জয়নুল আবেদিন সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে। তখন দেশ ভাগ হয়নি। ১৯৪৫ সালে আমি প্রথমবর্ষে আর্ট স্কুলে ভর্তি হই এবং শিক্ষক হিসেবে তাঁকে পাই। আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেও আমরা অনেকে তাঁকে নামে চিনতাম। ১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষের বাস্তব রূপ চিত্রিত করে তিনি কলকাতা শহরে তখন আলোচিত ব্যক্তিত্ব। শহরের রাস্তায় অন্নের খোঁজে কঙ্কালসার মানুষের মিছিল, তাঁদের হাহাকার, মৃত্যুর ভয়াবহতা, তাঁর সপাটে রেখানির্ভর সৃষ্টিগুলোতে বিশিষ্টরূপে পড়েছিল। জয়নুল আবেদিনের মতো একজন খ্যাতিমান শিল্পীকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া আমাদের অনেকের কাছেই ছিল কল্পনাতীত।
দ্বিতীয়বার জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে আমি ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসি ১৯৫০ সালে ঢাকায় সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়ার সুযোগলাভ করে। তিনি সে-সময় আর্ট ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ।
১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভাগের ফলে জয়নুল আবেদিন সাহেবসহ অন্যান্য মুসলমান শিল্পী যেমন, সফিউদ্দীন আহমেদ, আনোয়ার উল হক, সফিকুল আমিন, কামরুল হাসান কলকাতা ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা শহরে বদলি হয়ে যান। এই শিল্পীদের প্রথমে ঢাকায় বিভিন্ন সরকারি স্কুলে চাকরি করতে হয়েছিল। সে এক বিড়ম্বনার ইতিহাস। পরে ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠা হলে এঁরা সকলে সেখানে যোগদান করেন এবং জয়নুল আবেদিনের প্রযত্নে গড়ে ওঠে বাংলাদেশে চিত্রকলা-শিক্ষার এক নতুন পরিবেশ ও উৎসাহ।
আমার ঢাকায় আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়া সম্ভব হয় জয়নুল আবেদিনের বদান্যে। এখানে উল্লেখ্য, ১৯৪৯-এর শেষ দিকে আরো কয়েকটি ছাত্রের সঙ্গে আমাকেও ছাত্র রাজনীতি করার অভিযোগে কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এখানে বিভিন্ন আর্ট স্কুলে ভর্তির সুযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রাজনৈতিক কারণে। আমার পৈতৃক ভিটা ও দেশ ছিল পূর্ব বাংলায়। এ-অবস্থায় আমি মনস্থ করি ঢাকায় যাওয়ার ও ওখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার।
ঢাকায় পৌঁছে অধ্যক্ষ আবেদিনের সঙ্গে দেখা করি। কলকাতায় আর্ট স্কুলের পরীক্ষা দিতে না পারা ও অন্যান্য ঘটনা তাঁকে জানাই। সহৃদয়তার সঙ্গেই তিনি আমায় ভর্তির এবং শিল্পকলা-শিক্ষার সুযোগ করে দেন। ছাত্র হিসেবে তাঁকে খুব ঘনিষ্ঠভাবেই আমরা পেয়েছিলাম। আমি পঞ্চম বর্ষের শেষ পরীক্ষায় রেকর্ড নম্বর পেয়েছিলাম তাঁর অধীনে শিক্ষার সুযোগ লাভ করেই। পরীক্ষার পর আমি ঢাকায় থেকে যাই ও ওখানকার শিল্পকলা-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ি।
দুই
