সন্ধেয় যখন জানতে পারে সাঈদুল, ভালো এক খবর, যাব কি যাব না ভাবনায় আরো একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে শেষমেশ পুরনো মাফলার দিয়ে মুখ-নাক ঢেকে বের হয়ে যায়। তখন আলিয়া পেছন থেকে ডাক দেয় –
‘বাবা এই সন্ধ্যার সময় কোথায় বের হলে? যা শীত পড়েছে, তোমার তো কোট-জ্যাকেটও নেই, আদ্যিকালের এক সোয়েটার, শীত কাটে না; কিছু লাগলে বলো এনে দিই। আমার চাদর দেব?’
‘তেমন কিছু নয় মা, এই যাব আর আসব। তোর মা কি রান্না করছে?’
‘হ্যাঁ, কিছু বলবে? মা ও মা, বাবা কী বলে শোনো। বাবা চাদরটা গায়ে দাও।’
‘না মা, লাগবে না। তোর মাকেও ডাকার দরকার নেই। উনুনের আগুনে হাত-পা সেঁকে নিক। পায়ের ব্যথায় কাবু হয়ে আছে।’
‘ও মায়ের জন্য ট্যাবলেট আনতে যাচ্ছ? সে তো কয়েকটা আছে। পেইন কিলার খেয়ে খেয়ে শেষে কিডনি নষ্ট!’
‘সেও তো বটে! আচ্ছা মা তুই দুয়ার লাগিয়ে দে। পড়তে বোস। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি।’
সাঈদুল যতটুকু ভেবেছিল, বাইরে তার চেয়েও শীত। মাঘের প্রথম পর্যায়, সারাদিন মেঘ মেঘ কুয়াশা আকাশ। বৃষ্টি হবো হবো ভেজা কনকনে বাতাস। আজো অন্যান্য দিনের মতো সূর্য অবশেষে বেলা দুই কি আড়াইটার দিকে উঁকি মেরে চেহারা দেখিয়ে বিদায় নিয়েছে। সাঈদুল নিজের চেহারা দেখাতে চায় না। এ হলো নিজের কাছে থেকে পলায়ন। তাই কোভিড সতর্কতা মাস্কের সঙ্গে মাথা-গলায় মাফলার জড়িয়ে নিয়েছে। কপালেরও খানিকটা লুকিয়ে রাখা। পোড়া কপাল! তাকে কি সুন্দরবনের জলদস্যুর মতো লাগে? কোনো একরাতে টিভি চ্যানেলে নিউজ দেখেছিল। ক্যামেরার কতগুলো অ্যাঙ্গেল থেকে শুটিং কভারেজ। বন আর জলদস্যুর আত্মসমর্পণ। লিলি মোড়ের সনি শোরুমে কখনো কখনো একসঙ্গে কতগুলো টিভি অন থাকে। নিউজ টোয়েন্টি ফোর সেই ছবি সাড়ম্বরে দেখিয়েছিল। পাবলিক রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখে। সরকারের উচ্চপদস্থ অফিসারের হাত থেকে রজনীগন্ধার স্টিক নিয়ে অন্ধকারের মানুষ আলোয় ফিরছে। দেখতে ভালো লাগে। আনন্দের কথা। কেউ যখন অন্ধকার অপরাধ জগৎ থেকে
পৃথিবীর আলোয় ফিরে আসে কার না মন খুশি হয়! জীবনযাপনের এই দিনকালে সত্যি কি আলো আছে? কারো সন্দেহ থাকতে পারে। অপরাধের কাজ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা এত সহজ? জনসমক্ষে চেহারা দেখানো যায়? মানুষ ভয় পায় না? দস্যুদের লজ্জা হবে না?
