ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বেতালপঞ্চবিংশতি : ফিরে দেখা

লোকমান কবীর

বেতালপঞ্চবিংশতি (১৮৪৭) ঈশ্বরচন্দ্র শর্মা ওরফে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-৯১) প্রথম প্রকাশিত গদ্যসাহিত্য। হিন্দি গ্রন্থ বৈতালপচ্চিসী অবলম্বনে এটি রচিত হলেও বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশে গ্রন্থটির গুরুত্ব অপরিসীম। এই পুস্তকের প্রথম সংস্করণে লেখক হিসেবে বিদ্যাসাগরের নাম লেখা ছিল না। এটি রচিত হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যবইয়ের সংকট দূর করার উদ্দেশ্যে। কেননা এর পূর্বে ওই কলেজে পাঠ্যবই থাকলেও দূরান্বয় ও দুর্বোধ্যতা সেসব বইকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। দ্বিতীয় সংস্করণের বিজ্ঞাপনে বিদ্যাসাগরের ভাষ্য থেকে আমরা জানতে পারি লেখকের নাম ও গ্রন্থ রচনার প্রেক্ষাপট :

কালেজ অব্ ফোর্ট উইলিয়ম নামক বিদ্যালয়ে, তত্রত্য ছাত্রগণের পাঠার্থে, বাংলা ভাষায় হিতোপদেশ নামে যে পুস্তক নির্দ্দিষ্ট ছিল, তাহার রচনা অতি কদর্য। বিশেষতঃ, কোনও কোনও অংশ এরূপ দুরূহ ও অসংলগ্ন যে কোনও ক্রমে অর্থবোধক ও তাৎপর্য্যগ্রহ হইয়া উঠে না। তৎপরিবর্ত্তে পুস্তকান্তর প্রচলিত করা উচিত ও আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, উক্ত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহামতি শ্রীযুত মেজর জি. টি. মার্শল মহোদয় কোনও নূতন পুস্তক প্রস্তুত করিতে আদেশ দেন। তদনুসারে আমি বৈতালপচীসীনামক প্রসিদ্ধ হিন্দি পুস্তক অবলম্বন করিয়া এই গ্রন্থ লিখিয়াছিলাম।১

এর আগে অবশ্য বাসুদেব-চরিত নামে একটি পুস্তক তিনি রচনা করেছিলেন। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন না পাওয়ায় তা ছাপা হয়নি। হয়তো ধর্মীয় বিষয়াশ্রিত বলেই পুস্তকটি ছাপা হয়নি।২ এ-কারণে বেতালপঞ্চবিংশতির মাধ্যমেই বিদ্যাসাগরের গদ্যশৈলী ও গদ্যসৌন্দর্য সম্পর্কে পাঠক প্রথম পরিচিত হন। উপক্রমণিকা ছাড়া গ্রন্থটিতে পঁচিশটি পর্ব আছে। এ-পর্বগুলিতে রয়েছে পঁচিশটি উপাখ্যান। গল্পগুলি বেতাল নামে এক অতিপ্রাকৃত শক্তি রাজা বিক্রমাদিত্যকে শোনায়। বেতাল প্রতিটি কাহিনিশেষে বিক্রমাদিত্যকে একটি করে প্রশ্ন করে। বেতালের শর্ত হচ্ছে, গল্পগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে না পারলে রাজাকে প্রাণ হারাতে হবে। বুদ্ধিদীপ্ত সম্রাট নিজ প্রজ্ঞাকে কাজে লাগিয়ে সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয় এবং গল্পশেষে পুরস্কৃত হয়। ধারাবাহিকভাবে পঁচিশটি উপাখ্যান বলা হলেও আধুনিক শিল্পপ্রকরণ যেমন ছোটগল্প কিংবা উপন্যাসের সঙ্গে এর সম্পর্ক দূরবর্তী। বরং লোকসাহিত্যের কাল্পনিক আখ্যানের সঙ্গে এর মিল লক্ষণীয়। উপাখ্যানগুলোর বিভিন্ন চরিত্র – যেমন, রাজা-রানি-রাজপুত্র-রাজকন্যা-মন্ত্রী-মন্ত্রীপুত্র-ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণপত্নী-সওদাগর-রাক্ষস-গন্ধর্ব-সাপ-চোর প্রমুখ যে-জীবন যাপন করে, সে-জীবনের সঙ্গে আমাদের প্রাত্যহিক বাস্তবতার মিল খুব সামান্যই। প্রাত্যহিক জীবনের সূক্ষ্ম জীবনাচরণ ও মনস্তত্ত্বের বাহক না হওয়া সত্ত্বেও নীতিশিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে এই চরিত্রগুলোর ভূমিকা রয়েছে। কাল্পনিক চরিত্র হয়েও এরা সাধারণ মানুষের প্রেম-প্রার্থনা-কাম-লোভ-অসূয়া-বাৎসল্য ইত্যাদি দ্বারা আলোড়িত। ফলে এসব উপাখ্যানের মধ্যে মানবজীবনের অনুপুঙ্খ বর্ণনা না থাকলেও মানব-জীবন-দর্শনের কথা উঠে এসেছে নানা ইঙ্গিতে। তাই পাঠ্যপুস্তক রচনার উদ্দেশ্য প্রধান হলেও এই গ্রন্থের সাহিত্যরসকেও অস্বীকার করা যায় না।

