আমার অভিবাসী বাঙালিয়ানায় সুরের অনুষঙ্গ

প্রায় কুড়ি বছর আগে যখন চিরচেনা ঢাকা শহরের নিজস্ব গণ্ডি ছেড়ে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে অজানা-অচেনা মেলবোর্ন শহরে এসেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষালাভের স্বপ্ন নিয়ে, তখন কি জানতাম একদিন এই শহর আমার নিজের শহর হবে, এই দেশ আমার বাসভূম হবে? আত্মীয়-বন্ধু তো দুরস্ত, একটি মানুষকেও চিনতাম না এই শহরে। এতো বছর পর যখন ফিরে তাকাই, তখন ভাবি অচেনা, নির্বান্ধব নতুন শহরে সত্যিই কি আমি একা ছিলাম, ছিলাম নিঃসঙ্গ? মনের গভীর থেকে উত্তর আসে ‘না’।

‘বড়ো বিস্ময় লাগে, হেরি তোমারে।’ অপরিচিত, অজানা শহরে এসে নতুন করে একাকী এই আমি বিস্ময়ভরে আবিষ্কার করলাম আমার আশৈশবের ‘চিরবন্ধু, চির নির্ভর, চির শান্তি’ গান – গানের সুর – সুরের বোধ আমার অন্তঃপুরে কত বিশাল জায়গা জুড়ে আছে। নিজের জীবনের নতুন এ-অধ্যায়ে এসে নতুন করে গভীরভাবে উপলব্ধি করলাম আমার অস্তিত্বের সঙ্গে রাগসংগীতের সুরের অনুষঙ্গ অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে আছে। আমার এই ‘চিরসখা’কে যেমন নতুনভাবে চিনতে চেষ্টা করলাম জীবনের এই সন্ধিক্ষণে, ঠিক তেমনি তাকে ঘিরে আমার নানান বোধ, নানান উপলব্ধি, নতুন দেশে নতুন পরিবেশে নিজেকে নতুন করে চেনার, জানার সুযোগ করে দিলো। আর এতো বছর পর যখন ঘুরে দেখি, তখন গভীরভাবে বুঝতে পারি এই দেশে আমার বসবাস যে প্রবাস থেকে অভিবাস হয়ে উঠেছে; আত্তীকরণ থেকে সংশ্লেষণ হয়ে অভিযোজনের যে দীর্ঘ পথ এই আমি অতিক্রম করেছি, তার পেছনে  আমার এই ‘চিরবন্ধু’ এক অনন্য ভূমিকা রেখেছে। আজ মর্মে মর্মে বুঝি যে আসলেই আমার জীবনে

যে গান আজিও নানা রাগরাগিণীতে

শুনাও তাহারে আগমনীসঙ্গীতে

যে জাগায় চোখে নূতন-দেখার দেখা।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বহু বছর আগে লিখেছিলেন ‘বাংলার এবং বাঙালি জাতির সমস্ত জীবনটা ভালো করিয়া দেখিতে হইবে, তবেই তুমি বাঙালি হইবে।’ বাঙালি হয়ে উঠবার জন্য ‘বাংলার এবং বাঙালি জাতির সমস্ত জীবনটা’র কতটুকু দেখেছিলাম জানি না; কিন্তু এ জানি, নিজেদের বাঙালি আত্মপরিচয়ে দারুণভাবে গর্বিত, প্রতিদিনকার আটপৌরে জীবনযাপনের অভ্যাসকে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, গানের চর্চা দিয়ে সাজিয়ে উদ্যাপন করে তোলা বাবা-মায়ের ঘরে জন্মেছিলাম। গ্রামের শেকড়হীন পুরোদস্তুর শহুরে আমাদের পরিবারে বাংলার গ্রাম, জনপদ, জনপদের মানুষসহ সমগ্র  ‘বাংলার এবং বাঙালি জাতির সমস্ত জীবনটা’কে জানার পথ ছিল বাংলা সাহিত্য, বাংলা গান।  

