‘উদ্বেগে দুঃখ পাওয়া ছাড়া আর কী করার থাকে’ সৌরীন ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথোপকথন

চিন্ময় গুহ

[অর্থনীতির অধ্যাপক, সমাজতাত্ত্বিক, সংস্কৃতি-পাঠক ও চিন্তক হিসেবে সৌরীন ভট্টাচার্য (জ ১৯৩৭) বাংলা সংস্কৃতিজগতে একটি বিশিষ্ট নাম। তাঁর নিরপেক্ষ, পরিমিত চিমত্মা আমাদের কালের নানা মানবিক বিতর্কে সর্বদাই যুক্ত করে নতুন এক যুক্তিবাদী মাত্রা। তাঁর সাহিত্যপাঠ, ইতিহাস ও দর্শনভাবনা সবই এক সামগ্রিক চিমত্মায় মানুষ ও পৃথিবীকে বুঝতে চায়।

তাঁর বইগুলো পরিবর্তনের ভাষা (১৯৯৩), রাজনীতির বয়ান ও স্বচ্ছতার সংস্কৃতি  (১৯৯৮), পদ্ধতির পাঁচালি (২০০২), সময়-সংস্কৃতির তত্ত্বতালাশ (২০০৩), আধুনিকতার সাধ আহ্লাদ (২০০৭), কেন আমরা রবীন্দ্রনাথকে চাই এবং কীভাবে (২০০৭) নানা জট খুলে আমাদের স্বচ্ছতার দিকে টেনে আনতে চায়। কিছুদিন ধরে মারুফ হোসেনের অভিযান পাবলিশার্সের জন্য অক্লান্ত নিষ্ঠায় খ– খ– সৌরীন ভট্টাচার্যের রচনাসংগ্রহ সম্পাদনা করছেন অমস্ন­vন দত্ত। আপাতত তিনটি খ- প্রকাশিত হয়েছে।

এই অন্তরঙ্গ কথোপকথনে আমরা চেষ্টা করেছি তাত্ত্বিক কূটকচালকে যথাসম্ভব পরিহার করে তাঁর মনের বিকাশকে জানার, আমাদের সময়ের মূল সমস্যাগুলোকে স্পর্শ করার।]

 

আপনাকে অর্থনীতির অধ্যাপক, সমাজতাত্ত্বিক, চিন্তক হিসেবে চিনি। কিন্তু এই যে খোলা চোখে সমাজ ও পৃথিবীকে দেখা, সেগুলোকে নির্মোহভাবে বোঝার চেষ্টা, এর তো নিশ্চয়ই একটা শুরু আছে। কোন পরিবেশে আপনার জন্ম, বেড়ে ওঠা… আমার মনে হয়, গতানুগতিক হলেও জরুরি প্রশ্ন এগুলো।

গোড়ার দিকের কথা কী আর বলব। সবই আর পাঁচজনের মতো একদম সাধারণ। কিছুমাত্র বৈশিষ্ট্য নেই।

আমার জন্ম অবিভক্ত বাংলার যশোর জেলায়। ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের ৫ কার্তিক। এখনকার প্রচলিত হিসাবে ১৯৩৭-এর ২২ অক্টোবর। আমাদের গ্রামের নাম পাঁজিয়া। সদর মহকুমা। আমাদের গ্রাম কিন্তু একেবারেই গ্রাম ছিল তখন। ইলেকট্রিক আলোর প্রশ্নই ওঠে না। এমনিতে সে-গ্রাম অজপাড়াগাঁ বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। তবে আমরা ছোটবেলায় যা নিয়ে বুক বাজিয়ে বেড়াতাম তা হলো মাইকেলের গ্রাম সাগরদাঁড়ি আমাদের গ্রাম থেকে তখনকার ভাষায় এক ক্রোশ মাত্র দূরে। এবং ওই একই পথে। আর আরো কাছে মনোজ বসুর ডোঙাঘাটা।

বলার মতো নদী ছিল না আমাদের। ভৈরবের কথা শুনতাম। তাও আমাদের দিকে নাকি শুকনো। জলটল তখনই বেশি ছিল না। অন্তত আমি সেদিকে যাইনি কখনো। যাওয়ার মতো অত কাছে ছিলও না সে-নদ। আমাদের ছিল খাল-বিল-ডোবা এসব। কুলীনগোছের কিছুই বোধহয় ছিল না সে-গ্রামে। কেবল এক পরিষদ ভবন আর তার সংলগ্ন মাঠ। সে-মাঠে আমরা খুব ফুটবল খেলতাম, খেলতাম না বলে পেটাতাম বলাই ভালো। আমাদের খেলার অনেক নিয়ম ছিল, যা ফুটবল সংগঠন ঠিক মেনে নেবে না। গ্রামের জমিদারবাড়ির এক ছেলে আমাদের সঙ্গে খেলত। সে তখনই অন্যদের তুলনায় অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাহারি জামা-প্যান্ট পরে খেলতে আসত। তার প্যান্টের কথা খুব মনে আছে। ধবধবে সাদা, মনে হয় ইস্ত্রি করা থাকত। তার প্যান্টে যাতে কাদার দাগ না লাগে তা দেখা অন্য খেলোয়াড়দের অন্যতম কর্তব্য ছিল। কর্তব্যে ত্রম্নটি হলে বকুনিও জুটত। তার কাছ থেকে বল নেওয়ার সময়ে খুব জোরে চার্জ করার নিয়ম ছিল না।

কিন্তু আমাদের পরিষদ খুব সাংস্কৃতিক কাজকর্মের জায়গা ছিল। আমাদের গ্রামে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং বামপন্থী রাজনীতি দুয়েরই বেশ জায়গা ছিল বলে মনে হয়। বিয়ালিস্নশের আন্দোলন নিয়ে আমাদের বাড়ির বড়দের মধ্যে উত্তেজনা আমার চেনা অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়ে। আর পরিষদের মাঠে পিসি জোশীর বক্তৃতা আমি নিজেই শুনেছি হুজুগে। ভবানী সেন বাংলা অনুবাদ করেছিলেন মনে আছে। তেভাগা আন্দোলনের পাঁজিয়া রেজুলিউশন তো বইতেই পাওয়া যায়। বোধহয় এরকম সংযোগের জন্যই ওই মাঠে পঞ্চাশের মন্বন্তরের লঙ্গরখানার তেতো অভিজ্ঞতাও হয়েছিল আমার।

যা হোক, আমার গ্রামের গুণগান আর কত করব। আমাদের অঞ্চলে ইলিশ বলতে পাওয়া যেত নোনা ইলিশ। টিনে করে বিক্রি হতো বাজারে। ভেতরে নুনে ভেজানো মাছ, টিনের জল সুরকি গোলা জলের মতো লালচে রং। ইলিশ-রসিকেরা ওই নোনা ইলিশ পাতে পড়লে বিদ্রোহ করবে। আমরা অবশ্য খুব স্বাদ করে ওই ইলিশই খেতাম; কাঁচকলা আর বেগুনের টুকরো দিয়ে রান্না করা। বাড়ির লোক আমার এই রেসিপি শুনে অবিশ্বাসের হাসি হেসে গড়াগড়ি যায়। ঢাকার বনেদি রান্নার স্বাদ তাদের জিভে। অবিশ্বাস ভাঙল একদিন টিভিতে কাঁচকলা দিয়ে ইলিশ মাছ রান্নার রেসিপি শুনে। তবে মাছের রাজ্যে যশোরের কৌলীন্য বলতে ছিল কই আর গলদা চিংড়ি। আমাদের যা ছিল তা শুনলে এখন এখানে সবাই হাসবে। ছোট পুঁটি আর চেলা মাছ। ডোবার জলে গামছা দুজনে দুদিকে ধরে ওইসব মাছ ধরা বেশ রেওয়াজ ছিল। আমাদের যৌথ পরিবারে এক তুতো দাদা ছিল তার এসব বাতিকে আমরা সঙ্গী হতাম। এই বয়সে এসব গল্পে ঢুকে গেলে আর শেষ হবে না। থাক।

 

‘ছোট মুখে বড়ো কথা’র জন্য তিরস্কার নিশ্চয় আপনার ওপরও বর্ষিত হয়েছে। ‘ছোটরা মানানসই হতে জানে না, চায় না’, লিখেছেন আপনি। জানে কিন্তু অনেকে। আপনি তাদের দলে ছিলেন না। তাই তো?

