একাত্তরের কিছু কথা

উনিশশো একাত্তরের মার্চ-ডিসেম্বরের স্বাধিকার ও সার্বভৌমত্ব অর্জনের যুদ্ধটি ছিল পুরোপুরি একটি জনযুদ্ধ। যেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন প্রশস্ত বুকে, ভয়শূন্য চিত্তে। এই যুদ্ধে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নানাভাবে অংশ নিয়েছিলেন সাধারণ মানুষও। এমন সাধারণ মানুষ হতেও প্রয়োজন অসাধারণ গুণাবলি। এমন কিছু মানুষ ও সাহসী ঘটনার কথা তুলে ধরতেই এই লেখার অবতারণা।

এক

প্রথমেই জানাচ্ছি ফেরদৌসী হক লিনুর কথা। তাঁর বাবার নাম কাজী ইউসুফ আলী এবং মা জোহরা কাশেম। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকার আজিমপুর সরকারি কলোনিতে হলেও পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের নয়নপুরে। বাবা চাকরি করতেন পাকিস্তান সরকারের এস্টাবলিশমেন্ট ডিপার্টমেন্টে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি আজিমপুর স্কুলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্রী।

১৯৭০-এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে আওয়ামী লীগ। তবু বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করতে থাকে পাকিস্তান সরকার। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেও স্থগিত করে ইয়াহিয়া খান। ফলে সারা দেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ওই সময় ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। প্রতিবাদে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান তাঁরা। এছাড়া এই সংগ্রাম পরিষদ থেকে প্রতিটি এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য কমিটি করে দেওয়া হয়। আজিমপুর এলাকায় এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন শহীদুল ইসলাম সানু। মূলত স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যুক্ত থেকেই একাত্তরে নানা কাজ করেছেন ফেরদৌসী হক লিনু। সঙ্গে ছিলেন শিরীন আখতার, কে এ এম আজিজুল হক, শফিকুল ইসলাম, নিজামি, এফ এম জিয়াউল হক ফারুক, শামীম বানু, সালাউদ্দিন আহমেদ বাবলু, শফিউদ্দিন, আব্দুল হক, কাইয়ুম, এনায়েত কবির, বেবী, আব্দুল হাই প্রমুখ।

তাঁদের কাজ কী ছিল? লিনু বলেন : ‘একটা কিছু ঘটবে – এটা নিশ্চিত ছিলাম। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাদে ডামি রাইফেল দিয়ে ট্রেনিং করানো শুরু হয়। ৭ মার্চের পর আমিসহ শিরীন আপা, শামসুন্নাহার ইকু আপা, ফোরকান আপা, সাকি আপা, রাবেয়া আপা, মমতাজ আপা ছাড়াও বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে আসা ছাত্রীরাও ওই ট্রেনিংয়ে অংশ নেন। আমরা ট্রেনিং করি দুদু ভাই ও পেয়ারু ভাইয়ের কাছে। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত চলে এই ট্রেনিং।

‘মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাস থেকেই আজিমপুর কলোনির ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে যেতে থাকে। লিনুরাও যুদ্ধে যাওয়ার জন্য গোপনে নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কথা ছিল সহপাঠী রোজী ও তার ছোট বোন বেবীর সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার। তাঁদের নিয়ে যাবেন ছাত্রলীগের রফিক ভাই (‘লিটল কমরেড’ বলে পরিচিত)। কিন্তু সেটি আর সম্ভব হয় না। নেতাদের কাছ থেকে খবর আসে, দেশে থেকেই কাজ করতে হবে তাদের। শুনে কয়েকদিন খুব মন খারাপ থাকে লিনুদের।’   