একজন শিল্পীর শিল্পকর্ম অধ্যয়ন করতে হলে সেই শিল্পীর বিভিন্ন পর্বের সৃষ্টিসমূহকে যেমন গণ্য করতে হয়, তারই পাশাপাশি সেই শিল্পীর সময়কালের পরিবেশ, সমাজ সম্বন্ধকেও জানতে হয়।
জয়নুল আবেদিন পূর্ববাংলার ময়মনসিংহের মানুষ, শিল্পকলা-শিক্ষার জন্য এসেছিলেন কলকাতায়, ভর্তি হয়েছিলেন সরকারি আর্ট স্কুলে। আর্ট স্কুলে তখন অ্যাকাডেমিক পাশ্চাত্যরীতি শিক্ষার প্রচলন ছিল। আবেদিন সাহেব খুবই পরিশ্রমী ও কৃতী ছাত্র ছিলেন। প্রকৃতির নানান বর্ণময় দৃশ্য রচনায়, প্রতিকৃতি বা মুখাবয়ব চিত্রণে, নারী-পুরুষের দেহরূপের স্পর্শগ্রাহী অঙ্কনশৈলী উপস্থাপনায় আলো-আঁধারের পরিবেশ সৃষ্টির এবং ড্রইং বা রেখাচিত্রের দক্ষতায় তিনি খুবই পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। এছাড়া সে-সময়কার অ্যাকাডেমিক পাশ্চাত্য অঙ্কনরীতির ধারক, যেমন হেমেন্দু মজুমদার, অতুলচন্দ্র বসু, প্রহ্লাদ কর্মকার প্রমুখ দেশ-বিদেশখ্যাত শিল্পীর প্রভাবও তাঁর ওপর বর্তায়। এর কারণেই ছাত্রোত্তর ও প্রথম পর্বের সৃষ্টিতে শুধু নয়, উত্তর কালের সৃষ্টিসমূহেও বাস্তবতা, আকারগত ও ড্রইংয়ের ধ্রুপদী বিন্যাস তাঁর সৃষ্টিতে বিশিষ্টতা নিয়ে আমাদের কাছে আসে।
জয়নুল আবেদিন নিজেকে অ্যাকাডেমিক শিল্পরীতিতে আবদ্ধ রাখেননি। তাঁর জলরঙে আঁকা নদীমাতৃক বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির চিত্রসমূহ, সাঁওতাল পরগনার দুমকার জীবন-চিত্রমালা প্রথাগত অঙ্কনরীতির বাইরে অন্য মাত্রা সংযোজন করেছিল। সৃষ্টিতে দেশজ চরিত্র আরোপের প্রচেষ্টা, লোকায়ত ঐতিহ্য ও রূপসমূহের ব্যবহারের প্রশ্ন এবং সমসাময়িক আধুনিক শিল্প-জিজ্ঞাসা ও অনুসন্ধান এবং প্রতিবাদী ও সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থানে সংগত সৃষ্টির প্রয়াসসমূহের সম্বন্ধেও তিনি সজাগ ছিলেন। কারণ, ত্রিশের দশকের শেষ পর্ব থেকে চল্লিশের দশকের শেষ পর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে যে সকল শিল্পকলা-সম্বন্ধীয় চিন্তাভাবনা, আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল তার প্রস্তাবসমূহকে সে-সময়কার কোনো সৎ শিল্পীই এড়িয়ে যেতে সমর্থ হননি। সমভাবে সবসময়ই পরিবর্তিত অবস্থান এবং গভীর সামাজিক ও মানবিক অনুষঙ্গ কাজ করেছে।
পঞ্চাশের মন্বন্তর ও দুর্ভিক্ষের বাস্তবতা যেমন তাঁর ছবিতে নতুন মাত্রা ও সার্থক প্রকাশভঙ্গি অর্জন করেছে, আবার মাঠে গরু লাঙল নিয়ে এবং মই দিয়ে মাঠে চাষকাজে কর্মরত চাষি, মাছ ধরা, নৌকাবাইচ, গ্রাম্যমেলা, সাঁওতাল পল্লীজীবনের রূপ – এসবও বিশিষ্টতা নিয়ে, অপ্রচলিত ভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছে বারবার।
তিন
জয়নুল আবেদিন যে-সময়কালে কলকাতায় শিল্পকলা চর্চা এবং সৃষ্টির কাজে নিয়োজিত ছিলেন, সে-সময়ে বাংলার সংস্কৃতি ও শিল্পকলা জগৎ নানান পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। পূর্ববাংলায় দুটি প্রধান ধারা প্রাধান্যে ছিল। একটি পাশ্চাত্য অ্যাকাডেমিক, যার উল্লেখ পূর্বে করেছি। অন্যটি অবনীন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত দেশীয় নব্যবঙ্গীয় কলাশৈলী, যার লক্ষ্য ছিল সৃষ্টির স্বদেশিকরণ এবং ভঙ্গিমায় ও কাঠামোয় এক নিজস্ব স্বদেশি চিত্রভাষা গড়ে তোলা। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, অসিতকুমার হালদার, ক্ষিতীন্দ্র মজুমদার, ঈশ্বরী প্রসাদ, সুনয়নী দেবী, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ নব্যবঙ্গীয় ধারার শিল্পীরা তখন খ্যাতির মধ্যগগনে বিরাজ করছেন।