সাঈদুলের আজকাল অনেক শরম লাগে। আলো থেকে আবছায়ায় জীবনযাপন নেমে এসেছে। কোনো কাজ নেই। কাজের সন্ধানে এর-ওর কাছে আবদার-অনুরোধ করে আরো একবার-বারবার, যেমন করেছিল বি.এ পাশ করার পর; এখনো মানুষজন ঠাট্টা-মশকরা ভেবে নেয়।
‘দূর ভাই, এই বয়সে আর কী চাকরি করবেন? বিশ্রামের সময়। রেস্ট নেন।’
‘কাজ করার শক্তি আছে ভাই। আমি পারব। ভলানটিয়ার হিসেবে টেস্ট নিয়ে দেখেন। শিক্ষক মানুষ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পড়াতে পারে। অন্য কাজও পারব। এই হিসাব লেখা সেলসম্যান যা বলবেন।’
‘সেই তো কথা, আচ্ছা যদি কখনো সুযোগ আসে জানাব।’
সেই সুযোগ কিংবা ডাক আর আসে না। সাঈদুল নিজ গরজে দু-একবার পুনরায় হাজির হয়। মালিকের কথা বলার সময় নেই। জীবন আর বাস্তবতা নিগৃহীত করে তাকে। মেয়েটি দুই বাসায় টিউশনি পেয়েছে। সেলাই মেশিনে কাজ করে অনেক রাত অবধি। মেশিনের ঠক-ঠক ছন্দোবদ্ধ শব্দ হাতুড়ির ঘা হয়ে বুকে বাজে। সাঈদুল কী করল জীবনভর? ছেলেটিও সকালে উঠে আধভাঙা সাইকেলে এখান থেকে ওখানে দৌড়ায়। কোনোদিন শুকনো মুখে ফিরে আসে। সাঈদুল চেহারা দেখেই বোঝে, কিছু খায়নি আবিদ; জিজ্ঞেসও করে।
‘কোথায় কোথায় ঘুরিস বাবা? দুপুরে খেয়েছিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘কোথায় খেলি … কে খাওয়ালো? টাকা-পয়সা তো নেই।’
রুণিমা বেশিরভাগ সময় কথা বলতে দেয় না তাকে। সাঈদুলও তেমন কিছু আর বলতে পারে না। বলার আছে কী? একপলক তাকিয়ে খুব ছোট করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। রুণিমা তিরিশ বছর ধরে হাতে হাত রেখে আছে, এখনো তবু চেনা-অচেনার ঊর্ধ্বে; কেন এমন হয়? যে মানুষটি এত আপন হয়ে বুকের সঙ্গে মিশে ছিল, আজকাল কেমন দূরত্ব মেপে নিয়েছে। পুরুষ মানুষ যখন সংসারে অর্থের জোগান দিতে পারে না, তখন তার কথা কারো ভালো লাগে না; মূল্যহীন আসবাবের মতো পড়ে থাকা মাত্র। এও জীবনের অমোঘ নিয়ম। নিজের প্রতি এইসব অক্ষমতা আরো নিষ্ফল ভাবনায় নতজানু করে রাখে। হীনম্মন্যতা পেয়ে বসে শান্তি আর স্বস্তির আবহে। ঘরের এককোনায় বসে বসে দেখে … দেখতে থাকে; এখন শুধু দেখার দিনকাল। আবিদের জন্য ভাত গরম করে ডেকে বসায় রুণিমা। কোনোদিন ছেলে খেতে বসে, কখনো বসে না : বন্ধু খাইয়েছে। বেড়ার হোটেলে মাংস-ভাত। সাঈদুল শোনে। হায় কত দিন ভালোমন্দ খাবার জোগাড় হয় না! নিজেকে নিয়ে এই মর্মপীড়ন হয়তো নিয়তি বা ভাগ্যের লেখা। তারপরও লজ্জা পায় সাঈদুল। তার চেয়ে আরো বয়সী মানুষ কাজ করে। রোজগার করে। সে কেন পারে না? মানুষ বহুতল ভবন নির্মাণের শ্রমিক হয়। ভ্যান বা কাঁধে ভার নিয়ে বাড়ি বাড়ি ফেলে দেওয়া জিনিস সংগ্রহ করে। কেউ রাস্তায় দুর্বল পায়ে হেঁটে হেঁটে ভিক্ষে করে। সাঈদুল কিছুই পারে না। এও তার শরমের উপলব্ধ জায়গা।