আসলে আমাদের পরিবার সামাজিক বিচারে ছিল অঞ্চলের জমিদারবাড়ির পুরোহিত বংশ। আমার বাবা তাঁর জীবনের একটা পর্বে পৌঁছে যজমানি করতেন। তাঁর অনেক শিষ্যপরিবার ছিল। হরিহরের মতো তিনি মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়তেন। তুলনায় অল্প বয়সেই তিনি সংসার থেকে অবসর নিয়েছিলেন বলা চলে। আমার দাদা, বয়সে আমার চেয়ে প্রায় কুড়ি বছরের বড়, আমাদের সাংসারিক হাল ধরেছিলেন। আর ছিলেন আমার কাকা। যৌথ পরিবারে তাঁর ছিল রাশভারী স্নেহময় উপস্থিতি। আমার দাদা প্রায় তাঁর হাতেই মানুষ। বাবা শেষ বয়সে চর্চা করতেন জ্যোতিষ, তন্ত্র ও বেদান্ত।

আমার দাদা ছিলেন গণিতের অধ্যাপক। তখনকার দিনের কলেজের শিক্ষক। প্রচুর উঞ্ছবৃত্তি করে সংসার চালাতে হতো তাঁকে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে যাঁরা ওখানে পড়াতে আসেন তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তারপর বাকি জীবন ওখানেই পড়িয়েছেন। আমাদের পরিবারে রাজনীতির উপস্থিতি বেশ জোরালো ছিল।
বাবা-কাকার আমলে জাতীয়তাবাদ ও স্বদেশির ধাঁচ টের পাওয়া যেত। পরের প্রজন্ম ঝুঁকেছিল বামপন্থী রাজনীতির দিকে। আমার দাদা অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির লোক ছিলেন। পরে অল্প কিছুটা নকশাল সহানুভূতির পর্ব পেরিয়ে চলে আসেন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির দিকে। আমৃত্যু তিনি সেখানেই ছিলেন।

আমার ঠিক কোনো শিবিরেই মন তেমন করে গেল না। পরিবারে এবং অন্যত্রও একটু বেমানানভাবে কেটে গেল জীবনটা। তাও আমি কৃতজ্ঞ যে, আমাকে তো এতদিন ধরে এতটা সইলেন অনেকেই। কারো কাজেই ঠিক লাগা হলো না আমার।

 

এ-কথা বলছেন কেন? ছাত্রদের কাজে লাগল, পাঠকের কাজে লাগল।… যাক, শিক্ষকদের কারো কথা বলবেন বিশেষ করে? আপনার রচনাসংগ্রহের (তৃতীয় খ- থেকে) সম্পাদক যাকে বলেছেন আপনার ‘চিমত্মা আর সৌম্য সহিষ্ণুতার উদ্‌ভাসন’ সেটা কোন সূত্রে এলো?

আমার পড়াশোনার সূত্রপাত ওই পাঁজিয়া গ্রামেই। আমাকে ভর্তি করা হয়েছিল একেবারে পাঠশালাতেই। তখন যে সেটা খুব রেওয়াজ ছিল তা মনে হয় না। আমার দাদাই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল অনেক বড় বয়সে। আমার বেলায় কেন অন্যরকম হলো তা আমার জানা নেই। দুষ্টুমি একটা সম্ভাব্য কারণ। তবে যতদূর মনে পড়ে এবং যতদূর শুনেছি আমি খুব দুষ্টুও ছিলাম না। আমি কখনো মারামারি করিনি। বাড়িতেও কারো কাছে আমি তেমন বকুনি খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। তবু কেন আমাকে সাত তাড়াতাড়ি পাঠশালায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল তা আমি সত্যিই জানি না। এটুকু মনে আছে, পাঠশালায় আমাদের যে-ঘরে ক্লাস হতো সে-ঘরে দুটো ক্লাস একসঙ্গে হতো। একটা দিকে আমাদের আর অন্যদিকে আমাদের চেয়ে একটু বড় যারা তাদের। একই মাস্টারমশাই দু-দলকেই পড়াতেন। একবার আমাদের দিকে, একবার ওদের দিকে। তিনিও খুব বকাঝকা করতেন বলে মনে পড়ে না। ওই ঘরের দুদিকে পড়ে তারপরে আমি মাঠ পেরিয়ে চলে যাই পুরোপুরি স্কুলে। ওয়ান
টু-থ্রি সব পড়তে থাকি। স্কুলে চলে গিয়ে আমাদের খুব একচোট বড় হওয়ার বোধ জন্মেছিল মনে আছে। কেননা, এই স্কুলে যিনি হেডমাস্টারমশাই তিনি আমাদেরও হেডমাস্টারমশাই এখন থেকে। এটা বড় হয়ে যাওয়ার বেশ স্পষ্ট একটা মাপকাঠি। ওঁর নাম ছিল শচীন্দ্রনাথ মিত্র। তিনি ইংরেজি পড়াতেন। চেহারা একেবারে শরৎচন্দ্রের উপন্যাস থেকে উঠে আসা। সাদা শার্ট, ধুতি, পায়ে চটি। এটা তখনকার মাস্টারমশাইদের পোশাকের প্রায় নির্বিশেষ এক বর্ণনা। ফারাক বলতে কারো শার্ট আর কারো পাঞ্জাবি। কাজেই ওই পোশাকের জোরে ওঁকে শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের চরিত্র বলার মানে নেই। শচীনবাবুর মাথার খাড়া খাড়া চুলে আর মুখের সহজ কী জানি কী একটা ভঙ্গিতে ওইরকম মনে হতো। আসলে পরে যখন মেজদিদি-বড়দিদি জেনেছি, তখন এরকম কথা মনে আসত। পড়েছি যখন ওই স্কুলে তখন ওঁকে সম্ভ্রম করা হতো কিন্তু তেমন ভয়টয়ের কথা কিছু মনে আসে না।

আমাদের স্কুলের নাম ছিল পাঁজিয়া এইচ ই স্কুল। এইচ ই মানে হাই ইংলিশ। তখনকার অনেক স্কুলের এরকম নাম ছিল। কারণ এম ই (মিডল ইংলিশ) স্কুল বলে একটা ব্যাপার ছিল। আমার ছোটবেলার মাস্টারমশাইদের মধ্যে শচীনবাবু ছাড়া যাঁর কথা আমার খুব মনে পড়ে তিনি হলেন জয়গোপালবাবু। তিনি আমাকে হাত ধরে অক্ষর পরিচয় করিয়েছিলেন। আমি যখন এম এ পাশ করি তখনো তিনি বেঁচে ছিলেন। আমাকে একেবারে জড়িয়ে ধরে খুব লাফালাফি করেছিলেন। অক্ষর যিনি হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর কথা শুধু মনে রাখা ছাড়া আর কী করতে পারি আমরা। ওঁর হাতের আঙুলের বিশেষ ধাঁচও আমার মনে আছে। বোঝাব কী করে। একটু মোটা ধরনের আঙুল। ওই আঙুলে স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ সব তুলে দিয়েছিলেন আমার হাতে।

১৯৪৬-এর গোড়ায় আমরা চলে আসি ঢাকুরিয়ায়। তখন পড়তাম কসবা চিত্তরঞ্জন স্কুলে। ওখানে খুব বেশিদিন পড়িনি
আমি। আগস্ট মাসের দাঙ্গার আগে আগে আবার আমাদের দেশের বাড়িতে ফেরত পাঠানো হলো। তারপর একেবারে চলে এলাম ১৯৪৮-এর জানুয়ারি মাসে। সে-দেশে আমি আর যাইনি কখনো। সত্যি বলতে যাওয়ার খুব টানও বোধ করিনি। আমার স্মৃতি যা ছিল তা আজো তেমনি আছে। একটুও মলিন হয়নি।  আমাদের মাঠ-
ঘাট-জলা-ডোবা আর আমার এক আশ্চর্য সঙ্গী, একটা টায়ারের চাকা, সব আমার তোলা আছে।

