উত্তর-কল্প – সময়ের স্বগতোক্তি

মানুষের এককেন্দ্রিকতা তথা বিচ্ছিন্নতার ইতিহাস যৌথতা অর্থাৎ দলবদ্ধ সংগ্রামের চেয়ে নতুনতর ইতিহাস। দলগত শক্তিতে প্রতিনিয়ত লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে হাজার বছর পাড়ি দিয়ে আজ এমন বিচ্ছিন্ন আর শক্তিহীন অবস্থায় এসে ঠেকেছে সভ্যতার উৎকর্ষ। চারদিকে তাই বিষণ্ণতা, ভয়, আত্মপরিচয়-সংকট। অর্থহীন জীবনের গল্প। এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার একাকিত্বের পরিণতি সম্পর্কে সজাগ সকলেই জানি এর পরিণতির ভয়াবহতা! কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষই ঘুরে দাঁড়িয়েছে সকলের তরে। ‘উত্তর-কল্পে’র জন্ম যেন এ-পরিস্থিতিতে যূথবদ্ধতার দায়িত্ব নিয়ে বৃহত্তর পথে এগোনোর প্রয়াস। এ-কারণে ‘উত্তর-কল্প’ চায় শিল্প, শিল্পী ও সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে এক সেতু হিসেবে বন্ধন তৈরি করতে। শহরের রেস্টুরেন্ট, শপিংমল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল – প্রয়োজনীয় এসব প্রতিষ্ঠানের ভেতরে শিল্পের আবশ্যক শক্তিকে প্রতিষ্ঠা এর লক্ষ্য। যেভাবে, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন চেয়েছিলেন এ-অঞ্চলের মানুষের মধ্যে রুচির দুর্ভিক্ষ দূর করতে। এই ‘রুচি’ শুধু জামাকাপড়, প্রসাধনসামগ্রী ব্যবহারে নিজের বাহ্যিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয় – এটি অন্তরের কদর্যতা দূর করে নীতি-নৈতিকতার মধ্য দিয়ে সৃষ্টিশীলভাবে বাঁচার রুচি, যা সামগ্রিক সমাজের সুস্থতার পরিচায়ক। শিল্প-সংস্কৃতি মূলত এই কাজটিই করে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রেও প্রয়োজন যথাযথ দিকনির্দেশনা। বিপাশা হায়াৎ, গোলাম ফারুক সরকার, শহিদ কাজী – তিনজন প্রতিশ্রম্নতিশীল শিল্পী গভীরভাবে উপলব্ধি করেন যে, এই কঠিন কিন্তু আবশ্যক দায় তাঁরা এড়াতে পারেন না। তাঁরা একত্রে ‘উত্তর-কল্প’কে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, মেনিফেস্ট তৈরি করেন এবং ‘সলিলোকয়িস অব দ্য বিগিনিং’ (Soliloquies of the Begining)-এর মাধ্যমে প্রথম প্রচেষ্টা জনগণের সামনে নিয়ে আসেন। উত্তর-কল্পের পস্ন্যাটফর্ম প্রথমত দেশের জন্য। কিন্তু আন্তর্জাতিকতা-বিচ্ছিন্ন নয়। গত ২৮ অক্টোবর ২০১৮-তে আলিয়ঁস ফ্রঁসেসে এই দলগত প্রদর্শনীর আয়োজন হয়, চলে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত। প্রদর্শনীতে দেশের ও দেশের বাইরের, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার শিল্পীরাও অংশ নিয়েছেন। পেইন্টিং, ইনস্টলেশন, পারফরম্যান্স, গল্প, আড্ডা – সবকিছুই হয়েছে তথাগত প্রদর্শনীরীতিকে চ্যালেঞ্জ করতে চাওয়ার প্রবণতার মধ্য দিয়ে। কোনো আয়োজিত আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং বেঁধে-দেওয়া সময়কালে স্বাধীন স্বতঃস্ফূর্ত আনুষ্ঠানিকতা। শেষদিনে প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকৃত শিল্পীদের বাইরেও শিল্পী জাহিদ হাসান, ফারাহ নাজ মুন পারফরম্যান্স করেন।  বেড়াতে আসা শিশুরাও কালি-কাগজে ড্রইং করেছে। বিপাশা হায়াৎও প্রথমবারের মতো পারফরম্যান্স করেন। অর্থাৎ ধরাবাঁধা নয়, বরং সকলের, মানে শিল্পী-দর্শকদের সরাসরি অংশগ্রহণই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