কী কাজ করবেন – এমন কোনো নির্দেশনা ছিল? তার ভাষায়, ‘সেটা ছিল না। এর মধ্যে শিরিন আপাদের নিচতলায় আসে ফৌজিয়া খালাম্মারা। তিনি প্রবলভাবে ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষে। আমাদের নানা কাজে যুক্ত থাকেন খালাম্মাও। পাশের বাসাতেই ছিলেন আফজাল সাহেব। আমার খালাতো ভাই আলী হায়দার তখন পুলিশে চাকরি করেন। আমাদের বাসায় থেকেই লেখাপড়া করে মানুষ হয়েছেন। উনিও তখন পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করেন। পাকিস্তানপন্থী পরিবারগুলি ক্রমেই কলোনিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। যেসব বাসা থেকে ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে তাদের বাড়িতে দু-একজন দালাল গিয়ে হুমকি ও ভয় দেখানো শুরু করে। ঠিক তখনই আমরা কলোনির পাকিস্তানপ্রেমী ও দালালদের শায়েস্তা করার পরিকল্পনা আঁটি।’

কীভাবে? ‘নিজেরা মিলেই চিঠি লিখলাম। লাল চিঠি। লেখা থাকত – ‘তোমরা যে দালালি করছ, এ খবর চলে গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে। তোমাদের শায়েস্তা করা হবে।’ শিরীন আপা, আমি আর ফৌজিয়া খালাম্মা চিঠিগুলি লিখি। শিরিন আপার ছোট বোন বেবী ও ভাই নিলুর বয়স তখন বারো বা তেরো বছর হবে। ওদেরসহ বাড়ি বাড়ি গিয়ে লেটারবক্সে চিঠি ফেলে আসতাম। পরদিন সকালবেলায় নানা অজুহাতে ওইসব বাসায় ঘুরতে যাই। তখন দেখতাম চিঠি পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে তাদের রান্না হয়নি, নাওয়া-খাওয়াও বন্ধ। এটা আমাদের খুব আনন্দ দিত। মনে হতো শায়েস্তা করতে পেরেছি। বিচ্ছুদের মতো এভাবেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধটা শুরু হয়।

এর মধ্যে সানু ভাই ট্র্রেনিং থেকে ফিরে আসেন। উনি সেক্টর টু-র অধীনে কাজ করতেন। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল সজীব ভাইদেরও। সানু ভাই চিঠির কথা শুনে বললেন, ‘এভাবে তো হবে না, লিফলেট করতে হবে।’ লিফলেট কেন? বাড়ি বাড়ি মুক্তিযুদ্ধের খবর পৌঁছাতে হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধজয়ের খবর, পাকিস্তানিদের গণহত্যার খবর মানুষকে জানাতে হবে। আজিমপুর কলোনির বেশিরভাগই তখন সচিবালয়ে চাকরি করেন। তাই কলোনির বাড়ি বাড়ি লিফলেট পৌঁছাতে পারলে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগের খবরগুলি দ্রুত সচিবালয় হয়ে পাকিস্তান সরকারের কানে পৌঁছাবে। শুনে আমরা রাজি হয়ে যাই। 

তিনি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের তৃতীয় শ্রেণির এক কর্মচারীকে দিয়ে গোপনে সাইক্লোস্টাইল করে লিফলেট বানিয়ে আনেন। কলোনির কাছের বিল্ডিংগুলিতে বেবী ও নিলু আর দূরের বাড়িগুলিতে আমি, লিটু (শিরীন আপার ভাই) আর শিরীন আপা সন্ধ্যায় হাঁটার নাম করে দরজার নিচ দিয়ে লিফলেট ফেলে আসতাম। এই কাজে ভয় ছিল; কিন্তু ভয়কে জয় করেই কাজ করেছি আমরা। 

