অনুবাদ : সুমনা লতিফ

সর্বোপরি আদর্শ আবহাওয়া বিরাজ করছিল। তারা যদি ফরমাশ না করত তাহলে উদ্যান-মিলনের এমন সুন্দর দিন তারা আর পেত না। আবহাওয়া ছিল বাতাসহীন, উষ্ণ এবং আকাশে এক টুকরো মেঘও ছিল না। গ্রীষ্মের প্রথমদিকে মাঝে মাঝে যেমন নীল আকাশ হালকা সোনালি রঙের আবছায়ায় আবৃত থাকে আকাশের অবস্থা ঠিক তেমনটিই দেখাচ্ছিল। মালি প্রত্যুষে উঠেছেন, লনের বিচালি পরিষ্কার করছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না ঘাস এবং ডেইজি ফুলের চারা, যেগুলো গাঢ় সমতল গোলাপাকৃতির খোদাই করা পাথরে বোনা হয়েছে তা উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। গোলাপ ফুলের ক্ষেত্রে, তুমি এ-ধরনের ধারণা না করে পারবে না যে, উদ্যান-মিলনের আয়োজকেরা এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে, উদ্যান-মিলনে যারা আমন্ত্রিত হয়ে আসে গোলাপ ফুলই একমাত্র ফুল যা সবাইকে মুগ্ধ করে; এটি একমাত্র ফুল যা সবাই চেনে। শতাধিক, হ্যাঁ, শাব্দিক অর্থে শতাধিকই, একরাতে ফুটল; সবুজ জঙ্গল এমনভাবে নুয়ে অভিবাদন জানাল যা দেখে মনে হচ্ছিল দেবদূতেরা যেন এখানে এসেছিলেন। 

সকালের নাস্তা শেষ করার আগেই তাঁবু স্থাপন করার লোকেরা এলো। 

‘মা, আপনি তাঁবুটি কোথায় স্থাপন করতে চান?’

‘আমার প্রিয় সন্তান, আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করা বৃথা। ছেলেমেয়েরা, আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে, এ-বছর আমি তোমাদের ওপর সবকিছু ছেড়ে দেব। আমি যে তোমাদের মা, তা ভুলে যাও। আমার সঙ্গে একজন সম্মানিত অতিথির মতো আচরণ করো।’

কিন্তু মেগ সম্ভবত যেতে পারলেন না এবং লোকেদেরও তত্ত্বাবধান করতে পারলেন না। তিনি নাস্তা করার আগে তাঁর চুল ধুয়েছিলেন এবং একটি সবুজ রঙের হ্যাট তাঁর মাথায় শোভা পাচ্ছিল। তিনি বসে বসে কফি পান করছিলেন, তাঁর গাঢ় ভেজা কোঁকড়া চুল দু-গালের দু-পাশে আটকে ছিল। জোসে, যাকে প্রজাপতি বলে ডাকা হতো, সে সবসময় সিল্কের একটি পেটিকোট এবং একটি কিমোনো জ্যাকেট পরে নিচতলায় নেমে আসত।

‘লরা, তোমাকে যেতে হবে; কারণ একমাত্র তোমারই নান্দনিক সৌন্দর্যবোধ রয়েছে।’

লরা, যার হাতে তখনো রুটি-মাখনের টুকরো ধরা ছিল, মনে হলো যেন উড়ে চলে গেল। খাবারটি এতো সুস্বাদু হয়েছে যে বাড়ির বাইরে খাওয়ার এটি একটি অজুহাত হতে পারে, পাশাপাশি, লরা বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে ভালোবাসত; সে সবসময় অনুভব করত অন্য যে-কারোর চেয়ে এ-কাজ সে অনেক ভালোভাবে করতে পারবে।

বাগানের পথে হাতাকাটা শার্ট পরিহিত চারজন লোকের একটি গ্রুপ দাঁড়িয়ে ছিল। তারা একটি কাঠের টুকরো বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, যেখানে অনেক তৈলচিত্র ছিল এবং তাদের পিঠে যন্ত্রপাতি নেওয়ার ব্যাগ ছিল। তাদের দেখতে ভালো লাগছিল। 

লরার মনে হচ্ছিল, তার কাছে যদি মাখন-রুটি না থাকত; কিন্তু মাখন-রুটি রাখার কোনো জায়গা ছিল না এবং সে মাখন-রুটি ছুড়েও ফেলতে পারছিল না। তার মুখ রক্তিম হয়ে উঠল এবং সে কঠোর ভাব বজায় রাখার চেষ্টা করছিল। সে যখন লোকেদের কাছে এলো তখন তাকে কিছুটা ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন মনে হচ্ছিল। 

তার মায়ের গলা অনুকরণ করে সে তাদের বলল, ‘সুপ্রভাত।’ কিন্তু তার গলার আওয়াজ তার মায়ের গলার আওয়াজকে এমন অবিকলভাবে নকল করল যে সেটি রীতিমতো ভীতিকর শোনাল এবং সে লজ্জিত হলো। সে একটি ছোট মেয়ের মতো তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘ওহ্, আপনারা এসেছেন Ñ এটি কি তাঁবু সম্পর্কিত?’ 

লোকেদের মধ্যে যে-লোকটি সবচেয়ে লম্বা, কৃশ এবং মুখে যার দাগ ছিল, সে উত্তর দিলো, ‘মিস, আপনি ঠিকই ধরেছেন।’ লোকটি তার যন্ত্রাংশে ভরা ব্যাগটি তুলে ধরল, তার খড়ের হ্যাটটি টোকা দিয়ে ঘুরিয়ে নিল এবং লরার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘আমরা তাঁবুসম্পর্কিত ব্যাপারেই এসেছি।’

তার হাসি এতো সহজ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল যে, লরা স্বাভাবিক হতে পারল। তার চোখগুলো কী সুন্দর, ছোট; কিন্তু কী গাঢ় নীল! এখন সে অন্যদের দিকে তাকাল। তারাও তার দিকে তাকিয়ে হাসছিল। তাদের হাসি দেখে মনে হচ্ছিল, তারা যেন বলতে চাইছে, ‘প্রফুল্ল হও, আমরা কামড়াতে আসিনি।’ কী সুন্দর কর্মীবাহিনী! কি সুন্দর সকাল! তার সকালের কথা বলা উচিত হয়নি; তার ব্যবসায়ীসুলভ মনোভাব বজায় রাখতে হবে। তাঁবু।

‘লিলিফুলের লন নিয়ে আপনারা কি কিছু ভেবেছেন? এটার জায়গা কি ঠিক আছে?’

সে লিলি-লনের দিকে হাত দিয়ে নির্দেশ করল এবং সেই হাতে রুটি-মাখন ধরা ছিল না। তারা ঘুরে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে

থাকল। একটি ছোট মোটা লোক তার জিহ্বা বের করল এবং লম্বা লোকটি ভুরু কোঁচকাল।

সে বলল, ‘আমি অলীক কোনো কিছু ভাবছি না।’ ‘এটি যথেষ্ট দর্শনীয় নয়। সত্যি বলতে কি, তাঁবুসম্পর্কিত বিষয় বলে বলছি’ Ñ একথা বলে সে তার স্বাভাবিক ছন্দে লরার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি যে-জায়গায় তাঁবু স্থাপন করতে চাচ্ছেন সেটি আপনার চোখে প্রচণ্ড আঘাতসহ

থাপ্পড় মারার সমতুল্য হবে, কাজেই অনুগ্রহ করে আমার কথা শুনুন।’   

লরা যেভাবে বেড়ে উঠেছে তাতে লোকটির কথায় সে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল এবং ভাবল, এটা কি ঠিক যে একজন সাধারণ কর্মী তার সঙ্গে এভাবে আচরণ করবে, তাকে চোখে আঘাতসহ থাপ্পড় মারার কথা বলবে; কিন্তু লরা তাকে ঠিকই অনুসরণ করল। 

সে পরামর্শ দিলো, ‘টেনিস কোর্টের একটি কর্নারে তাঁবু স্থাপন করা যেতে পারে।’

‘কিন্তু ব্যান্ডের দল এক কর্নারে

থাকবে।’ 

কর্মীদের একজন বলল, ‘হুম্, আপনারা ব্যান্ডের গানের আয়োজন করছেন, করছেন কি?’ লোকটির মুখ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। তার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ ছিল, তার গাঢ় চোখ পুরো টেনিস কোর্টটি তন্নতন্ন করে দেখল। লোকটি কী ভাবছে?

