ইনামুল হক : নাটক ও অন্যান্য

ড. ইনামুল হক (১৯৪৩-২০২১) স্বাধীন বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় অবিস্মরণীয় এক শিল্পীর নাম।

স্বাধীনতা-উত্তর নাট্য-আন্দোলনকে যাঁরা বেগবান করেছেন, যাঁরা নাটককে জনগণের যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, আকাঙ্ক্ষা-প্রতিবাদের ভাষায় রূপ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন সামনের সারির একজন। তিনি ছিলেন একাধারে অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক, সংগঠক ও শিক্ষক। নাটক ছিল তাঁর জীবনের অংশ। টেলিভিশন, রেডিও ও মঞ্চে প্রায় হাজারখানেক নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। লিখেছেন ষাটের অধিক টিভি নাটক, পঞ্চাশটি বেতার নাটক ও সতেরোটি মঞ্চনাটক। তাঁর নির্দেশিত নাটকের সংখ্যাও কম নয়। বাংলাদেশের স্বনামধন্য নাট্যদল নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় ও নাগরিক নাট্যাঙ্গনের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। মাত্র ৭৮ বছরের ইহজীবনে নাটকের নানা শাখায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। এই বিরল নাট্যব্যক্তিত্ব ২০২১ সালের ১১ই অক্টোবর আকস্মিক মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর নাট্যচেতনা-দর্শন ও পদ্ধতি-প্রক্রিয়া ভবিষ্যতের নাট্যচর্চার জন্য উদ্ঘাটন জরুরি। এতে বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় তাঁর অবদান যেমন স্পষ্ট হবে, তেমনি ভবিষ্যৎ নাট্যকর্মীদের দিকনির্দেশক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারবে।

বহুমাত্রিক অভিনেতা ইনামুল হক

ইনামুল হক জনপ্রিয় হয়েছিলেন তাঁর অভিনয়ের গুণে। অনুকরণের প্রবণতা থেকে তাঁর অভিনয়ের ভিতটা গড়ে উঠেছিল শৈশবে। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে মে ফেনী জেলার মোটবী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা ওবায়দুল হক ও মা রিজিয়া খাতুন। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। শৈশবেই মাতৃহারা হন। তাঁর ফুপু তাঁকে খুবই আদর করতেন। 

ইনামুল হক ফেনীর লস্কর হাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে ভর্তি হন ফেনী পাইলট হাই স্কুলে। সেখানে স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করতেন, অভিনয় করতেন। তিনি এত চমৎকার অনুকরণ করতে পারতেন যে সবাই তাঁর এই গুণের প্রশংসা করতেন। ম্যাট্রিক পাশ করার পর ভর্তি হন ঢাকার নটর ডেম কলেজে। তাঁর ছিল সংস্কৃতিতে ঝোঁক।

প্রকৃতপক্ষে ইনামুল হকের নাট্যচর্চার প্রতি মূল ঝোঁক তৈরি হয় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায়, ফজলুল হক হলের সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর। সে-সময় পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করলে ব্যাপকভাবে রবীন্দ্রচর্চা বেড়ে গিয়েছিল। সে-পরিবেশটাই ছিল তাঁর নাট্যচর্চা বিকাশের উর্বর সময়। ১৯৬৫ সালের ৭ই মার্চ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করলে তাতে বরাদ্দ করা ফ্ল্যাটটি হয়ে ওঠে নাট্যচর্চার কেন্দ্র। এ-সময় সৈয়দ হাসান ইমামের নির্দেশনায় অভিনয় করেন তাসের দেশ নাটকে। বুয়েটের তরুণ অবিবাহিত শিক্ষক ইনামুল হকের ছিল অভিনয়ের প্রতি এক সহজাত ঝোঁক। এরপর রক্তকরবী নাটকে গোঁসাই চরিত্র, মা নাটকে মার্কসবাদী ফিয়োদর চরিত্রে অভিনয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। ইনামুল হক ছিলেন রাজনীতি-সচেতন। হয়তো এ কারণে ফিয়োদর চরিত্রে তাঁর অভিনয়ে দর্শকরা অভিভূত হয়েছিলেন। এরপর অল্পদিনের মধ্যেই আবর্ত, দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন, মাইলস্টোন, ঋতুরাজ, ভ্রান্তিবিলাস প্রভৃতি নাটকে অভিনয় করেন তিনি।