একবার পরিকল্পনা করি আজিমপুরের রাস্তায় পোস্টারিং করার। কারণ ওখানকার সড়কে পাকিস্তানি আর্মিদের চলাচল ছিল বেশি। ফৌজিয়া খালার পরামর্শে রংতুলি দিয়ে পাকিস্তানি সেনা আর মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি এঁকে পোস্টারে লেখা হয় – ‘পাক আর্মি সারেন্ডার করো।’ লিটু ও সানু ভাই মিলে পাইওনিয়ার প্রেস থেকে গোপনে পোস্টার ছাপিয়ে আনে।

ওই পোস্টার গোপনে দেয়ালে লাগাতে হবে। কীভাবে সেটা করব? সে চিন্তাতেই রাত পার। অতঃপর আমি আর শিরীন আপা ফজরের আজানের পরপরই আটা দিয়ে আঠা তৈরি করে পোস্টার নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কলোনির গেটের বাইরের রাস্তায় পোস্টার লাগিয়ে দৌড়ে গেটের ভেতর ঢুকে যেতাম। মসজিদে যাওয়ার মানুষ যেন না দেখে, এ-কারণে বিল্ডিংগুলির সিঁড়িঘরে লুকিয়ে যেতাম। সকালে দেয়ালে পোস্টার দেখে কলোনির সবাই অবাক হয়। তারা আলোচনা করতে থাকে, কলোনিতেই মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি রয়েছে।

পোস্টারিং হওয়ার কিছুদিন পরই আজিমপুর কলোনির রাস্তার পাশের বাড়িগুলিতে পাকিস্তানি আর্মিরা তল্লাশি চালায়। ওরাও বুঝে যায়, কলোনির ভেতর থেকেই কেউ এটা করছে। কিন্তু কেউ চিন্তাও করেনি, এগুলি কলোনির মেয়েদের কাজ। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে কাজ করেছি আমরা। স্বাধীনতালাভের পর ওই পোস্টারের একটি কপি বাংলা একাডেমির আর্কাইভে জমা ছিল। কিন্তু পঁচাত্তরের পর সেটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।’ 

একাত্তরে ঈদ উদযাপন না করার নির্দেশ দিয়ে রোজার সময়ে আজিমপুরের মেয়েবিচ্ছুর দল কলোনির বাড়ি বাড়ি চিঠি বিলি করেছিলেন। কীভাবে তা করেছিলেন তাঁরা? সেই পরিকল্পনার আদ্যোপান্ত শুনি মেয়েবিচ্ছু ফেরদৌসী হক লিনুর মুখে।

‘বান্ধবী মলি থাকত ধানমণ্ডি ৫ নম্বরে। তার বাংলা ও ইংরেজি হাতের লেখা খুব ভালো ছিল। ওকে ডেকে এনে শিরিন আপার বাসায় বসিয়ে চিঠি লেখাই। চিঠির মূল বিষয় ছিল এমন – ‘দেশের মানুষকে পাকিস্তানিরা হত্যা করছে। তাই জাঁকজমক করে ঈদ উদযাপন করা যাবে না, নতুন জামাকাপড় পরা থেকে বিরত থাকতে হবে, পরলে তার কাপড় নষ্ট করে দেওয়া হবে। পশ্চিম পাকিস্তানি পোশাক বর্জন করতে হবে, মুক্তিবাহিনীকে সব রকম সহযোগিতা করতে হবে। তা না হলে ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হবে।’ শেষে লেখা হলো – জয় বাংলা, জয় শেখ মুজিব। বিনীত – স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সংগ্রামী বোনেরা।

কিন্তু ওই চিঠিতে ছবি আঁকতে হবে। সেটা কীভাবে করি? সানু ভাইকে বলতেই তিনি চারুকলার অধ্যাপক শামসুল ইসলামকে দিয়ে ডাস্টবিনে খাবার খাচ্ছে মানুষ, দেশের অবস্থা মুমূর্ষু এবং অস্ত্রহাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি আঁকিয়ে সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ওই চিঠি তৈরি করে দেন। একাত্তরের পুরো রোজার মাস আজিমপুর কলোনির বাড়িগুলিতে গোপনে আমরা ওই চিঠি বিলি করেছি। সানু ভাইদের মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়ও এই চিঠি বিলি করা হয়েছিল।

চিঠিতে কি কাজ হয়েছিল?