এদুটি ধারার বিপরীতে তিরিশের দশকেই ভিন্ন ধরনের শিল্পকলা মতামত ও ধারণার শিল্পীরা বিভিন্ন গ্রুপ বা দল গঠন করেন এবং নতুন ধরনের আন্দোলন শুরু করে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ইয়ং আর্টিস্ট ইউনিয়ন, আর্ট রিবেল সেন্টার ও পরবর্তীকালে ক্যালকাটা গ্রুপ – এই সকল নব্যপন্থী (avant grade) প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে নতুন ধারা প্রবর্তনের আহবান জানান। এঁরা ঘোষণা করেন, রক্ষণশীল অ্যাকাডেমিক ধারার এবং নব্যবঙ্গীয় স্বদেশ ভাবপ্রবণ ধারায় এ-যুগের শিল্প সৃষ্টি হতে পারে না। এদের কাছে ইউরোপের ইম্প্রেশনিস্ট, কিউবিস্ট এবং অন্যান্য শিল্পকলা মতবাদের সৃষ্টির খবর পৌঁছে গিয়েছিল এবং অনুপ্রেরণার স্থল হয়ে উঠেছিল।
দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী, ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায়, গোবর্ধন আশ, অবনী সেন যেমন এই নব্যধারার প্রবর্তক, তেমনই প্রায় সমসাময়িক কালেই ক্যালকাটা গ্রুপের প্রদোষ দাশগুপ্ত, নীরোদ মজুমদার, রথীন মৈত্র, প্রাণকৃষ্ণ পাল, শুভো ঠাকুর, গোপাল ঘোষ প্রমুখও ছিলেন প্রতিবাদী, প্রগতিশীল শিল্পকলা মতবাদের অনুগামী।
এই গোষ্ঠীগুলোর বাইরেও একজন প্রতিভাবান শিল্পী প্রচলিত ধারার বিরুদ্ধে নিজের মতো করে বাংলার লোকায়ত রূপ অবলম্বনে অভিনব চিত্রসম্ভার সৃষ্টি করে চলেছিলেন, তিনি যামিনী রায়। এ-সকল শিল্পধারা, মতবাদ ও আন্দোলনসমূহের অভিঘাত থেকে জয়নুল আবেদিনের দূরে থাকা সম্ভব ছিল না।
আমরা এ-কথা জানি যে, তিরিশ ও চল্লিশ দশক ভীষণভাবে পরিবর্তন ও বিপর্যয়ের কাল। তিরিশ দশকের শেষদিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল, আমাদের দেশেও তার অভিঘাত প্রচন্ড ছিল। বিশ্বজোড়া মন্দার সঙ্গে, ধ্বংস ও বিপর্যয় এদেশের জনজীবনে আছড়ে পড়ল। একদিকে স্বদেশি আন্দোলনের তীব্রতা, দেশে দেশে জাতীয় মুক্তি-আন্দোলনের প্রসার। ফ্যাসিবাদী আগ্রাসী আক্রমণ, বিপক্ষে সাম্যবাদী যুদ্ধবিরোধী মানবতাবাদী আন্দোলন এবং অভিযান, এসবও এদেশের সমাজের স্থায়িত্বকে আন্দোলিত করছিল।
এই সময়কালে মানবতার সপক্ষে, যুদ্ধের ও ধ্বংসের বিরুদ্ধে অধিকাংশ বাঙালি বুদ্ধিজীবী সজাগ হয়ে উঠেছিলেন। এ-কারণেই ওই সময়কার শিল্পকলা, সাহিত্যে, নাটকে এর প্রতিফলন আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। আর শিল্পী জয়নুল আবেদিন সাহেবের পক্ষেও চল্লিশ দশকের পরিবর্তনকামী স্পন্দিত অবস্থান এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। যেমন পারেননি সে-সময়ের চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য, অবনী সেন, দেবব্রত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পী।
