I sometimes think that so much has been written in literature about love and so little about friendship that there is a real need to redress the balance without trying to redefine friendship under some kind of a broadened umbrella of love when they are not really the same things at all.
– অমর্ত্য সেন, Home in the World, (2021)
সত্যিই তো। যদি সারা পৃথিবীর সাহিত্যসম্ভারের ঝাঁপি থেকে শুধু ‘ভালোবাসা’র প্রসঙ্গ আলাদা করে চয়ন করার একটা প্রকল্প নেওয়া হয়, হয়তোবা দেখা যাবে, অন্য সব বিষয়ের সম্মিলিত কথামালার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে শুধু প্রেম নিয়ে রচিত শব্দাবলি। এটা নিয়ে নিশ্চয়ই কোনো বিতর্ক উত্থাপনের প্রয়োজন নেই। রবীন্দ্রনাথ তো বলেই গেছেন, ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে’। সেই আদ্যিকালের অর্জুন-চিত্রাঙ্গদা, অ্যান্টোনি-ক্লিওপেট্রা থেকে এই সেদিন ভারতের মুম্বাইয়ের এক তরতাজা ও প্রতিশ্রুতিশীল ফিল্মি নায়কের আত্মহননের সত্য-মিথ্যা-কাল্পনিক অযুত কাহিনির মধ্যে কেন্দ্রীয় উপাদান হিসেবে ‘ভালোবাসা’ অমরত্ব অর্জন করেছে। এমন ভালোবাসার উৎস থেকে কালক্রমিক বিবর্তনের মধ্যে কোন্ বিন্দু পর্যন্ত তা বন্ধুত্ব ছিল এবং কোন্ প্রগাঢ় রূপান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জানা-অজানা স্তর পেরিয়ে তা ভালোবাসায় গিয়ে নোঙর করল, এমন কোনো গবেষণাকেই নির্ভুল বলা যাবে না। তবে অমর্ত্য সেনের আত্মজীবনী পড়তে গিয়ে, এই যে ‘বন্ধুত্ব’ চিহ্নিত সম্পর্কটা সাহিত্যের দুয়োরানি হিসেবে রয়ে গেছে, সেই কথাটা মরমে গিয়ে এমন টোকা দিলো যে, আমি সুনিশ্চিতভাবেই প্ররোচিত বোধ করলাম এই ভাবনার হিসাব-নিকাশে, সত্যিই তো, বন্ধুত্বের বন্ধন নিয়ে সাহিত্য প্রশ্নাতীতভাবে স্বল্পবাক। অথচ ছোটবেলা থেকে তো বন্ধুত্ব বিষয়ে কম গল্প পড়া-শোনা হয়নি। ভালুক দেখে এক বন্ধুর গাছে চড়ে বসা থেকে শিকারির তীরকে ভিন্ন দিকে চালিত করার জন্য ব্যাধের পায়ে পিপীলিকার দংশন – বন্ধুত্বের আরো কত সত্যিকারের ঐতিহাসিক কাহিনির কথা বহুশ্রুত। বন্ধুত্বের নানা দৃষ্টান্ত অবশ্যই ছড়িয়ে আছে অসংখ্য সাহিত্যকর্মে। কিন্তু এই দ্বন্দ্বটাও আমাকে ভাবিয়ে তুলছে যে, ফুলদানিতে গোলাপ ও রজনীগন্ধা অথবা তরুশাখায় কপোত-কপোতীর চিত্রকথায় যেভাবে ভালোবাসার বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায় সহজে, বোধ করি অমন সরলপথে বন্ধুত্বের যুক্ততা ও পরস্পরনির্ভরতাকে প্রকাশ করা যাবে না, যায় না। যে পরম বাস্তবকে নিয়ে কিছু লেখার প্রয়াসে করোটির ভেতরে শব্দ খুঁজে বেড়াচ্ছি, কীভাবে শুরু করব আলাপন, সেই কষ্ট বা সমস্যার সুরাহা হয়ে ওঠে না। হার মানছি, সুগভীর বন্ধুত্বের ভাষ্যরচনা বড়ই আয়াসসাধ্য ব্যাপার।
প্রিয় প্রয়াতজনদের নিয়ে আগেও লিখেছি, হৃদয়ের টানে বিচ্ছেদের কষ্ট অন্যকে জানানোর চেষ্টা করেছি, সর্বোপরি অমন একজনের প্রতি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের একটা দায় বোধ করেছি। কিন্তু এই যাঁকে নিয়ে কিছু শব্দ ও ভাবনা সাজাবো বলে বর্তমান লেখার পরিকল্পনা, তাঁর কথা যে কীভাবে বলবো, তার বিন্যাসটা কেমন হলে যা বলতে চাই, তা উপস্থাপন করতে পারবো, অনেক প্রহর, অনেক দিবস ধরে – ভেবেছি সেই কথাটাই। এই যে পেয়ে গেছি, এমন কোনো ঊন-নিশ্চয়তাপ্রবণ ভাবনার বিন্দুতে পৌঁছাতে পারিনি। অনেক বিকল্পের ওজনের তারতম্য খেলা করেছে মস্তিষ্কের ভেতর, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর বিপন্নতা থেকে মিলল না মুক্তি। এমন নিবিড়ভাবে তাঁকে চিনি, চিনি নিকটজন হিসেবে, দিনে দিনে বিস্মিত হয়েছি তাঁর পড়াশোনা ও চিন্তাভাবনার ব্যাপ্তি এবং গভীরতা পরিমাপ করতে গিয়ে। একমাত্র হায়াৎ মামুদ ছাড়া আর কোনো বান্ধবের সঙ্গে তাঁর চেয়ে বেশি একান্ত সময় কাটাইনি। এতো দ্রুততায় তাঁর পারিবারিক সদস্য হয়ে উঠেছিলাম, সেটি এখনো এক প্রহেলিকা আমার কাছে। অধ্যাপক আলী আনোয়ার অগ্রজপ্রতিম, তাই আনোয়ার ভাই বলতাম। আমার শ্রেষ্ঠ বান্ধবদের একজন; কিন্তু নামের সঙ্গে যে ভাই যুক্ত করেছিলাম, সেটা বোধ করি অজান্তে কিন্তু অবাধে তাঁর পরিবারের বৃত্তে প্রবেশের সূত্রেই।
তাঁকে নিয়ে লেখার একটা আন্তরিক দায় আছে, তাঁকে যাঁরা কাছ থেকে চিনতেন, তাঁরাই লিখবেন – এটা একদিক থেকে যেমন স্বাভাবিক, তেমনি অন্যদিক থেকে তা তো বিশেষ সুখপ্রদায়ী কথা নয়। তাঁর যে বৈদগ্ধ্য, যা আমাদের বিমুগ্ধ করছে, সেকথা দিকে দিকে রটে যাওয়ার কথা ছিল। না, তা হয়নি। তাঁর নিজের কারণেই এমনটি ঘটেনি। এমন পর্যবেক্ষণ হয়তোবা বিস্তারিত করবো পরবর্তী কোনো অংশে। সূচনা অনুচ্ছেদের সমস্যা মেটাতে কোনো সমাধানের পথ দেখতে পাইনি। তাই একটা আটপৌরে বিকল্পকেই বেছে নিলাম। এই অক্ষমতাকে মানতে হলো।
শেষ থেকেই শুরু করি। পাবনায় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের জাতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। আমার আরেক অতিঘনিষ্ঠ বন্ধু বিলেতপ্রবাসী গোলাম মুরশিদ সেখানে আলোচনা সভায় কিছু বলবেন। ঢাকার বাইরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে যোগ দেওয়ার ঝক্কি-ঝামেলা আগের মতো আর সইতে পারি না। তাই সাধারণত যোগদান থেকে বিরত থাকি; কিন্তু ড. গোলাম মুরশিদ কথা বলবেন, তাই আমিও তাঁর সহযাত্রী হবো। পাঠকদের মধ্যে অনেকেই হয়তো জানেন, তবু উল্লেখ করতে চাই, ড. গোলাম মুরশিদ দেশত্যাগের আগে অধ্যাপক আলী আনোয়ারের সহকর্মী ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই। বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের গোলচত্বরের ‘রবীন্দ্র গ্রুপ’-এর সদস্য দু’জনেই। আমাদের পাবনা যাওয়া হয়নি। বিনা মেঘে প্রবল বজ্রপাতের মতো আকস্মিক না হলেও এই সংবাদ আমাদের বুকের পাঁজর দুমড়ে-মুচড়ে দিলো যে, আলী আনোয়ার আর নেই। আগামীকাল আকাশযানে বাক্সবন্দি লাগেজ হয়ে তাঁর নশ্বরদেহ এসে পৌঁছাবে ঢাকায়। আজো স্মরণ করতে পারি কী অবর্ণনীয় ও গভীর শূন্যতা আচ্ছন্ন করেছিল আমাদের।
আমি এবং মুরশিদ – দুই বন্ধু পাশাপাশি বসে প্রায় নীরব একটা সন্ধ্যা কাটিয়ে দিলাম। দুজনের মধ্যে নানান স্মৃতির সম্ভার বড় বেশি ভার হয়ে উঠেছিল। আর বাস্তব সত্যটা ছিল এই যে, আনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে জীবিত অবস্থায় সবশেষ দেখাটাও হয়েছিল একসঙ্গে। তিনি বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই লড়ছেন কর্কট রোগের সঙ্গে। আমেরিকার মতো দেশে তাঁর চিকিৎসা নেওয়ার অনুকূল পরিস্থিতি ছিল বলেই হয়তো লড়াইটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পেরেছিল। অবিনের বারিধারার বাসায় শেষ দেখা, শেষ সাক্ষাৎ, শেষ আড্ডা তিন বন্ধুর। আহা, অমন ঝলমলে, সদা টগবগে অবিনও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। বাস্তব এতোটা প্রস্তরকঠিন হতে পারে! ভাবা যায় না। সেদিন আলী আনোয়ারের সঙ্গে শেষ দেখায়, তাঁকে অতটা পীড়িত মনে হয়নি আমাদের। হয়তো অন্তরের উত্তাপ, রাজশাহীর স্মৃতিচারণ এবং আরো নানা বিষয়ে তিনজনেই নিমজ্জিত হয়েছিলাম।
প্রকৃতপক্ষে দুই প্রবাসীর অনেকদিন পর দেখা হওয়ার আনন্দ চমৎকার একটা আবহ তৈরি করেছিল, যদিও আমি ও মুরশিদ একটু পরেই তাঁর শারীরিক দুর্বলতার বিষয়টি টের পেলাম। অবিন অনেক চেষ্টাতেও বাবাকে বিছানা থেকে চেয়ারে বসতে রাজি করাতে পারছে না। যা হোক, সেদিন বিকেল থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে অনেকটা সময় পর বিদায় নিয়েছিলাম। ঘুণাক্ষরে বুঝিনি সেই হবে আমাদের শেষ দেখা।
আমাদের অনেক বন্ধুর মতো যুক্তরাষ্ট্র নামের দেশটার প্রতি আমার কোনোদিন অনুরাগ জন্মায়নি। যদিও আমেরিকায় গিয়ে বহু অভিজ্ঞতায় ওই দেশটার অনেক ইতিবাচক দিক দেখে-শুনে মনটা দ্রবীভূত হয়েছে, তবু ওই দেশটির পররাষ্ট্রনীতির জটিল-কুটিল কূটাভাস সর্বদাই প্রত্যাখ্যানের অনুভূতি জন্ম দিয়েছে। কিন্তু ওখানকার উন্নততর চিকিৎসায় আনোয়ার ভাইয়ের জীবন যে দীর্ঘতর হয়েছে সেই কৃতজ্ঞতা আমাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুর্বল করেছে। এই রোগের দূরবাহী সংবাদটা আমি জেনেছিলাম যখন তিনি হেপাটাইটিসের কঠিন ছোবলে তাঁদের বাড়ির প্রতিবেশী দূরত্বে মনোয়ারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল দেখে ওখানকার ডাক্তার ঘোর অশনি-সংকেতের কথা আমাকে জানিয়েছিলেন। সেই থেকেই আমার মন খারাপের শুরু। আমার সেই পুরনো কষ্টের কথা কাউকে বলেছিলাম কি না আজ আর মনে পড়ছে না।
