নওশাদ জামিল

মিলনায়তনটি সাজানো হয়েছিল শৈল্পিকভাবে। সুদৃশ্য মঞ্চের পেছনে লাল রঙের বড় ব্যানারে লেখা – ‘তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১১’।
সাহিত্য শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা কালি ও কলম প্রতি বছর এইচএসবিসির পৃষ্ঠপোষকতায় সেরা তরুণ কবি ও লেখকদের দিচ্ছে এই পুরস্কার। এবার এই পুরস্কার প্রদান উপলক্ষে গত শনিবার শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে আয়োজন করা হয় এক জমকালো অনুষ্ঠান। তাতে সাহিত্যের চার শাখায় চার তরুণের হাতে তুলে দেওয়া হয় ২০১১ সালের ‘এইচএসবিসি-কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’।
পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকেরা হলেন – কবিতায় হওয়া না-হওয়ার গান কাব্যগ্রন্থের জন্য শুভাশিস সিনহা, কথাসাহিত্যে রাজনটী  উপন্যাসের জন্য স্বকৃত নোমান, প্রবন্ধ ও গবেষণায় প্রকৃতি, প্রান্তিকতা ও জাতিসত্তার সাহিত্য গ্রন্থের জন্য সুমন সাজ্জাদ এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে সোনার পরমতলা  উপন্যাসের জন্য মিজানুর খান। বিবিসিতে কর্মরত মিজানুর খান দেশের বাইরে থাকায় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি।
নবীন কবি ও লেখকদের সাহিত্য চর্চা ও সাধনাকে গতিময় এবং বাংলাদেশের তরুণদের সৃজনধারাকে সঞ্জীবিত করার লক্ষ্যে এইচএসবিসি ও কালি ও কলম ২০০৮ সাল থেকে তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার প্রবর্তন করেছে। সে-বছর দুটি শাখায় দেওয়া হয়েছিল পুরস্কার। সাহিত্যের আরো শাখাকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে ২০০৯ সাল থেকে পুরস্কার দেওয়া হয় তিন শাখায়। পরের বছর যোগ করা হয় আরো দুটি শাখা : মুক্তিযুদ্ধ ও কিশোরসাহিত্য। ফলে পুরস্কার দাঁড়ায় মোট পাঁচ শাখায়। কিশোর সাহিত্যে এবারে অবশ্য কোনো পুরস্কার দেওয়া হয়নি।
চারজন কবি ও লেখক প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে মোট চার লাখ টাকা পুরস্কার প্রদান করা হয়। তাদের হাতে এ-পুরস্কার তুলে দেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এসময়ে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি বরেণ্য কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। সভাপতিত্ব করেন বিচারকমন্ডলীর সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বিচারকমন্ডলীর পক্ষে অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন। এসময়ে আরো উপস্থিত ছিলেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং কালি ও কলমের প্রকাশক বিশিষ্ট শিল্পানুরাগী আবুল খায়ের, এইচএসবিসির করপোরেট ব্যাংকিং প্রধান মো. মাহবুব-উর-রহমান, কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত এবং কালি ও কলম সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য লুভা নাহিদ চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্যই পৃথিবীতে বাংলা ভাষার সম্মান এখন রয়েছে। ইউনেস্কোকে বলতে হয়, বাংলা সুইটেস্ট ভাষা।’ আর এই মিষ্টি ভাষার সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য তিনি প্রশংসা করেন লেখকদের। গুণী এই সাহিত্যিক তরুণ বয়সে লেখক হিসেবে তাঁর গড়ে ওঠার সংগ্রামের কথাও শোনালেন। তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আদান-প্রদান খুব কম। এখানকার বই খুব কম পাই। যেটুকু পাই তা গ্রোগ্রাসে পড়ি।’ বাংলাদেশের সাহিত্য-প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানকার কবিদের কৃতিত্ব খুব উজ্জ্বল। তবে গদ্যসাহিত্যে পৃথিবীজুড়েই চলছে মন্দাভাব। এই অবস্থা গত ২০-২৫ বছর ধরে দেখতে পাচ্ছি। আমি এটা নিয়ে ভাবছি, কেন এমনটা ঘটছে। আশা করছি, বাংলাদেশের এইসব তরুণই দূর করবে সেই মন্দাভাব।’
