ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়

তারিক মনজুর

শিশু সহজাতভাবেই মুখের ভাষা আয়ত্ত করে ফেলে; অর্থাৎ কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই মাতৃভাষায় কথা বলতে শিখে যায়। কিন্তু ভাষার পঠন ও লিখন দক্ষতা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে ঘটে। এই পঠন ও লিখন দক্ষতা যত দ্রুত তৈরি করা সম্ভব হয়, তত দ্রুত শিক্ষার্থীকে কার্যকরভাবে অন্য বিষয়ের পাঠের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায়। বিশ্বজুড়ে এটি বড় চ্যালেঞ্জ – কীভাবে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ের স্কুল শিক্ষার্থীদের দ্রুততার সঙ্গে পড়তে ও লিখতে শেখানো যায়। 

ভাষা-শিক্ষণের একটি প্রক্রিয়ায় প্রথমে বর্ণ শেখানো হয়; এরপর শব্দ ও বাক্যের পর্যায়ে যাওয়া হয়। একে বলে আরোহী পদ্ধতি। বিপরীত পদ্ধতিকে বলে অবরোহী পদ্ধতি – যেখানে আগে বাক্য শোনানো ও পড়ানো হয়; পরবর্তী ধাপে শব্দ ও বর্ণ শেখানো হয়। অবরোহী পদ্ধতিতে শিশু বেশ তাড়াতাড়ি পড়তে শিখে যায়; কিন্তু তার পঠনে প্রচুর ভুল হতে থাকে। অবরোহী পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা লক্ষ করে এখন অধিকাংশ ভাষা-শিক্ষণ প্রক্রিয়া এগোয় মিশ্র পদ্ধতিতে।  

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নবীন বিদ্যার্থীদের বাংলা ভাষা পড়তে ও লিখতে শেখার উদ্দেশ্য নিয়ে বর্ণপরিচয় প্রণয়ন করেছেন। তিনি এগিয়েছেন আরোহী পদ্ধতিতে। পুস্তকের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগে অপেক্ষাকৃত সহজ থেকে কঠিন পাঠের দিকে গিয়েছেন। এই লেখায় ভাষা-শিক্ষণের উপকরণ হিসেবে বর্ণপরিচয়ের রচনা-কৌশল ও বৈশিষ্ট্য খুঁজে দেখা হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে কিছু মন্তব্য ও মূল্যায়নও করা হয়েছে – শিশুর ভাষাশিক্ষার নতুন পুস্তক প্রণয়নে যেগুলো বিবেচনায় নেওয়া যায়। 

এক

বাংলা বর্ণমালা সংস্কারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদানকে গুরুত্বের সঙ্গে স্বীকার করে নেওয়া হয়। বর্ণমালায় ড়, ঢ়, য় সংযোজনের কৃতিত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। স্বরবর্ণ থেকে দীর্ঘ ঋ এবং দীর্ঘ ৯ – এ দুটি বর্ণকে বাদ দেওয়ার কাজটিও তিনি করেছেন। অনুস্বার, বিসর্গকে স্বরবর্ণের তালিকা থেকে সরিয়ে ব্যঞ্জনবর্ণে নিয়ে গিয়েছেন। চন্দ্রবিন্দুকে আলাদা বর্ণের মর্যাদা দিয়েছেন। যুক্তাক্ষর ক্ষ বাদ দিয়েছেন বর্ণমালা থেকে। এগুলোর পেছনে তাঁর যেসব যুক্তি ছিল, সেগুলো সংক্ষেপে লিখেছেন বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের ভূমিকা (‘বিজ্ঞাপন’) অংশে : 

বহুকাল অবধি, বর্ণমালা ষোল স্বর ও চৌত্রিশ ব্যঞ্জন এই পঞ্চাশ অক্ষরে পরিগণিত ছিল। কিন্তু বাঙ্গালা ভাষায় দীর্ঘ ঋ„কার ও দীর্ঘ ৯কারের প্রয়োগ নাই; এই নিমিত্ত ঐ দুই বর্ণ পরিত্যক্ত হইয়াছে। আর, সবিশেষ অনুধাবন করিয়া দেখিলে, অনুস্বর ও বিসর্গ স্বরবর্ণ মধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না; এজন্য, ঐ দুই বর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণের মধ্যে পঠিত হইয়াছে। আর, চন্দ্রবিন্দুকে ব্যঞ্জনবর্ণস্থলে এক স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া গণনা করা গিয়াছে।

ড, ঢ, য এই তিন ব্যঞ্জনবর্ণ, পদের মধ্যে অথবা পদের অন্তে থাকিলে, ড়, ঢ়, য় হয়; ইহারা অভিন্ন বর্ণ বলিয়া পরিগৃহীত হইয়া থাকে। কিন্তু যখন আকার ও উচ্চারণ উভয়ের পরস্পর ভেদ আছে, তখন উহাদিগকে স্বতন্ত্র বর্ণ বলিয়া উল্লেখ করাই উচিত; এই নিমিত্ত, উহারাও স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনবর্ণ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। ক ও ষ মিলিয়া ক্ষ হয়, সুতরাং উহা সংযুক্ত বর্ণ; এজন্য, অসংযুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ গণনাস্থলে পরিত্যক্ত হইয়াছে।

বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের শুরুতে বিদ্যাসাগর স্বরবর্ণের তালিকা উপস্থাপন করেছেন। প্রতিটি বর্ণের জন্য একটি করে শব্দ দিয়েছেন: অ – অজগর, আ – আনারস, ই – ইঁদুর, ঈ – ঈগল, উ – উট, ঊ – ঊষা, ঋ – ঋষি, ৯ – লিচু, এ – একতারা, ঐ – ঐরাবত, ও – ওল, ঔ – ঔষধ। বর্ণের সঙ্গে শব্দ যোজনের উদ্দেশ্য থাকে যাতে শিশু পরিচিত শব্দের মাধ্যমে বর্ণের যথাযথ উচ্চারণ শিখতে পারে। কিন্তু পুস্তকপ্রণেতা এ-ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন বলে মনে হয় না। যেমন, ইঁদুর শব্দের শুরুতে চন্দ্রবিন্দু থাকায় ই-এর প্রমিত উচ্চারণে অনুনাসিকতার সৃষ্টি হয়। ফলে ‘ইঁদুর’ছেড়ে তিনি চন্দ্রবিন্দুবিহীন অন্য শব্দে যেতে পারতেন। আবার, একতারা শব্দের উচ্চারণ থেকে এ-ধ্বনি পাওয়া যায় না; পাওয়া যায় এ্যা ধ্বনি। তবে এটাও ঠিক, ‘এ’ বর্ণ দিয়ে একতারার বিকল্প ব্যবহারযোগ্য শব্দ বাংলায় নেই। আবার দীর্ঘ ঋ এবং দীর্ঘ ৯-এর প্রয়োগ বাংলা ভাষায় নেই। এই যুক্তিতে বিদ্যাসাগর বর্ণ দুটিকে বাদ দিয়েছেন। একই যুক্তিতে ৯-কেও বাদ দিতে পারতেন। কারণ লিচু লেখার জন্য ল-এর সাথে ই-কার যথেষ্ট।   

অ বর্ণ দিয়ে অজগর শব্দ না দেওয়ার পক্ষে হাল আমলে অনেককে বলতে শুনেছি। তাঁদের যুক্তি, অজগর শব্দটি চারটি বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত দীর্ঘ শব্দ। তাছাড়া এটি শিশুদের মনে ভীতি তৈরি করতে পারে। কিন্তু বাংলা অ-এর অবিকৃত উচ্চারণ দিয়ে শিশুপাঠ্যে ব্যবহার-উপযোগী শব্দ কেউ খুঁজে বের করতে পারেননি। অলি, অসি এসব শব্দ শিশুর পরিচিত জগতের শব্দ নয়; আর এসব শব্দে অ বর্ণের উচ্চারণ ও-এর মতো। আবার অজ, অতসি, অনল এসব শব্দে অ-এর উচ্চারণ অবিকৃত হলেও শব্দগুলো শিশুর পরিচিত জগতের নয়। তাই যেকোনো বিচারে অ বর্ণের জন্য অজগর সবচেয়ে ভালো শব্দ। বিদ্যাসাগর দীর্ঘ ঈ দিয়ে ঈগল এবং দীর্ঘ ঊ দিয়ে ঊষা লিখেছেন। কিন্তু বানানের নিয়ম পরিবর্তিত হওয়ার কারণে দীর্ঘ ঈ এবং দীর্ঘ ঊ দিয়ে উপযোগী শব্দ পাওয়া যায় না। ঐ আর ঔ দিয়েও ভালো শব্দ নেই। হাতিকে নিশ্চয় শিশুরা ‘ঐরাবত’ হিসেবে চেনে না, কিংবা ওষুধকে ‘ঔষধ’ বলে না। আবার ঙ, ঞ, ণ, ড়, ঢ়, য়, ৎ, ং, ঃ ইত্যাদি বর্ণ দিয়ে শুরু হওয়া বাংলা কোনো শব্দ নেই। ফলে, পরিচিত শব্দের মাধ্যমে বর্ণের উচ্চারণ শেখানো, কিংবা বর্ণ দিয়ে শব্দ শেখানোর প্রক্রিয়া থেকে আমাদের সরে আসা উচিত। 