আহির ভৈরব রাগে বাঁধা ‘অরুণকান্তি কে গো যোগী ভিখারি’ শুধু ‘আহির’ শব্দের অর্থ যে ‘রাখাল’ তাই মনে সারা জীবনের জন্য গেঁথে দেয়নি, চিনিয়েছিল সুরের সঙ্গে বাণীর গভীর সম্পৃক্ততা। এঁকে দিয়েছিল শিশুমনে ভোরবেলাকার এক অপূর্ব দৃশ্য, যেখানে কোনো এক সবুজ-শ্যামল গ্রামে ঊষালগ্নে এক রাখাল বালক তার পোষ্যদের নিয়ে যাচ্ছে মাঠের দিকে। অথবা সেই সে কোন ছোটবেলায় যখন বৃন্দাবনী সারং রাগে বাঁধা রবিঠাকুরের ‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা’ শুনেছিলাম তখন তৎক্ষণাৎ ‘বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন’-এর কী দারুণ এক রূপকল্প সেই শিশুমনেই  আঁকা হয়ে গিয়েছিল। তারপর জানলাম, ফার্সি ভাষায় ‘সারং’ শব্দের অর্থ মেঘ হলেও সারং ঘরের রাগগুলোর ঋতু গ্রীষ্ম। কিন্তু গ্রীষ্মশেষের সেই গ্রীষ্মকালে খানিক মেঘের আভাস আছে, ধীরে ধীরে তার সঞ্চার আছে অল্পবিস্তর। ক্রমশ যখন জানা হলো, বৃন্দাবনের প্রখর দাবদাহে মেঘের তৃষার মতোই বৃন্দাবন শব্দের মাঝে লুকিয়ে আছে শ্রীকৃষ্ণের অনুষঙ্গ পাওয়ার আকাক্সক্ষা, তখন বৃন্দাবনী সারং রাগ হয়ে উঠলো আমার কাছে গনগনে তপ্ত দিনে মেঘের দেখা পাওয়ার পরম আকুতি প্রকাশের সুর। আর তাতে বাঁধা গান ‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা’ কিংবা ‘তৃষিত আকাশ কাঁপেরে’ তৈরি করে দিলো গ্রীষ্মদিনের রূপকল্প, যা আমার একান্ত নিজস্ব। আবার সাহানার মতো রাগে যখন ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’ কিংবা ‘নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা’ শুনেছিলাম শৈশবের দিনগুলোতে, রাগের মাহাত্ম্য তখন বুঝিনি ঠিক কিন্তু এ-রাগের গভীরতা, মর্মস্পর্শী সুরের সঙ্গে রাতের রূপকল্প একাকার হয়ে গিয়েছিল আমার ছোট্ট হৃদয়ে। তার কয়েক বছর পরে শিখতে গিয়ে জানলাম সাহানা রাতের রাগ, যে-রাগে আছে সানুনয় আত্মসমর্পণ আর ঐকান্তিক কামনা। চাঁদের হাসির বাঁধভাঙা রাতে রজনীগন্ধাকে গন্ধসুধা ঢালতে বলার মাঝে লুকিয়ে থাকা গভীর এক কোমল অনুনয়; আবার নিবিড় ঘন অন্ধকার রাতে ধ্রুবতারার রূপক ব্যবহার করে প্রকাশ পাওয়া ঐকান্তিক কামনা; এর সঙ্গে সাহানা শব্দার্থে অন্তর্নিহিত রাতের রাজসিকতা আর এ-রাগের গম্ভীর গভীর রূপ-চলন-রস আমার কাছে একাকার হয়ে গিয়েছিল।

