উজানগাঁওয়ের অমরনাথ

স্যার?

সকালে হাসপাতালের ফোন দেখেই বাবুলনাথ রায়ের বুকটা কেঁপে ওঠে। কোনো দুঃসংবাদ? অবশ্য রাতে বাবা অমরনাথ রায়কে ভালোই দেখে এসেছে। অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাবুলনাথ। প্যান্ট-শার্ট পরা শেষ। টাইটা বাঁধার জন্য স্ত্রী পাপিয়ার সামনে মাত্র দাঁড়িয়েছে, পকেটে রাখা মোবাইল বেজে ওঠে। পাপিয়াকে অপেক্ষা করতে বলে বাবুলনাথ মোবাইল হাতে নেয়। হাসপাতালের সিনিয়র সিস্টার অমৃতা আহমেদের ফোন দেখেই শরীরটা কেমন ঝিম মারে। এই সিস্টারের ফোন মানেই একটা দুঃসংবাদ। গত দেড় মাস ধরে সোনার বাংলা প্রাইভেট হাসপাতালের সঙ্গে দিনরাত এক করে ফেলেছে বাবুলনাথ রায়।

কী হলো? মোবাইলের দিকে তাকিয়ে কেন? পাপিয়ার প্রশ্ন।

হাসপাতালের ফোন।

গ্রহণ করো, জরুরি কোনো বার্তা থাকতে পারে বাবা সম্পর্কে।

হ্যালো? স্ত্রী পাপিয়া মণ্ডলের অনুপ্রেরণায় ফোন কানে নেয় বাবুলনাথ।

স্যার, দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, আপনার বাবা এই পনেরো মিনিট আগে দেহত্যাগ করেছেন। অমৃতা আহমেদের গলায় সাজানো নির্লিপ্ত শোক।

ঠিক এই সংবাদটাই পাবে বাবুলনাথ, অমৃতা আহমেদের ফোন দেখেই মনে হয়েছিল। বাবা অমরনাথের বয়স আশি বছর। হালকা-পাতলা গড়নের মানুষ। চোখে দেখতেন ভালোভাবে। কিন্তু শরীরে নানা ধরনের ব্যাধি বাসা বেঁধেছিল। ডায়াবেটিস ছিল অনেক, হার্ট, পায়ের হাড় ক্ষয়ে হাঁটতে পারছিলেন না, প্রস্রাবে ছিল যন্ত্রণা …। এতকিছুর সঙ্গে শেষের দিকে কোনোকিছু খেলে রাখতে পারতেন না পেটে, বমি হতো খুব।

অমৃতা আহমেদের গলা, স্যার?

হ্যাঁ ঠিক আছে। আমি আসছি, আপনারা কাগজপত্র তৈরি করুন। – মোবাইল কেটে দেয় বাবুলনাথ রায়।

কী হলো? টাই বাঁধার জন্য পাপিয়া মণ্ডল দুই হাত বাড়ায়।

বেদনামিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে বাবুলনাথ – বাবা আর নেই। বসে খাটের ওপর। শোক থইথই করে বাবুলনাথ আর

পাপিয়ার মধ্যে। রুমে ঢোকে বাবুলনাথের পুত্র কৌশিকনাথ। বাবা এবং মায়ের

বিষণ্ন মুখ দেখে বুঝতে পারে একটা কিছু ঘটেছে। মায়ের কাছে এগিয়ে যায়, মা কী হয়েছে?

তোমার দাদু আর নেই …। এই মাত্র হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছে।

বাবাকে জড়িয়ে ধরে কৌশিক, বাবা!

বাবুলনাথও জড়িয়ে ধরেন পুত্রকে। এক পিতার স্মৃতির বাথানে প্রয়াত পিতার পরম্পরা অনুভব করে দুজনে। সময় সেকেন্ড-মিনিট অতিক্রম করে পিতা বাবুলনাথ পুত্রকে বলেন, চলো কৌশিক হাসপাতালে যাই, তোমার দাদুর কাছে।

চলো। পিতা-পুত্র সামনে এগোয়, পেছন থেকে পাপিয়া জিজ্ঞেস করে, দাহ করবে কোথায়?

বাবুলনাথ থমকে দাঁড়ায়, পাপিয়া, এটা নিয়ে খুব জটিল অবস্থায় আছি।

কী জটিল অবস্থায় আছো?

