আর কি হবে মানবজনম

আহমাদ মোস্তফা কামাল

শহরের ব্যস্ত এবং পুরনো এক মার্কেটের প্রবেশপথের পাশে ছোট্ট একটা দোকান, আর সেখানেই দিনরাত উজার করে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে অনিমেষ। ছোট দোকান হলে কী হবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে একেবারে ঠাসা। এমন কোনো জিনিস নেই যা সংসারের দৈনন্দিন কাজে লাগে অথচ এখানে পাওয়া যায় না, তবে দোকানটি বিখ্যাত তাদের নিজস্ব বেকারির তৈরি খাদ্যসামগ্রীর জন্য। প্রায় চার যুগের পুরনো ব্যবসা, কত নতুন নতুন জিনিস এলো, বাহারি মোড়কে মোড়ানো কত রংচঙে প্যাকেট এলো, তবু এই দোকানের পুরনো ক্রেতারা তাতে প্রলুব্ধ হলেন না, অবিচলভাবে তারা রয়ে গেলেন পুরাতনপ্রেমী। এত বছর ধরে ব্যবসাটিকে একই মানে ধরে রাখার জন্য এর পেছনে জীবন ব্যয় করে দিতে হচ্ছে অনিমেষকে। বড় কষ্টের এই জীবন, বেদনায় ভরা জীবন, যে-জীবনে কখনো বিরতি বলে কিছু নেই, অবসর বলে কিছু নেই। নেশাগ্রস্তের মতো, ভূতে-পাওয়া মানুষের মতো দিনরাত শুধু খেটে মরা। এতটার প্রয়োজন নেই, আবার আছেও। এমন একটা ব্যবসা, চালু না রাখলে ধসে পড়বে, তখন সবকিছু সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বড়ো সংসার – বুড়ো মা, বিধবা বোন আর তার ছেলেমেয়ে, ছোট ভাই আর তার সংসার, নিজের সংসার, অসচ্ছল আত্মীয়স্বজন – সবাই কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তার ওপর নির্ভর করে আছে। অথবা কারণটা অজ্ঞাত নয়, সে জানে – সহযোগিতা আর মমতার হাত বাড়িয়ে দেয় বলেই সবাই ভরসা করে তার ওপর। জগতের নিয়ম – যে বেশি করবে তার ওপরেই সবাই নির্ভর করবে, পান থেকে চুন খসলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগও করবে, অথচ যারা কোনো দায়দায়িত্বই নেয় না কোনোদিন, তাদের নিয়ে মুখও খুলবে না কেউ। এত দায় মাথায় নিয়ে বসে থাকা কঠিন। আর ওই যে ব্যবসা, ছোট্ট ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হলে কী হবে, রমরমা বেচাকেনা, একদিন বন্ধ মানে হাজার হাজার টাকার ক্ষতি, পরিচিত-পুরনো কাস্টমারদের এসে ফিরে যাওয়া – এসবই তো মাথায় রাখতে হয়! তাই বছরের প্রতিদিনই খোলা, একদিনও ছুটি নেই। কর্মচারীদের পালাক্রমে ছুটি দেওয়া হয়, সপ্তাহে একদিন এবং ছ-মাস পরপর সাতদিন। কিন্তু নিজে কখনো ছুটি নেয়নি অনিমেষ, বরং প্রতিদিনই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দোকানে দাঁড়িয়ে-বসে থাকে। দাঁড়িয়েই থাকতে হয় বেশিরভাগ সময়। এত বেশি ক্রেতা আসেন প্রতিদিন, অধিকাংশই মুখচেনা, তাদের সঙ্গে কেবল লেনদেনের সম্পর্ক রাখলে তো চলে না, দু-চারটে কুশল বিনিময়ের কথাও বলতে হয়। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা-দুটোতে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে, ফুলে ভারী হয়ে থাকে। একটু বিশ্রাম পেলে তীব্র ব্যথায় কাতরায় অনিমেষ, তবু কারো কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়ার উপায় নেই। ক্যাশবাক্স আগলাবে কে? কাঁচা টাকার ব্যাপার, কারো ওপর ভরসা করা যায় নাকি? ভাইটা অকর্মার ধাঁড়ি, দু-চারদিন তাকে বসিয়ে দেখেছে অনিমেষ, সব গুবলেট করে ফেলে। রোজগারে মন নেই ওর, নেই সংসারেও। মাথার ভেতরে গানের পোকা, কেবল গান আর গান, তবু যদি ওদিকে কিছু করতে পারতো তাহলে একটা সান্ত্বনা পাওয়া যেতো। পারেনি। নিজে বসে বসে ঘোড়ার ডিম পাড়বে আর মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করবে। ওরা কত অসৎ, কত বদমাশ, কত ধান্ধাবাজ, কে কবে ওর গান মেরে দিয়েছে, কে কবে কাকে পথে বসিয়েছে, এইসব। তা, তুমি কী করেছ বাপু? এ-প্রশ্নের উত্তর নেই। ভাইটার জন্য দুঃখ হয় অনিমেষের। নিজে কিছু হতে পারেনি, ভাইটা যদি একটু ওপরের দিকে উঠতো, বড়ো শান্তি পেতো সে। কী আর করা! মুখ বুজে মেনে নিয়েছে এইসব। একটা দুর্যোগেই সব এলোমেলো হয়ে গেছে, কিছুই আর আগের মতো হবে না। সে নিজেও তো এই দোকানদারির জীবন চায়নি। পড়াশোনা শেষ করে বেরুতে না বেরুতে বাবা আর জামাইবাবু চলে না গেলে জীবন এরকম হতোও না। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল – ছেলেরা পড়াশোনা করে বড় কোনো চাকরি করুক, তার নিজেরও ইচ্ছে ছিল সরকারি চাকরিতে যাওয়ার, প্রস্ত্ততিও নিচ্ছিল বিসিএস যুদ্ধে নামার। পরিবারে আর্থিক সংকট যেহেতু নেই, সৎ থেকেও সম্মানজনক ও আকর্ষণীয় একটা জীবনযাপনের সুযোগ আছে ওই চাকরিতে। প্রথমদিকে একটু কষ্ট হলেও ওপরের দিকে উঠলেই যেসব সুবিধা পাওয়া যায়, এই দেশের প্রেক্ষাপটে তা অতুলনীয়। সারাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে, সরকারি প্রটোকল নিয়ে – নিজেকে এইভাবে কল্পনা করতে ভারি ভালো লাগতো তার। কিন্তু হলো না। হবে কীভাবে? নিয়তির ইচ্ছে যে অন্যরকম! বাবার নিজের হাতে তৈরি করা এই ব্যবসা রক্ষা করার দায়িত্ব বর্তালো তারই কাঁধে। স্বাধীনতার আগে, সেই বিরূপ সময়ে, সব আত্মীয়স্বজন যখন এদেশ ছেড়ে পাশের দেশে পাড়ি জমাচ্ছে তখন বাবা আরো শেকড় গেড়ে বসার জন্যই যেন এই দোকানের জন্য ছোট্ট জায়গাটুকু কিনলেন। সেইসঙ্গে একটা বেকারিও স্থাপন করলেন – বিস্কুট, পাউরুটি, বনরুটি, কেক, বাটারবন, ক্রিমরোল এইসব বানানো হতো সেখানে, চায়ের পাতা আনানো হতো সিলেটের এক আত্মীয়ের চা-বাগান থেকে, আর নিজেদের এইসব পণ্য বিক্রি করেই এই ছোট্ট দোকানটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মানের প্রশ্নে বাবা কখনো আপস করেননি, ক্রেতাদের সঙ্গে রক্ষা করেছেন দারুণ সুসম্পর্ক। তখন এই শহর এত ব্যস্ত ছিল না, একে অপরের ভালোমন্দের খোঁজখবর রাখতেন, একে অপরের বাসায়ও যেতেন। বাবাও এইসব সামাজিকতা রক্ষা করে চলতেন। আশেপাশের এলাকার প্রায় সব বাসিন্দাই ছিল তার ক্রেতা। তখন এত মার্কেট ছিল না, সুপারশপ ছিল না, এত প্যাকেটজাত খাদ্যবস্ত্তও ছিল না। ফলে তাঁর ব্যবসাটা জমে যায়। কিন্তু বয়স হয়ে যাচ্ছিল তাঁর, একা সামলাতে পারছিলেন না, পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটবে বলে দুই ছেলেকেও কখনো দোকানে বসাননি। ডেকেছিলেন মেয়ের জামাইকে, তিনিও সানন্দে শ্বশুরমশাইকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। কলেজে শিক্ষকতা করতেন তিনি, অন্যসব চাকরির মতো অতটা চাপ ছিল না কাজের, বেশ খানিকটা সময় পেতেন, ছুটিছাটাও ছিল প্রচুর, ফলে সময় দিতে সমস্যা হয়নি। বাবাও হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। কিন্তু সুসময় রইলো না বেশিদিন, হঠাৎই এক ভীষণ বিপর্যয় এসে বিঘ্ন ঘটালো। গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় জামাইবাবু মারা গেলেন। সেই শোক সইতে না পেরে বাবাও শয্যা নিলেন, আর মাস-তিনেকের মাথায় চলেও গেলেন। এত দ্রুত ঘটে যাচ্ছিল ঘটনাগুলো যে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব ভার এসে পড়লো অনিমেষের কাঁধে। বাবার চালু ব্যবসাটা বাঁচাতে হবে, সংসার বাঁচাতে হবে, উপর্যুপরি শোককে সামাল দিতে হবে। পরিবারের বড়ো ছেলে হলে যা হয় আর কি! সামাল সে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু নিজের স্বপ্নটপ্ন বিসর্জন দিয়ে, কিংবা নিজের জীবনকে একটা দোকানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে। তার সহপাঠী বন্ধুরা কত ওপরে উঠে গেছে একেকজন, তার জীবন কেটে গেলো এই দোকানের ভেতরেই! অথচ তার ছিল ঘুরে বেড়ানোর নেশা। একসময় বন্ধুদের সঙ্গে সারাটা দেশ চষে বেড়িয়েছে সে। সেইসব দিন! আহা! ওইদিন কি কখনো তার জীবনে এসেছিল?