দেশভাগের পরে এদেশে এসে আমি পড়ি বারুইপুর এইচ ই স্কুলে। আবার সেই হাই ইংলিশ। এখানকার হেডমাস্টারমশাইও ইংরেজি পড়াতেন। নাম বঙ্কিমচন্দ্র পাল। ওঁর কাছে যেমন আছে আমার ঋণ, তেমনি আছে এক অপরাধবোধ। এই সুযোগে ক্ষমা চেয়ে নেব। অপরাধবোধের কারণ হলো ওঁকে আমরা প্রথমদিকে মন থেকে গ্রহণ করিনি। তার কারণ আমরা ওই স্কুলে প্রথম যাঁকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে পাই তাঁর নাম সুরেনবাবু। অল্পদিন বাদে তিনি অবসর নিয়ে চলে যান। তাঁর বদলে আর কেউ আমাদের মন পাবেন না, এটা আমাদের সিদ্ধান্তই ছিল বলা যায়। ফলে বঙ্কিমবাবুকে প্রথম থেকেই আমরা গ্রহণ করিনি। ওঁর একমাত্র দোষ, তিনি সুরেনবাবুর পরে এসেছেন। আজ ভাবতে গিয়ে একটা কথা মনে হয়। আমাদের ভালো-লাগা মন্দ-লাগা অনেক সময়েই এমনিভাবে তৈরি হয়। তাতে আমাদের নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ তেমনভাবে জায়গা পায় না আসলে। একটা ভালো বা মন্দের কাহিনি তৈরি হয়ে থাকে, আমরা শুধু তার মধ্যে প্রবেশ করি। সেই প্রবেশ করা না-করার মধ্যে আমরা ঠিক থাকি না তেমন করে। অথচ তার সব দায় আমাদের নিতেই হয় কোনো একরকমভাবে।

পরে বুঝতে পারি বঙ্কিমবাবুর বেলায় ওই ধরনের কিছু একটা ঘটেছিল। আমাদের ওই স্কুলের গোটা অঞ্চল সুরেনবাবুর জায়গায় আর কাউকে সহজে মেনে নেওয়ার মনে ছিল না। আমরা সেই মনটার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলাম এই মাত্র। তিনি যে কী যত্নে আমাদের ইংরেজি শিখিয়েছিলেন তা তখনই বুঝতে পারতাম, কিন্তু ওই যে বললাম, নিজেদের মনেও সে-কথার স্বীকৃতি দিতে পারিনি তখন। আর আমার অপরাধবোধ আরো একটু বেশি এই কারণে যে, আমার প্রতি স্নেহে ওঁর পক্ষপাতিত্ব আমাকে ছোটখাটো সাজা দেওয়ার মধ্যেও টের পাওয়া যেত। এই সুযোগটুকু পেলাম বলে কথাটা অকপটে বলে নিতে পারলাম।

আর বাংলামাধ্যম স্কুলে ইংরেজি পড়ে শেখা না-শেখার যে-গল্প আজ আমাদের একেবারে গিলে নিয়েছে সে-প্রসঙ্গে বলি ওইসব বাংলা স্কুলের বঙ্কিমবাবুদের আমরা যদি আরো কিছুদিন ধরে রাখতে পারতাম তাহলে ইংরেজিতে বেশি ফেল করে বলে আমাদের স্কুল-কলেজ থেকে সেই ভাষা ও সাহিত্য-শিক্ষার ব্যাপারটাকেই অত আগ্রহে সরিয়ে নিতে হতো না। আমাদের এই মাস্টারমশাইদের অনেকেই আমাদের ভাষাটার উচ্চারণ শেখাতে পারেননি বটে, তবে ভাষার খুঁটিনাটি শেখাতে ত্রম্নটি করেননি। আর ওই উচ্চারণের ব্যাপারেও দু-চারজন মোটেই কম যেতেন না। বাংলামাধ্যম স্কুলের ইংরেজি ক্লাসকে বঙ্কিমবাবু রীতিমতো সমর্থ করে দাঁড় করিয়েছিলেন।

 

একটু যখন বড় হচ্ছেন, কী ধরনের বই পড়ছেন? অঙ্কে ভালো ছিলেন, অনুমান করা যায়। আরো অনেক বিষয়ে আপনার আগ্রহ। সাহিত্যে আগ্রহটা কবে থেকে টের পাচ্ছিলেন?

কলেজ স্তরে আমি চার বছর পড়াশোনা করেছি সিটি কলেজে। প্রথম দু-বছর ইন্টারমিডিয়েট স্তরের বিজ্ঞান আর তার পরে দু-বছর অর্থনীতি অনার্স নিয়ে বিএ। বিজ্ঞানের দু-বছর আমার খুব খারাপ কেটেছে। অঙ্কে ভালো ছিলাম না। ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি কিছুই বুঝতাম না আর সত্যি কথা বলতে কী, অঙ্কে আমি বরাবরই ছিলাম কাঁচা। অঙ্কে কাঁচা অথচ কেন আমি বিজ্ঞান পড়তে গিয়েছিলাম এ-প্রশ্ন আমার কাছে আজো রহস্য। কিন্তু একটা কথা আমাকে বলতে হবে। কথাটা এই যে ওই স্তরে বিজ্ঞান আমি অবশ্যই কিছু শিখিনি। কিন্তু ওই দুটো দুঃসহ বছর আমার অনেক কাজে লেগেছে। তলায় তলায় একটা আগ্রহ বোধহয় কোনোভাবে তৈরি হয়েছিল। যার জোরে বিজ্ঞান আজো আমার মতো করেই না জেনে একরকম চর্চারও বিষয়। অঙ্কের কথায় একটু পরে আসছি।

কিন্তু যেজন্য আমার ওই ব্যর্থ পর্বের কাছেও আমার ঋণ রয়ে গেছে সে-কথা বলি। আমার ধারণা জন্মেছে যে, কোনো একটা বিষয়ে আদৌ আমার ছোঁয়া লাগল না আর ছোঁয়াছুঁয়ি হলো কিন্তু তার বেশি কিছু হলো না, এ-দুয়ের মধ্যে খুব তফাৎ আছে। আমরা যাকে এক্সপোজার বলি সেই এক্সপোজার মূল্যবান। না শিখতে পারলেও। শুধু লেখাপড়া নয়, আমার মনে হয় জীবনের সব ব্যাপারেই     এ-কথাটা মাথায় রাখা চলে।

ওই ইন্টারমিডিয়েট স্তরে আমার টান লেগেছিল জীববিজ্ঞানে। বিশেষত জুওলজিতে। প্রসঙ্গত বলি, সিটি কলেজে জীববিজ্ঞান শাখাটাই খুব জোরালো ছিল। জুওলজির যে-মাস্টারমশাই আমাদের ইভালিউশন থিওরি পড়াতেন তাঁর কাছে আমি খুব ঋণী। বিবর্তনতত্ত্বে আমার তখন রীতিমতো ঘোর লেগেছিল। এমনকি স্নাতক স্তরে জুওলজি অনার্স পড়ব কিনা এরকম চিমত্মাভাবনাও কিছুদিন আমাকে পেয়ে বসেছিল। পড়িনি। তবে ইভালিউশন, ডারউইন ইত্যাদি ব্যাপারে আমার এখনো আগ্রহ একেবারে মস্নান হয়নি।

ওই পর্বে আমার ওপরে দখল ছিল বাংলার দুজন মাস্টারমশাইয়ের। বিভূতি চৌধুরী আর নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। বিএ ক্লাসেও ওঁদের দুজনের কাছে পড়েছি। সে হিসাবে টানা চার বছরই ওঁদের পেয়েছি। আর পরেও আরো অনেকদিন পেয়েছি। নারায়ণবাবুর রাজাবাজারের বাড়িতে একসময়ে আমি নিয়মিত আড্ডা দিয়েছি। সে অনেক পরের কথা। তখন আমিও পড়াতে এসে গেছি। কিন্তু কলেজের ওই অল্পবয়সে ওঁদের কাছে সাহিত্যপাঠ অবশ্যই আমার একটা পাওয়া। বিভূতিবাবুর সে-কথা আজো কানে বাজে। কতবার কত প্রসঙ্গে বলেছি কথাটা। রাধার কী হইল অন্তরে ব্যথা। এটা আমাদের পাঠ্য ছিল। কতদিন ধরে যে বিভূতিবাবু আমাদের পড়িয়েছিলেন এই কবিতা। বৈষ্ণব-তত্ত্বের কথা বলতে আমাদের কিছু কার্পণ্য করেননি। বুঝেছি কি বুঝিনি জানি না। কিন্তু বলেছিলেন বলেই তো ঋণী। তিনি তো আমাদের সেসব বলার
কথাই ভেবেছিলেন। আমাদের রবীন্দ্রনাথের বধূও পাঠ্য ছিল। চ–দাস কোনোমতে শেষ করে বলেছিলেন, এটুকু একটা বাচ্চা কবিতা পড়াতে এতদিন সময় নিয়ে নিলাম, এখনো বধূ বাকি রয়ে গেছে। নারায়ণবাবুর পড়ানোও আমরা গোগ্রাসে গিলতাম। তাছাড়া তখন ওঁর সব গল্প-উপন্যাস নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আমাদের চোখের ’পরে। তার রোমাঞ্চ আছে না। ভালোয়-মন্দে এভাবে কেটেছিল ওই দু-বছর।

 

আসেত্ম আসেত্ম বই পড়ার ধরন কি পালটাচ্ছিল?

