একবিংশতম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব

‘নান্দনিক চলচ্চিত্র, মননশীল দর্শক, আলোকিত সমাজ’ – সেøাগান সামনে রেখে শেষ হলো একবিংশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। উৎসবটি ১৪ থেকে ২২শে জানুয়ারি (২০২৩) পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মানুষের সাড়া ছিল উল্লেখ করার মতো। উৎসবে আসা বিদেশি প্রতিনিধিরা দর্শকসমাগম দেখে ভীষণ আশান্বিত হন। শুধু তাই নয়, তাঁরা বাংলাদেশি ছবিরও বিশেষ প্রশংসা করেন। দেশের দর্শক ও চলচ্চিত্রপ্রেমীরাও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন এবং প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন, আগামীবার তাঁরা আবারো আসবেন সবান্ধব। 

চলচ্চিত্রের ঝাঁপি

বরাবরের মতো এবারের উৎসবে এশিয়ান প্রতিযোগিতা বিভাগ, রেট্রোস্পেকটিভ বিভাগ, ট্রিবিউট, বাংলাদেশ প্যানারোমা, ওয়াইড অ্যাঙ্গেল, সিনেমা অব দ্য ওয়ার্ল্ড, চিলড্রেন্স ফিল্ম, স্পিরিচুয়াল ফিল্মস, শর্ট অ্যান্ড ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্ম এবং উইমেন্স ফিল্ম সেশনে বাংলাদেশসহ ৭১টি দেশের মোট ২৫২টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। উৎসবের ২৫২টির মধ্যে পূর্ণদৈর্ঘ্য (৫০ মিনিটের বেশি) চলচ্চিত্রের সংখ্যা ১২৯টি, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও স্বাধীন চলচ্চিত্রের সংখ্যা ১২৩টি। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ছিল ৮১টি, যার মধ্যে ৬৯টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও স্বাধীন এবং ১২টি পূর্ণদৈর্ঘ্য।

শুধু ছবি নয়, অর্ধশতাধিক ভিনদেশি চলচ্চিত্রকার, প্রযোজক, চলচ্চিত্র বাছাইকারী ও সমন্বয়ক (প্রোগ্রামার), চলচ্চিত্র-সমালোচক ও বিচারকদের মিলনমেলায় পরিণত হয় ঢাকা শহর। উৎসবে আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, বেলারুশ, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, ব্রাজিল, বুলগেরিয়া, কানাডা, চীন, ক্রোয়েশিয়া, কিউবা, সাইপ্রাস, চেক রিপাবলিক, কঙ্গো,  মিশর, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, প্যালেস্টাইন, জার্মানি, গ্রিস, গুয়েতেমালা, হাঙ্গেরি, ভারত, ইরান, ইরাক, ইতালি, জাপান, কাজাখস্তান, কসোভো, কিরগিজস্তান, লেবানন, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, মালয়েশিয়া, মৌরিতানিয়া, মঙ্গোলিয়া, মন্টেনিগ্রো, নেপাল, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে, পাকিস্তান, পেরু, ফিলিপাইন, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, রাশিয়া, রুয়ান্ডা, সার্বিয়া, সিঙ্গাপুর, সেøাভাকিয়া, সেøাভেনিয়া, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলংকা, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিরিয়া, তাইওয়ান, তাজাখস্তান, থাইল্যান্ড, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, উজবেকিস্তান, ভিয়েতনাম ও ইয়াকুতিয়া থেকে প্রতিনিধি আসার কথা থাকলেও করোনা মহামারির কারণে অনেকেই ঢাকার বিমান ধরতে পারেননি। তবে উল্লিখিত দেশগুলির চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ হয়েছে এদেশের দর্শকদের।