‘অবশ্যই। শুধু চিঠি বিলি করেই আমরা থেমে থাকিনি। কেউ যদি ঈদে নতুন কাপড় পরে তাহলে তার কাপড় নষ্ট করতে হবে। সানু ভাই অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ের ল্যাব থেকে সালফিউরিক অ্যাসিড চুরি করে এনে দেন। সিরিঞ্জ কেনা হয় ফার্মেসি থেকে। সিরিঞ্জে অ্যাসিড নিয়ে কাপড় নষ্ট করার অস্ত্র তৈরি করেছিলাম আমরা। সাতাশে রমজানের সময় নতুন কাপড় পরে ঈদে আনন্দ প্রকাশের কথা বলেছিল কলোনির কয়েকজন। অ্যাসিড দিয়ে গোপনে ওদের কাপড়গুলি ছিদ্র করে দিই। এ-খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে কলোনিতে। ফলে ভয়ে ঈদের দিনও নতুন কাপড় পরে কেউ আর বের হয়নি।’

ফেরদৌসী হক লিনুর মতো মেয়েবিচ্ছুরা একাত্তরে যা করেছেন তা ছিল অন্যরকম এক মুক্তিযুদ্ধ। ঢাকার ভেতর মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানকে জানান দেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মানুষকে সাহসী করে তোলার কাজটি তাঁরা করেছিলেন গেরিলাদলের মতোই। তাঁদের কাজে জীবনের ঝুঁকি ছিল অনেক বেশি। তবু বুকের ভেতর স্বাধীনতার স্বপ্নকে লালন করে একাত্তরে এমন যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন আজিমপুরের মেয়েবিচ্ছুরা। তাই একাত্তরে তাঁদের অবদান অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

দুই

একাত্তরকে তুলে আনতে মুখোমুখি হই বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মুরাদ হোসেনের। বর্তমানে তিনি রাজধানী ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর। তাঁর বাবা আমজাদ হোসেন সিকদার ছিলেন অ্যাকাউন্টস অফিসার, রেলওয়েতে। সে সুবাদে থাকতেন সৈয়দপুর শহরে, আতিয়ার কলোনির এল-৭৬-বি নম্বর কোয়ার্টারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুরাদ ছিলেন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। একাত্তরকে ঘিরে সৈয়দপুরে বাঙালিদের ওপর বিহারিদের অত্যাচারের অজানা কয়েকটি ঘটনা উঠে আসে তাঁর ভাষ্যে।

তাঁর ভাষায়, ‘সৈয়দপুরে বিহারিরাই নেতৃত্ব দিত। ছয় দফার আন্দোলন চলছে তখন। ফলে ওদের সঙ্গে আমাদের ভেদ তৈরি হতে থাকে। উর্দু ভাষায় নিজেদের মধ্যে নানা আলোচনা করত ওরা। প্রকাশ্যে শেখ মুজিবকে গাদ্দার বলত, গালিও দিত। শুনে ঠিক থাকতে পারতাম না। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সারা দেশে আন্দোলন তখন তুঙ্গে। স্টেডিয়ামের নাম উর্দুতে লেখা ছিল। তা আলকাতরা দিয়ে মুছে দিয়েছিলাম। ১৯৭০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষাশহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করব আমরা। আগেই টাকা তুলে ইট, বালি ও সিমেন্ট দিয়ে স্কুলমাঠে একটা শহিদ মিনার তৈরি করি। কিন্তু রাতের আঁধারে বিহারিরা মেথরদের দিয়ে বাইরে থেকে মল (পায়খানা) এনে ওই শহিদ মিনারের বেদিতে ফেলে রাখে। সকালে এ-দৃশ্য দেখে বুকের ভেতর আগুন জ্বলে ওঠে। ওদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে। কিন্তু তার আগেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেন তৎকালীন এসডিও। নিজ উদ্যোগে শহিদ মিনার পরিষ্কার করে দেন তিনি। পরে সেখানে আমরা শহিদদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করি। পাকিস্তানিদের মতো বিহারিরাও বাঙালিদের ঘৃণার চোখে দেখত।

