ইন্দ্রপাত

বারো বছর আগে জার্মানি থেকে ফেরার পথে আমার বিমানসঙ্গী ছিলেন চট্টগ্রামের ইস্পাহানি সাহেব। সেকালের নামকরা বণিক ইস্পাহানির পুত্র। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে আমরা লুফট-হানসার বিমানে উঠি ও পাশাপাশি আসনে বসি।
‘ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে পার্টিশন একটা সর্বনাশা ব্যাপার। আমাদের কারবার ছিল প্রশস্ত পরিধি জুড়ে। তাকে টুকরো করতে হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের ভার পড়েছে আমার উপরে। ওইটুকু গণ্ডির ভিতরে প্রসারণের পরিসর কোথায়?’ তিনি আপসোস করেন।
অর্থনীতির প্রসঙ্গ থেকে আমরা রাজনীতির প্রসঙ্গে আসি। তিনি বলেন, ‘আইয়ুব খান যে বেসিক ডেমোক্রাসী প্রবর্তন করতে যাচ্ছেন তার ফল ভালো হবে না। মাত্র আশি হাজার জন ভোটার। টাকা ছড়িয়ে একচল্লিশ হাজার জন ভোটারকে হাত করা অতি সহজ। আইয়ুব চান চিরস্থায়ী হতে।’
আমি জিজ্ঞাসা করি, তাঁর নিজের মতে কী করা উচিত। তিনি এর উত্তরে বলেন, ‘রাজনীতিকদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিলেই হয়। আগেকার মতো প্রত্যক্ষ নির্বাচনে যাঁরা জিতবেন তাঁরাই সরকার চালাবেন।’
‘কিন্তু সরকার চালাবার মতো যোগ্য লোক কি পূর্ব পাকিস্তানে কেউ আছেন?’ আমার নিজের মনেই সংশয় ছিল।
‘কেন? শেখ মুজিবুর রহমান।’ তিনি নিঃসংশয়ে রায় দেন।
‘শেখ মুজিবুর রহমান কি পারবেন একটা প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হতে।’ আমি তাঁর সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলুম।
‘কেন পারবেন না? তাঁকে একটা সুযোগ দিলে ক্ষতি কী?’ তিনি শেখ মুজিবকে চিনতেন ও তাঁর ওপর আস্থাবান ছিলেন।
ইস্পাহানি বাঙালি নন। মুজিব বাঙালি। কিন্তু লক্ষ্য করলুম তাঁর মধ্যে প্রাদেশিকতা নেই। তার কারণ বোধহয় তিনি ইরান দেশের আগন্তুক। পাকিস্তানি নাগরিক হলেও তার মানসিকতা পূর্ব পাকিস্তানি সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। কলকাতাতেই তিনি ভালো ছিলেন। হিন্দু-মুসলমানের ঝগড়া তিনি পছন্দ করেননি।
‘আপনার সঙ্গে কলকাতা অবধি গিয়ে সেখান থেকে অন্য ফ্লাইটে চট্টগ্রাম যাওয়াই আমার পক্ষে সুবিধের। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। আমার সময়ের দাম আছে। কিন্তু ওরা কি সেটা বুঝবে? নিয়ম করে দিয়েছে করাচিতেই রাতের মাঝখানে নামতে হবে। করাচি থেকেই ফ্লাই করতে হবে ঢাকায়। সেখান থেকে চট্টগ্রামে। একটা দিন নষ্ট। আর রাতের ঘুমটাও।’ তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
তখন থেকেই আমার জানা যে, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের অদ্বিতীয় নেতা। পরে একদিন তাঁর আরো এক প্রকার পরিচয় পাই। আমার এক বন্ধুপুত্র ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে কাজ করতেন। কিছুকাল তাঁকে ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনে নিযুক্ত থাকতে হয়। সেখান থেকে বদলি হয়ে এসে আমাকে তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিব ভারতের কাছে অস্ত্র চেয়েছিলেন। আর মুক্তিসৈনিকদের ভারতের মাটিতে তালিম। পণ্ডিত নেহেরু সম্মত হন না।’
আমি তা শুনে তাজ্জব বনে যাই। মানুষ কী পরিমাণ মরিয়া হলে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা করে। আইয়ুব খান মুজিবকে মুখ্যমন্ত্রী হতে না দিয়ে কোন্ পথে ঠেলে দিচ্ছেন? তখতে বসিয়েছেন তিনি মোনায়েম খানকে। ময়মনসিংহে থাকতে একদিন ওঁকে আমার আদালতে বসে থাকতে দেখেছিলুম। মিনিস্টার চেহারা। দারুণ কমিউনাল বলে ওঁর দুর্নাম। হয়তো সেইটেই ওঁর যোগ্যতার মাপকাঠি।
আইয়ুব খানের পতনের পর শেখ মুজিবের সুদিন আসে। বেসিক ডেমোক্রাসী পরিত্যক্ত হয়। প্রত্যক্ষ নির্বাচন পুনঃপ্রবর্তিত হয়। সাবালকদের সবাইকে ভোটের অধিকার দেওয়া হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে যে সাধারণ নির্বাচন হয় তাতে মুজিবের দলের জয়জয়কার। শতকরা নিরানব্বইটা আসন কোন্ দল কবে কোন্ দেশের ইতিহাসে পেয়েছে? মুজিবের তো সারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার কথা।
সেই সময়ে কতকগুলি গ্রামোফোন রেকর্ড তৈরি হয় ঢাকায়। একটি ছাত্রের বাড়ি ঢাকায়। সে পড়ে শান্তিনিকেতনে। তাকে পাঠাই বই কিনে আনতে। সে বই নিয়ে আসে। উপরন্তু আনে কয়েকটি রেকর্ড। আমাকে বাজিয়ে শোনায়, কিন্তু হাতছাড়া করে না। রেকর্ড শুনে আমি চমকে উঠি। পাকিস্তান সরকার বার করতে দিচ্ছে না অমন সব রেকর্ড। তাতে শেখ মুজিবের বজ্রকণ্ঠ। কণ্ঠে বিদ্রোহের সুর। পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশ ও বাংলাভাষা। সে কী উন্মাদনাভরা গান। গেয়েছে তরুণ-তরুণীরা। আবার যেন সেই ১৯০৫ সালের স্বদেশি আমল ফিরে এসেছে। লোকে পাকিস্তানের জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্য পাগল। যে বাংলাদেশ তাদের একান্ত আপনার।
আজ বাদে কাল রাম রাজা হবেন, কিন্তু তা তো হবার নয়। তেমনি শেখ মুজিবের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া। তার বদলে তিনি পশ্চিম পাঞ্জাবের এক দুর্গম স্থানে হলেন রাজবন্দি। যখন ফিরে এলেন তখন তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। আমার সেই রেকর্ড শোনার বারো মাসের পরেই রেডিওতে তাঁর সংবর্ধনার বিবরণ শোনা। তাঁর ভাষণ শোনা। রামের মতো তিনি ফিরে এলেন পুষ্পক বিমানে।
তিনি যে প্রাণ নিয়ে ফিরে এলেন এতেই আমরা কৃতার্থ। কারণ তাঁর প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়েছিল। ঢাকায় পাকিস্তানি ফোঁজ আত্মসমর্পণ না করলে, রাতারাতি ইয়াহিয়া খান পদত্যাগ না করলে, পাকিস্তানের নতুন রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁকে মুক্তি দিয়ে লন্ডনে পাঠিয়ে না দিলে লন্ডন থেকে তিনি দিল্লি ও দিল্লি থেকে ঢাকায় পৌঁছতেন না। তাঁর দিল্লির সংবর্ধনার বিবরণও শুনেছি। সেখানেও তিনি বাংলায় ভাষণ দেন।
একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে যোগদানের আমন্ত্রণে ঢাকা যেতে পারিনি। পরে ডিসেম্বর মাসে আসে অন্য এক আমন্ত্রণ। ততদিনে শেখ সাহেব স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেছেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেবকে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি পদ। ইতোমধ্যে কলকাতায় চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তিনি আমার পথে প্রবাসের থেকে আবৃত্তি করে আমাকে অবাক করে দেন। পরে ঢাকায় বঙ্গভবনে মধ্যাহ্নভোজনে আপ্যায়িত করেন। তখন জানতে পাই তিনি ছাত্রবয়সে তাঁর পত্রিকার জন্য আমাকে চিঠি লিখে লেখা চেয়েছিলেন।
তার পরের একুশে ফেব্রুয়ারিতে যাওয়া হয় না। কিন্তু পরবর্তী একুশে ফেব্রুয়ারিতে সদলবলে নিমন্ত্রণ। ভারতীয় প্রতিনিধিমণ্ডলীর নেতা হয়ে বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিই। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর দক্ষিণপাশে শিক্ষামন্ত্রী, তাঁর পাশেই আমি। খুব কাছাকাছি পাই শেখ সাহেবকে। আমার অন্যতম হিরো। কিন্তু কথা বলার অবকাশ পাই নে। পেতুমও না, যদি না সম্মেলনের উদ্যোক্তারা আমাদের প্রত্যাবর্তনের দিন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতেন।
সেই অবিস্মরণীয় দিনটির কথা আমি ফিরে এসে লিখি ও তার নাম রাখি ‘ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে’। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ তাতে ছিল না। তিনি নিজেই আমাদের বারণ করেছিলেন। আজ তিনি নেই। আমারও তো বয়স হলো একাত্তর। আর কতদিন আছি কে জানে। কেউ না কেউ লিখে না রাখলে ভাবীকাল জানতেই পাবে না, শেখ মুজিব কী করেছিলেন ও কেন করেছিলেন। তাঁর নিষেধ তাঁর জীবৎকালে মান্য করেছি। এখন তিনি সব আপদবিপদের ঊর্ধ্বে। মরণোত্তর মানহানিরও শঙ্কা নেই। তিনি অমর।
এ বিবরণ আনুপূর্বিক নয়। পরেরটা আগে, আগেরটা পরে, যখন যেটা মনে আসছে তখন সেটা কলমের মুখে আসছে। ভাষা ও ভঙ্গি শেখ সাহেবের নয়, তবে বক্তব্যটা তাঁরই। ভুলচুক যদি ঘটে থাকে তবে সেটা আমার স্মৃতির ভ্রম।
‘দেখুন আমি দুই দুইবার মরতে মরতে বেঁচে গেছি। প্রথমবার আইয়ুব খানের বন্দিশালায়। ষড়যন্ত্রের মামলায়। আমার এক সাথী আমাকে হুঁশিয়ার করে দেয় যে, সন্ধ্যাবেলা সেলের বাইরে গিয়ে নিয়মিত বেড়ানোর অভ্যাসটি বিপজ্জনক। পেছন থেকে গুলি করবে আর বলবে পালিয়ে যাচ্ছিল বলে গুলি করেছি। অন্যের বেলা ঘটেও ছিল ওরকম গুলি চালনা। দ্বিতীয়বার ইয়াহিয়া খানের কারাগারে। আমার সামনেই আমার কবর খোঁড়া হচ্ছে। বুঝতে পারছি যে আমার শেষ মুহূর্ত ঘনিয়ে আসছে। মনটাকে তৈরি করে নিই যে মরতে যখন হবেই তখন মিছে ভয় কেন? শান্ত মনে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করি।’ শেখ সাহেব বলে যান।
সেদিন তিনি বেশ খোশমেজাজে ছিলেন। সাতজন আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁকে বুঝিয়ে লাহোরে ইসলামি শীর্ষ সম্মেলনে নিয়ে যেতে। তিনি তাঁদের সাফ বলে দিয়েছেন যে আগে স্বীকৃতি, তার পরে সম্মেলনে যোগদান। এখন কী হয় দেখা যাক। আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ঘণ্টাকয়েক যেতে না যেতেই পাকিস্তান দেয় স্বীকৃতি আর রাত পোহাতে না পোহাতেই শেখ উঠে যান লাহোরে। সেখানে পড়ে যায় সংবর্ধনার ধুম। শেখ সাহেবকে আমরা প্রশ্ন করি, ‘বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এলো।’
‘শুনবেন?’ তিনি মুচকি হেসে বলেন, ‘সেই ১৯৪৭ সালে। তখন আমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালির এক দেশ। বাঙালিরা এক হলে কী না করতে পারত। তারা জগৎ জয় করতে পারত। They could conquer the world.’
বলতে বলতে তিনি উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন। তারপর বিমর্ষ হয়ে বলেন, ‘দিল্লি থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সোহরাওয়ার্দী ও শরৎ বোস। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কেউ রাজি নয় তাঁদের প্রস্তাবে। তাঁরা হাল ছেড়ে দেন। আমিও দেখি যে আর কোন উপায় নেই। ঢাকায় চলে এসে নতুন করে আরম্ভ করি। তখনকার মতো পাকিস্তান মেনে নিই। কিন্তু আমার স্বপ্ন কেমন করে পূর্ণ হবে এই আমার চিন্তা। হবার কোন সম্ভাবনাও ছিল না। লোকগুলি যা কমিউনাল। বাংলাদেশ চাই বললে সন্দেহ করত। হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলাভাষা। আমিও ভিড়ে যাই ভাষা-আন্দোলনে। ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দিই দেশভিত্তিক আন্দোলনে। পরে এমন একদিন আসে যেদিন আমি আমার দলের লোকদের জিজ্ঞাসা করি, আমাদের দেশের নাম কী হবে? কেউ বলে পাক বাংলা। কেউ বলে, পূর্ব বাংলা। আমি বলি – না, বাংলাদেশ। তারপর আমি স্লোগান দিই, জয় বাংলা। তখন ওরা বিদ্রূপ করে বলে, জয় বাংলা না জয় মা কালী। কী অপমান। সে অপমান আমি সেদিন হজম করেছি। আসলে ওরা আমাকে বুঝতে পারেনি। জয় বাংলা বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছিলুম বাংলাভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির জয়। যা সাম্প্রদায়িকভাবে ঊর্ধ্বে।’
‘জয় বাংলা’ আসলে একটি মন্ত্র। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ বা দাদাভাই নওরোজীর ‘স্বরাজ’ বা গান্ধীজির ‘কুইট ইন্ডিয়া’ বা নেতাজী সুভাষের ‘চলো দিল্লি’। এ হলো শব্দব্রহ্ম। একটি শব্দের বা শব্দের সমষ্টির মধ্যে অসীম শক্তি নিহিত। সে-শক্তি অসাধ্য-সাধন-পটীয়সী।
একটি কমিউনাল পার্টিকে ন্যাশনাল পার্টিতে রূপান্তরিত করা চারটিখানি কথা নয়। বার-বার জেলে গিয়ে বার-বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে তিনি একদিন সত্যি-সত্যিই পেয়ে যান তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ। যে-বাংলাদেশ অবিভক্ত না হলেও সার্বভৌম ও স্বাধীন। আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের দিনই পেলেন পাকিস্তানের স্বীকৃতি। পরে ইউনাইটেড নেশনসে আসন। একজন ব্যক্তি তাঁর পঞ্চান্ন বছর বয়সে এর চেয়ে বেশি সার্থকতা প্রত্যাশা করতে পারেন কি? আর কেউ কি পারতেন?
