সাহিত্যের পাতায় রাজহংসকে আমরা চিরকালীন বিশুদ্ধতার প্রতীক হিসেবেই জানি। কবিতায় ভালোবাসার চিত্রকল্প হিসেবে রাজহংসের উদ্ভাস কাব্যিক ব্যঞ্জনাকে দিয়েছে আকাশছোঁয়া উচ্চতা। তাদের মধ্যে ব্যভিচার নেই, পরকিয়া নেই, নেই কোনো বহুগামিতা। প্রকৃতির ইতিহাস বলে, একটি হংস-হংসীর যুগল আজন্ম-বন্ধনে জড়িয়ে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মৃত্যু ছাড়া তাদের সখ্য কখনো বিচ্ছিন্ন হয় না। ১৯২৩ সালে আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের (১৮৬৫-১৯৩৯) ‘লিডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান’ কবিতাটি প্রকাশিত হওয়ার পর সাহিত্যের পাঠকরা অবাকবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলেন, প্রকৃতির ইতিহাস আর সাহিত্যের ইতিহাসের স্রোতধারা চিরকাল সমান্তরাল রেখায় অগ্রসর হয় না। এই কবিতায় আমরা রাজহংসকে প্রত্যক্ষ করেছি একজন সফল ও কৌশলী ধর্ষকের ভূমিকায়। ঠিক পঞ্চান্ন বছর পর, সম্প্রতি প্রয়াত কানাডার গল্পকার এলিস মানরো (১৯৩১-২০২৪) এই রাজহংসকেই ধর্ষকের চিত্রকল্প হিসেবে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘ওয়াইল্ড সোয়ান্স’ শিরোনামের শর্ট ফিকশনে। সাহিত্যে চিত্রকল্প হিসেবে রাজহংস পাখিটি অবশ্য অনেক দিন থেকেই ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৯৭১ সালে প্রকাশিত এলিস মানরো লাইভস অব গার্লস অ্যান্ড উইমেন-রচিত টাইটেলের গল্পসংকলনটিকে পর্নোগ্রাফি আখ্যা দিয়ে কানাডার মৌলবাদী খ্রিষ্টানরা নিষিদ্ধ করেছিল ১৯৭৮ সালে। মৌলবাদীদের অভিযোগ, এই গ্রন্থে ব্যভিচারের কাহিনি অশ্লীল ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁর গ্রন্থকে নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে ১৯৭৮ সালের ১৩ জুন ক্লিনটন শহরের সেন্ট্রাল হিউরন সেকেন্ডারি স্কুলে অনুষ্ঠিত একটি জনসভায় মানরো সেদিন বলেছিলেন, ‘কাহিনির চরিত্র নির্মাণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রসঙ্গ হিসেবে পবিত্র বাইবেল থেকে যেসব গল্প (বা চিত্রকল্প) উঠিয়ে নিয়ে আসা হয়, সেই গল্পগুলো সত্য হলেও অশ্লীল মনে হয়। বাইবেল গ্রন্থে বর্ণিত রাজা ডেভিড তাঁর সেনা কর্মকর্তা উরির স্ত্রী বাথসেবার সাথে সঙ্গম করেছেন। বাথসেবার গর্ভে রাজার সন্তান ভ্রƒণস্থ হলে, ব্যভিচারী রাজা পরিকল্পনা করে বাথসেবার স্বামী তথা তাঁর অনুগত উরিকে হত্যা করেন এবং বিধবা বাথসেবাকে বিয়ে করে তাঁর অবৈধভাবে গর্ভস্থ সন্তানের বৈধ পিতা হন।’ এই ঘটনার পঁয়ত্রিশ বছর পর, ২০১৩ সালে, শর্ট ফিকশনের বিষয়, ধারা, কারিগরি কৌশলসহ নানান সূচকের নান্দনিকতা, মান ও মাত্রাবিচারে ছোটগল্প ক্যাটাগরিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন এলিস মানরো।