‘সত্তরের নির্বাচনের সময় ঘটে আরেক ঘটনা। কলোনির পাশে চিকা (দেয়াল লেখা) মারছিলাম। পরিচিত এক বিহারি ছেলে এসে বলে, ‘শেখ মুজিব গুণ্ডা হ্যায়’। শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে যায়। নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। ঘুষি দিয়ে ওর নাক ফাটিয়ে দিই। মুহূর্তের মধ্যে অনেক বিহারি একত্র হয়। ওরা আক্রমণ করে আমার নাক ফাটিয়ে দেয়, নাকের নিচের ডগাটা আজো ভাঙা।’

ছোটবেলায় চঞ্চল ও ডানপিটে ছিলেন মুরাদ। মা খুব শাসন করতেন। তিনি শিক্ষানুরাগী ছিলেন। মাগরিবের নামাজের পর মুরাদদের নিয়ে পড়তে বসাতেন। পাশে বসে তিনিও লাইব্রেরি থেকে আনা বই পড়তেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো ছাড় দিতেন না, বলতেন – ‘পড়াশোনা আগে। তারপর অন্যকিছু।’ মায়ের আদর্শে এভাবেই বেড়ে ওঠেন তাঁরা।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে সৈয়দপুরসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতা দিতে টালবাহানা করতে থাকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। বিহারিরাও তখন বাঙালিদের ওপর চড়াও হয়। মুরাদের ভাষায়, ‘বিহারিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। ওদের নেতা ছিল মতিন হাশমি, সৈয়দপুর কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। পুরো বিহারি এলাকার নেতৃত্ব দিতেন। প্রকাশ্যে তিনি ঘোষণা দেন, ‘২৩শে মার্চ যুদ্ধ হবে। বোঝাপড়া হবে এদেশে আমরা থাকব, নাকি বাঙালিরা।’

‘এর পর থেকে সৈয়দপুরে বাঙালি-বিহারি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ২৪শে মার্চ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে সিভিল ড্রেসে বেরিয়ে আসে।

মাথায় গামছা বেঁধে তারা মেশিনগান দিয়ে ফায়ার শুরু করে। ফলে পাখির মতো বাঙালি মরে। হাজার হাজার লাশ দেখে তৎকালীন এসডিও মুয়ীদ চৌধুরী থানায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। আমরা তখন গ্রামের দিকে লুকিয়ে থাকি।’

কলোনির কোয়ার্টারে তখন তাঁর মা সুফিয়া খাতুনের সঙ্গে থাকতেন দূরসম্পর্কের এক বোন, নাম জোবাইদা। কিন্তু মুরাদ কলোনিতে ফিরতে পারেননি। তাঁর মাথার দামও ঘোষিত হয় প্রকাশ্যে। জীবিত বা মৃত তাঁকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০০ টাকা দেবে বিহারিরা। এতেই তারা ক্ষান্ত হয় না। বাড়িতে আক্রমণ করে মুরাদের মাকে দ্বিখণ্ডিত করে হত্যা করে।