তাই সেখানে যাওয়া যাবে কি না ভাবনার জট জটিল হওয়ার আগেই বেরিয়েছে। গরিব মানুষের উপায় কি? তার রাগ-লজ্জা-ভয় থাকতে নেই। যদি একটি পাওয়া যায়, রুণিমার উপকার হয়; সেই লক্ষ্যে সন্ধের অন্ধকারে রাস্তায় নেমে যাওয়া। কেউ দেখে ফেললে কীভাবে নেবে? ভাবনা নেই। বিবেকানন্দ বলেছেন, রাগ-লজ্জা-ভয়, তিন থাকতে নয়। সাঈদুল হেঁটে হেঁটে গন্তব্যের অনেক কাছে এসে দাঁড়ায়।
আলোয় আলোয় ভেসে গেছে সামিয়ানা চত্বর। এই উজ্জ্বল আলোর বন্যায় নিজের চেহারা কোন অন্ধকারে লুকায় সাঈদুল? একটু থমকে দাঁড়িয়ে এলোমেলো ভাবনায় ডুবে যেতে শুরু করে। রুণিমার জন্য এইটুকু সংকোচ সইতে পারবে না? এইটুকু ত্যাগ? তাকে যে পারতে হবে। তখন থেকে থেকে হিমেল বাতাস দমকা ঢেউ হয়ে ভেসে ভেসে শরীরে বিঁধতে থাকে। আকাশের একলা এক চাঁদ সেও অদ্ভুতরকম ম্লান হয়ে কুয়াশা-হিমে আরো ভিজে যায়। উত্তরাঞ্চলে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ চলছে। ব্যারোমিটারে প্রতিদিন আট-সাত-ছয় ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রচণ্ড শীত। সারাদিন সূর্যের প্রায় দেখা নেই। কুয়াশায় সামনের সবকিছু অস্বচ্ছ-ঝাপসা। এর মধ্যেই সংসারের শত কাজ করে রুণিমা। ঘুম থেকে ওঠা। সকালে যা হোক রুটি বা খিচুড়ি কিংবা রাতের বেঁচে যাওয়া ভাতের তেলে ভাজা। সাঈদুল কখনো লাল চায়ে আদা বা লবঙ্গের টুকরো খুঁজে দেখে হতাশ হয়। এই তো বছর দেড়েক আগে কাজ ছিল। কোত্থেকে এসে গেল মরণব্যাধি। মহামারি করোনা না কোভিড, মাথাব্যথা-কাশি আর তীব্র জ্বর, ফুসফুসে পানি জমে যায়; মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসে। বাতাসের মধ্যে ডুবে থেকেও অক্সিজেন পাওয়া যায় না। দেশে দেশে শত শত মানুষ মরছে। হাসপাতালে জায়গা নেই। কোনো দেশে হাসপাতালে আগুন জ্বলে ওঠে। রোগী নয়, মানুষ পুড়ে ছাই। ডাক্তার-নার্সের হিমশিম অবস্থা। মানুষের বুকে মরে যাওয়া লাশকেও ভয়। বড় ছোঁয়াচে আর ভয়ংকর রোগ। চিকিৎসাবিজ্ঞানী-গবেষক অসুখের প্রতিকার-প্রতিষেধক আবিষ্কারে ব্যস্ত। সকলের চোখে-মুখে আকুল জিজ্ঞাসা, কবে বেরোবে চিকিৎসার