এত যে কষ্ট করে সে, নিজেকে উজার করে দেয়, তবু বাসায় এসে শান্তি মেলে না। ঘরে খিটখিটে মেজাজের বউ, মেজাজ সবসময় চড়েই থাকে তার। সবার বিরুদ্ধে তার অজস্র অভিযোগ। আর হবেই বা না কেন? যার যত অসুবিধা আর ঝামেলা, সব এসে পড়ে তার কাঁধে, সামাল দিতে হয় শক্তভাবে। কাঁহাতক আর সহ্য হয়? অনিমেষ দু-একবার বলেছে –  এত রেগে থাকো কেন গো বউ? কেন এত অভিযোগ করো?

বউ ঝংকার দিয়ে উঠেছে – করবো না কেন? এতকিছু করি ওদের জন্য, এত টাকাপয়সা খরচ করি…

টাকাপয়সা তো তোমার নয় বউ!

আমার নয়! তোমার টাকা কি আমার টাকা নয়?

আমারটুকু অবশ্যই তোমার। কিন্তু এ-টাকা যে আমারও নয়। এ যে বাবার ব্যবসা।

তো কী হয়েছে? তুমি না দেখলে এসব থাকতো? লুট হয়ে যেতো না?

তা যেতো। কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব নিতেই হয়। আমার তো এ নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই।

তোমার নেই বলে আমারও থাকবে না? এত কষ্ট করো, জীবনটাকে কাটিয়ে দিলে এই ব্যবসা ব্যবসা করে, আমার খারাপ লাগে না?

লাগে। বুঝি তো! কিন্তু যতটুকু করো সেটুকুর গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায় ওই রাগের ফলে। রাগ যে আগুন, সব পুড়িয়ে ফেলে, তুমি বোঝো না?

বউ চুপ করে থেকেছে, কিন্তু সংশোধন হয়নি। অনিমেষও হাল ছেড়ে দিয়েছে। করুক যা ইচ্ছে তাই। এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তার নেই। ভাগ্য ভালো যে, অভাব নেই সংসারে, বরং অনেকের চেয়ে বেশি সচ্ছলতা আছে, ফলে ওরকম কোনো অভিযোগও তাকে শুনতে হয় না। দোকানটা যেন সোনার খনি, এত পয়মন্ত যে, মনে হয় – মা লক্ষ্মী এসে আসন গেড়েছেন ওখানে!