সে-ইতিহাসের কথা বলতে গিয়ে বারবারই থেমে যান মুরাদ হোসেন। বুকে জমে

থাকা কষ্টের পাহাড়ে তখন বৃষ্টি ঝরে। চোখের জলে বুক ভাসিয়ে তিনি বলেন শহিদ মাতার আত্মত্যাগের করুণ ইতিহাস – ‘সৈয়দপুর শহরের সব বাঙালিকে ওরা আটকে রেখেছিল। আন্দোলনে যারা যুক্ত ছিল তাদের ফ্যামিলিকেও বাঁচতে দেয়নি। ১৪ই এপ্রিল রাতে আম্মাকে ওরা নির্মমভাবে হত্যা করে। কলোনিতে ওটাই ওদের প্রথম অ্যাটাক। মেইন রোডের পাশেই ছিল আমাদের কোয়ার্টার, ছাদ দেওয়া একতলা বাড়ি। মার্চের শুরুতেই ছাদের ওপর বিশাল সাইজের একটা বাংলাদেশের পতাকা ও একটা কালো পতাকা লম্বা বাঁশ দিয়ে টানিয়ে দিয়েছিলাম। সেটা দেখা যেত অনেক দূর থেকে। ওই রাস্তা দিয়েই যাতায়াত করত পাকিস্তানি আর্মি। বাংলাদেশের পতাকা দেখে তারা ক্ষিপ্ত হয়।

‘বিহারিরা প্রথম এসে আম্মাকে বলে, ‘উসকো উতার দো।’ তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে টাঙিয়েছে। এটা আমি নামাতে পারব না।’ ওরা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তানি আর্মিদের ভয় দেখিয়ে আবারো পতাকা নামাতে বলে। এবারো আম্মা অস্বীকৃতি জানান। তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ছাদে ওঠার চেষ্টা করে ওরা। কিন্তু আম্মার বাধার কারণে পারে না। ফলে হুমকি ও গালাগাল করে চলে যায়।

‘এর কিছুক্ষণ পরেই আর্মিসহ বিহারিদের একটি সশস্ত্র দল এসে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে। মা তখন রেহালে রেখে কোরআন শরিফ পড়ছিলেন। পেছনের দরজা দিয়ে তিনি ওই বোনটাকে পাঠান পাশের বাড়িতে, আব্বার বন্ধুকে ডেকে আনতে। কিন্তু পথের মধ্যেই বিহারিরা বোনটাকে কুপিয়ে হত্যা করে। সামনের দরজা ভেঙে তারা ঘরের ভেতরে যখন ঢোকে, আম্মা তখন কোরআন শরিফ বুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকেন। ওদের কাছে প্রাণভিক্ষাও চান। কিন্তু পিশাচদের মন গলে না।

কোরআন শরিফ ধরা অবস্থাতেই আম্মাকে ওরা কোপ দিয়ে দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলে। রক্তে ভেসে যায় পুরো ঘর। আল্লাহর কালাম কোরআন শরিফও মাটিতে পড়ে রক্তে ভিজে যায়। মুসলমান হয়েও বিহারিরা এমন বর্বরতা চালিয়েছিল। পরে আম্মার লাশ পাকিস্তানি আর্মিরা ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। তাঁর লাশটাও ফেরত দেয়নি ওরা। বোন জোবাইদার লাশটা রাস্তায় পড়ে ছিল কয়েকদিন। দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকলে স্থানীয়রা পরে তা মাটিচাপা দেন।

‘আশপাশের পরিচিতজনরা আম্মার করুণ ও নির্মম মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে। তাদের মুখেই শুনেছি সবকিছু। বিহারিরা চলে গেলে পাশের বাসার একজন ঘর থেকে আম্মার রক্তমাখা কোরআন শরিফটি তুলে নেন। পরে সেটি আমরা সংগ্রহ করি। রক্তমাখা ওই কোরআন শরিফটাই আমাদের মায়ের শেষ স্মৃতি। যার পাতায় পাতায় রয়েছে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।

‘কোরআন শরিফটা হাতে নিলে বুকের ভেতর ঝড় ওঠে। পতাকা দুটি যদি না টাঙাতাম তাহলে হয়তো ওরা আম্মাকে এভাবে হত্যা করত না। মাঝেমধ্যে নিজেকেও অপরাধী মনে হয়। স্বপ্নে আম্মার চিৎকার শুনে জেগে উঠি প্রায়ই। তখন খুব কষ্ট লাগে। এই দুঃখের কথা ঠিক বোঝাতে পারব না ভাই। দেশ তো স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আমরা তো মাকে ফিরে পাইনি, তাঁর লাশও পাইনি। ফলে তাঁর কবরও নেই। পুরো দেশের মাটিতেই মিশে আছে আমার মায়ের রক্ত। কিন্তু এ-দেশ কি মনে রাখবে আমার শহিদ মাকে?’

