আমেরিকার জীবন – স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন

দুঃস্বপ্নের দিনরাত্রি
আমার বউ মুক্তিকে এইমাত্র ওরা নিয়ে গেল সার্জারি ওয়ার্ডে। স্ট্রেচার ঠেলে নিয়ে গেল অপরিচিত কয়েকজন মহিলা। নার্স। তাদের মাথায় অপারেশন থিয়েটারের ক্যাপ। পরনে সার্জিক্যাল রোব। তাদের চোখে জরুরি অবস্থার ভাব। ভীষণ, ভীষণ সিরিয়াস।
মুক্তি সম্পূর্ণ অচেতন। ও জানে না, কী হচ্ছে। জানি না, ওকে আর দেখতে পাব কিনা।
স্ট্রেচারের কাঠামোতে লাগানো স্টিলের রড থেকে নানারকম রবারের নল ওর নাকে-মুখে হাতে-পায়ে লাগানো। ব্লাড, স্যালাইন, আরো কী কী সব। ওর জ্ঞান নেই। চোখ বন্ধ। পালস নেমে গেছে তিরিশে, নাকি আরো কম। ভীষণ কম। মৃত্যু আর জীবনের সন্ধিক্ষণে থাকলে যেমন হয়, ঠিক তেমন। ডক্টর প্যাটেলের মুখ দেখে মনে হলো, পালস পাচ্ছেন না তিনি। অনেকক্ষণ ধরে দেখার পর যেন একটু পাওয়া গেল। তারপর একটা মেশিন দিয়ে আবার দেখলেন। ওর মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল। গম্ভীর হয়ে গেলেন খুব। আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি। অজানা আশঙ্কায় আমার বুকটা ওঠানামা করছে।
ওর মুখটা কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। বিবর্ণ, রক্তশূন্য। ওকে কখনো এমন অবস্থায় দেখিনি আমি। আমার বান্ধবী মুক্তি। আমার স্ত্রী মুক্তি। আমার মেয়ের মা মুক্তি। প্রাণোচ্ছল। আমার ভয় করছে ও হয়তো আর বাঁচবে না, এই কথা ভেবে; কিন্তু ভয়ের থেকেও অসহায় লাগছে বেশি। নিজেকে কেমন যেন ভারশূন্য মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমি যেন আমার নিজের পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নেই। আমার যেন আমার নিজের ওপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সবকিছু আমার কেমন যেন অদ্ভুত, অতিবাস্তব, অধিবাস্তব – সুররিয়েল – মনে হচ্ছে। এই ঘর, এই হাসপাতাল, এই শহর, এই দেশ … আমেরিকা … সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার …
এখন রাত দশটা বোধহয়। সময় আর দেখছি না। সময়ের কোনো দাম এই মুহূর্তে আর আমার কাছে নেই। এখন দশটা হতে পারে। আটটা হতে পারে। বারোটাও হতে পারে। কী হবে জেনে? কোনো লাভ নেই। এখানে আর কেউ নেই। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলার নেই। সবাই চলে গেছে। মুক্তিকে অপারেশন করা হবে এখন। বাঁচানোর চেষ্টা করা হবে। বাঁচবে নিশ্চয়ই। বাঁচবে না কেন? বাঁচবে না? এই তো কালকেই, এই তো আজ সকালেই কত কথা হলো, কত গল্প হলো। মেয়েকে নিয়ে কত আদর, ভালোবাসা, স্নেহ … বাঁচবে না, এ আবার হয় নাকি?
বাঁচবে না?
ডাক্তার প্যাটেল বললেন, ডিএনসি বলে কী একটা অপারেশন করা হবে। আমাকে দিয়ে একটা কাগজে কী একটা সই করিয়ে নিয়ে গেলেন। আমি সই না করে দিলে নাকি সে-অপারেশন করা যাবে না। কারণ, মৃত্যুর আশঙ্কা আছে। সার্জারির সময় মৃত্যু হলে ডাক্তার আর হাসপাতালকে যাতে কেউ দোষী করতে না পারে। ক্ষতিপূরণ দাবি করতে না পারে। মামলা আনতে না পারে।
এসব ব্যাপার আমি বুঝি না। আগে কখনো দেখিনি। কলকাতায় মায়ের ক্যান্সার অপারেশনের সময়ে যা করার বাবাই করেছিল। আমি কিছু জানতাম না। সেখানে তাও সব চেনাপরিচিত লোকজন ছিল। ডক্টর দীপক দাশগুপ্ত। আমাদের দীপুদা। রক্ত দিয়েছিল বন্ধু নাগেশ। কত লোক দেখতে এসেছিল। আত্মীয়স্বজন। এখানে আমি কাউকে চিনি না। জানি না। আমাদের এই অবস্থার কথা আমি কাকে বলব এখন? এখানে তো আমি তেমন কাউকে চিনি না। যে কজনকে চিনি, তারা কেউ জানে না আজকে আমরা এখানে কী অবস্থায়। কাউকে তো খবর দেওয়া হয়নি। সবকিছু এত হঠাৎ হয়ে গেল!