চার
১৯৪৭-এর দেশভাগের পর জয়নুল আবেদিন সাহেবের কর্মস্থল পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। এ-সময়কার রাজনৈতিক ও অবস্থানগত পরিবর্তন প্রথম কয়েক বছর তাঁকে খুবই বিব্রত করেছিল। চাকরি ক্ষেত্রে সরকারি শিক্ষক শিক্ষণকেন্দ্রে শিল্পকলা বিভাগে সাধারণ শিক্ষক হিসেবে কাজ করতে হয়েছিল, এছাড়া ছিল নতুন পরিবেশে ছবি আঁকার অনেক অসুবিধা। এ-সকল তাঁর নিয়মিত কলাচর্চাকে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। এই প্রথম দিকের সময়ে শিল্পকলার সপক্ষে ঢাকা শহরে কোনো পরিবেশই গড়ে ওঠেনি। আর এ-কারণেই আবেদিন সাহেবকে, নিজের উদ্যোগকে কেন্দ্রীভূত করতে হয়েছিল একটি শিল্পকলা শিক্ষাকেন্দ্র, আর্ট স্কুল গড়ে তুলতে। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে প্রতি সন্ধ্যায় কিছু শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি মিলিত হয়ে আড্ডা দিতেন, শিল্পী কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ, কবি ফারুক আহমেদ ও আব্দুল লতিফ এবং এঁদের সঙ্গে থাকতেন জয়নুল আবেদিন সাহেবও। আমাদের জানা আছে যে, নানান আলোচনার মধ্যেও ঢাকায় আর্ট স্কুল সম্পর্কেও শলাপরামর্শ চলত।
ওই আড্ডা থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, সংগঠিতভাবে আর্ট স্কুল স্থাপনের জন্য কিছু করতে হবে। এরপর এঁরা ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে বৈঠক করেছেন, জনমত সংগ্রহ করেছেন, সরকারের সঙ্গে দেখা করে চাপ সৃষ্টি করেছেন এবং আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার দাবিকে প্রায় আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে। এইভাবে একটি ৮ কোটি মানুষের বসবাসকারী দেশে প্রথম ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট নামে শিল্পকলার শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, প্রথমে রায়সাহেব বাজারের ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের ভবনে, পরে সেগুনবাগানে ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউটের সম্প্রসারণ ঘটে। অধ্যক্ষ হিসেবে জয়নুল আবেদিনকে সকলে স্বীকার করে নেয়।
জয়নুল আবেদিনের শিক্ষাদানও ছিল খুব উচ্চমানের। তাঁর ছাত্রদরদি মনের, অনুশীলন ও চর্চার ক্ষেত্রে সঠিক পথনির্দেশ দান যেমন উল্লেখ্য, তেমনি প্রচলিত শিক্ষার কার্যক্রম এবং গতানুগতিক পথের বাইরে, ছাত্র-শিল্পীদের কাজের বৈশিষ্ট্যগুলোকে প্রাধান্যে রেখে তাঁদের নিজস্বতা অর্জনে সাহায্য করতেন। সেটিও লক্ষণীয়। এর ফলেই ঢাকা আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে পরবর্তীকালে অনেক প্রতিভাধর শিল্পী উঠে এসেছেন। শিল্পী আমিনুল ইসলাম, রশিদ চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, মুর্তজা বশীর, দেবদাস চক্রবর্তী প্রমুখ শিল্পী আবেদিন সাহেবেরই ছাত্র। অধুনা বাংলাদেশের এই প্রখ্যাত শিল্পীদের পাওয়ার জন্য আবেদিন সাহেবের কাছেই ঋণ স্বীকার করতে হয়।