শিশু বর্ণকে ছবি আকারে দেখতে পায়। ফলে বাংলা ভাষায় দ্রুত পঠনযোগ্যতা তৈরির জন্য কিংবা পঠন-দ্রুতি আনার জন্য ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে কারচিহ্ন যোগ করে ক, কা, কি, কী, কু, কূ, কৃ, কে, কৈ, কো, কৌ – এভাবে পড়ানো ও লেখানো যায়। এভাবে অন্য ব্যঞ্জনের সাথেও আ-কার, ই-কার যোগ করে শেখালে শিশু কারচিহ্নসহ বর্ণটিকে একটি ছবি হিসেবে দেখবে এবং দ্রুত পড়তে পারবে। 

বর্ণপরিচয় পুস্তকে স্বরবর্ণের পরে ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই বর্ণগুলো ঠিকমতো শিশু শনাক্ত করতে পারে কি না, এর পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। বর্ণ শনাক্তের পরীক্ষা নেওয়া যায়; তবে বর্ণের ধারাবাহিকতা বা অনুক্রমের পরীক্ষা না নেওয়া উচিত। বিদ্যাসাগর ঠিক কাজটিই করেছেন; তিনি বর্ণ-শনাক্তের পরীক্ষা নিয়েছেন, বর্ণক্রমের পরীক্ষা নেননি। লেখা পড়তে শেখার জন্য বর্ণ চেনা দরকার, এর অনুক্রম মোটেও জরুরি নয়। যেমন, ইংরেজিসহ বিশ্বের অধিকাংশ প্রধান ভাষার বর্ণমালায় বর্ণগুলো খুবই অবিন্যস্তভাবে রয়েছে – স্বর ও ব্যঞ্জন পৃথক করা নেই। অধিকাংশ ভাষার ব্যঞ্জনবর্ণ বাংলা বর্ণমালার ব্যঞ্জনের মতো ধ্বনিগতভাবে সাজানো নেই। বর্ণের এই অবিন্যাস ভাষা শেখার পথে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না।   

বর্ণ শেখানোর পরে বিদ্যাসাগর অগ্রসর হয়েছেন বর্ণ যোজন করে শব্দ শেখানোর দিকে। এক্ষেত্রে প্রথমে কারচিহ্ন ছাড়া শব্দ তৈরি করেছেন; যেমন : ঘট, নখ, ফল, ইতর, মরণ, সরল ইত্যাদি। প্রথমে দুই বর্ণের সংযোজনে এবং পরে তিন বর্ণের সংযোজনে শব্দ তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়া, নামশব্দ না গুণবাচক শব্দ – এরকম চিন্তা থেকে শব্দ নির্বাচন করেননি। এমনকি শিশুর পরিচিত-অপরিচিত সব ধরনের শব্দ নির্দ্বিধায় ব্যবহার করেছেন। 

কারচিহ্নহীন শব্দ-তালিকার পর আ-কার, ই-কার এভাবে একে একে দশটি কারচিহ্ন যোগে শব্দ দিয়েছেন। প্রচুর অপ্রচলিত শব্দ আছে; যেমন : নিধি, সূপ, অপূপ, অনৃত, কৈতব, ধৈবত, মোদক, কৌল, শৌচ ইত্যাদি। এখানে দারুণ কাজ করেছেন বিদ্যাসাগর – তিনি আ-কার যোগে শব্দ-তালিকায় অন্য কারচিহ্নের প্রয়োগ করেননি, ই-কার যোগে তৈরি শব্দের তালিকায় ই-কার ভিন্ন অন্য কারচিহ্নের প্রয়োগ করেননি। এভাবে ঔ-কার পর্যন্ত শেষ করার পর মিশ্র কারচিহ্নের প্রয়োগে শব্দের তালিকা দিয়েছেন। মিশ্র উদাহরণের তিনি দুটি তালিকা দিয়েছেন। প্রথম উদাহরণে রেখেছেন দুই বা তিন বর্ণের শব্দ, যেমন : সাধু, কৃপা, নীরোগ, দয়ালু ইত্যাদি; দ্বিতীয় উদাহরণে রেখেছেন চার বা পাঁচ বর্ণের শব্দ, যেমন : অধিকার, কৌতূহল, অনুমোদন, পারিতোষিক ইত্যাদি।

কারচিহ্নযোগে শব্দ শেষ হওয়ার পর অনুস্বার, বিসর্গ ও চন্দ্রবিন্দু যোগে গঠিত শব্দের তিনটি ভিন্ন তালিকা দিয়েছেন। আরেকটি কাজ তিনি করেছেন, যেটি আজকের দিনে আর প্রয়োজন হয় না। হ্রস্ব উ-কার, দীর্ঘ ঊ-কার, ঋ-কারের চিহ্ন ক্ষেত্রবিশেষে পালটিয়ে যায়। গু, রু, শু, হু, রূ, হৃ ইত্যাদি আকার বৈচিত্র্যকে বিবেচনায় নিয়ে তিনি আরো কয়েকটি নমুনা প্রদর্শন করেছেন। একই কারচিহ্নের ভিন্ন ভিন্ন চেহারা শিশুর পঠনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, এই বিবেচনা বিদ্যাসাগরের ছিল। তাই কারচিহ্নের সাধারণ পাঠে তিনি ভিন্ন চেহারার কারচিহ্ন দিয়ে কোনো শব্দ দেননি। পরে আলাদা করে ‘বর্ণ বিশেষে উ, ঊ, ঋ যোগের বিশেষ’ শিরোনাম দিয়ে উদাহরণ দিয়েছেন।