অধ্যাপক আলী আনোয়ার। তাঁর কাছের মানুষেরা, শিক্ষার্থী ও সহকর্মীরা বুঝতেন এবং আজো বোঝেন যে, বুদ্ধিবৃত্তি ও চর্চার দিক থেকে কী ধরনের উচ্চমার্গীয় জ্ঞানের আধার ছিলেন তিনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে, আমার বিচারে, তিনিই ছিলেন সর্বাধিক দ্যুতিময় নক্ষত্র। অন্যদের বিদ্যাচর্চাকে খাটো করে দেখতে চাইছি না। কিন্তু অন্যদের মধ্যে তিনি ছিলেন অনন্য। বাংলাদেশের বিদ্বৎসমাজে তাঁর মতো এতো ব্যাপক পড়াশোনার পরিধি, বিশ্লেষণের গভীরতর দীপ্তি দেখতে পেয়েছি, এমন ব্যক্তির সংখ্যা নিতান্তই মুষ্টিমেয়। তিনি আমাকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বান্ধবের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, সে আমার জীবনের পরম সঞ্চয়। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর এবং আমার চিন্তাধারার গতিপথ ও সাদৃশ্য ছিল। কত রকমের সাহিত্যিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিতর্কে কতবার কত সন্ধ্যা, কত প্রহর, কত দিন পার করেছি – সে-হিসাব মেলানো সম্ভব নয়। তবে সেসব আদান-প্রদানের কালে, তাঁর প্রকাশিত রচনা পড়তে গিয়ে এবং তাঁর বক্তৃতা শুনতে শুনতে প্রায়ই নিজের ক্ষুদ্রতা আবিষ্কার করে আনত হতাম। আলী আনোয়ারকে দেখে আপাতভাবে মনে হবে না, তিনি বড় কথক অথবা আশেপাশে যে অবিরতভাবে নানা অন্যায়, নানা অবিবেচনা সংঘটিত হয়ে যাচ্ছে, সেসবের অভিঘাতে করোটির ভেতরে যে অসহিষ্ণুতা তৈরি হচ্ছে, তা প্রকাশে তিনি উচ্চবাক। এক ধরনের প্রশান্ত গাম্ভীর্যই প্রধানত অধিকার করে থাকত তাঁর মুখমণ্ডল। কিন্তু যখনই মুখনিঃসৃত শব্দমালা উচ্চারিত হতো, তখনই আশপাশের ব্যক্তিরা নির্বাক বোধ করতেন।
মোটা ভরাট গোঁফ প্রায় আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তুলনীয়, সেজন্যে শিক্ষার্থীরা এবং বন্ধুবর্গ কখনো কখনো রসিকতাচ্ছলে রবীন্দ্র গীতিনাট্যের অনুসরণে তাঁর নামের আগে জুড়ে দিতেন ‘কোটালরাজ’। একেবারে আমার বাচাল ধরনের বিপরীত আলী আনোয়ার বেশিক্ষণ শ্রোতা থাকতেই পছন্দ করতেন। কিন্তু যখন তিনি নিজেই আড্ডা বা বুদ্ধিবৃত্তিক বৈঠকে কথা শুরু করতেন এতসব অতীত প্রসঙ্গ এবং ধ্রুপদী ও আধুনিক চিন্তার সংমিশ্রণে যুক্তিতর্কের দুর্গ গড়ে তুলতেন যে, তা ভেদ করার কোনো প্রচেষ্টা ও সাহস আমাদের মধ্যে জন্ম নিত না, সবাই তাঁর যুক্তি ও বাক-নির্মাণশৈলীতে মোহিত হয়ে যেতাম।
এই সঙ্গে সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ করতে চাই। তাতে হয়তো বিষয়টা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মনে পড়ে, ১৯৭৪ সালের কোনো এক গোধূলিবেলায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমপাড়ার আবাসিক এলাকা থেকে ক্লাবমুখী রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে এই কোটালরাজের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল, তারপর দিনে দিনে আমাদের পারস্পরিক সখ্য অনেক গভীর ও জোরালো হয়ে উঠেছিল। পেশাগত কাজ, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ এবং সাংগঠনিক তৎপরতায় আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে পড়েছি। আলী আনোয়ার খুব সংগঠনমুখী ব্যক্তি ছিলেন না। কিন্তু এক্ষেত্রে তাঁকে আমি বিশেষভাবে প্ররোচিত – প্রভাবিত করতে সমর্থ হয়েছিলাম। আমাদের আরেক বন্ধু হায়াৎ মামুদও ছিলেন বুদ্ধদেব বসুর অনুসারী। তাঁকেও আমি নিছক পড়াশোনার বাইরে সামাজিক দায়গ্রহণের প্রয়োজনের সপক্ষে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলাম। যে-স্মৃতিকথা এখানে বলতে চাই সেজন্য এই কয়েকটা বাক্যে বিষয়টির পটভূমি বেশ প্রাসঙ্গিক। ১৯৭৫ সালের মধ্য-আগস্ট পরবর্তীকালে নানা অস্পষ্টতা, দোদুল্যমানতার মধ্যে শিক্ষক সমাজের মধ্যে এক ধরনের শীতলতা ও সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল। ঢাকায় আমরা কয়েকজন মিলে অনেকদিনের ছোটখাটো সংগোপন সভা করার পর নতুন চরিত্রের প্রগতিবাদী শিক্ষকগোষ্ঠী হিসেবে বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলি।
আমার ব্যক্তিগত নির্বাচন ও প্রচেষ্টায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুপ্রতিম বেশকিছু সংখ্যক সহকর্মীকে এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলাম। তাঁরা সকলেই যে খুব সক্রিয় ছিলেন সে-দাবি করতে পারব না। আমরা অধ্যাপক আলী আনোয়ারকে এই সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সহ-সভাপতি হিসেবে নির্বাচন করেছিলাম। ভাবনা-চেতনায় তিনি তো আমাদের সঙ্গে গভীরভাবে সহমর্মী ছিলেন, সে-কথা তো বলা বাহুল্য। কিন্তু আমার প্ররোচনায় ও নিয়ত তাগিদে তিনি যথাযথ নেতৃত্বদানে এগিয়ে এসেছিলেন। এই সংগঠনটিকে শিক্ষা ও শিক্ষকদের জন্য একটি সত্যিকারের দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে আমরা প্রচুর সময় ও শ্রম নিয়োগ করেছিলাম। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, সময়টা আমাদের অনুকূলে ছিল না। দেশের তখনকার সরকারের প্রতি আমাদের কোনো আদর্শিক আনুগত্য ছিল না, ছিল প্রত্যাখ্যান ও ঘৃণা।
কথাটা পেড়েছিলাম আলী আনোয়ারের জ্ঞানের পরিধি নিয়ে। এখন যা বলতে চাইছি অথবা যে-কথা স্মৃতির ভাঁড়ার থেকে এখানে পেশ করতে চাইছি, তাতে তাঁর যুক্তিতর্কনির্ভর বাগ্মিতার পরিচয়ও মিলবে। বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে আমরা শিক্ষা-অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি প্রভৃতি নানা বিষয়ে ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে নানান জায়গায় সেমিনার ও মতবিনিময় সভার আয়োজন করতাম। আশির দশকের মাঝামাঝি এক বিকেল। ঢাকার বেইলি রোডে সিদ্ধেশ্বরী মহিলা কলেজ মিলনায়তনে একটা আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ওই কলেজের অধ্যক্ষ বেগম শামসে আরাও আমাদের সমিতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। সেদিনকার বিকেলের প্রধান আলোচক ছিলেন আলী আনোয়ার। সুনির্দিষ্ট বিষয়টা কী ছিল, সেটা এই এতোকাল পরে মনে নেই। মনে আছে নাছোড়বান্দা পীড়াপীড়িতে আলী আনোয়ার তাঁর সুনির্দিষ্ট উপস্থাপনার একটা লিখিত ভাষ্য আমাদের দিয়েছিলেন। তখনকার দিনে সেই প্রবন্ধের সাইক্লোস্টাইল (এই প্রযুক্তি বিষয়ে বর্তমানে বহু মানুষই হয়তো অবহিত নন) করে দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে বিতরণ করেছিলাম। ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় মিলে জনাবিশেক শিক্ষক ছাড়া প্রায় শ-খানেক অংশগ্রহণকারীর মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন সিদ্ধেশ্বরী মহিলা কলেজ, প্রতিবেশী হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজ ও নটর ডেম কলেজের। অন্য প্রতিষ্ঠান থেকেও হয়তো কয়েকজন এসেছিলেন, এখন মনে করতে পারছি না। এতোটা বিস্তারিত যে বর্ণনা দিচ্ছি তা সকারণ। বাঙালির প্রথামত সামান্য বিলম্বে সভা শুরু হলো। আলী আনোয়ার প্রবন্ধ উপস্থাপন শুরু করলেন, তাঁর অনুলিপি তো আছে, প্রায় সবার কাছে। যেটা পড়ার জন্য স্বাভাবিকভাবে বিশ-পঁচিশ মিনিট সময় লাগার কথা, আলী আনোয়ার কোনো একটা অনুচ্ছেদের শেষে বা কোনো মন্তব্যের পরপরই তার ব্যাখ্যা-বিস্তার ঘটিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা পরে শেষ করলেন। যে-কথা বলার, তা হলো, সিংহভাগ শ্রোতাই মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। দুজন নির্ধারিত আলোচক নিঃশব্দে একটু অসহায় বোধ করেছিলেন। উপস্থাপনার বিপরীতে বাড়তি কিছু যোগ করার যে অবকাশ থাকে, প্রধান বক্তা তা যুগপৎ অকাতরে ও স্বতঃস্ফূর্ততায় হরণ করে নিয়েছিলেন। সভা শুরু হতে যেটুকু বিলম্ব হচ্ছিল, তার সদর্থক ক্ষতিপূরণে আমরা শিঙাড়া ও চা-পানের ব্যবস্থা অনুষ্ঠান আরম্ভের সময়ই ব্যবহার করেছিলাম।
এমন দীর্ঘ আলোচনার পরও সেদিন শ্রোতাদের মধ্যে কোনো অবসাদ দেখিনি, দু-চারজনের হয়তো সত্যি অন্য কাজ ছিল, জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষকদের নির্দিষ্ট সময়ে বাস ধরার তাড়া ছিল, তাঁরা হয়তো সভাস্থল ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা সংখ্যায় বেশি নন। আলোচনার শেষে সঞ্চালক হিসেবে আমি শ্রোতাদের আহ্বান জানালাম মূল বক্তার প্রতি প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করার জন্য। এরপর এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। অপেক্ষাকৃত তরুণ থেকে যথারীতি অভিজ্ঞ শিক্ষকবৃন্দ (অধিকাংশই মহাবিদ্যালয় পর্যায়ের) তাদের নানান মন্তব্য – প্রশ্ন, অভিমত, অভিজ্ঞতা হাজির করতে লাগলেন। দু-একজন বাদ দিয়ে সকলেই কথা বলছিলেন আলী আনোয়ারের উপস্থাপনা ঘিরে। সেসবের উত্তর দিতে গিয়ে আলী আনোয়ার বিচরণ করতে লাগলেন ইতিহাস, শিক্ষাব্যবস্থা, ব্রিটিশদের কপটতা, রেনেসাঁস, মাদ্রাসা শিক্ষা, সক্রেটিস, রবীন্দ্রনাথ, রোকেয়া, ডিউই ইত্যাকার বহুতর প্রান্তে। এখনো যেন দেখতে পাচ্ছি সবকিছু। শিক্ষকরা কেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিক্ষার্থীর বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে শুনছেন সব কথা। প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হয়। বিরতিহীনভাবে সভা চলেছিল পাঁচ ঘণ্টারও অধিক সময় ধরে। সঞ্চালকও মুগ্ধ তথৈবচ। সমাপন ঘোষণা করার সময় আমি ওই সেমিনারকে অভিহিত করেছিলাম ‘মহানগর গোধূলি যাত্রা’ হিসেবে। সে-সময় ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে চলাচলকারী মহানগর রেলগাড়ির সত্যিই বিরতিহীন যাত্রা ছিল। ঠিক পাঁচ ঘণ্টায় গন্তব্যে পৌঁছে যেত। এই হলেন আলী আনোয়ার। সেই সন্ধ্যা গড়িয়ে শিশু – রাতে পৌঁছে যাওয়া বিকেলের সবটা বিবরণী যদি শব্দবন্ধ এবং পরবর্তী সময়ে সম্পাদনা করে প্রকাশ করা যেত, শিক্ষাবিদ আলী আনোয়ারের একটা প্রামাণ্যচিত্র রচনা করা যেত।
