একটি কাঙ্ক্ষিত শোক সংবাদ

আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা এলোমেলো চক্কর দিয়ে গিয়ে উঠেছে দয়াগঞ্জ বাজারের মুখে। তখন বিকেলের শেষ ভাগ, মা আমাকে টুকটাক সদাইপাতি আনার জন্য বাজার করতে পাঠিয়েছিলেন। আধা সের লম্বা কালো বেগুন, শিম, আলু আর এক হালি ডিম কিনে আমি যখন দয়াগঞ্জ থেকে বাড়ির দিকে এগোচ্ছিলাম তখন আমার সামনে বারবার মায়ের ছবি ভেসে উঠছিল। দুপুরের পর আমি যখন বিমলাকে পড়াতে ওদের নন্দলাল দত্ত লেনের বাড়িতে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হচ্ছি মা তখন আমার পেছন পেছন দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। আমি আমার পেছনে মায়ের উপস্থিতি অনুভব করতে পারি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মা কী বলেন সেটা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছি।

মা বললেন,

খোকা –

মা যখন আমাকে নাম ধরে ডাকেন তখন আমার মধ্যে এক ধরনের উপলব্ধি টের পাই। এই উপলব্ধি কোথা থেকে উৎসারিত আমি বুঝি না। তবে মায়ের খোকা ডাক আমার মধ্যে এক ধরনের ধন্দ তৈরি করে। ধন্দ নাকি ঘোর? আমি এই ধন্দ কিংবা ঘোর কিসের তাও জানি না। শুধু এতটুকু বুঝি মায়ের এই খোকা ডাকের মধ্যে আমি যেন কোথা থেকে আমার বাবার গন্ধ পাই। ছায়া পাই।

আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে মায়ের দিকে তাকাই। দুপুরের রোদ তখন জানালা দিয়ে আমাদের রাস্তা লাগোয়া ঘরে এসে পড়েছে, তাতে একটা আলোছায়ার খেলা তৈরি হচ্ছে ঘরে। আমাদের এই ঘর থেকে বসুবাজার লেনের রাস্তা দেখা যায়। এই ঘর ছিল বাবার একান্ত ঘর। আমরা বলতাম, বাবার ঘর, আর বাবা বলতেন বৈঠকখানা। বাবা এই ঘরে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আড্ডা দিতেন।

মা, কিছু বলবে?

তোর কলেজ ফাইনাল কবে?

মায়ের মুখে রোদ এসে পড়ছে। খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে মাকে।

মাকে দরজার কাছে অমন চিন্তিত দেখে আমি একটু ভড়কে গেলাম। ভেতরের ঘরে সাবু, রুমি আর মুন্নি ঘুমোচ্ছে। দুপুরে ভাত খাওয়ার পর মা ওদেরকে ঘুম পাড়ান।

এই তো আর মাস দুয়েক পর, কেন?

ও – বলে মা আর কথাটা শেষ করলেন না। খোকার মনে হলো, মা যেন আরো কিছু কথা ওকে বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বলতে পারলেন না। খোকার দিকে মা কেমন করে তাকালেন। ইদানীং মায়ের মধ্যে কিছু পরিবর্তন খেয়াল করছে খোকা। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে যেসব পরিবর্তন এসেছে। আগে সে মায়ের মধ্যে এসব দেখেনি। খোকা লক্ষ করেছে সে যখন ঘরের বাইরে বের হয় তখন মা তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। ঘর থেকে দরজা পর্যন্ত আসা অবধি মা তার পেছন পেছন আসেন। বাবা যখন অফিসে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে এগোতেন মা তখন এরকম করে বাবার পেছন পেছন ঘরের দরজা পর্যন্ত যেতেন। বাবা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে মা পেছন থেকে গম্ভীর হয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলতেন। বাবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের সব কথা শুনতেন। মায়ের কথার বিপরীতে বাবা খুব একটা কথা বলতেন না। মায়ের দিকে চোখ রেখে বাবা শুধু হু-হা করতেন। কখনো কখনো নেমে যাওয়া গলায় বলতেন, মুকুল, তুমি অত ভেবো না। দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