বই পড়ার ঝোঁক ছিল, তবে খেয়ে না খেয়ে বই আমি কোনোদিনই পড়িনি। আর তাছাড়া আমার বেজায় ঝোঁক ছিল খেলাধুলোয়।

বাহ্! এটা জানতাম না।

হ্যাঁ। ফুটবল, আথলেটিক্স, সাঁতার, এতে আমি প্রচুর সময় দিয়েছি তখন। খুব মন দিয়ে খেলতাম। হয়নি কিছু সে আমার প্রতিভার অভাব। চেষ্টার ত্রম্নটি ছিল না। ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছা ছিল, হলো না। সবার সবকিছু তো হয় না।

অঙ্কের অবস্থা ও সমস্যার কথা আগে বলেছি। খুব যে কিছু শিখতে পেরেছি তা হয়তো নয়, তবে গণিতের তত্ত্বে আমার এখনো খুব আগ্রহ আছে। লজিক আমার পছন্দের বিষয়। ইতিহাসেও আমার আগ্রহ অবশ্যই আছে, তবে সেও একটু তত্ত্বঘেঁষা আগ্রহ। আসলে আমার আগ্রহ ইতিহাসে না বলে বোধহয় বলা ভালো ইতিহাস-ভাবনায়। বিভিন্ন ঘরানার ইতিহাস চিমত্মার গুণাগুণ নিয়ে আমার যথেষ্ট উৎসাহ আছে।

অঙ্কের কথা হচ্ছিল…

হ্যাঁ, অঙ্কের কথা। শুনতে হয়তো আশ্চর্য লাগবে, কিন্তু অবাক হওয়ার কিছু নেই। আগেই বলেছি আমার দাদা ছিলেন গণিতের অধ্যাপক। তিনি জীবনের একটা বড় অংশ পড়িয়েছিলেন কলকাতার সিটি কলেজে। তিনি শুধু গণিতের ভালো ছাত্র ছিলেন তাই না, গণিতে ওঁর ছিল এক ধরনের আবেগের দায়িত্ববোধ। তাও আমাকে তিনি অঙ্কে বিশেষ কিছু করিয়ে উঠতে পারেননি। তখন আমার কাছে অঙ্ক ছিল এক রীতিমতো প্রহেলিকা। আমি কষতে গেলে কোনো অঙ্কই শুধু মেলে না তা-ই না, কোন দিক দিয়ে এগোনো উচিত হবে তার কোনো বোধগম্য হদিস তখন আমার চোখে ধরা দিত না। অথচ সেই অঙ্কই আমার দাদার হাতে, আমার অন্য মাস্টারমশাইদের হাতে, এমনকি আমার কোনো কোনো বন্ধুর হাতেও দিব্যি মোলায়েমভাবে মিলে যেত। কেন যে তখন বুঝতাম না, সে-কথা আমি খানিক বুঝেছি অনেক পরে। যেমন ট্রিগনোমেট্রির সঙ্গে পিথাগোরাসের যোগাযোগের কথা তখন আমাকে কেউ বলেনি। এরকম অনেক কথাই বুঝতে বুঝতে আমার বড় দেরি হয়ে গেছে। সে আর কী করা যাবে।

যা হোক অঙ্কের জন্য আমি ঠেকে ঠেকে একদিন গিয়ে পৌঁছলাম আমার আরেকজন মাস্টারমশাই প্রভাত সর্বাধিকারীর কাছে। তিনি কিন্তু আদৌ গণিতের অধ্যাপক ছিলেন না। তিনি ছিলেন আমার অর্থনীতির শিক্ষক। ওঁর কাছে আমি কী পেয়েছি আর কী পাইনি তার তালিকা করাই যাবে না। সংক্ষেপে এটুকু বলি যে, অর্থনীতির ব্যাপারে আমি যেটুকু যা শিখতে পেরেছি তা প্রধানত আমার এই দুজন শিক্ষকের কাছে – প্রভাত সর্বাধিকারী আর অমর্ত্য সেন। প্রভাতবাবুও সারাজীবন পড়িয়েছেন মূলত সিটি কলেজে। শেষের অনেকগুলো বছর যাদবপুরে। তবে আমি ওঁর কাছে শুরু করেছি সিটি কলেজে। আর তখন থেকে একটানা প্রায় শেষদিন পর্যন্ত ওঁর কাছে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। সঙ্গ করা যাকে বলে সে আমি বুঝেছি প্রভাতবাবুর সঙ্গে থেকে। আর ওই সঙ্গ করার ঠিক বিকল্প হয় না। স্নাতকোত্তরে পেয়েছিলাম অমর্ত্য সেনকে। তিনিও শিক্ষক হিসেবে অসাধারণ। আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের পড়াতেন গ্রোথ আর ওয়েলফেয়ার ইকোনমিক্স, যে-বিষয়টা পরে ওঁর প্রধান বিচরণক্ষেত্র হয়ে উঠবে। যে-কল্যাণমূলক অর্থনীতি তিনি আমাদের পড়াতেন ওঁর গবেষণায় তার আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট রইল না। বিষয়টার চেহারাটাই আমূল বদলে গেল। সামাজিক চয়নতত্ত্ব যে নতুন পরিপ্রেক্ষিত উপস্থাপন করল তার জনক অবশ্যই কেনেথ আরো, তবে সে-কাঠামোর প্রধান স্থপতি নিশ্চয় অমর্ত্য সেন।

প্রভাতবাবুর কথা একটু বলি। ওঁকে পেয়েছি ক্লাসে, বাড়িতে, পথেঘাটে আর সেই এক নম্বর ভবনাথ সেন স্ট্রিটে। শ্যামবাজারে এই ঠিকানাটা ছিল ওঁর লেখাপড়া আর আড্ডার ঠিকানা। আমরা প্রথমে যেতাম অবশ্যই পড়তে, পরে যেতাম আড্ডায়। কত রকমের মানুষ যে আসতেন সেখানে। শিক্ষাশীলন শব্দটা যদি বানাতে চাই খুব আপত্তি হবে? এক নম্বর ভবনাথ সেন স্ট্রিট ছিল আমাদের শিক্ষাশীলনের ঠেক। তিনি আমাকে লেখাপড়া শেখাতে শুরু করেছিলেন একেবারে গোড়া থেকে। আমার বেশ মনে পড়ে, ইকোনমিক্স অনার্সের ক্লাস আরম্ভ হওয়ারও আগে তিনি আমাকে টাউসিগ, বেনহাম জাতীয় বই নিজের সংগ্রহ থেকে দিয়ে দিতেন। বলতেন টানা পড়ে যাও। সব বুঝবে না এখনি, তবু পড়ে যাও। সব কেন, কিছুই তখন বুঝতাম কিনা জানি না। কিন্তু পরে বুঝেছি এর তাৎপর্য। হয় কি, বিষয়ের চৌহদ্দির একটা আন্দাজ তৈরি হয় এতে করে। একটা বিষয়ের কোথায় কী আছে তার একটা আবছা মানচিত্র তৈরি হতে পারে। অন্যথায় এক-একটা টপিক মাত্র পড়া হয়, সেসব জিনিস মিলেমিশে একটা কোনো মোট চেহারা পায় না। যে-কোনো আলোচনায় এই গোটা চেহারা যে কত জরুরি তা আজকের ছোট প্রশ্নের ছোট উত্তরের যুগে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের উত্তর তো অনেক ক্ষেত্রে টিক মার্কে দাঁড়িয়েছে। এই গোটা চেহারা ও মোদ্দা কথাটাকে তুলে আনার ব্যাপার আমরা প্রভাতবাবু ও অমর্ত্য সেন দুজনের কাছে এত ভালোভাবে পেয়েছি সে-কথা ভোলার নয়। আঙ্গিকের মারপ্যাঁচে একটা প্রতিপাদ্য প্রতিষ্ঠা করা এক জিনিস আর তার মর্মকথা উদ্ধার করা অন্য জিনিস।