ব্রকো হসপিটালের যে ছোট্ট ঘরটায় ওকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নিয়ে এসে রেখেছিল ইমার্জেন্সি রুম থেকে, সে-ঘরটার অন্যদিকে একটা বেবি-বিছানায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে আমাদের শিশুসন্তান। এখন এই ঘরটায় আমি একা দাঁড়িয়ে আছি। মেয়ের নাম আমি রেখেছি নন্দিনী। আদর করে রক্তকরবীর নন্দিনীর নামে নাম রেখেছি। রবীন্দ্রনাথের মায়াময় উজ্জ্বল জগতের একটু আলো মেয়ের নামকরণের মধ্য দিয়ে ওর নিষ্পাপ, নরম মুখে মাখিয়ে দিতে চেয়েছি। আমাদের এই নিঃসঙ্গ-প্রবাসে আমাদের দুজনের সংসারে নতুন মুখ। আমাদের সুখ, আমাদের আনন্দ, আমাদের অনেকদিনের অনেক স্বপ্নের, ভালোবাসার ফসল। ও এখন মাত্র সাত না আট দিনের। ও খুব ভালোই আছে। হাসছে, খেলছে, কাঁদছে, দুধ খাচ্ছে, ঘুমিয়ে পড়ছে। আমার আঙুলটা ওর ছোট্ট নরম হাতে মুঠো করে ধরে থাকে। আর আমার দিকে চেয়ে হাসে। আমি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে এসে দরজা খুললেই ও জানতে পারে, বাবা এসে গেছে। খুশিতে ছোট্ট ছোট্ট হাত-পা ছুড়তে থাকে। ওর ছোট্ট ক্রিবে ম্যাট্রেসের ওপর ওর পা ছোড়ার শব্দ হয়, ‘ধুপ ধুপ ধুপা ধুপ ধুপ …’
কী আশ্চর্যসুন্দর ওর হাসিটা। স্বর্গ থেকে যেন সবেমাত্র দেবী সরস্বতী আর লক্ষ্মীর আশীর্বাদ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে ও, আমাদের এই সুদূর, নির্বাসিত জীবনে একটু আনন্দ, ভালোবাসা, গান, কবিতার ছোঁয়া দেবে বলে। ওর কচি মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকি আমি অনেকক্ষণ ধরে, ও ঘুমিয়ে পড়ার পরে। বুকের গভীরে মরুভূমিতে বৃষ্টি হয়। বাংলার বৃষ্টি। শান্ত, পবিত্র, মায়াময়। বাংলার মাটির কোমলতা।
উনিশশো পঁচাশিতে আমি এসেছি আমেরিকার মিডওয়েস্ট অঞ্চলের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। ছোট্ট শহর, নাম নরমাল-বস্নুমিংটন। কোনোদিন আমেরিকায় আসব ভাবিনি। আমাদের পরিবারের কেউ কখনো আমেরিকায় বলতে গেলে আসেইনি। দু-একজন এসেছে, কিন্তু খুব কম দিন থেকেই চলে গেছে। তাদের কাছে কোনো সাহায্য আমি পাইনি। শুধু দু-তিনজন বন্ধু এদেশে ছাত্র হিসেবে এসেছে, এবং থেকে গেছে। তাদের কাছে কিছু পরামর্শ পেয়েছিলাম। উৎসাহ পেয়েছিলাম; কিন্তু তারা আমার মতো নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসেনি। আমার মতো ভীষণ সংগ্রাম করতে হয়নি কাউকে। সেই আমার স্মৃতিকথা ঘটিকাহিনিতে যেমন লিখেছি, সুদূর সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের কলেজে অধ্যাপনা, টিচার্স হোস্টেলে থাকা। বিদ্যুৎ নেই, কলের জল নেই, রাসত্মাঘাট নেই, ডাক্তার নেই। জলপথে যাওয়া-আসা। ফোন নেই। কলকাতায় পড়ে আছে স্ত্রী এবং বাবা, বোন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো উপায় নেই। সপ্তাহান্তে বাড়ি যাওয়া। দুদিন থেকেই আবার ফিরে আসা এই পা-ববর্জিত জায়গায়। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। চার বছর এভাবে কাটিয়ে একরকম বেপরোয়া, মরিয়া হয়ে আমেরিকায় ছাত্র হয়ে চলে আসার জন্যে চেষ্টা শুরু করেছিলাম। সফল হবো, ভাবিনি। কেমন করে যেন সবকিছু হয়ে গেল। প্রস্ত্ততি ছিল না – শারীরিক, মানসিক, আর্থিক। সবাইকে পৃথিবীর অন্যদিকে পেছনে ফেলে এসে দেশহীন, সমাজহীন, রাষ্ট্রহীন, বন্ধুহীন, ভাষাহীন জীবন কেমন করে কাটাতে হয়, তার কোনো ধারণাই ছিল না।
তারপর থাকা ভীষণ একাকিত্বের মধ্যে। নির্জনতা, বন্ধুহীন, আত্মীয়হীন সুদূর আমেরিকার জনশূন্য মধ্যপ্রতীচ্য। ইলিনয়, ইন্ডিয়ানা, আইওয়া, মিসৌরি, ওহাইও। ইলিনয় কোথায়, কেমন সেখানকার পরিবেশ, আবহাওয়া কেমন, লোকজন কেমন, দিন কেমন, রাত কেমন? কোনো ধারণা ছিল না। স্কলারশিপ পেয়েছি এই ইউনিভার্সিটিতে, আর চলে এসেছি অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই। এই এক বছর তীব্র ভীষণ একাকিত্ব। দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলাম।
তারপর একটু একটু করে কোনোরকমে সয়ে গেল। একটু একটু করে দাঁড়িয়ে গেলাম।
পঁচাশিতে আমি এসেছি আমেরিকার মিডওয়েস্ট অঞ্চলের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। এক বছর একা থাকার পর মুক্তি এসেছে ছিয়াশির আগস্টে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক পারমিশন জোগাড় করে, অনেক কাগজে সই করে। আমি আর একা থাকতে পারছিলাম না। শিকাগোর বিশ্বদা, রেবেকা বউদি আর ওদের দুটো ছোট মেয়ের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়ে তাও একটু ভালো লাগতে আরম্ভ করেছিল।
মা তখন নেই। উনিশশো আটাত্তরে ক্যান্সারে মাত্র কয়েকমাস ভুগেই চলে গেছে। থাকলে কী হতো জানি না। হয়তো বাধা দিত না। আমার একরোখা স্বভাব মা খুব ভালো করেই জানত। আমার উচ্চাকাঙক্ষার কথা মা জানত। জেদ জানত। কিছু একটা করতে শুরু করলে আমি যে শেষ দেখে ছাড়ব, তা জানতে মায়ের বাকি ছিল না।