এর আগে অনুষ্ঠানে সূচনা ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন কালি ও কলম সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য লুভা নাহিদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের তরুণ কবি ও লেখকদের সাহিত্য চর্চা ও সাধনার মধ্যেই নিহিত আছে এদেশের সাহিত্যের বিকাশ-প্রক্রিয়া। বাংলাদেশের সাহিত্য-আন্দোলনকে আরো গতিশীল করার লক্ষ্য নিয়ে আমরা নয় বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছি। এই পথচলার মধ্য দিয়ে সাহিত্য শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা কালি ও কলম হয়ে উঠেছে বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পত্রিকা। সেই ধারাবাহিকতায় কালি ও কলম  পরিচর্যা করে আসছে নবীন কবি ও লেখকদের।’
এরপর পুরস্কৃত সাহিত্যকর্মের শংসাবচন পাঠ করেন কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ ও অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল। এতে শুভাশিস সিনহার সৃজনকর্ম নিয়ে বলা হয়, ‘যথার্থ কবিপ্রতিভার প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুভাশিস সিনহা রচনা করেছেন হওয়া না-হওয়ার গান কাব্যগ্রন্থ। কবিতার প্রধান গুণ যে ব্যঞ্জনাধর্মী ও শব্দছন্দ নিরীক্ষা তা এই কাব্যে রয়েছে। বিষয়ভাবনার ক্ষেত্রে হয়তো তিনি চিরাচরিত প্রেম ও প্রকৃতিকেই বেছে নিয়েছেন। কিন্তু ভাবনাটি রূপায়ণের ক্ষেত্রে তা আর চিরাচরিত থাকেনি, চেতনার ও বলার ভঙ্গির জন্য তা হয়ে উঠেছে আলাদা ব্যঞ্জনা সৃষ্টিকারী।’ স্বকৃত নোমানের রচনা-প্রসঙ্গে বলা হয়, ‘ত্রিপুরা রাজ্যের বিস্তৃত এক কিংবদন্তিকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে রাজনটী উপন্যাস। এই বই বাঙালি নারীর মর্যাদা ও সম্মান, অবস্থা ও অবস্থান সুরক্ষার অভিযানে দুর্লভ এক শিল্পসৃষ্টি। কিংবদন্তিকে উপন্যাসিক অবয়ব দেওয়ার ক্ষেত্রে লেখক এখানে যে শিল্পিতার পরিচয় দিয়েছেন, নিঃসন্দেহে তা নিজস্বতাচিহ্নিত।’ সুমন সাজ্জাদের রচনার বিষয়ে বলা হয়, ‘সুমন সাজ্জাদ বাংলাদেশের সাহিত্যের সীমানা থেকে প্রান্তের কথকতাকে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এ বইটিতে লেখক সাহিত্যের ইতিহাসের সদর অন্দরে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন, দেখেছেন প্রান্তিকতার কয়েকটি পরিসর ও প্রকৃতি, জাতিসত্তা ও সাহিত্যের আন্তঃসম্পর্কের মাত্রা। তার বিশ্লেষণে আছে নতুন চিন্তার উৎস, ভাষায় আছে শিল্পের কারুকাজ।’ মিজানুর খানের রচনা সম্পর্কে বলা হয়, ‘ইয়োরোপের জার্মানি আর বাংলাদেশের পরমতলা গ্রামের পরিসরে তাঁর কাহিনি বিস্তৃত। যুদ্ধ, মানুষের লড়াই, কিছু বিরোধী মানুষের নৃশংস অমানবিক কার্যকলাপ, হত্যা ও মৃত্যুর ঘটনা তুলে ধরে মিজানুর খান দেখাতে চেয়েছেন যে, স্বাধীনতা, অস্তিত্ব রক্ষা ও আত্মমর্যাদা বজায় রাখার লড়াইয়ের প্রাক্কালে বিশ্বের সব দেশই এক। বিশ্বজুড়ে মানবপ্রজাতি একই নিয়তি বরণ করছে। পরমতলা গ্রামের মুক্তিযুদ্ধ ও মায়ের নির্যাতনের কাহিনি আর জার্মানির যুদ্ধঘটনায় নারীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আত্মমর্যাদা ত্যাগের ঘটনা একই তাৎপর্য বহন করে। এই কাহিনির সঙ্গে লেখক জুড়ে দিয়েছেন বর্তমানের এক প্রবাসীর বেঁচে থাকার লড়াইকে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনাধারায় সোনার পরমতলা একটি মূল্যবান সংযোজন এবং এটির স্থান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।’