ওষুধ, প্রতিষেধক বা টিকা? এমন দুরবস্থার মধ্যে আরো খারাপ সময় এসে দাঁড়াল কারো কারো আঙিনায়। সাঈদুলের মিল চাতালের ছোট চাকরি চলে গেল। কত পরিশ্রম করত সে। সকাল আটটা থেকে সন্ধে কি রাত সাত-আট-নয়। এর মধ্যে ঘরে ফিরে দুই বাড়িতে টিউশনি দৌড়। একটু বাড়তি আয় নয়, প্রয়োজন মেটাতে কতই না কাজ; তবু কষ্টের কথা মনে আসেনি। এখন বসে থাকতে থাকতে
হাতে-পায়ে বুঝিবা শক্তি ফুরিয়ে যায়। লাল চায়ের লালিমায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভেবে নেয় বুড়িয়ে গেছে সে। করোনা নিতে পারত, নেয়নি; যন্ত্রণা কিংবা অন্ধকারের সবটুকু দেখা যে অবশিষ্ট আছে। এরপর দিন আসতে আসতে গড়িয়ে গেল অনেক দিন আর মাস। কত জায়গায় যাওয়া হলো। আবদার আর অনুনয়-বিনয়। কেউ কাজ দেয় না। সাঈদুলের বয়স হয়েছে। সে ফিরে আসে। রাস্তায় শত ভাবনার মধ্যে কত কথা এসে যায়। স্মৃতিময় বিগত দিনকাল। একেবারে সচ্ছল না হলেও দিন তো তেমন খারাপ যায়নি। এখন যে কোনোদিকে উপায় খুঁজে পাওয়া যায় না। রুণিমা এর মধ্যে তবু আশা নিয়ে বসে থাকে। চোখে জিজ্ঞাসা তুলে তাকায়। বড় আশাবাদী মন। তাই অভাবের মধ্যে এটা-ওটা রান্নায় মার্জিন টেনে চালিয়ে নেয় দিনকাল। কাজ শেষ হলে মেঝের এককোণায় পড়ে থাকে। সাঈদুল দেখে ঠান্ডায় আরো জড়সড় হয়ে আছে কত জনমের সাথি। সে কিছু করতে পারে না। রুণিমা কোনো রাতের মধ্যপ্রহরে হালকা কাঁথা হাতে তুলে এগিয়ে কাছে আসে। অনুচ্চ মৃদুকণ্ঠে ডাক দেয় –
‘আলিয়ার বাপ … ও আলিয়ার বাপ, একটু সরে শোও, তোমার কাছে শোব, খুব ঠান্ডা লাগছে।’
সাঈদুলের বাড়িঘর নেই। বাবার তোলা টিনচালের বাসাবাড়ি চার ভাইয়ে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছে। তার ভাগে দুটো রুম। এই বড় রুমটায় রাতের খাবারের পাট চুকলে পুরনো বেডশিট দিয়ে পর্দা টানা হয়। পশ্চিমের দেয়াল ঘেঁষে মেঝেয় শুয়ে থাকে সে। একটি সাড়ে তিন বাই পৌনে সাত ফুট তোষক, পুরনো জীর্ণ, ফেলে দেওয়ার মেয়াদ পেরিয়ে গেছে, তারই ওপর একদিন পৃথিবীর রাজা হওয়ার খোয়াব দেখে দেখে শীত ঠেকাতে থাকে। পুবে একটি চৌকিতে দুই মেয়ে – আলিয়া আর সামিয়া। তাদের দক্ষিণে ঘরের মধ্যভাগ আর দরজা। তারই এককোণে মাদুর ফেলে কাঁথা বিছায় রুণিমা। তারপর সারাদিনের ক্লান্তি উবে মিহি সুরে ঘুমোয়। সাঈদুল কোনো রাতে কিছুক্ষণ পলকহীন দেখে থাকে। জীবনে কোনো শখ নেই, চাওয়া নেই, দাবি বা অভিযোগ নেই; রুণিমা খুব সাধারণ। দেখতে