সেদিন আমাদের বিশ্বাস করে আরো একটি কথা বলেন শেখ সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে বলিয়ে নেন যে আমরা প্রকাশ করব না। আমি এখন কথার খেলাপ করছি ইতিহাসের অনুরোধে। আমি প্রকাশ না করলে কেউ কোনোদিন করবে না।
‘আমার কী প্ল্যান ছিল, জানেন? অকস্মাৎ আমরা একদিন পাওয়ার সিজ করব। ঢাকা শহরের সব কটা ঘাঁটি দখল করে নেব। আর্মিতে, নেভীতে, এয়ারফোর্সে, পুলিশে, সিভিল সার্ভিসে আমাদের লোক ছিল। কিন্তু একটা লোকের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য সব পণ্ড হয়। নেভীর একজন অফিসার বিশ্বাস করে তাঁর অধীনস্থ একজনকে জানিয়েছিলেন। সে ফাঁস করে দেয়। তখন আমরা সবাই ধরা পড়ে যাই।’
তিনি আক্ষেপ করেন।
আমি প্রশ্ন করি, ‘ঘটনাটা ঘটত কোন্ তারিখে?’
তিনি মৃদু হেসে উত্তর দেন, ‘বলব না।’
আমি চুপ। বুঝতে পারি অশিষ্টতার মাত্রা অতিক্রম করেছি।
বহু তপস্যার ফলে মর্ত্যরে মানুষ স্বর্গের ইন্দ্র হয়। পুণ্যবল ক্ষয় হলে বা অসুররা প্রবল হলে পরে একদিন সেই ইন্দ্রের পতনও হয়। দুই দুইবার মরণের মুখ থেকে বেঁচে এসে তিনবারের বার তাঁকে মৃত্যুর কবলে পড়তে হলো। পাওয়ার সিজ করল তাঁরই স্বদেশবাসী ও স্বজাতি। অদৃষ্টের বিড়ম্বনা।
এর কি কোন দরকার ছিল? সাক্ষাৎকারের দিনই তো শেখ সাহেব আমাদের বলেছিলেন যে, তিনি আর ক্ষমতার আসনে থাকতে চান না, কী করবেন, তাঁর দলের লোক যে তাঁকে যেতে দিচ্ছে না। তিনি স্পষ্ট করে বলেন যে, তাঁর কাজ সারা হয়েছে।
তিনি যা যা চেয়েছিলেন সবকিছুই পেয়েছেন।
ঠিক সময়ে সরে গেলে দলের মধ্যে ভাঙন ধরত। সে ভাঙন শুধু স্বার্থঘটিত কারণে নয়, মতবাদঘটিত ও পলিসিঘটিত কারণেও। সব বাঙালি কখনো এক হতে পারে না, সব বাংলাদেশী কখনো এক হতে পারে না, সব মুসলমানও কি কখনো এক হতে পারে? সব মুসলমানের জন্যে পাকিস্তান একটি অনন্য সৃষ্টি। তার এক অংশের থেকে অপরাংশ হাজার মাইল দূরে। মাঝখানে সমুদ্র নয়, অপর এক দেশ। তার কোন স্বাভাবিক কেন্দ্রস্থল ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকার কোনকালেই মেজরিটি ভোট মেনে নিত না। ভোটবল ছিল পূর্বপ্রান্তের বাঙালি মেজরিটির। অস্ত্রবল ছিল পশ্চিমপ্রান্তের পাঞ্জাবি ও পাঠান মাইনরিটির। একদিন না একদিন একটা বল পরীক্ষা হতোই।
শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সেই অবশ্যম্ভাবী ঐতিহাসিক পরিবর্তনটি সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়। তিনি ছিলেন ক্রান্তদর্শী পুরুষ। আপন ব্রতে নিবেদিত কর্মবীর। একটি স্বপ্ন নিয়েই তাঁর যাত্রারম্ভ। যাত্রাশেষও সেই স্বপ্নের রূপায়ণে।
সময়ে পদত্যাগ করলে বাঁচতেন তিনি আরো কিছুকাল নিশ্চয়। কিন্তু বাঁচতেন কী নিয়ে? যুক্তবঙ্গের লেশমাত্র সম্ভাবনা ছিল না। তিনিও সে আশা ত্যাগ করেছিলেন। এমনভাবে ত্যাগ করেছিলেন যে তাঁর কারবার ছিল দিল্লির সঙ্গে, কলকাতার সঙ্গে নয়। ভারত সরকারের সঙ্গে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে নয়। আমরাও বাংলাদেশে গেলে বাঙালি বলে চিহ্নিত হতুম না, হতুম ভারতীয় বলে, ইন্ডিয়ান বলে। বাংলাসাহিত্যের সম্মেলনেও আমরা বিদেশি অতিথি বলে অভ্যর্থনা পাই, যেমন পান সোভিয়েত রাশিয়ার বা পূর্ব জার্মানির প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত সাবধান ছিলেন যাতে কেউ কখনো মনে না করে বাঙালিতে বাঙালিতে তলে তলে একটা একতার চেষ্টা হচ্ছে। তাই আমাদের প্রতি তাঁদের একটা ছাড়া ছাড়া ভাব।
ওদিকে আবার একদল সক্রিয় ছিলেন মুসলমানে মুসলমানে একতার চেষ্টায়। শেখ সাহেবকে তাঁরা বিশ্বাস করতেন না। তাঁদের অবিশ্বাস থেকেই এই ঘাতকতা। ***
[সূত্র : শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ, ঢাকা, ১৯৭৯, পৃ ২০-২৪]

বঙ্গবন্ধু : মৃত্যুদিনের ভাবনা
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

এক
বিগত দিনের বারো মাস তের পার্বণ আর আজকের বছরব্যাপী দিবস উদযাপন, ঠিক এক জিনিস নয়। আজকের দিবস উদযাপন আমাদের ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় ঘটনা-দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এখন চলেছে শ্রাবণ মাস। শ্রাবণের শেষার্ধ আর অগাস্টের প্রথমার্ধ দুটি মৃত্যুদিন উপহার দিয়েছে বঙ্গবাসীকে, বাঙালিকে। দুটিই শোকের দিন : রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের দিন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সপরিবারে নিহত হওয়ার দিন। আরো মৃত্যুদিন আছে এ-মাসে, এর সবক’টিকে ছাড়িয়ে-ছাপিয়ে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে ২২শে শ্রাবণ ও ১৫ই অগাস্ট। একটির বেলায় বাংলা তারিখটি মনে রেখেছি আমরা। অন্যটির বেলায় টিকে গেছে খ্রিস্টীয় তারিখ। সে-বৎসর, ১৯৭৫ সালে, ১৫ই অগাস্টে বাংলা সন-ভিত্তিক তারিখটিকে যদি আমরা আমাদের জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করতাম, তাহলে আমাদের জন্য সেটা সম্মানজনক হতো। কিন্তু বলে লাভ নেই। ইতিহাস চলে নিজের নিয়মে। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আমরা বাংলা সনে টানতে পারিনি। একুশে এমনভাবেই আমাদের চেতনায় প্রবেশ করেছে যে এটি আর পঞ্জিকার একটি দিন নয়, অনেক আবেগ অনেক বেদনা-জাগানো এক বিশাল অনুভূতি।
এবারের শ্রাবণে (১৪১১) বাংলাদেশ একটি আক্রান্ত জনপদ। দেশের অর্ধেকের বেশি জমিন জলমগ্ন। দু’কোটির বেশি মানুষ দিন কাটাচ্ছে চরম দুর্দশা ও অসহায়ত্বের মধ্যে। ঘরে-বাইরে একমাত্র প্রসঙ্গ বন্যা ত্রাণ ও বহুমাত্রিক বিপর্যয়। এই বিপর্যয় স্পর্শ করেছে দেশের প্রতিটি মানুষকে; যে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নয়, তাকেও। অথচ কী আশ্চর্য, এর মধ্যে উদযাপিত হয়েছে ২২শে শ্রাবণ, সঙ্গীতে নৃত্যে অভিনয়ে। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শিল্পীকে, স্রষ্টাকে আমরা স্মরণ করেছি শিল্পিত পন্থায়, তাঁরই গান গেয়ে, তাঁরই নৃত্য পরিবেশন করে, তাঁরই নাটক অভিনয় করে। মৃত্যুদিনের এই উদযাপনে আমরা জীবনেরই জয় ঘোষণা করেছি। একজন কবির তিরোধানের দিবসটি সে-অর্থে শোকের দিন নয়। আমরা মৃত্যুর ক্ষতিকে বড়ো করে দেখিনি, আমাদের প্রাপ্তিকে মনে রেখেছি, গর্বে, কৃতজ্ঞতায়।