চেখভধারার চলমান ছোটগল্পের নির্মাণশৈলীতে বিপ্লব ঘটিয়েছেন গল্পকার মানরো। ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক জাগরণকালীন নারীত্ব, নারী-পুরুষের সম্পর্ক, মধ্যবয়সের সংকট, মৃত্যুসহ নানান মানবিক জটিলতার বিষয় ও বিস্ময়গুলোকে অ-জটিল ভাষায় তিনি উদ্ভাসিত করেছেন গল্পের ক্যানভাসে। বুকার বিচারকদের ভাষায় ‘সীমিত পরিসরে তাঁর গল্পগুলো নির্মিত হয়েছে উপন্যাসের গভীরতা, প্রজ্ঞা এবং সূক্ষ্মতা দিয়ে।’ ছোটগল্পের নির্মাণ গবেষণায় মানরোর সফলতা, প্রাপ্তি ও ব্যাপ্তি যুগান্তকারী। মার্গারেট অ্যাটউডের (জন্ম ১৯৩৯) ভাষায়, ‘In Munro’s work, grace abounds, but it is strangely disguised: nothing can be predicted. Emotions erupt. Preconceptions crumble. Surprises proliferate. Astonishments leap out. Malicious acts can have positive consequences. Salvation arrives when least expected, and in peculiar forms.’ অর্থাৎ মানরোর কাহিনিতে বিভূষণ আছে বিপুল, যা আবৃত থাকে বিস্ময়করভাবে। তাঁর গল্পে গতি আছে, যার বেগ ও পথ অনুমান করা দুষ্কর। ফেটে পড়া আবেগের আবহে পাঠকের পাঠকালীন পূর্বধারণাগুলো বারবার ভেঙে যায়। প্রসারিত হয় বিস্ময়। বিমোচিত হয় চমক। পঙ্কিলতাকে অতিক্রম করে প্রস্ফুটিত হয় পদ্ম। ক্ষীণ মাত্রার প্রত্যাশাকে চমকে দিয়ে নির্দিষ্ট চরিত্রের প্রাপ্তি অবস্থান নেয় চরম উচ্চতায়।
মানরোর চরিত্রগুলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, অনঅভিজাত শ্রেণির, যাদের আচমকা দেখা মেলে ট্রেন, শপিংমল, হেয়ারড্রেসিং শপ, স্কুলের সভা বা কারো বাড়িতে যেখানে তাদের মধ্যে বিনিময় হয় স্বাভাবিক কিংবা অযাচিত সংলাপ। এসব সংলাপের আড়াল থেকে জীবন-সংশ্লিষ্ট নানান অর্থ ও গভীর তাৎপর্য নিংড়িয়ে বের করেন এলিস মানরো। এই এলিস মানরো হঠাৎ করে লাফ দিয়ে সাহিত্যের মঞ্চে আবির্ভূত হননি। তিনি নিজেও বেড়ে উঠেছেন কানাডার একটি পশ্চাৎপদ দূরান্ত প্রান্তিক অঞ্চলে
দক্ষিণ-পশ্চিম অন্টারিওর হিউরন কাউন্টিতে। কানাডার চারুকলা বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃৎ চারুশিল্পী গ্রেগ কার্নো (১৯৩৬-১৯৯২) কানাডার চূড়ান্ত দক্ষিণে অবস্থিত অন্টারিও প্রদেশের এই সাউথ-ওয়েস্টার্ন অন্টারিও অঞ্চলটির সংক্ষিপ্ত নাম রেখেছিলেন সোয়েস্টো। সোয়েস্টো নামের এই উপদ্বীপটির উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ অর্থাৎ তিন দিক ঘিরে রয়েছে জর্জিয়ান উপসাগর, হুরন হ্রদ, সেন্ট ক্লেয়ার নদী, লেক সেন্ট ক্লেয়ার, ডেট্রয়েট নদী এবং এরি হ্রদের বিশাল জলরাশি। কার্নো বলতেন, এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মনের জগৎটা গাড় অন্ধকার আর উদ্ভটতায় ঠাসা। এখানে জন্ম নেওয়া কিংবদন্তি সাহিত্যিক ও পণ্ডিতজন। টরন্টো বিশ^বিদ্যালয়ের সাহিত্যের শিক্ষক রবার্টসন ডেভিস (১৯১৩-১৯৯৫) বলতেন, ‘আমার এই অঞ্চলের অন্ধকার জনপথ আমি চিনি।’ ডেভিসের মতো এলিস মানরোও চিনতেন। তিনিও জানতেন, তিনদিকে জলরাশি পরিবেষ্টিত বন্যা-প্রবণ সমতল সোয়েস্টো অঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূমি জুড়ে দৃশ্যমান গমক্ষেতে ঈশ^রের সন্ধান পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, বাইবেলে গম হচ্ছে প্রেম, দয়া, সম্পদ, প্রজননশীলতা ও পরিপক্বতার প্রতীক। মানরো নিজেও বেড়ে উঠেছেন পিছিয়ে থাকা এই গমক্ষেত-প্রভাবিত জনপদে। এই অঞ্চলের সামাজিক কমিউনিটি গড়ে উঠেছে কারখানার শ্রমিক, ফাউন্ড্রি কর্মী, চোরাই মদের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ছিঁচকে চোর, মুচিসহ নিম্নআয়ের বিভিন্ন স্তরের কর্মজীবীদের নিয়ে। মানরো নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তাঁর চৌহদ্দির আর্থিকভাবে অ-সচ্ছল মেয়েদের মনোজগৎ। উন্নত নগরজীবনের
ছোঁয়া-বঞ্চিত মেয়েদের যৌন আকাক্সক্ষার কথা মানরোর মতো করে খুব কম সমকালীন কাহিনিকার ফিকশনের পাতায় অবরুদ্ধ করতে পেরেছেন। তাঁর গল্পের ক্লেদমুক্ত সরল মনের মেয়েরা পুরুষ-পাগল। তারা দরিদ্র, কম শিক্ষিত। প্রেমের ক্ষেত্রে তারা উচ্ছল না হলেও, যৌন আকাঙ্ক্ষায় পরিপূর্ণ। নিজের শরীর নিয়ে কৌতূহল থাকলেও, শরীরকে তারা বিকোয় না। একধরনের উদ্ভটতায় পরিপূর্ণ এই চরিত্রগুলো। পুরুষসঙ্গীকে পাওয়ার জন্য তারা জীবনের অন্য সব কিছু উজাড় করে দিতে পারে। নিজেদের তারা উত্তরণ চায়, পালটাতে চায়। ভাটির অঞ্চল ছেড়ে তারা উজানের দিকে পালাতে চায়।
এলিস মানরোর প্রকাশিত পনেরোটি গল্পসম্ভারে সংযোজিত একশ চল্লিশটি কাহিনির মধ্যে হু ডু ইউ থিংক ইউ আর (১৯৭৮) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘ওয়াইল্ড সোয়ান্স’ (বন্য রাজহংস) মানরো-সাহিত্যে একটি অনন্য, চমকপ্রদ এবং ব্যতিক্রমী সংযোজন। মানবিক সম্পর্কের জটিলতার মধ্যে ব্যক্তিস্বাধীনতার অনুসন্ধানে কাব্যিক সুষমা আর জাদুকরী মহিমা দিয়ে সৃজিত এই উপাখ্যানের নান্দনিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন হাজারো বিদগ্ধজন। এই কাহিনিতে মানরো অনায়াসে ‘খেলাখেলি’ করেছেন পাঠকদের নিয়ে। মেতে উঠেছেন ‘রোজ’ নামের এক কিশোরীর চরিত্রের গতিপথ ও গতিবেগ নির্ণয় করার খেলায়, যা পাঠ করে বিনোদিত হয়েছেন চমকিত পাঠক। গল্পকার এখানে রাজহংসকে চিত্রকল্প হিসেবে ব্যবহার করে কাহিনির গভীরতা ও তাৎপর্যের উদ্ভাস ছড়িয়েছেন, অনুরণিত করেছেন পাঠকের হৃদয়কে। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে ব্যক্তির বাসনা পূরণে একটি সফল চিত্রকল্প হিসেবে উত্তীর্ণ হয়েছে মানরোর রাজহংস।
হ্যানরাট্টি ওয়াইল্ড সোয়ান্স গল্পে সোয়েস্টো অঞ্চলের একটি কাল্পনিক শহরতলি। এই কাহিনিতে আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্যে বেড়ে ওঠা মেধাবী কিশোরী মেয়েটির নাম রোজ। পরিবারে বিমাতা ফ্লো ছাড়া কেউ নেই। সম্প্রতি স্কুলে অনুষ্ঠিত রচনা প্রতিযোগিতায় প্রাইজমানি হিসেবে সে দশ ডলার অর্জন করেছে। শহরের আর দশটি মেয়ের মতো রোজও নিজেকে পালটাতে চায়। একজন পুরুষসঙ্গীর কল্পনায় বিভোর রোজ নিজেকে আকর্ষণীয় করে সাজাতে চায়। ফিকশনের কথকের ভাষায় ‘She had a considerable longing to be somebodz She had a considerable longing to be somebodzÕs object. Pounded, pleasured, reduced, exhausted’s object. Pounded, pleasured, reduced, exhausted.’ আগামীর পুরুষসঙ্গীর কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করে সাজিয়ে তোলার জন্যে সম্বল হিসেবে তাঁর হাতে আছে মাত্র পুরস্কারের দশ ডলার। প্রয়োজন একটি নীল আঙ্গোরা সোয়েটার, একটি চুড়ির ব্রেসলেট, কিছু হেয়ার রিমুভার এবং কয়েকটি হিপ রিডিউসার কুশন। প্রাপ্তিস্থান টরন্টো শহর। স্বপ্নপূরণের সংকল্প নিয়ে কিশোরী রোজ একদিন চেপে বসলো ট্রেনে। হ্যানরাট্টি স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার পর থেকে টরন্টোগামী ট্রেনটি ক্রমশ এগিয়ে যায়; গ্রাম থেকে শহর, ভাটি থেকে উজান। উত্তরণ আর রূপান্তরের নেশায় এগিয়ে যায় স্বপ্নবাজ রোজ। পরের স্টেশনে পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন যাত্রী তার পাশের আসনে বসেই অযাচিতভাবে আলাপ শুরু করে দেন। ইউনাইটেড চার্চের পাদ্রি হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, তিনি সবসময় ইউনিফর্মে থাকেন না। অপরিচিত কিশোরীর কাছে তিনি বসন্তের আবহাওয়া নিয়েও কথা বলেন। সম্প্রতি গাড়ি চালাবার সময় যে একঝাঁক দুর্দান্ত বন্য রাজহাঁসকে উড়ে যেতে দেখেছিলেন, তিনি তাও জানিয়ে দিলেন নিরুৎসাহী শ্রোতাকে। গির্জার পাদ্রি হিসেবে পরিচয় প্রদানকারী বক্তা বলতে থাকেন, ‘কী মনোরম দেখতে সেই রাজহংসের দল। রাজহংসকে এই প্রথম আমি দেখলাম। এইগুলো সম্ভবত বসন্তকালীন মাইগ্রেটরি বার্ড। মনে হলো নর্থবাউন্ড। চোখ জুড়িয়ে গেলো আমার।’ সৌজন্যমূলক দুয়েকটা উত্তর ছাড়া অপর প্রান্ত থেকে তেমন কোনো সাড়া না পেয়ে পাদ্রি তার সংবাদপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন এবং এক পর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়লেন অথবা ঘুমিয়ে পড়ার ভান করলেন। খবরের কাগজটি হঠাৎ পাঠকের কোলের ওপর পড়ে যায় এবং কাগজের কোনাটি রোজের হাতে ধরে থাকা তার গায়ের কোটকে স্পর্শ করে। একটু পরে রোজের মনে হলো, একটি পুরুষালি হাত তার পায়ে এসে ঠেকলো। চোখ বন্ধ করে থাকা পাদ্রির দিকে তাকিয়ে দেখলো রোজ; পাদ্রির হাত সংবাদপত্র দিয়ে ঢাকা। তার মনে হলো, একটি হাত বুঝি তার পায়ের ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছে। ফাঁকা কাগজে একটি কলম বুঝি কিছু বর্ণমালাকে অবমুক্তি দিতে দিতে এগিয়ে চলেছে। মুহূর্তের মধ্যে রোজের চোখের সামনে এসে দাঁড়ালো তাদের স্কুলের ফরাসি ভাষার সেই অ-ফরাসি শিক্ষক, যার হাতখানা হাতিয়ে বেড়ায় মেয়েদের অন্তশ্চর্মস্তর। এবার পাঠকের কাছে বিষয়টি রহস্যময়। রোজের পায়ের ওপর আসলেই কি কোনো হাত ছিলো? খবরের কাগজের কোনা না তো? রোজের দুই পায়ের মাঝখানে কি কোনো ফাঁকা ছিলো? গাল্পিকের কথন :
Was there a pressure, or was there not? … Her legs had been, and remained, tightly closed. It was. It was a hand. It was a hand’s pressure. … Her legs were never going to open. But they were. They were.