দেখতে কত বছর পেরিয়ে গেল! কী চেহারা আর আকর্ষণ সব মিলিয়ে যায় যায়। এখন একসঙ্গে থাকতে লজ্জা তার। সেই বিব্রত ঘোর শীতে কাবু হলে নিঃশব্দে কাছে আসে। সাঈদুল সরে গিয়ে জায়গা করে দিতে দিতে নিজেকে মেঝের ঠান্ডায় ফেলে দেয়। তিরিশ বছরের ছায়াকে বুকে জড়িয়ে কখনো সেই আগের মতো বাসন্তিক কবিতা নিশ্চুপ আওড়াতে গিয়ে চমকে ওঠে। তার নিজের, নিজেদের কোনো ঘর নেই, আড়াল নেই, শুধু কপালভরা বিষাদ আর গভীর শীত। সুখ আছে কি না জানা নেই।
এই শীত ঠেকানো যায়? অনেক অনেক আগে রূপকথার দিনগুলো মনে আসে, সেখানে পরিত্যক্ত খড়-কাগজ আর
এটা-সেটা জ্বালিয়ে উষ্ণতা খুঁজে নেওয়ার অবসর ছিল। এখন সেই সময় আর জায়গা কোথায়? চোখে ভাসে কোন অচিন দেশের শীত। আকাশ থেকে তুষার ঝরে পড়ছে আর বয়ে চলে কনকনে বাতাস, তখন অপরাহ্ণের আলোয় এক কিশোরী পাইনবনের চিকন রাস্তায় হেঁটে যায়; বরফজমা ঠান্ডায় কোনো অবলম্বন খোঁজে। সেটি পাওয়া যায় না। হিমবাহে শরীরের তাপ নেমে যায়, যেতে থাকে, মেয়েটি এক আশ্রয় পেতে চায়। তারপর প্রচণ্ড শীত, আঁধার হয়ে আসে চারদিক, শীতের নেকড়েরা চোখে আলো জ্বেলে এগোতে শুরু করে। কিশোরীর হাত অনড় হয়ে গেছে প্রায়, হিম বরফে জমে যাওয়া আঙুল দেশলাই কাঠি জ্বেলে জ্বেলে একটু উত্তাপ খোঁজে, ব্যাকুল হয়ে আলো দেখে। এভাবে দেশলাই কাঠি শেষ হয়ে আসে। এই গল্পের কি ইতি আছে? আশ্চর্য সেই মেয়েটি রুণিমা হয়ে যায়। সাঈদুল চমকে পাশ ফেরে। কাহিনির মধ্যে কোনো প্রশ্ন কিংবা সান্ত¡না হাতড়ায়। সে নিজে অনেক ভালো আছে। তার শহরে তুষারপাত হয় না। নেকড়ের চোখ দেখা যায় না। ভয়ংকর ডাক শোনা যায় না। সড়কের ধারে লাইপোস্টের উজ্জ্বল বাল্ব আলোকিত করে রাখে চারপাশ। সেই আলোকরেখা গলিতে এসে আচমকা অন্ধকার হয়ে যায়। সাঈদুলের ঘুম আর হয় না। পুরনো বাড়ির ভাঙা-আধভাঙা মেঝেয় শীত জেগে ওঠে। একটি কম্বল কি শীত নিবারণ করতে পারে না? কম্বলের কি উত্তাপ আছে? কম্বলের নিজস্ব কোনো তাপ নেই, শরীরের উষ্ণতায় গরম হয় মাত্র। শীত এলে বিভিন্ন সংগঠন-ক্লাব, শিল্পপতি-ধনাঢ্য ব্যক্তি এমনকি প্রশাসনও হতদরিদ্র ছিন্নমূল মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র-কম্বল বিতরণ করে। মঞ্চের সামনে ফুলের ঝাড়ে সাজানো টেবিল থাকে, ওপারে কোট-প্যান্ট-টাই পরিহিত দানশীল মানুষ, তারা পাঁচ কিংবা দশ-বারোজন হাসিমুখে একটি কম্বল কারো এগিয়ে ধরা আকুল হাতে তুলে দেয়। অনেক পুণ্যের কাজ। মানুষজন হাত তুলে দোয়া করে। একটু তো উত্তাপ এসে মনকে উজ্জীবিত রাখে। সাঈদুল সেই আশাতে অতিথি পাখির মতো এসেছে।