এর বিপরীতে, ১৫ই অগাস্ট সর্বার্থেই এক শোকের দিন। এ-দিনও ২২শে শ্রাবণের মতো একটি দিন হতে পারত, কিন্তু হয়নি। হয়নি যেহেতু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। তিনি নিহত হয়েছেন ষড়যন্ত্রকারীদের ভিতর থেকে বেরিয়ে-আসা একদল নিষ্ঠুর ঘাতকের হাতে। এই ঘাতকেরা ভেবেছিল ও দাবি করেছিল, তারা দেশোদ্ধারের এক মহৎ কাজ সম্পন্ন করেছে; আশা করেছিল তাদের এই বীরোচিত কাজের জন্য তারা সারাদেশের প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা অর্জন করবে। প্রশংসা তারা অর্জন করেছে গোষ্ঠীবিশেষের। আর ধিক্কার অর্জন করেছে অধিকাংশ দেশবাসীর। এই ঘাতকদলের বর্বরতায় যারা রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে, তাদের জন্য একটা দুরূহ সমস্যাও রেখে গিয়েছে তারা। ইতিহাসের এক ঘৃণ্যতম কাজকে কিভাবে কলঙ্কের কালিমুক্ত করে উজ্জ্বল শুভ্রতায় মণ্ডিত করা যাবে, কিভাবে এর অপরাধী চক্রকে সঙ্কটের ত্রাতায় পরিণত করা যাবে, কিভাবে ক্ষমতার চোখ রাঙিয়ে ইতিহাসকে দিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ানো যাবে, এই দুঃসাধ্য কাজের পথে ঠেলে দিয়েছে ঘাতকেরা। একজন নির্দোষ মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করে, রিমান্ডে এনে পুলিশ তাকে দিয়ে আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ানোর চেষ্টা করে। সাক্ষী যদিবা প্রথমে শিখিয়ে দেয়া সাক্ষ্য দেয়, তারপরই প্রথম সুযোগে আসল সত্য ফাঁস করে দেয়। মিথ্যা দিয়ে সত্যকে ঢাকা এত সহজ নয়। আর ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে বিকৃত করে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করা যে কতো কঠিন, ইতিহাসের রূপকথা সৃষ্টিকারীরা সেটা একটু দেরিতে উপলব্ধি করেন। বা আদৌ করেন না।
যৌবনে রাজনৈতিক কর্মী, সেখান থেকে প্রভূত সম্ভাবনাময় রাজনীতিক, সেখান থেকে দক্ষ ও পরিপক্ব স্টেট্সম্যান এবং সব শেষে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নস্রষ্টা ও স্থপতি, – এভাবেই পর্যায়ক্রমে উত্তরণ ঘটেছে শেখ মুজিবের। কোনো আকস্মিক ঘটনাসূত্রে কেউ কেউ ক্ষমতার উচ্চশীর্ষে উৎক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। তাঁদের ক্ষেত্রে রাজনীতির চড়াই-উৎরাই পার হয়ে শেষাবধি উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছবার স্বাভাবিক ধারা প্রযোজ্য নয়। বিপ্লবে-উপবিপ্লবে এ ধরনের আশ্চর্য ঘটনা ঘটে থাকে। এঁদের বেলায় ক্ষমতায় আরোহণ অনেকটাই অভাবিতপূর্ব, আকস্মিকের উপহার। কোনো-কোনো ক্ষেত্রে যাঁদের আগমন আকস্মিক, তাঁদের প্রস্থানও আকস্মিক। তবে বিপ্লব-উপবিপ্লবের প্রকৃতিই এমন যে এর ডামাডোলে হারিয়ে যেতে পারে উভয় শ্রেণীর নেতৃত্বই। অস্থির সময় কাউকেই রেহাই দেয় না। সুকৃতি ও দুষ্কৃতির মধ্যে তফাৎ করে না। এভাবেই, মাত্র কয়েক বৎসরের ব্যবধানে বাংলাদেশের দু’জন রাষ্ট্রপতি বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য যে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ কেবলই তৈরি হয়েছিল, তাও মুছে দিল।
এখানে একটা বিতর্কের সম্ভাবনা আছে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আকস্মিকতা অস্বীকার করব না। তাঁর মৃত্যু কি একেবারেই আকস্মিক ছিল, একেবারেই একটা অসম্ভাব্য ঘটনা ছিল?
ইতিহাসবিদের জন্য, বঙ্গবন্ধুর প্রামাণ্য জীবনীকারের জন্য, এ এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একদিকে সত্য হ’ল এই যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ সম্ভব হয়েছিল বাঙালি জাতির শিলাদৃঢ় একতার জোরে, যে-একতার ভিত্তি তৈরি করেছিলেন মূলত বঙ্গবন্ধু, তাঁর নেতৃত্বের দশকে। আবার অন্যদিকে আরেকটি সত্য হ’ল, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচয়ে দেখা দিলেও রাষ্ট্র হিসেবে তার বুনিয়াদ দৃঢ় হওয়ার অবকাশ মেলেনি। এ জন্য প্রয়োজন ছিল অন্তত দশ বৎসরের একটি স্থিতিশীল সরকার। স্থিতিশীলতা অর্জনের বিপরীতে সক্রিয় ছিল বিভিন্ন গোষ্ঠী ও শক্তি, দেশের ভিতরে ও বাইরে। দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্বলতার পুরো সুযোগ গ্রহণ করে এরা, এই দুই শক্তি, এক যোগে একই লক্ষ্যে কাজ করেছে। এ-যুগের মার্কিনী কৌটিল্য কিসিঞ্জারের কূটবুদ্ধি কাজ করেছে এই যৌথ উদ্যোগের পিছনে। কিসিঞ্জারের সঙ্গে নাম করতে হবে আরও একজন মনুষ্যরূপী সর্পের, যার লেজ মুড়ে দিয়ে জন্ম হয়েছিল বাংলাদেশের। জুলফিকার আলী ভুট্টো ছিলেন এক আহত সর্প। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সঙ্গে তাঁর ছিল গোপন ও অব্যাহত যোগাযোগ।
এত সব বিরুদ্ধ শক্তির তৎপরতাও সফল হত না, যদি না নতুন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা তাকে বিপজ্জনকভাবে আক্রমণযোগ্য করে রাখত। সরকারের শীর্ষে বঙ্গবন্ধু, একদিকে যেমন ছিল পরম ভরসাস্থল, আবার অন্যদিকে ছিল বিপদের উৎস। সবাই সব ভূমিকার জন্য সমান যোগ্যতা রাখেন না। রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকায় বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্ব বাঙালি জাতিকে আশ্বস্ত করেছে। সারা বিশ্ব তাঁকে একজন বিশ্বনেতার সম্মান দেখিয়েছে। দরিদ্র বাঙালি বিশ্বের চোখে সম্মানীয় জাতির মর্যাদা অর্জন করছে, এবং এসবই হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির একতা, সাহস ও শৌর্যের কারণে, সেই যুদ্ধে নেপথ্যের নায়ক বঙ্গবন্ধুর কারণে। তবে –
তবে এ-সন্দেহও মন থেকে তাড়ানো যায় না যে বঙ্গবন্ধু তাঁর সকল সুকৃতি, তাঁর অসামান্য জনপ্রিয়তা, তাঁর আদর্শের ধ্রুবতা, তাঁর প্রশ্নাতীত সততা সত্ত্বেও সেদিনের সেই টালমাটাল সময়ের জন্য উপযুক্ত সরকার প্রধান ছিলেন কিনা। তাঁর মানসিক গঠনে কয়েকটি মহৎ গুণ, – ক্ষমা, উদারতা – ওই সময়ে তাঁর দুর্বলতা হিসেবে দেখেছেন অনেকে। তাঁকে দেবতার আসনে বসিয়েছিল যারা, সৎ পরামর্শ দেয়ার ইচ্ছা বা সাহস তাদের ছিল না। …
বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের মহানায়ক। তিনি তাঁর অপরিসীম ত্যাগ, তিতিক্ষা, সাহস ও প্রজ্ঞা দিয়ে ধাপে ধাপে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে, যথাসময়ে সঠিক রণ-কৌশল উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে, বাঙালি জাতিকে পরিণত করেছিলেন একটি একতাবদ্ধ লড়াকু জাতিতে। তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্বদানের মূল্য কেউ কমাতে পারবে না। তাঁর রাষ্ট্রনৈতিক নেতৃত্ব বিষয়ে জীবনীকার ও ইতিহাসবিদ সম্ভবত একমত হবেন না। এই প্রশ্নে আমরা আজও ইতিহাসের রায় পাইনি। হয়তো সে সময়ও আসেনি।
ইতিহাস একদিকে যেমন সত্যবাদী, আবার অন্যদিকে তার রয়েছে এক ধরনের হেঁয়ালিপনা। খ্যাতিমানের খ্যাতির পাশাপাশি রয়েছে অখ্যাতি। যিনি বীর তিনিই আবার অবরেণ্য দুর্জন। যে যেভাবে দ্যাখে। সবাই একজন প্রকৃত বীরকে বীরের সম্মান দেবে না, দেয়নি। ক্রমওয়েলকে রাজতন্ত্রীরা দুর্জন প্রতিপন্ন করেছিল। কবর থেকে তাঁর কঙ্কাল তুলে নিয়ে ফাঁসিকাঠে লটকেছিল। ইতিহাসবিদেরাও সবাই সবক্ষেত্রে একমত হতে পারে না। দলীয়-সাম্প্রদায়িক আনুগত্যের বাইরে সবাই নন, যদিও ইতিহাস তাই দাবি করে। শোনা যায়, হিটলারের অভ্যুত্থানের সময়ে বুদ্ধিজীবী সমাজে তাঁর সমর্থকের অভাব হয়নি, আর ইতিহাসবিদেরাও এর মধ্যে পড়েন।