কিন্তু সে-কথা পরীক্ষা করার জন্য মা ততদিন আর থাকেনি। বাবা ছিল। বাবা খুব খুশি হয়েছিল যখন ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে আমার সেই বহুমূল্য আই-টোয়েন্টি নামক ইমিগ্রেশনের কাগজপত্র এসে পৌঁছল। এই কাগজ দেখালে কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেট আমাকে বিদেশি ছাত্রদের যে এফ-ওয়ান ভিসা দেয়, তা দিয়ে দেবে। বিশেষ করে ওদের যদি দেখানো যায় আমি একটা কলেজে পড়াই, আর কলেজ থেকে আমাকে কেবল দু-বছরের ছুটি দিয়েছে আপাতত একটা মাস্টার্স ডিগ্রি করার জন্য, এবং আমি আমার স্ত্রীকে ফেলে ওদেশে যাচ্ছি। তখন ওরা নিশ্চিত হবে যে, আমি পাকাপাকিভাবে আমেরিকায় থেকে যাওয়ার বাসনা নিয়ে যাচ্ছি না। সুতরাং, ভিসা না দেওয়ার কোনো কারণই থাকতে পারে না। ভিসা পেতে কোনো সমস্যাই হয়নি। দশদিন নাকি দুই সপ্তাহের মধ্যে সমস্ত গোছগাছ করে ভারত ছেড়ে, বাংলা ছেড়ে আমেরিকায় চলে এলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখার, ভাবনাচিন্তা করার, কারো সঙ্গে পরামর্শ করার সময় পাইনি। আমেরিকায় যাচ্ছি স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে, সেই আনন্দ, গর্ব, উত্তেজনায় আর কিছু তলিয়ে দেখার কথা মনে হয়নি।
আপত্তি একটু এসেছিল আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে। ওদের মধ্যে বাস্তববুদ্ধি অনেক বেশি ছিল। তাছাড়া ওরা সবাই বামপন্থি মনোভাবের, আর আমেরিকাবিরোধী। কিন্তু আমার বিদেশে পড়তে যাওয়ার সফলতা অর্জনের পথে ওরাও বাধা সৃষ্টি করেননি। মুক্তির মা অনেক চোখের জল ফেলেছিলেন। একমাত্র সন্তান। দেশভাগ, দাঙ্গা, সর্বস্ব খুইয়ে ঢাকা থেকে কলকাতায় চলে আসা। নতুন করে আবার জীবন শুরু করা। নিঃসীম দারিদ্রে্যর সঙ্গে লড়াই করে দাঁড়িয়ে ওঠা। তারপর স্বামী, আর এই মেয়ে। এদের নিয়ে আবার এক নতুন জীবন গড়ে তুলেছিলেন নতুন আশায়। আবার সেই মেয়েকে
পৃথিবীর উলটোদিকে চলে যেতে হবে? সে-কথা ভেবেই তাঁর দিশেহারা লাগছিল। বাবা সংযত, গম্ভীর। মেনে নিয়েছিলেন। স্বার্থত্যাগ করেছিলেন মেয়ে, জামাইয়ের আশা-আকাঙক্ষার পথে অন্তরায় হতে চাননি।
যেটা আমি বুঝিনি সেটা হলো, আমার মতো একটা ছেলেকে মার্কিন শিক্ষাব্যবস্থা – যা বিদেশি ছাত্রদের ওপর বিরাটভাবে নির্ভরশীল – কম পয়সায় খাটিয়ে নিতে পারবে। আমাকে শুরুতে মাসে তিনশো আশি ডলার অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ দেওয়া হবে। পড়ার খরচ ফ্রি। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীদের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস নিতে হবে। সেই দায়িত্ব পালনের জন্য প্রতি সপ্তাহে কুড়ি ঘণ্টা কাজ করতে হবে। অর্থাৎ, মাসে আশি ঘণ্টা। তিনশো আশি ডলারকে আশি দিয়ে ভাগ করলে কত হয়? ভাবাই যায় না! একটা সিনিয়র স্টুডেন্টকে উচ্চশিক্ষায় কাজ করার জন্য ঘণ্টায় পাঁচ ডলারও দিচ্ছে না। যেখানে বাড়িতে একটা ঘাস কাটার লোক লাগালে সেও ঘণ্টায় দশ ডলারের কমে কাজ করতে রাজি হবে না; কিন্তু আমরা বিদেশি ছাত্র। আমাদের ঠকানো সহজ। আমরা কিছুই বুঝি না। এদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই।
তার ওপরে ছিলাম অধ্যাপক। সম্মান, শ্রদ্ধা, ছাত্রছাত্রী। আবার হয়ে গেলাম পরিচয়হীন বিদেশি ছাত্র।
তিনশো আশি ডলারে মাস চলে নাকি আমেরিকায়? সে যতই পড়ার খরচ দিক না কেন। বাড়িভাড়া, বই-খাতা কেনার খরচ, খাওয়ার খরচ – সবকিছু তিনশো আশি ডলারে কেমন করে হয়? ডিপার্টমেন্ট বা ইউনিভার্সিটির বাইরে কোনো কাজও নেওয়া যাবে না। নিলে তা আইনবিরুদ্ধ হবে। কিন্তু, আমরা জানিই না ওদেশের মূলস্রোত আমেরিকানদের ওরা কত দেয়, আর আমাদের মতো বিদেশি ছাত্রদের কত দিচ্ছে। আমরা যারা একেবারে আনকোরা নতুন, তাদের ঠকানো তো আরো সহজ। আমেরিকায় পড়তে যেতে দিচ্ছে, তাতেই আমরা আহ্লাদে আটখানা। যেন লটারির প্রাইজ জিতেছি। অহংকারের আর শেষ নেই।
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, নরমাল টাউন। বিশ্ববিখ্যাত শিকাগো শহর থেকে একশ মাইল দক্ষিণে মধ্য ইলিনয়। সেন্ট্রাল ইলিনয়। সেই রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতার লাইনের মতো, ‘ধু-ধু করে যেদিক পানে চাই, কোনোখানে জনমানব নাই।’ অন্তত, বাঙালি একেবারেই নেই। মিডওয়েস্ট আমেরিকার ব্রেড বাস্কেট কর্নফিল্ড। যোজনব্যাপী ভুট্টার ক্ষেতের মধ্য দিয়ে রাসত্মা চলে গেছে, তার মাঝে মাঝে দু-একটা ছোট ছোট শহর। নরমাল-বস্নুমিংটন, পিওরিয়া, আর্বানা-শ্যাম্পেন, আরো একটু ভেতরের দিকে আব্রাহাম লিঙ্কনের স্মৃতিবিজড়িত স্প্রিংফিল্ড – ইলিনয় রাজ্যের রাজধানী। কিন্তু ছোট্ট শহর।