সাঈদুল এমনই দৃশ্যের সামনে এসে দাঁড়ায়। সামিয়ানার উত্তর প্রান্তে মঞ্চ। তিন ফুট মঞ্চের নিচে কয়েকটি টেবিল জোড়া দিয়ে লম্বা করে সাজানো। তার ওপর থরে থরে কম্বল। পেছনে কম্বলের গাঁট বা পেটি। মানুষজন টেবিলের মুখোমুখি লাইন ধরে দাঁড়িয়েছে। নারী-পুরুষের পৃথক লাইন। একটু কি অস্থির কথাবার্তা কলরোল ভেসে যায়? শীতরাতের বুকে বিতরণ আর প্রাপ্তির মধ্যে কত কাহিনি লেখা থাকে, কিছু তার উক্ত বাকিসব অনুচ্চ; মাঘের বাতাসে সব ফিসফিস হয়ে যায়। শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দ টেবিলের ওপারে দাঁড়িয়ে প্রস্তুত। আলোচনা পর্ব শেষ। কম্বল বিতরণ শুরু হয়েছে। সাঈদুল চমকে ওঠে। কোনোদিন ভাবেনি একটি কম্বলের জন্য হাহাকার নিয়ে দাঁড়াতে হবে। তেমন দুশ্চিন্তাও ছিল না। মানুষের জীবনে কখন কোন অবস্থা আসে, সহজভাবে মেনে নিতে হয়; অভাবে স্বভাব নষ্ট। কত কিছু এড়িয়ে যেতে হয়। তাই হয়তো আচমকা খুশি কিনতে বুকে উৎসাহ ছিল। রুণিমা নিশ্চয়ই আনন্দে চমকে যাবে, কিন্তু সেই ইচ্ছে ক্রমশ স্তিমিত হতে শুরু করে; এই আলো-ছায়ায় কীভাবে দাঁড়ায়? আজ যারা গর্বিত চেহারা নিয়ে ত্রাতার ভূমিকায় হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে, তিন-চার জোড়া হাত এগিয়ে ধরা কাঙাল হাতের কোলে লাল-কালো-সাদা কম্বল তুলে দেয়, তারা একসময়ের হালকা-গভীর চেনাজানা মানুষ। কেউ কেউ স্কুলের সহপাঠী মিত্র। তারা রাজনীতি করে, নেতা মানুষ, শহরের এখানে-সেখানে বিশাল বাড়িঘর, দোকানপাট; এসবের মধ্যে কখনো ইনিস্টিটিউট চত্বরে জ্বালাময়ী ভাষণ দেয়। তাদের আছে ক্ষমতা।
উনিশশো একাত্তরের পর বাহাত্তর, পৃথিবীর মানচিত্রে জেগে উঠেছে নতুন দেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে আসছে হাজারও ত্রাণ ও পুনর্বাসন সহায়তা। সে ছিল অন্যরকম সময়, মানুষ শিখেছে বেঁচে থাকতে গেলে অনেক কিছু এড়িয়ে যেতে হয়, সহ্য করতে হয়, হাত পাততে হয়; সাঈদুল তবু রিলিফের লাইনে দাঁড়াতে পারেনি। একাত্তরে বাড়িঘরের সবকিছু লুট হয়ে গেছে। বাবা পরিবারের পাঁচজন সদস্যের খাবার জোটাতে দিনরাত কাজ করেন। সেও ঠিকমতো জোটে না। তারা পেটে শুকোয়, চোখে কষ্টের কালিমা, শীতের ঠান্ডায় হাতদুটো বুকে চেপে ঠকঠক কাঁপে; তারপরও রিলিফের লাইনে দাঁড়াতে পারে না। সেই শিক্ষা নেই। শরম করে।
