আমেরিকার চোখে রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথ যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন পাঁচবার। ১৯১২-তে তাঁর প্রথম সফর, ১৯৩৯-এ শেষ। প্রথমবারের যাওয়াটা ঠিক করেছিলেন হঠাৎই। ইংল্যান্ডে সে-বছর তিনি গিয়েছিলেন স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য। সেখান থেকে পাড়ি দিলেন মার্কিন মুলুকে। সঙ্গে ছিলেন রথীন্দ্রনাথ ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে সে-দেশ তখনো খুব পরিচিত নয়। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রথীন্দ্রনাথ তখন ছাত্র। সে-সূত্রেই সেখানকার বিদ্বৎসমাজ রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে পরিচিত হন।

রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছে ছিল সেখানে নিরিবিলিতে কিছু বই পড়বেন; কিন্তু দিনদশেকের মধ্যেই তিনি Unity Club-এ ব্রাহ্মসমাজ সংক্রান্ত ভাষণ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হন। সেখানে তিনি চারটি বক্তৃতা দেন। একটি পত্রে রবীন্দ্রনাথ রটেনস্টেইনকে (Rothenstein) লিখেছেন ÔMy reputation as a poet is fast spreading এবং সেই ÔreputationÕ-এর ফলেই তিনি শিকাগো, রচেস্টার ও ক্যামব্রিজে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হন।

১৯১৩ সালের মার্চ মাসে মার্কিন মুলুক ত্যাগ করার পরই ম্যাকমিলন কোম্পানি রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থ লন্ডন ও নিউইয়র্ক থেকে একসঙ্গে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। তার কিছু পরেই রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মার্কিনি পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের নাম ছড়িয়ে পড়ে। পরের দেড় বছরে রবীন্দ্রনাথের সাতটি গ্রন্থ এদেশে প্রকাশিত হয়। সর্বত্র একটা ‘Tagore crazeÕ দেখা দেয়। আসলে রবীন্দ্রনাথের সৌম্য শান্ত মূর্তি, বেশভূষা সবকিছু মিলিয়েই বিদেশিদের কাছে তাঁকে ভিন্ন মনে হয়েছে। কারো কারো কাছে তিনি mystic কবি, কারো কাছে saint, আবার কারো কাছে তিনি ÔPoet who looks like a poetÕ।

১৯১৬ সালের সেপ্টেম্বরে রবীন্দ্রনাথের যুক্তরাষ্ট্র সফর কিছুটা বৈষয়িক কারণে। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ফলে সেদেশে তিনি তখন সুপরিচিত। সেই সুযোগে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের জন্য মার্কিন মুলুক থেকে অর্থ উপার্জনের কথা ভাবলেন। নিউইয়র্কের একটি সংস্থা তাঁকে সমগ্র দেশে চল্লিশটি ভাষণ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। প্রতি বক্তৃতার জন্য পাঁচশো ডলার দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তাঁর এসব বক্তৃতা Nationalism I Personality গ্রন্থে ধরা আছে।

নিউইয়র্কের ভাষণ সম্পর্কে সাময়িকপত্র লিখেছিল, ‘The lecture was one of the most remarkable one, from many standpoints, ever heard in New York.’

১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথের মার্কিন মুলুকের তৃতীয় সফরটি খুব সুখের নয়। প্রথমত, রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি প্রত্যাখ্যানকে মার্কিন সরকার খুব ভালোমনে মেনে নিতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, জার্মানির সঙ্গে তাঁর নাম যুক্ত করে তাঁকে anti-British রূপে তারা চিহ্নিত করেছিল। ফলে গতবারের মতো বক্তৃতার আহ্বান তিনি পাননি।

এরপরই হঠাৎ মার্কিনি পত্র-পত্রিকা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে খুব নির্লিপ্ত হয়ে পড়ে। আট বছরের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মাত্র দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। পত্র-পত্রিকাতেও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে লেখা কম চোখে পড়ে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের দক্ষিণ আমেরিকায় যাত্রার কথাও এখানে প্রকাশিত হয় না। কিন্তু ১৯২৯-এ রবীন্দ্রনাথ কানাডায় ÔNational Council of EducationÕ-এ ভারতের প্রতিনিধি হয়ে আসেন।

তার পরের বছরই আবার নিউইয়র্কে যান। সেখানে একটি Tagore Reception Committee তৈরি হয়। সেখানকার সভায় প্রচুর লোকসমাগম হয়। এবার রবীন্দ্রনাথ নিজের আঁকা কিছু ছবি নিয়ে গিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসু ‘Tagore in TranslationÕ প্রবন্ধে দুঃখ করে বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের মতো এতো বড় প্রতিভা শুধু অনুবাদের অভাবে বিশ্ববাসীর কাছে অপরিচিত থেকে গেছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ কোন ভাষায় কবিতা লিখতেন সে-সম্পর্কেও অনেকের ধারণা নেই। অনুবাদের দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথ নিজেই প্রথমে হাতে নিয়েছিলেন গীতাঞ্জলি অনুবাদ করে। সে-ইংরেজি সে-যুগের ইংরেজি ভাষাভাষীদের মুগ্ধ করেছিল।