আলী আনোয়ারকে সাধারণভাবে উত্তম মানের ‘কথক’ হিসেবে অভিহিত করা যাবে না, যদিও বন্ধুবান্ধবের মধ্যে আড্ডায় তিনি সর্বদাই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যোগ দিতেন। সবাই মিলে কথা বলছি, অনেক লঘু বিষয়ে কথা চলছে, কখনো কখনো পরচর্চা, যা বাঙালির সবচেয়ে অধিক প্রিয় বিষয়। কিন্তু আমাদের আড্ডায় সেসবেরও একটা আবশ্যিক প্রাসঙ্গিকতা থাকত। সরল আলোচনায় নেহাতই কারো কারো সম্পর্কে নিন্দামন্দ জায়গা করে নিত; কিন্তু আলী আনোয়ার সেসব বিষয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকা নীরব শ্রোতার আড়মোড়া ভেঙে হঠাৎই এমন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিক্রিয়া দেখাতেন, যা আমার মতো যারা তাঁর ঘনিষ্ঠজন, তাদের পুলকিত করত; কিন্তু কখনো-সখনো অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত কোনো বন্ধু-অধ্যাপক অথবা আমলা তথাপি সাহিত্যচর্চা করেন, এমনজনকে তা বিশেষভাবে বিস্মিত এবং অধিকাংশ সময়ই তাদের হতাশ করত। কারণ আলী আনোয়ার দেশ-বিদেশের, একাল-সেকাল এবং রক্ষণশীল-উদারতাবাদী কিংবা বাস্তবতা ও তত্ত্ব ইত্যাকার প্রসঙ্গ টেনে এমন এক বিশ্লেষণ এবং ভাবনার বৃত্ত রচনা করতেন, মুহূর্তেই আমাদের মনে হতো, আমরা কত কম জানি অথচ কত বেশি লম্ফঝম্প করি।
একেবারেই আলোচনাটা যখন আমাদের দুজনের মধ্যে, তখনো নানা উত্তেজনার আবহ সৃষ্টি হতো। অবশ্য আমাদের দুজনের মধ্যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক আনুগত্যের দূরত্ব প্রায় ছিল না বললেই চলে। আর তেমনটি না হলে এমন আমৃত্যু উত্তাপময় সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন থাকতো না। তবে এর দ্বারা যে অহং নামক একটা পরিতৃপ্তিকে লালন করব তার কোনো উপায় নেই। এই প্রসঙ্গে আবশ্যিকভাবে মনে পড়ে অনতিকাল পূর্বে প্রয়াত আমাদের আর দুই স্বজনের কথা – দ্বিজেন শর্মা ও বিলেতপ্রবাসী ওসমান জামাল। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী পাড়ার প্রতিবেশী এবং ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী ওসমান জামালের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আনোয়ার ভাই। ওসমান জামালও ছিলেন প্রাথমিকভাবে একজন অভিনিবিষ্ট পড়ুয়া।
ছোট একটি স্মৃতি আকস্মিকভাবেই উঁকি দিলো মনের মধ্যে। জামাল ভাইয়ের লিডসের বাড়িতে আমি বেশ অনেকদিন আতিথ্য গ্রহণ করেছিলাম। নানা বিষয়ে আলোচনা হতো, যদিও ১৯৭৫-উত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট এবং গতি- প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের পর্যালোচনা, প্রতিক্রিয়া ও অভিমত অবিভাজ্য এবং সমমুখীন ছিল না। সেটা অন্য কথা। যাই হোক, এক সন্ধ্যায় জামাল ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনায় ইতিহাসের পুনর্দর্শন বিষয়ে নানা প্রসঙ্গের সঙ্গে Benjamin Franklin-এর Illuminations গ্রন্থটির কথা ওঠে। এখানে সলজ্জভাবে স্বীকার করে নিই যে, সেই ১৯৮৮ পর্যন্ত ওই বইটি আমার পড়া হয়নি। সেকথা জেনে জামাল ভাই মন্তব্য করলেন, ‘এখানে থাকতে থাকতে বইটা পড়ে নিন, না হলে বন্ধুদের তালিকা থেকে অধ্যাপক আলী আনোয়ার আপনাকে বাদ দিয়ে দিতে পারেন।’
এ থেকে শেষোক্তজনের লেখাপড়ার পরিধি সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। অবাক লাগতো, এখনো লাগে, তিনি কীভাবে এতো কিছু পড়ে, বিশেষত সাহিত্যে নিহিত বৈশ্বিক সংস্কৃতির বিবর্তন বিষয়ে নানাকথা, কত সব বিপ্রতীপ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতাকে তাঁর মস্তিষ্কের অসাধারণ প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রাখতে পারতেন এবং ঠিকই অনুকূল সময়ে সেইসব চৈতন্যজাত বিশ্লেষণকে আমাদের সাহচর্যে মুক্ত করতে পারতেন। অলিভার গোল্ডস্মিথ তাঁর কবিতায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সম্বন্ধে যে বিস্ময়বিমূঢ় অনুভূতির কথা বলেছিলেন, আমার বিচারে আলী আনোয়ার তার এক সুসংস্কৃত প্রতিচ্ছবি। তাঁর সঙ্গ আমাকে সর্বদাই সমৃদ্ধ করেছে। আমাদের মনোবৃত্তির সহোদরত্ব সম্পর্কে নানান কথা যদি উল্লেখ করতে চাই, (যদিও স্মৃতির সংগ্রহ থেকে সেসবের প্রকাশের অস্থিরতা আমাকে এখন নীরবে অস্থির করে তুলছে) তাহলে আত্মকথন প্রায় অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই যতটা সম্ভব তা থেকে নিরস্ত থাকতে চাই।
ঠিক এখনি একটা স্মৃতি লিপিবদ্ধ করা বোধ করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আনোয়ার ভাই যে আমার ঢাকার বাসায় অনেকবার এসেছেন, তা নয়। তবে যখন তিনি রাজশাহী থেকে ঢাকা আসতেন, সেই প্রাক্-ইন্টারনেট প্রাক্-মুঠোফোন নাতি – অতীতে, আমাকে তিনি আবশ্যিকভাবেই জানাতেন। সেকালের সেই অনিশ্চিত নগরবাড়ি ফেরির পদ্মা-পরিক্রমণ শেষে কখন তিনি ঢাকায় এসে পৌঁছাবেন, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। কিন্তু তাঁর এক সুগভীর দাবি ছিল আমার ওপর। ওই বিকেলে বা সন্ধ্যায় দেখা হতেই হবে। এমন দু-একবার হয়েছে যে, ঢাকায় এদিক-ওদিক করে সন্ধ্যা পার করে বাসায় প্রবেশ করেছি। তার একটু পর ফোন বাজলো, বুঝতে পারতাম আনোয়ার ভাই হয়তো পথের পোশাক না পালটেই সিদ্ধেশ্বরীর কাকলি নিকেতনে পৌঁছেই ফোনে আমাকে ধরতে চেয়েছেন। অজুহাত নয়, সত্য কথাই উচ্চারণ করেছি, তখন আমি বেশ ক্লান্ত, আমাদের সাক্ষাৎ আগামীকাল পর্যন্ত স্থগিত করা যাক। তখন ততোধিক ক্লান্ত প্রিয়ংবদ এই ভাষণ শুনতে পাই আর জড় টেলিফোনের তারের সংযোগও যেন তাতে জীবন্ত হয়ে ওঠে – ‘আরে আপনার আর কি কষ্ট, যা কষ্ট হবার, তা তো হবে ওই অভাজন গরিব রিকশাওয়ালার।’ নির্বাক নির্বিকল্প পরাজয় মানতেই হয়।
শিবের গীত গেয়েই ফেললাম ধান ভানতে গিয়ে। বলছিলাম, আমার বাসায় আলী আনোয়ারের দীর্ঘ বিরতিতে পদার্পণের কথা। বাসায় ঢোকার পর আমি হয়তো উনুনে চায়ের জল চাপিয়ে ফিরে আসতে পারিনি। একটি অদ্বিতীয় স্বাভাবিক দৃশ্য। আনোয়ার ভাইয়ের নিমগ্ন চোখ আমার বইয়ের তাকে। ডুবুরির চোখ দিয়ে দেখছেন আমার সংগ্রহে থাকা কিছু বইয়ের মেরুদণ্ড। কোনোটা নাড়ছেন, কোনোটার সূচিপত্র পড়ছেন মনোযোগ দিয়ে, প্রকাশনার তারিখ, সংস্করণ ইত্যাদি দেখছেন। নাড়াচাড়ার পর তিন-চার-পাঁচটাকে স্থানচ্যুত করে পিতৃসূত্রে পাওয়া আমার একটা সাবেকি আরাম কেদারায় আধাশোয়া অবস্থায় সেসবের মধ্যে লুকানো সম্ভাব্য সোনা-দানা-পান্না অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে যেতেন নিবিড়ভাবে। তিনি যে আমার বাসায় এসেছেন, সে-কথা যেন আর গুরুত্বপূর্ণ নয়, চায়ের চুমুক ও গ্রন্থের সঙ্গে এক অনির্ধারিত অভিসার তখন তাঁকে দখল করে থাকতো। তারপর, আসলে বেশ কিছুক্ষণ পর, আবার বইয়ের জন্য আরো দু-তিনটে তাক নিবিড় নিরীক্ষণশেষে আনোয়ার ভাই বলতেন, অনেকটাই অবশ্য আন্তরিকভাবে, কিন্তু খেদ ও তির্যকোক্তির এক অনবদ্য মিশেলে, ‘শফি, আপনি কষ্ট করে সব দরকারি বই কোত্থেকে জোগাড় করেন?’ প্রীতি ও প্রশংসার সেই কথন এখনো শুনতে পাই।
মনে পড়ে, আমার বাসায় নানান বিষয়ে আলোচনার মধ্যে নির্দিষ্টভাবে একটি প্রসঙ্গের কথা। পশ্চিমের বেশ কয়েকজন সমাজতাত্ত্বিক সমকালীন বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রবণতার সপক্ষে ইসলামভীতি নিয়ে লিখছিলেন। বিভিন্ন কারণের মধ্যে এশিয়া ও অন্যত্র এবং বিশেষভাবে আফ্রিকান কতিপয় দেশে সশস্ত্র ইসলামি গোষ্ঠীর জন্ম ও বিকাশ ঘটছে। আনোয়ার ভাই, আমি বা আমাদের গোত্রের মুসলমান বংশপরিচিতির মানুষ এটাও বুঝতে পারছি যে, বিশেষত মার্কিন মদদে যে তথ্যসাম্রাজ্যবাদ গড়ে উঠেছে গণমাধ্যমে, যেটাকে নোয়াম চমস্কি ‘সম্মতি উৎপাদনে’র এক পরিকল্পিত প্রকল্প বলে চিহ্নিত করেছিলেন, সেসবের এক তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনা এবং এই যৌথ উদ্যোগের প্রভাবে আমেরিকার সামরিক বৃত্ত ও অর্থনীতি সম্প্রসারণের কর্মসূচিকে যাতে বিশেষ করে উন্নয়নে পিছিয়েপড়া দেশগুলিতে যৌক্তিক বলে প্রতিষ্ঠা করা যায়, সেই লক্ষ্য পূরণে একটা অনুদার ও আধিপত্যপ্রবণ বৈশ্বিক আবহ সৃষ্টি করা হচ্ছে। আবার একই সময়ে পাশ্চাত্যের স্বাধীন মতামত প্রদানের যে সামাজিক- ঐতিহাসিক ধারা রয়েছে, তার সুযোগ নিয়ে ওইসব দেশে বসবাসকারী বিভিন্ন ভূখণ্ডের অভিবাসী মুসলমান বুদ্ধিজীবীবৃন্দ বেশকিছু যুক্তিপ্রবণ ও বুদ্ধিজৈবিক অভীক্ষা রচনা করছিলেন, যার মাধ্যমে নব্য রক্ষণশীল তাত্ত্বিকদের একচক্ষু পর্যালোচনার জবাব দেওয়ার উদ্যোগ দেখা যাচ্ছিল। একই সঙ্গে ইসলামপন্থীদের মধ্যেও যে একটা রক্ষণশীল গোষ্ঠী গত শতকের সত্তরের দশক পর্যন্ত রচনে-বচনে মিতাচারী ছিলেন, কিন্তু মৌলবাদী ধ্যান-ধারণার প্রতি অনেকটা অযৌক্তিকভাবেই অনুগত ছিলেন, তারা পাশ্চাত্যের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের সুবাদে তাদের অবস্থানের সপক্ষে লেখালেখি শুরু করেন এবং বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক স্বার্থের লেনদেনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের প্রতি ইসলাম ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীরও এক ধরনের প্রকাশ্য অথবা সংগোপন পৃষ্ঠপোষণার দৃষ্টান্ত দেখতে পাওয়া যায়।
