বাংলাদেশের নানা প্রান্তিক এলাকার শিশু-কিশোরদের যুক্ত করে তাদের জন্য চারুশিল্পকে শিক্ষামূলক, আনন্দময় ও জাতি গঠনে সংস্কৃতিবান মানুষ গড়ার ব্রত নিয়ে চারুকলা উৎসবের আয়োজন করে চলেছে আর্ট বাংলা ফাউন্ডেশন নামে একটি বেসরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক শিল্পী মোহাম্মদ ইউনুস প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান এবং সহযোগী অধ্যাপক হারুনর রশিদ টুটুল মহাপরিচালক। ২০১৬ সালে শুরু করে গত সাত বছরে তাঁরা চারটি চারুকলা উৎসব করেছে চারটি জেলায়। প্রথমটি জয়পুরহাটের তেঘর উচ্চ বিদ্যালয়ে, দ্বিতীয়টি ২০১৮ সালে নীলফামারীর নীলসাগর দীঘির পাড়ে, ২০১৯ সালে তৃতীয় আয়োজন হয় ঢাকার অদূরে গাজীপুরের ভাওয়াল মির্জাপুর হাজি জমিরউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে।
কোভিড অতিমারির কারণে দুই বছর বিরতির পর ২০২২ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭শে ডিসেম্বর ময়মনসিংহে ছিল চতুর্থ আয়োজন। ওই উৎসবের প্রতিপাদ্য ছিল – ‘ঐতিহ্যের ছোঁয়ায় শিল্পিত আগামী’। ২৫শে ডিসেম্বর দুপুরে ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বিজিবি পার্কে আয়োজিত উৎসব উদ্বোধন করেন বিশ্ববরেণ্য বাঙালি চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ ও সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি।
উৎসবের তিনদিন ধরে দুই শতাধিক শিশু-কিশোরসহ স্থানীয় শিল্পীরা ঢাকা থেকে আসা বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে দিনভর ছবি এঁকেছেন, আর্ট প্রজেক্ট করেছেন, শিল্পের আলোচনা শুনেছেন, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা দেখেছেন ও নিকটবর্তী বিদ্যালয়ে রাত কাটিয়েছেন। ঢাকায় বসবাসকারী বিশিষ্ট চারুশিল্পীরা ছবি আঁকার পাশাপাশি স্থানীয় সংস্কৃতিসেবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন, তাঁদের সাংস্কৃতিক পরিবেশনা উপভোগ করেছেন। বরেণ্য শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়ে স্থানীয়রা তাঁদের ছবি আঁকতে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছেন!
অনুপ্রেরণাদায়ী এই আয়োজনে অংশগ্রহণকারী হিসেবে রুশ প্রজাতন্ত্রের দুজন – তাতিয়ানা সভেৎকিনা, এলিজাবেথ তারাশোভা; ভারতীয় তিনজন – বিদ্যাসাগর উপাধ্যায়, বিনয় শর্মা, ব্রিজেশ কাটিয়ার এবং বাংলাদেশের পঁয়ত্রিশজন চারুশিল্পীর সঙ্গে আমি নিজেও যুক্ত ছিলাম এ-দলে।
এদেশের অন্য শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন – প্যারিসপ্রবাসী শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ, কানাডাপ্রবাসী শিল্পী একেএম আলমগীর, জামাল আহমেদ, রেজাউন নবী, সৈয়দ হাসান মাহমুদ, শিশির ভট্টাচার্য্য, নাজমা আকতার, মিনি করিম, গুলশান হোসেন, দিলরুবা লতিফ, সন্জীব দাস অপু, মো. জহিরউদ্দিন, রুবিনা নার্গিস, আনিসুজ্জামান, শফিকুল কবির চন্দন, আজমীর হোসেন, গুপু ত্রিবেদী, রাশেদ হুদা, সুশান্ত অধিকারী, কামাল উদ্দিন, আবদুস সাত্তার তৌফিক, রাশেদ সুখন, সৌরভ চৌধুরী, দ্রাবিড় সৈকত, দিদারুল লিমন, মনজুর রশিদ, জিয়াউর রহমান, হাসুরা আকতার, নাজ নাজিয়া প্রমুখ।
গত ১৭ই জুলাই ২০২৩ ময়মনসিংহ উৎসবে অঙ্কিত চিত্রকর্মের ছয় দিনব্যাপী প্রদর্শনী শুরু হয় চারুকলা অনুষদের জয়নুল গ্যালারিতে। গ্যালারিতে ঢুকে দেখা গেল, বিশিষ্ট শিল্পীদের চিত্রকর্মের পাশেই শিশু-কিশোর শিল্পীদের আঁকা ছবি শোভা পাচ্ছে। এটি অভিনব যেমন, তেমনি নতুন প্রজন্মের জন্য উৎসাহব্যঞ্জকও বটে!
