একটি বৃহত্তর বৃত্ত

‘Documenta’ হলো সমসাময়িক শিল্পের একটি প্রদর্শনী, যা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর জার্মানির কাসেল শহরে অনুষ্ঠিত হয়। এটি ১৯৫৫ সালে শিল্পী, শিক্ষক এবং শিল্পতত্ত্বাবধায়ক আর্নল্ড বোড শুরু করেছিলেন। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল, নাৎসিবাদের সাংস্কৃতিক অন্ধকারকে নির্বাসনে পাঠিয়ে আধুনিক শিল্পের কেন্দ্র হিসেবে জার্মানিকে গড়ে তোলা। আন্তর্জাতিক শিল্পমহলে প্রতি পাঁচ বছরে ১০০ দিন ধরে আয়োজিত এই শিল্প-প্রদর্শনী সমকালীন আন্তর্জাতিক শিল্পের প্রতিচ্ছবি হিসেবে স্বীকৃত। এই প্রদর্শনীটির এবারের শিল্পতত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করেছে ‘রুয়াংরুপা’ (Ruangrupa) নামে ইন্দোনেশিয়ার একটি শিল্পীগোষ্ঠী, যারা ৩২টি নির্বাচিত স্থানে দেড় হাজার জন আন্তর্জাতিক শিল্পীর (প্রধানত গোষ্ঠীবদ্ধ) কাজ প্রদর্শন করেছে। এবারের Documenta-র মূল গঠনগত ধারণা হলো লুম্বুং (Lumbung)। এটি ইন্দোনেশিয়ায় প্রচলিত একটি শব্দ যা ধান সংরক্ষণের জন্য গোষ্ঠীভিত্তিক শস্যাগারকে নির্দিষ্ট করে। লুম্বুং-এ সম্প্রদায়ের সুবিধার জন্য উদ্বৃত্ত ফসল সংরক্ষণ করা হয়। বর্তমান Documenta তার অতীতের সংস্করণগুলি থেকে আলাদা, কারণ এই প্রদর্শনীটি আমাদের সমসাময়িক পৃথিবীর ঔপনিবেশিক চিন্তাধারাকে সরাসরি প্রশ্ন করছে এবং শিল্প যে কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রচেষ্টা নয়, বরং একটি সমষ্টিগত সামাজিক অনুশীলন, যা মনস্তাত্ত্বিক অনুভূতির সঙ্গে শিল্পীদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং ভৌগোলিক অবস্থান দ্বারাও নির্ধারিত, তার এক সুস্পষ্ট প্রেক্ষাপট প্রস্তুত করেছে। এই প্রেক্ষাপট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শিল্পচর্চার এক অনন্য উপস্থাপনের জন্যই শুধু নয়, এর মূলে রয়েছে আদিবাসী গোষ্ঠীদের ভূমিহীনতা, ঔপনিবেশিকতা, বর্ণবাদ, ধনতন্ত্র, পুরুষতন্ত্র, বিশ্বব্যাপী জলবায়ুকেন্দ্রিক বিপর্যয় এবং সর্বশেষে মানবতার অবক্ষয় সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা। এই Documenta-তে বাংলাদেশের ‘বৃত্ত’ শিল্পগোষ্ঠীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়া হচ্ছে কৃষ্টি, ইতিহাস, নিপীড়ন, গৌরব দিয়ে মেশানো এক পাঁচমিশালি ভূখণ্ড। একদিকে ঔপনিবেশিকদের নিজেদের আধিপত্য বিস্তার, অন্যদিকে জাতিগোষ্ঠী ধর্ম নিয়ে চলে আশা এক চিরাচরিত অন্তর্দ্বন্দ্ব। এসব মিলিয়ে উত্তর-উপনিবেশী দক্ষিণ এশিয়ার আছে তিনটি প্রধান প্রধান পক্ষ – বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান। যুযুধানরত ভারত ও পাকিস্তান যখন পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণের এক নিরন্তর প্রচেষ্টায় মগ্ন, তখন বাংলাদেশ তার ইতিহাসের ব্যথা ভুলে ও ভবিষ্যতের কথা নিয়ে এগিয়ে চলা এক প্রগতিশীল স্বপ্ন।