দিল্লির জুমা মসজিদ থেকে যে-রাস্তা মাটিয়া মহল আর চিতালি কবর হয়ে অনেকদূর এগিয়ে দরওয়াজার দিকে গেছে, সেখানেই ছিল মহল্লা ‘কুল্লু খাবাস কি হাবেলি’। প্রতিদিন সন্ধে ঘনিয়ে রাত আরো গভীর অন্ধকার হলে মহল্লা থেকে একজন ফকির বের হয়ে জুমা মসজিদ পর্যন্ত হেঁটে যায়। দীর্ঘকায় পুরুষ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ, ময়লা ছেঁড়াফাটা পোশাক, এমনকি মাথার টুপিও বিস্রস্ত ছিন্ন; তার এক হাতে লাঠি অন্য হাতে মাটির পাত্র। কে বলবে এই তো সিপাহি বিদ্রোহের আগে তার অবয়ব-কাঠামোয় লেপটে ছিল রাজকীয় আভিজাত্য। এখন শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত দুর্বল চেহারার মলিনতায় চোখদুটোর ক্ষীণ দৃষ্টি ধরে রাখে শুধু গোপন বেদনার অশ্রু। এক পয়সার আটা মাগে আল্লাহ্র কাছে। ফকির কারো সামনে দাঁড়ায় না। পথে হেঁটে যেতে যেতে কেউ যদি দয়া করে ভিক্ষার পাত্রে পয়সা বা আটা তুলে দেয়, ফকিরের দোয়া, ‘তোমার ভালো হোক, আল্লাহ্ যেন তোমাকে খারাপ সময় না দেখায়।’ দিল্লির অনেকেই জানে না, কে এই ফকির যাকে কি না দিনের আলোয় দেখা যায় না। তিনি মোগল বংশের শেষ নবাব বাহাদুর শাহ্ জাফরের বংশধর … নাতি; মির্জা কমর সুলতান। যুদ্ধ আর সময় অনেক কিছু বদলে দেয়। সাঈদুল বোঝে, একাত্তর কতভাবে কীভাবে কত কিছুর রূপান্তর করে দিয়েছে। কারো পরম ভাগ্য … কারো জন্য নির্মম পরিহাস। আবুল হোসেন ফুটপাতে চা বিক্রি করত। সকাল-বিকেল-সন্ধ্যা-রাত কয়লার লম্বা দ্বিমুখী চুলোয় জ্বলত গনগনে আগুন। বাতাসে চা-লিকারের ঘ্রাণ। তারপর একদিন চুরির দায়ে সাজা হয়ে গেল আবুলের। ছয় মাসের জেল। তিরিশ মার্চ একাত্তর, মঙ্গলবারের পর একসময় কারাগার খুলে দেওয়া হলে চোর-ডাকাত-খুনি কয়েদি বেরিয়ে গেল শত শত। মুক্তিযুদ্ধ শেষে কে কীভাবে সমাজের নমস্য-সম্মানীয় অভিজ্ঞান পেয়ে গেল সেও বুঝি প্রযুক্তি-বিজ্ঞান। আবুল হোসেন এখন শহরের বড় বিজনেসম্যান। অটো রাইস মিলের মালিক। মানুষজন সঙ্গ পেলে কৃতার্থ হয়। সাঈদুল এইসব হাজারও অসংগতি মেনে নিতে পারে না, মেনে নেওয়া যায় না; তাই হাত পাততে বড় লজ্জা আসে। সে কি কোনো ভাগ্যবিড়ম্বিত নবাব প্রজন্ম, নাকি জমিদারপুত? পরিবারে একসময় সচ্ছলতা ছিল, যেখানে হাত উপুড় করে দেওয়ার শিক্ষা পেয়েছে, দিয়ে গেছে, সেটি কীভাবে চিৎ হয় আকুল প্রত্যাশায়? সাঈদুল তাই পারে না। ক্লাসের ফার্স্ট বয়, কখনো ফুল বা হাফ ফ্রি’র আবেদন করেনি; সে কি না হাত পাতে?