আরো অনেক দক্ষিণে, প্রায় তিনশো মাইল দক্ষিণে সাদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটি টাউন কার্বনডেল। ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি বা আইএসইউ থেকে সাদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটি বা এসআইইউ চলে গিয়েছিলাম এখান থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি করার পর পিএইচ.ডি করার জন্য। সে-গল্প পরে বলা যাবে।
কী ভয়ংকর শীত এই সেন্ট্রাল ইলিনয়ে! চারদিকে বরফ জমে আছে। শিকাগোর দক্ষিণে সাবার্ব টাউন লাইল। একদিকে লাইল, আর একদিকে ভারতীয়-অধ্যুষিত মাঝারি মাপের শহর নেপারভিল। গুজরাটি ইন্ডিয়ানদের বসতি আমেরিকানদের মাঝে। লাইল ক্ষুদ্র জনপদ। সেখানে নির্জন, নিরিবিলি রাসত্মা নর্থ ক্লোভার ড্রাইভে বিশ্বদার – বিশ্বপ্রসাদ নাথের বা স্থানীয় ইন্ডিয়ানদের মধ্যে যার নিকনেম বব আঙ্কেল – তার একতলা বাড়ি। যখন যাই, দু-একদিন থেকে আসি। পিওরিয়া চার্টার বলে একটা বাস ছাড়ে আমাদের স্কুলের লাইব্রেরির সামনে থেকে, সেই বাসে চড়ে দশ ডলার ভাড়া দিয়ে চলে যাই। দু-ঘণ্টার রাসত্মা। বাসস্টপ থেকে বিশ্বদা ওদের নীলরঙের বিউইক গাড়িতে করে নিয়ে যায়।
কেমন যেন একটা মমতা-মাখানো ওদের ছোট্ট বাড়িটা। বাড়ির পেছনে একটু খোলা জায়গা, সেখানে একটা বিরাট ম্যাপল গাছ ব্যাকইয়ার্ডের ঠিক মাঝখানে। যেন বাড়ির প্রহরী। চারদিকে বরফের মোটা চাদর বিছানো। বাড়ির ভেতরে গুমগুম করে হিটার চলার শব্দ। শীতকালে সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ। ভীষণ শীত। বাথরুমের মেঝেতে কার্পেট নেই। বাঙালিদের বাথরুমে কার্পেট থাকে না। আমরা জল ফেলি। মুছি। সেই একটুখানি কার্পেট ছাড়া হালকা নীল রং করা মোজাইক জায়গাটায় পা পড়লেই মনে হয় বরফের একটা চাঁইয়ের ওপরে যেন পা পড়ল। আর, চারদিক সব বন্ধ থাকার কারণে কেমন যেন একটা গন্ধ। এ গন্ধটা আমাদের দেশে নেই। কলকাতায় নেই। নরমাল শহরে প্রথম পা দিয়েই এ-গন্ধটা পেয়েছি আমাদের স্টুডেন্ট অ্যাপার্টমেন্টের ঘরগুলোতে। বিশেষ করে বেসমেন্টে – মাটির নিচের তলায়। সেখানে সূর্যের আলো একেবারেই আসে না। কার্পেট আর ওয়াল পেপার থেকে কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গুমোট গন্ধ বেরোয়। তার সঙ্গে কার্পেট ক্লিনারের তীব্র কেমিক্যালের গন্ধ। দম বন্ধ হয়ে আসে। আমরা বাংলা দেশের খোলা হাওয়ায় মানুষ। এই দমবন্ধ পরিবেশ যেন কয়েদখানার মতো।
আমি নির্বাসিতের জীবন যাপন করি। এক বছর এভাবে কাটল। সারাদিন ক্লাস করি। সপ্তাহে দুদিন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের ল্যাবরেটরির ক্লাস নিই। বাড়ি এসে যা হয় কিছু খাই। খাওয়ার কোনো ঠিক নেই। প্রথম সেমিস্টারে পট্যাটো চিপস দিয়ে ভাত খেতাম। রান্না করতে জানতাম না তো কী আর খাব? দেশে আমাদের মতো ফ্যামিলিতে ছেলেরা কখনো রান্নাও করতে শেখে না, আর তাদের কোনো ধারণাও নেই রান্না কীভাবে হয়। দুবেলা খাবার সময়ে
লাঞ্চ-ডিনার সামনে এসে হাজির হয় – তা সে মোগলাইখানাই হোক, নয়তো ভাত-ডাল-সবজি-ভর্তা। ছেলেরা কেউ কখনো জানতেও চায় না এই রান্নাগুলো কেমন করে হলো। দু-চারজন ব্যতিক্রম থাকতে পারে; কিন্তু এই হলো নর্ম, অর্থাৎ সাধারণ প্রথা। সুতরাং, আমি রান্না জানি না। কোনোরকমে ভাত রাঁধতে পারি – এই মাত্র।
আমাদের সঙ্গে থাকে তামিল ছেলে ভরত। বড়লোকের বখাটে ছেলে। বাপের টাকায় আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়তে এসেছে – অভাবনীয় আমাদের কাছে। লাখ লাখ টাকা খরচ। অনেক সময় ভরত একেবারে উলঙ্গ হয়ে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থাকে, আর ভয়ংকর ঝাল মাংস রাঁধে। আর কেমন করে যেন হাসে। বিচ্ছিরি লাগে আমার। আমি এসব অশস্নীলতা কখনো দেখিনি। ওর হাসির মধ্যে কী যেন একটা কামার্ত ভাব আছে। ওর ঘর রুমমেট এডগার রাতে ছেড়ে দেয় মাঝে মাঝে, আর একাধিক মেয়ে এসে ওর ঘরে থাকে। এডগার তখন শুয়ে থাকে আমাদের বসার ঘরে সোফার ওপর।
আমাদের বাড়িওয়ালি ছিয়াশি বছরের মিসেস হ্যারিসন; কিন্তু বুড়ো হলে কী হবে, সবদিকে নজর। মাঝে মাঝেই ওপরে উঠে এসে আমাদের বলে, ‘গট আ গ্যাল লাস্ট নাইট, ডিডন্ট ওয়াচ’ তারপর গম্ভীর হয়ে আবার নিচে চলে যায় বুড়ি। বুড়ির ধারণা, আমরা ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টরা সব কামুক, ড্রাগ অ্যাডিক্ট, মাদকাসক্ত। শোবার ঘরের দরজায় আমাদের কোনো খিল নেই। চাবি লাগানোর ব্যবস্থা নেই। সেই নিয়ে আমাদের আর এক রুমমেট ইথিওপিয়ার ছেলে আবাবা কাবাডা সবসময় বিরক্ত। বিরক্ত হওয়ারই কথা। আমরা ইন্ডিয়ান আর বাঙালিরা অতিবিনয়ী। নিজের অধিকার নিজেরা দাবি করতে শিখিনি। ঘরে চাবি দিতে পারব না কেন আমরা?