কেবল রাষ্ট্রপরিচালনার প্রশ্নে নয়, এমনকি রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রশ্নেও বঙ্গবন্ধু অবিতর্কিত থাকবেন, তা আশা করা যায় না। তথ্য যাই বলুক, তথ্যের ব্যাখ্যা যিনি করবেন তিনি একজন ব্যক্তি। এবং একজন ব্যক্তি পুরোপুরি নৈর্ব্যক্তিক হবেন, অতো বড়ো অতিমানুষিকতা আশা করা যায় না। রসুলুল্লাহ এ কথা কখনো ভোলেননি, তাই তাঁর বিনয়ী উক্তি, আনা বাশারুম মেসলুকুম – আমি তোমাদের মতোই মানুষ। অথচ ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে এই মানুষটিকেই অমানুষে পরিণত করেছে মধ্যযুগের ইয়োরোপীয় কবি যাজক পণ্ডিত। ইতিহাসের যাঁরা মহানায়ক, তাঁদের ভাগ্যে রয়েছে এই দুর্গতি। তবে শেষাবধি তাঁরা তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদাই পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুও এর ব্যতিক্রম নন।
বাংলাদেশের জন্মেতিহাস নিয়ে সরকারি পর্যায়ে যে কাটাছেঁড়া চলেছে, তার ফলে বঙ্গবন্ধুর উচ্চতা এক ইঞ্চিও কমেছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। একটা প্রবল জাতীয় ঐকমত্য রয়েছে তাঁর এই উচ্চতা বিষয়ে। নিন্দুকেরা তাঁর সুনামে আঁচড় বসাতে না পারলেও স্তাবকেরা যে-ক্ষতি করেছে সেটা অস্বীকার করা যায় না। এই ক্ষতির দায় বইতে হয়েছে দলকে, দেশকে। এরা তাঁর জীবদ্দশায় ক্ষতি করেছে, মৃত্যুর পরও করে চলেছে।
বন্যাপ্লাবিত বাংলাদেশেও কৃতজ্ঞ দেশবাসী মহান নেতার মৃত্যু দিবসে তাঁর প্রতি তাদের শ্রদ্ধা জানাবে। দু’কোটি দুর্গত মানুষের কথা ভুলবে না, তাদের ভাগ্যোন্নয়নে যিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁকেও স্মরণ করবে।

দুই
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এ যাবৎ যাঁরা লিখেছেন, প্রায় সবাই তাঁর অসাধারণ রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। ছাত্রজীবন থেকে তিনি চলমান রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলা যায় সর্বসমর্পিত। ভারত বিভাগ ও পাকিস্তানের অঙ্গ পরিচয়ে যেদিন থেকে পূর্ব বাংলা দেখা দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তান নামে, সেদিন থেকেই তিনি এদেশের রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চুয়ান্নর নির্বাচনেই তিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। পঞ্চাশের দশকে তাঁর রাজনৈতিক জ্যেষ্ঠরা সবাই জীবিত, – এ কে ফজলুল হক, তমিজুদ্দীন, আবুল হাশিম, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান। রাজনীতির শিক্ষানবিসি পূর্বে জ্যেষ্ঠরা তাঁর গুরুস্থানীয়, তিনি ছাত্র। কার কাছে তিনি কতটা শিক্ষা গ্রহণ করেছেন জানি না। তবে যদি একজনেরও নাম করতে হয়, তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখেছেন মওলানা ভাসানীকে। সেটি নানা টানাপোড়েনের পরও অটুট ছিল তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আমার ধারণা তাই। তবে যে নেতাকে তিনি মনেপ্রাণে নেতা বলে জেনেছেন তিনি সোহরাওয়ার্দী। আর সোহরাওয়ার্দীও তাঁকে শনাক্ত করেছেন আগামীর নেতা হিসেবে। ষাটের দশকেই (১৯৬৩) সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু হ’ল, এবং প্রায় অনিবার্যভাবেই তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করলেন শেখ মুজিব। এই দশকের শেষার্ধে, ছয় দফার প্রবক্তা শেখ মুজিব বাংলাদেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানের রাজনীতি ছিল কুহেলিকায় আচ্ছন্ন। রাজনৈতিক দল হিসেবে মুসলিম লীগ সমগ্র পাকিস্তানেই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এই মুসলিম লীগের থেকেই রাজনীতি করেছেন কোনো এক পর্যায়ে প্রথম সারির সকল নেতা, এবং তরুণ শেখ মুজিব। দলটি যে ভেতর থেকে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে দেউলিয়াত্বে পৌঁছে গেছে, সে সত্যটি ধরা পড়েছিল যাঁদের চোখে, সে দলে শেখ মুজিবও ছিলেন। এই দেউলিয়াত্ব গণমানুষের চোখে ধরা পড়ল ১৯৫৪-র প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে। নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হ’ল। বিপুলভাবে বিজয়ী হ’ল যুক্তফ্রন্ট।
এই নির্বাচনের তাৎপর্য বুঝে নিতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ভুল করেনি। বস্তুত ১৯৫৪-র নির্বাচন ছিল কেন্দ্রের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার অঘোষিত বিদ্রোহ। কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্নতার কথা কেউ ভাবেনি। তবে কেন্দ্র যখন সেনাবাহিনী জেনারেলদের সঙ্গে আঁতাত গড়ে তুলল, যখন পেছন থেকে জেনারেলরা রাজনীতির সুতো টানতে শুরু করলেন, যখন ‘৫৪-র নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করল কেন্দ্র, তখন থেকে পাকিস্তানী রাজনীতির চরিত্রই বদলে গেল। পাকিস্তানকে আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের পথে রাখার যতো চেষ্টাই করলেন সোহরাওয়ার্দী, সবই ব্যর্থ হ’ল। ভগ্নহৃদয় সোহরাওয়ার্দী নিদারুণ হতাশার মধ্যে মৃত্যুবরণ করলেন। বিদেশে, বৈরুতের এক হোটেলে। আর এই হতাশার অন্ধকার থেকে মুক্তির আলোয় বেরিয়ে আসার দুরূহ সাধনায় নেতৃত্ব দিলেন সোহরাওয়ার্দীর মানসপুত্র শেখ মুজিব।
সাবেক মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে আসা নেতা-কর্মীরা গঠন করলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ, যা কিছুদিন পরেই (১৯৫৫, ২১-২৩ অক্টোবর) ‘মুসলিম’ শব্দটি ছেঁটে ফেলে নাম গ্রহণ করল আওয়ামী লীগ। পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসছে, এ যেন তারই ঘোষণা।
সম্প্রদায়-ভিত্তিক নির্বাচনের জায়গায় যে ‘একজন এক ভোট’ নীতি চালু রয়েছে (১৯৭০ মার্চ থেকে), তারও সূচনা তখন থেকেই।
’৫৪-র নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটল ’৭০-এর নির্বাচনে। সেবার জয়ী হয়েছিল যুক্তফ্রন্ট, এবার জয়ী হ’ল আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ, কারণ দলটিকে গড়েপিটে তৈরি করার মূল কৃতিত্ব তাঁর।