লরা ভদ্রভাবে বলল, ‘শুধু একটি ছোট ব্যান্ড অংশগ্রহণ করবে।’ ব্যান্ডটি ছোট হলে হয়তো সে কিছু মনে করবে না। কিন্তু লম্বা লোকটি বলে উঠল, ‘এদিকে দেখুন, মিস, জায়গাটি ওটিই। ওই গাছগুলোর আড়ালে। ওই যে ওখানে। ওটিই ভালো জায়গা।’ 

কারাকা গাছের আড়ালে। তাহলে কারাকা গাছগুলো ঢাকা পড়ে যাবে। গাছগুলো এত সুন্দর, গাছের পাতাগুলো চওড়া, চিকচিকে এবং একগুচ্ছ হলুদ ফল সেখানে ধরে আছে। তোমার কল্পনায় মরুভূমিতে যেসব গাছ জন্মায় সেসব গাছের মতোই এসব গাছ একাকী, গর্বিত চিত্তে তাদের পাতা উঁচিয়ে ধরেছে এবং এক ধরনের নীরব উজ্জ্বলতায় ফলগুলোও সূর্যের দিকে নিজেদের মেলে ধরেছে। তাঁবু দিয়ে তাদের ঢেকে দেওয়া কি ঠিক হবে?

সেটাই করা হবে। ইতোমধ্যে লোকেরা কাঁধে করে কাঠের টুকরো বয়ে নিয়ে গেছে এবং সেগুলো রাখার জায়গা করেছে। শুধু লম্বা লোকটিই সবার থেকে আলাদা পড়ে গেছে। সে নিচু হলো, চিমটি দিয়ে ফ্যাকাসে বেগুনি রঙের সুগন্ধি ফুল তুলল, তার বৃদ্ধাঙ্গুল এবং তর্জনী নাকের কাছে আনল এবং গন্ধ শুঁকল। লরা যখন তার ওই ভঙ্গি দেখল তখন সে কারাকা গাছ সম্পর্কে সবকিছু ভুলে গেল এবং লোকটির ওই সমস্ত জিনিসের প্রতি মমতা Ñ যেমন ফ্যাকাসে বেগুনি ফুলের গন্ধের জন্য মমতা Ñ দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। সে যাদের চেনে তাদের মধ্যে কতজন লোক এ-ধরনের কাজ করবে? সে চিন্তা করল, ওহ্, কি অসাধারণ সুন্দর এই কর্মীবাহিনী। যেসব তুচ্ছ ছেলেদের সঙ্গে সে নাচে এবং রবিবার রাতে যারা রাতের খাবার খেতে আসে, তাদের থেকে সে তার বন্ধুদের জন্য এ-ধরনের কর্মীবাহিনী কেন পেতে পারে না? সে এ-ধরনের লোকদের সঙ্গে চলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

এগুলো অযৌক্তিক শ্রেণিবিভাজনের ফল বলে সে স্থির করল এবং ঠিক সেই সময়ই লম্বা লোকটি একটি খামের পেছন থেকে কিছু একটা বের করল, যেটি লুকোনো যেত অথবা ঝোলানোর জন্য ফেলে রাখা যেত। যাই হোক, তার দিক থেকে সে এসব আমলে নেয় না। কোনো ক্ষুদ্র অংশও নয়, অ্যাটম বোমার মতো বড়োও নয় … কাঠের হাতুড়ির ঠকঠক শব্দ ভেসে আসতে লাগল। কেউ একজন শিস দিলো, কেউ একজন গান গেয়ে উঠল, ‘তুমি কি ওখানে, মেটি?’ ‘মেটি!’ তাদের এই বন্ধুতা তার মধ্যে সুখবোধ জাগরিত করল। সে লম্বা লোকটিকে Ñ নিজের বাড়িতে আছে Ñ এরকম অনুভূতি দেখানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে করল এবং তাদের এই বন্ধুসুলভ আচরণের জন্য সে অসভ্য প্রথাগুলোকে অবজ্ঞা করতে পারল। লরা তার রুটি-মাখনে একটি বড় কামড় বসাল এবং ক্ষুদ্রাকৃতির শিল্পকর্মটির দিকে তাকিয়ে থাকল। তার নিজেকে একজন কর্মজীবী মেয়ে বলে মনে হচ্ছিল।

বাড়ি থেকে একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘লরা, লরা তুমি কোথায়? টেলিফোন, লরা!’

‘আসছি!’ বলে লরা যেন লন, রাস্তার ওপর দিয়ে, সিঁড়ির ওপর, বারান্দার এপার থেকে ওপারে এবং উঠোন পর্যন্ত উড়ে গেল। হলঘরে তার বাবা এবং লরি অফিসে যাওয়ার জন্য তাদের হ্যাট ব্রাশ করছিল। 

লরি খুব দ্রুত বলল, ‘লরা, আমি বলছি, তুমি বিকেলের আগে আমার কোটটিতে চোখ বুলিয়ে নিতে পারো। দেখো, কোটটি ইস্ত্রি করার প্রয়োজন আছে কি না।’  

সে বলল, ‘আমি দেখব।’ হঠাৎ সে নিজেকে থামাতে পারল না। সে লরির দিকে দৌড়ে গেল এবং তাকে ছোট কিন্তু দ্রুত একটা চাপ দিলো। লরা শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘ওহ্, আমি পার্টি ভালোবাসি, তুমি ভালোবাসো না?’

লরির উষ্ণ, যুবকসুলভ কণ্ঠস্বর বলে উঠলো, ‘তার চেয়ে’, এই বলে সে তার বোনকে একটু চাপ দিলো এবং তাকে নম্রভাবে একটু ধাক্কা দিলো। ‘ওহে মেয়ে, টেলিফোনটা তাড়াতাড়ি রেখে দাও।’

টেলিফোন। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ; ওহ্, হ্যাঁ, কিটি? সুপ্রভাত, প্রিয়। লাঞ্চে আসবে? এসো, প্লিজ। আমি খুশি হবো। ঘরে যা কিছু ছিল তাই দিয়ে খাবার বানানো হয়েছে Ñ মচমচে স্যান্ডউইচ, ভাঙা ডিমের সাদা অংশের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে তৈরি একধরনের মিষ্টান্ন এবং বাকি যা কিছু ফেলনা তা দিয়ে তৈরি খাবার। আচ্ছা, আজকের সকালটি তার নিজস্ব রূপে প্রতিভাত নয় কি? কি বলো তুমি? এক মিনিট Ñ টেলিফোনের লাইনটি ধরো। মা ডাকছে।’ লরা ঘুরে বসল। ‘কী বলছ, মা? শুনতে পাচ্ছি না।’ 

সিঁড়ির নিচ থেকে মিসেস শেরিডানের গলার আওয়াজ ভেসে এলো। তিনি বললেন, ‘তাকে বলো গত রবিবার যে মিষ্টি হ্যাটটি সে পরেছিল সেটা পরেই যেন আসে।’

‘মা তোমাকে গত রোববার যে মিষ্টি হ্যাটটি পরেছিলে তা পরে আসতে বলছে। ভালো। বেলা একটায় দেখা হবে। বিদায়।’  

লরা টেলিফোন রিসিভারটি রেখে দিলো, তার মাথার ওপর দিয়ে বাহু ঘুরিয়ে নিল, গভীর একটি শ্বাস নিল, হাতগুলো টান টান করল এবং ছেড়ে দিলো। সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, ‘হুহ্’ বলল এবং দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার পরমুহূর্তেই সে দ্রুত উঠে বসল। সে স্থিরভাবে বসে শুনছিল। বাড়ির সব দরজা মনে হলো খুলে গেল। বাড়িটি মৃদু, দ্রুতলয়ের পায়ের আওয়াজ এবং চলমান কথাবার্তায় মুখর ছিল। সবুজ রঙের বেইজের দরজা, যেটি রান্নাঘরের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল, তা হঠাৎ খুলে গেল এবং চাপা একটি আওয়াজের সঙ্গে বন্ধ হলো। এখন সেখান থেকে চাপা হাসির লম্বা ও অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। ভারী পিয়ানোটি তার শক্ত চাকার ওপর ভর করে অন্যত্র সরানোতে এরকম আওয়াজ হচ্ছিল। কিন্তু বাতাস! তুমি যদি খেয়াল না করো তাহলে বাতাস কি সবসময় এরকম ছিল? বাইরে জানালার ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছিল ছোট মৃদুমন্দ বাতাস একে অপরকে ধাওয়া করছে। সূর্যের ক্ষুদ্র দুটি আলোকবিন্দু জানালা ভেদ করে ভেতরে এসে প্রবেশ করেছিল, একটি দোয়াতদানির ওপর, আরেকটি রুপোলি রঙের ছবির ফ্রেমের ওপর। প্রিয় ক্ষুদ্রাকৃতির আলোকবিন্দু। বিশেষ করে, দোয়াতদানির ঢাকনার ওপর যেটা এসে পড়েছিল। এটি ছিল অনেক উষ্ণ। একটি উষ্ণ ছোট রুপোলি তারা। তার মনে হচ্ছিল, সে এটাকে চুম্বন করবে।

সদর দরজায় ঘণ্টা বাজল এবং সিঁড়িতে সাদির প্রিন্টেড স্কার্টের খসখসে আওয়াজ ভেসে এলো। একজন ভদ্রলোকের মৃদু গলার আওয়াজ শোনা গেল; সাদি উদাসভাবে উত্তর দিলো, ‘আমি নিশ্চিত, আমি জানি না। অপেক্ষা করুন। আমি মিসেস শেরিডানকে জিজ্ঞেস করছি।’  

লরা হলঘরে এলো এবং জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে, সাদি?’ 