গোয়ানিজ ছেলে এডগার। সেও বিরাট বড়লোকের ছেলে, সেও বাপের টাকায় আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়তে এসেছে। তবে ভদ্র আর মিশুক। ভরত, এডগার এরা দুজনেই ভারতবর্ষ থেকে আমেরিকায় পড়তে এসেছে বাপের পয়সায়, যা আমার পক্ষে কল্পনা করাই সম্ভব নয়। আমাকে আরো দুটো ইউনিভার্সিটি থেকে অ্যাডমিশন দিয়েছিল। ওহাইওর কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে লিখেছিল, আমি যদি একটা সেমিস্টার নিজের খরচে পড়ি, তাহলে নিশ্চয়ই সেই সময়ের মধ্যে আর একবার টোফেল পরীক্ষা দিয়ে আমি অনেক ভালো রেজাল্ট করতে পারব, আর তখন ওরা আমাকে টিচিং ফেলোশিপ দিতে পারবে। আমি তার উত্তরে লিখেছিলাম, এক সেমিস্টার কেন, একটা দিনও আমি ইউএসএতে নিজের খরচে থাকতে পারব না। আর এই দুটো কুড়ি-একুশ বছর বয়সের ভারতীয় ছেলে নিজের ফ্যামিলির টাকায় পড়তে এসেছে। প্রতি মাসে পড়াশোনা, থাকা-খাওয়া, বইপত্র ও অন্যান্য খরচ সব মিলিয়ে চার-পাঁচ হাজার ডলারের মতো তো হবেই! আমাদের সে-সময়কার হিসাবে মাসে হয়তো পঞ্চাশ হাজার টাকা। আমি এদেশে এসেছি আমার আর মুক্তির সমস্ত জমানো টাকা নিঃশেষ করে এগারো হাজার টাকা দিয়ে ওয়ানওয়ে পেস্নলনের টিকিট কিনে। ফিরে যেতে চাইলেও ফিরে যাওয়ার আর কোনো উপায় নেই।
ফল সেমিস্টারে পড়ার ফলও অতি খারাপ হলো। ভীষণ ঠান্ডা লাগে, আর প্রায় না খেয়ে থেকে অসুখ করল। তিনদিন স্টুডেন্ট ইনফার্মারিতে কাটালাম। যেসব কোর্স নিয়েছিলাম পড়ার জন্য, তার একটা ছেড়ে দিতে হলো। ল্যাবের ক্লাস নিতে গিয়ে ইংরেজি বলতে না পারা, আর ভুল উচ্চারণ করার জন্য অল্পবয়সী আমেরিকান ছেলেমেয়েদের ব্যঙ্গাত্মক উক্তি ও হাসি শুনতে হলো। কান লাল হয়ে গেল অপমানে। গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে উঠল একটা নিঃশব্দ প্রতিবাদ। মনের যখন এই অবস্থা, আর শরীরের অবস্থা তার চেয়েও খারাপ, তখন ঠিক করলাম দেশে ফিরে যাব। ঠিক সেই সময়েই বিশ্বদার আবির্ভাব দেবদূতের মতো, সঙ্গে দূতী রেবেকা, এবং দেবকন্যা-দুটি।
শিকাগো ভ্রমণ, রান্না ও গাড়ি চালানো শেখা, এবং স্প্রিং সেমিস্টারের শুরুতে ফিরে গিয়ে ইন্ডিয়ান ও মার্কিন স্টুডেন্ট
বন্ধু-বান্ধবীদের বাঙালি রান্না খাইয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া।
বিশ্বদা বলল, ‘তুমি দেশে ফিরে যাবে? এত কষ্ট করে গরিবের ঘর থেকে নিজের চেষ্টায় এসেছ, এর মধ্যেই ফিরে যাবে?’
আমি বললাম, ‘কী করব বিশ্বদা? এত ঠান্ডা, আর এত পড়ার চাপ আর নিতে পারছি না। শরীর ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু ফিরবই বা কী করে? টাকাই তো নেই। ফিরে যেতে গেলেও তো এক হাজার ডলার পেস্নন ফেয়ার লাগবে।’
বিশ্বদা বলল, ‘ওকে, সে তুমি ভেবে দেখো; কিন্তু টাকা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি তোমাকে দেবো। কিন্তু একবার ফিরে গেলে আর কখনো আসতে পারবে না। তোমার কনফিডেন্স নষ্ট হয়ে যাবে।’
এখনো মনে আছে বিশ্বদার সেই কথা। প্র্যাকটিক্যাল কথা। মেদবর্জিত কথা। বাস্তব কথা। সবচেয়ে যেটা বেশি সাহস দিয়েছিল, তা হলো ওই, টাকা দিয়ে টিকিট কেটে দেবে বলেছিল দরকার হলে। অর্থাৎ, সম্পূর্ণ অসহায়, ডেসপারেট অবস্থা আর থাকল না। মনের জোর ফিরে এলো আবার।ধ
ওদিক থেকে মুক্তিও বারবার করে বলছিল ফোনে – ‘এত কষ্ট করে, এত সংগ্রাম করে এই যোগ্যতা, সাফল্য অর্জন করেছ। ফিরে এসো না।’
শীতের শেষে প্রকৃতিদেবীও একটু হাসলেন। আর সরস্বতী দেবীও।
পড়াশোনায় সাফল্য এলো। ভারতের নিষ্ঠুর, নির্দয়, শাসিত্মমূলক শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যর্থতার যে-ক্ষত থেকে এতকাল রক্ত ঝরছিল চুঁইয়ে চুঁইয়ে, আমেরিকার এক অজানা জায়গার এক অজানা স্কুলের অধ্যাপকবৃন্দের স্নেহছায়ায়, উৎসাহে, প্রশংসায় তাতে একটু প্রলেপ পড়ল। সঠিক চিকিৎসা হলো এতদিনে। মনটা একটু একটু করে ভালো হতে শুরু করেছিল আবার।
থেকে গেলাম আমেরিকায়। দেশে ফিরে আর যাইনি।
কিন্তু তাও, দ্বীপান্তরের আসামির মতো দিন কাটে। ফেল্মলি হলে বায়োলজি ডিপার্টমেন্টের প্রধান দরজা আর আমার ল্যাবের দরজার চাবি আমার কাছে থাকে। রাত্তির বেলা পড়াশোনা আর পেপার করার জন্য ফিরে যাই আবার। তিনতলায় আমাদের ল্যাব আর অফিস। ওয়াক্স করা ঝাঁ-চকচকে হলের, বারান্দার মেঝে; মাছি পড়লে পিছলে যাবে। ইনক্যান্ডেসেন্ট আলো জ্বলে। রাত বারোটা, একটা, দুটো। আমি আমার ল্যাবে কাজ করছি মাইক্রোস্কোপের নলে চোখ রেখে। কিংবা, কম্পিউটার রুমে ডক্টর অ্যান্ডারসনের ইকোলজি পেপার লিখছি। জীবনে কম্পিউটার চোখেই দেখিনি। আর এখানে আসার দশ-বারোদিনের মধ্যেই কম্পিউটার ব্যবহার করতে শিখে পেপার লিখে স্ট্যাটিসটিক্স করে জমা দিতে হবে। প্রথম টার্ম পেপার। টার্ম পেপার কাকে বলে, কলকাতায় জানতাম না। শিখিনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় টার্ম পেপার ছিল না।
কাজ শেষ হলো। ক্লান্ত লাগছে। বাড়ি ফিরব। কাছেই দশ মিনিটের হাঁটা পথ। ডিপার্টমেন্ট থেকে যখন বেরোচ্ছি, তখন চারদিক নিস্তব্ধ, সুনসান। আকাশের তারাগুলো আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকায়। বলে, ‘কী, কেমন লাগছে আমেরিকার স্বর্গ? কত ধানে কত চাল, বুঝেছ তো এবার?’