হাসপাতালে বাবা আমাকে বলেছেন তাঁর শেষকৃত্য গ্রামের বাড়িতে করার জন্য।

গ্রামের বাড়ি, উজানগাঁও? পাপিয়া মণ্ডলের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা। কীভাবে সম্ভব?

তুমি দাদুকে কথা দিয়েছো?

ছেলের প্রশ্নে মাথা নাড়ান বাবুলনাথ, বাবার শেষ ইচ্ছে, না করি কীভাবে?

তিনজনের মধ্যে নীরবতা নেমে আসে। বুঝতে পারে, বরিশালের পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়া উপজেলার উজানগাঁওয়ের গ্রামের সদ্য মৃত অমরনাথ রায় পুত্র বাবুলনাথকে একটা ঝুলন্ত ব্রিজে রেখে গেছেন। আটদিন আগে বাড়ি থেকে লঞ্চে ঢাকায় এসেছিলেন অমরনাথ চিকিৎসার জন্য। তিনি আসতে চাননি কিন্তু পুত্র বাবুলনাথ, নাতি কৌশিক নাথের ফোনে অতিষ্ঠ হয়েই এসেছেন। ঢাকা শহর কখনোই ভালো লাগেনি অমরনাথের। যতবারই এসেছেন, দু-চারদিন থেকে চলে গেছেন গ্রামের বাড়ি, উজানগাঁওয়ে।

বাবা, গ্রামে তো কেউ নেই। বাড়িতে একলা থাকেন কীভাবে? মা মারা গেছেন বছরপাঁচেক হলো।

হাসেন অমরনাথ রায়, তোমরা যারা শহরে থাকো বুঝবা না গ্রামের মজা। বিকালে উজানগাঁও বাজারে গিয়ে কালু মিয়ার দোকানে সবার সঙ্গে বসে এক কাপ চা না খেলে মনে হয় সারাদিনে আমার কি একটা জরুরি কাজ হয় নাই। শনিবার আর সোমবার উজানগাঁওয়ের হাটে ঘোরাঘুরি না করলে দিনগুলোই আমার ভালো

লাগে না। আর বিকালের দিকে কচা নদীর পাড়ে না বসলে মনে হয় আমি আমার মায়ের ছায়ায় নাই। বাবুল, তোমরা এই ঢাকা শহরের মানুষ আমার এই ব্যামো বুঝবা না।

সত্যিই বুঝি না তোমাদের ব্যামো। মা ঢাকায় এলে তিনদিন পরই গ্রামে ফেরার জন্য উতলা হয়ে উঠত। গত মাসে এলো হামিদ কাকা। এসে বললো দিনদশেক থাকবে, আমরা সেইভাবে প্রস্তুত হলাম। ডাক্তার দেখানো শেষ হলে তিনদিন পরেই, বাবা আমি যাই? আমি অবাক। বলি, আপনার তো দশ-বারোদিন থাকার কথা। কৌশিক আপনাকে ঢাকা শহরের সব ঘুরিয়ে দেখাবে।

কৌশিকের সঙ্গে খুব খাতির হয়ে গিয়েছিল। দুজনে অনেক গল্প করত। কৌশিকই প্রশ্ন করলো, আপনি না বললেন দশদিন থাকবেন। হলো মাত্র তিনদিন … এই তিনদিনে তো চিকিৎসা করালেন। আমার সঙ্গে ঘুরে সব দেখবেন –

চিকিৎসার জন্যই তো এলাম। চিকিৎসা শেষ, মন টেকে না তোমাদের শহরে, আমি যাই …। আমার গরুগুলায় আমারে ছাড়া ঘাস খায় না। তোমাগো এই সাজানো-গোছানো শহর আমার ভালো লাগে না। বুঝতে পারছি, অমরনাথ আইসা কেন       থাকতে পারে না।

রাখতেই পারলাম না হামিদ কাকাকে, পরের দিন দুপুরে ঠিকই চলে গেলেন সদরঘাটে। অবাক তোমাদের জীবন …

উজানগাঁও হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে একত্রিশ বছর চাকরি করার পর আট বছর হলো অবসরে আছেন অমরনাথ রায়।  কিন্তু   স্কুলের   অবসরে থাকলেও জীবনের অবসরে নেই অমরনাথ রায়। বাড়ির মধ্যে একটা ঘর তুলেছেন। উজানগাঁও গ্রামসহ আশপাশের মাদার্শী, তেলিখালি, পশারীবুরিয়া, বোথলা গ্রামের ছেলেমেয়েরা এসে পড়ে যায়। তিনি সকালে ওদের নিয়ে বসেন, যে যখন আসে, তখনই দেখতে পায়, অমরনাথ বসে আছেন। হাসিমুখে বলেন, আয়, বোস আমার কাছে। কী সমস্যা? অংক, না ইংরেজি?