পাঁচ
জয়নুল আবেদিনের সৃষ্টিসমূহকে তিনটি পর্বে পরিষ্কারভাবে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্বের ছবিতে প্রচলিত অ্যাকাডেমিক চাক্ষুষ বাস্তবতার অনুসরণ না করে, কিছুটা পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট ধরনের কাজের আভাস আমাদের লক্ষে আসে। এসব কাজের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, রেখার বন্ধনীকে দ্রুত ছন্দে ব্যবহার করার প্রচেষ্টা। এ-সময়কার বেশিরভাগ ছবিই জলরঙে এঁকেছিলেন। কিছু এঁকেছিলেন তেলরঙে।
ওই সকল জলরঙের ছবির বৈশিষ্ট্য ছিল কাগজের প্রয়োজনীয় সাদা অংশ ছেড়ে অন্য অংশে পাতলা হালকা রং চাপিয়ে আলোর ব্যবহার করা। রঙের উজ্জ্বলতায় ও ব্যবহারের স্বচ্ছতায় ওই ছবিগুলো খুবই উচ্চমান অর্জন করেছিল ও আকর্ষণীয় হয়েছিল।
আমার দেখা ওই পর্বের সাঁওতাল পরগনার ছবিগুলো, গ্রামবাংলার বিভিন্ন দৃশ্যাবলি, যাতে প্রকাশ পেয়েছিল গ্রাম্য, মাটির মানুষের জীবনচিত্র, আজো সেসবের স্মৃতি আমাকে আবেগপ্রবণ করে তোলে।
এ-সময়কারই সৃষ্টি, ড্রইং বা রেখাচিত্রমালা তেরোশো পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর অবলম্বনে আঁকা ছবিগুলো শিল্পরসিক সমাজে আজো, তীব্রতায় এবং অসহায়তার সব থেকে সার্থক রূপপ্রকাশ বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। জয়নুল আবেদিনের দ্বিতীয় পর্বের ছবিগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দেশজ লোকায়ত উপাদানকে প্রাধান্যে এনে, শিল্পশৈলীতে রূপকের জগৎ সৃষ্টির প্রয়াস করা। অবশ্যই দেশ-কাল-বাস্তবতাবর্জিত। রূপক নয়। এসব চিত্রে তাই অবচেতনা অবস্থানে গ্রামের কাঠের রঙিন পুতুল, ঘোড়া, হাতি কাঠপুতুলি মনসার ঘট, বাইচের নৌকার রঙিন নকশা ব্যবহৃত হয়েছে অভিনবভাবে নিজস্ব ভঙ্গিতে।
অনেক ছবিতেই তাঁর পূর্বের স্বচ্ছ রং-ব্যবহারের পরিবর্তে দ্বিমাত্রিক অবস্থানে অস্বচ্ছ (ওপেইক) রঙের ব্যবহার ও বলিষ্ঠ গতিময় রেখার পরিবর্তে সংযমী রেখাবন্ধনীর প্রয়োগ ঘটিয়ে ওই সময়কার সৃষ্টিগুলোকে এক ভিন্ন চরিত্রের মর্যাদা দিয়েছে। ওই সময়কার সৃষ্টির আরেকটি বিষয়েও উল্লেখ করার প্রয়োজন সেটি হচ্ছে, সংস্থাপনে কিছুটা জ্যামিতিক বিভাজন প্রবিষ্ট করার প্রচেষ্টা এবং ছবির তলকে (স্পেস) গুরুত্বসহকারে ব্যবহারের ইচ্ছা, যা তিনি আধুনিক মননে সচেতনভাবেই শুরু করে দিয়েছিলেন।
উনিশশো একান্ন-বাহান্নতে আবেদিন সাহেব রকফেলার বৃত্তি পেয়েছিলেন এবং ওই সুবাদে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশে পর্যটন ও ওইসব দেশের আর্ট গ্যালারি-চিত্রকলার সংগ্রহশালা পরিদর্শন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এছাড়া ওইসব দেশের বেশকিছু কর্মরত প্রখ্যাত শিল্পীর সংস্পর্শেও সে সময়কালে উনি আসেন। এবং বলা যায়, স্বাভাবিকভাবেই এই দেখা ও অভিজ্ঞতা উত্তরকালে তাঁর সৃষ্টিতে কিছুটা প্রভাব বিস্তার করেছিল।