স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ ও কারচিহ্ন শেখানোর কাজ শেষ হলে গদ্য পড়ার কাজ শুরু করেছেন। পাঠ ১, ২, ৩ … এভাবে ২১ পর্যন্ত পাঠ আছে। ১ থেকে ১৩ পর্যন্ত বাক্য-ভিত্তিক পাঠ এবং ১৪ থেকে ২০ পর্যন্ত অনুচ্ছেদ-ভিত্তিক পাঠ দেওয়া হয়েছে। আর পাঠ ২১-এ এক থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যাগুলোকে অংকে ও কথায় লেখা শেখানো হয়েছে।

গদ্য পাঠের ১ থেকে ৮ পর্যন্ত দুই শব্দের প্রয়োগ আছে। এসব প্রয়োগে শব্দগুচ্ছ বা বাক্যের বর্গ আছে; কর্তা ও ক্রিয়ার অন্বয় শেখানো হয়েছে; নির্দেশক, প্রশ্নবোধক, অনুজ্ঞাসূচক ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের বাক্যের প্রয়োগ আছে; এমনকি ক্রিয়ার ভিন্ন ভিন্ন কালের বাক্যিক প্রয়োগও আছে। পাঠ ৯ থেকে দুইয়ের অধিক শব্দ দিয়ে বাক্য তৈরি করা হয়েছে। পাঠ ১৪ থেকে ১৮ পর্যন্ত একটি অনুচ্ছেদ। কিন্তু ১৯ ও ২০ সংখ্যক পাঠে একাধিক অনুচ্ছেদ যোগে তৈরি দীর্ঘ রচনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মূলত জোর দিয়েছেন শিশুর ভাষা-শিক্ষার ওপর। কিন্তু এই সূত্রে তিনি নীতিশিক্ষাও দিতে চেয়েছেন। যেমন, পাঠ ১২-তে আছে :

কখনও মিছা কথা কহিও না।

ঘরে গিয়া উৎপাত করিও না।

কাহারও সহিত ঝগড়া করিও না।

রোদের সময় দৌড়াদৌড়ি করিও না।

কাহাকেও গালি দিও না।

পড়িবার সময় গোল করিও না।

সারা দিন খেলা করিও না।

পাঠ ১৪ ও ১৫-র বক্তব্য প্রায় একরকম : ভোরে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুতে হবে, এরপর কাপড় পরে বই নিয়ে স্কুলে যেতে হবে। এর পরের তিনটি পাঠে তিনটি চরিত্র আছে : রাম, নবীন ও গিরিশ। রাম পড়ার সময় গোল করেছিল; নবীন বাড়ি যাওয়ার পথে ভুবনকে গালি দিয়েছিল; গিরিশ কোনো কারণ ছাড়াই কাল পড়তে আসেনি – এরকম অসদাচরণ বা ভুল থেকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে পাঠ ১৬, ১৭ ও ১৮-তে। পাঠ ১৯-এ গোপালকে নিয়ে এবং পাঠ ২০-এ রাখালকে নিয়ে দীর্ঘ বর্ণনা আছে। এ দুজনের মধ্যে গোপাল সুবোধ বালক – বাবা-মা যা বলেন, সে তাই করে। তাই সবাই গোপালকে ভালোবাসে। আবার গোপাল যেমন সুবোধ রাখাল তেমন নয়; সে বাবা-মার কথা শোনে না। তাই রাখালকে কেউ ভালোবাসে না। বিদ্যাসাগর তাই এ দুটি পাঠের সিদ্ধান্ত টেনেছেন যথাক্রমে এভাবে : ‘সকল বালকেরই গোপালের মত হওয়া উচিত’ এবং ‘যে রাখালের মত হইবে, সে লেখা পড়া শিখিতে পারিবে না’। 

দুই

বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগে সংযুক্ত বর্ণ শেখানো হয়েছে। এরপর ছোট-বড় অনুচ্ছেদে সেগুলোর প্রয়োগ দেখানো হয়েছে। পুস্তকের দ্বিতীয় ভাগের ভূমিকা (বিজ্ঞাপন) অংশে বিদ্যাসাগর লিখেছেন :