প্রভাতবাবুর বিষয়ে আর একটা কথা বলে অন্য প্রসঙ্গে যাই। প্রভাতবাবুর মনের আগ্রহ ছিল থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স, পিয়োর ম্যাথমেটিক্স আর সেই সূত্রে ফাউনডেশন্স অব ম্যাথমেটিক্সে। একটা তপ্ত আবেগের অনুভব ছিল এই বিষয়গুলোতে। আমাদের মধ্যে সেটা তিনি বড় আন্তরিকভাবে সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। কত যত্নে কতদিন ধরে তিনি আমাদের জন্য একটা অনানুষ্ঠানিক কোর্স চালু রেখেছিলেন এসব বিষয় নিয়ে। যাদবপুরে বুধবার দুপুরে এই লেকচারগুলো হতো। বুধবারে দুটোর পরে আমরা বিভাগের সাধারণ ক্লাস রাখতাম না। আমরা যে-কয়েকজন এই কোর্সে অংশ নিতাম তারা ওই সময়টায় ঘণ্টা দু-তিন, কখনো আর একটু বেশি, ওঁর সঙ্গে কাটাতাম। তারপরে সবাই একসঙ্গে কফির আড্ডা হতো। বিভাগের আমরা জনাতিনেক থাকতাম আর আমাদের দু-একজন পুরনো ছাত্রছাত্রী। তারা অন্যান্য কলেজে পড়াত। তারপরে সন্ধ্যা নাগাদ ওঁকে ন-নম্বর বাসে তুলে দিয়ে আমরা যে-যার মতো ফিরতাম। কত জিনিস যে পেতাম সেসব আড্ডায়। আমরা সব হয়তো নিতে পারিনি, সে অন্য কথা।

আর একটা কথাও বলতে ইচ্ছা করছে। সেটা শুনলে আপনার ভালো লাগবে। ওঁর আর একটা আগ্রহের জিনিস ইংরেজি ভাষা ও উচ্চারণ। কত যে শেখাতেন আমাদের, আর কী সূক্ষ্ম ভঙ্গিতে। আমাদের একটা অলিখিত গোপন নিয়ম ছিল। আমরা বলতে গিয়ে কোনো উচ্চারণ ভুল করলে তিনি তখনই সেটা শুধরে দিতেন না। সেটা বড় অশোভন। দু-এক মিনিটের মধ্যে তিনি ওই শব্দটা ওঁর ব্যবহারে নিয়ে আসতেন। আমাদের দায়িত্ব ওঁর উচ্চারণ কান পেতে শোনা ও ঠিক করে নেওয়া। ড্যানিয়েল জোনস আর ও ই ডি দেখে তারপরে সম্ভাব্য বিকল্প উচ্চারণ নিয়ে আবার তর্ক-বিচার। অনেকদিন এমন হয়েছে তিনি বাড়ি ফিরেই আবার তখনি ফোন করেছেন। অমুক শব্দের অমুক অভিধানে একটা বিকল্প আছে। উচ্চারণ ছাড়াও কত যে প্রয়োগ আর বাগবিধি শিখিয়েছিলেন আমাদের। শিখতে পারিনি সে আমাদের প্রতিভা।

 

(হাসি) সাদা কাগজ পেলে তাতে দাগ কাটার কথা লিখেছেন একটি ভূমিকায়, কবে থেকে শুরু? শুনতে ইচ্ছা করছে।

সাদা কাগজে দাগ কাটার খেলা। হ্যাঁ, ও-ব্যাপারটা আমার ছিল বটে। এখনো খানিকটা আছে। অনেকে যেমন সাদা কাগজ পেলেই কথায় কথায় কলম দিয়ে একটা স্কেচ করে ফেলে তেমনি আর কি। আমার হাতে ছবির নামগন্ধ নেই, তাই অগত্যা। আর কলম ঘাঁটাঘাঁটির শখ বলুন, বদঅভ্যাস বলুন, সবই আছে, কিছুটা এখনো আছে। খুব ছেলেবেলায় মনে আছে বাবার একটা লাল রঙের ফাউনটেন পেন বাড়ি আনা মাত্র আমি তার সবকিছু খুলে ফেলে ভেতর থেকে নাড়িভুঁড়ি সব টেনে বের করে ফেলেছিলাম। রবার টিউব, নিব, তার নিচের পাথরসমেত সব আলাদা করে ছাড়িয়ে ফেলেছিলাম। বাবা কিছু বলেননি এটা মনে আছে। এসব প্রশ্রয় আমি পেয়েছি অনেক। বকাঝকার সমস্যা সত্যি বলতে আমাকে খুব পোহাতে হয়নি। তাই বোধহয় বয়ে গেছি। হ্যাঁ, একটা কথা। আমার এসব বাতিক খুব পুরনো। আমি দেশের বাড়িতে ছেলেবেলায় রীতিমতো তালপাতায় লিখেছি। সে-তালপাতা আমাদেরই তৈরি করতে হতো। জলে ভেজাতে হতো, তারপরে রোদে শুকোতে হতো। কালি বানাতে হতো চাল পুড়িয়ে। সে বেশ একটা লম্বা প্রক্রিয়া।

 

আচ্ছা, আমরা তো memory-কে পুনর্নির্মাণ করতে চেষ্টা করছি। পরে যখন ‘সর্ব অঙ্গে নগ্নতা নিয়ে আকাশের নীচে’ দাঁড়াতে চাইলেন, সেই স্মৃতির ভূমিকা তাতে কতখানি? সময়টা কীভাবে গৃহীত হচ্ছিল শিশু, বালক ও কিশোর সৌরীনের মনে?

দেখুন, সময়ের কথা যেটা তুলেছেন তার উত্তরে এটুকু বলব যে, কীভাবে গৃহীত হচ্ছিল, যদি আদৌ তা আমি গ্রহণ করতে পেরে থাকি, তা আমার পক্ষে বলা সত্যি শক্ত। আমার ভাবনার ধরনে আমাদের প্রমূর্ত বর্তমান খুব জরুরি, এ-কথাটা বলতে পারি। অর্থাৎ যাকে বলে here and now। আমার কাছে ইতিহাসও মূলত সেই কারণেই জরুরি। যাই দেখি সে আমিই দেখছি, এই আমিই, খ্রিষ্ট -পরবর্তী এই হাজারদুয়েক বছর পেরিয়ে এসে জ্বলন্ত অগ্নিকু–র মধ্যে দাঁড়িয়ে, তার সব তাপ-উত্তাপ গায়ে মেখে এক মূর্তিমান আমি এসবের দর্শক, আবার হয়তো অকিঞ্চিৎকর কুশীলবদের অন্তর্গতও বটে।

 

আপনি অনেক সময় স্মৃতিক-ূয়নের চেষ্টা করেছেন আলাদা করে। স্মৃতির সঙ্গে একটা বোঝাপড়া। Memory as a remedy for evil…

স্মৃতি আমার কাছে নানা অর্থে খুব বড় জিনিস। তা নিয়ে একটু-আধটু লেখারও চেষ্টা করেছি, হয়নি কিছু। স্মৃতিরোমন্থনের ব্যাপার আমার খুব আছে বলে মনে হয় না। নিকটজনের সঙ্গে বসে তার মৌতাত আমি নিশ্চয় খুব দামি মনে করি। সে-সুযোগ ঠিকঠাক কার আর কতটুকু হয়। রেগানমিক্সের বদনামে বিদ্ধ মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রেগান শেষ জীবনে অনেকদিন স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত ছিলেন। ওঁর স্ত্রী নানসি রেগান আক্ষেপে বলেছিলেন, ভেবেছিলাম অবসর জীবনে দুজনের পুরনো স্মৃতি ভাগ করে নেব। তা আর হলো কই। এমনিই হয় জীবনে।