বাবা প্রায় দিনই মাকে এ-কথা বলতেন। বাবার কথায় মা বলতেন, তুমি সব সময় এ-কথা বলো। কই, সবকিছু তো আর ঠিক হচ্ছে না, হয়ও না – এই দুপুরবেলা, দরজায় দাঁড়িয়ে বাবার কথা মনে পড়ে খোকার। সে নিজেকে বাবার জায়গায় ভাবতে থাকে। ছেলেরা বড় হয়ে উঠতে থাকলে বাবারা তাদের মধ্যে ভর করেন। সে ভাবতে থাকে, তার মধ্যে সেই ভর করার ব্যাপারটা আসছে। এই ভাবনাটা খোকাকে একটা অন্য রকমের আনন্দ দিচ্ছে। আর তখনই দুপুরবেলাটা খোকার কাছে মোহনীয় হয়ে ওঠে।

মা, তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?

খোকা, সকালে সেকান্দর আলী এসেছিল।

সেকান্দর আলীর নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে খোকার মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে একটা গালি বেরিয়ে আসে, শুয়োরের বাচ্চা!

এই লোকটাকে দেখলেই বাবা বলতেন, সেকান্দরকে দেখলে মানুষ বলে মনে হয় না। আচ্ছা, সেকান্দরকে মানুষ বলে মনে না হলে সে আসলে কী? বাবাকে মেরে ফেলার পেছনে সেকান্দরের হাত রয়েছে – মা সব সময় এরকম সন্দেহ করেন। খোকাও আজকাল সেরকম মনে করে।

সেকান্দর কিছু বলেছে?

কী আর বলবে? সেকান্দরের তো একটাই কথা, এই বাড়ি তাকে ছেড়ে দিতে হবে।

বাবার কেনা বাড়ি আমরা কেন সেকান্দর শয়তানকে লিখে দেব? দেশটা মগের মুল্লুক হয়ে গেছে! সেকান্দর যা কিছু বলুক, ওকে আগ বাড়িয়ে তুমি কিছু বলতে যেও না।

না, আমি কিছু বলিনি – ওরে দেখলেই আমার গা ঘিন ঘিন করে – তোমাকে কিছু করতে হবে না, যা করার আমিই করব – বলে খোকা থামল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, যাতে মা শুনতে না পারেন, একদিন রাতের অন্ধকারে আমি ওরে শরৎগুপ্ত রোডের মোড়ে মেরে ফেলে রাখব। তবে সেকান্দরকে মেরে ফেলার আগে খোকা একটা কাজ করবে, সেটা হলো, তার চোখ জোড়া জং ধরা ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে উপড়ে ফেলবে। এ-কথাটা খোকা উচ্চারণ করে না। সেকান্দরের রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত লাশকে আকাশমুখো হয়ে পড়ে থাকতে দেখে মহল্লার সবাই বলাবলি করবে, আহারে, এককালের মুসলিম লীগের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পাণ্ডা সেকান্দরের এ কী অবস্থা! আইচ্ছা সেকান্দররে মাইরা ফালাইছোছ মাইরা ফালাইছোছ, তয় ওর চোখ দুইটারে উপড়াইয়া নিলি ক্যালা? ওর চোখ দুইটা কি দোষ করছিল?