পরে পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকেরা তাঁদের অনুভূতি প্রকাশ করেন। উপস্থিত দর্শক ও গুণীজনদের শোনান সাহিত্য নিয়ে তাঁদের নিজস্ব ভাবনার কথা। পুরস্কার পেয়ে তাঁরা প্রত্যেকেই আনন্দিত, উৎফুল্ল। আপ্লুত। শুভাশিস সিনহা বলেন, ‘কবিতা নিজের মতো করে লিখে গেছি ভালোবাসার জায়গা থেকে। পুরস্কার পাবো তা কখনো ভাবিনি। এ পুরস্কার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।’ তিনি আরো বললেন, ‘কাব্যবিমুখ এই রূঢ় সময়ে কবিতাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই অন্তরের সারসত্তা দিয়ে। আগামী দিনগুলোতে সেই লক্ষ্যেই পরিচালিত হবে আমার সাহিত্যকর্ম।’
সুমন সাজ্জাদ বলেন, ‘তরুণদের ভাব-ভাবনা ও সৃজনকর্মকে মূল্যায়ন করবার উদ্যোগ বাংলাদেশে খুবই কম। এই স্বীকৃতি আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার। এই স্বীকৃতিকে মর্মে ধারণ করে আমি এগিয়ে যেতে চাই আমার সাহিত্যকর্ম নিয়ে।’
স্বকৃত নোমান বলেন, ‘শিল্প-সাহিত্যের প্রতি দায়বোধ ও ভালোবাসা থেকে লেখালেখি করছি দীর্ঘদিন ধরে। পুরস্কার পাব তা ভাবিনি। এ পুরস্কার আমার দায়বোধ, কর্তব্য ও ভালোবাসাকে আরো শাণিত করবে আশা করি।’
লন্ডন থেকে প্রেরিত বার্তায় মিজানুর খান বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি একজন লেখকের যা কিছু বলার তার পক্ষ হয়ে সেটা বলবে তার বই। তাই একজন পাঠকও যদি বইটা পড়েন এবং বলেন যে তার ভালো লেগেছে, তাহলেই আমি বুঝবো যে আমার কথাগুলো আমি ভালোভাবে বলতে পেরেছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার বিশ্বাস একজন লেখক কখনো পুরস্কার পাওয়ার আশায় লেখেন না; কিন্তু এই পুরস্কার তাকে আবার একটা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখেও দাঁড় করিয়ে দেয়, তাকে আরো ভালো লেখা লিখতে হয়। কালি ও কলম আমাকে এখন এরকমই এক কঠিন রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে।’
সবশেষে বক্তব্য রাখেন কালি ও কলম-সম্পাদক আবুল হাসনাত। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সাহিত্যের উন্নয়ন ও বিকাশে তরুণদের সাহিত্যসাধনার রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। তাঁদের হাত ধরে এগিয়ে যাবে আগামীদিনের সৃজনধারা। তরুণদের সাহিত্যচর্চার পথ সুগম হোক ও তাঁদের সৃজনপ্রতিভা সমাজ অঙ্গীকার, মানবিকতা বোধ ও দেশ ও ভুবনকে সমৃদ্ধ করবে – এই প্রার্থনা করি।’

অনুষ্ঠানে আয়োজকরা জানান, আগের বছরের তুলনায় ২০১১ সালে তাঁরা তরুণদের অধিক সাড়া পেয়েছেন। এবারে জমা পড়েছিল মানসম্পন্ন অনেক বই। পাঁচ সদস্যের বিচারকমন্ডলী প্রাথমিক বাছাই করেন। এই কমিটির সদস্য ছিলেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, কবি খালেদ হোসাইন ও কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। এরপর অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ও অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ চূড়ান্ত ফলাফল স্থির করেন। আয়োজকরা আরো জানান, এই বিচার-প্রক্রিয়ায় এইচএসবিসি এবং কালি ও কলমের কেউ কোনোভাবেই যুক্ত ছিলেন না।

Leave a Reply