তাই বলি, শাস্ত্রীমশায়ের বর্ণনা মোতাবেক বাঙালি হতে পেরেছি কি না জানি না; কিন্তু এমনিভাবে গানে গানে, গানের সুরের আবেশে বাঙালির বাঙালিত্বকে অনুভব করার যে প্রয়াস শুরু হয়েছিল মনের অজান্তে সেই কোন ছোটবেলায়, সেই প্রবহমান প্রক্রিয়াতেই আমার বাঙালিয়ানার স্বরূপ তৈরি হয়েছে পরিণত বয়সে এসে, তৈরি হয়েছে বাঙালি হিসেবে আমার আত্মপরিচয়। আমি আর আমার বাঙালিয়ানা যেমন ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে, ঠিক তেমনি আমার বাঙালিয়ানার স্বরূপে গান – গানের সুর – সুরের বোধ পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। অবচেতনের এই  গভীর বোধ আমার চেতনে, আমার উপলব্ধিতে নাড়া দিয়ে গেল, সাড়া ফেলে গেল আমার চিরচেনা বাঙালিয়ানার ঘেরাটোপ ছেড়ে যোজন যোজন দূরে এই পরবাসে যখন এলাম। সচেতন বোধে উপলব্ধি করলাম গভীরভাবে যে, আমার বাঙালিয়ানা থেকে আলাদা করে আমায় ভাবাই যায় না। আর অবাক হয়ে দেখলাম, বুঝলাম, এই ‘বোধিলাভের’ পেছনেও রয়েছে গান – গানের সুর – সুরের বোধ। নতুন দেশে আত্মপরিচয়ের সংকট তো নয়ই, বরং নতুন করে নিজেকে চিনে-জেনে আমার অভিযোজন সহজতর করে তুললো আমার সেই ‘চিরসখা’।

আঞ্চলিক প্রবাদ আছে ‘স্থান ছাড়লে মান যায়’। কিন্তু এই প্রবাদ মিথ্যে হয়ে গেল আমার জীবনে আমার সুরের অনুষঙ্গে, সুরকে নিয়ে ভাবার চিরচলমান অভ্যাসে। আমার এই অভিবাসী জীবনকে আমার কাছে মনে হয় ‘পরমেল প্রবেশক রাগের’ মতো। ‘পরমেল প্রবেশক রাগ’ ব্যাপারটা কী আর তার মাঝে আমি কেন অভিবাসী জীবনকে খুঁজে পাই, সে-কথায় আসছি একটু বাদেই; কিন্তু তার আগে বলি, অভিবাসী জীবনে স্থানান্তরের অভিজ্ঞতার মাঝে চিরচেনা অতিপরিচিত পরিবেশ ছেড়ে আসার কষ্টানুভূতি যেমন আছে, ঠিক তেমনি আছে নতুনকে গ্রহণ করার অভিলাষ, নতুনের মাঝে গৃহীত হওয়ার স্বপ্ন। আর তাই বোধ করি অভিবাসীদের ক্ষেত্রে স্থান ছাড়লেও মান হয়তো যায় না। আর দশজন অভিবাসীর মতো আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় হয়নি। বরং আমার এই জীবনে গল্পে স্থানান্তরের বেদনা যেমন আছে, তেমনি আছে আর ছিল নতুন আবাসের সঙ্গে সমন্বয়ের আকাক্সক্ষা আর নিরন্তর প্রচেষ্টা। আর আমার কাছে প্রবাসী থেকে অভিবাসী হয়ে-ওঠার ব্যাপারটাকে এক প্রবহমান প্রক্রিয়া বলে মনে হয়। এই চলমান প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ দিনে দিনে কখনো জেনে-বুঝে, কখনো আবার নিজের অজান্তেই অভিবাসী এই আমি এক তৃতীয়মাত্রিক অভিযোজিত সত্তা তৈরি করে ফেলেছি। এই কুড়ি বছর পার করে এসে এই তৃতীয়মাত্রিক অভিযোজিত সত্তাটাই আসলে আমার প্রত্যক্ষ প্রকাশমান সত্তা। এ শুধু আমার গল্প নয়, এই গল্প সকল অভিবাসীর গল্প। পার্থক্য হয়তো কেবল আমাদের নতুন আবাসের সঙ্গে সমন্বয়ের আকাক্সক্ষা আর নিরন্তর প্রচেষ্টার মাঝে। আর এই দোলাচলের ব্যাপারটাকেই আমি মেলাই জয়জয়ন্তী কিংবা পুরিয়া ধানেশ্রী কিংবা ঝিঝোটের মতো ‘পরমেল প্রবেশক রাগের’ সঙ্গে। পরমেল প্রবেশক রাগের মাঝে আমি প্রকৃতপক্ষে অভিবাসী মানুষের তৃতীয়মাত্রিক অভিযোজিত সত্তার উপযুক্ত উদাহরণ খুঁজে পাই।