‘মিস লরা, ফুল সাজানোর লোক এসেছে।’

ঠিক, তাই। দরজার ভেতরের দিকে, একটি চওড়া, অগভীর ট্রেতে গোলাপি রঙের লিলি ফুলের গুচ্ছ সাজানো রয়েছে। অন্য কিছু নয়। লিলি ফুল ছাড়া আর কোনো ফুল নয় Ñ ক্যানা লিলি, বড় গোলাপি ফুল, উজ্জ্বল গাঢ় লাল বোঁটার ওপর ফুলগুলো ভয়ঙ্করভাবে জীবন্ত লাগছিল।

লরা বলল, ‘ওহ্, সাদি!’ এবং শব্দটি একটি ছোট গোঙানির মতো শোনাল। সে সোফায় এমনভাবে নিজেকে এলিয়ে দিলো যে মনে হচ্ছিল, সে যেন লিলি ফুলের আভায় নিজেকে উষ্ণ করতে চাইছে। তার মনে হলো, ফুলগুলো যেন তার আঙুলের ভেতর, তার ঠোঁটের ওপর, তার বুকের ভেতর বেড়ে উঠছে।

সে মূর্ছিতের মতো বলল, ‘একটা কিছু ভুল হয়েছে। কেউই এত ফুলের ফরমাশ দেয়নি। সাদি, যাও এবং মাকে খুঁজে বের করো।’

কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে মিসেস শেরিডান তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন।

তিনি শান্তভাবে বললেন, ‘ঠিক আছে। হ্যাঁ, আমি ফুলের ফরমাশ দিয়েছিলাম। ফুলগুলো সুন্দর নয়?’ তিনি লরার বাহুতে চাপ দিলেন। ‘গতকাল আমি দোকানটির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম এবং জানালার ভেতর দিয়ে ফুলগুলো দেখতে পেলাম। আমার হঠাৎ মনে হলো, জীবনে একবারের জন্য হলেও আমি অনেক ক্যানা লিলির অধিকারী হতে পারব। উদ্যান-মিলন এর উপযুক্ত জায়গা হতে পারে।’    

লরা বলল, ‘কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, তুমি বলেছিলে যে, তুমি উদ্যান-মিলন আয়োজনে হস্তক্ষেপ করবে না।’

সাদি চলে গেল। ফুলের লোক তখনো বাইরে তার ভ্যানগাড়িতে অপেক্ষা করছিল। লরা তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল এবং খুব নম্রভাবে তার মায়ের কানে কামড় দিলো।

‘ডার্লিং মা, তুমি নিশ্চয়ই একজন যুক্তিবাদী মা পছন্দ করবে না, করবে কি? এটা আর কখনো কোরো না। লোকটি আসছে।’ 

লোকটি আরো এক ট্রে-ভর্তি লিলি ফুল নিয়ে এলো।

মিসেস শেরিডান বললেন, ‘অনুগ্রহ করে উঠোনের দুপাশে দরজার ভেতরের দিকে ফুলগুলো স্তূপ করে রাখুন। তুমি কি বলো, লরা?’

‘হ্যাঁ, মা, আমিও তোমার সঙ্গে একমত।’

বসার ঘরে, মেগ, জোসে এবং ছোট্ট হ্যান অবশেষে পিয়ানোটি সরাতে সফল হলো।

‘তুমি কী বলো, এখন আমরা যদি এই গদি আঁটা সোফাগুলো দেয়ালের ওপাশে রাখি এবং শুধু চেয়ারগুলো রেখে বাকি সবকিছু ঘরের বাইরে নিয়ে যাই, তাহলে কেমন হয়?’

‘ঠিক আছে।’ 

‘হ্যান্স, ধূমপান করার ঘরে এই টেবিলগুলো সরিয়ে নিয়ে যাও এবং একজন জমাদারকে ডাকো যে কার্পেটের ওপর থেকে চিহ্নগুলো তুলে ফেলবে Ñ এক মিনিট, হ্যান্স Ñ’ জোসে চাকরদের আদেশ করতে ভালোবাসত এবং চাকররাও তার আদেশ মেনে চলতে পছন্দ করত। সে সবসময় তাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করত যে তাদের মনে হতো, তারা যেন কোনো নাটকে অংশ নিচ্ছে। 

‘খুব ভালো, মিস জোসে।’

সে মেগের দিকে ঘুরে তাকাল, ‘পিয়ানোর বাজনা কেমন হয় আমি তা শুনতে চাই, এটা এ-কারণে যে, হয়তো এই বিকেলে আমাকে গান গাইতে বলা হতে পারে। ‘এই জীবন ক্লান্তিময়’  গানটি আমরা গাইতে চেষ্টা করতে পারি।’

পম! টা-টা-টা-টি-টা! পিয়ানোর আওয়াজ এত মনোরম শোনাল যে জোসের মুখের ভাবে পরিবর্তন এলো। সে হাততালি দিলো। যখন গায়কদল গান গাইতে গাইতে ঘরে প্রবেশ করল তখন সে করুণভাবে এবং হেঁয়ালিভরে তার মায়ের দিকে এবং লরার দিকে তাকাল। 

এই জীবন ক্লান্তিময়,

একটি ক্রন্দন Ñ একটি দীর্ঘশ্বাস,

ভালোবাসা যা পরিবর্তনশীল,

এই জীবন ক্লান্তিময়,

একটি ক্রন্দন Ñ একটি দীর্ঘশ্বাস।

ভালোবাসা পরিবর্তনশীল,

এবং তারপর … বিদায়!

যদিও পিয়ানোর আওয়াজ আগের চেয়ে আরো বেশি বেপরোয়া শোনাল; কিন্তু ‘বিদায়’ শব্দটি বলার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখাবয়ব একটি উজ্জ্বল, ভয়ানকভাবে অসহানুভূতিপূর্ণ হাসিতে ভেঙে পড়ল। 

সে লাল হয়ে বলে উঠল, ‘আমার গলা ভালো, তাই না, মা?’

এই জীবন ক্লান্তিময়,

আশা মরে যায়।

একটি স্বপ্ন Ñ একটি জাগরণ

কিন্তু এখন সাদি তাদের কথোপকথনে বাধা দিলো। ‘কী হয়েছে, সাদি?’

‘মা তুমি অনুগ্রহ করে বলবে কি, রাঁধুনী জিজ্ঞেস করছিল, স্যান্ডউইচের জন্য বার্চ আনা হয়েছে কি না?’

মিসেস শেরিডান স্বপ্নের মতো অনুরণন করলেন, ‘স্যান্ডউইচের জন্য বার্চ, সাদি?’ ছেলেমেয়েরা তাদের মায়ের মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছে যে, মা সেগুলো জোগাড় করতে পারেননি। ‘আমি দেখছি’ এবং তিনি সাদিকে কঠোরভাবে বললেন, ‘রাঁধুনীকে বলো, দশ মিনিটের মধ্যে আমি বার্চগুলো জোগাড় করছি।’  

সাদি চলে গেল।

‘এখন, লরা’, তার মা দ্রুতবেগে বললেন, ‘আমার সঙ্গে ধূমপান করার কক্ষে এসো। আমি একটি খামের উল্টোপিঠে কোথাও নিমন্ত্রিত অতিথিদের নামগুলো লিখে রেখেছি। তুমি আমাকে নামগুলো লিখে দাও। মেগ, এই মুহূর্তে ওপরে যাও এবং তোমার মাথা থেকে ভিজে কাপড়টি সরিয়ে ফেল। জোসে, দৌড়াও এবং এই মুহূর্তে পোশাক পরা শেষ করো। ছেলেমেয়েরা, তোমরা কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ, নাকি তোমাদের বাবা যখন আজ রাতে বাসায় আসবে তখন তাকে বিষয়টি জানাব? জোসে, তুমি যদি রান্নাঘরে যাও তাহলে রাঁধুনীকে শান্ত করো, তুমি কি তা করবে? আমি সকাল থেকে তার ভয়ে ভীত হয়ে আছি।’

খাওয়ার ঘরের ঘড়ির পেছনে অবশেষে খামটি পাওয়া গেল, যদিও খামটি সেখানে কীভাবে গেল তা মিসেস শেরিডানের কল্পনার অতীত ছিল।

‘ছেলেমেয়েরা, আমার ব্যাগ থেকে তোমাদের মধ্যে কেউ একজন এটা চুরি করেছ, কারণ  ক্রিমের পনির এবং লেবু দেওয়া দইয়ের কথা আমার খুব ভালোভাবে মনে পড়ছে। তোমরা কি এটা করেছ?’