ফেল্মলি হল থেকে আমাদের কিংসলি স্ট্রিট – ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ধনাঢ্য, সাজানো ক্যাম্পাসের মাঝখানে চেরি, ম্যাপল, অ্যাশ, পপলার, বার্চ গাছে ঘেরা চত্বর – কোয়াড। জনশূন্য এখন। দিনের বেলা সুবেশা, সুন্দরী মার্কিনি যুবতী ও স্বাস্থ্যবান যুবকদের ভিড় আর হাসিঠাট্টায় মুখর হয়ে থাকে। সেখানে আমার প্রবেশাধিকার নেই। আমি গরিব বাঙালি ছাত্র। বয়সও ওদের চাইতে অনেক বেশি। আমি ঊনত্রিশ বছর বয়সে ঝুঁকি নিয়ে, ঝোঁকের মাথায় আমেরিকায় চলে এসেছি বাংলার মাটি জল ভালোবাসা আর কবিতার মায়া কাটিয়ে। আমি ওদের সঙ্গে মিশতে পারি না। আমি ভালো ইংরেজি বলতে পারি না। আমি ওদের সঙ্গে বারে গিয়ে ড্রিঙ্ক করতে পারি না। আমি ডর্মগুলোর উদ্দাম উইকেন্ড পার্টিতে গিয়ে ওদের সঙ্গে নাচতে পারি না। আমি আমাদের ইন্ডিয়ান ধনী পরিবারের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গেও তাল মিলিয়ে মিশতে পারি না। ওরা রাজনীতির আলোচনা করে না। কবিতা, অল্টারনেটিভ ফিল্ম বোঝে না। সব ভীষণরকম ক্যাপিটালিস্ট। অর্থ ও সম্পদ ওদের জীবনের ব্রত। রঙিন ম্যাগাজিনে ঝাঁ-চকচকে গাড়ির বিজ্ঞাপন দেখে ভরত আমাকে বলে, ‘বুঝলে, এরকম গাড়ি আমি কিনছি আর কয়েক বছরের মধ্যেই। কেমন, ভালো না? আই থিঙ্ক ইটস সোয়েল।’ বাড়ি, গাড়ি, ধন, সম্পদ, শেয়ারবাজারে মুনাফা। ওরা দেশকে যে-চোখে দেখে এসেছে, আমি সে-চোখে দেখিনি। আমি উত্তর কলকাতার ধূলিধূসর গলি থেকে উঠে আসা ছেলে। আমি সুন্দরবনের এক অতিপ্রত্যন্ত গ্রামের কলেজে চার বছর পড়িয়ে আসা, দারিদ্রে্যর সঙ্গে মুখোমুখি বসে কথা বলা ছেলে। আমার মা ক্যান্সারে মারা গেছে বিয়াল্লিশ বছর বয়সে বলতে গেলে কোনো চিকিৎসা ছাড়াই। আমার জীবনদর্শনের সঙ্গে ওদের মেলে না। আমি উদ্দাম ফান করতে পারি না। আমি ডেট করতে শিখিনি ওদের মতো।
তাছাড়া, আমি এখন বিবাহিত। দেশে পড়ে রয়েছে আমার স্ত্রী। সে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
দূরে হিউয়েট আর ম্যানচেস্টার রেসিডেন্স হলের বিরাট বিরাট উঁচু বাড়িতে আলো জ্বলে। সাতাশতলা উঁচু ডরমিটরি ওয়াটারসন টাওয়ার্সের মাথায় লাল সতর্ক আলো দপদপ করে। এখানকার
আকাশ কেমন যেন অতিরিক্ত স্বচ্ছ। কোথাও কোনো ধুলো নেই। রাতের আকাশের তারাগুলো যেন অতিরিক্ত উজ্জ্বল। মাঠের দিগন্তবিসত্মৃত ঘাসের লনগুলো যেন কেমন অতিরিক্ত সবুজ। অল্পবয়েসি টিনএজার আমেরিকান ছাত্রীরা কেমন যেন অতিরিক্ত স্বাস্থ্যবতী। মিডওয়েস্ট ইলিনয়ের কর্নবেল্টের ধনী পরিবারের আদুরে মেয়ে। আমার স্টুডেন্ট কয়েকজন আছে এসব ফ্যামিলি থেকে আসা।
ওই লিজ, ওই স্যামান্থা, ওই ডন, ওই ক্যারেন। শ্বেতাঙ্গ যুবতীদের গায়ের রং যেন অতিরিক্ত সাদা, আর তাদের ঢলঢল বুক যেন মোমের মতো মসৃণ, বাতাবি লেবুর মতো গোল। ফল সেমিস্টারে শুধু তাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই অনেক সময় কেটেছিল। তাদের রঙিন হালকা হালকা বড় বড় জামা। খোলা হাত, খোলা পা, ঊরুর অনেকটা ওপর পর্যন্ত তোলা আলগা আলগা শর্টস। ছেলেরাও তাই। টি-শার্ট আর শর্টস। প্রায় প্রত্যেক যুবতীর সঙ্গেই এক যুবক সঙ্গী। কেউ বয়ফ্রেন্ড, কেউবা এক হাই স্কুল থেকে পড়তে আসা বন্ধু কাম দেহরক্ষী।
আমার মতো বিদেশি গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট আর টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টদের প্রতি তাদের মনোভাব কিছুটা রেসপেক্ট, কিছুটা অনুকম্পা, কিছুটা উদাসীনতা, আর কিছুটা ওপর-ওপর ছুঁয়ে যাওয়া বন্ধুত্ব। দেখা হলে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় একটু হালকা হাসি, আর ‘হাই দেয়ার।’ আমাদের সঙ্গে তারা বেশি মিশতে চায় না। ডেট করতে চায় না নববই-পঁচানববই শতাংশ ছেলেমেয়ে। সেক্সচুয়াল স্বাধীনতা খুব বেশি, কিন্তু ভারতীয়রা – অন্তত আমার মতো শ্রেণি থেকে আসা ভারতীয়রা – এসব ব্যাপারে খুবই অনগ্রসর। আবার অতিঅগ্রসর ছেলেও আছে। পুনে থেকে আসা নরেন্দ্র। কংগ্রেসের লিডার ছিল দেশে। বিগ শট। পুরনো একটা মার্সিডিজ গাড়ি কিনেছে এখানে এসেই। ইন্ডিয়ান স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছে, এবং সঙ্গে সঙ্গে একাধিক মার্কিনি যুবতী গার্লফ্রেন্ড। শ্রীলংকার দু-একটা ছেলে। অতি খলিফা। কে বলবে, তারা পঁচাশি সালে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আসা ছাত্র? তারপর আছে ক্যারিবিয়ান থেকে আসা ভারতীয় বংশোদ্ভূত অ্যানড্রিয়া, আর তার সঙ্গী বিশালাকৃতি অরুণ, আর সব কে কে যেন। উদ্দাম নাচ ডর্মের রাতের পার্টিতে। আমাকেও নিয়ে গেছে দু-একবার। আলোছায়ার খেলা। উদ্দাম কানফাটানো মিউজিক। আমি মাঝপথে একা বাড়ি ফিরে এসেছি।
কয়েকজন সুন্দরী মার্কিনি যুবতী আমার খুব কাছে এসে তাদের উত্তাপ দিয়ে আমাকে দ্রবীভূত করার চেষ্টা করেছে। তাদের গায়ের মিষ্টি পারফিউমের গন্ধ আমাকে মাতাল করেছে। আর তারপরে মধ্যবিত্ত বাঙালির মধ্যবিত্ত সংস্কার আমাকে ফ্রোজেন করে দিয়েছে। মোহময়ী স্যারা আমার সঙ্গে স্টুডেন্ট ক্যাফেটেরিয়ায় কাপডিশ ধুতে ধুতে আমাকে অনেক প্রশ্ন করেছে। দুর্বলতা, কোমলতা দেখিয়েছে। কফি খেতে, পিৎজা খেতে নিয়ে গেছে। তারপর আমি ওকে ওর ডর্ম ওয়াকার হলে পৌঁছে দিয়েছি। ওর চোখের তারা আশায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেই আবার নিভে গেছে। অ্যান আর লিসা তাদের চার্চে আমাকে নিয়ে গেছে। সানডে বাইবেল স্কুলেও নিয়ে গেছে। কিন্তু খ্রিষ্টের প্রতি আমার উদাসীনতা দেখে হতাশ হয়েছে।
আমি একা। ভীষণভাবেই একা।
চট্টগ্রামের আবু হায়দার বিরাট ধনী ব্যবসায়ীর ছেলে – শুনেছি ওখানে ওদের গাড়ির কারখানা আর শোরুম আছে, কলকাতা থেকে আমার সঙ্গে পড়তে আসা উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়ে সুনীতা, আর আমার রুমমেট সায়েন্স কলেজে আমার দু-তিন বছরের জুনিয়র রঞ্জন গুপ্ত – এই তিনজন মাত্র এখানে বাঙালি। ছোট্ট স্কুল আইএসইউ। নরমাল-বস্নুমিংটন টুইন সিটির নরমাল অংশে ইউনিভার্সিটি। বস্নুমিংটনে কদাচিৎ যাওয়া হয়।
স্প্রিং সেমিস্টারে আলাপ হলো কেরালার ইয়ং ডাক্তার রবি কাটুর ও তার স্ত্রী রাধার সঙ্গে। আমার একাকিত্ব দেখে ইউনিভার্সিটিতে কথা বলে তাঁদের হোস্ট ফ্যামিলি হওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন আমার জন্য। অর্থাৎ, বিদেশ বিভুঁইয়ে তাঁরা আমার দেখাশোনা করবেন স্বেছায়।
দু-চারবার ওঁদের বস্নুমিংটনের বাড়ি গেলাম ওঁদেরই বদান্যে। সদাশয়, শিক্ষিত ফ্যামিলি। সত্যজিৎ রায় আর রবি ঠাকুরের ভক্ত। বাংলা গান আর বাংলা সিনেমার ভক্ত। আমাকে গান গাইতে হলো বেশ কয়েকবার তাঁদের অনুষ্ঠানে। বিশাল প্রাসাদের মতো বাড়ি। বিশাল গাড়ি। কখনো এত বড় বাড়ি দেখিনি। এত বড় স্ক্রিনের টিভিও দেখিনি। সেই টিভিতে ভিডিও ক্যাসেট চালিয়ে হিন্দি সিনেমা দেখা। গৌতম ঘোষের পার। নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরী, শাবানা আজমি। হাসি, গল্প, খাওয়া-দাওয়া হয়তো দু-সপ্তাহে একদিন।
কিন্তু, তাও আমি একা। ভীষণভাবেই একা।
ছিয়াশির আগস্টের গোড়ায় মুক্তি এসে পৌঁছল বিশ্বদার স্পন্সরশিপে। আর, আমাদের ডিপার্টমেন্টের মালয়ালি খ্রিষ্টান প্রফেসর ডক্টর নাডাকাভুকারেনের পাঠানো এক আমন্ত্রণে। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলে ডিপার্টমেন্টকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছেন, পার্থ লেখাপড়ায় ও কাজে আরো অনেক বেশি সাফল্য লাভ করতে পারবে, যদি সে তার স্ত্রীকে এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে পারে। এক বছরেই আমি বোধহয় আমার বায়োলজি প্রফেসরদের কিছুটা ইমপ্রেস করতে পেরেছিলাম আমার ভাঙা ভাঙা ইংরেজি দিয়ে এবং রাত জেগে ল্যাবে কাজ করার বাসনা ও পরিশ্রম দেখিয়ে। মুক্তি এসে পৌঁছল শিকাগো ও’হেয়ার এয়ারপোর্টে। বিরাট ভারী সুটকেস আর শাড়ি পরা বাঙালি মেয়ে। একবছর দেখিনি ওকে। আমরা দুজনেই নির্বাসিত ছিলাম। আমি আমেরিকায়, ও কলকাতায়।
