেন, ‘ও হে, যথেষ্ট হয়েছে, এবার ছেড়ে দাও।’ পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, দীর্ঘদেহী একজন সাদা ফুলপ্যান্ট ও ফুলহাতা শার্ট গায়ে খুব সুপুরুষ – হাত থেকে কাগজ টেনে নিলেন। পরে জেনেছি, তিনিই শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ।
দূর থেকে দেখি। মৃদুভাষী। কিন্তু আমাদের ওপরের ক্লাসের ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধুর মতো। ক্লাস নিচ্ছেন, গল্প করছেন। কাঠখোদাইয়ের ক্লাসে হামিদুর রহমান হাতুড়ি-বাটাল নিয়ে ঠকঠক শব্দ তুলে কাঠ কাটছেন। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে আমরা বসে ঘটি, বাটি অাঁকছি। আমরা ঘনিষ্ঠ হলাম সোজাসাপটা তাঁর ক্লাসে। কাঠখোদাইয়ের ক্লাস। বিষয়বস্ত্ত স্কেচ করে নিয়ে আসার পর সেটা শুধু সাদা-কালোতে আলোছায়া দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে হতো। তারপর একখন্ড কাঠের ওপর সেটা ট্রেস করতে হতো। কাঠটা আগেই ব্যাঁদা দিয়ে মসৃণ করে শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে আরও একটু মোলায়েম করে ছবির ট্রেসিং ও কালি লাগানো। তারপর নরুন দিয়ে কাটা। স্যার সাহায্য করতেন। অসাধারণ তাঁর সাহায্যের ধরন। আমার কাঠে হাত দেওয়ার আগে সিঙ্কের সামনে গিয়ে শার্টের হাতা গুটিয়ে হাত ধুয়ে নিলেন। হাত ঝাঁকুনি দিয়ে আমার টুলে বসে তুলি হাতে নিয়ে কাঠে চায়নিজ ইংক ছোঁয়ালেন। একদম একজন সার্জনের অপারেশন টেবিলে যাওয়ার মতো। ছাপচিত্রের প্রতি আমার ভীতি জন্মাল প্রথম দিনেই। কাঠ তৈরি করে নরুন দিয়ে বসে কাটতে গেছি, নরুন ফসকে বাঁ হাতে কাঠ চেপে ধরা বুড়ো আঙুলের মাঝ বরাবর ঢুকে গেল। চিৎকার করে উঠে দাঁড়ালাম। রক্তারক্তি কান্ড। আলমারি খুলে সফিউদ্দীন স্যার দ্রুত টিনচার আয়োডিন বের করে আঙুলে লাগিয়ে দিয়ে তুলো দিয়ে চেপে দিয়ে বললেন, ‘চেপে ধরো।’ আমার কাঠখোদাইয়ের এখানেই ইতি।
স্যার খুব ফিটফাট থাকতেন, যাকে বলে ওয়েল টেইলর্ড পারসন। মাখম জিনের সাদা প্যান্ট, সাদা টুইলের শার্ট, পায়ে অক্সফোর্ড জুতা, পরিপাটি চুল অাঁচড়ানো। ঝকঝকে চেহারা। এরকম একটি ক্লাসে স্যার আমাদের সহপাঠী আখতারুজ্জামানের কাঠে হাত দিয়েছেন। হঠাৎ কী করে যেন চায়নিজ ইংকের এক ফোঁটা সাদা মাখম জিনের প্যান্টে। ব্যস, আর যায় কোথায়? হইহই কান্ড। সফিউদ্দীন স্যার টুল ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন। এখন, এখন কী হবে? কাতর কণ্ঠে স্যার বলে উঠলেন, ‘কীভাবে এ কালো ফোঁটার দাগ ওঠাব।’ আমরা তো ভয়ে অস্থির। আখতার বলে উঠল, ‘স্যার, ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ছাগলের দুধ দিয়ে ধুয়ে দিলে উঠে যাবে।’ কোথায় ছাগল, কোথায় দুধ! সে এক এলাহি কান্ড।