পরমেল প্রবেশক রাগের ব্যাপারটা বোঝাতে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে ‘ঠাট’ শব্দটার মাহাত্ম্য বা ব্যাপ্তির খানিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। ঠাট বা মেল হলো ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের এক ধরনের সাংগীতিক প্রকাশ, যা মূলত রাগসংগীতকে শ্রেণিবদ্ধ করেছে। এই  ঠাটের ধারণাকে খুব সহজ কথায় মানবসমাজের জাত বা গোত্র বা শ্রেণির সঙ্গে তুলনা করলে হয়তো বুঝতে খানিক সুবিধে হবে। নানান বৈশিষ্ট্যের মানুষ দিয়ে গড়া প্রতিটি আলাদা জাতি, শ্রেণি বা গোত্রের মানুষের যেমন জাতিগত, শ্রেণিগত বা গোত্রগত কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, ঠিক তেমনি ঠাট হলো ভিন্ন ভিন্ন শুদ্ধ, কোমল আর তীব্র স্বরের সমন্বয়ে গঠিত স্বরসমগ্র, যার প্রতিটির অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে। আমাদের শাস্ত্রীয় সংগীতে গীত প্রায় সকল রাগরাগিণীই কোনো না কোনো ঠাটের অন্তর্ভুক্ত। পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে (১৮৬০-১৯৩৬) বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সকল রাগকে দশটি ঠাট বা মেলে বিন্যস্ত করেছেন। মোটামুটিভাবে এই শ্রেণিবিভাজনই সর্বজন গৃহীত। আবার এই জনক দশটি ঠাট শুদ্ধ ও কোমল গান্ধার আর নিষাদের প্রায়োগিক ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে তিনটি বর্গে বিভক্ত। এবারে পরমেল প্রবেশক রাগের ব্যাপারটা হলো যে, রাগ সচেতন আর স্পষ্ট ইঙ্গিত বা সংকেত দিয়ে এক ঠাট থেকে অন্য ঠাটে প্রবেশ করে। আর দুই ঠাটের মিশেলে রাগটি তার নিজের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আত্মপরিচয় প্রকাশ করে।

এ-কারণেই আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার অভিবাসী জীবনের অভিজ্ঞতাকে ঠিক পরমেল প্রবেশক রাগের সঙ্গেই মিলিয়ে দেখি। জন্মভূমির জাতিসত্তার বৈশিষ্ট্য আর পরিচয় নিয়ে ‘এলেম নতুন দেশে’ আর সেখানে আরেকভূমের জাতিসত্তার বৈশিষ্ট্য আর পরিচয়ের সঙ্গে মিশেলে নিজের সত্তার নতুন যে এক জন্ম হলো, সে একই সঙ্গে বাঙালি আবার অস্ট্রেলিয়ান – ঠিক জয়জয়ন্তী রাগের মতো। পরমেল প্রবেশক রাগ জয়জয়ন্তী যেমন শুদ্ধ ঋষভ, গান্ধার ও ধৈবত আর শুদ্ধ-কোমল দুই নিষাদের খাম্বাজ ঠাট থেকে কোমল গান্ধার ও নিষাদের কাফিতে গিয়ে নিজের রূপ মেলে ধরে; ঠিক গত কুড়ি বছরের অভিবাসী জীবনে আমার বাঙালিয়ানা গিয়ে মিশেছে আমার অস্ট্রেলিয়ান পরিচয়ের সঙ্গে। খুব সহজাতভাবেই তৈরি হয়েছে আমার অভিযোজিত তৃতীয় সত্তা। জয়জয়ন্তী শুনতে গিয়ে, গাইতে গিয়ে যেমন কখনো মনে হয়নি খাম্বাজ-কাফীর মিশেল বেমানান লাগছে, ঠিক তেমনি আমার বাঙালিয়ানার লাল-সবুজ রঙে অস্ট্রেলিয়ান সবুজ-সোনালি রং মেশাতে গিয়ে বেখাপ্পা লাগেনি একটিবারের জন্যও। এখন ফিরে তাকালে মনে হয়, হয়তো আমার সুরের অনুষঙ্গই আমার এই ‘পরমেলে প্রবেশ’টা খুব স্বাভাবিক আর সহজিয়া করে তুলেছিল। তাই পরমেল প্রবেশক রাগে আমি অভিবাসী জীবনের সমাপতনের গল্প খুঁজে পাই, খুঁজে পাই নিজেকে। ভাবি, আমি নিজেই হয়তো এক ‘জয়জয়ন্তী’।