এমনই এক বিচিত্র আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিল হিসেব-নিকেশের একটা অনভিপ্রেত প্রভাব দেখা দিলো অর্থনৈতিকভাবে অধিকতর শক্তিধর মুসলমান দেশগুলির সম্পর্কে। পশ্চিমের আগ্রাসনপ্রবণ ও অস্পষ্টবাক ইসলামভীতি বা কখনো ইসলামবিরোধিতার প্রতিক্রিয়ায় তথাকথিত মুসলিম উম্মাহতে এক ধরনের আদর্শিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু বহু মুসলমান দেশের (বাংলাদেশসহ) বিদ্বৎসমাজে এর প্রভাব দিন দিন ক্রমবর্ধমান ও জটিল হয়ে উঠল। উদারপন্থী বুদ্ধিজীবীর বিপরীতে বাংলাদেশেও দেখা গেল পুরাকালের অনুসরণে ধর্মাচার সম্প্রচারে উৎসাহী একটা আলেম সমাজ গড়ে উঠছে। ইসলামি চিন্তা নয়, ইসলামি ধর্ম শিক্ষার ওপর প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে লাগল প্রাথমিকভাবে গ্রামীণ ভূগোলে; কিন্তু প্রায় ষাটের দশকের ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও করো’ সেøাগানের অনুকরণে নগরগুলিতেও দিন দিন এসব প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পেতে লাগল। আমার এবং আনোয়ার ভাইয়ের মধ্যে এসব নিয়ে আলোচনা কোনো একদিন বা একবারে সীমাবদ্ধ ছিল না। এমন ভাবনা আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে স্থায়ী আবাস পেয়েছিল।
কিন্তু আমি আমার বাসায় সেদিন দুপুর গড়িয়ে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার প্রস্থান পর্যন্ত যে-বিষয়টার ওপর বেশি আলোচনা করেছিলাম এবং কিছুটা নিঃসহায়ভাবে পরাস্ত বোধ করছিলাম, তার ভাবনার কেন্দ্রে ছিল নারী। দেখা যাচ্ছে, এখনো দেখা যায়, পশ্চিমের আদি ইসলাম ভাবনা (স্মরণ করার চেষ্টা করুন স্পেনের ওহয়ঁরংরঃরড়হ, আমরা দুজন সেদিন স্মরণ করেছিলাম) থেকে আধুনিক কালের প্রবণতা বিচারে ভিন্নধর্মী কিন্তু যুগপৎ উত্তপ্ত ও শীতল বুদ্ধিবৃত্তিক যুদ্ধের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে এবং তার সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাবটা পড়েছে নারীর ওপর। মাত্র কিছুদিন আগে লন্ডন শহর থেকে ফিরে আসা আমার স্মৃতির অনিচ্ছুক প্রহরায় তখনো বিপণিসাম্রাজ্যের রাজধানী লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটের দৃশ্য ভাসছিল। কেনাকাটার ওই কেন্দ্রে তখন হিজাবধারিণী যত নারী দেখেছিলাম, তার সংখ্যা ছিল তৎকালীন ঢাকাই শপিং মলের বাস্তবতার চেয়ে বেশি।
আমাদের সমাজের আলেম গোষ্ঠী প্রায় বিনা বিবাদে নিত্যদিন ধমক দিচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ আচরণে বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবীদের। আর পাশ্চাত্যের ইসলামবিরোধী মানস যুদ্ধ করে বোমা ফেলে মুসলমান নিধনের যে প্রকল্প রক্তাক্ত প্রচেষ্টায় বাস্তবায়ন করছে, প্রধানত মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায়, তার অভিঘাতেও আমার – আনোয়ারভাইয়ের চিন্তার বৃত্ত বেশ টলমল করতে লাগল। এবং নারীকেও যেন প্রায় বিনা যুদ্ধে পরাজয় মেনে ঘরে ঢুকতে হলো এবং ঘরের বাইরে যেতে গেলে নিজেকে আপাদমস্তক ঢাকতে হলো। সমাজ-ইতিহাসের এক অনভিপ্রেত ও অনিবার্য বিচারে আমরা তখন বিধ্বস্ত বোধ করেছি।
আনোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে এমন অনেক আলোচনা হয়েছে। শুধু নারীর সামাজিক অবস্থান নিয়ে নয়, আরো বহুতর বিষয়ে। নানা কারণে, অনেকদিনের বিরতিতে হলেও এই প্রসঙ্গ ফিরে এসেছে আমাদের আলাপনে। আমি বছরের পর বছর শেক্সপিয়র পড়াই। বিশেষ করে আশির দশকে আমাদের হাতের নাগালে এসেছিল বেশ কয়েকটা বই, যেগুলি এই নাট্যসম্রাটের নারী-ভাবনা বিষয়ে তুখোড় সব তর্কের সৃষ্টি করেছিল। আমি বেশ উত্তেজিত ও উদ্দীপ্ত বোধ করেছি। নারীবাদী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে প্রাধান্য দিয়ে সাহিত্য-সংস্কৃতির বিচারের প্রবণতা তখন এদেশে এবং ভারতে গতিশীল হয়ে ওঠে। আমাদের দেশের এবং কলকাতাসহ অগ্রবর্তী চিন্তায় আগ্রহী ব্যক্তিরা সাহিত্যবিচারে নারীর অবস্থানকে গুরুত্ব প্রদানে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। যে-কোনো আলোচনার সূত্রে আধুনিক কালে এই প্রবণতা বেশ প্রাধান্য পেয়েছে। মজার বিষয় হলো, এমন ভাবনাবৃত্তের মধ্যে এই কিছুকাল আগে পর্যন্ত যেমন রাজনীতি বা বিশ্বব্যবস্থার নিরীক্ষণে বামপন্থার অনুসারী বিদ্বৎসমাজ অনেক বেশি উচ্চবাক্ ছিলেন, কালক্রমে দেখা গেল যারা মধ্যপন্থী, যারা নিজেদের শুধুই উদারতাবাদী হিসেবে পরিচয় দিতে আরামবোধ করেন, তারাও এমন চিন্তাধারাকে মূল্য দিচ্ছেন।
এতো কথা আবার তুললাম এই কারণে যে, আলী আনোয়ার এসব সভায় অতিমুখর ভূমিকায় নেমেছেন, এমনটা খুব দেখিনি। কিন্তু অন্যরা যখন শব্দের আতশবাজি সৃষ্টি করেছেন, তিনি সেসব অনুসরণ করেছেন এবং তার সাম্প্রতিক স্ফূরণের সঙ্গে অতীতের প্রেক্ষাপট যুক্ত করে আরো চিন্তাশীল, আরো পরিশীলিত বিচার-বিবেচনার গঠন প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত হয়েছেন। দীর্ঘ আলাপচারিতায় তা প্রকাশ পেত। এ-কথা এখনো মনে পড়ে, কতবার বিতর্ক-বিভূষিত আড্ডার পর হাঁটতে হাঁটতে তাঁকে বলেছি, আনোয়ার ভাই, এই যেসব বিষয় নিয়ে ইতিহাসের অন্দর-বাহির পরিভ্রমণ করলেন, এইগুলিকে লিখে ফেললে হয় না? তাঁর একটি বিচিত্র হাসির মুদ্রা ছিল, হাসির দৈর্ঘ্য সেকেন্ড তিনেকের মতো, তারপর দুই ঠোঁটের মিলন। অর্থাৎ কথাটাকে অবজ্ঞা না করলেও আমরা যেমন কোনো কিছু লিখতে গিয়ে যথাযথ প্রতিশব্দের খোঁজ নিতে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিধান তাক থেকে নামিয়ে আবার যথাস্থানে রেখে আসি, ব্যাপারটা ওইরকম। অর্থাৎ তাঁর প্রতিক্রিয়ার ধরন ছিল এমন যে, প্রসঙ্গটা নাড়াচাড়ার সময় আমি না হয় কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছি, অন্যান্য পণ্ডিত কী বলেছেন, সেসব উল্লেখ করেছি, তাই বলে কি এ বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে? খুব কাছ থেকে তাঁকে দীর্ঘদিন দেখেছি, তাই এমন মন্তব্য করতে পারছি, অনেকটা বেদনায়, কিছুটা ক্ষোভে।
এই সূত্রে মনে পড়ছে আমাদের আরেক প্রয়াত বন্ধুর কথা, নাজিম মাহমুদ। খুলনায় আমরা দুজনেই ছিলাম সক্রিয় সংস্কৃতিকর্মী, আবার তিনি ছিলেন আলী আনোয়ারের সহপাঠী বন্ধু, দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী। চাকরি সূত্রে দুজনেই ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। আলী আনোয়ার শিক্ষকতায় আর নাজিম মাহমুদ প্রশাসনে। সহপাঠী আলী আনোয়ারের সঙ্গে ঠাট্টায়-আড্ডায় মেতে থাকলেও অন্যজন ছিলেন বন্ধুর জ্ঞানচর্চার আমারই মতো মুগ্ধ ভক্ত। রাজশাহীতেই নাজিম মাহমুদ (তাঁকে আমি আলো ভাই বলে ডাকতাম) একবার খুবই শ্রদ্ধাসূচক কণ্ঠে আমাকে বলেছিলেন, আমাদের মধ্যে লেখাপড়ায় চিন্তাভাবনায় আলী আনোয়ারের চেয়ে পরিপক্ব কেউ নেই। আর আমার মনের কথা জুড়ে দিয়েছিলেন, ‘ও যখন আড্ডার মধ্যে ও ব্যক্তিগত কথাবার্তায় নানান বিষয়ে কথা বলে, সেগুলো যদি কোনোভাবে টেপ রেকর্ডারে ধরে রাখা যেত, তা থেকে ট্রান্সক্রাইব করে কয়েকটা অসাধারণ বই প্রকাশ করা যেত।’ বিশ্বাস করি, তাঁর ছাত্রছাত্রীরাও অনুরূপ মত পোষণ করতেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আলী আনোয়ার আমাদের মতো বাঙালি পাঠকদেরকে ঋদ্ধ করতে পারতেন।
আমাদের সমাজে এবং বৃহত্তর বিশ্ব প্রেক্ষাপটে নারীর গৌণ অবস্থান বিষয়ে আলোচনার রেশ ধরে অনেক আশেপাশের পথ পরিক্রম করে ফেললাম। স্মৃতিচারণমূলক রচনার এই এক বিরাট ঝুঁকি এবং সেটা আরো প্রবল হয়ে ওঠে যখন ব্যক্তি অতি নিকটজন এবং যুগপৎ অনন্য গুণের অধিকারী। বারকয়েক তাঁকে বলেছি, নারী নিয়ে যে এতো বহুকৌণিক আলোচনায় সমকালীন সমাজ মশগুল এবং আপনারও ক্ষুরধার বেশ মন্তব্য আছে – এ-বিষয়ে একটা বড় আকারের কিছু লিখুন। প্রত্যুত্তরে সেই ক্ষণিকের প্রস্তাব – বাতিল – করা হাসি। তিনি অবশ্য পরে লিখেছেন, যতটা কাঠামোগত বিন্যাসে প্রকল্পিত হলে তা একটা অসাধারণ গ্রন্থ হতে পারতো, তেমন প্রবল ইচ্ছানিষ্ঠ ব্যক্তি তিনি ছিলেন না।