কিশোরী মনে মনে নিজের কাছেই প্রশ্ন রাখলো, ‘এটি যদি হাত হয়, তাহলে কী হতে পারে?’ অতঃপর রোজের মনে হলো, সংবাদপত্রের আগা কিংবা ডগা নয় পাদ্রির হাত তার পায়ে স্পর্শ করছে এবং ক্রমশ ঊরুগামী হচ্ছে। সামাজিক লজ্জার কারণে রোজ ‘প্লিজ ডোন্ট’ বলে প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েও চুপ করে থাকে। একটি ‘অশরীরী’ হাতের অনুসন্ধানকর্মে আরেকটি স্বপ্নবিলাসী শরীর উত্তেজনায় দুর্বল হয়ে আসে। প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধ নয়; শরীরী আকাঙ্ক্ষা পূরণে কৌতূহলী রোজ কল্পনার ডানা মেলে উড়তে থাকে মুক্ত আকাশে, পাদ্রির বর্ণিত দুর্দান্ত বন্য রাজহংসের মতো। ট্রেন গন্তব্যে এসে থেমে গেলে নকল পাদ্রী উড়ে গিয়ে হারিয়ে যায় রাজহংসের আকাশে। ‘কল্পনার রাজহংস’ পড়ে থাকে রোজের আসনে।
আমরা এখন পাঠকদের নিয়ে যাবো উইলিয়াম বাটলার ইয়েটসের ‘লিডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান’ কবিতায়। এই কবিতায় গ্রিক পুরাণে বর্ণিত দেবরাজ জিউস রাজহংসের ছদ্মবেশে এসে ধর্ষণ করেছিলেন গ্রিসের স্পার্টা রাজ্যের রানী লিডাকে। রানী লিডা একদিন দাঁড়ানো অবস্থায় হঠাৎ টাল হারিয়ে ফেলেন। আচমকা উড়ন্ত একটি রাজহংস তাঁকে বেসামাল করে দেয়। বিশাল আকারের পাখা মেলে হাঁসটি জড়িয়ে ধরে লিডাকে। হাঁস তার জালের মতো বোনা পা দিয়ে আবেশ ছড়াতে থাকে রানীর দুই ঊরুতে; লম্বা গলার আগায় লাগানো ঠোঁটটা এগিয়ে দেয় রানির গ্রীবা জুড়ে। হাঁসের পালকময় বুকটি একশ আশি ডিগ্রি কোণে চেপে বসে আক্রান্ত লিডার অসহায় স্তনের ’পরে। দ্রুত পালকশোভিত বিশেষ ‘অঙ্গ’টি গন্তব্য খুঁজতে গেলে লিডা তাঁর নিজের ঊরুর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারান। আতঙ্কিত রানীর সিদ্ধান্তহীন দশটি আঙুল ধর্ষকের বিশেষ ‘অঙ্গ’টিকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেনি। বেপরোয়া সাদা পাখার নিচে অভিগৃহীত হয়ে তিনি বরং কান পেতে শুনলেন এক লুটেরা হৃৎপিণ্ডের উন্মাতাল স্পন্দন, যার লোলুপতার অন্তিম পর্বে বেজে ওঠে শিহরিত সংগীত রানীর নিতম্ব জুড়ে। রাজহংস উড়ে যায় মুহূর্তেই, অবসন্ন রানী পড়ে থাকেন লিডাতেই।
আইরিশ কবি ইয়েটসের কবিতায় দেবরাজ জিউস লিডাকে ধর্ষণ করেছে রাজহংসের ছদ্মবেশে। কাব্যিক প্রশ্রয় পেয়ে গ্রিক পুরাণের কাহিনিটি ইংরেজি সাহিত্যের অন্তর্গত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, মানরোর গল্পে রোজ কল্পনা করেছেন, একটি ‘রাজহংস’ গির্জার পাদ্রির ছদ্মবেশে তাকে যৌন হয়রানি করেছে। দুটি ঘটনার প্রেক্ষাপট ও কাল ভিন্ন হলেও দুই ভিকটিমের প্রতিক্রিয়া অভিন্ন – তারা প্রতিরোধ করেনি, প্রতিবাদও করেনি; উভয় ক্ষেত্রে ভিক্টর বিনা বাধায় কার্য সম্পাদন করেছে। সনেটের দ্বিতীয় স্তবকে এসে ইয়েটস নিজেই প্রশ্ন করেছেন।
How can those terrified vague fingers push
The feathered glory from her loosening thighs?
And how can body, laid in that white rush,
But feel the strange heart beating where it lies?