ছাত্র হেসে বলে, আমার ইংরেজিটা সমস্যা হচ্ছে স্যার। বুঝতে পারছি না।

অমরনাথ রায় অবাক শিক্ষক – বাংলা, বাংলা ব্যাকরণ, ইংরেজি, ইংরেজি ব্যাকরণ, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, হিন্দু ধর্ম শিক্ষা, ইসলাম ধর্ম শিক্ষা সবই পড়ান। কত দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্ররা পড়তে আসে, হিসাব নেই। কিন্তু কারো কাছ থেকে একটা টাকা তিনি গ্রহণ করেন না। বরং অনেক ছাত্রছাত্রীর স্কুলের বেতন গোপনে দিয়ে দেন। কেউ জানে না। অনেক মেয়ের বিয়ের টাকাও জোগান দিয়ে থাকেন অমরনাথ রায়।

হাসতে হাসতে বলেন, গ্রামে গিয়া হামিদ ভাই তো কৌশিকের গল্প কত যে করেছে। বড় দুঃখ, কৌশিক তুমি, নৃত্য গ্রামের বাড়ি যাও কম। তোমরা গেলে কত খুশি হয় সবাই …

বুঝি বাবা আমিও। কিন্তু আপনি  জানেন, বেসরকারি বড় ব্যাংকের ডিএমডির দায়িত্ব অনেক। আমার জীবনটা হয়ে গেছে লাটিমের জীবন, খালি ঢাকা শহরেই ঘুরপাক খেলাম। যদিও মফস্বল শহরে যাই মাঝেমধ্যে কিন্তু নির্দিষ্ট একটা জায়গায় যাই, সেটা হতে পারে হোটেল কিংবা আমাদের অফিস, কাজ শেষ করে হয় গাড়ি নয় বিমান …। এইভাবে তো আমি আটকে পড়ে গেছি বাবা।

বুঝতে পারি; কিন্তু একটা পরামর্শ, অন্তত জীবনের শেষদিকে গ্রামে থাকবে। আমি সেইভাবে ঘরবাড়ি তৈরি করে রাখছি। তোমাদের কষ্ট হবে না।

পিতার কাছে প্রতিশ্রুতি দেয় বাবুলনাথ রায়, থাকবো বাবা, থাকবো।

যদিও সন্দিহান, কৌশিক-নৃত্য, ওদের মা থাকতে দেবে কি না! ঢাকায় বড় একটা ফ্ল্যাট কিনেছে বছরদুই হলো। সাভারে গ্রামের দিকে দশ কাঠা জায়গাও কিনেছে কৌশিকের আগ্রহে। ওখানে ছোট্ট একটা একতলা টিনের ঘর করার পরিকল্পনা আছে ওর। সুতরাং গ্রামে, উজানগাঁওয়ে …। অবশ্য গ্রামে দুই বছরে এক-দুইবার

গেলে মানুষজনের আন্তরিকতা ভালো লাগে খুবই।

বাবা? গাড়িতে উঠতে উঠতে কৌশিক বলে, দাদুকে গ্রামেই দাহ করবে?

মাথা নাড়েন বাবুলনাথ, হ্যাঁ। আমার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই কৌশিক।

তুমি ভেবে দেখেছো, কত ঝামেলা?

ভেবেছি কিন্তু আমি বাবার হাত ধরে কথা দিয়েছি, গ্রামে, উজানগাঁওয়ে, তাকে দাহ করবো।

ড্রাইভার গাড়ি বাসা থেকে মেইন রাস্তায় নিয়ে এসেছে। পিতা ও পুত্র বসা গাড়ির পেছনে। ফোন করে অফিসের এমডির কাছে পিতার মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে সাতদিনের ছুটি নিয়েছে বাবুলনাথ রায়। সবাই তো জানে না পিতার মৃত্যুসংবাদ। অফিসের নানা স্তরের অফিসারের কাছ থেকে ফোন আসতে থাকে, রিসিভ করে যতদূর সম্ভব সমাধান দিচ্ছে।

বাবা, গ্রামে নিয়ে যেতে কত ধরনের ঝামেলা তুমি বুঝতে পারছো?