তবে ২০০৮ সালে তিনি ‘নারীমুক্তির স্খলিত স্বপ্ন’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। অনবদ্য, তথ্য ও বিশ্লেষণসমৃদ্ধ প্রবন্ধ। পড়লে তাঁর অধ্যয়ন ও যুক্তিবিন্যাস বিষয়ে পাঠক চমকিত বোধ করবেন। না, আমাদের অনুরোধের পীড়নে বা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তিনি ওই প্রবন্ধ রচনায় হাত দেননি। বেশ কয়েকবার তাগাদা দিতে হয়েছিল অবশ্য। প্রবন্ধের জন্মকথনটা একটু নিবেদন করতে চাই। ড. খান সারওয়ার মুরশিদ অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে আমাদের অনেকেরই শিক্ষাগুরু তিনি। তাছাড়া এদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের নেপথ্যকর্মী হিসেবে তিনি আমাদের সকলেরই শ্রদ্ধার পাত্র। সত্তর দশকের প্রথম দিকেই তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সূত্রে আলী আনোয়ার তাঁর সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ পান। নানান কাজে আমিও মুরশিদ স্যারের সান্নিধ্য পেয়েছি। তাঁর সহধর্মিণী বেগম নূরজাহান মুরশিদ আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের সপক্ষে সমর্থন জোরদার ও সংহত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। স্ত্রীর পরলোকগমনের পর মুরশিদ স্যার একটি স্মরণগ্রন্থ প্রকাশনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। অনুপ্রবিষ্ট বলে মনে হলেও প্রাথমিকভাবে একটা মন্তব্য পেশ করতে চাই। পরম বন্ধু আলী আনোয়ারের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে যা বলেছি তার প্রায় সবটাই অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের জন্য প্রযোজ্য। তিনিও তাঁর গভীর অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে নিজের বা পরবর্তী প্রজন্মের বুদ্ধিবৃত্তিক কল্যাণে নিয়োগ করেননি। ভাবতে অবাক লাগে, তাঁর এমন অতল পাণ্ডিত্য আমাদের জন্য সম্পদ হয়ে উঠতে পারল না। কিঞ্চিৎ একাগ্রতা ও শ্রমে আসক্তি থাকলেই তিনি তাঁর মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের উঁচু মানের গবেষক হয়ে উঠতে সহায়তা করতে পারতেন।
যাই হোক, এমন উপ-কথা থেকে আপাতত নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়াই ভালো। নূরজাহান মুরশিদ স্মরণগ্রন্থের জন্য আলী আনোয়ারকে অন্যতম লেখক হিসেবে নির্বাচন করেন খান সারওয়ার মুরশিদ। আমিই সেকথা তালিকাভুক্ত লেখককে জানিয়ে দিই। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আমার বন্ধু যা বলেছিলেন তার মর্মকথা হলো, এই ষড়যন্ত্রের নিশ্চয়ই আমি একজন সক্রিয় হোতা এবং আমার মতো মিত্র থাকলে নাকি শত্রু থাকার আর দরকার নেই ইত্যাদি। সব কথাই অবশ্যই সরস কথোপকথনের অন্তর্ভুক্ত। বলা বাহুল্য, আমার উদ্যোগে প্রথম সংবাদ পরিবেশন আলী আনোয়ারের ওপর প্রাথমিকভাবে তেমন কোনো সদর্থক প্রভাব ফেলতে পারেনি। খান সারওয়ার মুরশিদ তাঁর দায়িত্বের জায়গা থেকেই লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। এতেও যে তিনি অনুগত ছাত্রের মতো লিখতে বসে গেলেন, তা নয় কিন্তু। বোধ করি এমন যুগপৎ বৌদ্ধিক গুণসমৃদ্ধ এবং লিখনে শীর্ষ অনেক বিদ্বজ্জনের জন্যে সেটাই স্বাভাবিক।
আমার দ্বিতীয় তাগাদায় যা বললেন তিনি সেটাকে স্বীকারোক্তিই বলতে হবে। কথাগুলো ছিল এরকম – ‘কী যে লিখব তার মাথামুণ্ডু কিছু ভেবে পাচ্ছি না।’ কিন্তু মুরশিদ স্যার নিজেও বলেছেন, অতএব তা যে মান্য করতে হবে, এমন এক বোধ তাঁকে তাড়িত করছে, সেটা বোঝা গেল। এমন তাগাদার ফসল হলো নারীমুক্তি বিষয়ে একটি অসাধারণ প্রবন্ধ। শুরু করেছেন সাম্প্রতিক ঘটনা এবং আমাদের নিকটবর্তী দুই দেশের সমকালীন প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে। অতিদ্রুতই ফিরে এসেছেন বাংলাদেশের ভূগোলে। ১৯৯৩ সালে সিলেটের ছাতকছড়া গ্রামের নূরজাহান নামের নারীর ওপর অবিচার, মানসিক নির্যাতন ও তাঁর আত্মহত্যার পূর্বাপর বর্ণনা আছে। প্রথম চার পৃষ্ঠার কিছু বেশি অংশ পাঠে মনে হবে যেন সংবাদপত্রের খবর বা অতিথি কলাম লেখকদের মন্তব্য শুনছি। কিন্তু তিনি দ্রুতই ফিরে গেলেন ঊনবিংশ শতকে নারী মুক্তির আন্দোলন, বিধবাবিবাহ প্রচলন এবং রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মুসলিম নারীদের পর্দাবন্দিত্বের বিরোধী অবস্থানে। ক্রমে প্রবেশ করেছেন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বেহুলা, এলিজাবেথীয় ইংরেজি সাহিত্যের দেসদিমোনায়। আমার এই রচনায় উদ্দেশ্য এই প্রবন্ধ ও তাঁর অন্যান্য রচনার সমীক্ষণ নয়। চিহ্নিত করতে চাইছি তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক বিচারের কথা। প্রবন্ধের সমাপনী অংশের দুটি বাক্য শুধু উদ্ধৃত করতে চাই – ‘মহিলারা যে ক্ষমতা সম্পর্কে এত স্পর্শকাতর তা-ও ভাবাদর্শভিত্তিক। কাজেই প্রচলিত ভাবাদর্শের বিনির্মাণ (deconstruction) না করে নারী – পুরুষের নতুন সুস্থ সমতার আনন্দময় সম্পর্ক স্থাপন করা যাবে না।’
দীর্ঘ পঁচিশ পৃষ্ঠার এই প্রবন্ধের এমন সিদ্ধান্তবাচক কথা উচ্চারণ করতে গিয়ে আলী আনোয়ার দীর্ঘ সময় ও বিপুলা এ পৃথিবীর অনেকটা অংশ পরিক্রমণ করেছেন। চিন্তার আলোকিত রাজপথ ও অন্ধকার অলিগলিতে উঁকি দিয়েছেন বিশ্লেষণী মন নিয়ে। প্রবন্ধ শেষ করলেন এভাবে, (ওপরে উদ্ধৃত দুই বাক্যের ঠিক পরপরই) ‘নারী নেতৃত্ব অবধারিতভাবে সেদিকেই এগোচ্ছে।’ আমি তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক পথ চলারও অনুরাগী সহচর ছিলাম। তাই নিশ্চিত করেই বলতে পারি, তিনি এভাবে শেষ করে তৃপ্ত ছিলেন না। লেখাটা বেশ দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে, তাগাদা বাড়ছে। তাই যে-কথা আগে বলেছি, সংক্ষোভের সঙ্গে, এখান থেকেই যদি তিনি তাঁর থামিয়ে দেওয়া ভাবনারাজিকে শব্দের বাঁধনে বিন্যস্ত করতে উদ্যোগী হতেন, নারীমুক্তির পন্থা, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে তাহলে চেতনার স্তম্ভে গিয়ে ধাক্কা দেওয়ার মতো একটা গ্রন্থ রচনা করতে পারতেন। মুরশিদ স্যারের কাছে তাঁর কথা রাখা হয়ে গেছে। অনুচ্চারিত অন্যসব কথা আবার মস্তিষ্কের কোটরে পুনর্বাসিত হলো।
এসব কথা যখন বলছি, তখন তাঁর শব্দে আমার বহু বছরের বন্ধুত্বের উত্তাপ ও কথোপকথনের নিঃশেষিত বচনপ্রক্রিয়া প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে আসছে। জানি যা বলেছি, তাতে এক ধরনের সমালোচনা লুকানো আছে, কিন্তু তারও গভীরে আছে অশ্রু। আমার এই লেখার প্রধান লক্ষ্য আলী আনোয়ারের অনতিকলেবর ও বিচিত্র সাহিত্যকর্মের মূল্যায়নধর্মী কোনো বিবরণী রচনা নয়। এই লেখা হলো পরম স্বজন হারানোর অশ্রুপাতস্নাত এক স্মৃতিলেখ, যার মধ্যে ‘আপনার চেয়ে আপন যে জন’, তাকে খুঁজে ফেরার পথে তাঁর রচিত অসামান্য সব বুদ্ধিবৃত্তিক বিবেচনা রোমন্থন করে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। সবাই তো জানেন যে, শ্রদ্ধা এবং আন্তরিক ভালোবাসা অবিভাজ্য। মননে সদাই বিতর্কলিপ্ত মানুষ যে, তার বোধ ও ধারণাসমূহ শব্দের রেখায় আঁকতে কতটা নির্লিপ্ত হতে পারেন, আমার মতো যারা আলী আনোয়ারকে কাছ থেকে দেখেছেন, তারা বুঝতে পারবেন।
যে-লেখাটার বিষয় একটু আগে আলোচনা করলাম, তার জের ধরে আমার মন খারাপ হওয়া আরেকটি স্মৃতি উল্লেখ করতে চাই। সালটা ঠিক মনে নেই। তবে সম্ভবত আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধে। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনের বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষে প্রতিবারই সঙ্গীত সংস্কৃতি নামে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়। প্রায় বছর তিরিশেক আমি এই সংকলন সম্পাদনায় মুখ্য দায়িত্ব পালন করেছি। সেবার সম্মেলনের কাছাকাছি সময়ে আলী আনোয়ার রাজশাহী থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। অনেক পীড়াপীড়ির পর তাঁকে রাজি করাতে পারলাম। একটা লেখা তিনি দেবেন। আমি সাভারের কর্মস্থল থেকে ফিরে সিদ্ধেশ্বরী যাওয়া পর্যন্ত তিনি লিখবেন। দিন তিনেক লিখলেও একটা ভালো লেখা তৈরি হয়ে যাবে। সেই সময় আমার আরেকটা কঠিন দায় এসে পড়লো। আমার এক অতিনিকটজনের কনিষ্ঠ ভ্রাতার বিয়ে। আমি না গেলেই নয়। আমার বন্ধুও তা জানেন। আমি মহাখুশি। তিনি হাতের লেখায় পৃষ্ঠা চার-পাঁচ লিখে ফেলেছেন। লেখাগুলির অক্ষরবিন্যাস চলছে তাঁর সিদ্ধেশ্বরীর বাড়ির প্রতিবেশী দূরত্বে শান্তিনগরে, একেবারে হাঁটাপথ। দুজনে মিলে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম। তাঁকে চিনিয়ে দিলাম জায়গাটা। লেখাটা শেষ করে তিনি এখানে দিয়ে যাবেন। ঢাকায় ফিরে দেখি লেখার যে পর্যন্ত দেখে আমি ঢাকা ছেড়েছিলাম, তারপর তিনি শুধু রবীন্দ্রকবিতার ‘মুক্ত কর হে বন্ধ’ যুক্ত করেছেন। লেখাটা জমা দিয়ে তিনি রাজশাহী ফিরে গেছেন। মজার ব্যাপার হলো, এর কদিন আগেই নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের উদ্যোগে একটি থিয়েটার উৎসব আয়োজিত হয়েছিল, আর এই উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকার শিরোনাম ছিল ওই রবীন্দ্র-উদ্ধৃতি। আমিই তাঁকে ওই স্মরণিকাটি দিয়েছিলাম। তাঁকে গভীরভাবে জানলেও একটা চমৎকার সম্ভাবনাময় রচনার এমন অকালমৃত্যু মোটেও মানতে পারছিলাম না। বুকের মধ্যে কম্পন বাড়ে এই ভেবে যে, আমি জানি আর কত সব সম্ভাবনা হেরে গেছে আলী আনোয়ারের অন্তর্গত আলস্যের কাছে।