কিন্তু এ-উচ্ছ্বাস বেশিদিন থাকেনি। লস অ্যাঞ্জেলেসের টাইমস (Times) পত্রিকা লিখেছিল, নোবেল কমিটি একজন হিন্দুকে – যাঁর নাম কম লোকেই উচ্চারণ করতে পারে, যাঁর রচনার মান সম্পর্কে অনেকেই সন্দিহান, তাঁকে নোবেল পুরস্কার দিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকার লেখকদের discourage’ করেছে। 

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এই নির্লিপ্ততার কারণ কী? রবীন্দ্রনাথ মার্কিন সাহিত্যমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিলেন গীতাঞ্জলি নিয়ে। কিন্তু তিনি সে-দেশে যা নিয়ে বেশি আলোচনা করেছেন তা হলো Nationalism, ধর্ম ইত্যাদি। বস্তুত, রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভার সঙ্গে পশ্চিমদেশের পরিচয় সীমিত। তাঁর কবিতার বিশাল ভাণ্ডারের মধ্যে মুষ্টিমেয় ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। পরবর্তীকালে অবশ্য বব ডিলনের (Bob Dylan) কাব্যসংগীতে এবং মায়া অ্যাঞ্জেলুর কবিতায় রবীন্দ্রপ্রভাব লক্ষ করা যায়। এমনকি তাঁর নাটকগুলোকেও পাঠোপযোগী বলে মনে করা হয়েছে, কিন্তু অভিনীত করার কথা ভাবা হয়নি।

বাংলা ছোটগল্পের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের দান সম্পর্কে বাঙালির কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প নিয়ে আলোচনা কমই হয়েছে। আসলে রবীন্দ্রনাথ বাংলার যে-ছবি তাঁর ছোটগল্পে তুলে ধরেছেন তার সঙ্গে পশ্চিমদেশের পরিচয় সামান্য। ফলে মার্কিন মুলুকে তাঁর ছোটগল্পের বিষয় সমস্যা, সমাজ, অনুভূতি – সবকিছুই অপরিচিত থেকে গিয়েছে।

উপন্যাসের ক্ষেত্রেও দেখা যায় রবীন্দ্রনাথের খুব বেশি উপন্যাস ইংরেজিতে অনূদিত হয়নি। কাজেই সবকিছু মিলিয়ে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা ঠিক উপযুক্ত মর্যাদা লাভ করতে পারেনি। মূলত তার তিনটি কারণ বলা যেতে পারে। প্রথম কারণটি কিছুটা রাজনৈতিক। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সে-দেশের যখন পরিচয়, তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। সে-সময়ে রবীন্দ্রনাথের মতবাদ, তাঁর নাইট উপাধি প্রত্যাখ্যান ইত্যাদি আচরণ মার্কিনিরা ভুল বুঝে তাঁকে জার্মান দলভুক্ত মনে করেছে এবং সে-কারণেই রবীন্দ্রনাথকে ঠিক সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। এই আচরণের ফলে রবীন্দ্রনাথও কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়েছিলেন। ফলে ব্যবধান কিছুটা প্রশস্ত হয়ে গিয়েছে।

দ্বিতীয় কারণটি সাংস্কৃতিক ব্যবধান। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক ব্যবধানের ফলে প্রাচ্যের সমস্যা, তার সুখ-দুঃখ-বেদনার ধারার সঙ্গে পাশ্চাত্য দেশ তেমন পরিচিত নয়। সে-কারণে তাঁর নাটক-উপন্যাসের রস উপভোগ করতে পারেনি।

তৃতীয় কারণটি হলো অনুবাদের সমস্যা। একদিকে যেমন ইংরেজির মানের প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি অন্যদিকে দেখা যায় রবীন্দ্রভাণ্ডারের বিশাল পরিধির সামান্যই বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত ‘শতবার্ষিকী বৎসরের রবীন্দ্রচর্চা’ প্রবন্ধে দুঃখ করেছেন, আমাদের প্রিয় কবি সম্পর্কে তেমন চর্চা করতে পারিনি। এমনকি রবীন্দ্রনাথের সমগ্র ইংরেজি রচনার একটি সংকলন এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সেই সঙ্গে পাওয়া যায় না প্রকৃত এবং পর্যাপ্ত অনুবাদ। তার ফলে ডিমকের (Dimock) ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ‘He is an isolated figure, for us, he is not part of a living tradition.