এর পরের ঘটনা সবারই জানা। তার বিশদ বয়ানে যাওয়ার প্রয়োজন দেখি না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি, মুক্তিযুদ্ধের পরিচালনা করছে যে সরকার, সেটি তাঁরই ’৭০-এর বিজয়ী সাংসদ ও প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের নিয়ে গঠিত। নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের ঘনিষ্ঠতম সহযোগী তাজউদ্দীন আহমদ। ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার ধারাবাহিকতায় ও মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনিই প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট। তাঁর অবর্তমানে ভাইস-প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম পালন করছেন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব। তবে সরকারপ্রধানের গুরুদায়িত্ব পালন করছেন অক্লান্তকর্মা তাজউদ্দীন আহমদ।
মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি পর্যন্ত এবং পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত মুজিব-নেতৃত্বের একটি পর্ব। দ্বিতীয় পর্বে তিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপালনকারী রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান। অনভিজ্ঞ ও অব্যবস্থিত প্রশাসন, কাণ্ডারীহীন পরিত্যক্ত মিল-কারখানা, ধ্বংসপ্রাপ্ত যোগাযোগ-ব্যবস্থা, সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির নাশকতামূলক কার্যকলাপ, বিশ্বময় মুদ্রাস্ফীতি, ’৭৪-এর বন্যা দুর্ভিক্ষ মুজিব সরকারের সামনে সমস্যার পাহাড় হয়ে দেখা দিল। দৃঢ় হস্তেই বঙ্গবন্ধু সকল সমস্যা ও সংকটের মোকাবিলা করলেন। কিন্তু অচিরেই উপলব্ধি করলেন তাঁর নিজের দল ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত তাঁর প্রশাসন একেবারেই ব্যর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্রটিকে সচল রাখতে।রাষ্ট্র-ব্যবস্থার একটি আমূল পরিবর্তন ছাড়া অভীষ্ট লাভ সম্ভব নয়। সেই পরিবর্তনের লক্ষ্যে সাংবিধানিক পরিবর্তন যেটা করলেন, সংসদীয় ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতির শাসন-ব্যবস্থা প্রবর্তন, সেটা তিনি বলতে গেলে একক দায়িত্বেই করলেন। এ জন্য কোনো মতবিনিময় বা সংসদীয় বিতর্কেরও অবকাশ দিলেন না। এর সঙ্গে তুলনীয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থা ঘোষণা। সে সিদ্ধান্তও কোনো মুক্ত আলোচনার ভিত্তিতে হয়নি। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল ব্যবস্থা বলতে গেলে ঘোষণার স্তরেই মৃত্যুবরণ করল। ’৭৫-এর ১৫ অগাস্টে তিনি নিহত হলেন এক সামরিক অভ্যুত্থানে। বাকশাল ব্যবস্থার আঁতুড়ে মৃত্যু ঘটায় এর ভালোমন্দ, এর কার্যকারিতা বা অকার্যকারিতা কিছুই জানা গেল না। লাভের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বিতর্কিত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করল তাঁর সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এবং রাষ্ট্রপতির শাসন-ব্যবস্থার প্রবর্তন।
বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে এযাবৎ যতগুলো বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তার উৎস রাজনৈতিক। অন্য কথায়, তাঁর হত্যার পর যারা ক্ষমতায় থেকেছে, যারা তাঁর প্রবর্তিত নীতিকে বর্জন করেছে ও ভিন্ন ধারার রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির জন্ম দিয়েছে, তারাই তাঁকে নিয়ে কয়েকটি বিতর্কের সূত্রপাত করেছে। এই বিতর্কের মূল্য উদ্দেশ্য দুটি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা যথাসম্ভব লঘু করে দেখা, যেহেতু তিনি নিজে প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব দেননি এবং স্বেচ্ছায় পাকিস্তানীদের হাতে ধরা দিয়েছিলেন।
এই লেখায় আমি ’৭৫-এর শুরুতে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর সমর্থনে বা সমালোচনায় কিছু বলব না। প্রতিকূল অবস্থার চাপে তিনি একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন, তাঁর উদ্দেশ্যের মধ্যে কোনো দোষ ছিল না, এই যুক্তিতে আমি বাকশাল-ব্যবস্থার প্রতি এমনকি শর্তাধীন সমর্থনও জানাবো না। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করার পক্ষেও আমার কিছু বলার নেই। আমার মনে হয়েছে, তাঁর শাসনকালে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য বিস্ময়কর। অভ্যন্তরীণ প্রশাসনের ক্ষেত্রে তাঁর ব্যর্থতাই আমার চোখে পড়ে। যদিও সেই আপেক্ষিক ব্যর্থতার একটা ব্যাখ্যাও আমি খুঁজে পাই। তাঁর দলের দুর্বলতা এবং তাঁর দুর্বল ও অনভিজ্ঞ আমলা গোষ্ঠী নিয়ে তিনি অগ্রসর হতে পারেননি। দলের ও প্রশাসনের মধ্যে সততা ও আনুগত্যেরও ঘাটতি ছিল বলে মনে হয়। তাঁর নিজের গোয়েন্দা বিভাগ তাঁকে বিদ্যমান পরিস্থিতি বিষয়ে কতটা সত্য সংবাদ দিয়েছে জানি না, যদিও বিদেশী সূত্রে প্রাপ্ত বিপদসংকেত তিনি নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন। তবে এক ভ্রান্ত নিরাপত্তাবোধ তাঁকে আত্মরক্ষার জন্য কোনো কার্যকর ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে দেয়নি। তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখী, এটা কি তিনি জানতেন না? নিশ্চয়ই জানতেন। তবে সে হুমকির আসন্নতা বোধ হয় টের পাননি। এমন হতে পারে, শতেক সমস্যা নিয়ে তিনি এত বেশি ব্যস্ত ও বিব্রত ছিলেন যে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে ভাবনা করার ফুরসতও তাঁর হয়নি।
সপরিবারে ও নিকটতম আত্মীয় পরিবারসহ তাঁর অপঘাত-মৃত্যু বাংলাদেশের জন্য এক সমূহ ট্র্যাজেডী। ট্র্যাজেডীর নায়কের পতন কেবল নিয়তির নির্দেশেই ঘটে না। নায়ক-চরিত্রে অনেক গুণাবলির মধ্যে থাকে একটা ‘দোষ’, যা তাঁর পতনের রন্ধ্রপথ তৈরি করে।
আমার কাছে এই ব্যাখ্যা অতিমাত্রায় তাত্ত্বিক মনে হয়। বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের যতো বর্ণনা আমি পেয়েছি তার মধ্যে ‘হিউব্রিস’ বা ‘অতিগর্বের’ প্রমাণ আমি পাইনি। যেটা পাই তা এক পিতৃতান্ত্রিক মেজাজ, যার প্রভাবে তাঁর মুখে ‘তুই’ সম্বোধনটা সহজেই এসেছে। যাঁদের বেলায় তিনি এই সম্বোধন করেছেন, ‘তাঁরা জেনেছেন এর পেছনে আছে এক গভীর মমত্ববোধ। তাঁরা এর মধ্যে কোনো অহেতুক মুরব্বিয়ানার গন্ধ পাননি। মহানুভবতা ও সহৃদয়তায় পরিপূর্ণ ছিল তাঁর অন্তর। রাজনৈতিকভাবে যারা ছিল তাঁর প্রতিপক্ষ, তাদের জন্যও খোলা ছিল তাঁর হৃদয়ের দ্বার। ‘ট্র্যাজিক ফ্ল’ বা চারিত্রিক দুর্বলতা যদি তাঁর থেকে থাকে তবে তা তাঁর অতিরিক্ত সন্দেহমুক্ততা। এই গুণটিও দোষ হয়ে যেতে পারে একজন রাষ্ট্রনায়কের বেলায়। সন্দেহমুক্ততা মহৎ চরিত্রেরই লক্ষণ। ক্ষুদ্র স্বভাবেই থাকে সন্দেহপরায়ণতা।
বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি বিশেষত তাঁর রাষ্ট্রনীতি নিয়ে পণ্ডিতেরা তর্ক করুন। যতো ইচ্ছে করুন কেউ আপত্তি করবে না। যাঁকে সারা জীবন অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, তাঁর অনেক সিদ্ধান্তই ভুল প্রমাণিত হতে পারে। সকল রাষ্ট্রনায়ক সম্বন্ধেই একথা বলা যায়। মাও সে তুং-এর দেশে গিয়ে আমি কোথাও তাঁর প্রতিকৃতি বা ভাস্কর্যমূর্তি চোখে দেখিনি। দোভাষীকে জিজ্ঞেস করতে সে বলেছিল, মাও ছিলেন এক মহান নেতা, তবে শেষ পর্যায়ে তিনি কিছু ভুল করেছিলেন। তাঁর এ মন্তব্যে কোনো নিন্দার সুর বাজেনি।
আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধেও আমরা সেই দোভাষীর সুরে বলতে পারি, বঙ্গবন্ধু ছিলেন এক মহান নেতা, তবে শেষ পর্যায়ে তিনি কিছু ভুল করেছিলেন। একবারও ভুল করেননি এমন কোনো মানুষ কি জন্মেছেন এ জগতে? কিন্তু কোনো একটি ভুলের জন্যই তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল, আমি তা মানতে রাজি নই। তাঁর মৃত্যু তাঁকে খর্ব করেনি, খর্ব করেছে তাঁর জাতিকে, তাঁর দেশকে, আর অভিশপ্ত করেছে তাঁর হন্তারক গোষ্ঠীকে।

তিন
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু স্বাভাবিক হলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতির মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় থাকতো। আজকে যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত বিতর্ক তার একটি কারণ, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল এক ঘাতকচক্রের হাতে এবং তাঁর মৃত্যুর পর ঘাতকচক্র সংবিধানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তাদের পছন্দের ব্যক্তি মুশতাক আহমদকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসিয়ে দেয়। খোন্দকার মুশতাক মুজিব মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন, তবে বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন কতটা ছিলেন বলা মুশকিল। মুজিবনগর সরকারের সময় থেকেই তিনি ছিলেন সন্দেহের পাত্র। তিনি আওয়ামী লীগের। তবে অন্তরে তিনি কী, তা প্রকাশ হয়ে পড়ল তাঁর প্রেসিডেন্ট পদে বৃত হওয়ার পরই। বঙ্গভবনে তাঁকে ঘিরে ছিল বিদ্রোহী সেনা অফিসারেরা। স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তাঁর ওই পরিস্থিতিতে থাকার কথা নয়। তবে তিনি বিশ্বের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য একটি চাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন, – মুজিব মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যকে তাঁর মন্ত্রিসভায় নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর দ্বারা তিনি বোধহয় দেশের ও বিদেশের যে সন্দেহ – তাঁর ক্ষমতারোহণের সাংবিধানিক তাৎপর্য বিষয়ে – সেটা দূর করতে চেয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ চার নেতা হত্যায় তাঁর ভূমিকা প্রমাণ করলো তিনি কী ও কাদের লোক। বরাবরই তিনি ছিলেন ঘরের শত্রু বিভীষণ।
এর পরই শুরু হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রাজনৈতিক অপপ্রচার। তাঁকে চিত্রিত করা হয় বাংলাদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদের সহায়ক ব্যক্তি হিসেবে, যদিও এটা বিশ্বাসযোগ্য করা সহজ ছিল না। ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ ও কার্যকর সহায়তায় মুজিবনগর সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল দেশের মুক্তিসেনাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে অতি দ্রুত দেশকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করা। এই রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে ভারতীয় বাহিনীর লোকক্ষয় সামান্য ছিল না। (সম্প্রতি অঙ্কুর প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত সালাম আজাদকৃত কন্ট্রিবিউশন অব ইন্ডিয়া ইন দি ওয়ার অব লিবারেশন অব বাংলাদেশ গ্রন্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় সেনাসদস্য যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তাঁদের পূর্ণ তালিকা দেওয়া হয়েছে। গ্রন্থের পৃ ৩২৫ থেকে ৪৮১ পৃ)’। মোট সংখ্যা নেই। তবে প্রতি পৃষ্ঠায় গড়ে ২০ জন ধরলেও মোট সংখ্যা হবে ৩১২০ জন।
তবে এর বেশি ছাড়া কম হবে না। এই তালিকায় প্রতি মৃত ব্যক্তির নাম, মৃত্যুর তারিখ, সার্ভিস নং পদ থেকে স্পষ্ট হয় মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় ত্যাগের একটি দিক। এটা দুঃখজনক যে বাংলাদেশের অধিকাংশ লেখায় এই দিকটি যথাযথ গুরুত্ব পায়নি।
স্বাভাবিকভাবেই সদ্য শত্রুকবলমুক্ত ও অরাজক দেশ থেকে যাদের ত্যাগে ও শৌর্যে মুক্তি এল তাদের অপসারণ সময়-সাপেক্ষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বঙ্গবন্ধু দেশের সরকার-প্রধান হিসেবে প্রথমেই যেটা নিশ্চিত করলেন, তা হ’ল ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্বদেশে প্রত্যাবর্তন। এ কাজে তিনি যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সম্মতি পেয়েছিলেন, সেটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে। আর যিনি অতি সহজে এই অসাধ্য সাধন করলেন, তাঁকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের সুহৃদ দাবি করা সম্ভব ছিল না।
সম্ভব না হলেও আজ পর্যন্ত মুজিব-বিরোধী পক্ষের প্রচারণায় এই অভিযোগটি শুনতে পাওয়া যায়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও কিছু বক্তব্য, যার লক্ষ্য হ’ল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর যে অনন্য অবদান সারা বিশ্ব মেনে নিয়েছে, সেই অবদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। যেভাবে ও যে-মহল থেকে এই প্রচারণাকে জিইয়ে রাখা হয়েছে, তার রাজনৈতিক চরিত্র একেবারেই স্পষ্ট। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করে যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা আওয়ামী লীগকে শুধু বিরোধী পক্ষ মনে করে না, শত্রু বিবেচনা করে। তবে স্বীকার করা উচিত যে বিরোধী দল সম্বন্ধে এই মনোভাবটা পারস্পরিক। এর উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যে। এই হত্যাকে বৈধতা দান, হত্যার সুবাদে ক্ষমতায় আসা পক্ষের জন্য কর্তব্য হয়ে পড়ে। না হলে তাদের ক্ষমতারোহণই বৈধ থাকে না।