বেতালপঞ্চবিংশতির দশম সংস্করণের বিজ্ঞাপন থেকে আমরা জানতে পারি, যোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর শ্বশুর মদনমোহন তর্কালঙ্কারের যে জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছেন, সেখানে তর্কালঙ্কারকে বেতালপঞ্চবিংশতির সহরচয়িতা হিসেবে দাবি করেছিলেন। তাঁর দাবি অনুযায়ী :

বিদ্যাসাগর প্রণীত বেতালপঞ্চবিংশতিতে অনেক নূতন ভাব ও অনেক সুমধুর বাক্য তর্কালঙ্কার দ্বারা অন্তর্নিবেশিত হইয়াছে। ইহা তর্কালঙ্কার দ্বারা এত দূর সংশোধিত ও পরিমার্জিত হইয়াছিল যে বোমাণ্ট ও ফ্লেচরের লিখিত গ্রন্থগুলির ন্যায় ইহা উভয় বন্ধুর রচিত বলিলেও বলা যাইতে পারে।৩

বিদ্যাসাগর উপর্যুক্ত তথ্যকে অসত্য উল্লেখ করে বলেন :

আমি বেতালপঞ্চবিংশতি লিখিয়া মুদ্রিত করিবার পূর্ব্বে, শ্রীযুত গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ও মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে শুনাইয়াছিলাম। তাঁহাদিগকে শুনাইবার অভিপ্রায় এই যে, কোনও স্থল অসঙ্গত বা অসংলগ্ন বোধ হইলে, তাঁহারা স্ব স্ব অভিপ্রায় ব্যক্ত করিবেন; তদনুসারে, আমি সেই সেই স্থল পরিবর্ত্তিত করিব। আমার বিলক্ষণ স্মরণ আছে, কোনও কোনও উপাখ্যানে একটি স্থলও তাঁহাদের অসঙ্গত বা অসংলগ্ন বোধ হয় নাই, সুতরাং, সেই উপখ্যানের কোনও স্থলেই কোনও প্রকার পরিবর্ত্ত করিবার আবশ্যকতা ঘটে নাই। আর, যে সকল উপাখ্যানে তাঁহারা তদ্রূপ অভিপ্রায় প্রকাশ করিয়াছিলেন, সেই সেই উপখ্যানে, স্থানে স্থানে, দুই একটি শব্দ মাত্র পরিবর্ত্তিত হইয়াছিল। বিদ্যারত্ন ও তর্কালঙ্কার ইহার অতিরিক্ত আর কিছুই করেন নাই।৪

বেতালপঞ্চবিংশতি গ্রন্থে দশম সংস্করণের বিজ্ঞাপনে গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্নের একটি চিঠি ছাপা হয়। সেই পত্রের বক্তব্য মূলত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বক্তব্যের পক্ষেই জোরালো সমর্থন। সুতরাং বেতালপঞ্চবিংশতি যে লেখকের একক রচনা এ-বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই।