বিগত উৎসবের মতো এবারো বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, বেক্সিমকো গ্রুপ অব কোম্পানিজ, আইএফআইসি ব্যাংক লিমিটেড, রুট গ্রুপ অব কোম্পানিজ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাংলাদেশ। উৎসব পার্টনার হিসেবে ছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, আঁলিয়স ফ্রঁসেজ ঢাকা, স্টার সিনেপ্লেক্স, ঢাকা ক্লাব লিমিডেট, নরওয়েজিয়ান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব হগুসন্ড, রিলিজিওন টুডে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, চ্যানেল আই, দুরন্ত টিভি, একাত্তর টিভি ও সেন্স ফর ওয়েভ, ক্লাউডলাইভ। 

পর্দা উঠল, আলো নিভল

রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মিলনায়তনে চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন উৎসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। উদ্বোধন-শেষে নিভিয়ে দেওয়া হয় সকল আলো। প্রথম দিনই দেখানো হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র, ফাখরুল আরেফীন খান পরিচালিত জে কে ১৯৭১।

যেখানে জমেছিল চলচ্চিত্রের মেলা

জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তন ও কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তন, শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা ও নৃত্যশালা মিলনায়তন এবং আঁলিয়স ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে একাধিক প্রদর্শনী হয়েছে। চলচ্চিত্রপিপাসু মানুষ এসব জায়গায় উপভোগ করেন বিভিন্ন স্বাদের চলচ্চিত্র।

কত চলচ্চিত্র সরোবরে

প্রতিযোগিতা বিভাগের ভেতর ছিল এশিয়ান সিনেমা কম্পিটিশন। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২৪টি চলচ্চিত্র নিয়ে গঠিত (ন্যূনতম ৭০ মিনিটব্যাপী ফিকশন ফিল্ম) প্রতিযোগিতা বিভাগে সেরা চলচ্চিত্র নির্ধারণে ছিল চার সদস্যবিশিষ্ট একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ড। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের জন্য পুরস্কার হিসেবে ছিল একটি ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট এবং নগদ এক লাখ টাকা। এ ছাড়া শ্রেষ্ঠ পরিচালক, শ্রেষ্ঠ

অভিনেতা-অভিনেত্রী, শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক এবং শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের জন্য পুরস্কার হিসেবে ছিল একটি সার্টিফিকেট ও ক্রেস্ট।

রেট্রোস্পেকটিভ বিভাগে দেখানো হয় বিশ^ চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ ফরাসি অতর চলচ্চিত্র নির্মাতা ফ্রাসোঁয়া ত্রুফোর চারটি চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রগুলি হলো : ১. দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ, ২. কনফিডেনশিয়ালি ইওরস, ৩. জুলে এ জিম, ৪. দ্য লাস্ট মেট্রো।   

বাংলাদেশ প্যানোরামায় ছিল বাংলাদেশের নয়টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি। এই বিভাগে প্রথমবারের মতো যুক্ত করা হয় ১০ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি। প্রতিযোগিতায় থাকা ২০টি ছবির ভেতর থেকে বাছাই করা হয় তিনটি শীর্ষ ছবিকে। এই তিনের ভেতর সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ছবি পায় আড়াই লাখ টাকা, প্রথম রানারআপ পায় দেড় লাখ টাকা আর দ্বিতীয় রানারআপ পায় এক লাখ টাকা। বাংলাদেশ প্যানোরামার একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রকে দেওয়া হয় চলচ্চিত্র-সমালোচকদের আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ‘ফিপ্রেসি’র সনদ। ‘ফিপ্রেসি’র পক্ষ থেকে এই বিভাগে ছিলেন তিনজন বিচারক।

সিনেমা অব দ্য ওয়ার্ল্ড বিভাগে বিভিন্ন দেশের সমকালীন সেরা ৪৫টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এই বিভাগের জন্য দর্শক জরিপে একটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয়। চলচ্চিত্রের জন্য পুরস্কার ছিল সার্টিফিকেট ও ক্রেস্ট।