‘হ্যাঁ।’

মিসেস শেরিডান তাঁর কাছ থেকে খামটি দূরে সরিয়ে বললেন Ñ ‘ডিম এবং … এগুলোকে ইঁদুরের মতো লাগছে। এগুলো ইঁদুর হতে পারে না, পারে কি?’

লরা তার কাঁধের ওপর থেকে তাকিয়ে বলল, ‘জলপাই, পোষ্য।’

‘অবশ্যই, জলপাই। মিশ্রণটি শুনতে কি ভয়াবহ লাগছে। ডিম এবং জলপাই।’

তাদের কথোপকথন অবশেষে শেষ হলো এবং লরা জিনিসগুলো রান্নাঘরে নিয়ে গেল। সে দেখল জোসে রাঁধুনীকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, যদিও তাকে দেখতে মোটেও ভীতিপ্রদ বলে মনে হচ্ছে না।

জোসে অত্যধিক আনন্দের সঙ্গে বলল, ‘আমি কখনো এরকম অপরূপ সুন্দর স্যান্ডউইচ দেখিনি। রাঁধুনী, বলো তো কত রকমের স্যান্ডউইচ আছে? পনের রকম?’

‘মিস জোসে, পনের রকম।’

‘ভালো, রাঁধুনী, আমি তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।’

রাঁধুনী লম্বা স্যান্ডউইচের ছুরি দিয়ে এর মচমচে ওপরের অংশ ফেলে দিলো এবং চওড়াভাবে হাসল।

সাদি বাসন-কোসন রাখার ঘরের দিকে দেখিয়ে বলল, ‘গদবারের লোক এসেছে।’ সে লোকটিকে জানালার পাশ দিয়ে যেতে দেখেছে। 

এর অর্থ হলো, ক্রিমের পাফগুলো এসেছে। গদবার তার ক্রিম পাফের জন্য বিখ্যাত। এগুলো বাড়িতে তৈরি করার কথা কেউ চিন্তাও করতে পারে না।

রাঁধুনী আদেশ করল, ‘মেয়ে আমার, পাফগুলো ভেতরে আনো এবং টেবিলের ওপর রাখো।’

সাদি পাফগুলো নিয়ে এলো এবং পুনরায় দরজার কাছে ফিরে গেল। লরা এবং জোসে যে বয়েসে এসে পৌঁছেছে তাতে তাদের পক্ষে এসব ক্ষুদ্র বিষয়ের প্রতি নজর দেওয়া সম্ভব নয়। সবসময় যা হয়ে থাকে, তারা দুজনেই এ-বিষয়ে একমত না হয়ে পারল না যে, পাফগুলো দেখতে সত্যিই খুব আকর্ষণীয়। খুব। রাঁধুনী পাফগুলো সাজাতে শুরু করল, পাফগুলো থেকে বাড়তি চিনি ফেলে দিলো।

লরা বলল, ‘কারো দেওয়া পার্টিতে কোনো সময় কি পাফ থেকে যায় না এবং সেগুলো কি ফেরত নেয়া হয় না?’ 

বাস্তববাদী জোসে, যে কি না অব্যবহৃত খাবার ফেরত নেয়া পছন্দ করে না, বলল, ‘আমার মনে হয় তারা তা করে। আমাকে বলতেই হবে যে, পাফগুলো নান্দনিকভাবে হালকা এবং পালকময়।’

রাঁধুনী সন্তুষ্টির সঙ্গে বলল, ‘আমার প্রিয় ছেলেমেয়েরা, তোমরা প্রত্যেকে একটি করে চেখে দেখ। তোমাদের মা জানবেন না।’

ওহ্, অসম্ভব। নাস্তার পরপরই এরকম শৌখিন ক্রিমের পাফ খাওয়া সম্ভব নয়। চিন্তাটি শরীরে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। বরাবরের মতো, দুই মিনিট পর জোসে এবং লরা কোনোকিছুতে গভীরভাবে মজে গেছে এমন চেহারা নিয়ে আঙুল চাটছিল যেটি শুধু ঘাঁটানো ক্রিমের পাফ থেকেই আসে।

লরা প্রস্তাব করল, ‘চলো, আমরা পিছন দিক দিয়ে বাগানে যাই। তাঁবু নিয়ে লোকেরা কী করছে তা আমি দেখতে চাই। লোকগুলো খুব ভালো।’

কিন্তু পিছনের দরজায় রাঁধুনী, সাদি, গদবারের লোক এবং হ্যান্স দাঁড়িয়ে ছিল। 

কিছু একটা হয়েছে।

অস্থিরচিত্ত মুরগির মতো রাঁধুনী মাথা ঝাঁকিয়ে ‘টুক-টুক-টুক’ আওয়াজ করল। সাদি এমনভাবে তার গালে হাত রেখে হাততালি দিলো যে মনে হলো, তার দাঁত ব্যথা হয়েছে। হ্যান্স ঘটনাটি বোঝার চেষ্টা করছিল এবং তাতে করে তার মুখমণ্ডলটি পেঁচিয়ে গেছে Ñ এমন অভিব্যক্তি প্রকাশ পেল। গদবারের লোকটিই শুধু ঘটনাটি উপভোগ করছিল বলে মনে হলো; গল্পটি যে তারই।

‘কী হয়েছে? ঘটনাটি কী?’

রাঁধুনী বলল, ‘একটি ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটেছে। একজন লোক মারা গেছে।’

‘লোক মারা গেছে! কোথায়? কীভাবে? কখন?’

কিন্তু গদবারের লোকটি তার নাকের তলা দিয়ে গল্পটি চুরি হয়ে যাবে, তা হতে দিতে রাজি নয়।

‘মিস, নিচে যে ছোট কটেজগুলো আছে সেগুলো সম্পর্কে কি আপনি অবহিত?’

কটেজগুলো সম্পর্কে কি আমি অবহিত? অবশ্যই, সে তাদের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। ‘নিচের কটেজে স্কট নামে একটি যুবক বাস করত এবং সে বাচ্চাদের কাপড় বিক্রি করত। তার ঘোড়ার এই সকালবেলা হক স্ট্রিটের কোনায় একটি ভারী ইঞ্জিনের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় এবং যুবকটি ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ে। সে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই মারা যায়।’

লরা গদবারের লোকটির দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে বলল, ‘মৃত!’       

গদবারের লোকটি আগ্রহের সঙ্গে বলল, ‘তারা যখন তাকে টেনে তুলল ততক্ষণে সে মারা গেছে। আমি যখন এখানে আসছিলাম তখন তারা মৃতদেহটি বাড়ি নিয়ে যাচ্ছিল।’ সে রাঁধুনীকে বলল, ‘সে স্ত্রী এবং পাঁচটি ছোট বাচ্চা রেখে গেছে।’

লরা তার বোনের কাপড় টেনে ধরে তাকে টানতে টানতে রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে বেইজের দরজার অপর প্রান্তে নিয়ে বলল, ‘জোসে, এখানে এস।’ সেখানে সে একটু থামল এবং দরজার অপর প্রান্তে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।

সে ভীত গলায় বলল, ‘জোসে! যাই হোক, আমরা কি সব বন্ধ করে দেব?’ 

জোসে উত্তেজিতভাবে বলল, ‘সবকিছু বন্ধ হয়ে যাবে, লরা! তুমি কী বলতে চাচ্ছ?’

‘উদ্যান-মিলন বন্ধ করার কথা বলছি নিশ্চয়ই।’ জোসে কেন না বোঝার ভান করছে?