একদিন সেকান্দরের লাশ হয় শরৎগুপ্ত রোড, না হয় বসুবাজার লেন, না হয় মনির হোসেন লেন, না হয় বেগমগঞ্জের মোড়, না হয় দয়াগঞ্জ বাজারের আশপাশে পড়ে থাকবে। খোকার চোখে সেকান্দরের ক্ষতবিক্ষত লাশ – এরকম দৃশ্যকল্প একের পর এক ভাসতে থাকে কচুরিপানার মতো।

সেকান্দর খুব খারাপ লোক। বাবা তুই সাবধানে থাকিস – মা, আমাকে নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। আজ বিমলাদের ওখান থেকে ফেরার পথে রিয়াজ কাকার সঙ্গে দেখা করে আসব। বাবার মামলার ব্যাপারে আজ আমাকে যেতে বলেছেন।

রিয়াজভাইয়ের সঙ্গে কথা বলিস। সেকান্দরের মতিগতি ভালো লাগছে না। মা আর কিছু বললেন না।

মা, তুমি অত কিছু ভেবো না। দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

খোকার কথা শুনে মা তার দিকে তাকালেন। মায়ের দীর্ঘশ্বাসের ঝাপটা তার শরীরে এসে লাগে। খোকা সেটা বুঝতে পারে।

দুই

রামকৃষ্ণ মিশন রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলেন আফসার আহমেদ। বিকেলের পর থেকে তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। শরীরে জ্বর আছে তার। এই জ্বরটা খুব খারাপ। অক্টোবরের শেষভাগে নিয়ম করে এই জ্বরটা আফসার সাহেবের শরীরে এসে থির হয়। এই জ্বরে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। গত দশ-বারো বছর ধরে নিয়ম করে জ্বরের এই ব্যাপারটা ঘটছে আফসার আহমেদের।

আজ কত তারিখ?

সেপ্টেম্বর মাসের ঊনত্রিশ তারিখ, অথচ শরীরে অক্টোবর মাসের জ্বরের উপস্থিতি আফসার সাহেবকে ভাবিয়ে তোলে। দুপুরের দিকে অফিসে ঢুকলেন তিনি। নিউজরুমে তখন সাব-এডিটর আসিফুর রহমান আর সম্পাদকীয় বিভাগের আহির হোসেন বসে চা খাচ্ছিলেন। নিউজরুমটা প্রায় খাঁ-খাঁ করছে। কী একটা বিষয় নিয়ে আসিফুর রহমান আর আহির হোসেন হাসাহাসি করছিলেন। আফসার আহমেদকে নিউজরুমে ঢুকতে দেখে তারা হাসির মাত্রাটা কমিয়ে আনলেন। আসিফুর রহমান বললেন, আফসারভাই, পুরান ঢাকার জমি দখল নিয়ে আপনার রিপোর্টটা মার-মার কাটকাট হয়েছে। চারদিকে তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে গেছে।

আফসার আহমেদের শরীরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠছে। সেইসঙ্গে প্রচণ্ড ব্যথা তো আছেই। আফসার সাহেব আসিফুর রহমানের কথায় কিছু বললেন না। নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। তার মাথাটা খুব ধরেছে।

আসিফুর রহমান কথার জবাব না পেয়ে একটু বিরতি দিলেন। তারপর বললেন, ভাই, আপনাকে এরকম লাগছে কেন? শরীর খারাপ নাকি?

আফসার আহমেদ কিছু বললেন না। সিলিংয়ের দিকে তাকালেন। সিলিংয়ের কয়েক জায়গায় হালকা ফাটলের রেখা বিদ্যুচ্চমকের মতো এঁকেবেঁকে গেছে। পিয়ন জাহাঙ্গীর এসে আফসার আহমেদের জন্য টেবিলে এক কাপ চা রেখে গেল। আফসার আহমেদ অফিসে এলে আলগা পাতি দিয়ে কড়া লিকারের এক কাপ চা তার টেবিলে দিতে হবে।  জাহাঙ্গীরের মনে হলো, আফসার সাহেব বুঝি তার দিকে তাকালেন। আফসার আহমেদের মনে হলো, কেউ বুঝি হঠাৎ করে নিউজরুমের সব লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি সবকিছু অন্ধকার দেখছেন এবং তিনি আর চেয়ারে বসে থাকতে পারছেন না। তার মাথা ভনভন করে ঘুরছে।

নিউজ এডিটর গোলাম সারওয়ার নিউজরুমে ঢুকে দেখলেন আফসার আহমেদ চেয়ারে কাত হয়ে বসে আছেন। আফসার আহমেদকে ওভাবে কাত হয়ে বসে থাকতে দেখে তিনি চমকে গেলেন, আফসার সাহেব, আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?