‘বৃত্তে’র পথচলা শুরু ২০০২ সালে, ঢাকায়। শিল্পীদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠিত এই গোষ্ঠীটির মূল উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের সমসাময়িক শিল্পের ও সাংস্কৃতিকচর্চায় আত্মনিয়োগ করা। Venice Biennale (দ্বিবর্ষীয়) থেকে শুরু করে Documenta-15 পর্যন্ত অসংখ্য আন্তর্জাতিক মানের সাংস্কৃতিক আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ বৃত্ত।

Documenta 15-এ বৃত্তের কাজে পরিলক্ষিত হয় খাদ্য-রাজনীতি, দুর্ভিক্ষ, বাস্তুচ্যুতি এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের একটি সুস্পষ্ট আন্তঃসংযুক্ত ঐতিহাসিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিফলন। গঠনগতভাবে বৃত্তের কাজকে চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমটি হলো ‘রসদ’ (২০২২)। এই কাজটি Documenta-Halle-এর অন্যতম প্রধান অংশ। রসদের প্রথম ভাগ যেন নাম-না-জানা কোনো এক মফস্বলের বাজারের পুনর্নির্মাণ। এই বাজার রকমারি মালপত্রে ঠাসা এবং প্রতিটি খাদ্যদ্রব্য এমনসব উপাদানে প্রস্তুত যা কি না মূলত সেসব খাদ্য প্রস্তুতে ব্যবহৃত হয় না। প্রথম দেখায় মনে হয়, কোনো নিয়মনিষ্ঠ শিল্পী নিজেকে নিয়োজিত করেছেন মফস্বলের বাজারের অনুকারনিক পুনর্নির্মাণে। কিন্তু এই বাজারে একটু সময় কাটালে বোঝা যায়, বৃত্ত অন্তঃসারশূন্য অনুকরণে আগ্রহী নয়। বৃত্তের ধারণাগত পরিধি বৃহত্তর। এই বাজারে পরাবাস্তব বস্তুর সমাহার যুদ্ধ, ধনতন্ত্র, বস্তুবাদের দৃঢ় সমালোচনা করছে। এখানে অর্থনীতি, হিংস্রতা ও তার সঙ্গে খাদ্যদ্রব্যের পরস্পর নির্ভরশীলতার উদাহরণস্বরূপ দেখা যায় ঠান্ডা পানীয়র বোতল আর ক্ষেপণাস্ত্র কেমনভাবে যেন এক হয়ে গেছে।

রসদের দ্বিতীয় ভাগ এক ইউরোপিয়ান খাদ্যপণ্যের বিপণিকেন্দ্র। যেখানে ঠিক প্রথম ভাগের মতোই সমস্ত কিছু অনুকারনিকভাবে পুনর্নির্মিত – মৃৎকলা, সূচিকর্ম অথবা ধাতব কাজের মাধ্যমে। রসদের এই অংশ যেমনভাবে এই কাজটিকে পৃথিবীর দুই প্রান্তের খাদ্য বিপণনের সেতু হিসেবে দেখায়, ঠিক তার সঙ্গেই উত্তর-উপনিবেশী খাদ্য-সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান পুনঃউপনিবেশায়নের কথা বলে।

রসদে বৃত্তের সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য হিসেবে দেখা যায়, পরাবাস্তব বস্তুর সমাহারের মধ্যে চিরাচরিত মশলা রাখার থলেতে আসল মশলা। ঔপনিবেশিকতার নাগপাশ বিশ্বসহ দক্ষিণ এশিয়াকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। এই মশলা আমাদের খাদ্য-সংস্কৃতির জন্য আশীর্বাদ হলেও আমাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করেছিল। ইউরোপ যে শুধু ঐতিহাসিকভাবে একটি ঔপনিবেশিক শক্তি তা নয়, আজো যে সে পৃথিবীকে তার ক্ষমতার জালে আবদ্ধ করে রেখেছে তা তর্কাতীত। অবিকৃত মশলার উপস্থিতি এক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক রূপক পরাধীনতা এবং পুনঃস্বাধীনতার প্রতীক।