চিলড্রেন্স বিভাগে ১৮টি শিশুতোষ চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। বরাবরের মতো এবারো সব শিশুর জন্য এই প্রদর্শনী ছিল উন্মুক্ত। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য এই বিভাগের চলচ্চিত্রগুলি দেখার বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়। এই বিভাগ থেকে একটি চলচ্চিত্র ‘বেস্ট জুভেনাইল অডিয়েন্স বাদল রহমান অ্যাওর্য়াডে’র জন্য মনোনীত হয়। এখানেও পুরস্কার হিসেবে থাকে সনদ ও ক্রেস্ট।

স্পিরিচুয়াল ফিল্মস বিভাগে প্রায় ১৪টি ছবি প্রদর্শিত হয়। মূলত ধর্মীয় বিশ^াস, অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং মানবতাবাদী চলচ্চিত্র এ-বিভাগে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এ বিভাগের ছবিগুলি আন্তঃধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তৈরিতে সহায়তা করে। এ বিভাগের জন্য ইন্টারফেইথ জুরি একটি শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র ও একটি শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্রকে পুরস্কৃত করে। পুরস্কার হিসেবে ছিল একটি সার্টিফিকেট ও একটি ক্রেস্ট।

উইমেন ফিল্ম মেকার্স সেশনটি দেশ-বিদেশের নারী নির্মাতাদের চলচ্চিত্র নিয়ে সাজানো হয়। এতে দেশি-বিদেশি ২৩টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নারীদের একটি দল দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠিত এই বিভাগের একটি শ্রেষ্ঠ কাহিনিচিত্র ও একটি শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্রকে পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করেন। এছাড়া এই বিভাগ থেকে একজন শ্রেষ্ঠ নারী নির্মাতাকেও পুরস্কৃত করা হয়। পুরস্কার হিসেবে ছিল সনদ ও ক্রেস্ট।

শর্ট অ্যান্ড ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্মস বিভাগে নবীন ও স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের তথ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্রসমূহ প্রদর্শিত হয়। এতে দেশি-বিদেশি ৮৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ছবি দেখানো হয়।

২১তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ওয়াইড অ্যাঙ্গেল বিভাগে এবার প্রদর্শিত হয় ঋত্বিককুমার ঘটকের দুর্লভ প্রামাণ্যচিত্র দুর্বার গতি পদ্মা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ছবিটি নির্মাণ করেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত পরিচালক ঋত্বিক ঘটক।  ঋত্বিক ঘটকের ছবিটি ছাড়াও উৎসবে দেখানো হয় মাসুদুর রহমানের আনরেকগনাইজড (২০২২), নাসরিন ইসলামের রংতুলিতে মুক্তিযুদ্ধ (২০২১), খিজির হায়াত খানের  দওরা সাতজন (২০২২), শায়লা রহমান তিথির  যুদ্ধজয়ের কিশোর নায়ক (২০২২), এস সুখদেবের  নাইন মান্থস টু ফ্রিডম (১৯৭৫), বিনয় রায় ও সি এস নায়ারের রিফিউজি ৭১ (১৯৭৪), শান্তি এস ভার্মার সোনার বাংলা (১৯৭২), শঙ্কর গাঙ্গুলির জন্ম নিলো বাংলাদেশ (১৯৭২), শেরিন ব্র্যান্ডিটের ডেটলাইন বাংলাদেশ (১৯৭২) ও এভজেনি বারখানভের ফ্রিডম ডাজেন্ট লিভ অন মানি (২০২১)। উৎসব কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এবারের ওয়াইড অ্যাঙ্গেল বিভাগটি উৎসর্গ করা হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে।

নারীদের নিয়ে, নারীদের জন্য সম্মেলন

উৎসব চলাকালে ১৫-১৬ই জানুয়ারি ২০২৩ উৎসবের অংশ হিসেবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের জেন্ডার স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টের সহযোগিতায় চলচ্চিত্রে নারীর ভূমিকাবিষয়ক ‘নবম আন্তর্জাতিক উইমেন ফিল্ম মেকারস কনফারেন্স’ অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা ক্লাবের স্যামসন লাউঞ্জে।