মফিদুল হকের মতে, “রক্তকরবী’ নাটকে ইনাম ভাই হয়েছিলেন গোঁসাই, হাস্যরসে তিনি সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন বলে তাঁকে সেই ধরনের চরিত্রে খুব মানানসই মনে হতো। নাটকের ভাষায় এসব হয়তো পার্শ্বচরিত্র, কিন্তু নাট্যাভিনেতা জানেন তিনি যখন মঞ্চে প্রবেশ করেন তখন তিনি সম্পূর্ণ একা, এবং চরিত্র যাই হোক সমস্ত হৃদয়-মন দিয়ে তা প্রাণবন্ত করে তুলতে হয়। আর ইনাম ভাই জানতেন যে কোনো চরিত্র কীভাবে প্রাণবন্ত করে তোলা যায়।’

টেলিভিশনে প্রথম অভিনয় করেন ১৯৬৮ সালে মুখরা রমণী বশীকরণ নাটকে। তাঁর টিভি ও বেতার নাটকের সংখ্যা এত বেশি যে তা এ-সীমিত পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়। ইনামুল হক মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযন্ত্রণা অনবদ্যভাবে ফুটিয়ে তুলতেন। তাঁর অভিনয়নৈপুণ্য, চরিত্র চিত্রণে পারঙ্গমতা এবং সবচেয়ে বড় তথা পরিশীলিত অভিনয় দর্শক হৃদয়ে একটি দীর্ঘস্থায়ী অনুরণন সৃষ্টি করতে পেরেছে।

বুয়েটে তাঁর ফ্ল্যাটেই ১৯৬৮ সালে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় নাট্যদল প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জিয়া হায়দারের নেতৃত্বে ইডিপাস নাটকের রিহার্সাল দিয়ে এর যাত্রা শুরু। কিন্তু ইডিপাস নাটকটি মঞ্চে আসেনি। তা টিভিতে প্রচারিত হয়েছিল। এ-নাটকে ইনামুল হক অভিনয় করেছিলেন মেষপালক চরিত্রে। বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছিলেন ‘বাচস্পতি’ চরিত্রে। শোনা যায় নাটকটির মাত্র দুটি প্রদর্শনী হয়েছিল।

 মামুনুর রশীদ-নির্দেশিত কবর নাটকটি স্বাধীনতার পর ঢাকা শহরে মঞ্চায়িত প্রথম প্রথাগত নাটক। ১৯৭২ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি এটি মঞ্চায়ন হয়। এই নাটকে ইনামুল হক অভিনয় করেছিলেন।

নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় একে একে বাকি ইতিহাস, বিদগ্ধ রমণীকুল ও তৈল সংকট, দেওয়ান গাজীর কিসসা, শাজাহান, অচলায়তন, নুরুল দীনের সারাজীবন, কোপেনিকের ক্যাপ্টেন প্রভৃতি নাটক মঞ্চস্থ করে। এসব নাটকে তিনি মেধাদীপ্ত সৃজনশীল অভিনয়ের পরিচয় দেন। আদর্শগত কারণে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় থেকে অব্যাহতি নিয়ে তিনি ১৯৯৫ সালে সহধর্মিণী বিশিষ্ট অভিনেত্রী লাকী ইনামের সঙ্গে গড়ে তোলেন ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন’। জীবনের বাকি সময় এই দল নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন তিনি।

ইনামুল হকের চরিত্র-নির্মাণ পদ্ধতি ছিল বাস্তববাদী। তিনি চরিত্রের সঙ্গে মিশে যেতেন। তাঁর পছন্দের চরিত্র ছিল নিষ্পেষিত মানুষের। হুমায়ূন আহমেদ-রচিত অয়োময় নাটকে তিনি ‘পাংখা টানা’ ব্যক্তির চরিত্রে অভিনয় করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, চরিত্রকে জীবন্ত করাই অভিনেতার মূল কাজ।

আধুনিক সমাজ বিনির্মাণে প্রতিশ্রুতি

অভিনয়ের পাশাপাশি নাট্য রচনার মাধ্যমেও দর্শকদের হৃদয় জয় করেছেন ইনামুল হক। সমাজ ও পারিবারিক জীবনের বিচিত্র ভাবনা এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ সংলাপ তাঁর নাটকগুলোকে গুরুত্ববহ করে তুলেছে।

ইনামুল হক-রচিত নাটক প্রথম টেলিভিশনে প্রচারিত হয় ১৯৬৮ সালে। নাটকটির নাম ছিল অনেক দিনের একদিন। তৎকালীন পাকিস্তান টেলিভিশন পিটিভতে নাটকটি প্রচারিত হয়। এটি প্রযোজনা করেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। নাটকের বিষয়বস্তু ছিল দেশের উত্তাল পরিস্থিতি। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭০-এর উত্তাল দিনগুলোতে রাজপথে ইনামুল হক ছিল সক্রিয় নাট্যযোদ্ধা। জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে গণসংগীত ও দেশপ্রেম বিষয়ক জাগরণী পথনাটক ছিল তাঁর প্রধান অস্ত্র।