জয়জয়ন্তী রাগটা আমার বড্ড প্রিয়। ওই যে লেখার শুরুতেই বলছিলাম না রাগসংগীতের সুরের মাঝে আমি জীবনের নানান রূপকল্প খুঁজে পাই, তাকে ঘিরে মনে আঁকা নানান ছবি দিয়েই আমার পৃথিবীটা সাজানো। এই জয়জয়ন্তী রাগের রূপবৈশিষ্ট্যের মাঝে আমি আমার অভিবাসী জীবনের গল্প খুঁজে পাই বলেই হয়তো বিগত কুড়ি বছরে এই রাগ আমার আরো একান্ত নিজের হয়ে উঠেছে, প্রিয়তর হয়ে ধরা দিয়েছে। রাতের এই রাগ এক দারুণ মিশ্র অনুভূতির চিত্রকল্প তৈরি করে আমার মনে। সাংগীতিক তত্ত্ব অনুযায়ী একই সঙ্গে এই রাগ প্রকাশ করে আনন্দ, জয়ের সুখানুভূতি, আবার এর সুর গেয়ে যায় হারানোর বিষাদযন্ত্রণা। সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুই আবেগানুভূতি খুব সহজাতভাবেই এই রাগের চলনে আনে গভীরতা আর গাম্ভীর্য – সেখানে আনন্দের উচ্ছলতাকে হারানোর বেদনা প্রগলভ হতে দেয় না যেমন, তেমনি আবার বিচ্ছেদের বেদনাকে প্রাপ্তির আনন্দ দেয় না অকল্পনীয় দুঃসহ হয়ে উঠতে। আমার ভাবনায়, আমার বিশ্বাসে আমার অভিবাসী জীবনটাকেও তো ঠিক তেমনি মনে হয়। আর শুধু আমি কেন, এই অনুভূতি তো সকল অভিবাসীর কাছেই সর্বজনীন, তাই না? কারণ আমার মতো সকল অভিবাসীর জীবনেই বিচ্ছেদের বেদনার সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে আছে নতুন কিছু পাওয়ার স্বপ্ন আর আনন্দ। আমাদের জীবনের প্রেক্ষাপট জুড়ে আছে এই দুই অনুভূতির মিথস্ক্রিয়া আর তাকে মানিয়ে জীবনকে ভালোবাসার গল্প। আমার চোখে এই গল্প তাই ঠিক যেন জয়জয়ন্তী রাগে বাঁধা, এর সুরে সাধা। এ যেন ‘তোমায় নতুন করে পাবো বলে, হারাই ক্ষণে ক্ষণ, ও মোর ভালবাসার ধন’। 