আমার একথাটা মনে হয়েছে যে, আলী আনোয়ারের ব্যাপক পড়াশোনাও সম্ভবত তাঁর লেখালেখির ভাণ্ডারটা হ্রস্ব হওয়ার জন্য দায়ী। নানা বিষয়ে বিশ্বের প্রধান পণ্ডিতরা কী বলেছেন, কীভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিচিত্র সব তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেসব বিষয়ে মস্তিষ্কের মধ্যে সম্যক উপলব্ধি গড়ে উঠলে স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে, এরপর নতুন এমন কী লেখা যেতে পারে, কী ভাবনা আর যুক্ত করা সম্ভব যা সারস্বত সমাজে আলাদা আলোড়ন সৃষ্টি করবে। তাঁর মতো উচ্চতার পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তি যখন দেখতে পান, কোনো মনীষী বা সুনিশ্চিতভাবে তৃতীয় নয়নের অধিকারী কোনো বিদ্বজ্জন সাহিত্য, সমাজ বা সংস্কৃতি সম্বন্ধে সুতীক্ষè মন্তব্য করছেন, তখন তিনি অর্থাৎ আলী আনোয়ার সেসব মত কীভাবে তাঁর পঠিত বিষয়ের মধ্যে প্রতিফলিত বা প্রযোজ্য হতে পারে, সেই অনুশীলনে প্রবৃত্ত হন। এর উল্টো পিঠটাও একইভাবে সত্যি হতে পারে। উচ্চমানের সৃজনশীল সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বমূলক যেসব বই বাংলাভাষায় এদেশে বা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলির পঠনের সময় অমন সব পণ্ডিতের বীক্ষাকে কীভাবে বা কতটা শনাক্ত করা হচ্ছে – সেই অনুসন্ধানও সচল থাকে আলী আনোয়ারের মতো অনলস জ্ঞানভিক্ষুকদের জন্য। এমন মানুষদের জন্য শিক্ষার রাজত্ব বা প্রভুত্ব এতোটাই কাম্য যে, তাঁরা নিজেদের অভিমতটা সশ্রমে গুছিয়ে তোলার আগেই নতুন গ্রন্থের সংবাদ এসে হয়তো তাঁদের কাজটাকে আর এগোতে দেয় না। আর অধ্যাপক আলী আনোয়ারের মতো যাঁরা সাহিত্যের শিক্ষার্থী হয়েও সমাজবিজ্ঞান, সমাজের হিতাহিত এবং আর্থ – রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে ভাবেন, তাঁরা অনুকারী বা পুনরাবৃত্তিবাচক লেখার ডাকে সাড়া দিতে পারেন না।
স্মৃতির ঝাঁপি থেকে আরেকটা মন খারাপ করা কথা পেশ করছি। এরপর নিজেকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করব। ১৯৮৮ সাল। অগ্রগণ্য ব্রিটিশ/ আমেরিকান কবি-নাট্যকার-সমালোচক টিএস এলিয়টের জন্মশতবর্ষ। এর বেশ কয়েক বছর আগেই আমি বিভিন্ন বিরতিতে এলিয়টের কিছু কালজয়ী গদ্য, ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ এবং ‘দ্য ফ্যামিলি রিইউনিয়ন’ অনুবাদ করেছিলাম। ভূমিকা ও বিস্তারিত টীকা-টিপ্পনীসহ এলিয়টের সাড়া-জাগানো অনন্য দীর্ঘ কবিতার অনুবাদ-গ্রন্থটি আমি অগ্রজপ্রতিম আলী আনোয়ারকে উৎসর্গ করেছিলাম। যা হোক, ১৯৮৮ সালের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আমার অনুবাদ ছাড়াও এলিয়টের আরো কিছু কবিতার বাংলা ভাষান্তর প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতা থেকে। বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে যাতে বাংলাভাষায় একটা প্রতিনিধিত্বমূলক (বংংবহঃরধষ) এলিয়টগ্রন্থ প্রকাশ করা যায়, তার জন্য এক শ্রমশীল উদ্যোগ গ্রহণ করি, বাংলার এপার – ওপারের এলিয়ট – বোদ্ধা এবং আমার বন্ধু ও কৃতী ছাত্রছাত্রীদেরও প্ররোচিত করেছিলাম নির্বাচিত কবিতা এবং কবির সাহিত্যচিন্তা বাংলায় ভাষান্তরের কাজে। খেটেখুটে একটা দীর্ঘ জীবনপঞ্জিকা তৈরি করেছিলাম। অধ্যাপক আলী আনোয়ারকে যুক্ত না করতে পারলে তো আমার প্রকল্প সম্পূর্ণ হতে পারে না। তাঁর জন্য আমি যথাযোগ্য দায়িত্বই ঠিক করেছিলাম। টিএস এলিয়ট তাঁর পিএইচ.ডি ডিগ্রির জন্য যে-অভিসন্দর্ভ প্রস্তুত করেছিলেন (অবশ্য তিনি সবশেষের মৌখিক পরীক্ষাটি আর দেননি) সেই বিষয়ে তাঁকে লিখতে বলেছিলাম। বেশ কষ্ট করে ওই অভিসন্দর্ভ বিষয়ে অন্যদের রচনা সংগ্রহ করেছিলাম। সেসবও আনোয়ার ভাইকে দিয়েছিলাম। মনে আছে, অল্প কদিনের জন্য বিলেত গিয়ে এ নিয়ে নতুন কিছু মালমসলা পেয়েছিলাম ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে। তা এনে দেওয়ার পর তিনি দৃশ্যতই বেশ উত্তেজিত বোধ করলেন। বারবার তাগাদা পাঠাচ্ছি। যেহেতু তাঁর পরিবারে আমার সদস্যপদ ছিল, তাই পুত্রকন্যা মারফত তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল। আমি ঢাকা থেকে প্রায় প্রতি সপ্তাহে একটি করে চিঠি লিখছি। এর মধ্যে এ-বিষয়ে তাগাদা জোরদার করার জন্য নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য একটি কাজে রাজশাহী যেতে হয়েছিল। তাঁর ওখানে আতিথ্য গ্রহণ আমার জন্য প্রায় বাধ্যতামূলক ছিল। বাড়িতে ঢুকে যা দেখি, তাতে আমি যারপরনাই পুলকিত ও বিস্মিত হয়ে গেলাম। আমার সেইসব চিঠি পুত্রকন্যারা কোনোটা আনোয়ার ভাইয়ের শোবার ঘরের দেয়ালে, কোনোটা খাবার ঘরে, কোনোটা আবার দরজার কপাটে লাগিয়ে রেখেছে খুবই দৃশ্যমান করে, চমৎকারভাবে স্বচ্ছ আঠালো সরু ফিতা দিয়ে লাগানো। ওদের অমন উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা এবং আমার আকুল আবেদনের পরও আনোয়ার ভাই কিন্তু আমার অমন শ্রমকাতর ও আকুল আবেদন রক্ষা করতে পারেননি। এখনো বুকের ভেতর একটা কষ্ট বাজে, অন্য অনেকের কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করার পরও আমার পরিকল্পিত ওই সংকলন – গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারিনি।
এজন্য মনটা খুব খারাপ হয়েছে। কিন্তু ভাবার চেষ্টা করেছি, কেন তিনি, যিনি আমার এক নিকটজন, কেন প্রার্থিত প্রবন্ধটি লিখলেন না। অনেকবার তাগাদা লাগবে, অনেকদিন অপেক্ষা করতে হবে, এমনটা আমি ধরেই নিয়েছিলাম, কিন্তু লেখাটা পাব না, এমনটি ভাবিনি। টিএস এলিয়টের গবেষণার বিষয় ছিল – এফ.এইচ. ব্রাডলির দর্শন, যেখানে গবেষক অনুসন্ধান করছিলেন ব্রাডলি – নির্দেশিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার তুলনামূলক মূল্য ও তারতম্য বিষয়ে। এলিয়ট হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কোর্সভিত্তিক পড়াশোনার শেষে এই সুনির্দিষ্ট অনুশীলনে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন; কিন্তু অন্বেষায় প্রার্থিত মাত্রায় আগ্রহী ছিলেন না। সেজন্যই মৌখিক পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য আর হার্ভার্ডে ফিরে যাননি। কিন্তু অধ্যাপক আলী আনোয়ারও বোধহয় ব্রাডলি বা এলিয়ট উভয়ের অবস্থানের দ্বান্দ্বিক ব্যাখ্যার রূপরেখা সাজাতে অন্য দার্শনিকদের অভিমত অথবা জীবনলগ্ন প্রত্যয়সমূহকে পরীক্ষা বা নির্মাণের যথাযোগ্য পথরেখা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, যার দ্বারা একটি মূল্যবান ও ব্যতিক্রমী যুক্তিতর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায়। বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা করার ভিত্তি হয়তো রচনা করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তী বিস্তার বিষয়ে নিশ্চিত বোধ করছিলেন না। জানি না।
সাহিত্য-সংস্কৃতির সব শাখা-প্রশাখা ছাড়িয়ে আমাদের দুজনের ভালোবাসার মূল কেন্দ্র ছিল নাটক। রাজশাহী থেকে ঢাকায় যখনই আসতেন, মহিলা সমিতি মঞ্চে নাটক দেখাটা ছিল প্রায় আবশ্যিক এক সান্ধ্য-কর্মসূচি। বাড়তি একটা সুবিধা ছিল, তাঁর বাড়ি থেকে এই মঞ্চ ছিল ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে। অতএব বিকেলের আড্ডাকে যতটা সম্ভব বিলম্বিত করে অথবা কোনো কাজ থাকলে তার দায় যথাশীঘ্র মিটিয়ে নাটক দেখার আনন্দ মিটিয়ে নেওয়া যেত। সে একটা সময় ছিল, যখন ঢাকার নাটকপাড়ায় (একটাই অবশ্য পাড়া তখন) জার্মানির ব্রের্টল্ট ব্রেশট খুবই জনপ্রিয়। তাঁর প্রধান দুটি কারণ ছিল – স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের মঞ্চনাটককে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যাঁরা প্রাথমিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁরা ওই ১৯৭১ সালে কলকাতাবাসের সময় ওই নগরে ব্রেশটের নাটকের অসাধারণ জনপ্রিয় সব প্রযোজনা দেখে উত্তেজিত বোধ করেছিলেন। অনুরূপ কিছু সৃজনের তাড়না তাঁদের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল। তাছাড়া সদ্যস্বাধীন দেশে ব্রেশটের সমাজতন্ত্রী মতবাদকে ছড়িয়ে দেওয়ার একটা আকাক্সক্ষাও সক্রিয় ছিল। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট যেন ব্রেশটের নাটক প্রযোজনার জন্য বিশেষভাবে অনুকূল ছিল। মনে আছে, ব্রেশট রূপান্তর নিয়ে আমরা অনেক আলোচনা করেছি। যে সমাজের মানুষ তখনো চলচ্চিত্রকে ‘বই’ বলতেন, তারা যে মঞ্চের কাহিনি এবং দর্শকসারির মধ্যে চেতনাগত বা ভাবগত দূরত্ব রচনার প্রয়াসকে মেনে নিচ্ছেন, এটা আমাদের পরিতুষ্ট করতো। অবশ্য তখন নাটকের দর্শকবৃন্দের একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীগত পরিচয় ছিল বা বলা যায়, এখনো আছে।