স্বাধীন দেশে দেখা দিয়েছে কয়েকটি গ্রুপ। মানুষজন সুবিধাবাদী এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায় অস্থির-চঞ্চল, কী কী কেড়ে নিতে হবে, কী কী বাগাতে হবে সেই ধান্ধায়, আর কেউ কেউ দেখে গেল এইসব হাজার বেহায়াপনার কুৎসিত তামাশা। একদিকে ছিনতাইকারী-হাইজ্যাকার, তারা পথেঘাটে মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নেয়, অন্যদিকে কেউ আবার আরো ক্ষমতাবান, শত্রু বা বিহারির পরিত্যক্ত বাড়িঘর-দোকান আর বিবিধ সম্পদ দখলের হরিলুটে মশগুল। কে কাকে কলাবোরেটিং কেসে ফাঁসিয়ে পুরনো বিরোধের জরিমানা আদায় করে নিতে ব্যস্ত। কোথাও পর্যাপ্ত শৃঙ্খলা স্থিতি আসেনি। তখনো বিদেশি ত্রাণ কম্বল-চাল-শিশুখাদ্য বিতরণ হয়েছে। মডার্ন সিনেমা হলের মোড়ে সকালে শুরু হতো লাইন। দোকানঘরের সামনে সেই লাইন লম্বা হয়ে এগিয়ে যেত দুপুরের রোদ পর্যন্ত। সাঈদুল সেখানে দাঁড়াতে পারেনি। কোথায় কোন জড়তা এসে ঘিরে ধরে, হায় দশ বছরের বালক, তখনো শোনেনি, যে মানুষটির কথায় মুক্ত হলো দেশ; তার ভাগের কম্বলও নাকি কেউ মেরে দিয়েছে।
সাঈদুল আজ কী করে? একটি কম্বলের জন্য রাতের গোপনীয়তায় মুখ ঢেকে মঞ্চের কাছাকাছি এসেছে। কত কাঙাল নিয়তি! সারাজীবন করল কী সে? কোনো রাজনীতি-দলবাজি-গ্রুপবাজি? বোকা মানুষ। আপনমনে পড়াশোনা শেষে কত চেষ্টা করে গেছে, ভালো চাকরি করবে, নিয়মনীতির নয়-ছয়ে পেল না; অবশেষে ছোট এক থাকা না থাকা হিসাবলেখা চাকরি। আর এই বাড়ি-ওই বাড়ি ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে, আদর্শের হাজারও তত্ত্বকথা শুনিয়েই বুড়ো হতে বসেছে। আজ কার কাছে হাত পাতে? এরাই তো সেই একাত্তরের সুবিধাবাদী উত্তরসূরি … বংশধর। তাদের চকচকে চেহারায় জ্বলজ্বল করছে ধান্ধাবাজির ইতিহাস।
সাঈদুল আলোর মধ্যে ক্রমে উদোম হয়ে পড়ে। আলো আর অন্ধকারের ব্যবধানে কে বা কারা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে কিছু বোঝা যায় না অথবা সব জেনে-বুঝেও কথা বলা যায় না; অনুক্ত ঢেকে যায় বুকে চেপে রাখা হাজারও কথা। আজ যাদের যেখানে থাকার কথা, তারা সেখানে নেই, অন্যেরা অনেক অনেক উপরে উঠে গেছে, সেই নাগাল পাওয়া যায় না; সাঈদুল কোথায়? কার পদতলে করুণা প্রত্যাশায় বসে থাকে? সে আলোকিত শামিয়ানার নিচে একটু ঘনীভূত অন্ধকার খোঁজে, যেখানে মুখ লুকোনো যায়; কেউ তাকে চিনতে পারবে না। আসলে কি তা সম্ভব? এইসব দোলাচল ভাবনায় অবশেষে লাইনে দাঁড়াবে কি না সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সে কি লাইনে দাঁড়িয়েছে?
ডানে-বাঁয়ের লাইনে পঁচিশ-তিরিশজন। তারা ধীরপায়ে এগিয়ে যায়। এগিয়ে আসে মাঘ রাতের জোরালো বাতাস। সাঈদুলের পুরনো সোয়েটারে শত ছিদ্র। তার ভেতর দিয়ে ঢুকে পড়ে হিমস্রোত বর্শা। সে ভয়ানক কেঁপে ওঠে। যখন ঘর থেকে পথে বেরোয়, বাধা পেয়েছিল; সেই কথা মনে পড়ে যায়। তার মনে প্রত্যাশা, একটি কম্বল যদি পাওয়া যায়, অনেক উপকার হয়। এখন কী করবে তবে? দাঁড়াবে, নাকি না? লাইন এগিয়ে যায়। সাঈদুল যেখানে স্থির, সেখানে লাইনে আছে নাকি বেলাইন বোঝা যায় না। বিবেকানন্দের বাণী পুনরায় মনে আসে।
রাগ-লজ্জা-ভয়, তিন থাকতে নয়। তারপরও তার চোখ-মুখ মাস্ক আর মাফলারের গহিনে অদ্ভুত শরমে হিমবরফ হতে থাকে। লাইন এগোয়।
তখন চোখের সামনে রুণিমার শীতে কাতর শুয়ে থাকা কুণ্ডলিত কাঠামো বারবার ভেসে ওঠে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.