বালকদিগের সংযুক্তবর্ণপরিচয় এই পুস্তকের উদ্দেশ্য। সংযুক্তবর্ণে উদাহরণস্থলে যে সকল শব্দ আছে, শিক্ষক মহাশয়েরা বালকদিগকে উহাদের বর্ণবিভাগ মাত্র শিখাইবেন, অর্থ শিখাইবার নিমিত্ত প্রয়াস পাইবেন না। বর্ণবিভাগের সঙ্গে অর্থ শিখাইতে গেলে, গুরু শিষ্য উভয় পক্ষেরই বিলক্ষণ কষ্ট হইবেক, এবং শিক্ষাবিষয়েও আনুষঙ্গিক অনেক দোষ ঘটিবেক। 

এটি শুরু থেকেই লক্ষ করা গিয়েছে, দ্রুত পড়তে শেখানো বিদ্যাসাগরের প্রধান উদ্দেশ্য। বাংলা বর্ণগুলো কার বা ফলার আকার যখন পায়, তখন সেগুলো চেহারা পালটিয়ে ফেলে। ফলে, বেশি বেশি শব্দে এগুলোর প্রয়োগ দেখিয়েছেন তিনি। বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগে অসংযুক্ত বর্ণ চেনানো হয়েছে এবং প্রাসঙ্গিক পাঠেও কোনো সংযুক্ত বর্ণ নেই। বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয় ভাগে প্রচুর সংযুক্ত বর্ণ এবং সেই অনুযায়ী পাঠ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। 

দ্বিতীয় ভাগে বিদ্যাসাগর একে একে য-ফলা, র-ফলা, ল-ফলা, ব-ফলা, ণ-ফলা, ন-ফলা, ম-ফলা শিখিয়েছেন। প্রয়োজন মতো তিনি পাঠও তৈরি করে দিয়েছেন। এর পিছনে তাঁর যুক্তি : ‘ক্রমাগত শব্দের উচ্চারণ ও বর্ণবিভাগ শিক্ষা করিতে গেলে, অতিশয় নীরস বোধ হইবেক ও বিরক্তি জন্মিবেক, এজন্য মধ্যে মধ্যে এক একটি পাঠ দেওয়া গিয়াছে।’ ফলাচিহ্নের আকৃতি ও উচ্চারণগত বৈচিত্র্য ঠিকভাবে শেখানোর জন্য বিদ্যাসাগরীয় পদ্ধতি এখনো পর্যন্ত বাংলা ভাষায় সবচেয়ে কার্যকর উপায়। ফলাচিহ্নের পাঠ শেষ করে ‘র’ বর্ণের আরেকটি চেহারা রেফ-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।  

এরপর দুই বর্ণের সংযোগে তৈরি হওয়া ৫৭টি যুক্তাক্ষরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন; যেমন : ক ক ক্ক – চিক্কণ, ধিক্কার, কুক্কুট; জ ঞ জ্ঞ – বিজ্ঞ, আজ্ঞা, অজ্ঞান, অজ্ঞেয়; শ চ শ্চ – নিশ্চয়, পশ্চাৎ, পশ্চিম ইত্যাদি। দুই বর্ণের যুক্তাক্ষর শেষ হলে তিন বর্ণের সংযোগে তৈরি ১৯টি যুক্তাক্ষর চিনিয়েছেন; যেমন: ক ষ ম ক্ষ্ম – সূক্ষ্ম, যক্ষ্মা, লক্ষ্মী; ষ ট র ষ্ট্র – উষ্ট্র, রাষ্ট্র ইত্যাদি। বাংলা যুক্তাক্ষরের সংখ্যা চারশোর বেশি; কিন্তু বিদ্যাসাগর অধিক ব্যবহৃত যুক্তাক্ষরকে এনেছেন।

বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগে মোট দশটি গদ্য পাঠ রয়েছে। প্রথম দুটি পাঠে বিভিন্ন নীতিবাক্য শিক্ষা দিয়েছেন। দুটি পাঠেই নম্বর-সংযুক্ত ছয়টি করে অনুচ্ছেদ আছে। একেকটি অনুচ্ছেদ তিন বা চার বাক্যের; প্রতিটি অনুচ্ছেদে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। বক্তব্য বিষয় এরকম :

প্রথম পাঠ :

১. কখনও কাউকে কুবাক্য না বলা।

২. বাল্যকালে মন দিয়ে লেখাপড়া করা।

৩. সদা সত্য কথা বলা।

৪. দিনের পড়া দিনে শেষ করা।

৫. পিতামাতার অবাধ্য না হওয়া।

৬. সুখে থাকতে চাইলে লেখাপড়া শেখা।

দ্বিতীয় পাঠ :

১. শ্রম না করলে লেখাপড়া হয় না।

২. যে চুরি করে, তাকে সবাই ঘৃণা করে।

৩. লেখাপড়া শিখলে সবার প্রিয় হওয়া  যায়।

৪. কখনও কারও সাথে কলহ না করা।

৫. গভীর মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করা।

৬. অভদ্র বালকের সঙ্গে না মেশা। 

দেখা যাচ্ছে, বারোটি বিষয়ের মধ্যে লেখাপড়া সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ আছে ছয়টি। আর দ্বিতীয় পাঠের শেষ অনুচ্ছেদে অভদ্র বালকের পরিচয় দেওয়া হয়েছে এভাবে : ‘যে চুরি করে, মিথ্যা কথা কয়, ঝগড়া করে, গালাগালি দেয়, মারামারি করে, তাহাকে অভদ্র বলে।’ পড়ালেখার পাশাপাশি সদাচরণও আয়ত্ত করতে বলেছেন পুস্তকপ্রণেতা।