কিন্তু জোসের তখনো বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি। ‘উদ্যান-মিলন বন্ধ হয়ে যাবে? আমার প্রিয় লরা, এতোটা উদ্ভট চিন্তা কোরো না। আমরা অবশ্যই সে-ধরনের কিছু করতে পারব না। কেউই আমাদের কাছ থেকে এটা প্রত্যাশা করে না। অলীক কোনো কিছু ভেবো না।’

‘কিন্তু সামনে গেটের বাইরে একজন মৃত ব্যক্তিকে রেখে আমরা উদ্যান-মিলনের আয়োজন করতে পারি না।’

এটি সত্যিই অকল্পনীয়, বাড়ির দিকে গেছে এমন একটি খাড়া ঢাল রয়েছে যার একেবারে নিচে ছোট কটেজগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ান। এর মধ্য দিয়ে একটি চওড়া রাস্তা গেছে। এটি সত্যি যে, কটেজগুলো খুব কাছে। কটেজের অধিবাসীরা তাদের প্রতিবেশীদের সম্ভাব্য চক্ষুশূল ছিল এবং তাদের সেই এলাকায় বাস করার মোটেও কোনো অধিকার ছিল না। তাদের থাকার জায়গা খুব সাধারণ ছিল, যা চকলেটের খয়েরি রং দিয়ে রং করা হয়েছিল। সাধারণভাবে তৈরি বাগানে গাজরের স্তূপ, অসুস্থ মুরগি এবং টমেটোর ধাতব পাত্র ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কটেজের চিমনি থেকে যে-ধোঁয়া নির্গত হতো তা দারিদ্র্যপীড়িত বলে মনে হতো। ছোট কাপড়ের টুকরো এবং ধোঁয়ার রেশ কটেজগুলোর চিমনি দিয়ে বের হতো এবং এটি শেরিডানদের চিমনি দিয়ে নির্গত হওয়া অগোলাকৃতির বড় রুপালি পালকগুচ্ছের  সঙ্গে তুলনীয় নয়। ধোপানিরা সেই লেনে বাস করত এবং ঝাড়ু দিত। একজন মুচি এবং একজন লোক, যার ঘরের সামনের দিক অতিক্ষুদ্র পাখির খাঁচা দিয়ে ভর্তি ছিল, তারাও সেখানে থাকত। ছেলেমেয়েরা দলবেঁধে থাকত। শেরিডান ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছিল তখন তাদের সেখানে পা দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল, কারণ সেখানকার অধিবাসীদের ভাষা ছিল খারাপ এবং তারা সেখান থেকে কোনো অসুখ বাধিয়ে আসতে পারে Ñ এই ভয় ছিল। কিন্তু যখন তারা বড় হলো, লরা এবং লরি কখনো-সখনো সেখানে বেড়িয়ে আসত। সেখানকার মলিন পরিবেশ তাদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। তারা কাঁপতে কাঁপতে সেখান থেকে বের হয়ে আসত। কিন্তু তারপরও একজনের অবশ্যই সব জায়গায় যাওয়া উচিত; সবকিছু দেখা উচিত। সে-কারণে তারাও সেখানে গিয়েছিল। 

লরা বলল, ‘গরিব মহিলাটির কানে ব্যান্ডের বাজনা কেমন লাগবে তা চিন্তা করে দেখ।’

জোসে সত্যিকার অর্থে রাগতে শুরু করল, ‘ওহ্, লরা! তুমি যদি প্রত্যেকবার ব্যান্ডের বাজনা বন্ধ করো এই অজুহাতে যে, কোনো একজনের দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাহলে তোমাকে রীতিমতো ক্লান্তিকর জীবন যাপন করতে হবে। আমি তোমার মতোই বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত দুঃখিত। আমিও তোমার মতোই এদের প্রতি সহানুভূতিশীল।’ তার চোখ কঠোর থেকে কঠোরতর হয়ে উঠল। সে তার বোনের দিকে এমনভাবে তাকাল যে দৃষ্টিভঙ্গি তারা যখন ছোট ছিল এবং একসঙ্গে মারামারি করত, সেই সময়কার কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিল। সে নম্রভাবে বলল, ‘তুমি ভাবপ্রবণ হয়ে একজন মদ্যপ শ্রমিককে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।’

লরা হিংস্রভাবে জোসের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘মদ্যপ! কে বলেছে যে সে মদ্যপ ছিল?’ সে কথাটা এমনভাবে বলল যা সাধারণত তারা ওই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে বলে থাকে।

‘আমি সোজা মাকে গিয়ে বলছি।’

জোসে পাখির মতো কূজন করে বলল, ‘তাই করো, প্রিয়।’ 

লরা কাচের বড় দরজার হাতল ঘুরিয়ে বলল, ‘মা, আমি কি তোমার ঘরে আসতে পারি?’

‘অবশ্যই, মেয়ে। কেন, কী হয়েছে? তোমার মুখের ভাব এরকম হয়েছে কেন?’ এ-কথা বলে মিসেস শেরিডান তাঁর ড্রেসিং টেবিল থেকে লরার দিকে ঘুরে তাকালেন। তিনি মাথায় একটি নতুন হ্যাট দিয়ে দেখছিলেন যে হ্যাটটি তাঁকে মানায় কি না।

লরা বলতে শুরু করল, ‘মা, একজন লোক মারা গেছে।’

তার মা বাধা দিয়ে বললেন, ‘বাগানে নয় নিশ্চয়ই?’

‘না, না!’

‘ওহ্, তুমি আমাকে কি ভয়টাই না পাইয়ে দিয়েছিলে!’ মিসেস শেরিডান হাঁপ ছাড়লেন এবং বড় হ্যাটটি মাথা থেকে নামিয়ে কোলের ওপর রাখলেন।

লরা বলল, ‘কিন্তু মা, শোন।’ দম না নিয়ে, শ্বাস প্রায় বন্ধ করে লরা ভয়াবহ ঘটনাটি বলল। সে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল, ‘আমাদের পার্টিটি অবশ্যই আমরা হতে দিতে পারি না, পারি কি? ব্যান্ডের সদস্যরা এবং নিমন্ত্রিত অতিথিরা আসতে শুরু করেছেন। তাঁরা আমাদের কথা শুনবেন, মা; তাঁরা আমাদের প্রতিবেশীতুল্য!’ 

লরা বিস্মিত হয়ে দেখল তার মা ঠিক জোসের মতোই আচরণ করলেন; এটি মেনে নেওয়া কঠিন, কারণ মা এতে মজা পাচ্ছেন বলে মনে হলো। তিনি লরার বক্তব্যের গুরুত্ব অনুধাবন করতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। 

‘কিন্তু, প্রিয় সন্তান আমার, তোমার নিজস্ব বুদ্ধি দিয়ে ঘটনাটি পুরোপুরি বিবেচনা করো। হঠাৎ করেই  আমরা ঘটনাটি সম্পর্কে অবগত হয়েছি। যদি কেউ একজন সেখানে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করত এবং আমি বুঝতে পারি না ওই ক্ষুদ্র গর্তগুলোর ভেতর তারা কীভাবে বাস করে Ñ যাই হোক, আমরা এখনো উদ্যান-মিলনের আয়োজন করতে পারি, পারি না কি?’

লরাকে তার উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলতে হলো; কিন্তু তার মনে হলো এটা ঠিক হচ্ছে না। সে তার মায়ের সোফার ওপর বসে পড়ল এবং কুশনের ফ্রিলে চিমটি কাটতে লাগল।

‘মা, এটি কি আমাদের দিক থেকে চরম নিষ্ঠুরতা হচ্ছে না?’ সে জিজ্ঞেস করল।

‘ডার্লিং!’ মিসেস শেরিডান উঠে দাঁড়ালেন এবং হ্যাটটি হাতে নিয়ে তার কাছে এলেন। লরা তাঁকে থামানোর আগেই তিনি তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করলেন। ‘মেয়ে আমার!’ তার মা বললেন, ‘এই হ্যাটটি তোমার। এটি তোমার জন্যই তৈরি করা হয়েছে। হ্যাটটি আমার উপযোগী নয়, এটি কমবয়সীদের জন্য। তোমাকে এরকম ছবির মতো দেখতে আর কখনো লাগেনি। নিজের দিকে তাকাও!’ এবং তিনি তাঁর হাত-আয়নাটি তুলে ধরলেন।

‘কিন্তু, মা’, লরা আবার বলতে শুরু করল। সে নিজের দিকে তাকাতে পারছিল না; সে অন্যদিকে সরে গেল।  

এই সময় মিসেস শেরিডানের জোসের মতোই ধৈর্য্যচ্যুতি হলো।

তিনি ঠান্ডাভাবে বললেন, ‘লরা, তুমি খুব অদ্ভুত আচরণ করছ। ওই ধরনের লোকেরা আমাদের কাছ থেকে তাদের জন্য স্বার্থত্যাগ করা প্রত্যাশা করে না। তুমি এখন যা করছ, সবার আনন্দ নষ্ট করা, এটি কোনো সহানুভূতিশীল মনের পরিচায়ক নয়।’