কৌশিকের দিকে তাকায় বাবুলনাথ, আমিও একদিন এইভাবে মরে যাবো। আমার পুত্র আমার লাশ নিয়ে দিশেহারা হয়ে যাবে। এই মুহূর্তে আমি যেমন আমার বাবাকে নিয়ে বুকের ভেতরে কষ্টে ভেসে যাচ্ছি। কত স্মৃতি বাবার, কত মমতায় আমাকে গড়ে তুলেছেন। আজকে আমার জীবনে সাফল্যের যতটুকু পালক যুক্ত হয়েছে, সবটুকুই বাবার। মনে পড়ে পনেরো বছর আগে মাস্টার্স করে ঢাকায় চাকরির জন্য চেষ্টা করছে, একের পর এক ইন্টারভিউ দিচ্ছে, কিন্তু চাকরির খবর নেই। বাবা একটি চিঠি লিখে পাঠালেন ছাত্র আতাউর রহমানের কাছে, মতিঝিলে, আলিশান অফিসে। বিশাল অফিসে ঢুকেই হতবাক বাবুলনাথ। টেবিলের ওপাশে বসা আতাউর রহমান। চিঠি হাতে নিয়ে কেবল হাসলেন, আমার মনে হয় স্যার জীবনে প্রথম কাউকে চিঠি লিখলেন চাকরির জন্য।

মাথা নিচু করে বসে আছে বাবুলনাথ রায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, কারো কাছে চাকরির জন্য ধরনা দেবে না। কিন্তু কোথাও কিছু হচ্ছিল না। দুটো চাকরি হয়েছিল, একটা এনজিওতে, একটা ইনডেনটিং ফার্মে। কিন্তু যেতে হবে ঢাকার বাইরে …। ঢাকার বাইরের জীবনের সঙ্গে পরিচয় না থাকায় যায়নি বাবুলনাথ রায়।

বাবুলনাথ রায়ের কাগজপত্র দেখতে দেখতে প্রশ্ন করেন আতাউর রহমান, তোমার তো অনেক ভালো রেজাল্ট।

জি …

বিসিএস দাওনি?

দিয়েছি। কিন্তু …

কিন্তু কী?

ওরা আমার নাম দেখে কেমন চোখে তাকায়, প্রশ্ন করে বিদ্ঘুটে টাইপের …।

বুঝতে পেরেছি। আতাউর রহমান বলেন, তুমি কালকেই জয়েন করো আমার অফিসে। আপাতত বেতন পাবে বিশ হাজার। আমার নতুন একটা ঢেউটিনের ফ্যাক্টরি হচ্ছে। ম্যানেজার একজন আছে, তুমি ওর সহকারী হিসেবে কাজ করবে। ফ্যাক্টরি নারায়ণগঞ্জে। তিন-চার মাসের মধ্যে জার্মানি থেকে মেশিনপত্র আসবে। নেটে সব করেসপন্ডেস তোমাকেই করতে হবে – বলতে বলতে ফোন করেন ম্যানজার ইফতেখার আহমেদকে।

ম্যানেজার রুমে ঢুকলে বলেন, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরুষের নাম অমরনাথ রায়। আমার শৈশবের শিক্ষক। তাঁর পুত্র বাবুলনাথ রায়কে আপনার সহকারী হিসেবে নিয়োগ দিলাম। শিখিয়ে-পড়িয়ে নেবেন …।

বাবুলনাথ দুই বছর খুব যত্নের সঙ্গে চাকরি করে বেসরকারি ব্যাংকে ইন্টারভিউ দিয়ে ঢুকে যায়। সেই বাবা জীবনের যেমন ছিলেন …।

আমাকে বলো কিভাবে নেবে দাদুর লাশ?

কৌশিক, ঢাকা থেকে অ্যাম্বুলেন্স তো ভাণ্ডারিয়া পর্যন্ত যাবে। ভাণ্ডারিয়া থেকে কিভাবে নেবো? পালটা প্রশ্ন করে আটকে দেয় পুত্রকে।

নৌকায়, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয় কৌশিক।

এক কাজ করলে কেমন হয়?

কী?