বিপাশা হায়াৎ বলেন, ‘আমরা এমন একটা পস্নাটফর্ম তৈরি করতে চাই যেখানে যে-কারো যে-কোনো নতুন চিন্তা, বিবৃতি শিল্পের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন হোক। আরো স্বাধীনতা আসুক শিল্প-নির্মাণে।’ গ্যালারির মাঝামাঝিতে বিপাশা হায়াতের ‘Memoir 2017’ শীর্ষক স্থাপনাশিল্পটি নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন স্মৃতি নিয়ে কাজ করি। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য সবকিছুই আমার স্মৃতির অংশ। তাই এখানে যেসব উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে তা সবই আমার প্রতিদিনের ব্যবহার্য। কিন্তু এটা তৈরি করার পর আমি নিজের ভেতরে এক ধরনের মিনিমালিজমের চিন্তা খুঁজে পাই। আরো কম জিনিসে, সহজভাবে কি বাঁচা যায় না?’ ফারজানা আহমেদ ঊর্মি কাজ করেন ব্যক্তিমানুষের আবেগতাড়িত জীবনের চরিত্র নিয়ে। মানুষই তাঁর ছবির মূল বিষয়। তিনি মানুষকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। মানুষের ভেতরের আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ, কদর্যতা কিংবা উদারতাকে বুঝতে চেষ্টা করেন সামাজিক প্রেক্ষাপটে। মানুষ যখন কোনো কাজে সফল হয় কিংবা ব্যর্থ হয় – এ-সবকিছুই সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থার ফলাফল। অর্থাৎ, মানুষ কীভাবে সামাজিক ভিকটিম হয় কিংবা মানবিক ও অমানবিকতার মোটা দাগ কতভাবে পরস্পরে অতিক্রম করে গেছে – এসব তিনি ভাবেন। বিশেষ করে, এ-প্রদর্শনীর ‘To my love’ শীর্ষক প্রতিকৃতিধর্মী কাজটি করার পেছনের ভাবনাটি এমনই। সেমিরিয়ালিস্টিক আর এক্সপ্রেশনিস্টিক উপায়ের মিশ্রণ, রেখা ও রঙের স্বতঃস্ফূর্ততা ফারজানার কাজের অন্যতম লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। ফারজানা ‘উত্তর-কল্প’ সম্পর্কে বলেন, তিনি আশা করবেন আয়োজকরা যেন নতুনদের এবং যাঁরা কাজ করেন কিন্তু সেভাবে নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ পান না – তাঁদের নিয়েও কাজ করবেন। রিপিটেশন নয়, বরং নতুনত্বের চ্যালেঞ্জ নেবে উত্তর-কল্প – এমনটাই চান তিনি।

জয়দেব রোয়াজার কাজ ড্রইংনির্ভর, বাস্তবধর্মী। কালি-কলমে তিনি পাহাড়ের জনপদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরেন। বরাবরই শিল্পী পাহাড়ের জাতিগত নিপীড়নকে তুলে ধরেন তাঁর ড্রইংধর্মী কাজগুলোতে। ‘Soil and Mother’s Compassion’ শিরোনামের কাজ নৃ-গোষ্ঠীর তাত্ত্বিক ডকুমেন্টেশন। অন্তরা মেহরুখ আজাদ ‘Archipelago’- তে মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে ভেবেছেন। কয়েকটি ক্যানভাস একত্রে সংযোজিত করে উজ্জ্বল গোলাপি রঙের প্রলেপে শহরের জীবনের প্রকৃতি-বিচ্ছিন্নতার চিত্র এঁকেছেন। মানুষের উন্নয়ন কীভাবে কৃত্রিমতাকে আঁকড়ে ধরেছে, তার আদতে ফলাফল নিরূপণ করাটা জরুরি।

গোলাম ফারুক সরকার সমাজবাস্তবতার চিত্র এঁকেছেন। অনেক বেশি রূপক অর্থে। ‘Untitled’ শীর্ষক উজ্জ্বল হলুদ ব্যাকগ্রাউন্ডে বাস্তবধর্মী ফর্ম; কিন্তু ফর্মগুলো যেন কখনো অধিবাস্তব। যেভাবে ধারালো ছুরি পাখা পায় ওড়ার কিংবা হাতের মুদ্রায় ধরা শাপলা ফুল – এই সমাজের নেতিবাচক দিক রূপায়ণ করে শান্তি অন্বেষণ করে।

শহিদ কাজী ‘The Pieces of the Accident’ কাজটি অনেকগুলো ক্যানভাস একত্র করে কম্পোজিশন করেছেন। বলা যায়, ইনস্টলেশনধর্মী পেইন্টিং। শক্তিশালী ড্রইং ও স্বল্প পরিশীলিত রঙের ব্যবহার এতে লক্ষণীয়।

এছাড়া মালয়েশিয়ান শিল্পী হাদি সোসেনটোর ‘Matahari (The Sun)’ কাজটি অ্যাক্রিলিক এবং গ্লাস পেইন্টের সমন্বয়ে করা বিমূর্তধর্মী। অন্য শিল্পীদের মধ্যে আছেন সাওরগঙ্গা দর্শনধারী, ফাইজান ওমর, ইয়েশি চোদেন, সুত্তিফান সিত্তিচাল, টানতিখোন নোকং প্রমুখ।

‘উত্তর-কল্পে’র এবারের আয়োজন কেবল দীর্ঘ পদব্রজের প্রথম ধাপ। ইতিহাসে নানা সময়ে নানা শিল্পদলের উদ্ভব এবং কর্মপ্রয়াস বৃহত্তর স্বার্থে নব দিক ও গতি সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। সেখানে উত্তর-কল্পও বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে – এমনটাই দর্শনার্থীরা আশা করছেন।