আমি ‘সময় সংস্কৃতির তত্ত্বতালাশে’র দিকে ধীরে ধীরে আপনার চলে আসার ইতিবৃত্তকে ধরতে চাইছি। আপনি লিখেছেন ক্যালেন্ডারের সময় আর ইতিহাসের সময় সবসময় মেলে না।

ক্যালেন্ডারের সময় আর ইতিহাসের সময়। হ্যাঁ, এ দুয়ের তফাৎ তো মানতেই হয়। ক্যালেন্ডার খুব নির্বিশেষ। সূর্যগ্রহ তারা নিজেদের পথে নিজেরা ছুটে চলেছে। ক্যালেন্ডার এদের সময়ের হিসাব রেখে যায়। সে-হিসাবটাও এই পৃথিবীর সব জায়গায় একেবারে এক নয়। উত্তর গোলার্ধ, দক্ষিণ গোলার্ধ, এই হিসাবে ঋতুর ফারাক হয়। এক প্রান্তে আর এক প্রান্তে সময়ের ফারাক হয়েই থাকে। এসবই ক্যালেন্ডারের সময়ের অন্তর্গত। কিন্তু মানুষের জীবনে, মানুষের সমাজে, মানুষের ইতিহাসে সময়ের ধারণার সঙ্গে সংস্কৃতির প্রশ্ন জড়িয়ে যায়। একই ক্যালেন্ডারের সময়ে বিভিন্ন সমাজের সাংস্কৃতিক সময় এক হয় না। কোনো সমাজে যে-বয়সে মেয়েরা অরক্ষণীয়া হয়ে যায়, সেই একই সময়ে অন্য কোনো সমাজে সেই বয়সের মেয়েদের বিয়ের বয়স হয়েছে বলেই মনে করা হয় না। এটা ইতিহাসের সময়ের কথা। সামন্ততন্ত্র, পুঁজিতন্ত্র, ইতিহাসের এসব বড় বড় ঘটনার কাহিনিতে হামেশাই দেখা যায় ক্যালেন্ডারের সময় আর ইতিহাসের সময়ে বড় ফাঁক তৈরি হয়ে গেছে।

 

মার্কস কখন এলেন আপনার চিমত্মা-প্রক্রিয়ায়? মানুষকে বোঝার উপায় হিসেবে?

মার্কসের কথা প্রসঙ্গে বলি, আমি তো কখনো কোনো রাজনৈতিক দলে ছিলাম না। শুধু সভ্য ছিলাম না, এই আনুষ্ঠানিক অর্থে বলছি না কথাটা। দলের অনুগত সদস্য না হয়েও অনেকে বাইরে থেকে মনোগতভাবে কোনো রাজনৈতিক বা অন্য কোনো সংঘের অংশী হতে পারেন। যেমন রামকৃষ্ণ সংঘের গৃহী ভক্ত। সেই অর্থে আমি কোনো মার্কসবাদী কিংবা অ-মার্কসবাদী রাজনৈতিক দলের গৃহী ভক্তও ছিলাম না কখনো। তবে এটা ঠিক যে, ছাত্রবয়স থেকেই এরকম মার্কসবাদী রাজনৈতিক কর্মী অনেককেই কাছের মানুষ হিসেবে পাওয়ার সুযোগ হয়েছে আমার। আমাদের সহপাঠীদের মধ্যে কুমারেশ, অরুণ, অজিত একসময়ে আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। এঁরা অনেকেই ছাত্রনেতা, পরে শিক্ষক-নেতা। আমার সঙ্গে এঁদের অনেকের সম্পর্ক ব্যক্তিগত স্তরে খুবই কাছের। কিন্তু আমার মতিগতিও এঁরা জানতেন। কখনো ভুল বোঝাবুঝি হয়নি। পরিবারে আমার অগ্রজ ও অন্য বেশ কয়েকজন আছেন বা ছিলেন যাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কসীয় রাজনীতির মানুষ। তাঁরাও আমার মতিগতি জানেন। সেখানেও এ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। পরবর্তীকালেও কর্মজীবনে নানা স্তরে আমার অনেক মার্কসবাদী সুহৃদ ছিলেন, এখনো আছেন। সত্যি বলছি খুব সমস্যা হয়নি কখনো। আমার মতিগতির হদিস আমার কাছের লোকদের কাছে অজানা ছিল না।

মার্কস বিষয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এত করে মার্কসীয় রাজনীতির কথা তুললাম কেন তার কারণ বুঝতেই পারছেন। মার্কসের বেলাতে থিওরি আর প্র্যাকটিসের কথা এমনভাবে জড়িয়ে আছে বা তার এমন মানে আমাদের মনে গেঁথে আছে যে, এ-কথাটা ভালো করে খোলসা করে নেওয়া উচিত। আমার মার্কসের দিকে যাওয়া যে সংঘের পথে নয় এ-কথাটা পরিষ্কার করে বলা দরকার।

অল্প বয়সের দুটো কথা বলি। দাদাকে দেখতাম ওই মার্কস-এঙ্গেলসের বইগুলো নিয়ে সারাদিন নাড়াচাড়া করতে। অমন চমৎকার ছাপা-বাঁধাইয়ের অত শস্তা দামের বইয়ের আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য বটেই। সুন্দর নীল রঙের মলাট। মলাটে মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন এঁদের মুখ খোদাই করা। আর বাড়িতে তখন রাজনৈতিক কর্মী ও তত্ত্ব-প্রবক্তাদের আনাগোনা যতটুকু ছিল তার বড় অংশই মার্কসবাদী রাজনীতিতে দীক্ষিত। ফলে আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনির্ভরভাবেই মার্কসের কথাবার্তার একটা পরিবেশ পাশে তৈরি হয়েই ছিল। আমাদের বাড়ির ছাদে একবার অঞ্চলের কমিউনিস্ট কর্মী ও নিকটজনদের কাছে লোকায়ত খ্যাত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় মার্কসের তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। অনাহূত সে-সভায় পেছনের দিকে একপাশে বসে দেবীবাবুর মার্কসব্যাখ্যা সেই স্কুল বয়সে আমিও শুনেছিলাম। বুঝিনি কিছুই। কিন্তু ওই অর্থে এরকমের একটা এক্সপোজার ছিল। মনে হয় তাও আমার কাজে লেগেছিল। আর একটা ব্যাপার ছিল ওই সময়ে। সেটা একটু নেগেটিভ। ওই বড় হওয়ার মুখে মুখে দাদার সঙ্গে তো বটেই, তাঁদের বন্ধুদের সঙ্গেও আমি বেশ খোলামেলা কথাটথা বলতাম। আসেত্ম আসেত্ম তর্কও করতাম। একটা ব্যাপার আমার ভারি অদ্ভুত লাগত। জীবনের সমস্ত প্রসঙ্গে, সব সমস্যায় ওদের একটা ঝোঁক ছিল মার্কসের দৃষ্টিতে তার সমাধান সন্ধান করা। এটা আমার কাছে বেশ গোলমেলে বলেই মনে হতো। এদিকে নিজের মতো একেবারে এলোমেলোভাবে নেহাতই পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথে এক ধরনের একটা প্রবেশ হচ্ছে তখন। মনে আছে, এরকম অবস্থায় একদিন আমি এ-প্রশ্ন তুলেছিলাম : ধরা যাক চিরকুমার সভা, এর মার্কসীয় ব্যাখ্যা, এর মানে কী? আসেত্ম আসেত্ম কলেজে এসে গেছি। চোখ-কান একটু একটু খুলছে। পরে যে-জিনিসকে যান্ত্রিক মার্কসবাদ বলে ভেবেছি তার অনেক নমুনা দেখতে পাচ্ছি। সীতাংশু মৈত্রের যুগন্ধর মধুসূদন ওইরকম সময়ে বেরোচ্ছে। বেশ আগ্রহ নিয়ে পড়ে বেশ আশাহত হলাম। আমাদের ছাত্র বয়সে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে ওঁর বেশ প্রসিদ্ধি ছিল। পরিচয়ে তখন তিরিশের দশকের বাংলা কবিতা নিয়ে যেসব লেখা বেরোচ্ছে তাতেও খুব হতাশ হচ্ছি। তার আগের পর্বেই রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যেসব কা-কারখানা হয়ে গেছে তারও আন্দাজ পেয়ে গেছি। এসব ব্যাপারে বেজার হয়ে উঠছি ক্রমশ। আবার কলেজে আমাদের মাস্টারমশাইদের মধ্যে নানা অর্থে যাঁরাই বেশ ভালো তাঁরা প্রায় সকলেই চিমত্মাভাবনায়, যতটুকু বুঝতে পারি, এই ধাঁচের। আমাদের ওই সময়কার দীক্ষিত সহপাঠীরাও প্রায় এক ধাঁচের। এসব আমাদের কাছে তখন খুব মুশকিলের ব্যাপার। ব্যতিক্রম ছিলেন একমাত্র ওই প্রভাতবাবু। তা এসব নিয়ে তখন আমার খুব ঝামেলা গেছে।