তেলিখালি ঘাটে তো ঢাকা থেকে যাওয়া দোতলা লঞ্চ ভেড়ে। ভাণ্ডারিয়া থেকে আমাদের উজানগাঁও প্রায় আট-নয় কিলোমিটার, জলপথে আরো বেশি। কিন্তু তেলিখালি থেকে লঞ্চে মাত্র ঘণ্টাখানেকের পথ। তেলিখালি থেকে তো উজানগাঁওয়ের নৌকা পাওয়াই যাবে। কচা নদী থেকে উজানগাঁওয়ের খালে ঢুকতে বড়জোর আধাঘণ্টা লাগবে। খালে ঢুকতে পারলে …

যদি নৌকা না পাওয়া যায়?

যাবে। এক কাজ করো –

বলো বাবা।

গ্রামের কার কাছে মোবাইল ফোন আছে, খবর নাও।

হামিদ কাকারই আছে। আমার কাছে মোবাইল নম্বর সেভ করা।

তাহলে ফোন করে জানিয়ে দাও বাবাকে নিয়ে আসছি।

কিন্তু বাবা তুমি পরিস্থিতিটা ভেবে দেখেছো? আমরা কী করে দাদুর লাশ নিয়ে যাবো? সম্ভব আমাদের পক্ষে?

কৌশিক, আমি জানি গোটা ব্যাপারটা বিরক্তিকর। কষ্টেরও। টাকা-পয়সার ভজঘট হবে। আমার নিজের কাছেও বাবার এই দাবিটা এখন ভালো লাগছে না। মানুষ আমরা মারা যাবো। ঢাকায় জুরাইনের শ্মশানঘাটে নিয়ে গেলে সব মিলিয়ে ঘণ্টাদুয়েকের কাজ। কিন্তু এখন লাশটাকে ধুয়েমুছে বরফ দিয়ে কফিনে রাখতে হবে। অ্যাম্বুলেন্সে করে নিতে হবে সদরঘাট। কোন লঞ্চে জায়গা পাবো ঠিক নাই …। মাথাটা আমার কাজ করছে না কৌশিক – অনেকটা হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি বাবুলনাথ রায়ের।

পিতা-পুত্রের মধ্যে নেমে আসে নীরবতা। হাত ধরে পিতার কৌশিক, বাবা তুমি যদি ভেঙে পড়ো আমার কী হবে? দাদুকে তো আমিও ভালোবাসি।

জানি।

মানে তুমি দাদুকে লঞ্চে নিয়ে যেতে চাও?

হিসাব-নিকাশ করে বলো, আমার প্ল্যানটা কেমন লাগলো?

তোমার প্ল্যানটাই বেশ মনে হচ্ছে। আপাতত হাসপাতালে যাই, দেখি কী অবস্থা। আর কফিন কোথায় পাওয়া যাবে?

হাসপাতালের লোকদের জিজ্ঞেস করলেই ওরা বলে দেবে।

গাড়ি হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ঢোকে। ড্রাইভার গাড়ি পার্ক করলে পিতা-পুত্র নেমে হাসপাতালের লিফটের দিকে যায়। বিছানার ওপর সোজা শুয়ে আছেন উজানগাঁওয়ের প্রবীণ মানুষ, উজানগাঁও হাই স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক, বাবুলনাথ রায়ের পিতা অমরনাথ রায়। গতকাল রাতেও যখন শেষবারের মতো পিতাকে দেখে চলে যায়, তখনো বিছানায় শুয়ে তাকিয়ে ছিলেন দুটি ব্যাকুলচোখে। এতক্ষণ চোখে পানি ছিল না বাবুলনাথের। গত কয়েক বছর ধরে এমনিই যাচ্ছিলেন অমরনাথ। একটু অসুস্থ হলে ঢাকায় পুত্রের কাছে আসতেন। কয়েকদিনের চিকিৎসায় সুস্থ হলে চলে যেতেন গ্রামে, উজানগাঁওয়ে। সেই পালা সাঙ্গ হলো …।

অমরনাথের লাশ কফিনবন্দি করে, অ্যাম্বুলেন্সে রেখে দুপুরে বাসায় আসেন বাবুলনাথ আর কৌশিক রায়। গোসল সেরে হালকা খাবার মুখে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে বের হবার সময়ে সঙ্গী হয় নৃত্য। নৃত্য ব্যাগ গুছিয়ে প্রস্তুত হয়ে ছিল। ওকে দেখে অবাক বাবুলনাথ, তুমি কোথায় যাবে?