কাঠখোদাইয়ের ক্লাস করতে গিয়ে পরিচিত হই স্যারের কাজের সঙ্গে। মেলার পথে, তালবীথি, সাঁওতাল রমণী। ছবিতে আলোছায়ার খেলা, কালোর বিপরীতে সাদার ভারসাম্য রক্ষা এবং সর্বোপরি কাঠ কাটায় মুন্শিয়ানা। আমরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতাম। তেমনি তাঁর তেলরঙের কাজ। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বলতেন, ‘তেলরঙের কাজ শিখতে হলে সফিউদ্দীন স্যারের কাজ দেখো। কী সুন্দর ট্রিটমেন্ট তেলরঙের।’ তাঁর ময়ূরাক্ষী, শালবন, সাঁওতাল রমণী মুগ্ধ হয়ে দেখার মতো।
সাঁওতাল পরগণার দুমকা ছিল সফি স্যারের, না শুধু সফি স্যার কেন, কলকাতার প্রায় সবারই প্রিয় নিসর্গ। দুমকাতে জয়নুল আবেদিন, আনোয়ারুল হক সবাই গেছেন, নিসর্গের ছবি এঁকেছেন। পাহাড়ের কোল থেকে নেমে আসা অাঁকাবাঁকা ময়ূরাক্ষী নদী, শুকনো মৌসুমে তিরতির করে বয়ে যাওয়া, সাঁওতালরা হেঁটে পার হচ্ছে। কী অপূর্ব দৃশ্য। জলরঙে, তেলরঙে, ছাপচিত্রে ময়ূরাক্ষী অমর হয়ে আছে। কলকাতা আর্ট স্কুলে সফি স্যারের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন আবদুল মঈন। অকালপ্রয়াত এ-শিল্পীর কাজে মুগ্ধ ছিলেন সফি স্যার। বসন্ত গাঙ্গুলীর জলরং, রমেন চক্রবর্তীর কাঠখোদাই, মুকুল দের সাহেবিয়ানা সফি স্যারকে মুগ্ধ করে রাখত।
সদরঘাটে নোঙর করা একটি লঞ্চের ছবি – তেলরঙের করা – আমার এখনো চোখে ভাসে। প্রতিটি কাজেই পরিশ্রমের ছাপ সুস্পষ্ট। আমাদের পেইন্টিং ক্লাস স্যার মাঝেমধ্যে নিতেন। নিজে হাতে ধরে দেখিয়ে দিতেন তেলরঙের তুলি চালনা। রঙের মিশ্রণ। কাজ দেখানোর পর হাত মুছতে মুছতে বলতেন, তেল খাও, তেল খাও, তাহলেই তেলরঙের ছবি হবে।
খুব পরিহাসপ্রিয় ছিলেন সফিউদ্দীন স্যার। ক্লাসে পৌঁছাতে প্রায়ই দেরি হতো আমার। দোহাই দিতাম নবাবপুর রেলগেটের। ট্রেন আসার জন্য রেলগেট বন্ধ, তাই লেট। সন্তর্পণে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ক্লাসে ঢুকতে যাচ্ছি, দরজার পাশে দাঁড়ানো সফি স্যার শুধালেন, ‘কি হে, তুমি ঢুকছ না বেরোচ্ছ?’ কম্মকাবার। তোতলাতে তোতলাতে জবাব দিলাম, ‘স্যার, রেলগেট।’ ‘বুঝেছি বুঝেছি, যাও যাও, ক্লাসে যাও।’ আরেকটা উদাহরণ দিই। মিজানুর রহমান আমার সতীর্থ ছিল। এই মিজানুর রহমান পরে ডাকসাইটে পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিল। কাগজের নাম ছিল তাঁর নামেই মিজানুর রহমানের পত্রিকা। পারস্পেকটিভ ক্লাস চলছিল আমাদের। ক্লাস নিচ্ছিলেন সফিউদ্দীন স্যার। পারস্পেকটিভ ড্রয়িং করে ওয়াশে সেটা শেষ করতে হবে। ড্রয়িং বোর্ডে হ্যান্ডমেড পেপার মাউন্ট করে নিয়ে ড্রয়িং করে তাতে ওয়াশ দেবো সিপিয়া রঙে। বিষয় ছিল, কাঠের পিরামিড ও কাঠের গোল বল। সুন্দর একটা কম্পোজিশনে সাজানো। মিজান কাগজ মাউন্ট না করেই ওয়াশ চাপিয়েছে। ভেজা রং পেয়েই কাগজে ঢেউ খেলে গেল। সিপিয়ার বদলে নীল। স্যার দেখেই বললেন, ‘বাহ্, এবার পিরামিডের পেছনে দুটো খেজুরগাছ লাগিয়ে দাও, একেবারে আরব দেশে।’ হাসির হুল্লোড় বয়ে গেল ক্লাসে। স্যার প্রশ্ন করলেন মিজানকে, ‘সিপিয়া রঙে অাঁকার কথা, তুমি নীল রং লাগালে কেন?’ ‘কোথায় নীল? সিপিয়াই তো লাগিয়েছি।’ মিজানের জবাব। সেই দিনই মিজান বুঝতে পারল, সে রং-কানা। আর্ট স্কুলে পড়ার সেখানেই ইতি।
সফি স্যারের প্রিয় রং ছিল কালো। নানা গ্রেডের কালো তিনি তাঁর ছবিতে ব্যবহার করেছেন। পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরিয়ার জিওফ্রে গ্লেস্টার সফি স্যারের কাজ দেখে খুব মুগ্ধ। শুধু কালো রঙের ব্যবহার দেখেই তিনি ছবির উৎকর্ষ পরিমাপ করতেন। কালোর এমন ব্যবহার তিনি অন্য কোনো শিল্পীর কাজে দেখেননি।
সফি স্যার লন্ডনে গেলেন উচ্চশিক্ষার্থে। লন্ডনে থাকাকালীন তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন বিভিন্ন শিল্পীর কাজ। তখন শিল্পে পাঠ নিয়েছেন গভীর মনোনিবেশে। একটা নাটকীয় পরিবর্তন তাঁর ছবিতে এসেছে। বিষয়বস্ত্তর উপস্থাপনে পূর্ববর্তী কাজের ফর্ম স্পেসের সংক্ষিপ্তকরণের মাধ্যমে আধুনিকায়ন তাঁর ছবিতে নতুন মাত্রা দিয়েছে। সেই বিষয়ের ছবি এচিং, অ্যাকুয়াটিন্ট, ডিপএচ ও সফট গ্রাউন্ডের বিভিন্ন মাত্রার প্রয়োগে অনন্যসাধারণ সৃষ্টি আমাদের শিল্পে একটি নতুন যোজনা। তাঁর অ্যাংরি ফিশ, ব্রিজ অ্যাক্রস, ফ্লাড রিসিডিং, ফিশিং টাইম, ফিশিং নেট, ব্লু ওয়াটার আমাদের ছাপচিত্রে নতুন ব্যঞ্জনা এনে দিয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, তিনি তাঁর ছাপচিত্রের এই টেকনিক, নতুন উপস্থাপনা তৈলচিত্র এবং ড্রয়িংয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। তাঁর তৈলচিত্রের সামনে দাঁড়ালে চিত্রের প্রতিটি অংশে পরিশ্রমের ছাপ লক্ষ করা যায়। প্রকৃতির সংগীত-১, রিদম অব লাইন-২, অন্ধ মেয়ে ও মৃত পাখি, নীলের নিনাদ-২ আমাদের বিস্ময়াভিভূত করে। সমকালীন ঘটনাবলিও তাঁর ছবিতে উপেক্ষিত থাকেনি। একুশে স্মরণে এনগ্রেভিং, একাত্তরের স্মৃতি এনগ্রেভিং, একাত্তরের স্মরণে এনগ্রেভিং উল্লেখযোগ্য। একাত্তরের স্মরণে এই এনগ্রেভিংয়ে আত্মপ্রতিকৃতির আভাস তাঁর সংবেদনশীল মনের সুস্পষ্ট ছাপ। স্বামীবাগের গৃহে অবস্থানকালে প্রত্যক্ষ করেছেন ঢাকার ভয়াবহ বন্যা। দিনের পর দিন কাটিয়েছেন বন্যায় পরিবেষ্টিত হয়ে। অঙ্কিত ছবিও নষ্ট হয়েছে সেই বন্যায়। সেই দুঃসহ স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে তাঁর অনেক ছবিতে, ড্রয়িংয়ে।
ব্রিটিশ ছাপচিত্রী উইলিয়াম হেটারের গুণমুগ্ধ ছিলেন স্যার। কিছু ছবিতে তাঁর ছাপ অনুভূত হয়। এনগ্রেভিং গুনটানা ছবিতে সে ছাপ স্পষ্ট।