কিন্তু কখনো কাহিনিভিত্তিক মঞ্চায়নের প্রতি দর্শক আনুকূল্য হ্রাস পায়নি। খুব স্বাভাবিকভাবেই অনেক নাটকের কাহিনিতেই মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এসেছে। সেসবের পরিবেশনার মধ্যে নাট্যকার-নির্দেশক এবং দলের বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিও প্রকাশ পেত। মনে পড়ে, থিয়েটার নাট্যদলের প্রযোজনা পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়-এর কথা। কাহিনি ও পরিবেশনা ঢাকার মঞ্চে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। নাটকের সংলাপে অন্ত্যমিলসমৃদ্ধ পয়ার এবং মোহাম্মদ জাকারিয়া, ফেরদৌসী মজুমদার এবং আবদুল্লাহ আল মামুনের অনবদ্য অভিনয়ে সৈয়দ শামসুল হক বিরচিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এই আখ্যান আনোয়ার ভাইও একাধিকবার দেখেছিলেন। রীতিভাঙা মঞ্চ পরিকল্পনা এবং সেলিম আল দীনের কাহিনিকে ভিন্ন আঙ্গিকে পরিবেশনার মাধ্যমে দেশীয় মঞ্চনাটকে ঢাকা থিয়েটার আলাদা ধারা সৃষ্টিতে তৎপর ছিল। এসবের মধ্যেও ঢাকার মঞ্চে অভিনীত হয়েছে শেক্সপিয়রের ওথেলো এবং বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণকান্তের উইল। স্বীকার করতেই হবে, এসব নিয়ে আলোচনার নানাপর্বে আনোয়ার ভাইয়ের বিশ্লেষণ ছিল খুবই শিক্ষণীয়। আজ গভীর বেদনার সঙ্গে সেসব দিনের কথা স্মরণ করছি।
আমাদের দুজনেরই আনন্দ-অনুসন্ধানের পথ অদ্বিতীয় ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চার বছর পার হওয়ার কম সময়ের মধ্যেই রাজনৈতিক মাৎস্যন্যায় সৃষ্টি হয়েছিল এবং তার অনিবার্য প্রভাবে আবার আমাদের ওপর সামরিক শাসন চেপে বসলো। এমনকি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন, যেখানে সর্বদাই প্রগতিশীল ভাবধারা বিকশিত হয়েছে এবং যেখানে মুক্তচিন্তা লালন করার উদার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, সেসবও যেন কেমন করে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের অভিঘাতে অন্যরকম হয়ে গেল। বেশ কয়েকটা বছর আমাদের মতো অনেক শিক্ষককে একধরনের বিহ্বল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। শিক্ষার্থী সমাজের মধ্যে কী দ্রুত প্রতিক্রিয়াবাদী ধ্যানধারণা জায়গা করে নিল। মনে পড়ে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের মিছিলে নানা সেøাগান ধ্বনিত হচ্ছে, করিডোর প্রদক্ষিণকালে আমার বা মোহাম্মদ রফিকের কক্ষের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় উচ্চ কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে, রুশ-ভারতের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান। ঠিকই একই শব্দহুংকার হয়তো শুনতে হয়নি আনোয়ার ভাইকে, কিন্তু রাজশাহীর পরিস্থিতিও ছিল বেশ দুর্বহ। মনে পড়ে, অনেকবার আমি আর আনোয়ার ভাই বোঝার চেষ্টা করছি, চিন্তার রাজ্যে এমন ভাঙন কী করে সৃষ্টি হল। বঙ্গবন্ধুকেও শুধু পরিহার নয়, তাঁকে নিন্দার পাত্র হিসেবে চিহ্নিত করতে দেখেছি বহুসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে।
মনে পড়ে, ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক কালবৈশাখীর পর প্রাথমিক কয়েক মাসের অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা ও প্রবল ভীতিগ্রস্ত অবস্থা আমাদের ভীষণভাবে বিচলিত করেছিল। তখনকার দিনে মুঠোফোনের সুবিধা ছিল না। আর তখন আনোয়ার ভাইয়ের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাড়িতেও ফোন ছিল না। একেবারে জরুরি প্রয়োজন হলে অন্য কোনো সহকর্মীর বাড়িতে ফোন করে ডেকে কথা বলতাম। তিনি আমাকে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তা করতেন। ফোনের অন্যপ্রান্তের কণ্ঠস্বরে তা বুঝতে পারতাম। জাহাঙ্গীরনগর তখনো বিভাগ সংখ্যায় একটা ছোট বিশ্ববিদ্যালয়। দৃশ্যমান দূরত্ব সৃষ্টি না হলেও যেসব শিক্ষককে আওয়ামী লীগ বা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি সমব্যথী মনে করা হতো, তাঁরা এক অদৃশ্য চাপ বোধ করতেন। অথচ যারা আমাদের (তাদের ভাষায় রুশ – ভারতের দালালদের) কিছুটা তির্যকভাবে দেখতেন, তাদের প্রায় সবাই কদিন আগে বাকশাল সদস্য হিসেবে স্বাক্ষর দান করেছিলেন। শিক্ষক সমিতির সভা না ডেকে (এমনকি নির্বাহী পরিষদের সভা আহ্বান না করে) একটি বিবৃতি প্রদান করায় অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমদ (তিনি তখন বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি), মোহম্মদ রফিক এবং আমি নিয়মতান্ত্রিকভাবে এটা করা হয়নি বলে সাধারণ সম্পাদককে চিঠি দিই। ভাবতে কষ্ট হয়, তখন আমরা বিশেষভাবে সমালোচিত হয়েছিলাম। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সংবাদ রটে যায়। আনোয়ার ভাই বন্ধু নাজিম মাহমুদের ফোন থেকে আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চাকরিকাল তখনো দু – বছর পেরোয়নি। তাঁর সঙ্গেও আলাপটা মাত্র বছর তিনেকের। কিন্তু আমি সেদিন থেকে বুঝেছিলাম, তিনি কতটা আমাকে ভালোবাসতেন। এসব লিখতে গিয়ে চোখ ভিজে যায় জলে।
এমন স্মৃতির ঝাঁপি খুলতে গেলে লেখাটা দীর্ঘতর হতে থাকবে। সাহিত্যপাঠে আধুনিক সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগের সমান্তরালে আর একটি বিষয় তাঁর চিন্তার জগতে সদা-অস্তিত্বমান ছিল। তা হলো, ঊনবিংশ শতকের বাংলায় রেনেসাঁস ও সামাজিক পরিসরে তার সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ায় সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব এবং এমন একটা বুদ্ধিবৃত্তিক পটভূমি থেকে তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের পুনর্মূল্যায়ন করেছেন। তাঁর একটি প্রবন্ধের শিরোনাম ‘বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস : পুনর্মূল্যায়নের খসড়া’। যাকে তিনি মনে করেছেন ‘খসড়া’, গ্রন্থাকারে মুদ্রিত সেটির দৈর্ঘ্য হলো ৩৯ পৃষ্ঠা। লেখক যদি পূর্ণ কলেবর একটা রচনা লিখতেন, তাহলে তা বঙ্কিমপাঠে যে কী অসাধারণ এক মাইলফলক বলে পরিগণ্য হতো, সেকথা ভেবে অবাক হই।
সাহিত্যের বিরল আঙিনায় নামে (যা ২০১৭ সালে লেখকের জীবনাবসান-উত্তরকালে প্রকাশিত) প্রবন্ধ সংকলনগ্রন্থের ভূমিকায় সমকালের আরেক প্রাগ্রসর বুদ্ধিজীবী সনৎকুমার সাহা লিখেছিলেন, ‘আমার বিবেচনায় [এই প্রবন্ধ] আলী আনোয়ারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। নিরাসক্ত দৃষ্টি ও বিশুদ্ধ মনের নির্মাল্য নিয়ে তিনি বঙ্কিম-উপন্যাসে মগ্ন হয়েছেন। তাদের নান্দনিক পুষ্পমালা আমাদের মনোজগতে একটু একটু করে বিকশিত হয়েছে। প্রতিহত সম্ভাবনারাশি আমাদের মন বিদীর্ণ করেছে। আমরা বিরল সাহিত্যিক আনন্দের স্বাদ পাওয়ার একটি পথ খুঁজে পেয়েছি। বঙ্কিমের উপন্যাস যদি কেউ পড়তে চান, তবে তার আগে এই লেখাটি অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত বলে মনে করি।’ সনৎকুমার সাহার সঙ্গে মতান্তর হতে পারে, এমন পাঠক পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। উল্লিখিত প্রবন্ধটি এই গ্রন্থের প্রথম লেখা। দ্বিতীয় রচনাটিও বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস সাহিত্যের পুনর্মূল্যায়ন বিষয়ক। দ্বিতীয়টির শিরোনাম – ‘বঙ্কিমচন্দ্রের ইতিহাস ও সংস্কৃতি অন্বেষা : একটি উত্তর-ঔপনিবেশিক প্রস্তাবনা’। এটির আয়তনও কম নয়, ছাপার অক্ষরে ২৯ পৃষ্ঠা। সনৎকুমার সাহার মতে, (প্রায়-সহোদর না হলেও অথবা বিষয়ে সমভাবনামূলক না হলেও উভয়ই তো বঙ্কিম পাঠের পুনর্মূল্যায়ন) দ্বিতীয় প্রবন্ধটি আমাদের দৃষ্টিকে এক বিভাজিক ছকে ঠেলে ফেলে দেয়। উপনিবেশিকতা ও তার প্রভাবিত উত্তরকাল নিয়ে সনৎকুমার সাহার মন্তব্য মূল্যবান হলেও আমি এমন দ্বিভাজন কিংবা বহুবিভাজনের বিপক্ষে নই। এখানে সেকথা আলোচনার অবকাশ নেই।
কিন্তু বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের পাঠকদের যে-কথাটির প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই, তা হলো, উভয় রচনার শিরোনামের শেষ শব্দের ভ্রাতৃত্বসুলভ সাদৃশ্য ও দ্যোতনা। প্রথমটি ‘খসড়া’ এবং দ্বিতীয়টি ‘প্রস্তাবনা’। এখানেও আমার আর আনোয়ার ভাইয়ের মধ্যে একটা মিল খুঁজে পাই। কোনো একটি কেন্দ্রীয় ভাবনা নিয়ে লেখা শুরু করলেও লেখাটা যখন হয়ে ওঠে বা হয়ে ওঠার উপক্রমের আগেই, যারা লিখতে বলেছিলেন তাদের আর বাড়তি সময় বরাদ্দ করার উপায় থাকে না, তখন সেটাতে কিছু শব্দের আনুষ্ঠানিকতাবাচক সমাপনী জুড়ে দায়িত্ব পালন সাঙ্গ করা। খসড়ার মধ্যে তো পূর্তির বা বিকশিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকে; প্রস্তাবনা তো রাগসংগীতের আলাপের মতো প্রকৃত রস সঞ্চারের জন্য শ্রোতাকে দীর্ঘতর অভিজ্ঞতায় আহ্বান। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, প্রবন্ধদ্বয় শেষ করার সময় আলী আনোয়ার ভেতর থেকে বুঝেছিলেন, এ – বিষয়ে বলার মতো আরো অনেক কথা না-বলাই থেকে গেল, নিজের জন্য একটা অন্তর্গত সান্ত্বনা তৈরির জন্য শিরোনামের ওই ‘রইল বাকির’ দ্যোতনা।