তোমাদের সঙ্গে, দাদুর সঙ্গে, শেষবারের মতো।

কৌশিক ক্ষেপে যায়, নৃত্য এটা যা ইচ্ছে তাই করার সময় নয়। দাদুর

ডেডবডি নিয়ে যাচ্ছি আমরা গ্রামে। সারাপথে অনেক ঝামেলা। ভাবলেই মাথা গরম হয়ে যায়। বুঝলাম না বুড়ো কেন ওই গ্রামে দাহ হবার অযৌক্তিক দাবি করেছিল। আর তুই মনে করছিস আমরা পিকনিকে যাচ্ছি!

না, আর্ট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী নৃত্য বলে, না দাদা। আমি বুঝি তোমরা গ্রামে যাচ্ছো দাদুর লাশ নিয়ে। তোমরা যেতে পারলে আমি পারবো না কেন দাদুর সঙ্গে যেতে? আমি মেয়ে, তাই?

পিতা ও পুত্র চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে নৃত্যর দিকে। এবং নৃত্যকে নিয়ে যেতে রাজি হয় শেষ পর্যন্ত। সদরঘাটে আসার পর বাবুলনাথ অবাক হয়ে দেখলেন অফিসের দশ-বারোজন কলিগ এসে হাজির। এবং বাবুলনাথের কিছুই করার প্রয়োজন হলো না। বিশেষ করে বাবুলনাথের ইমিডিয়েট কলিগ আহমেদ কফিল একাই সব কাজ করেছেন। লঞ্চ ঠিক করেছেন। ভাড়া মিটিয়েছেন কয়েকগুণ, কারণ লাশ নিতে চাইছিল না লঞ্চ। মানুষ কখন মানুষের পাশে দাঁড়ায়, বলা মুশকিল। এই যে কলিগরা এসে সব কাজ করে দিয়ে গেল, সান্ত্বনায় সিক্ত করলো …। লঞ্চের ছাদে দাঁড়িয়ে বিকেলের অস্তপ্রায় সূর্যের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না বাবুলনাথ। কান্নায় ভেঙে পড়ে। লঞ্চ ছুটে চলছে সদরঘাট ছেড়ে তীব্র সিটি বাজিয়ে।

অমরনাথের কফিন নিচতলায় সিঁড়ির কাছে পড়ে আছে। মেয়ে নৃত্যর জন্য ডাবল রুম নেওয়া হয়েছে। কৌশিক কফিনের কাছে দাঁড়িয়ে। বাবুলনাথের খুব অসহায় লাগছে। এতদিন পৃথিবীতে পিতা ছিলেন। একটা গভীর দায় ছিল, যদিও বিরক্ত এখন, এই লাশ বহন করে নিয়ে যেতে হচ্ছে উজানগাঁওয়ে! বাবার কেন এই দাবি? গ্রাম? জন্মগ্রাম …। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ পথে-প্রান্তরে মারা যায়, গেছে, যাচ্ছে কিন্তু অমরনাথ রায়, আপনার গ্রামে দাহ হবার ইচ্ছে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমরা কত কঠিন সময় পার করছি! ঢাকায় এতক্ষণে আপনার দাহ শেষ হয়ে যেত। হ্যাঁ বলতে পারতেন, আমার শরীরের ছাই গ্রামের জন্মভিটায় ছিটিয়ে দিও, কচা নদীতে ভাসিয়ে দিও … সেটা আমাদের জন্য কত ভালো হতো …।

মোবাইলে গ্রাম থেকে হামিদ কাকার ফোন আসে, বাবুল তোমরা কোথায়?

কাকা, আমরা বাবাকে নিয়ে লঞ্চে।

কোন লঞ্চে?