উদ্বোধনী দিনের প্রথম প্রবন্ধটি পাঠ করেন বাংলাদেশের স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা মেহজাদ গালিব। তাঁর লেখা ‘হাওয়া : মিথোলজি, মিস্ট্রি অ্যান্ড ম্যাজিক রিয়েলিজম ইন বাংলাদেশি সিনেমা’ শীর্ষক লেখাটি নিয়ে আলোচনা করেন ভারতের নির্মাতা ও অভিনেত্রী অপরাজিতা ঘোষ এবং বাংলাদেশের অভিনেত্রী বন্যা মীর্জা। এই সেশনটি পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর কাবেরী গায়েন।

প্রথম দিনের দ্বিতীয় সেশনে ‘হাজার চুরাসি কা মা টু কালবেলা : পলিটিক্যাল কনস্ট্রাকশন অব লাভ অ্যাফেকশন অ্যান্ড ইনটিম্যাসি ইন নাক্সালাইট মুভমেন্ট : আ ফেমিনিস্ট কনটেমপ্লেশন’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন ভারতের আরভি ইউনিভার্সিটি ব্যাঙ্গালুরুর অধ্যাপক ডক্টর দেবযানী হালদার। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর সাদেকা হালিমের পরিচালনায় সেশনে আলোচক হিসেবে ছিলেন অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির এবং শ্রীলংকার নারী অধিকারকর্মী আনোমা রাজাকারুনা।

প্রথম দিনের শেষ সেশনে প্রবন্ধ পাঠ করেন কানাডার ভ্যানকুভার চলচ্চিত্র উৎসবের সাবেক পরিচালক হানা ফিশার। তিনি উপস্থাপন করেন ‘হু আর উই? হাউ ডু উই মুভ ফরোয়ার্ড?’ শীর্ষক প্রবন্ধ। নাঈমা চৌধুরীর পরিচালনায় এই সেশনে আলোচনা করেন বেলজিয়ামের সাংবাদিক আনিয়া স্ট্রেলেক ও ভারতের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের শিক্ষক ডক্টর ঈপ্সিতা বরাট।

১৬ই জানুয়ারি, সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ‘ফ্রম ঢাকা টু লিউড? টুকি দ্য টাইগার টেকস আর ট্রিপ : অ্যান আনইউজুয়াল প্রজেক্ট’ শীর্ষক প্রবন্ধ পড়েন যুক্তরাষ্ট্রের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ব্যক্তিত্ব সিডনি লেভিন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-নির্মাতা শামীম আকতারের পরিচালনায় এই সময় আলোচক হিসেবে ছিলেন আনিয়া স্ট্রেলেক ও ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক ভারতের স্বাধীন নির্মাতা মোনালিসা দাশগুপ্ত।

দ্বিতীয় দিনের দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘দ্য আই বিহাইন্ড দ্য সিনেমা : রিফ্লেকশনস অন দ্য উইম্যান ওয়ার্কফোর্স অব কনটেম্পোরারি বেঙ্গলি সিনেমা ইন ইন্ডিয়া’ পাঠ করেন ডক্টর ঈপ্সিতা বরাট। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-পরিচালক সৈয়দ সালাহউদ্দীন জাকীর সঞ্চালনায় আলোচনা করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর গীতিআরা নাসরীন ও কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ডক্টর লিপি গ্লোরিয়া রোজারিও।

দ্বিতীয় দিনের শেষ সেশনে প্রবন্ধ পাঠ করেন ক্রোয়েশিয়ার চলচ্চিত্র-প্রযোজক ডালিয়া অ্যালিক। তাঁর ‘হিউম্যান সিকিউরিটি অ্যান্ড ফিল্ম : রিডিসকভারিং দ্য পটেনশিয়াল অব স্টোরিটেলিং ফর সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট অ্যান্ড গ্লে­াবাল পিস’ প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন আনজা স্ট্রেলেক ও ভারতের চলচ্চিত্র-প্রযোজক ও ফিল্ম ফেস্টিভাল প্রোগ্রামার নেহা জৈন। এই সেশনটি পরিচালনা করেন কিশোয়ার কামাল। এই সেশন দিয়েই শেষ হয় দুদিনের সম্মেলন।