এই বৃত্তি নিয়ে ভ্রমণকালেই লন্ডনে তিনি প্রথম একক চিত্র-প্রদর্শনী করেন। এসব চিত্র ছিল বেশিরভাগ জলরঙে আঁকা এবং অল্পকিছু রেখাচিত্র। বিলাতের প্রখ্যাত শিল্পকলা-সমালোচক হার্বার্ড রিড উল্লিখিত প্রদর্শনীর সচিত্র ক্যাটালগে এ নিয়ে একটি সুন্দর লেখা লিখেছিলেন। তাঁর লেখনীতে ছিল জয়নুল আবেদিনের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে কিছু ইঙ্গিত। এখানে সেটির উল্লেখ প্রয়োজন বোধ করছি। তিনি লিখেছিলেন যে-কথা, তার সারাংশ এই রকম, জয়নুল আবেদিনের চিত্রমালায় প্রাচ্যদেশীয় গ্রামীণ মানুষের বিচিত্রমুখী রূপটি প্রকটিত হয়। মানুষ ও সমাজ কাঠামোর এই রূপ ও পরিপ্রেক্ষিত আবিষ্কার করার সামর্থ্য জয়নুল আবেদিনের এক মৌলিক অবদান হিসেবে স্বীকার হওয়ার যোগ্য।
আমরা ওই প্রদর্শনীর তালিকা-বইটি দেখলেই বুঝতে পারব এ-বক্তব্যের যথার্থতা। আবেদিন সাহেব ওই প্রদর্শনীর ছবির বিষয়বস্ত্ত হিসেবে নিয়েছিলেন নদীমাতৃক বাংলাদেশের চিরপরিচিত রূপটিকে। এ-কারণেই নৌকাঘাট, গুণটানা মাঝি, জেলেদের মাছ ধরা, পালকি চড়ে নববধূর শ্বশুরবাড়িযাত্রা, মাঠে দড়িছেঁড়া বলদের দৌড়ঝাঁপ – এক-একটি ছবির বিষয় হয়ে উপস্থিত ছিল।
ছয়
ইউরোপ থেকে ফিরে এসে জয়নুল আবেদিনকে বেশ কিছুদিন আর্ট ইনস্টিটিউটের প্রশাসনিক কাজে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। ওই সময়টিতে অবশ্যই তিনি উল্লেখযোগ্য কিছু সৃষ্টি করতে সমর্থ হননি। তাছাড়া রাজনৈতিক পরিবেশও তখন ছিল খুবই অগ্নিগর্ভ। সে-সময়ে বাংলাদেশে ভাষা-আন্দোলন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে-আন্দোলন পূর্ববাংলাকে আলোড়িত করে তুলেছিল, তার থেকেও তিনি নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেননি। আমরা দেখেছি যে, ১৯৪৯ সালে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ মহল থেকে যখন ঘোষণা করা হয়েছিল যে, উর্দু সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে, সমস্ত দেশের মানুষের সঙ্গে জয়নুল আবেদিন সাহেবও সেই আতঙ্কের ভাগিদার হয়েছিলেন। তা-ই দেখি ওই রকম দুর্দিনে সাহিত্যিক নাসিরউদ্দিন সাহেবকে কেন্দ্র করে, হাসান হাফিজুর রহমানের প্রযত্নে, প্রগতিশীল শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের যে-সাহিত্য সংসদ সংগঠন গড়ে উঠেছিল শিল্পচার্য জয়নুল সেখানে বেগম সুফিয়া কামাল, কামরুল হাসান, কাজী মোতাহের হোসেন, মুনীর চৌধুরী, অজিতকুমার গুহ, আবদুল গণি হাজারী প্রমুখের সঙ্গে সহযোগী ও সহমর্মী হিসেবে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন। প্রথম যুক্তফ্রন্ট ও তার পতন এবং পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তানের অবলুপ্তি ও বাংলাদেশ সরকার গঠন সময়কালে আবেদিন সাহেবের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি আমাদের এ-কারণেই গোচরে আসে না। একমাত্র ১৯৭০ সালের বাংলাদেশের সর্বগ্রাসী বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসের বিষয় নিয়ে জয়নুল আবেদিনের ‘মনপুরা’ পর্বের ছবিগুলোতেই আবার তাঁকে উত্থিত অবস্থানে দেখতে পাই। আবার তাঁর সৃষ্টিক্ষমতাকে চিনিয়ে দেয়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.