লরা বলল, ‘আমি বুঝতে পারি না’, এই কথা বলে সে দ্রুত তার মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের শোবার ঘরে চলে গেল। নিজের ঘরে, হঠাৎ করেই আয়নায় সে একটি মিষ্টি মেয়েকে দেখতে পেল, যার কালো হ্যাটটি সোনালি রঙের ডেইজি ফুল দিয়ে আবৃত ছিল এবং একটি কালো লম্বা ভেলভেটের ফিতা দিয়ে ফুলগুলো বাঁধা হয়েছিল। তাকে দেখতে যে এরকম লাগবে এটা তার কল্পনায় কখনো আসেনি। সে ভাবল, মা কি ঠিক বলছেন? এবং এখন সে আশা করতে শুরু করল যে, তার মা ঠিক কথাই বলেছেন। আমি কি বেশি কিছু আশা করছি? হয়তো এটা আশাতীতই বটে। এক মুহূর্তের জন্য হলেও তার সেই গরিব মহিলাটি এবং ওইসব ছোট ছেলেমেয়ের কথা মনে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গেই মৃতদেহটি বাড়িতে যে বয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল, তার কথাও মনে পড়ল। কিন্তু সবকিছুই এখন সংবাদপত্রের ছবির মতো ঝাপসা, অবাস্তব বলে মনে হলো। সে স্থির করল, পার্টি শেষ হওয়ার পর আমি আবার ঘটনাটি মনে করব। কোনো একভাবে এটিই সবচেয়ে ভালো পরিকল্পনা বলে মনে হলো …

সোয়া একটার দিকে দুপুরের খাবারের পর্ব শেষ হলো। সোয়া দুটোর সময় তারা সবাই অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত হলো। সবুজ কোট পরিহিত ব্যান্ডের সদস্যদের আগমন ঘটল এবং তারা টেনিস-কোর্টের এক কর্নারে অবস্থান নিল। 

কিটি মেইটল্যান্ড তাঁর কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘প্রিয় আমার, সত্যি কথা বলতে কি, ব্যান্ডের সদস্যদেরকে কি ব্যাঙের মতো দেখাচ্ছে না? তোমার উচিত ছিল একটি পাতার মাঝখানে ব্যান্ডটির কন্ডাক্টরকে রেখে পুকুরের চতুর্দিকে তার লোকদের বসার ব্যবস্থা করা।’

লরির আগমন ঘটল এবং পোশাক পরিধান করতে যাওয়ার পথে সে তাদের দিকে হাত নাড়ল। তাকে দেখে লরার দুর্ঘটনাটির কথা আবার মনে পড়ল। সে তাকে সবকিছু বলতে চাচ্ছিল। লরি যদি অন্যদের সঙ্গে একমত পোষণ করে, তাহলে তাদের মন্তব্য ঠিক আছে বলে ধরে নিতে হবে। সে তাকে অনুসরণ করে হলঘর পর্যন্ত গেল।

লরা ‘লরি’ বলে ডাকল।

সে যখন ওপরতলায় যাচ্ছিল তখন মাঝপথে, সবাইকে উদ্দেশ করে ‘হ্যালো’ বলল; কিন্তু যখন সে ঘুরে দাঁড়াল এবং লরাকে দেখতে পেল তখন হঠাৎ করেই তার মুখ থেকে জোরে নিশ্বাস নির্গত হলো এবং লরার দিকে চোখ পাকাল। ‘আমি বলছি, লরা! তোমাকে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে’, লরি বলল। ‘কী চমৎকার টুপি!’

লরা মূর্ছিতের মতো বলল, ‘সত্যি তাই?’ এবং লরির দিকে তাকিয়ে হাসল, মোটের ওপর, তাকে কোনো কিছুই বলল না।

তার পরপরই, জনস্রোতের মতো লোক আসতে শুরু করল। ব্যান্ড বেজে উঠল; ভাড়া করা পরিচারকরা বাড়ি থেকে তাঁবুর দিকে ছুটল। যেদিকে তুমি তাকাও না কেন সেদিকেই দেখতে পাবে যুগলে যুগলে পায়চারি করছে, ঝুঁকে ফুলের গন্ধ শুঁকছে, অতিথিদের সম্ভাষণ জানাচ্ছে, লনের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই একটি বিকেলের জন্য তাদেরকে উজ্জ্বল পাখিদের মতো দেখাচ্ছে, যারা শেরিডানদের উদ্যান আলোকিত করে রেখেছে, তাদের যাত্রাপথকেও আলোকিত করছে Ñ তারা যাচ্ছে কোথায়? আহ্, সুখী মানুষদের সান্নিধ্য লাভ করা কতো আনন্দের, তাদের সঙ্গে করমর্দন করা, তাদের গাল ধরে চাপ দেওয়া, তাদের সঙ্গে চোখাচোখি হলে হাসি বিনিময় করা।   

‘লরা ডার্লিং, তোমাকে দেখতে কত সুন্দর লাগছে!’

‘মেয়ে, হ্যাটটি পরিধান করে তুমি হ্যাটের মর্যাদা বাড়িয়েছ!’

‘লরা, তোমাকে দেখতে অনেকটা স্প্যানিশদের মতো লাগছে। তোমার এ-রূপ যা সবাইকে এতো আকর্ষণ করছে তা আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।’

লরা তার উজ্জ্বলতা ছড়াতে ছড়াতে নম্রভাবে বলল, ‘তোমার কি চা খাওয়া হয়েছে? চা-তে কি বরফ দেয়া হয়নি? প্যাশন ফলের বরফগুলো সত্যিই বিশেষত্বের দাবিদার।’ সে দৌড়ে তার বাবার কাছে গেল এবং তাকে পীড়াপীড়ি করতে লাগল, ‘ডার্লিং বাবা, ব্যান্ডের লোকজন কি কিছু পান করবে না?’

বিকেলটি, যেটি সত্যি মনোরম ছিল, ধীরে  ধীরে  রক্তিম  ভাব  ধারণ  করল,  প্রকৃতি বিবর্ণ হতে শুরু করল এবং গাছের পত্র-পল্লব ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল।

‘এর আগে কখনো এরকম চমৎকার উদ্যান-মিলন হয়নি …’, ‘উদ্যান-মিলনের সাফল্য ….’, ‘অনেকাংশেই …’  Ñ অতিথিদের কাছ থেকে এ-ধরনের মন্তব্য আসতে লাগল।

লরা তার মাকে অতিথিদের বিদায় জানাতে সাহায্য করছিল। তারা বারান্দায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সবাইকে বিদায় জানাল যতক্ষণ পর্যন্ত না সবাই বিদায় নিল।

মিসেস শেরিডান বললেন, ‘ভগবানকে ধন্যবাদ, উদ্যান-মিলন শেষ হয়েছে, শেষ হয়েছে। লরা, সবাইকে একত্রিত করো। চলো তাজা কফি খেয়ে আসি। আমি চরম পরিশ্রান্ত। হ্যাঁ, উদ্যান-মিলন খুব সফলভাবে শেষ হয়েছে। কিন্তু ওহ্, এই পার্টিগুলো, এই পার্টিগুলো! ছেলেমেয়েরা কেন তোমরা পার্টি দেওয়ার জন্য তাগাদা দাও!’ এবং তারা সবাই পরিত্যক্ত তাঁবুটিতে বসে পড়ল।

‘প্রিয় বাবা, একটি স্যান্ডউইচ খাও। আমি প্রস্তরফলকটিতে লিখেছি।’  

মিস্টার শেরিডান স্যান্ডউইচে এক কামড় দিয়ে বললেন, ‘ধন্যবাদ’ এবং স্যান্ডউইচটি নিঃশেষ হলো। তিনি আরেকটি নিলেন। তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয় আজকে যে একটা জঘন্য দুর্ঘটনা ঘটেছে তা সম্পর্কে তোমরা অবগত কি?’

মিসেস শেরিডান তাঁর হাত তুলে ধরে বললেন, ‘প্রিয় আমার, আমরা শুনেছি। দুর্ঘটনাটির কারণে পার্টিটি প্রায় ধ্বংস হতে বসেছিল। লরা অনুনয় করছিল পার্টিটা যাতে আমরা না করি।’

‘ওহ্, মা!’ লরা চাচ্ছিল না তাকে এ-বিষয় নিয়ে কোনো ধরনের খোঁচা দেওয়া হোক।

মিস্টার শেরিডান বললেন, ‘ঘটনাটি বরাবরের মতোই ভীতিকর। ছেলেটি বিবাহিতও ছিল। লেনের নিচে বাস করত, সবাই বলছে যে, সে স্ত্রী এবং এক ডজনের মতো বাচ্চা রেখে গেছে।’

বিব্রতকর একটি নীরবতা নামল। মিসেস শেরিডান তাঁর কাপ নিয়ে অস্থিরভাবে নড়াচড়া করলেন। সত্যি, বাবার দিক থেকে এটি খুব অকৌশলী আচরণ ছিল …

হঠাৎ তিনি চোখ তুলে তাকালেন। টেবিলের ওপর টাটকা কিছু স্যান্ডউইচ, কেক, পাফ পড়েছিল এবং এগুলোর সদ্ব্যবহার না করলে খাবারগুলো নষ্ট হবে। লরার মায়ের মাথায় তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিকল্পনাগুলোর একটি ঘুরপাক খাচ্ছিল। 

তিনি বললেন, ‘আমি জানি। চলো, আমরা একটি ঝুড়ি বানাই। ওই গরিব মহিলাকে এই টাটকা খাবারের কিছুটা পাঠাই। কোনো না কোনো দিক থেকে, ছেলেমেয়েদের জন্য এটি হবে সবচেয়ে ভালো উপহার। তুমি আমার সঙ্গে একমত নও?’ তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে প্রতিবেশীরা তাঁর ডাকে সাড়া দেবে। ‘সবকিছু প্রস্তুত অবস্থায় পাওয়ার তাৎপর্য কী? লরা!’