চিত্রনাট্য লেখা প্রতিযোগিতা

২১তম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের অংশ হিসেবে ১৫-১৮ই জানুয়ারি আঁলিয়স ফ্রঁসেজ গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয় নির্মাতাদের মিথস্ক্রিয়ামূলক চার দিনব্যাপী সেমিনার ও কর্মশালা ‘ওয়েস্ট মিট ইস্ট : চিত্রনাট্য প্রতিযোগিতা’। চারদিনের কর্মশালা শেষে প্রথম পুরস্কার পায় বাংলাদেশের আফরোজা হোসেইনের লেখা চিত্রনাট্য সং অব ঝিনুক। দ্বিতীয় পুরস্কার পায় নেপালের নিগাম ভাণ্ডারির চিত্রনাট্য মেসেঞ্জার অব দ্য গড। তৃতীয় পুরস্কার পায় ভারতের ঋত্বিক গোস্বামীর লেখা চিত্রনাট্য স্বর্ণপুছরি। শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকে দেওয়া হয় নগদ ৫ হাজার মার্কিন ডলার, দ্বিতীয় স্থান অধিকারকারী চিত্রনাট্য পায় ৩ হাজার মার্কিন ডলার এবং তৃতীয় স্থানজয়ী চিত্রনাট্য পায় ২ হাজার মার্কিন ডলার। এই আয়োজনের কনভেনার ছিলেন চলচ্চিত্র-নির্মাতা আকা রেজা গালিব ও চিত্রনাট্যকার সাদিয়া খালিদ রীতি।

মাস্টারক্লাস

এবারের আয়োজনেই প্রথমবারের মতো মাস্টারক্লাস যুক্ত করা হয়। ২১শে জানুয়ারি দিনব্যাপী মাস্টারক্লাসে চলচ্চিত্র প্রযোজনা, চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ, চিত্রনাট্য উপস্থাপন, প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কলাকৌশল ও উৎসবে চলচ্চিত্র জমা দেওয়া নিয়ে কথা বলেন যথাক্রমে নরওয়ের প্রযোজক গিদা ভেলবিন মাইক্লেবাস্ট, বাংলাদেশের নির্মাতা তাসমিয়া আফরিন মৌ, বেলজিয়ামের নির্মাতা আনিয়া স্ট্রেলেক ও উইক্রেনের প্রোগ্রামার এলেনা রুবাশেভস্কায়া। মাস্টারক্লাসগুলি মডারেট করেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-সমালোচক ও লেখক বিধান রিবেরু।

সমাপ্তি অনুষ্ঠান

একবিংশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় ২২শে জানুয়ারি সন্ধ্যায়। জাতীয় জাদুঘরের মূল মিলনায়তনে অতিথি, জুরি ও বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নির্মাতা, প্রযোজকদের উপস্থিতিতে ঘোষণা করা হয় এবারের উৎসবে বিজয়ী ছবি, তথ্যচিত্র, নির্মাতা, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও চিত্রগ্রাহকের নাম। অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। এছাড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী।

বিজয়ী যাঁরা

এবার শ্রেষ্ঠ শিশু-চলচ্চিত্র ‘বাদল রহমান পুরস্কার বিজয়ী’ চলচ্চিত্র হলো মাজেল আ তায়েম্ফস্তভি লেসা (মার্টিন অ্যান্ড দ্য ম্যাজিক্যাল ফরেস্ট), (চেক প্রজাতন্ত্র, সেøাভাকিয়া, জার্মানি)।