বিপরীতমুখী আবেগানুভূতির কথা যখন এলোই তখন মনে পড়লো বাঙালিয়ানার অভিধাই ‘কান্নাহাসির দোল দোলানো’ বৈপরীত্যময়। ক্ষণে ক্ষণে আমাদের আবেগের এতো টানাপড়েন চলে বলেই বোধ করি একই শব্দ ‘রাগ’ ক্রোধ আর প্রণয় দুই-ই প্রকাশ করে। এ-শব্দে যেমন লুকিয়ে আছে প্রেমের পরশ, ঠিক তেমনি আছে রোষের তেজ। বাংলায় ‘রাগ’ যেমন ভিন্নমাত্রিক অনুভূতি প্রকাশ করে, তেমনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে ‘রাগ’ও কিন্তু স্বর আর সুরের মেলবন্ধনে আবেগ আর অনুভূতি প্রকাশের প্রতিরূপ। ‘রঞ্জয়দি ইতি রাগ’-স্বরের বিন্যাসে গাঁথা সুরের লহরী মনকে রঞ্জিত করে বলেই না এর নাম ‘রাগ’ – যা এসেছে রঞ্জক শব্দ থেকে ‘রঞ্জকো জনচিত্তানাং স রাগঃ কথিতো বধৈঃ’। দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তাই ভিন্ন ভিন্ন রাগের সুর যেমন মনকে রাঙায়; ঠিক তেমনি বর্ষার অনুভূতির সুরের রং আর বসন্তের সুরের রং কী তাই কখনো এক হতে পারে? সুরের খেলায় আর স্বরের মেলায় এই রঞ্জনা করার যে-প্রয়াস সেটাই রাগের আসল কথা। এখানে ব্যাকরণ নয়, বরং স্বরের বৌদ্ধিক আর সৃজনশীল মেলবন্ধনে সৃষ্ট সুরেলা অনুরণনের যে-ভাবপূর্ণ ব্যাপ্তি সেটাই মনকে রাঙায়, চিত্তে দোলা দেয়।

ভাবের জায়গা থেকে প্রকাশের এই প্রতিরূপ বিস্ময়কর আর এখানেই রবিঠাকুর প্রকৃতির নিরন্তর সৃষ্টিময়তার সঙ্গে রাগরাগিণীর সুরের সমাপতন খুঁজে পান। তাঁর ‘সঙ্গীতের মুক্তি’ (সবুজপত্র, ভাদ্র ১৩২৪) প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘রাগ-রাগিণী বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে নিত্য আছে। সেইজন্য আমাদের কালোয়াতি গানটা ঠিক যেন মানুষের গান নয়, তাহা যেন সমস্ত জগতের। ভৈঁরো যেন ভোরবেলার আকাশেরই প্রথম জাগরণ; পরজ যেন অবসন্ন রাত্রিশেষের নিদ্রাবিহ্বলতা; কানাড়া যেন ঘনান্ধকারে অভিসারিকা নিশীথিনীর; ভৈরবী যেন সঙ্গবিহীন অসীমের চিরবিরহবেদনা; মূলতান যেন রৌদ্রতপ্ত দিনান্তের ক্লান্তিনিশ্বাস; পূরবী যেন শূন্যগৃহচারিণী বিধবা সন্ধ্যার অশ্রুমোচন।’ ঠিক এভাবেই আমার বাঙালিয়ানার রঙে আমার অভিবাসের রং এসে মিশেছে, তাই  আমার জীবনে ‘গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি, তখন তারে চিনি, তখন তারে জানি’ ভীষণ সত্যি হয়ে উঠেছে।

এই ভুবনখানি দেখায়, চেনায়, অন্তর্লোকে তাকে অনুভব করার পুরো বিষয়টা সরলরৈখিক পরিক্রমা নয় কোনোভাবেই। সে কখনো হাসি-আনন্দের, কখনো বিরহের-বিচ্ছেদের, কখনো বিহ্বল-ক্লান্ত-আশাহীন তো কখনো উচ্ছল-প্রাণবন্ত-সম্ভাবনাময়, আপাত প্রেমহীন জীবনও সহসা প্রণয়রাগে রাঙা হয়। জীবনে যেমন নানান রসের ধারার মিলন হয়, ঠিক তেমনি স্বতন্ত্র অনন্যমাত্রিক নয়টি রসের বর্ণনা রাগরাগিণীর মাঝেও পাওয়া যায় – শৃঙ্গার, হাস্য, করুণ, রুদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত ও শান্ত। সুরের নান্দনিকতার মাধ্যমে এই নবরস মনের বিশেষ বিশেষ অবস্থা, আবেগ, অনুভূতি প্রকাশ করে। তেমন করে ভাবলে এই নয়টি রসের মিশ্রণেই তো আমাদের  জীবনের গল্পগুলো গাঁথা হয়,  প্রকাশমান হয় আমাদের জীবনের চিরচলমান প্রতিরূপ।