একটি কারণে আমার সঙ্গে স্যারের ঘনিষ্ঠতা একটু বেশি হয়েছিল, তাঁর সংগীতপ্রীতির জন্যে। সংগীত শ্রবণেও তাঁর একনিষ্ঠা আমায় মুগ্ধ করেছিল। কোনো বিশেষ সংগীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল না। ভালো গান, তা সে বাংলা আধুনিক, রবীন্দ্রসংগীত, হিনি – সবই শুনতেন। ধ্রুপদী সংগীতেও তাঁর আকর্ষণ উল্লেখ করার মতো। আবদুল করিম খাঁ, ফৈয়াজ খাঁ, বড়ে গোলাম আলী, ওস্তাদ আলী আকবর খান, রবিশংকর – সবই শুনতে ভালোবাসতেন। ইস্ট মিট ওয়েস্ট এই শিরোনামে রবিশংকর ও ফরাসি আন্দ্রে প্রেভিনের যুগলবন্দি শুনে উচ্ছ্বিসিত স্যার আমাকে টেলিফোনে শোনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ভালোবাসতেন তাঁদের ওপর কোনো বইপত্র পেলে। আমার একটি রেকর্ড প্লেয়ার ছিল। গ্যারার্ড। মাঝেমধ্যেই বিকল হতো। ঠিক করানোর জন্য যেতাম সেক্রেটারিয়েটের সেকেন্ড গেটের সামনে, বেতারণী নামের একটি দোকানে। পুরান ঢাকার একজন মেকানিক। তাঁর বাড়ি ছিল নয়াবাজারে সিরাজউদ্দৌলা পার্কের কোনায়। নামটা ভুলে গেছি। সফি স্যারও তাঁকে চিনতেন। যন্ত্র সারাতে তিনিও যেতেন। যাওয়ার আগে আমাকে টেলিফোন করতেন। সঙ্গে নিতেন আমাকে। একসঙ্গে দুজন যেতাম রিকশা করে। গানের যন্ত্রপাতি ও রেকর্ড বিক্রির দোকান ছিল সেই সেকেন্ড গেটের সামনে, বেতারণীর পাশে। কে রহমান অ্যান্ড কোম্পানি। হিজ মাস্টার্স ভয়েসের এজেন্ট। তখন মাত্র লংপ্লে রেকর্ড বেরিয়েছে। সুদৃশ্য রেকর্ড স্লিভসে ডিসপ্লে কর্নারে সাজানো রেকর্ড দেখার জন্য দাঁড়াতাম। ছোটবেলা থেকেই গান শুনি। হিজ মাস্টার্সের স্যুটকেস-সদৃশ কালো স্প্রিংয়ের গ্রামোফোন আমাদের। ৭৮ আরপিএম রেকর্ড। লংপ্লে প্রথম দেখছি। দোকানের ম্যানেজারের সঙ্গে আলাপ হলো। গ্যারার্ড সেটটি কিনলাম। কেনা শুরু করলাম এলপি। সফি স্যারকেও বললাম। তাঁরও প্রবল উৎসাহ। রেকর্ডের নতুন চালান এলেই ম্যানেজার টেলিফোন করতেন, ‘রেকর্ড এসেছে। ডিসপ্লেতে দেওয়ার আগেই চাচ্ছিলাম আপনি দেখে নিন। বাছাই করুন।’ স্যারকে নিয়ে যেতাম। রেকর্ড বাছাই করে নিতাম। এই করে করে একটা ভালো সংগ্রহ আমার হয়েছে। স্যারও বেশ কিছু রেকর্ড কিনেছেন। কে এল সাইগলের গানের মুগ্ধ স্রোতা ছিলেন সফিউদ্দীন আহমেদ। সেসময়ে তখনো লংপ্লে রেকর্ড বেরোয়নি। রেডিও সিলোনের দিনের অনুষ্ঠান শুরুই হতো সকালবেলায় সাইগলের গান দিয়ে। আমরা ছিলাম মুগ্ধ শ্রোতা। তাঁর কণ্ঠে ‘যব দিল হি টুট গয়া, শুন হে কিষন কালা’ অথবা ‘অ্যায় দিল বেকারার হ্যায়’ শ্রবণে সফি স্যার উচ্ছ্বসিত ছিলেন। সাইগলের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত ‘তোমার বীণায় গান ছিল’ অথবা ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’ বারবার শোনার মতো গান বলে উল্লেখ করতেন। তেমনি কানন দেবীর ‘যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে’, ‘শ্যামলের প্রেম’ ভুলতে পারতেন না। ষাটের দশক। রবীন্দ্রনাথের গান, তাঁর গীত-নাট্য, হেমন্ত, কণিকা, সুচিত্রার লংপ্লে। কী সুদৃশ্য রেকর্ড স্লিভস। শিল্পী পরিতোষ সেনের অাঁকা। কী সব দুর্লভ সংগ্রহ! স্যারও বেশ উত্তেজিত থাকতেন।