মধ্য-পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি এই বৈধতার প্রশ্ন দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে – বহুলাংশে। এ জন্যই জরুরি হয়ে পড়েছে সংবিধানের মধ্যে কিছু অংশ মুছে ফেলে কিছু অংশ যোগ করা। এই জন্যই জরুরি হয়ে পড়েছে স্বাধীনতার ঘোষক পরিচয়ে জিয়াউর রহমানের ভূমিকাকে মহিমান্বিত করা। এ জন্যই জরুরি হয়ে পড়েছে ৭ মার্চের ভাষণ যে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল না, বা পাকসেনাদের হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দেওয়া পর্যন্ত যে বঙ্গবন্ধু সত্যিই বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ভাবেননি, বা বলেননি, সেটা সত্য-মিথ্যা নানা কূটযুক্তির মাধ্যমে সপ্রমাণ করা। আক্রমণই হচ্ছে আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়, এই নীতির ওপরই পরিচালিত হয়েছে মুজিব-বিরোধী রাজনৈতিক প্রচারণা।
মুজিব-বিরোধী প্রচারণার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এতটাই স্পষ্ট যে এ বিষয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশের সুযোগ নেই। সকল দ্বিধার অবসান ঘটিয়েছে সম্প্রতি বিবিসি’র জনমত জরিপের ফলাফল। বিবিসি’র বাঙালি শ্রোতারা একবাক্যে রায় দিয়েছে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এ হচ্ছে সেই মুজিব যাঁকে সারা বিশ্ব বাংলাদেশের রাষ্ট্রের স্বপ্নস্রষ্টা ও স্থপতি পরিচয়ে জানে।
যিনি স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও রাষ্ট্রের স্থপতি, তিনি মাত্র সাড়ে তিন বৎসর দেশ-শাসনের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বিধ্বস্ত অর্থনীতি, দুর্বল প্রশাসন-যন্ত্র, অচল কল-কারখানা, বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি, বন্যা, দুর্ভিক্ষ – এর যে কোনও একটি যে কোনও চালু প্রশাসনের পক্ষে সামাল দেওয়া কষ্টসাধ্য ছিল। আর সদ্যোজাত একটি অসংগঠিত রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষে একত্রে এতগুলি সমস্যার মোকাবিলা করা ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। বঙ্গবন্ধু তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করে এই দুরূহ কর্মেই ব্রতী হয়েছিলেন। তাঁর ধারণা হয়েছিল, বিরাজমান পরিস্থিতি দাবি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ও তদনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এক ভিন্ন ব্যবস্থা।
যতোদূরে জানা যায়, তিনি বাকশাল ব্যবস্থাকে একটি আপৎকালীন ও অস্থায়ী, বড়ো জোর একটি পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবেই দেখেছিলেন। এই ব্যবস্থা গ্রহণের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য নিয়মসিদ্ধভাবে এগিয়ে যাওয়ার অবকাশ ছিল না। ১৯৭৭ সালে ভারতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও একই চিন্তায় তাঁর ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছিলেন মন্ত্রিসভার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই। ইন্দিরা গান্ধীর এই একক সিদ্ধান্ত তাঁর জন্য কয়েক বছরের রাজনৈতিক পতন ও পরাজয় ডেকে এনেছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর সিদ্ধান্ত কার্যকর করার আগেই দৃশ্যপট থেকে অপসারিত হলেন। ৪র্থ সংশোধনীর ফলে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার, একদলীয় সরকার ও জেলা-ভিত্তিক বিকেন্দ্রায়িত সরকার-ব্যবস্থা কতোটা কার্যকর হত সেটা চিরকালের জন্য একটা অনুমানের বিষয় হয়ে রইল।
তবে সে যাই হোক, এ আর অনুমানের বিষয় নয় যে বঙ্গবন্ধুর অবদান বাংলাদেশের সংবিধান (১৯৭২) রাষ্ট্রের যে রূপরেখা তুলে ধরে, তার সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গুরুতর অমিল ঘটে গেছে। একেবারে বিপরীতধর্মী চিন্তায় পরিচালিত হয়েছে সামরিক রাষ্ট্রনায়কদের অধীনে বাংলাদেশ রাষ্ট্র। একটা বিশেষ বিবেচনায় বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসন-ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। সেটা আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল সামরিক বাহিনী থেকে আগত দু’জন রাষ্ট্রপতির জন্য। তাঁরা নিজেদের ক্ষমতা সংহত করার স্বার্থে রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ পেলেন। একটির পর একটি ডিক্রী জারি করে এবং পরবর্তীকালে সবগুলি ডিক্রীর বৈধতা দিয়ে সংবিধানের সংশোধন করে তাঁরা সৃষ্টি করলেন এক বাংলাদেশ, যা তাঁদের বিকল্প বাংলাদেশ, তাঁদের ‘নতুন বাংলাদেশ’। এই নতুনত্ব ঘোষণার পেছনে যে দাবি তা হ’ল, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এখন অতীতের ব্যাপার, তার মৃত্যু হয়েছে।
এখন আমরা রয়েছি এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ এক অর্থে টিকে আছে। আবার নেইও। সেই বাংলাদেশের সারবস্তু এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। যদিও শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র ফিরে এসেছে সংসদীয় ব্যবস্থায়, কিন্তু ইতিমধ্যে রাজনীতির ধারা এতটাই দূষিত-বিষাক্ত হয়ে গেছে যে, সংসদীয় ব্যবস্থাও অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
সংসদ আছে নামে মাত্র, তার কার্যকারিতা নেই। সংসদের সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ ও বিতর্কের জায়গা নিয়েছে পারস্পরিক দোষারোপের প্রতিযোগিতা। এক পক্ষ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে অন্য পক্ষ নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে ও সংসদ বর্জন করে।
এমন কি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে যে ভিন্নধর্মী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করলাম, তাও ব্যর্থ হয়েছে সংসদীয় ব্যবস্থা অর্থপূর্ণ করার ব্যাপারে।
পঁচাত্তরের মধ্য-অগাস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার এই হয়েছে তিক্ত ফল। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দেননি। দেশের কোন মানুষ তাঁর কোনও ক্ষতি করবে, এ ছিল তাঁর চিন্তার বাইরে। এই আস্থা যে ভিত্তিহীন ছিল, প্রাণ দিয়ে তিনি তা প্রমাণ করেছেন।
কিন্তু যে অনিরাপত্তার মধ্যে পতিত হ’ল দেশ তাঁর অসময়ে, আকস্মিক বিদায়-গ্রহণে সেজন্য কাকে দায়ী করব আমরা? কেউ বলতে পারেন, আমাদের সমূহ অকৃতজ্ঞতার চরম মূল্য দিয়ে চলেছি আমরা। যে পাপ করেছি তার মূল্য পরিশোধ করে চলেছি। সেই স্বপ্নসম্ভব বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া ত’এই অভিশাপ থেকে মুক্তি নেই। আর তা যদি সম্ভব হয়, তাই হবে নির্বাসিত বঙ্গবন্ধুর স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন।***
ঢাকা, ২০০৪ সাল
সূত্র : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মারকগ্রন্থ ১।