নাবিক লঞ্চে।

ঠিক আছে, আসো ভাইকে লইয়া। আমরা আছি …।

লাইন কেটে দেন হামিদ কাকা।

রাতটা কেটে গেল জেগে, আধো জাগরণে, বেদনায়, হতাশায়, তিক্ততায়। শোকে রাতটা পার করে তিনজনে – কখনো রুমে, কখনো অমরনাথের সঙ্গে কফিনের কাছে, কখনো ছাদে …। সকাল আটটার দিকে লঞ্চ ভাণ্ডারিয়ায় ভেড়ে। সেখানে বেশ কিছুটা সময় দেরি করে লঞ্চটা। ঢাকা থেকে নানা ধরনের পণ্য নেমেছে। ভয় হচ্ছে বাবুলের, কফিনের ভেতরের বরফ গলতে শুরু করে যদি! লঞ্চ ভাণ্ডারিয়া ছেড়ে পাড়েরহাটে আসে। পাড়েরহাটে মাত্র কয়েক মিনিট থেকেই নাবিক ছুটছে কচা নদীর বক্ষ সাঁতরে তেলিখালির দিকে। পনেরো-বিশ মিনিটের মধ্যে নাবিক লঞ্চ তেলিখালি বন্দরে নোঙর করে। সঙ্গে সঙ্গে উজানগাঁওয়ের পনেরো-বিশজন পরিচিতজন উঠে আসে লঞ্চে। যে আশঙ্কায় বিপন্নবোধ করছিল বাবুলনাথ, এখানেও কিছুই করতে হয় না। গ্রামের সবাই মিলে কফিন নামিয়ে আহমদ মাঝির নৌকায় ওঠায়। আহমদ মাঝিকে ঠিক করে রেখেছে। সঙ্গে আরো দুটি নৌকা অতিরিক্ত ভাড়া করেছে। অতিরিক্ত নৌকায় গ্রামের লোকজন। অমরনাথের কফিনের নৌকায় বাবুলনাথ, কৌশিক, নৃত্য আর হামিদ কাকা। কচা নদীর স্রোতে তিনটি নৌকা যাচ্ছে উজানগাঁও গ্রামের দিকে, স্রোতের প্রতিকূলে উজান বেয়ে বেয়ে। নৌকার চড়নদার প্রত্যেকে শোকে আচ্ছন্ন। ছইয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে নদীর স্রোত, ভেসে যাওয়া কচুরিপানা দেখছে বাবুলনাথ। কফিনের পাশে বসে আছে কৌশিক, নৃত্য। পাশে দাঁড়িয়ে হামিদ কাকা মৌনতার সঙ্গে শোক যাপন করছেন। বাবুলনাথ জানে, দুজন মানুষের মধ্যে গভীরতম সখ্য ছিল। গ্রামের উলটোদিকে বাড়ি হামিদ কাকার। কিন্তু দুজনে দিনে দুই-তিনবার দেখা না হলে, পান না খেলে, চা না খেলে … দুজনেরই সময় কাটত না। সেই হামিদ কাকাও একা হয়ে গেলেন। শোকে নিস্তব্ধ হামিদ কাকা নির্বাক তাকিয়ে আছেন কচার জলস্রোতের দিকে।

বুঝলা? হামিদ কাকা বলেন, নদীর পাড়ে তোমার বাবার সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই আসতাম। বসে বসে গল্প করতাম। আর অপেক্ষা করতাম …

কিসের অপেক্ষা করতেন?

আমার মরণের; কিন্তু অমরই গেল আমার আগে। আমি কার লগে নদীর পাড়ে আসবো? দুটো চোখ পানিতে ভরে যায় হামিদ কাকার।

জড়িয়ে ধরে বাবুলনাথ, কাকা আমার কী হবে? আমার তো কেউ রইলো না।

নিজেকে সামলে বলে হামিদ, আমি আছি না বাজান! অমরনাথের কফিন নিয়ে নৌকা ঢোকে উজানগাঁওয়ের খালে। পেছনে আরো দুটো নৌকা। খালটা মাঝারি। মাঝখানে হালকা স্রোত। ছইয়ের ভেতর থেকে নৌকার সামনে এসে দাঁড়ায় কৌশিক আর নৃত্য। অমরনাথের নৌকা এগিয়ে চলে, ধীরে ধীরে। অবাক চোখে বাবুলনাথ, কৌশিক এবং নৃত্য দেখে খালের দুই পাড়ে শত শত মানুষ, হাজার হাজার মানুষ অমরনাথের নৌকার সঙ্গে হাঁটছে নিঃশব্দে। প্রত্যেকের মুখে শোক উপচে পড়ছে। নৌকা এগোচ্ছে, লোক বাড়ছে। শোকের এমন মিছিল পৃথিবীর আর কোথায় কখনো হয়েছে, জানা নেই বাবুলনাথ রায়ের। পিতার কাছে প্রার্থনা করে, বাবা ক্ষমা করে দিন, বুঝতে পারিনি, আমি আপনার অক্ষম পুত্র, কেন আপনি আপনার জন্মগ্রাম উজানগাঁওয়ে ফিরে আসতে চেয়েছেন, পিতা আমাকে মার্জনা করুন …।