শান্তি এটুকুই যে, এখনো মা বেঁচে আছেন, যাঁকে দেখলে শান্ত হয় মন, যাঁর হাসিমুখ দেখে মনে হয় এত কষ্ট বৃথা যায়নি। সে প্রতিদিন ফিরে মায়ের কাছে কিছুক্ষণ বসে, টুকিটাকি গল্প করে, সারাদিনের ফিরিস্তি শোনে। আরেকটা আনন্দ আছে। মাকে দেখাশোনার জন্য ছোট্ট একটা মেয়ে আনা হয়েছে গ্রামের বাড়ি থেকে, আরতি, মায়ের সঙ্গে পুটুরপুটুর গল্প করা ছাড়া আর কোনো কাজকর্ম নেই তার। কিন্তু অনিমেষ বাসায় এলেই আরতি চঞ্চল হয়ে ওঠে। লুঙ্গি-গেঞ্জি এগিয়ে দেয়, বাথরুমের সামনে তোয়ালে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, খাওয়ার সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকে, খাওয়া শেষে সে যখন শরীর এলিয়ে দেয় বিছানায় বা টিভি দেখতে বসে ড্রয়িংরুমে তখন আরতি বসে পড়ে তার পায়ের কাছে। কবে যেন বলেছিল, সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে খুব ব্যথা করে, তারপর থেকেই প্রতিদিন নিয়ম করে তার পা টিপে দেয় আরতি। অনিমেষের অস্বস্তি লাগে, এইটুকুন একটা মেয়ে, নিজের মেয়ের মতোই, পায়ে হাত রাখলেই তো অপরাধবোধ হয়। কিন্তু আরতি নাছোড়বান্দা, সেবা সে করবেই। অদ্ভুত ভাষায় কথা বলে মেয়েটা, একা একাই গান গায়, জিজ্ঞেস করলে বলে – তার বাবা নাকি বাউল ছিল, তার কাছ থেকে শিখেছে। অনিমেষ যতই বলে – লাগবে নারে আরতি, তুই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়; আরতি উলটো শুনিয়ে দেয় – আপনার পায়ে হাত দিলে যে আমার পুণ্য হয় কাকাবাবু।

কেন রে? তা কী করে হবে? আমি যে অতি সামান্য মানুষ।

আপনার মনটা যে বড়ো ভালো গো কাকাবাবু, কালি পড়ে নাই, দাগ পড়ে নাই। আপনার পা ধরলে মনে হয় যেন গুরুর চরণ ধরলাম। তারপর গান ধরে – কবে গুরুর চরণ ধূলি লাগবে গায়।

তার ধন্দ লাগে। এই মেয়েটা মন চেনে কীভাবে? আর তার মনে দাগ পড়েনি, কালি পড়েনি এইসব কথাই-বা এত দৃঢ়তার সঙ্গে বলে কীভাবে? সারাদিন হাজার রকমের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয় তাকে, সবই বৈষয়িক কথাবার্তা, মনের দিকে ফিরে তাকানোরও তো সুযোগ মেলে না। মনকে শুদ্ধ করা, নির্মল করা, পবিত্র করার জন্য     যে-সাধনার দরকার সে তো তার ধারেকাছেও যেতে পারে না। আরতির কথা শুনে তার আফসোস বাড়ে। কী একটা জীবন, নিজের দিকে ফিরে তাকানোরও একটু সুযোগ মেলে না! বরং প্রতিদিন নতুন নতুন ঝামেলা এসে সামনে দাঁড়ায়। আত্মীয়স্বজন নানা ধরনের সমস্যা নিয়ে আসে। সে-সবের অধিকাংশই সংখ্যালঘু হওয়ার সংকট থেকে উদ্ভূত। সে-বোঝানোর চেষ্টা করে – এদেশের মানুষ ভালো নেই, হিন্দু-মুসলমান সব মানুষই নানা সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তুমি হিন্দু বলে এত ছোট হয়ে থাকো কেন? মাথা উঁচু করে বাঁচো।