তারপর বি-এর পাঠক্রম থেকে দু-একটা জিনিসে একটু সুবিধা হলো আমার। আমাদের ইকোনমিক্স তো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঙ্গে একসঙ্গে মেলানো ছিল। সেটা আমার বিবেচনায় খুব দরকারি জিনিস। রাষ্ট্র সম্বন্ধে খানিক ধারণা পেলাম। সোশ্যাল কনট্রাক্ট থিওরির সঙ্গে পরিচয় হলো। লাস্কির রচনার সঙ্গে কিছু পরিচয় হলো। এই জিনিসগুলোতে খুব উপকার হয়েছিল সুশীল সেনের কাছে পড়ে। ধীরেন সেন ছিলেন ওঁর দাদা। তাঁর কথাও তখন জানতাম। আমি পাস সাবজেক্ট পড়েছিলাম ইতিহাস। ইউরোপের ইতিহাস ছাড়াও আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসের একটা পেপার ছিল আমাদের। আমাদের ফরাসি বিপস্নব পড়াতেন শান্তিময় রায়। বিপস্নবী ইউরোপের চেহারা একটু একটু করে দেখতে পাচ্ছিলাম। আর রুশ বিপস্নবের কথা বিশ্ব ইতিহাসের পেপারে খানিকটা ছিল। আসেত্ম আসেত্ম আন্দাজ কিছুটা যেন হচ্ছিল। তখন আমি সরাসরি মার্কসে কিন্তু ঢুকিনি। এবং আমার ধারণা ঢুকেও কোনো লাভ হতো না।

সত্যি কথা বলতে কী, আমার অনেক বেশি লাভ হয়েছে যাদবপুরে মার্কস পড়ানোর সুযোগ পেয়ে। বিভাগ যে আমাকে এই দায়িত্ব দিয়েছিল তার জন্য বিভাগের কাছে আমার ঋণ আছে অবশ্যই। তার চেয়েও বেশি ঋণ আমার ছাত্রছাত্রীদের কাছে। একটা পেপারের একটা মাত্র অংশের জন্য তারা যে অতদিন ধরে আমাকে সহ্য করেছে এটা কম কথা নয়।

 

পরে আপনি গ্রামসি বিষয়ে উৎসাহী হয়েছেন, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অনুবাদ করেছেন। যে-কাজটি খুব সিরিয়াসলি করেছেন। তাঁর মধ্যে কি নতুন সূত্র পাচ্ছিলেন?

ওই মার্কস, মার্কস বিতর্ক, মার্কসবাদের ইতিহাস এসব করতে করতে ঢুকে গেলাম আর কি। গ্রামসির শতবর্ষের কাছাকাছি সময়ে জগন্নাথ চক্রবর্তী একদিন বললেন, তোমার গ্রামসিতে ইন্টারেস্ট আছে না? আমি বললাম, আছে তো তা কী? এই প্রশ্ন থেকে মদনবাবুর সঙ্গে আমার যোগাযোগ। তিনি শতবর্ষে গ্রামসির একটা বাংলা সংস্করণ করতে চান। আসেত্ম আসেত্ম শমীক আর শোভনলালের সঙ্গে মিলে একটা দল তৈরি হয়ে গেল।

 

বিমূর্ততা আপনাকে সবসময় টেনেছে… আপনার নিজের ভাবনা কি বিমূর্তের দিকে যেতে চায়? ‘চারপাশে যা যা সব ঘটছিল’ (পরিবর্তনের ভাষা, ১৯৯৩, মুখবন্ধ) তার ধারাভাষ্য পার হয়ে মানবিকতার কয়েকটি চিরকালীন প্রশ্নকে স্পর্শ করতে চাইছিল?

বিমূর্ত বিষয়ে আমার সত্যি খুব আকর্ষণ আছে। ওই যে প্রমূর্ত বর্তমানের কথা বললাম তার জন্যই আমার ধারণা আমাদের বিমূর্তের কাছে যেতে হবে। এই যে আমাদের এই মুহূর্তের আমি সেই আমিকে স্থাপিত করতে হবে। স্থাপিত করতে হবে দেশে ও কালে। তার জন্য ইতিহাস লাগবে। আসলে লাগবে ইতিহাসের দর্শন। দর্শন ছাড়া ইতিহাস থেকে কিছু বের করা যাবে না। যে-আমিকে স্থাপন করার কথা তাকেও দেখতে লাগে ইতিহাস দর্শনের দর্পণে।

 

কল্যাণরাষ্ট্রের কথা এখন কীভাবে ভাবেন… আজকের পরিস্থিতিতে?

সত্তরের দশক থেকে পৃথিবী বদলে গেছে। আরব দুনিয়ার যুদ্ধ, তেলের মূল্যবৃদ্ধি, ভিয়েতনাম যুদ্ধের পরিণতি, সব মিলিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মোটামুটি দু-দশকের যে-পরিস্থিতি সে-চেহারা ওই সময় নাগাদ বদলে গেল। মার্কিন ডলারের অবমূল্যায়ন। বিশ্বের মুদ্রা সংকট। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের চেনা দুনিয়া হারিয়ে গেল। রাষ্ট্রের গায়ে তখনই হাত পড়তে আরম্ভ করেছে। রল্‌স্‌, নজিক্‌ প্রভৃতির নৈতিক দর্শনে ন্যূনতম রাষ্ট্রের চিমত্মা প্রশ্রয় পেয়েছে। নীতিপ্রণেতাদের হাতে রাষ্ট্রের ব্যয় কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের কথা উঠে এসেছে। রাষ্ট্রের তরফে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার হাওয়া উঠেছে। নববইয়ের দশকে বিশ্বায়ন এসে পড়ল। তার পরে সব চেনা আদল প্রায় ঝড়ের বেগে উড়ে গেল। ইতোমধ্যে নতুন প্রযুক্তি জোরকদমে এগিয়ে এলো।

রাষ্ট্রকে ছোট করে আনতে হবে, তাকে কমিয়ে আনতে হবে, এই মন্ত্রে আমাদের পৃথিবীতে কল্যাণরাষ্ট্রের ওপরেই কোপ পড়বে। কেননা সামরিকতা থেকে আমরা একচুলও সরিনি, সরতে পারব না। প্রতিপক্ষ সেদিন ছিল সোভিয়েত জোট, আর আজ আছে সন্ত্রাসবাদ। এন্ড অব হিস্ট্রির ভাবুকেরা তারও পরে আরো এগিয়ে গেছেন কট্টর রাষ্ট্রের ভাবনায়। যে-কোনোরকমের উদারনৈতিক ভাবনায় এখন দারুণ অনটন। রাষ্ট্রকে বাঁধতে হবে শক্ত বাঁধনে। আমাদের ভারতে এখন এ-জিনিসের মহড়া চলছে জোরকদমে।

সামাজিক কাঠামোতে ও ব্যক্তিজীবনে ওলটপালট দেখা দিয়েছে। এই ঘূর্ণির মধ্যে আছি এখনো। আরো দেখা বাকি আছে।