স্যারের সঙ্গে কখনো কোনো সিনেমা দেখিনি। কিন্তু সিনেমা নিয়ে আলোচনা হতো। তাঁর চোখের সামনে তৈরি জ্যোতির্ময় রায়ের উদয়ের পথে ছবিটির কথা বলতেন। জ্যোতির্ময় রায়ের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। নায়িকা বিনতা রায়ের কণ্ঠে ‘ঐ মালতিলতা দোলে’ কিংবা ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ গানটি অন্য কারো কণ্ঠে শুনতে তাঁর আপত্তি ছিল। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী সম্পর্কে বলতেন, ‘ওটা তো ছবি নয়, কবিতা।’ ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের জীবনীভিত্তিক ছবি ভিনসেন্ট মিনেলির তৈরি লাস্ট ফর লাইফ বেশ কয়েকবার দেখেছেন।
স্যারকে নিয়ে আরও অনেক স্মৃতি, আরও অনেক গল্প আছে। স্বল্পপরিসরে সবকিছু বলা সম্ভব নয়। একটাই আফসোস, শেষের কটি দিন তিনি ছবি অাঁকতে পারলেন না। দুর্ঘটনায় চলৎশক্তি রহিত হওয়ায় তিনি একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন। মানসিক সবকিছু সচল, অথচ হাত-পা অচল। হাত কাঁপে, তুলি-পেনসিল ধরতে পারেন না। ছবি অাঁকার প্রবল আকুতি। একজন শিল্পীর পক্ষে এ যে কী মানসিক যন্ত্রণা, তা বলে বোঝানো যাবে না। আজীবন ছবি এঁকেছেন, অাঁকা শেখার আগ্রহে সাতসমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন। অসংখ্য পুরস্কার, অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন, অর্জন করেছেন সুখ্যাতি। তারপরও প্রশ্ন করেন শিশুর মতো, ‘আমি কি কিছু করতে পেরেছি? আমার ছবি কি ছবি হয়েছে?’ বিস্ময় মানি।
তাঁর সৃষ্টি তিনি কখনো হাতছাড়া করতে চাননি। ছবি বিক্রির তাগাদা কখনো অনুভব করেননি। অধিকাংশ ছবি তাঁর সংগ্রহে। একটা ধারাবাহিকতা তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা দেখতে পাব, যদি তাঁর সৃষ্টির একটি সংগ্রহশালা তৈরি করা যায়। আগামী প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য আমাদের প্রয়োজন আছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদের সংগ্রহশালার। সেই লক্ষ্যে আমাদের এখন থেকেই কাজ করে যেতে হবে।
আমরা তাঁর ছবি দেখব। বারবার দেখব নিজেকে সমৃদ্ধ করার মানসে। তাঁর ছবিই তাঁকে আমাদের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁর ছবির মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করবে। তাঁর মৃত্যু নেই। 