এশিয়ান চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা বিভাগে পোডেল নিকি (দ্য রাশিয়া) চলচ্চিত্রটির জন্য সেরা সিনেমাটোগ্রাফি পুরস্কার বিজয়ী হন আর্টিওম আনিসিমভ। ভারতের অপরাজিত (দ্য আনডিফিটেড) ছবির জন্য সেরা স্ক্রিপ্ট রাইটার হন অনিক দত্ত। ভারতের প্রপেদা (হকস মাফিন) ছবিটির জন্য সেরা অভিনেত্রী মনোনীত হন কেতকী নারায়ণ।

নাকোডো-ম্যাচমেকারস (ম্যারেজ কাউন্সেলর), জাপান, চলচ্চিত্রের জন্য সেরা অভিনেতা ইক্কেই ওয়াতানাবে। জিন্দেগি ভা জিন্দেগি (লাইফ অ্যান্ড লাইফ), ইরান, চলচ্চিত্রের জন্য সেরা পরিচালক আলি ঘাভিতান। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় দি-মাদার (মাদারলেস), ইরান।

বিশেষ অডিয়েন্স পুরস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র হলো জে কে ১৯৭১, বাংলাদেশ। অডিয়েন্স পুরস্কারজয়ী চলচ্চিত্র হাওয়া, বাংলাদেশ। স্পিরিচুয়াল ফিল্ম সেকশনে সেরা তথ্যচিত্র  হলো মহাত্মা হাফকাইন, রাশিয়া। সেরা ফিচার ফিল্ম নির্বাচিত হয় ঘোর ফেরা (ঘরে ফেরা)।

উইমেন ফিল্মমেকারস সেকশনে সেরা তথ্যচিত্র আওয়ার মাদার, গ্র্যান্ডমাদার, প্রাইম মিনিস্টার : সিরিমাভো।

অ্যালে উলেন গেলিয়েবট ওয়ের্ডেন (অ্যাভরিবডি ভালোবাসতে চায়), জার্মানি, চলচ্চিত্রের জন্য সেরা পরিচালক ক্যাথেরিনা ওল। সেরা ফিচার ফিল্ম অ্যাকাউসে মি (লিসেন)।

মহাত্মা হাফকাইন ডির : গ্যালিনা ইভতুশেঙ্কো, আনা ইভতুশেঙ্কো সময়কাল : ৯৬ মিনিট। রাশিয়ার সেরা ফিকশন ফিল্ম ঘরে ফেরা (হোম কামিং), বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ প্যানোরামা সেকশনে সেরা চলচ্চিত্র অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে সাতাঁও। সেরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সেকশনের প্রথম রানারআপ হয় হাঘরে। এই সেকশনের দ্বিতীয় রানারআপ চলচ্চিত্র কৃষ্ণপক্ষ।

প্রতিদিন বুলেটিন

চলচ্চিত্রের যাবতীয় তথ্যসমৃদ্ধ স্মরণিকা প্রকাশিত হওয়ার পাশাপাশি উৎসব চলাকালে প্রতিদিনকার সংবাদসহ একটি বুলেটিন প্রকাশ করা হয়। এখানে চলচ্চিত্রকার, প্রযোজক, অভিনয়শিল্পীসহ দেশি-বিদেশি প্রতিনিধির পরিচিতি, সাক্ষাৎকার, প্রতিবেদন ও কলাম প্রকাশ করা হয়। বুলেটিন সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন মশহুরুল আমিন মিলন।

আয়োজকদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য

১৯৯২ সাল থেকে নিয়মিত চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করে আসছে রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ। এই সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭৭ সালে। রেইনবো চলচ্চিত্র সংসদ একটি অলাভজনক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। সংসদ-এর নিয়মিত কার্যক্রম ও চলচ্চিত্র উৎসবে উন্নত চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্রগুলোর সমাহার ঘটিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত চলচ্চিত্রকার, প্রযোজক, পরিবেশক, প্রদর্শক ও কলাকুশলীদের সুস্থ চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা, সর্বোপরি সুস্থ ধারার নির্মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে এদেশের দর্শকদের রুচির প্রসার ঘটানোই তাঁদের অন্যতম লক্ষ্য।

– কালি ও কলম প্রতিবেদন