তিনি লাফিয়ে উঠলেন। ‘সিঁড়িতে যে তৈজসপত্র রাখার আলমারি রয়েছে তা থেকে সবচেয়ে বড় ঝুড়িটি বের করে এনে আমাকে দাও।’      

লরা বলল, ‘কিন্তু মা, তুমি কি সত্যিই মনে করো পরিকল্পনাটি ভালো?’

পরিকল্পনাটি নিয়ে তিনি এতটাই কৌতূহলী হয়ে উঠলেন যে তাঁকে সবার থেকে আলাদা বলে মনে হলো। পার্টি থেকে উচ্ছিষ্ট খাবার তাদের জন্য নিয়ে যেতে তিনি তৎপর হলেন। গরিব মহিলাটি কি এগুলো পেলে খুশি হবে?

‘অবশ্যই! আজ তোমার কী হয়েছে? এক ঘণ্টা কি দু-ঘণ্টা আগে তুমি আমাদের ওই গরিব মহিলা এবং তার বাচ্চাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার জন্য অনুনয় করছিলে, আর এখন …’

ওহ্ ভালো! লরা ঝুড়িটি আনতে দৌড় দিলো। ঝুড়িটি তার মা জিনিস দিয়ে বোঝাই করে রেখেছিল।

তার মা বললেন, ‘ডার্লিং, ঝুড়িটি তুমি নিয়ে যাও। তুমি যেভাবে দৌড়াও সেভাবে দৌড়ে নিচে যাও। না, অপেক্ষা করো, অরাম লিলিগুলোও নিয়ে যাও। ওই শ্রেণির মানুষেরা অরাম লিলি ফুল দেখে খুব খুশি হবে।’

বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন জোসে বলল, ‘ফুলের বোঁটা দিয়ে লরার লেসের জামাটি নষ্ট হবে।’

সুতরাং তারা জোসের কথামতো কাজ করল। লরার মা তাকে অনুসরণ করে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এসে বললেন, ‘তাহলে শুধু ঝুড়িটি নিয়ে যাও। লরা, শোনো! Ñ কোনোভাবেই …’

‘কি মা?’ 

না, মেয়েটির মাথায় এ-ধরনের চিন্তার খোরাক না দেওয়াই ভালো! ‘কিছু না! দৌড়াও।’

লরা যখন তাদের বাগানের গেট বন্ধ করছিল তখন চারদিকে গোধূলি নামছে। একটি বড় কুকুর ছায়ার মতো পাশ দিয়ে চলে গেল। রাস্তাটির সাদা রং চিকচিক করছিল এবং নিচে গহ্বরে ছোট কটেজগুলোকে গাঢ় রঙের দেখাচ্ছিল। বিকেলের পর জায়গাটি কত শান্ত মনে হচ্ছিল। এখন সে পাহাড় বেয়ে নিচে নামছে এবং এখানে কোনো এক জায়গায় একজন মানুষ মৃত অবস্থায় পড়ে আছে, বিষয়টি সে অনুধাবন করতে পারছিল না। সে অনুধাবন করতে পারবে কি করে? সে এক মিনিটের জন্য থামল। তার মনে হলো, সে যেন চুম্বনরত মানুষ, তাদের গলার আওয়াজ, চামচের টুংটাং শব্দ, হাস্যধ্বনি, বিধ্বস্ত ঘাসের গন্ধ Ñ সবকিছুই নিজের ভেতর আত্মস্থ করে নিয়েছে। আর কোনোকিছু আত্মস্থ করার মতো অবস্থায় সে ছিল না। কী অদ্ভুত! সে ফ্যাকাশে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল এবং সে-মুহূর্তে যে-চিন্তাটি তার মাথায় খেলে গেল তা হলো, ‘হ্যাঁ, এই পার্টিটিই সবচেয়ে সফল পার্টি হিসেবে আখ্যা পাওয়ার যোগ্য।’   

চওড়া রাস্তাটি সে পার হলো। ধোঁয়াচ্ছন্ন এবং অন্ধকার লেন শুরু হলো। লরার পাশ দিয়ে শাল-পরিহিতা মহিলা এবং টুইডের টুপি-পরা পুরুষেরা দ্রুতবেগে পার হচ্ছিল। লোকেরা রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল; ছেলেমেয়েরা দরজায় বসে খেলছিল। দরিদ্র কটেজগুলো থেকে নিচুস্বরে গুনগুন আওয়াজ আসছিল। কতগুলো বাড়ি থেকে আলোর দ্যুতি দেখা যাচ্ছিল এবং কাঁকড়ার মতো একটি ছায়া জানালাময় ঘুরছিল। লরা মাথা নিচু করে দ্রুতলয়ে চলতে লাগল। তার মনে হচ্ছিল, তার গায়ে একটি কোট থাকলে ভালো হতো। তার জামাটি কত উজ্জ্বল দেখাচ্ছে! ভেলভেটের ফিতা লাগানো বড় হ্যাটটি Ñ অন্য কোনো হ্যাট যদি এটা হতো! লোকেরা কি তার দিকে তাকাচ্ছে? তাদের অবশ্যই তাকাতে হবে। মনে হচ্ছে এখানে আসাটা ভুল হয়েছে; প্রথম থেকেই সে জানত যে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এখন কি সে ফিরে যাবে? 

না, এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। বাড়িটি এটিই। অবশ্যই এই বাড়িটি হবে। বাড়িটির বাইরে একদল লোকের গাঢ় একটি জটলা ছিল। গেটের পাশে খুবই বৃদ্ধ একজন মহিলা একটি ক্রাচ নিয়ে চেয়ারে বসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তিনি একটি সংবাদপত্রের ওপর তাঁর পা তুলে রেখেছিলেন। লরা কাছে আসামাত্র লোকেরা কথা বলা বন্ধ করল। তারা বিভক্ত হয়ে পড়ল। এটা এমন হলো যে, মনে হচ্ছিল লরার আগমন প্রত্যাশিত ছিল, তারা জানত যে সে আসবে।

লরা ভীষণ বিচলিত বোধ করল। তার কাঁধের ওপর দিয়ে ভেলভেটের ফিতাটি নাড়িয়ে, সে তার কাছে দাঁড়ানো এক মহিলাকে উদ্দেশ করে বলল, ‘এটা কি মিসেস স্কটের বাড়ি?’ এবং মহিলা অদ্ভুতভাবে হেসে উত্তর দিলেন, ‘গাধা আমার, এটিই তাঁর বাড়ি।’

ওহ্, এখান থেকে যদি চলে যাওয়া যেত! সে যখন সরু রাস্তা ধরে ওপরে উঠছিল

প্রকৃতপক্ষে তখন সে বলছিল, ‘ভগবান, আমাকে সাহায্য করুন’ এবং জোর আওয়াজে চলছিল। সে ওই সমস্ত একদৃষ্টিতে তাকিয়ে-

থাকা চোখের চাহনি থেকে দূরে যেতে চাইছিল, অথবা নিজেকে কোনো কিছু দিয়ে আবৃত করতে, এমনকি ওইসব মহিলার একজনের শাল দিয়ে হলেও নিজেকে আবৃত করতে চাইছিল। সে স্থির করল, আমি ঝুড়িটি রেখে চলে যাব। আমি এমনকি ঝুড়িটি খালি করার অপেক্ষায়ও থাকব না।

তারপর দরজা খুলে গেল। আধো-অন্ধকারের ভেতর দিয়ে কালো পোশাক পরা একজন ছোট্ট মহিলাকে দেখা গেল। 

লরা বলল, ‘আপনি কি মিসেস স্কট?’ কিন্তু তার ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থার মধ্যে মহিলা উত্তর দিলেন, ‘মিস, দয়া করে ভেতরে আসুন’, এবং তিনি প্যাসেজের দরজাটি বন্ধ করে দিলেন।