বলতে বলতে গোলাম সারওয়ার দেখতে পেলেন তার চোখের সামনে আফসার আহমেদ চেয়ারে কাত হতে হতে ধীরে ধীরে মেঝের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। সারওয়ার সাহেব দ্রুত এগিয়ে গিয়ে আফসার আহমেদকে ধরে ফেললেন,

আপনি ঠিক আছেন তো?

আফসার আহমেদ মøান গলায় বললেন, সারওয়ারভাই, আমার মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে –

এরপর বেশ কিছুক্ষণ নিউজরুমের কোনায় একটা টেবিলে আফসার আহমেদ শুয়েছিলেন। টিকাটুলীর মোড়ের অর্চনা ওষুধ ঘরের নিরাভরণ দাশ এসে আফসার আহমেদকে দেখে বললেন, তেমন কিছু হয়নি। অতিরিক্ত টেনশন আর অনিদ্রা থেকে এরকম হয়েছে। কয়েকদিন বিশ্রাম নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

সন্ধ্যার পর পত্রিকা অফিস থেকে বের হয়ে গেলেন আফসার আহমেদ। চলে আসার সময় সারওয়ার সাহেব আফসার আহমেদকে বললেন, আফসার, আপনার রিপোর্টগুলো নিয়ে সরকারের অনেক নেতাই ভীষণ ক্ষেপে আছে। টেলিফোনে উল্টাপাল্টা হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন আমাদের। আমরা খুবই চিন্তিত। আফসার, আপনি সাবধানে থাকবেন।

অফিসের স্কুটার আফসার আহমেদকে শরৎগুপ্ত রোডের মাঝখানে বেগমগঞ্জের মোড়ে নামিয়ে দিয়ে গেল। স্কুটারের চালক ইসমাইল বলল, স্যার আপনেরে বাড়ি পর্যন্ত নামায়া দিয়া আসি?

আফসার আহমেদ ইসমাইলকে না করে দিয়েছেন। কী দরকার আবার কষ্ট করে বাড়ির দরজা পর্যন্ত নামিয়ে দেওয়ার? আফসার আহমেদের এত তাড়াতাড়ি অফিসের স্কুটারে বাসায় চলে আসাকে মুকুল কীভাবে নেবে? আর ইসমাইল যদি মুখ ফসকে মুকুলকে অফিসে অসুস্থ হয়ে পড়ার কথা বলে দেয় তাহলে আর রক্ষে নেই। এসব ভাবনা আফসার আহমেদকে মুহূর্তে সচেতন করে তোলে।

কী দরকার অযথা মুকুলকে চিন্তার মধ্যে ফেলার? দরকার নেই এসবের।

আফসার আহমেদ ভাবলেন, বেগমগঞ্জের এই মোড় থেকে আট-দশটা বাড়ি পরেই তার বাড়ি। দুই-তিন মিনিটের হাঁটাপথ। শরৎগুপ্ত রোড থেকে বসুবাজার লেনের গলিতে ঢুকলে কয়েকটা বাড়ির পর পড়বে মল্লিক বাড়ি। মল্লিক বাড়ির ভেতর থেকে দেয়াল ছাপিয়ে কামিনী গাছের ডালপালা রাস্তায় এসে পড়েছে। সেই ফুলের ঘ্রাণ আফসার আহমেদের খুব পছন্দ। প্রায় রাতে নিজের বাড়ি ফেরার পথে এখানে এসে তিনি কামিনী ফুলের ঘ্রাণ নেন। এই ঘ্রাণে তার বুক ভরে যায়। আজো আফসার আহমেদ মনে মনে ভাবলেন, কামিনী ফুলের ঘ্রাণ নিতে পারলে তার মাথাব্যথাটা বুঝি খানিকটা কমে যাবে।