এমন সীমিতপ্রজ অথচ এতো গভীর চৈতন্যতাড়িত একজন লেখক, আলী আনোয়ারের সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজ দর্শন-পুনর্দর্শনের কোনো আলোচনায় ব্রতী হওয়া, আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। তাঁর আরেকটি গ্রন্থের নাম সাহিত্য-সংস্কৃতি নানা ভাবনা। অধিকাংশ লেখাই উপলক্ষজাত ও রচিত হয়েছে যাদের অনুরোধ ফেলা যায় না তাদের নাছোড়বান্দা প্ররোচনায়। দুটি অসাধারণ গ্রন্থের অত্যল্প ও ছায়া-পরিচয় দিয়ে এই রচনার শেষ টানতে চাই।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল চিন্তাবিকাশে আলী আনোয়ারের নেতৃত্বদানের কথা সনৎকুমার সাহা দ্বিতীয়োক্ত গ্রন্থের ভূমিকা অংশে উল্লেখ করেছেন। ১৯৭০ সালে গোলাম মুরশিদের সম্পাদনায় বিদ্যাসাগরের সার্ধশত জন্মবর্ষে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশনায় আলী আনোয়ারের পরোক্ষ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ওই সংকলনে আলী আনোয়ার-প্রণীত ‘বিদ্যাসাগর ও ব্যক্তির সীমানা’ প্রবন্ধটির বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। আমার বিচারে অবশ্য মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার ‘বিদ্যাসাগর সংখ্যা’য় প্রকাশিত আলী আনোয়ারের ‘বিষণ্ন বিদ্যাসাগরের নির্বেদ ও নৈরাশ্য’ আরো চোখ খুলে দেওয়া প্রবন্ধ বলে মনে হয়েছে। আমার লেখা বিদ্যাসাগর বিষয়ে প্রবন্ধে এটির দ্বারা আমি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছি।
যে-দুটি গ্রন্থের বিষয়ে উল্লেখ করতে চাই, তার একটি ছিল ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারে পঠিত প্রবন্ধের সম্পাদিত সংকলন। সেমিনার ও গ্রন্থের শিরোনাম ধর্মনিরপেক্ষতা। এ – গ্রন্থে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার ভবিষ্যৎ’ বিষয়ে আলী আনোয়ারের একটি প্রবন্ধ রয়েছে। ১৯৭৬ সালের পরে জন্মগ্রহণ করা প্রজন্ম, যারা আজকের বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠজনের ধর্মের প্রবল প্রকাশ ও প্রতিপত্তি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার অভাব এবং বিভিন্ন বিরতিতে তাদের ওপর নির্যাতনের বাস্তবতা দেখে অভ্যস্ত, তারা হয়তো বুঝতেই পারবে না, একদিন এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের পক্ষে কী বিপুল সমর্থন ছিল। দেশের সংবিধানের মৌলিক চরিত্রের মধ্যেই সংগ্রথিত ছিল রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের কথা। বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসক তরবারির আঘাতে সংবিধান থেকে ব্যবচ্ছেদ করেন ধর্মনিরপেক্ষতা এবং তার সঙ্গে সমাজতন্ত্র। আজকের সংশোধিত সংবিধানে এই দুই মৌলিক স্তম্ভ পুনঃসংস্থাপন করা হলেও দেশের দ্বিতীয় সামরিক শাসকের অন্তর্ভুক্ত করা ‘রাষ্ট্রধর্ম – ইসলাম’, ওই সংযোজনকে রহিত করা যায়নি। দেশের রাজনীতি ও প্রশাসনে সংখ্যাগরিষ্ঠজনের ধর্মের আধিপত্য বিস্তারের কালে আনোয়ার ভাই আমাকে বলেছিলেন ১৯৭৩ সালের শেষ দিকে রাজশাহী থেকে ঢাকার পথে এক ট্রেনযাত্রার কথা। তখনো বাতাসে মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপ পাওয়া যেত, তখনো দেশের মুক্তির জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের দাগ বহন করা বহু বাড়ির দেয়াল দৃশ্যমান ছিল। সহযাত্রী বন্ধুকে আনোয়ার ভাই বলছিলেন, ‘আচ্ছা, আজ থেকে বিশ বছর পরে যখন আমাদের সন্তানরা দেশ ও সমাজ বোঝার জন্য মোটামুটি পরিণত হয়ে উঠবে, তারা তখন আমাদের এই উদ্যোগ নিয়ে কৌতুক করবে – আচ্ছা, এদেশে এমন একটা সময় ছিল বুঝি, যখন আমাদের বাবা – কাকারা এমনসব সমস্যা নিয়ে সেমিনার করতেন।’ আলী আনোয়ারের এমন বক্তব্য আজ বহু মানুষ নির্বোধের প্রলাপ হিসেবে চিহ্নিত করবেন। ১৯৭৩ সালেও এমন এক সমাজে বাস করেছি আমরা – কী বিস্ময়কর ঠেকে আজ!
আলী আনোয়ারের এক অসাধারণ কাজ হলো নরওয়েজীয় কবি-নাট্যকার হেনরিক ইবসেনকে নিয়ে লেখা বিপুলায়তন গ্রন্থ। তাঁর দুটি প্রবন্ধ-সংকলনের দক্ষ সম্পাদক ও ভূমিকা – লেখক সনৎকুমার সাহা খুবই যৌক্তিকভাবে এই খেদ প্রকাশ করেছেন যে, এই অসাধারণ গ্রন্থটি এখন বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। অধ্যাপক সাহা এটাকে লেখকের magnum opus বলে বিবেচনা করেছেন। যারা বইটি পড়েছেন তারা সবাই একথা মানবেন। আমি বইটি পুরোটা পড়েছি বারদুয়েক, আর ইবসেন বিষয়ে লিখতে গিয়ে বা আলোচনার সময় অকুণ্ঠভাবে এই গ্রন্থের বিভিন্ন অংশের শরণাপন্ন হয়েছি। জগদ্বিখ্যাত এই নাট্যকারের জীবনটাও ছিল নানা নাটকীয়তায় ভরা। আলী আনোয়ার অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে ইবসেনের একাধিক জীবনীগ্রন্থ পাঠ করেছেন, প্রধানত এই বইটি লেখার জন্য। ইবসেন বিষয়ে সাধারণ কিছু কথা, যা তাঁর একটি বা সংকলিত নাটকের বইয়ের জ্যাকেটে বা মুখবন্ধে লেখা থাকে, তা তো আগে থেকেই জানা ছিল। প্রধান বা সাড়াজাগানো সব নাটক, বাংলায় সেসবের রূপান্তর এবং মঞ্চায়ন, এমনকি ইউরোপে সেই কাহিনির সেলুলয়েডে পরিবেশনা এসব তাঁর খুবই ভালোভাবে জানা ছিল। কিন্তু ইবসেনের সব নাটকগ্রন্থ অথবা নাটক, জীবন এবং নারী, এমনকি ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে অজানিত এলাকা ছিল বিপুল। এর প্রধান কারণ, তখন সব বই হাতের নাগালে ছিল না। আলী আনোয়ার এই গ্রন্থ রচনার জন্য সুদীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, দূর নরওয়েতে গিয়েছিলেন একাধিকবার। এসব কথা সবার জানা নয়। কিন্তু আমি জানি। কারণ এই বৃহৎ গ্রন্থের হয়ে ওঠার মধ্যে আমার সামান্য ভূমিকা ছিল। ১৯৯৭ সালে ঢাকায় এক সপ্তাহব্যাপী আন্তর্জাতিক ইবসেন সেমিনার ও থিয়েটার উৎসব আয়োজিত হয়েছিল নরওয়েজীয় দূতাবাসের আর্থিক পৃষ্ঠপোষণা এবং সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটারের (যে সংগঠন এই গ্রন্থের প্রকাশক) সাংগঠনিক আয়োজনে। আমি ছিলাম ওই আয়োজনের প্রধান সমন্বয়ক। অনেক অনুরোধ করেও আনোয়ার ভাইকে দিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছি। কিন্তু একটি অধিবেশনে তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন এবং বেশ শাণিত মন্তব্য করেছিলেন অনেকগুলি অধিবেশনে। এভাবেই ইবসেন নিয়ে তাঁর গভীর অধ্যয়নের সূচনা এবং তা বাস্তবায়িত হয়ে ওঠে, যখন নরওয়েজীয় দূতাবাস ইবসেন নিয়ে বাংলায় একটি বিস্তারিত গ্রন্থ প্রকাশে অর্থায়ন করতে সম্মত হয়। সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটারের প্রধান কর্তা কামালউদ্দীন নীলু এ-বিষয়ে আমার মত চাইলে বলি, যদি রাজি করাতে পারি, তাহলে অধ্যাপক আলী আনোয়ারই আমার প্রথম পছন্দ। আনোয়ার ভাই সম্মত হয়েছিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক চললেও লেখকের স্বভাবজ আলস্যের জন্য পাণ্ডুলিপি চূড়ান্ত করতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বিলম্ব হয়েছে। ঢাকাতে মুদ্রিত হলেও আনোয়ার ভাই নিজের সুবিধার্থে রাজশাহীর কোনো একজনের মাধ্যমে পাণ্ডুলিপির অক্ষরবিন্যাস করিয়েছিলেন। তাতে এতো অজস্র মুদ্রণপ্রমাদ ছিল যে, আমাকে অনেক শ্রম দিতে হয়েছিল। আবার তা সংশোধনের জন্য রাজশাহীতে পাঠাতে হয়েছিল। ঢাকায় দ্বিতীয়বার সংশোধনের পরও প্রকাশিত গ্রন্থে বেশ কিছু ভুল রয়ে গিয়েছিল। কারণ নরওয়েজীয়দের সঙ্গে কথা রাখতে আর বিলম্ব করার উপায় ছিল না। এমন চাপের মধ্যেই ইবসেন হয়ে উঠেছিল। আজ নয়নসমুখে আপনি নেই, আনোয়ার ভাই। অনুমান করি, আমাদেরও ডাক আসতে বেশি দেরি নেই। এই সেদিন আমাদের অনন্য বন্ধু হাসান আজিজুল হক চলে গেছেন। আপনার বন্ধু নাজিম মাহমুদের পরলোকযাত্রা তো আপনি দেখে গেছেন। আনিসুজ্জামান নেই, আনোয়ার ভাই, আবুল হাসনাতও নেই, করোনাকাল এঁদের নিয়ে গেছে। অতিমারির দাঁতাল আক্রমণের ভয়ে তাঁদের শবযাত্রায় শামিল হতে পারিনি। চিত্রগুপ্তের দফতরের অস্তিত্বে আপনার-আমার কোনদিনও বিশ^াস ছিল না। তাই জানিয়ে দিই, আপনার প্রাণপ্রতিম বন্ধু দ্বিজেন শর্মা চলে গেছেন, ওই পথের পথিক হয়েছেন আপনার ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিবৃত্তিক সোদর ওসমান জামাল। হ্যাঁ, আপনার পুত্র অবিনও নেই পৃথিবীতে। আপনাদের সকলের প্রস্থান-উত্তর এই শোকাচ্ছাদিত এবং অদ্ভুত উটের পৃষ্ঠারোহী চলমান স্বদেশে আমরা এক অসহায় ও বাধ্যতামূলক জীবনযাপনে দিন দিন অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। শেষ বার যখন দেশ ছেড়ে গেলেন, এই ক-বছরে আপনার সেই প্রিয় স্বদেশ আরো অচেনা হয়ে উঠেছে। মুক্তচিন্তার অভ্যাসটাকে সিন্দুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে হয়। আপনার লেখাগুলি থেকে বেশ কয়েকটি নিয়ে আরেকটি বই বেরিয়েছে। এখনো গুরু বিষয় নিয়ে কোনো কিছু লেখার পরিকল্পনায় আপনার সেইসব শব্দমালার দ্বারস্থ হই। আর তখন শুধু আপনার চিন্তার সাম্রাজ্য পরিভ্রমণ করতে গিয়ে বিস্ময়বোধ করি না, বিচ্ছেদের কালো ছায়া দৃষ্টি ঝাপসা করে দেয়। রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর (যখনই পেরেছি, আপনাকে ডেকেছি এখানে), ঢাকা এবং অল্পদিনের হলেও কলকাতার সব স্মৃতি, দেশের ভেতরে কত জায়গায় একত্রে ভ্রমণ – সব অনাহূতভাবে ভিড় করে আসে। আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, বন্ধুত্বের এবং অগ্রজের বন্ধনে, আনুগত্যে ও ভালোবাসায় যুক্ত হয়েছিলেম, যা আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.