রসদের বস্তুসমূহ তৈরি হয়েছে ঢাকায় অবস্থানকারী পরম্পরাগত বিভিন্ন কর্মশালার সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে।

Documenta-Halle-এ রসদের ঠিক বিপরীতে বৃত্তের আরেকটি এরকম সহযোগী উদ্যোগ দেখা যায়। ‘ছায়াছবি’ (২০২২) একটি বিশালাকার দেয়ালচিত্র (Mural), যা প্রায় সমস্ত Documenta-Halle-এর দেয়াল জুড়ে রয়েছে। এটি প্রায় এক বছর ধরে করা গবেষণার ফসল। এই কার্যক্রমে দুই বাংলার (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) অসংখ্য চলচ্চিত্রে খাদ্য, দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধকে খুঁজে বের করে তার একটি সংঘবদ্ধ আবেগপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ করা হয়েছে। ঢাকার দেয়াললিখন, চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপন, ইশতাহার এবং রিকশাচিত্র নির্মাণকারীরা বৃত্তের অন্যতম প্রধান সহকর্মী এই ‘ছায়াছবি’ নির্মাণের ক্ষেত্রে।

রসদ ও ছায়াছবি – এই দুই কাজের ক্ষেত্রে চারুকলার বাইরে থেকে বৃত্ত যে সহযোগিতা নিয়েছে, তা চারুকলা ও কারুশিল্পের প্রতিষ্ঠিত কিন্তু আরোপিত এক বিভেদকে ভেঙে দেয় এবং পরিচয় করিয়ে দেয় এক বিশুদ্ধ, তরতাজা শিল্প-সংস্কৃতির উদারতার সঙ্গে। যদিও ছায়াছবি কাজটির গুরুত্ব সম্পূর্ণ অন্য একটি কারণেও অনস্বীকার্য। ছায়াছবিতে দুই বাংলার চলচ্চিত্রের সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে দুই বাংলার বাঙালিদের বিভাজন, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ এবং বঞ্চনার আন্তঃপ্রজন্মগত আঘাতকে তা নিরপেক্ষভাবে দর্শকের কাছে উপস্থাপন করে।

বৃত্তের ‘প্রান্তিকের-পথিকজন’ উদ্যোগটি শুরু হয় ২০০৯ সালে। এই উদ্যোগে বৃত্ত বিভিন্ন আমন্ত্রিত শিল্পীর সঙ্গে দূর গ্রামে গিয়ে এক দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালিয়েছে, যেখানে শিল্পের সঙ্গে গ্রামবাংলার আচার-অনুষ্ঠান শিল্পীদের ও গ্রামবাসীকে এক উৎসবমুখর পরিবেশে একত্রিত করে।

‘ফেরা’ (২০২১-২২) বৃত্তের ‘প্রান্তিকের-পথিকজন’ উদ্যোগের এক নবীন বিস্তার। এই ত্রি-আঙ্গিক চলচ্চিত্রে (Three channel video) সাবেক গ্রামগুলি পুনঃপরিদর্শনের পাশাপাশি বৃত্ত ওই গ্রামগুলির ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা, পরিবেশগত সংকট এবং সাংস্কৃতিকচর্চাকে এক কাব্যিক দৃশ্যপটে তুলে ধরেছে। ‘ফেরা’র এই যাত্রায় মৌখিক ইতিহাস, গল্প, গান ও রন্ধন প্রণালি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। ফেরা একটি ঐতিহাসিক ও কৃষ্টিভিত্তিক প্রয়াস। শিল্পের ইতিহাসের দিক থেকে এই কাজটি ক্লেয়ার বিশপের (Claire Bishop) অংশগ্রহণমূলক শিল্পতত্ত্বের (Participatory Art) এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