তৃতীয় পাঠের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘সুশীল বালক’। আদর্শ বালকের কোন কোন গুণ থাকা দরকার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই পাঠে তা তুলে ধরেছেন। সুশীল বালকের পরিচয় আছে ১০টি অনুচ্ছেদে :

অনুচ্ছেদ ১ : যে পিতামাতার আদেশ ঠিকমতো পালন করে।

অনুচ্ছেদ ২ : যে মন দিয়ে লেখাপড়া করে।

অনুচ্ছেদ ৩ : যে সহোদর ভাইবোনের প্রতি সহমর্মী।

অনুচ্ছেদ ৪ : যে মিথ্যা কথা বলে না।

অনুচ্ছেদ ৫ : যে অন্যায় কাজ করে না।

অনুচ্ছেদ ৬ : যে কখনও কটুবাক্য বলে না।

অনুচ্ছেদ ৭ : যে কখনও চুরি করে না।

অনুচ্ছেদ ৮ : যে অলসতায় দিন কাটায় না।

অনুচ্ছেদ ৯ : যে খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মেশে না।

অনুচ্ছেদ ১০ : যে বিদ্যালয়ে শিক্ষকের আদেশ পালন করে।

চতুর্থ পাঠের শিরোনাম ‘যাদব’। এই দুরন্ত বালকটিকে উপস্থাপনের ভঙ্গি শিশু-পাঠ্যের উপযোগী হয়নি। যাদবের বয়স আট বছর। তার বাবা তাকে প্রতিদিন স্কুলে পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু যাদব স্কুলে না গিয়ে ওই সময়টুকুতে পথে পথে খেলা করে বেড়াত। একদিন ভুবন নামে একটি ছেলেকে স্কুলে যেতে দেখে যাদব বলে, ‘ভুবন! আজ তুমি পাঠশালায় যাইও না। এস দুজনে মিলিয়া খেলা করি। পাঠশালার ছুটি হইলে, যখন সকলে বাড়ি যাইবে, আমরাও সেই সময়ে বাড়ি যাইব।’ যাদবের প্রলোভনে না ভুলে ভুবন স্কুলে চলে যায়। আরেকদিন অভয় নামে আরেকটি ছেলেকে স্কুলে যেতে দেখে যাদব একই রকম কথা বলে। অভয় রাজি না হওয়ায় তার হাত ধরে টানাটানি করতে থাকে যাদব। এরপর স্কুলে গিয়ে অভয় গুরু মহাশয়কে যাদবের কথা বলে দেয়। গুরু মহাশয় তাঁর ‘যথোচিত কর্তব্য’ মতো যাদবের পিতার কাছে অভিযোগ পাঠান। শেষ অনুচ্ছেদে বিদ্যাসাগর লিখেছেন : ‘যাদবের পিতা শুনিয়া অতিশয় ক্রোধ করিলেন, তাহাকে অনেক ধমকাইলেন, বই কাগজ কলম যা কিছু দিয়াছিলেন, সব কাড়িয়া লইলেন। সেই অবধি, তিনি যাদবকে ভালবাসিতেন না, কাছে আসিতে দিতেন না, সম্মুখে আসিলে দূর দূর করিয়া তাড়াইয়া দিতেন।’ সমাজের আদরবঞ্চিত এই দুরন্ত বালকের ভবিষ্যৎ কী হয়েছিল, জানার উপায় নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছে সে ভয়ংকর উদাহরণ হয়ে থাকবে।

পঞ্চম পাঠের শিরোনাম ‘নবীন’। নবীনের বয়স নয় বছর; সেও যাদবের মতো দুরন্ত। নবীন সারাদিন পথে পথে খেলা করে বেড়ায়, লেখাপড়ায় মন নেই। গুরু মহাশয় তাকে ধমকাতেন; ধমকের ভয়ে সে স্কুলে যাওয়াও বন্ধ করে দেয়। বিদ্যাসাগর দেখিয়েছেন তিনজন বালককে নবীন পভ্রষ্ট করতে চেয়েছে। তবে কেউ নবীনের প্রলোভনে পা দেয়নি; বরং তারা যুক্তি দেখিয়েছে হেলায় খেলায় সময় নষ্ট করলে এর পরিণাম ভালো হয় না। একসময় নবীন তার ভুল বুঝতে পারে :