তিনি শরৎগুপ্ত রোডের মাথায় স্কুটার ছেড়ে দিলেন। সন্ধ্যারাতের পর এলাকার রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা। দু-একটা রিকশা বেগমগঞ্জ হয়ে দয়াগঞ্জের দিকে চলে যাচ্ছে। বাবরের বাকরখানির দোকানের ঝাঁপ বন্ধ, পাশের সুজাতা টেইলার্সের মাস্টার মজিদ মিয়া দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। আফসার আহমেদ স্কুটার থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়ালেন। তার এখন খুব সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছে। নিরাভরণ বাবু সন্ধ্যায় কঠিন ভাষায় আফসার আহমেদকে বলেছেন, সাংবাদিক সাব, সিগারেট খাওয়া বাদ দিতে হবে।

আফসার আহমেদ সন্ধ্যা অতিক্রান্ত রাতের আঁধারে বাতাস বাঁচিয়ে কায়দা করে সিগারেট ধরিয়ে বসুবাজার লেনের গলির ভেতরে ঢুকে পড়লেন। গলিতে ঢোকার মুখেই আফসার আহমেদ দেখলেন গলির পুরোটাই অন্ধকারে ছেয়ে আছে। আফসার সাহেব ইলেকট্রিকের খাম্বার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, করপোরেশনের বাতিটা নেই, কে যেন সেটা ভেঙে ফেলেছে। তিনি নিশ্চিত এটা মহল্লার পোংটা পোলাপাইনের কাজ।

আফসার আহমেদ অন্ধকার গলিতে হাঁটতে থাকলেন। দূর থেকে তাকে ঠিক দেখা যাচ্ছে না, তবে যে কেউ ভালো করে খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, বসুবাজার লেনের অন্ধকার গলিতে একটা আগুনের বিন্দু নাচানাচি করছে। তারও কিছুক্ষণ পর অন্ধকার গলিতে কয়েকজন আফসার আহমেদের ওপর পিস্তল আর ধারালো ছুরি নিয়ে হামলে পড়ল। আফসার আহমেদ তাদের কিছু বলতে পারলেন না। অন্ধকারের ভেতর তার কানে ভেসে এলো, শালায় বহুত বাড়ছে – আমাগো বিরুদ্ধে পত্রিকায় রিপোর্ট লেখে?

কারা এসব কথা বলছে?

আফসার আহমেদের কাছে কণ্ঠস্বরগুলি চেনা চেনা লাগে; কিন্তু অন্ধকারে কাপড়ে ঢেকে রাখা মুখগুলি দেখতে পাওয়া গেল না।

তিন

সেকান্দর আলী কম কথা বলার মানুষ। প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা বলেন না তিনি। অযথা বেশি কথা বলে কী লাভ! বাড়ির বাইরে যে বড় ঘর আছে সেই ঘরে তিনি বসে আছেন। দেয়ালে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো খয়রাত আলীর সাদা-কালো ছবি ঝুলছে। পাক দেওয়া গোঁফ। মাথায় চোঙ্গা টুপিতে খয়রাত আলীকে দেখলে মনে হয়, তিনি যেন ঢাকার নবাব পরিবারের কেউ। অবশ্য সেকান্দর আলীর ঘরে অপরিচিত কেউ এলে খয়রাত আলীর ছবি দেখে তার ভারিক্কি চেহারার তারিফ করে আর বলে, সেকান্দর ভাই, আপনের দাদারে দেখলে মনে হয় এক্কেবারে বাঘের বাচ্চা।

তাদের এসব বাতাস দেওয়া কথা শুনে সেকান্দর আলী মনে মনে হাসেন, হ্যাঁ, আমার দাদারে একসময় নবাববাড়ির মানুষজন বহুত পেয়ার করত। দাদায় আছিল হেগো খাস গোলাম। মুসলিম লীগের লাইগা দাদায় হের জান ফানা ফানা কইরা দিছিল। সেকান্দর আলীর দুঃখ একটাই, আমার দাদায় মন-দিলে যতখানি মুসলিম লীগার আছিল বাপে হালায় হের সিকি ভাগও পায় নাইক্কা।