আর, তারপরে আমাদের মেয়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছল সাতাশি সালের জুলাই মাসের ভীষণ গরমের মধ্যে। সেই একই ইলিনয়। সেই একই শিকাগো। সেই একই নরমাল। জুলাই আর আগস্ট মাসে সেখানেই কী ভীষণ গরম! টেম্পারেচার চল্লিশ ডিগ্রি। ফারেনহাইটে একশ পেরিয়ে যাওয়া ঝাঁ ঝাঁ কান পোড়ানো গরম। সেখানেই, মেয়ে হওয়ার ঠিক এক সপ্তাহের মাথায়, মুক্তির
পোস্ট-পার্টেম জটিলতা দেখা দিলো। সম্পূর্ণ ডাক্তারের গাফিলতিতে। মায়ের প্রাণসংশয়। এক সপ্তাহের এতটুকু ছোট্ট পুতুলের মতো মেয়ে এখন মাকে হারাতে বসেছে।
মার্কিন হাসপাতালে, মার্কিন শ্বেতাঙ্গ ডাক্তারের হাতে সন্তানপ্রসবের সময় চরম অবহেলা। আনক্লিন প্ল্যাসেন্টায় কয়েকদিনের মধ্যেই ভয়ংকর ইনফেকশন। অস্বাভাবিক রক্তপাত। মুক্তিকে এক্ষুনি জরুরি অপারেশন করতে হবে। হয়তো ও বাঁচবে। হয়তো ও বাঁচবে না। আমরা যদি বিদেশি ও কৃষ্ণবর্ণের না হয়ে, দরিদ্র ছাত্র না হয়ে শ্বেতাঙ্গ মার্কিন নাগরিক হতাম, এত অবহেলা কি করা হতো? আজকে এতকাল আমেরিকায় থাকার পর মনে হয়, একেবারে কোর্টে বিশাল ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করার কেস। আমরা কিছু করিনি। কেউ আমাদের বলে দেয়নি। পরামর্শ দেয়নি। ওই হোস্ট ফ্যামিলির সুখী সুখী রবীন্দ্রসংগীতপ্রেমিক, সত্যজিৎপ্রেমিক ডাক্তার ও তাঁর স্ত্রী বলতে পারতেন। পরামর্শ দিতে পারতেন। ওঁরা অনেক আইনজীবীকে চিনতেন। ভারতীয়দের মধ্যেই ছিলেন আইনজীবী। কিন্তু স্কুলের বিরুদ্ধে যাওয়ার সৎসাহস তাঁরা দেখাননি। আমাদের পাশে এসে দাঁড়াননি।
সে-রাতে ব্রকো হসপিটালের সেই আধো-অন্ধকার ঘরটায় আমার মাত্র আটদিনের বাচ্চা ঘুমন্ত মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছিলাম, মুক্তি যদি আর ফিরে না আসে, এই ফুলের কুঁড়ির মতো মেয়েটাকে নিয়ে আমি কী করব? কোথায় যাব? অনেক সংকট পেরিয়ে সবকিছু পেছনে ফেলে রেখে আমেরিকায় এসেছি। কত ঝুঁকি, কত ফেলে আসা জীবন – ভালোবাসা, স্নেহ, পরিবার, বন্ধু, সমাজ। সব ফেলে রেখে এক নির্জন, প্রত্যন্ত, নির্বাসিত জীবন। একটু একটু করে আবার স্বাভাবিক, সুন্দর হতে শুরু করেছিল সবেমাত্র। ভয়ংকর শীতের বরফ গলতে শুরু করেছিল সবেমাত্র।
আবার সবকিছু চিরকালের মতো শেষ হয়ে যাবে? জীবনের সব রং হারিয়ে যাবে চিরতরে?
কলকাতায় সবাই এখন দিনের বেলা নানা কাজ করছে। রোদ, সূর্য, আলো। বাংলা নামে দেশ। হাওড়ার সেই সরু গলিটায় বাচ্চারা দৌড়াচ্ছে, ডাংগুলি খেলছে। সাইকেল-রিকশা অতি সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে প্যাঁক প্যাঁক হর্ন দিয়ে। দোকান, বাজার, হাওড়া ব্রিজের নিচটায় সেই রোজকার মতো ট্রাফিক জ্যাম। লোকাল ট্রেনগুলো একে একে লম্বা লম্বা ইলেকট্রিক আঁকশিগুলো দিয়ে মাথার ওপরের তার ছুঁয়ে ছুঁয়ে স্টেশনে এসে থামল। জনস্রোত। জীবনসংগ্রামের সেই আশ্চর্য সুন্দর ছবিটা।
বাংলাদেশ। ভারতবর্ষ। কলকাতা। রোদ, সূর্য, আলো। বাংলা নামে দেশ।
মুক্তির বাবা হয়তো সেই পুরনো টেবিলটায় রেখে তার প্রিয় গণশক্তি পড়ছেন। ওর মা রান্না করছেন, আর মাসির সঙ্গে
সুখ-দুঃখের গল্প করছেন। এখন সে-গল্পের সবটাই মেয়ে ও নাতনিকে ঘিরে। নাতনি এসেছে। নিশ্চয়ই কিছুদিনের মধ্যেই মেয়ে নাতনিকে নিয়ে আসবে দাদু-দিদার কাছে।
আর এখানে, মুক্তি, আমি, আর আমাদের ছোট্ট মেয়ে ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখোমুখি।
জটিল অস্ত্রোপচার চলছে এখন। কেউ জানে না। কেউ জানে না।