বৈতালপচ্চিসী অবলম্বনে রচিত হলেও বেতালপঞ্চবিংশতির ভাষানির্মাণে বিদ্যাসাগর সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। হিন্দি গ্রন্থের অন্ধ-অনুকরণের পরিবর্তে তিনি অনেক স্থানেই স্বকীয় শৈলীর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন এ-গ্রন্থে। সমগ্র গ্রন্থটিতে উপর্যুপরি ব্যবহার করেছেন অনুপ্রাস। আদ্যনুপ্রাস, মধ্যানুপ্রাস, অন্তানুপ্রাস, এমনকি বৃত্তানুপ্রাস ব্যবহারেও তিনি দুর্দান্ত প্রতাপের পরিচয় দিয়েছেন গ্রন্থটিতে :

চূড়াপরে, দেবস্বামী নামে, এক ব্রাহ্মণ বাস করিতেন। তিনি রূপে রতিপতি, বিদ্যায় বৃহস্পতি, সম্পদে ধনপতি ছিলেন। কিয়ৎ দিন পরে, দেবস্বামী, লাবণ্যবতী নামে এক গুণবতী ব্রাহ্মণতনয়ার পাণিগ্রহণ করিলেন। ঐ কন্যা রূপলাবণ্যে ভুবন-বিখ্যাত ছিল। উভয়ে প্রণয়ে কালযাপন করিতে লাগিলেন।

একদা বিপ্রদম্পতি, গ্রীষ্মের প্রাদুর্ভাব প্রযুক্ত, অট্টালিকার উপরিভাগে শয়ন করিয়া নিদ্রা যাইতেছিলেন। সেই সময়ে, এক গন্ধর্ব বিমানে আরোহণ পূর্ব্বক, আকাশপথে ভ্রমণ করিতেছিল। দৈবযোগে, বিপ্রকামিনীর উপর দৃষ্টিপাত হওয়াতে, সে তদীয় অলৌকিক রূপলাবণ্যদর্শনে মোহিত হইল; এবং বিমান কিঞ্চিৎ অবতীর্ণ করিয়া, নিদ্রান্বিতা লাবণ্যবতীকে লইয়া পলায়ন করিল।৫

উপর্যুক্ত উদ্ধৃতিতে অনুপ্রাসের উপর্যুপরি ঝংকার খুব সহজেই আমাদের চোখে পড়বে। বাক্যগুলি লেখক গঠন করেছেন মেপে মেপে। শব্দচয়নে শিল্পবোধ, বাক্যগঠনে পরিমিতিবোধ, বিদ্যাসাগরের এই ভাষাকে করেছে প্রাঞ্জল ও পরিচ্ছন্ন। দীর্ঘ সমাসবদ্ধ শব্দের পরিবর্তে সহজবোধ্য শব্দের ব্যবহার গদ্যকে করেছে নমনীয় ও গতিশীল। বিশেষণের অনবদ্য ব্যবহারেও তিনি অর্জন করেছেন বিশিষ্টতা। প্রয়োজনীয় বিশেষণের ব্যবহার এ-ভাষাকে করেছে ওজস্বী এবং সুখপাঠ্য। অনুপ্রাসের সঙ্গে খেলতে খেলতে কখনো কখনো লেখকের যমক সৃষ্টির প্রচেষ্টাও  লক্ষণীয় :

ক. বারাণসী নগরীতে, প্রতাপমুকুট নামে, এক প্রবলপ্রতাপ নরপতি ছিলেন। তাঁহার মহাদেবী নামে প্রেয়সী মহিষী ও বজ্রমুকুট নামে হৃদয়নন্দন নন্দন ছিল।৬

খ. ধারা নগরে, মহাবল নামে, মহাবল পরাক্রান্ত নরপতি ছিলেন।৭

গ. এক দিন, দীনদাস নামে তন্তুবায়, কোনও কার্য্য উপলক্ষ্যে, নিজ বন্ধুর সহিত, রাজধানীতে গমন করিতেছিল।৮

বেতালপঞ্চবিংশতির ভাষা সমসাময়িককালে কতখানি সুখদ ছিল তা বোঝা যাবে তাঁর পূর্ববর্তী গদ্যকারদের সঙ্গে তুলনায়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যপুস্তক রচয়িতাদের অন্যতম গোলকনাথ শর্মার হিতোপদেশের গদ্য থেকে বোঝা যায় এসব গদ্য কত নীরস ও নির্জীব ছিল :