এইরূপে, ক্রমে ক্রমে তিন জনের কথা শুনিয়া, নবীন মনে মনে ভাবিতে লাগিল সকলেই কাজের সময় কাজ করে। এক জনও, কাজে অবহেলা করিয়া, সারাদিন খেলিয়া বেড়ায় না। কেবল আমিই সারাদিন খেলা করিয়া বেড়াই। সকলেই বলিল, কাজের সময় কাজ না করিয়া, খেলিয়া বেড়াইলে, চিরকাল দুঃখ পাইতে হয়। এজন্য, তারা সারাদিন খেলা করিয়া বেড়ায় না। আমি যদি, লেখাপড়ার সময়, লেখাপড়া না করিয়া, কেবল খেলিয়া বেড়াই, তা হলে, আমি চিরকাল দুঃখ পাইব। বাবা জানিতে পারিলে, আর আমায় ভালবাসিবেন না, মারিবেন, গালাগালি দিবেন, কখন কিছু চাহিলে, দিবেন না। আমি আর লেখাপড়ায় অবহেলা করিব না। আজ অবধি, লেখাপড়ার সময় লেখাপড়া করিব।

শেষ অনুচ্ছেদে পুস্তকপ্রণেতা জানাচ্ছেন, নবীনের পরিবর্তনের ফলে সবাই তার প্রশংসা করত। আর লেখাপড়ায় মনোযোগী হওয়াতে ক্রমে ক্রমে সে অনেক বিদ্যা অর্জন করতে পেরেছিল।

আত্ম-উন্নয়নের শিক্ষা শিশুরা পেতে পারে নবীনের কাছ থেকে। তবে, এ বিদ্যাসাগরের পুস্তক প্রণয়নের দেড়শো বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বাংলাদেশের শিশুরা খেলার মাঠ হারিয়েছে, আর পড়াশোনার জন্য পেয়েছে সীমাহীন জায়গা – স্কুলঘর, নিজের বাড়ি আর কোচিং সেন্টার! 

ষষ্ঠ পাঠে আছে ‘মাধবে’র কথা। মাধবের বয়স দশ। চতুর্থ পাঠের যাদবের মতো মাধবকেও খারাপ ছেলে হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যাদবের পরিণতি কী হয়েছিল, লেখা নেই। কিন্তু মাধবের করুণ পরিণতির বর্ণনা আছে এই পাঠের শেষ অনুচ্ছেদে। মাধবের দোষ ছিল – সে স্কুলে গিয়ে অন্য বালকদের কলম, কাগজ ইত্যাদি চুরি করত। কয়েকবার ধরা পড়েছে সে; অন্য স্কুলে বদলিও করা হয়েছে তাকে; কিন্তু চুরির অভ্যাস থেকে সে বের হতে পারেনি। মাধব একধরনের মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিল। কারণ, ধরা পড়ার পর সে বলেছিল, ‘আমি চুরি করি নাই, ভুলিয়া লইয়াছিলাম।’ ধরা যাক, শিক্ষকের শাস্তির ভয়ে সে মিথ্যা বলেছে। কিন্তু ‘আমি আর কখনও চুরি করিব না’ এই জাতীয় বাক্য বারংবার বলা সত্ত্বেও সে নিজেকে শোধরাতে পারেনি। তার জীবনে ট্র্যাজেডি নেমে আসে যখন তার বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। মাধবের কাহিনিকার জানাচ্ছেন, বাল্যকাল থেকে চুরির অভ্যাস করে মাধব আর ওই অভ্যাস ত্যাগ করতে পারেনি। খেতে না পেয়ে, পেটের জ্বালায় ব্যাকুল হয়ে সে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াত। তবু তার জন্য কারো মায়া হতো না।

সপ্তম পাঠের শিরোনাম ‘রাম’। রামের মধ্যে আবার কোনো ধরনের খারাপ দোষ নেই। সে পিতামাতার বাধ্য ছেলে, ভাইবোনদের প্রতি আন্তরিক, সমবয়সীদের প্রিয়ভাজন, লেখাপড়ায় যত্নশীল, মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকে এবং কারো মনে কষ্ট দেয় না। একজন বালকের এত বেশি সুবোধ বা সুশীল হওয়াও স্বাভাবিক নয়!

অষ্টম পাঠের শিরোনাম ‘পিতা মাতা’। পিতামাতার গুরুত্ব ও মর্যাদা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে এই পাঠে। আর খুবই সাধারণভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে, ‘তোমরা কদাচ পিতা মাতার অবাধ্য হইবে না।’

নবম পাঠ ‘সুরেন্দ্র’কে নিয়ে। এই পাঠের শুরু কোনোরকম ভূমিকা ছাড়াই :

সুরেন্দ্র! আমার কাছে এস। তোমায় কিছু জিজ্ঞাসা করিব। এই কথা শুনিয়া, সুরেন্দ্র তৎক্ষণাৎ শিক্ষকের নিকট উপস্থিত হইল। তিনি বলিলেন, আমি শুনিলাম …