কিন্তু বৃথাই এসব সান্ত্বনা। তারা আর এই দেশে থাকতে চায় না, বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার আবদার করে। যেন চাইলেই সে সব আবদার পূরণ করতে পারবে! বাধ্য হয়েই সে তাদেরকে আশেপাশে কোথাও বাসা খুঁজে নিতে বলে, সমস্যা হলে সে দেখবে বলে কথা দেয়। তারা ভরসা পায়। এই করে করে এই পাড়ায় আত্মীয়রা জড়ো হয়ে গেছে। মিলেমিশে থাকতে চায়। একা থাকতে ভয় লাগে! কেন যে এত ভয়! অবশ্য তাতে সুবিধাই হয়েছে – মায়ের সময় কাটাতে সমস্যা হয় না, গল্প করার লোকের অভাব হয় না। আবার উলটোদিকে আতিথেয়তার ব্যয় বেড়েছে। বাড়ুক, তবু যদি সবাই মিলে একটু ভালো থাকে!

সে নিজেও এক কঠিন ঝামেলায় পড়েছে, সে-কথা কাউকে বলতে পারে না। এই দোকানটির জন্যই পাশের প্লটটির নির্মাণাধীন বহুতল দালানটি নাকি কাঙ্ক্ষিত রূপ পাচ্ছে না। ওই প্লটের মালিক ভদ্রলোক অনেকবার অনুরোধ করেছেন অনিমেষকে দোকানটা বিক্রি করে দিতে, সে রাজি হয়নি। এরপর চাপ দিয়েছেন, হুমকি-ধমকিও দিয়েছেন, মালাউনের বাচ্চা বলে গালিও দিয়েছেন, তাতেও নরম হয়নি সে। এরপর ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে জায়গাটার মালিকানা দাবি করে বসেছেন ভদ্রলোক, তবু মাথা নত করেনি অনিমেষ। দখল করতে চাইলে চেষ্টা করুক, দেখা যাক পারে কী না! এত দুর্বল হয়ে মাথা নত করে থাকলে চলে না। মালাউনের বাচ্চা হয়েছি তো কী হয়েছে, ধর্ম আমার জন্মগত পরিচয়, আর এ-দেশটির ওপর আমার জন্মগত অধিকার। এ-দেশ কি কারো বাপ-দাদার সম্পত্তি নাকি যে, হুমকি দিলেই মেনে নেবো? কিন্তু লোকটা দখলের পথে যায় না। কোন পথে যে যায় তাও বোঝা যায় না। তবে এক সকালে সবাই দেখতে পায় দোকানটা লন্ডভন্ড, গতরাতে নাকি একটা ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দোকানের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল! পেছনের দিকে দুজন কর্মচারী ঘুমায়, অল্পের জন্য বেঁচে গেছে, কিন্তু জিনিসপত্র কিছু অক্ষত নেই। কর্মচারীরা রাতেই জানিয়েছিল ঘটনাটা, সেও তৎক্ষণাৎ হাজির হয়েছিল সেখানে, ট্রাকটাকে ধরতে পারেনি, পালিয়েছে। সে বুঝতে পারে, এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত ঘটনা। লোকজনও এটাকে দুর্ঘটনা বলে স্বীকার করতে চায় না। নিয়ন্ত্রণই যদি হারাবে তাহলে মাত্র এই একটি দোকানের ভেতরেই সোজা ঢুকে পড়বে কেন ট্রাক? আশেপাশের দু-চারটা দোকানও তো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা!

যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। সে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন থানায় গিয়ে জিডি করে, তারপর রাজমিস্ত্রি ডেকে কাজের অর্ডার দেয়। সেই যে কত বছর আগে বাবা এই দোকান তুলেছিলেন, তারপর আর সংস্কার করা হয়নি, এই সুযোগে নতুন করে তৈরি করে নেওয়া যাক। মাথা নোয়াবার প্রশ্নই ওঠে না। দু-চারমাস সময় লাগবে, তাতে তার পুরনো ক্রেতারা হারিয়ে যাবে না, সে আবার নতুন করে শুরু করবে।