১৯৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর উত্তাল দিনগুলোর মধ্যে ২৩শে মার্চ টেলিভিশনে প্রচারিত হয় ইনামুল হকের নাটক আবার আসিব ফিরে। এ-নাটকের মধ্য দিয়ে ইনামুল হক পাকিস্তানি স্বৈরশাসন, জুলুম ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি একদিকে শিক্ষকতা, অন্যদিকে অভিনয়, রিহার্সাল এবং লেখালেখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৭২ সালের মার্চে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে স্বাধীন বাংলাদেশের টেলিভিশনে যে-নাটকটি প্রচারিত হয় তার রচয়িতা ইনামুল হক, নাম বাংলা আমার বাংলা। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নাটক হিসেবে স্বীকৃত। এর ইংরেজি অনুবাদও হয়েছিল, যা ঝড়ঁহফ ড়ভ ঋঁৎু ধহফ ঋৎববফড়স নামে বাংলাদেশ বেতারে প্রচারিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসহ ইনামুল হকের নাটকে প্রাধান্য পেয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে রাজনীতি ও সামাজিক অবক্ষয়। ত্ার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য – প্রতিধ্বনি প্রতিদিন, সেইসব দিনগুলো, সন্ধিক্ষণে আমরা, প্রতীক্ষার প্রহর, মেঘভাঙা রোদ, অতঃপর একদিন ইত্যাদি। সেইসব দিনগুলো নাটকটির কাহিনি নিয়ে তাঁর জ্যৈষ্ঠ কন্যা হৃদি হক সম্প্রতি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।

 বিটিভিতে ১৯৭২ সালে প্রচারিত প্রথম একুশের নাটকও ইনামুল হকের রচনা, নাম মালা এক শত মালঞ্চের।৫ এই নাটকের পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গেছে। তবে অভিনেতা ও নাট্যজনের স্মৃতিচারণে তার কিছু পরিচয় পাওয়া যায়।

রেডিওতেও তাঁর অসংখ্য নাটক প্রচারিত হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য – চোখের বাহিরে (১৯৭৯), নায়লা ও নূপুর (১৯৮৩), অনুভবে অনুভূতি (১৯৮৭), মহাকালের ঘোড়সওয়ার (১৯৮৪), দেয়াল (১৯৮৫), কিছু তো বলুন (১৯৮৫), সৈকতে সারস (১৯৮৭) ইত্যাদি।

আধুনিকমনস্ক অনুবাদক ইনামুল হক

ইনামুল হক অনুবাদের ক্ষেত্রেও ছিলেন পারঙ্গম। আন্তন চেখভের দ্য সী গাল, দ্য চেরি অর্চার্ড, আঙ্কেল ভানিয়া, আর্নল্ড ওয়েসকারের চিকেন সুপ উইথ বার্লি, স্ট্রিন্ডবার্গের এরিক দ্য ফর্টিনথ, দ্য ফাদার, মিস জুলি, দ্য গোস্ট সোনাটা, জ্যঁ পল সার্ত্রের দ্য ফ্লাইজ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য অনুবাদ। তিনি সাংস্কৃতিক রূপান্তর করতেন না। প্লট-কাঠামো, ভাব-বিষয়, চরিত্র-নির্মাণ ও পরিপ্রেক্ষিত একই থাকতো, শুধু ভাষাটা পরিবর্তন করে দিতেন। ইংরেজি থেকে বাংলা। অনুবাদের পাশাপাশি তিনি আন্তর্জাতিক জার্নালের জন্য গবেষণা প্রবন্ধও লিখতেন। তিনি একজন বিজ্ঞানীও ছিলেন। বিজ্ঞানবিষয়ক অসংখ্য আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। বিজ্ঞানের কিছু কথা শিরোনামে তাঁর গ্রন্থও রয়েছে।

বাস্তববাদী ধারার নাট্যনির্দেশক ইনামুল হক

ইনামুল হক প্রথম নাট্যনির্দেশনা দেন ১৯৭৩ সালে ম্যানচেস্টারে থাকাকালে। নাটক সুড়ঙ্গ। প্রবাসজীবনে স্ত্রী লাকী ইনামকে নিয়ে ইন্টেলেকচুয়াল লেডিসসহ নিজের লেখা মুক্তিযুদ্ধের পাঁচটি নাটক মঞ্চায়ন করেন। বাংলাদেশে প্রথম মঞ্চনাট্য নির্দেশনা দেন উদীচীতে। নাটকটি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিরকুমার সভা (১৯৯৩)। নাগরিক নাট্যাঙ্গনের প্রথম প্রযোজনা খোলস-এর (১৯৯৫) নির্দেশক ছিলেন তিনি। আরো নির্দেশনা দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৈকুণ্ঠের খাতা (১৯৯৫), আরউইন শ’র আমরা কবরে যাবো না (১৯৯৫), জনতার রঙ্গশালা (১৯৯৭, দ্বিতীয় পর্যায়), শুকদেব চট্টোপাধ্যায়ের জোয়ার, সৈয়দ শামসুল হকের আমাদের জন্ম হলো (১৯৯৮) এবং নিজ দলের বাইরে ঢাকা নান্দনিকের ঘা (১৯৯৭) ইত্যাদি।