ময়মনসিংহেই দেখেছিলাম শাহাবুদ্দিন আহমেদ বড় এক ক্যানভাসের তল থেকে রংতুলি নিয়ে ওপরদিকে গতিময় হাত চালিয়ে আঁকলেন মুক্তিযোদ্ধার আক্রমণোদ্যত এক ভঙ্গি! সেটি ঝুলছে জয়নুল গ্যালারির দেয়ালে। একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পী জামাল আহমেদ এঁকেছিলেন ব্রহ্মপুত্র নদ আর এর নৌকা, নৌকার মাঝি। রেজাউন নবী নদী ও নিসর্গের মূর্ত-বিমূর্ত রূপকে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। শিশির ভট্টাচার্য পোড়ামাটি রঙে চিত্রপট রঞ্জিত করে কালো কালিতে তাঁর স্বকীয় অঙ্কনশৈলীতে আমাদের সমকালীন জীবনের নানা অসংগতি তুলে ধরেছেন।
সৈয়দ হাসান মাহমুদ দুটি ক্যানভাস জোড়া দিয়ে জলরঙে রাতের রঙিন নগরের প্রেক্ষাপটে সাদা কাগজের তিনটি রকেট দিয়ে একটা আলোছায়ার রহস্যময়তার সঙ্গে গতির টান টান উত্তেজনা তৈরি করেছেন। আমি দুটি চিত্রপটে প্রকৃতির
মূর্ত-বিমূর্ত রূপের রহস্যকে অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি। গুলশান হোসেন নিসর্গের রূপের ডালাকে সাজিয়ে তুলেছেন। মিনি করিম স্পেটুলা দিয়ে বাহারি বর্ণে চিত্রপটকে রাঙিয়েছেন। দিলরুবা লতিফও নিসর্গ, বিশেষ করে ফুলের নান্দনিকতা তুলে ধরেছেন। সন্জীব দাস অপু, জহিরউদ্দিন ও রুবিনা নার্গিস নিজ নিজ স্টাইলে প্রকৃতি ও তার উপাদান নিয়ে এঁকেছেন। রুশ শিল্পী তাতিয়ানা ব্রহ্মপুত্রের বুকে স্থাপন করা কাপড় দিয়ে নির্মিত একটি ডানা মেলা পাখি ও এর আশপাশকে এঁকেছেন। এলিজাবেথ তাঁর দুটি চিত্রপটেই নদকেন্দ্রিক নিসর্গকে সরলভাবে উপস্থাপন করেছেন। ভারতের শিল্পী বিদ্যাসাগর উপাধ্যায় রঙিন ঘুড়ি ও ঝুড়ির ছবি এঁকেছেন। বিনয় শর্মা প্রাচীনকালের দলিল ও পুঁথি নিয়ে কাজ করেছেন। ব্রিজেশ কাটিয়ার আকাশ আবহে বর্ণিল রেখায় নৌকোর গলুই এঁকেছেন।