অর্থাৎ,
শিথিল ঊরুতে অন্তর্গত হয় পালকশোভিত লালিত অঙ্গ;
প্রতিরোধে বিমূড় হয় আতঙ্কিত অসংসক্ত আঙুলগুলি কীভাবে শায়িত শরীরে প্রতিরোধ করে প্রকুপিত শ্বেত পালক,
শুধু শুনতে পায় বুকের ভেতর এক হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন।
লিডা এবং রোজ দুজনই ‘প্রতিরোধে বিমূঢ়’ হয়ে নিজেদের সমর্পণ করেছেন ইচ্ছাপূরণের বেদিতে। এটি কোনো অভিযোগ নয়, পর্যবেক্ষণ। ঊরুর শিথিলতা ও প্রতিরোধে বিমূঢ়তার প্রসঙ্গটি কাকতালীয়ভাবে উঠে এসেছে ইয়েটস ও মানরোর সাহিত্যকর্মে। ‘লিডা অ্যান্ড দ্য সোয়ান’ কবিতায় লিডাকে জাপটে ধরা রাজহংসের দুটি বিশাল পাখাকে ‘ওয়াইল্ড সোয়ান্স’ গল্পে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে রোজের পায়ের ওপর ছড়িয়ে রাখা গির্জার নকল পাদ্রির সংবাদপত্রের ডগা দিয়ে। ইয়েটস তাঁর কবিতার কাহিনি ধার করেছেন গ্রিক পুরাণের ভাণ্ডার থেকে। জিউস (রাজহংসের ছদ্মবেশে) কর্তৃক লিডার ধর্ষণ কাহিনির চিত্রকল্প দিয়ে কবি ইয়েটস ‘প্রতিরোধে বিমূঢ়’ আইরিশ জাতির ওপর ব্রিটিশ সরকারের সাতশো বছরের জুলুম-নির্যাতনের ইতিহাসকে রূপায়িত করেছেন ১৯২৩ সালে। আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামের তখন চলছিলো চূড়ান্তকাল। অন্যদিকে কানাডার গল্পকার এলিস মানরো সত্তরের দশকের নারী-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নারীর আকাঙ্ক্ষা পূরণের অধিকার ও স্বাধীনতাকে তিনি প্রক্ষেপণ করেছেন ১৯৭৮ সালে তাঁর শর্ট ফিকশনে রোজের সঙ্গে চার্চের মিনিস্টারের যৌন আচরণের কল্পিত আখ্যান নির্মাণ করে। কল্পনার অস্ত্র প্রয়োগ করে, প্রকৃতপক্ষে, মানরো একপ্রান্তে পাঠকদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছেন, অন্যপ্রান্তে মৌলবাদীদের বোকা বানিয়ে তাঁদের অতীতের পর্নোগ্রাফির অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছেন। হংস চরিত্র ব্যবহার করে ইয়েটস নিজেকে রক্ষা করেছেন অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকারের রোষানল থেকে।
রাজহংসকে চিত্রকল্প বানিয়ে রচিত ইয়েটসের আরো একটি কবিতা আছে ‘ওয়াইল্ড সোয়ান্স অ্যাট কুল’ কবিতায় কবি নিজেকে প্রকাশ করেছেন ‘রাজহংস’ চরিত্রে। তাঁর মেন্টর লেডি গ্রেগরির কুল পার্কের বাড়িতে প্রথমবার বেড়াতে গিয়ে তাঁদের পুকুরে তিনি ৫৯টি রাজহংস দেখেছিলেন। ১৯ বছর পরে দ্বিতীয়বার গিয়েও, তখনো অবিবাহিত ইয়েটস সেই পুকুরে ৫৯টি রাজহংসকেই দেখেছেন। তাঁর দৃষ্টিতে এই পুকুরে ২৯ জোড়া (৫৮টি) হংস-হংসী আছে। কালের পরিক্রমণ হলেও, নির্দিষ্ট একটি হংসের হংসী-গমন হয়নি। ব্যক্তিগত জীবনে প্রেয়সী মডগণকে নিয়ে ঘর বাঁধতে না পারার বেদনাকে তিনি এইভাবে একটি হংসীবিহীন রাজহংসের চিত্রকল্প দিয়ে আড়াল করেছেন। ‘ওয়াইল্ড সোয়ান্স’ গল্পে নকল মিনিস্টারের একটি অশরীরী হাতকে কল্পনা করে রূপান্তর পিয়াসী কিশোরী রোজ তার শরীরী আকাক্সক্ষা পূরণ করলেও, মানরোর কিশোরী হ্যানরাট্টির একটি ‘৫৯তম রাজহংস’ হলো ‘ওয়াইল্ড সোয়ান্স অ্যাট হ্যানরাট্টি’।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.