ইনামুল হকের নাট্যনির্দেশনার মূল প্রবণতা ছিল স্বল্পব্যয়ে বাস্তববাদী ধারার নাট্যনির্মাণ। প্রসেনিয়াম ধারার ডিজাইনকেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন। তাঁর চরিত্রায়ন পদ্ধতি ছিল ন্যাচারাল।

বিনয়ী ও প্রাজ্ঞ ইনামুল হক

নাটক – পরিবার – শিক্ষকতা – এ তিনদিকের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল ইনামুল হকের মধ্যে। তিনি ছিলেন মানবদরদি। অর্থলিপ্সা ও উচ্চাভিলাষ ছিল না। ছিলেন সহজ-সরল ও সদালাপী। বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে ‘ডিকশনারির জেন্টেলম্যান’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

লাকী ইনাম বলেন, ‘ইনামুল চিন্তা-চেতনা এবং মননশীলতায় ছিল সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। সে ছিল তার কর্মে, উদ্যমে, বিশ^াসে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত আলোকিত একজন মানুষ। মানুষ হিসেবে অতুলনীয়, শক্তিশালী অভিনেতা – কিন্তু তার বাইরেও নাট্যকার, অনুবাদক বা নির্দেশক। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসেও ইনামুল তরুণদের আহ্বানে ছুটে যেতো – সজীব, প্রাণস্পন্দন ভরা নিজের সারা জীবনের সঞ্চয় করা উদ্দীপনা তাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। সে প্রমাণ করেছে সে সবসময়ই একজন টগবগে তরুণ – যে যৌবনের জয়ঢাক বাজিয়ে সকল অন্ধকার আর কূপমণ্ডূকতাকে দূর করতে বদ্ধপরিকর।’৬

ড. ইনামুল হক ছিলেন প্রাজ্ঞ ও আদর্শবান শিক্ষক। বুয়েটে শিক্ষকতা ও নাট্যশিক্ষকতায় ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নাট্যাঙ্গন ইনস্টিটিউট অব ড্রামা। তিনি আমৃত্যু এই ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিন যুগের বেশি সময়ের শিক্ষকতায় বুয়েটের উচ্চ প্রশাসনিক নানা দায়িত্বেও তিনি অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি টেলিভিশন রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের আজীবন সম্মাননা (২০১২), নাট্যকলায় অবদানের জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ এবং ২০১৭ সালে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ লাভ করেছেন।

ইনামুল হক ছিলেন একজন পরিপূর্ণ নাটকের মানুষ। তাঁর চেতনায় ছিল এদেশের মানুষের মুক্তি, সংস্কৃতির মুক্তি। আবদুশ শাকুর তাঁকে উপাধি দিয়েছেন ‘নাট্যগুণাকর’। নব্বইয়ের দশকের প্রতিটি গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনে ইনামুল হক ভূমিকা রেখেছেন।৭ বহুমাত্রিক অভিনয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সমাজচেতনতামূলক নাট্যরচনা, আধুনিকমনস্ক অনুবাদ ও বাস্তবধারার নির্দেশনায় প্রত্যুজ্জ্বল হয়ে থাকবেন ইনামুল হক। বাংলাদেশের আগামী নাট্যচর্চা তাঁর আদর্শকে ধারণ করে আরো সমৃদ্ধ হবে – এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

তথ্যসূত্র –
১.         মফিদুল হক, প্রাগুক্ত, পৃ-৬৯-৭০।
২.         প্রাগুক্ত, পৃ-১৯৭
৩.         ড. ইনামুল হক, বাংলা আমার বাংলা নাগরিক প্রকাশন, ঢাকা, ২০১১, পৃ-৬।
৪.         প্রাগুক্ত, পৃ-৬।
৫.         প্রাগুক্ত, পৃ-৬।
৬.         ২ জুন, ২০২৪ তারিখে গৃহীত ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার।
৭.         রতন সিদ্দিকী, নাট্যপত্র ‘শুধু নাটক’ বিশেষ সংখ্যা ২০২২, পৃ-১৯।