যেমন কাফি ঠাটে বাঁধা মিষ্টি রাগ পিলু প্রেমের রাগ, বিরহের রাগ – এই রাগে যেমন আছে শৃঙ্গার রস, তেমনি আছে ভক্তিরস আবার আছে গভীর বিষণ্নতা-অভিমান। ‘পরানপ্রিয় কেন এলে অবেলায়’ কিংবা ‘পিয়া ভোল অভিমান’ গাইতে গেলে কি এক গভীর অভিমান ছেয়ে বসে আমার মনকে। আর এখানেই আমার বাঙালিয়ানা আমার অভিযোজিত সত্তায় প্রকট প্রকাশমান হয়। অভিমান তো একান্ত বাঙালির অনুভূতি – এর তো কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দও নেই। তাই পিলু রাগের সুর, এতে বাঁধা এই গানগুলো অভিবাসী জীবনে আমার বাঙালিয়ানার উদ্যাপন। আবার নাতিচঞ্চল শান্ত প্রকৃতির রাগ ভৈরবীকে অনেকেই রাগের রানী বলেন। ভক্তি ও শৃঙ্গার রসাত্মক এ-রাগের আরো নানান ভিন্নমাত্রিক প্রকাশ আছে। কিন্তু এ-রাগে বারোটি স্বরের অনন্য ব্যবহার আমার কাছে ঠিক যেন জীবনের সব রং, সকল উপাচার ছুঁয়ে যাওয়ার প্রয়াস মনে হয়। তাই ভোরের ঊষালগ্নের এ-রাগ আমার কাছে দিনমান মনের আগল খুলে গাইবার রাগ। ‘না মিটিতে সাধ মোর নিশি পোহায়’ তাই শুধু আমার কাছে প্রিয়সঙ্গ যাপনের পর ভোরবেলাকার  বিচ্ছেদের কষ্ট মনে করায় না, ভাবায় জীবনের সব প্রিয় মুহূর্ত বড্ড ক্ষণস্থায়ী অথবা প্রিয়সঙ্গ লাভে মনের যে গভীর অনন্ত অভিলাষ, তা কখনোই হয়তো পূর্ণতা পায় না। এ-রাগে বিচ্ছেদ-বিরহ-অভিমান মিলেমিশে একাকার, সঙ্গে আছে শাশ্বত প্রেমের সানুনয় আকুতি – সে প্রেম কখনো নশ্বর, কখনোবা অবিনশ্বর। তাই আমার অভিবাসী জীবনে আত্তীকরণ থেকে সংশ্লেষণ হয়ে অভিযোজনের ভিন্নমাত্রিক প্রক্রিয়াটি যেন ঠিক ভৈরবী রাগের শুদ্ধ-কোমল-কড়ি বারোটি স্বরের সমন্বয়ে আঁকা অসীমের পথে অভিযাত্রার এক প্রতিরূপ।

আজ যখন ‘কুড়ি কুড়ি বছরের পর’ ফিরে চাই পেছন পানে, তখন টের পাই ‘চিরসখা’ সুরের অনুষঙ্গের সঙ্গে জীবনের মধুময় কিংবা বেদনাময় কত স্মৃতি আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। সেই কোন কিশোরবেলায় আনন্দী রাগ শেখার  সময় গুরুর কাছে শুনেছিলাম, এ-রাগের সুরে মানবশিশুর প্রথম কান্নায় মাসহ বাকি সকলের মনে যে-গভীর আনন্দের জন্ম হয়, তার যোগ আছে। এর বেশ অনেক বছর পর নিজে যেদিন মা হবো জানলাম, সেদিন থেকে প্রতীক্ষার প্রহর গুনেছি শুধু নবজাতকের জন্যই নয়; সঙ্গে ছিল জানার, বোঝার গভীর ঔৎসুক্য যে, কী সে আনন্দের অনুভূতি নবজাতকের প্রথম কান্নার মাঝে লুকিয়ে আছে যাকে শুনে, চিনে, জেনে আমার আনন্দী রাগের সুরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে। তারপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণে সদ্যজাত মেয়ের কান্না, আমার চোখে আনন্দের অবিরল অশ্রুধারা আর মনের অন্তঃপুরে গাইতে থাকা আনন্দী রাগ একাকার হয়ে মিলেমিশে গেল। এরপর যতবার ওই রাগের সুর কণ্ঠে আর প্রাণে জাগে, ততবার জীবনের ওই মধুরতম কান্নার শব্দ শোনার আনন্দময় স্মৃতি ভেসে ওঠে। আনন্দী রাগের চিত্রকল্পে, যা কি না একান্ত আমার নিজস্ব, তাতে আমার সদ্যজাত মেয়ের মুখটা আঁকা হয়ে গেল চিরতরে। 