কিন্তু বাসায় এসে শূন্য শূন্য লাগে। অযাচিতভাবে পেয়ে যাওয়া এই অবসর দিয়ে সে কী করবে? সময় কাটবে কী করে তার? বাসার সবার মুখ থমথমে, মেঘ জমে আছে, সে কথা বললেই অঝোরধারায় বৃষ্টি ঝরবে, জানে অনিমেষ। ইচ্ছে করে না কথা বলতে, তবু মায়ের কাছে গিয়ে বসে সে, বলে – মিস্ত্রি লাগিয়ে দিলাম মা। এত পুরনো দোকান, একটুতেই ভেঙেচুরে গেছে। এবার শক্ত করে বানাবো। চিন্তা করো না মা।

কিন্তু সান্ত্বনায় কাজ হয় না, মায়ের জমে থাকা কান্না এবার বিলাপ হয়ে ঝরে পড়ে – আমরা তো কারো ক্ষতি করি নাই। মানুষ আমাদের পেছনে লাগে ক্যান? এত বড়ো সর্বনাশ করলো! ভগবানের এ কী বিচার? – মায়ের বিলাপ চলতেই থাকে। ক্লান্ত লাগে অনিমেষের। সান্ত্বনা দিতে ইচ্ছে করে না আর। কতই বা দেওয়া যায়? তার নিজেরও তো কখনো কখনো সান্ত্বনার দরকার হয়! খুব দূরে, দূর অতীতের দিকে তাকিয়ে সে দেখতে পায় – কেউ কখনো তার কাঁধে রাখেনি সান্ত্বনার হাত, এমনকি জামাইবাবু আর বাবা মারা যাওয়ার পর শোক করার সময়টুকুও সে পায়নি, কেউ তাকে বলেনি – একটু কাঁদো, বাবা মরে গেলে ছেলেকে কাঁদতে হয়, নইলে চিরদিনের জন্য বুক ভারী হয়ে থাকে। বরং নিজের চোখ শুকনো রেখে সবাইকে আগলে ধরে রেখেছিল অনিমেষ, ভেবেছিল – সে ভেঙে পড়লে সবই ভেঙে পড়বে। সেই শোকটা এখনো ভেতরে রয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মোচড় দিয়ে ওঠে বুকের ভেতর। এই এখন যেমন খুব মনে পড়ছে বাবার মুখটা। কিন্তু নিজেকে সামলায় সে। এই মুহূর্তে কাঁদা যাবে না। কাঁদতেও হয় সময়-সুযোগ বুঝে! হায় জীবন! মায়ের কাছ থেকে উঠে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ে অনিমেষ। দ্যাখে পেছন পেছন আরতিও এসে দাঁড়িয়েছে পায়ের কাছে। অনিমেষ তাকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে, বলে – একটা গান গা তো মা। তোর গান শুনলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়।

আরতি দ্বিরুক্তি না করে গান ধরে – ‘হেলায় হেলায় দিন বয়ে যায়/ ঘিরে নিলো কালে/ আর কি হবে মানব জনম/ বসবো সাধু মেলে।’

প্রথম চরণ শুনেই বুকে ধাক্কা লাগে। আহা, জীবনটা হেলায় হেলায় কেটে গেল! কিছুই হলো না এ-জীবনে, কিছুই না! এই বৈষয়িক জীবন, এই টাকাপয়সার হিসাব, এই সংসারের ঝামেলা – এসবের বাইরেও তো একটা জীবন আছে, জীবনের বিবিধ রূপ আছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে মিলে সারাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছে অনিমেষ, দেখেছে – গ্রামের মানুষের জীবন কী সরল আর মায়াময়! অভাব-দারিদ্র্য তাদের কাবু করতে পারে না, শত সংকটের ভেতরে থেকেও তারা জীবনের ভিন্নতর কোনো অর্থ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে। তখন থেকেই সে ভেবে রেখেছিল – সরকারি চাকরিতে ঢুকতে পারলে গ্রামেগঞ্জে পোস্টিং নেবে, মিশে যাবে এইসব মানুষের সঙ্গে, তাদের সঙ্গে মিলে নিজেও খুঁজে দেখবে – এই জীবনের আদৌ কোনো অর্থ আছে কিনা, এই অস্তিত্বের আদৌ কোনো কারণ বা উদ্দেশ্য আছে কিনা। হলো না, কিছুই হলো না জীবনে। এইসব ভাবতে ভাবতে তার চোখ উপচে অনেকদিনের জমানো অশ্রু ঝরে পড়ে অঝোরধারায়।