Documenta-Halle-এর ভোজনালয় পেরিয়ে দেখা মেলে মুক্ত আকাশের নিচে বৃত্তের অন্যতম উদ্যোগ ‘পালন ও পাকঘর’ (২০২২)। এই অংশটি সম্পূর্ণভাবে বাঁশ দ্বারা নির্মিত এবং বাঙালি পরিবারের রন্ধন পরিশীলনকে উৎসর্গ করে নির্মিত। ‘পালন’ অংশটি হলো একটি জৈব তরিতরকারির বাগান, যা কুমড়ো, লাউ, বেগুন, শিম, টমেটো থেকে শুরু করে ভুট্টা কিংবা জুকিনির (এক প্রকারের ধুন্দুল) মতো শাক-সবজি সমৃদ্ধ। পালন পাকঘরকে খাদ্য সরবরাহ করে। বৃত্তের পাকঘরে Documenta-তে আসা দর্শনার্থী ছাড়াও কাসেল শহরের সাধারণ মানুষ, ভবঘুরে সংগীতশিল্পী বা বাংলাদেশ থেকে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রী – সবার অবাধ যাতায়াত। এখানে কাসেল শহরের অভিবাসী জনতা ১০০ দিনে ১০০টি আলাদা জাতীয়তার খাদ্য-সংস্কৃতি উপস্থাপন করছে। পাকঘরে কখনো সুদূর কলম্বিয়ার সমাজকর্মীরা তাঁদের কারাগারে বন্দি সহকর্মীর মুক্তির দাবি জানিয়ে খাবার বানাচ্ছে, বা মধ্য আফ্রিকা থেকে আসা আফ্রিকান অভিবাসীরা তাঁদের খাদ্যের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে উদ্যাপন করছে। পাকঘর তার অস্তিত্বে ফরাসি শিল্প-সমালোচক ও কিউরেটর নিকোলাস বুরিয়েওর আন্তঃসম্পর্কীয় নান্দনিকতা বা মার্কিন শিল্প-ইতিহাসবিদ গ্রান্ট এইচ কেস্টারের সংলাপমূলক নান্দনিকতার প্রতিফলন ঘটিয়েও এদের এক নতুন ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করে। এই স্থানে শুধু খাদ্য কিংবা খাদ্যসংক্রান্ত সংলাপ সৃষ্টি হয় না, সৃষ্টি হয় জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ অথবা শ্রেণীর ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের এক স্বাধীন ক্ষেত্র। বৃত্তের পাকঘরে যেন ভেদাভেদের পৃথিবীতে লালন সাঁইয়ের কথা প্রতিধ্বনিত হয় – ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি, ও মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’।

আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার সমসাময়িক শিল্প-ইতিহাস বা শিল্প-সমালোচনায় যখন একক শিল্পীদের দিকেই সকল মনোযোগ, ঠিক সেই সময়ে বৃত্ত অত্যন্ত শান্তভাবে সমাজের বুকে কান রেখে তার হৃদস্পন্দন শুনেছে উত্তর-উপনিবেশী শিল্পচর্চা, তার সমাজনির্ভরতা ও গোষ্ঠীসূচক অবস্থানের মাধ্যমে নিজেকে উপনিবেশী চিন্তাভাবনা থেকে আলাদা করে। দক্ষিণ এশিয়ার শিল্প-ইতিহাসে গোষ্ঠীভিত্তিক শিল্পচর্চা একটি প্রান্তিক চিন্তাধারা। প্রধানত দুটি কারণে এমনটি হয়েছে। প্রথমত, উত্তর-উপনিবেশী পরিচয় হওয়া সত্ত্বেও উপনিবেশী শিল্পশিক্ষা, মনন ও সমালোচনা। দ্বিতীয়ত, শিল্পীদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও স্বাধীনতার অভাব। আশা করা যায়, বৃত্তের এই আন্তর্জাতিক দৃশ্যমানতা এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে গৃহীত হবে এবং আরো সাহসী শিল্প-অভিব্যক্তির সূচনা ঘটবে।