ব্রহ্মপুত্র নদ ও নদের তীরে বিজিবি পার্কে বেশ কয়েকটি শিল্পিত স্থাপনা করেছিলেন নবীন ও তরুণ শিল্পীরা। এতে উৎসবস্থল হয়ে উঠেছিল বর্ণিল ও ব্যতিক্রমী। নদের বুকে জলপুতুল পাপেটস নামে স্থাপনা ও পারফরম্যান্স করেছেন একদল নবীন শিল্পী। এ-দলে ছিলেন – রায়হান আহমেদ রাফি, শাহরিয়ার শাওন, আবদুল মুকিত, আসিফ চৌধুরী ও সৈয়দা ফিরোজা খানম রুমি। উত্তম কুমার রায় ও মৌসুমী আকতার মনিকা গড়েছেন ময়মনসিংহ গীতিকার ‘মহুয়া’কে ভিত্তি করে আঁকা বড় বড় চিত্রসমেত এক স্থাপনা। অসীম হালদার সাগর লাল ইট রঙের এক লেপ ঝুলিয়ে লেপের মাঝখানটা বৃত্তাকারে পুড়িয়েছেন। সেই বৃত্ত দিয়ে দেখা যায় নদ। মাটির কয়েকটি চুলা সাজিয়ে ‘যাপনের উত্তরাধিকার’ নামে স্থাপনা করেছিলেন নাজমুল হাসান নয়ন। মাটির চিত্রিত কলস উল্টে মাথা জ্ঞান করে নানা বর্ণের বস্ত্রে সেগুলি দাঁড় করিয়ে কাকতাড়ুয়ার মতো রূপ দিয়েছেন, এর শিরোনাম ‘যাত্রা’। খড় ও বাঁশের তালাইবেড়া দিয়ে ‘মাতৃগর্ভের মত’ নামে এক স্থাপনা গড়েছেন কয়েকজন মিলে। তাঁরা হলেন – মুজাহিদ মুসা, সজল সরকার, মহসিন কবির হিমালয় ও অপু রাজবংশী। আশানা নাসরিন হক অঙ্গনা কয়েকটি পাতলা সাদা কাপড় লম্বা করে ঝুলিয়ে এর নাম দিয়েছেন ‘পবিত্রতা’। এটি তাঁর স্থাপনা। মাটির পাত্রে হাতের ছাপ দিয়ে গাছের ডালের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধেছেন অয়োময় নাসরিন হক অরণ্য। বাঁশ চিড়ে বৃতিগুলি ছড়িয়ে দিয়ে ‘ঝুলন্ত আত্মা’ শিরোনামে স্থাপনা গড়েছেন জাহিদ হোসেন। ‘ফ্রাগমেন্টেড ইউনিটি’ নামে কাঠ ও দড়িদড়া বেঁধে এক স্থাপনা গড়েছেন কাজী সালাউদ্দিন। জলপথের বাহন নৌকা ও লোককাহিনি লেখা পালের রূপক স্থাপনা গড়েছেন মেহেদি মাসুদ, নাম দিয়েছেন – ‘গল্পগাঁথা’। তাহমিনা হাফিজ লিসা মৃৎশিল্পের প্রাচীন সভ্যতা নির্দেশ করে গড়েছেন ‘পদচিহ্ন’।
সবমিলে শিল্পী ও সমঝদারদের সৃজন এবং পদভারে, কিশোর-কিশোরীদের কলকাকলিতে মুখরিত অনন্য এই উৎসব ছিল বাঙালি সংস্কৃতিকে নতুন করে দেখার আশায় এক দীপ্ত আয়োজন।
চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঘোষিত হলো, আগামী উৎসব আয়োজন হবে বাগেরহাটের রামপালে শিল্পী মোস্তাফিজুল হকের তত্ত্বাবধানে। আমরা আরো একটা চমৎকার শেকড়সন্ধানী আয়োজনের অপেক্ষায় থাকলাম।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.