লরা বলল, ‘না, আমি ভেতরে যেতে চাই না। আমি শুধু ঝুড়িটি রেখে যেতে চাই। মা পাঠিয়েছেন …’

আধো অন্ধকারময় প্যাসেজটিতে ছোট্ট মহিলাটি মনে হয় তার কথা শুনতে পেলেন না। মহিলাটি তোষামুদে কণ্ঠে বললেন, ‘মিস, দয়া করে এখান দিয়ে আসুন’ এবং লরা তাকে অনুসরণ করল।

লরা নিজেকে একটি ছোট নিম্নমানের পরিত্যক্ত রান্নাঘরে আবিষ্কার করল এবং রান্নাঘরটি একটি ধোঁয়াটে বাতি দ্বারা আলোকিত ছিল। আগুনের সামনে একজন মহিলা বসেছিলেন।

যে ছোট্ট প্রাণীটি তাকে ভেতরে ঢুকতে দিলো, তিনি ‘এম’ বলে শব্দ উচ্চারণ করলেন। ‘এম! একজন যুবতী আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন’, বলে তিনি লরার দিকে ফিরে তাকালেন। ছোট্ট মহিলাটি অর্থপূর্ণভাবে বললেন, ‘মিস, আমি তার বোন। তুমি তাকে অনুগ্রহ করবে, তাই নয় কি?’ 

লরা বলল, ‘ওহ্, অবশ্যই! দয়া করে তাঁকে বিরক্ত করবেন না। আমি-আমি শুধুমাত্র ঝুড়িটি রেখে …’

ঠিক সেই মুহূর্তে আগুনের কাছে যে মহিলাটি বসেছিলেন তিনি ঘুরে তাকালেন। তাঁর মুখমণ্ডলে পাউডার দেওয়া ছিল, তাঁকে লাল দেখাচ্ছিল এবং চোখ, ঠোঁট সবকিছুই ফোলা ছিল, তাঁকে দেখতে ভয়ংকর লাগছিল। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি লরার উপস্থিতির কারণ বুঝতে পারছেন না। লরার উপস্থিতি কী বোঝাতে চাইছে? এই আগন্তুকটি কেন ঝুড়ি হাতে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে? এসব কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে? নিঃস্ব মুখটি আবার কুঞ্চিত হলো।

অন্যপক্ষ বলল, ‘প্রিয়, ঠিক আছে। আমি যুবতীকে ধন্যবাদ দেব।’

মহিলাটি আবার শুরু করলেন, ‘আমি নিশ্চিত, মিস, তুমি তাকে অনুগ্রহ করবে’, একথা বলে তার ফোলা মুখ একটি তোষামুদে হাসি দেওয়ার চেষ্টা করল।

লরা শুধু বাড়িটি থেকে বের হতে চাইছিল, এখান থেকে চলে যেতে চাইছিল। সে আবার প্যাসেজটিতে ফিরে এলো। দরজা খুলে গেল। সে সোজা হেঁটে শোবার ঘরে চলে গেল, যেখানে মৃত লোকটি শুয়েছিল।

এমের বোন তাকে উদ্দেশ করে বলল, ‘তুমি তাকে একনজর দেখতে চাও, তাই নয় কি?’ এবং সে লরাকে জোরে সরিয়ে দিয়ে বিছানার কাছে গেল। তাঁর কণ্ঠস্বর স্নেহময় এবং কৌতুকপূর্ণ শোনাল যখন তিনি বললেন, ‘গাধা আমার, ভয় পেও না’, একথা বলে তিনি মমতার সঙ্গে বিছানার শিটটি টেনে তুললেন। ‘তাকে দেখতে ছবির মতো লাগছে। দেখাবার মতো কোনোকিছুই নেই। আমার সঙ্গে এসো, প্রিয় মেয়ে।’

লরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

একজন যুবক সেখানে ঘুমিয়ে আছে, প্রশান্তির সঙ্গে এবং গভীরভাবে সে ঘুমাচ্ছে, মনে হচ্ছে সে যেন তাদের থেকে অনেক অনেক দূরে চলে গেছে। ওহ্, কত সুদূর, কত শান্তিময়। ছেলেটি স্বপ্ন দেখছিল। তাকে আর কখনো জাগানো যাবে না। তার মাথা বালিশে ডুবে আছে, তার চোখ বন্ধ ছিল; বন্ধ চোখের পাতার আড়ালে তার চোখগুলো একজন অন্ধের চোখের মতো দেখাচ্ছিল। সে স্বপ্নের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছে। তার কাছে উদ্যান-মিলন, ঝুড়ি এবং লেসের জামার কি মূল্য আছে? সে এসব থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। সে চমকপ্রদ এবং সুন্দর ছিল। যখন তারা হাসছিল এবং ব্যান্ডের বাদ্য বাজছিল, তখন লেনে এই বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটেছিল। সুখী … সুখী … সবকিছু ভালো, ঘুমন্ত মুখটি তাই বলছিল। যেমন হওয়া উচিত ছিল তেমনটিই হয়েছে। আমি প্রশান্তি অনুভব করছি।

কিন্তু বরাবরের মতোই তোমাকে কাঁদতে হবে এবং সে যুবকটিকে কিছু না বলে ঘর থেকে বের হতে পারল না। লরা বাচ্চাদের মতো জোরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

সে বলল, ‘হ্যাটের জন্য আমাকে ক্ষমা করুন।’

এইবার সে এমের বোনের জন্য অপেক্ষা করল না। সে নিজেই রাস্তা খুঁজে বের করল, রাস্তা দিয়ে নিচে নামল, ওইসব গাঢ় লোকের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। লেনের এক কর্নারে লরির সঙ্গে তার দেখা হলো।

সে তার ছায়া থেকে বেরিয়ে এলো। ‘এটা কি তুমি, লরা?’

‘হ্যাঁ।’

‘মা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। সবকিছু ঠিক আছে তো?’

‘হ্যাঁ, ঠিক আছে। ওহ্, লরি!’ সে তার বাহু ধরলা এবং সেখানে একটু চাপ দিলো।

তার ভাই জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কাঁদছ না, কাঁদছ কি?’

লরা তার মাথা ঝাঁকাল। সে কাঁদছিল।

লরি তার বাহু দিয়ে তার বোনকে জড়িয়ে ধরল। ‘কেঁদো না’, সে তার উষ্ণ, ভালোবাসাপূর্ণ কণ্ঠে বলল।

‘খারাপ কোনো কিছু কি ঘটেছে?’ 

লরা ফুঁপিয়ে বলল, ‘না। চমকপ্রদ একটি ঘটনা। কিন্তু লরি …’ সে থামল, সে তার ভাইয়ের দিকে তাকাল। সে আশাহত হয়ে বলল, ‘জীবন কী, জীবন কী Ñ’ কিন্তু জীবন কী তা সে ব্যাখ্যা করতে পারল না। কোনো ব্যাপার নয়। তার ভাই ঠিকই বুঝতে পারল। 

লরি বলল, ‘ডার্লিং, বিষয়টি কি এটি?’

ক্যাথরিন ম্যান্স্ফিল্ড

বিশ শতকের অন্যতম সেরা ছোটগল্প লেখক হিসেবে বিবেচনা করা হয় ক্যাথরিন ম্যান্স্ফিল্ডকে। তিনি ১৪ অক্টোবর ১৮৮৮ সালে নিউজিল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন, মৃত্যুবরণ করেন ৯ই জানুয়ারি ১৯২৩ সালে ফ্রান্সে। তিনি গল্পের আঙ্গিক, বিষয়বস্তু ও বিষয়ে ওপর নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, যা তাঁর লেখায় নতুন মাত্রা দান করেছে এবং তাঁকে একজন গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক লেখিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর জীবন ও কাজের ওপর তাঁর ছোটভাইয়ের মৃত্যু প্রভাব ফেলেছিল।

ক্যাথরিন ম্যান্স্ফিল্ডের লেখনীর বৈশিষ্ট্য Ñ তাঁর লেখায় কবিতার ছন্দ খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর গল্পগুলো মানসিক দ্বন্দ্বের ওপর আলোকপাত করে, গল্পগুলোতে বর্ণনার অনিশ্চয়তা এবং পর্যবেক্ষণের কাঠিন্য লক্ষণীয় এবং এটি তাঁর ওপর আন্তন চেখভের প্রভাবকে স্পষ্ট করে তোলে। তিনি ছোটগল্পকে সাহিত্যের একটি শাখা হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর ছোটগল্পগুলো নতুন ধারণার প্রবর্তক, সর্বজনগ্রাহ্য এবং মানসিকভাবে সংবেদনশীল।