আবার আমার বাবার খুব প্রিয় রাগ ছিল ছায়ানট। কিশোরবেলায় রেওয়াজে বসে এই রাগ গাইতে শুরু করলেই বাবা হয় এসে কাছে বসতেন, নয়তো বদ্ধ ঘরে না ঢুকে বাইরে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ শুনে যেতেন। থামলে হয়তো বলতেন, ‘আবার একটু করবে নাকি মা ওই বন্দিশটা?’ ছায়ানটে বাঁধা নজরুলের ‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আয়’ গানটাও তাঁর ভারী প্রিয় ছিল আমার কণ্ঠে। বাবা অনন্তলোকে যাওয়ার আগে শেষ যে-কটি গান শুনতে চেয়েছিলেন এটি তার মাঝে একটি। তাই কোনো ব্যাকরণের নিয়ম মেনে নয়, বরং এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকা অযুত স্মৃতির কারণে আমার ছায়ানটের সুর আর আমার বাবা যেন অঙ্গাঙ্গিভাবে একে অপরকে জড়িয়ে আছে। ঠিক বাবার মতোই শান্ত, ধীর প্রকৃতির রাগ ছায়ানট তাই আমার একান্ত নিজের প্রিয় অনুষঙ্গ – যাতে বেদনার নীল রং আছে, আছে ভালোবাসাময় উদ্যাপন, আছে বিচ্ছেদের হাহাকার,  সঙ্গে আছে পুনর্মিলনের একান্ত গভীর প্রতীক্ষা। 

জীবনের নানান স্মৃতি, প্রিয় সব সম্পর্ক, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসার নানান অভিজ্ঞতা ঠিক যেন নানান স্বরের মেলবন্ধনে গাঁথা সুরের লহরীময় রাগগুলোর মতোই আর তাই এদের উলটেপালটে দেখতে আমার বড় ভালো লাগে। আর জীবনের নানান সন্ধিক্ষণে রামকেলী বা শ্রী, ভৈরব কিংবা পূরবীর মতো সন্ধি-প্রকাশ রাগের সুর আমায় বারংবার আশ্বস্ত করেছে। সুরের অনুষঙ্গে জানান দিয়েছে, ঊষালগ্নে যেমন সোনালি সূর্যের আলোর প্রত্যাশা জাগে, গোধূলিলগ্ন তেমনি রুপালি জ্যোৎস্নাময় শান্ত নিবিড় রাতের বারতা আনে। সুরের মাঝে নিজেকে খোঁজা, নিজের শেকড়কে খোঁজার এই যে অন্তহীন অসীম আনন্দময় যাত্রা বোঝার জ্ঞান হওয়ারও আগে সেই কোন শৈশবে শুরু করেছিলাম, পরিণত বয়সে এসেও  সেই যাত্রা নিরবচ্ছিন্ন ধারায় সচল আছে এখনোও আমার অস্তিত্বের সহজাত অভ্যাস হয়ে। ‘চিরবন্ধু’ আমার গান – গানের সুর – সুরের বোধের সাহচর্যে তাই একাকী মুহূর্তগুলোও কখনো নিঃসঙ্গ, সঙ্গীবিহীন হয়নি। আমার অভিবাসী  জীবনে, আমার বাঙালিয়ানার চর্চায় সুরের অনুষঙ্গের কাছে তাই আমার অন্তহীন অতল ঋণ …

জীবনপাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছ দান

তুমি জান নাই, তুমি জান নাই,

তুমি জান নাই, তার মূল্যের পরিমাণ ॥