সুরেন্দ্রর দোষ – সে পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে একটি পাখিকে লক্ষ করে ঢিল ছুড়ছিল। সেই ঢিল যদি পাখির গায়ে লাগত, তবে পাখি কষ্ট পেত – শিক্ষক এমনটাই বোঝাতে চেষ্টা করেন। তবে কাহিনির শুরুর মতো মধ্য অংশও বেশ নাটকীয়। সুরেন্দ্রর ছোড়া ঢিল কোনো পাখির গায়ে না লাগলেও লেগেছে নিকটে দাঁড়ানো একটি বালকের গায়ে। এমনকি সেই ঢিল বালকের মাথায় লেগে রক্তপাত হয়েছে। শিক্ষক বলেন, চোখে লাগলে ছেলেটি এ জন্মের মতো অন্ধ হয়ে যেত। সব শুনে সুরেন্দ্র তার ভুল বুঝতে পারে এবং ভবিষ্যতে আর এরকম না করার প্রতিশ্রুতি দেয়। 

দশম পাঠের শিরোনাম ‘চুরি করা কদাচ উচিত নয়’। এখানে যে-কাহিনি দেওয়া হয়েছে, আজকের দিনের পুস্তকপ্রণেতাগণ তা পড়লে শিউরে উঠবেন। এই পাঠের প্রধান চরিত্র ভুবন। শৈশবে সে পিতামাতাকে হারায়। এরপর মাসির কাছে বড় হতে থাকে। স্কুল থেকে একবার ভুবন একজনের বই চুরি করে নিয়ে আসে। কিন্তু মাসি কোনো শাসন করেনি; ফলে ভুবনের সাহস দিনে দিনে বাড়তে থাকে। গল্পের পরিণতিতে আছে, বড় হয়ে ভুবন বড় চোরে পরিণত হয়। বিচারক তাকে ফাঁসির আদেশ দেন। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভুবন তার মাসির সঙ্গে দেখা করানোর অনুরোধ করে। ভুবনের মাসিকে ফাঁসির মঞ্চের কাছে আনা হলে মাসি ভুবনকে দেখে উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে থাকে। ভুবন মাসিকে বলে, ‘এখন আর কাঁদিলে কি হইবে।’ এরপর মাসির কানে কানে একটি কথা বলার জন্য কাছে ডাক দেয়। মাসি কাছে গেলে ভুবন মাসির কান কামড়ে কেটে নেয়। আর ভর্ৎসনা করে বলে, মাসি যদি আগে থেকেই তাকে সাবধান করত, তাহলে তার জীবনে এই পরিণতি হতো না।

পাঠগুলোর বিষয় থেকে সমকালীন সমস্যাও উপলব্ধি করা যায়। চুরির ব্যাপারটিকে একাধিক পাঠে আনা হয়েছে। পাঠগুলোয় লেখাপড়ার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। বালকদের বিদ্যালয়মুখী করার জন্য পুস্তকপ্রণেতার আন্তরিক চেষ্টা আছে। তবে বিদ্যাসাগর কোনো পাঠে মেয়ে বা নারী চরিত্রের উদাহরণ টানেননি; অথচ তিনি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের পেছনে উদ্যোগী ছিলেন। 

তিন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগে যতিচিহ্ন হিসেবে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন ব্যবহার করেছেন; দ্বিতীয় ভাগে এগুলোর পাশাপাশি আশ্চর্যচিহ্নও আছে; কিন্তু কোনো ভাগেই তিনি জিজ্ঞাসাচিহ্ন ব্যবহার করেননি। ভাষা-শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় আরোহী পদ্ধতিকে তিনি উপযুক্ত মনে করেছেন – বর্ণ থেকে শব্দের পর্যায়ে গিয়েছেন; এরপর পাঠে শব্দগুচ্ছ বা বর্গ, ছোট বাক্য, বড় বাক্য এবং অনুচ্ছেদ এনেছেন; শেষে একাধিক অনুচ্ছেদ সহযোগে দীর্ঘ পাঠ তৈরি করেছেন। বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের সব শব্দই যুক্তাক্ষরবিহীন; অন্যদিকে দ্বিতীয় ভাগের মূল লক্ষ্য যুক্তাক্ষরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। বাংলাভাষী শিশুর মাতৃভাষা শেখার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হিসেবে বিদ্যাসাগরীয় পদ্ধতিকে মেনে নিতে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্য দুই পদ্ধতির মিশ্র রূপ ব্যবহার করেছেন সহজপাঠেসহজপাঠবর্ণপরিচয় দুটি পুস্তকেরই উদ্দেশ্য ভাষা-শিক্ষণ; তবে রবীন্দ্রনাথের পুস্তকে ছন্দের দোলা প্রধান সহায়ক উপাদান হয়েছে, আর বিদ্যাসাগরে নীতিশিক্ষাকে ভাষা-শিক্ষণের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।