অপরঞ্চ কাকের তাল ফেলার ন্যায়(;) অগ্রে নিধি দেখিয়া পায়(,) তাহা ঈশ্বরদত্ত বটে কিন্তু পুরুষার্থ অপেক্ষা করে(।) যদি কোন কাহার অগ্রে পাকা তাল কাকে ফেলায় সে দেখিয়া যদি না যায় তবে কখন পাবে না; অতএব যে পিতা তাহার পুত্রকে না পড়ায় সে শত্রু এবং সে পুত্র সভার মধ্যে কেমন দীপ্তি হয়(,) যেমন হংসের মধ্যে বক।৯

ওই কলেজের পণ্ডিতদের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের গদ্য তুলনামূলকভাবে উৎকৃষ্ট হলেও সংস্কৃতভাবাপন্ন সাধুভাষার প্রয়োগ ও তৎসম শব্দাধিক্য তাঁর গদ্যকেও সুললিত করতে পারেনি। এছাড়া তখন পর্যন্ত যতিচিহ্নের সার্থক প্রয়োগও তাঁরা শুরু করতে পারেননি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের পর রামমোহন রায়ের গদ্যে বাক্যের অন্বয় অনেকাংশে রক্ষিত হলেও তিনি সাহিত্যিক গদ্য-রচনার কোনো চেষ্টা করেননি। তাঁর গদ্য মূলত সমাজসংস্কারের প্রয়োজনে তর্ক-বিতর্ক, ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও মীমাংসামূলক। ফলে বাক্যের শেষে পূর্ণ যতির ব্যবহার করেও তিনি গদ্যকে প্রাঞ্জল ও প্রকৃষ্ট করে তুলতে পারেননি। সুকুমার সেনের ভাষায়, ‘রামমোহনের গদ্য রচনারীতি তাঁহার সমসাময়িকদিগের রচনারীতি অপেক্ষা জটিল, এবং দুর্ব্বোধ ছিল।’১০

বেতালপঞ্চবিংশতির মাধ্যমে বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে দুর্বোধ্যতা থেকে মুক্ত করলেন। এই গ্রন্থের উপাখ্যানগুলো বলতে গিয়ে লেখক বাংলা গদ্যে প্রথম সার্থকভাবে বিরামচিহ্নের প্রবর্তন ঘটালেন, ফলে বাক্যের মধ্যে পাঠক প্রয়োজনীয় বিরতি ও তালের সন্ধান পেল। কর্কশ গদ্যের স্থানে সুললিত সুখকর গদ্যের অনুভূতি সঞ্চারিত হলো বাঙালি পাঠকের মনে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গদ্যে দেখতে পেয়েছেন ‘এক অনতিলক্ষ্য ছন্দঃস্রোত’। প্রথম সংস্করণে দীর্ঘ সমাসবদ্ধ শব্দ ব্যবহার করলেও পরবর্তী সংস্করণগুলিতে সমাসবদ্ধ বৃহৎ শব্দকে কমিয়ে তিনি ব্যবহার করলেন সংক্ষিপ্ত শব্দ। মূলত বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রথম পরিপুষ্ট বীজ বিদ্যাসাগরের বেতালপঞ্চবিংশতির মাধ্যমেই প্রথম রোপিত হলো। সাধুভাষায় গ্রন্থটি রচিত হলেও পরিচিত শব্দচয়ন এবং যতিচিহ্নময় সংক্ষিপ্ত বাক্যগঠনের কারণে এ-গদ্য পড়তে কাউকে হোঁচট খেতে হয় না। পুনরাবৃত্তি ও একঘেয়েমি দূর করার জন্য এ-গ্রন্থে তিনি প্রয়োগ করেছেন একই শব্দের বিভিন্ন প্রতিশব্দ। যেমন সম্রাট শব্দের প্রতিশব্দ রূপে ব্যবহৃত হয়েছে নৃপতি, ভূপতি, নরপতি, মহারাজ, রাজা, ভূপাল ইত্যাদি। যৌনকর্মীর প্রতিশব্দরূপে ব্যবহার করেছেন বারবনিতা, বারনারী, বারযোষিৎ, বারঙ্গনা প্রভৃতি শব্দ। ফলে তাঁর ভাষায় পুনরুক্তির পরিবর্তে যুক্ত হয়েছে লালিত্য ও সুষমা। এসব কারণে বাংলা গদ্যে বিদ্যাসাগরের অবদান ও সৃজনশীলতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন :

বিদ্যাসাগর বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্বে বাংলায় গদ্যসাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল, কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথমে বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন। ভাষা যে কেবল ভাবের একটা আধারমাত্র নহে, তাহার মধ্যে যেন-তেন-প্রকারেণ কতকগুলা বক্তব্য  বিষয় পুরিয়া দিলেই যে কর্তব্যসমাপন হয় না, বিদ্যাসাগর দৃষ্টান্ত দ্বারা তাহাই প্রমাণ করিয়াছিলেন। তিনি দেখাইয়াছিলেন যে, যতটুকু বক্তব্য, তাহা সরল করিয়া, সুন্দর করিয়া এবং সুশৃঙ্খল করিয়া ব্যক্ত করিতে হইবে। আজিকার দিনে এ কাজটিকে তেমন বৃহৎ বলিয়া মনে হইবে না, কিন্তু সমাজবন্ধন যেমন মনুষ্যত্ববিকাশের পক্ষে অত্যাবশ্যক তেমনি ভাষাকে কলাবন্ধনের দ্বারা সুন্দররূপে সংযমিত না করিলে সে ভাষা হইতে কদাচ প্রকৃত সাহিত্যের উদ্ভব হইতে পারে না। […]

বাংলাভাষাকে পূর্বপ্রচলিত অনাবশ্যক সমাসাড়ম্বরভার হইতে মুক্ত করিয়া, তাহার পদগুলির মধ্যে অংশযোজনার সুনিয়ম স্থাপন করিয়া, বিদ্যাসাগর যে বাংলা গদ্যকে কেবলমাত্র সর্বপ্রকার-ব্যবহার-যোগ্য করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন তাহা নহে, তিনি তাহাকে শোভন করিবার জন্যও সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন।১১

বিদ্যাসাগরের সমগ্র সাহিত্যকৃতি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপর্যুক্ত মন্তব্য করলেও শুধু বেতালপঞ্চবিংশতির ক্ষেত্রেও কবিগুরুর এই উক্তি প্রাসঙ্গিক। পাঠ্যপুস্তকের অভাব মেটানোর তাগিদে সৃষ্ট হলেও গ্রন্থটি বাংলা গদ্যের ঊষর যুগে সাহিত্যের উর্বরক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছে – পথ দেখিয়েছে পরবর্তী সাহিত্যিকদের। বেতালপঞ্চবিংশতিতে সৃজনশীল বিদ্যাসাগরের উন্মেষ হয়েছিল বলেই শকুন্তলা হয়ে সমাজসংস্কারের প্রয়োজনে সৃষ্ট প্রবন্ধগুলোতে বিকশিত বিদ্যাসাগরকে পেয়েছি আমরা। তাই ঐতিহাসিকভাবেই বাংলা গদ্যের ইতিহাসে বেতালপঞ্চবিংশতি গুরুত্বপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত থাকবে।

তথ্যসূত্র

১. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিদ্যাসাগর-রচনাসম্ভার, প্রমথনাথ বিশী-সম্পাদিত, সপ্তম মুদ্রণ, ১৩৬৪, মিত্র ও ঘোষ, কলিকাতা, পৃ ৭।

২. ঋষি দাস, বিদ্যাসাগর, অশোক প্রকাশন, কলিকাতা, ১৯৭১, পৃ ৩০।

৩. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বিদ্যাসাগর-রচনাসম্ভার, পূর্বোক্ত, পৃ ৮।

৪. প্রাগুক্ত, পৃ ৮।

৫. প্রাগুক্ত, পৃ ১৬৭।

৬. প্রাগুক্ত, পৃ ১২৬।

৭. প্রাগুক্ত, পৃ ১৫২।

৮. প্রাগুক্ত, পৃ ১৫৩।

৯. উদ্ধৃত, সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য, রঞ্জন প্রকাশালয়, কলিকাতা-১৩৪১, পৃ ২৫।

১০. সুকুমার সেন, পূর্বোক্ত, পৃ ৩৬। ১১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘বিদ্যাসাগরচরিত’, চারিত্রপূজা, রবীন্দ্ররচনাবলী, একাদশ খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার, কলিকাতা, ১৩৬৮, পৃ ৩৩১।