বামপন্থীরা এখনো আশা ছাড়েননি…

এই প্রবণতার বিপরীতে যাঁরা বামপন্থার কথা এখনো ভাবেন আমার মনে হয় তাঁরা এখনো এই ব্যাপারটায় মোহমুক্ত হতে পারেননি যে, বামপন্থার লক্ষ্য আসলে যে-পাখির চোখে নিবদ্ধ তা হলো নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রক্ষমতা। যাকে ডেলিভার করা বলে তাই যদি একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হয় তাহলে এরকম চিমত্মা প্রায় অনিবার্য। অন্য কিছু ভাবতে গেলে অন্যরকমের দিগ্দর্শন লাগবে। সমাজমনে তার গ্রাহ্যতা এখনো বেশি দেখি না। সোভিয়েততন্ত্রের ব্যর্থতার সঙ্গে মার্কসবাদের ব্যর্থতা ধারণাগতভাবে জড়িয়ে ফেলার কোনো কারণ নেই। পণ্য সমাজের বিশেস্নষণে যে-অন্তর্দৃষ্টি মার্কসের রচনায় পাওয়া যায় তার জোর সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের সঙ্গে কমে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। উত্তর-আধুনিক তাত্ত্বিকদের কেউ কেউ মনে করেন আজকের পণ্য সমাজের চরিত্র এত আলাদা যে, সেখানে মার্কসের ভূমিকা আর বড় বেশি অবশিষ্ট নেই। এও মনে হয় একধরনের যান্ত্রিক চিমত্মার প্রকাশ। একটা প্রাক-নির্মিত মার্কসের তত্ত্বকাঠামো হাতে নিয়ে এসে এই এখনকার বর্তমানের সব হদিস পেয়ে যাব ভাবা ভুল। কিন্তু প্রসারিত দৃষ্টিতে মার্কসকে ব্যবহার করতে চাইলে মনে হয় সে অবকাশ নিঃশেষিত হয়নি।

 

আপনার চিমত্মার বিকাশে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তো একটা ভূমিকা আছে বিশ্বাস করি। অন্তত কয়েকজন বন্ধুর… শঙ্খ ঘোষ, অমিয় দেব, স্বপন মজুমদার, সুবীর রায়চৌধুরী… এঁদের।

যাদবপুরের বন্ধুদের কথা বলছেন। একদম শুরুতে একটা কথা বলি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অবসরের সময় হলে আনুষ্ঠানিকভাবে একটা চিঠি আসে। তাতে বেশ ভালোভাবে অবসরের আগাম দিনক্ষণ জানিয়ে কাজের জন্য ধন্যবাদ জানানো হয়। অবসর-পরবর্তী কাগজপত্র কীভাবে কী তৈরি করতে হবে এসব কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। আমি সে-চিঠির উত্তরে আমাদের রেজিস্ট্রারকে ধন্যবাদ দিয়ে জানিয়েছিলাম যে, আমার জীবনের একটা শ্রেষ্ঠ সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে গেলাম। সেখানে আমার বন্ধুদের কথা ও ছাত্রদের কথা মনে রাখতেই হবে। কথাটা শুধু ভদ্রতা করে বলিনি তখন। আমার নামি ছাত্ররা তো আছেই। অন্যদের অনেকের কথা মনে রাখার যথেষ্ট কারণ আছে। সেসব কথা পরে হবে কোনো সময়ে। আর বন্ধুদের মধ্যে আপনি যাঁদের কথা বললেন তাঁরা তো আছেনই। তাঁদের বন্ধু হিসেবে একটা জীবনে পাওয়া, এটাই তো অনেক। এর বাইরেও আরো অনেকে আছেন। কেউ কেউ এখন অসুস্থ। আমাদের সবারই সময় কমে আসছে। বন্ধুদের নাম করে বলতে গেলে বলা শেষ হবে না। একটা অনুভবের কথা বলি। আমরা এখনো মাঝে মাঝে নিজেরা বলি সে-কথা। আমরা বোধহয় অনেক উলটোপালটা ঢেউ কোনোরকমে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে পেরেছি। আর সে-ব্যাপারে অজান্তে একজন হয়তো আর একজনকে কোনোভাবে পাশে পেয়ে গেছি। আর কী বলব বলুন তো।

শিক্ষাব্যবস্থাটা মুখ থুবড়ে পড়ার উপক্রম হচ্ছিল বহু বছর ধরে। এখন খুব একটা আশা আর দেখি না। বুদ্ধিমান ছাত্রছাত্রী এখনো আছে, কিন্তু সেটা নিজেদের গুণে, আমরা তাদের প্রতি সুবিচার করিনি।

খুবই জরুরি কথা কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ইতোমধ্যে যেখানে পৌঁছে গেছি আমরা, তাতে এ-নিয়ে আর কথা বলার বেশি জায়গা আছে কিনা তা-ই প্রশ্ন। শুরুতে হালকাচালে একটা কথা বলে নিই। আমি যেদিন অবসর নিই সেদিন আমার এক তরুণ বন্ধু সহকর্মী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মোট কতদিন পড়ালেন, স্যার? আমি বলেছিলাম, সাড়ে আটত্রিশ বছর। ব্যাপারটা যা করে দিয়ে গেলাম এ-বাঁচানো আর তোমাদের সাধ্যে কুলোবে না। তখনো বোধহয় তত বুঝিনি যে, কথাটা কতটাই সত্যি হয়ে দাঁড়াবে।

কথাটা দুঃখের। অবশ্যই লজ্জারও। কী অন্যায়টাই না আমরা করে চলেছি সবাই মিলে, আগাগোড়া, সব স্তরে। কথাটা সরকার, ইউ জি সি এরকম উঁচু মহল থেকে আরম্ভ করে একেবারে কে জি স্তর পর্যন্ত ঘোর সত্যি। তার মধ্যে আমরা শিক্ষকেরা রীতিমতো জড়িয়ে আছি খুবই অন্তরঙ্গভাবে। তবে এটাও ঠিক যে, এসব স্তরে এমন অনেকেই আছেন যাঁদের বেলায় এরকম ক্ষোভের অভিযোগ তোলার কোনো অবকাশ নেই। কিন্তু শুধু ব্যক্তিগতভাবে বালির বাঁধ বেঁধে আর কী হবে। আমাদের চিমত্মাভাবনার গোড়ায় পোকা লেগে গেছে।

শিক্ষা বলতে ভেবেছি পরীক্ষা। পরীক্ষা বলতে ভেবেছি নম্বর। আর নম্বরের জন্য আছে কোচিং। তা এখন অত্যন্ত সংগঠিত। তার হাতও অনেক লম্বা। নীতি-অনীতির প্রশ্ন অবান্তর। বৃহৎ পুঁজি এখন শুধু কে জি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব স্তরে বিনিয়োগ করা হয় তাই না। ওই পুঁজি থেকেই কোচিং প্রতিষ্ঠানগুলোও পুষ্টি পেয়ে থাকে। সেসব প্রতিষ্ঠান আজ প্রায় মূল প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে। ভালো ভালো স্কুলেও আজ অনেক ক্লাসের দিকেই ছাত্রছাত্রীদের কোনো গরজ থাকে না। তারা কোচিংনির্ভর হয়ে পড়ে। এখনো কিছু কিছু ব্যতিক্রম আছে নিশ্চয়। সেটুকুই যা ভরসা। লেখাপড়াকে আবার লেখাপড়াতেই ফিরিয়ে আনতে হবে।

নীতিপ্রণেতারা এমন এমন কা- করছেন মাঝে মাঝে যে, তা অবাক করার মতো। বাংলামাধ্যম বনাম ইংরেজিমাধ্যম, এই একটা নাটক আমরা সবাই মিলে যে-যত্নে প্রযোজনা করলাম তা নিয়ে অল্প কথায় কিছু বলা অসম্ভব। এই বাংলাতেই বাংলা শিখেও ইংরেজি শিখেছিল এককালের ছাত্রছাত্রীরা। ভাবা তো দরকার যে, কী হলো। হয় ইংরেজি, নয় বাংলা, এরকম একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো কীভাবে। এসব কথায় মন দেওয়ার দরকার আছে আমাদের। এরকম আলোচনায় তো মীমাংসা হওয়ার নয়।

কোনোদিক থেকেই আজ পৃথিবীতে মানুষের অবস্থা ভালো নয়। বামের বিপর্যয়, ধনতন্ত্রের স্ফীতি, এক ছদ্ম-বিশ্বায়ন, ধূর্তভাবে পরিকল্পিত ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সমস্যা… মানুষ তবে কী করবে?

আপনার শেষ কথা। একজন চিমত্মাশীল অনুভূতিশীল মানুষের কথা। উদ্বেগে দুঃখ পাওয়া ছাড়া তার আর কী করার থাকে।

হতাশ হব না। দেখা যাক।  r