সেকান্দর আলীর সামনে অনেকক্ষণ ধরে বসেছিল রহমত মিয়া। সেকান্দর আলীর নীরবতা দেখে রহমত মিয়া আর চুপ করে থাকতে পারল না। রহমত বলল, সাংবাদিকের পোলাটা খুব বাইড়া গেছে। মহল্লার পোলাপাইনরে আপনার বিরুদ্ধে খেপায়া তুলতাছে। আপনে খালি কন দেখবেন গল্লির অন্ধকারে ওরে ড্যাগার দিয়া পাড় মাইরা ফালায়া দেই।

রহমতের দিকে তাকান সেকান্দর, আমি হুকুম দিলেই তুই ওরে মাইরা ফালাইতে পারবি!

পারুম না ক্যালা? একশ একবার পারুম। খালি কয়াই দেহেন –

চার

বিমলাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নারিন্দা মোড়ে রিয়াজ কাকার সঙ্গে দেখা করে নন্দলাল দত্ত লেনে অজিতদার কাছে গেল খোকা। সেখান থেকে সন্ধ্যার অনেক পর বাড়ির পথ ধরল। নারিন্দা হলুদ মসজিদের ওখানে হেলালের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল খোকার। গতকাল হেলালের সঙ্গে সব নিয়ে কথা হয়েছে। হেলালও সব শুনে বলেছে, তুই যা করবি আমি তর লগে আছি। খালি আমারে কইবি কী করতে হইব।

হেলালকে পেয়ে খোকা বলল, সব ঠিকঠাক?

হেলাল কোমরে হাত দিয়ে কী যেন বুঝে নিল। তারপর বলল, হ, সব ঠিকঠাক।

হেলাল আর খোকা মনির হোসেন লেনের গলিতে ঢুকে নিরঞ্জনদের বাড়ির রকে বসে রইল। হেলাল সিগারেট ধরিয়ে বলল, খোকা টান দিবি নি?

হেলাল জানে, খোকা সিগারেট খায় না।

হেলালকে অবাক করে দিয়ে খোকা বলল, দে, খামু – বসুবাজার লেনের গলিতে বাবার লাশের পাশে আধ টুকরো স্টার সিগারেটের অংশ পড়েছিল। বাবার মুখে ছিল সিগারেটের গন্ধ। হেলালের হাত থেকে খোকা সিগারেট নিয়ে লম্বা একটা টান দিলো।

খোকার এভাবে সিগারেট খাওয়া দেখে হেলাল চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকায়।

পাঁচ

এশার নামাজের পর খোকা বাড়ি ফিরে এলো। খোকাকে দেখে মা বললেন, কই গিয়েছিলি? তোকে এরকম দেখাচ্ছে কেন?

খোকা মাকে কিছু বলল না। মাকে পাশ কাটিয়ে আলনা থেকে লুঙ্গি নিয়ে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গেল। তার এখন একটা গোসল দরকার।

বাথরুম থেকে গোসল শেষ করে বেরিয়ে এসে খোকা মায়ের ঘরে গেল। খোকা মাকে বলল, ক্ষুধা লেগেছে, ভাত-তরকারি হয়ে গেলে আমাকে খেতে দাও।

আফসার আহমেদও অফিস থেকে ফিরে এভাবেই মুকুলকে খাবার দেওয়ার কথা বলতেন। মা খোকার দিকে তাকালেন। ছেলেটা দিন দিন বাবার মতো হয়ে যাচ্ছে।

খোকা যখন খাবার টেবিলে খেতে বসল তখন বসুবাজার লেনের গলি থেকে মাইকের শব্দ শোনা গেল। অন্ধকার গলি থেকে রহমত মিয়ার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হতে থাকে, একটি শোক সংবাদ, একটি শোক সংবাদ।

রহমত মিয়া কি কাঁদছে?