তিন

একাত্তরে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পশ্চিম ছাতনাই ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম বদলে হয় আরশাদগঞ্জ। কোন ঘটনার কারণে এমনটি ঘটেছিল সেটি জানতে মুখোমুখি হই বীর মুক্তিযোদ্ধা এ এইচ এম আশরাফুল ইসলাম চৌধুরীর। জগলু নামেই তিনি অধিক পরিচিত। বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বাহুকা গ্রামে। দার্জিলিংয়ের মূর্তিনালা মুজিব ক্যাম্প থেকে এক মাসের ট্রেনিং শেষে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেন ছয় নম্বর সেক্টরে। প্রশ্নের উত্তরে তিনি তুলে ধরেন টুনিরহাটের এক রক্তক্ষয়ী অপারেশনের কথা। তাঁর ভাষায়, ‘টাউড়িদহ নাম এলাকায় ছিল পাকিস্তানি আর্মি ও রাজাকারদের বড় ক্যাম্প। ওটা নীলফামারীর ডিমলা থানার টুনিরহাট এলাকায়। আমরা ছিলাম থল এলাকায়, বাঁশঝাড়ের ভেতর বাংকার করে থাকি। সকালেই খবর আসে রেকি করতে যেতে হবে টুুনিরহাটে। রংপুরের ভাষা জানি না। ফলে রেকি করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তবু নানা তথ্য নিয়ে ক্যাম্পে ফিরি।

‘দুপুরে সিদ্ধান্ত হয় আক্রমণের। মনিভাই ছিলেন ওই অপারেশনের কমান্ডার। ২৭শে অক্টোবর সন্ধ্যায় আমরা রওনা হই। ছোটখাটো অপারেশন করলেও ওটাই ছিল আমাদের প্রথম সরাসরি যুদ্ধ। রাতেই ওদের ক্যাম্পের কাছাকাছি একটি বাড়িতে চলে আসি। ভোর হতে তখনো অনেক দেরি। কমান্ডার বললেন রেস্টে যেতে। দুজন সেন্ট্রি ছিল পাহারায়। ২৮শে অক্টোবর খুব ভোরে অ্যাটাকে যাব। সবাইকে জাগিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব থাকে সেন্ট্রিদের। কিন্তু প্রচণ্ড ক্লান্তিতে তারাও ঘুমিয়ে যায়। যখন ঘুম ভাঙে তখন ফকফকে সকাল। মনিভাই তবুও নির্দেশ দিয়ে বলেন, গো। ডোবার মতো এক জয়াগায় সবাই গিয়ে একসঙ্গে পজিশন নিই। পাকিস্তানি সেনারা ছিল একটু উঁচুতে, পাড়ের ওপরে এক স্কুলের ভেতর ক্যাম্প করা। ক্যাম্পের চারপাশে তারা মজবুত বাংকার তৈরি করেছে কলাগাছ ও বড় গাছের গুঁড়ি দিয়ে।’

‘আমরাই ফায়ার ওপেন করি। দুই ইঞ্চি মর্টার ফুটাই তিনটি। নিয়ম হলো, একবার দুই ইঞ্চি মেরেই পজিশন চেঞ্জ করতে হবে। ওটা করতে যাওয়ার আগেই ওরা বেশ কয়েকটা দুই ইঞ্চি মর্টার ছোড়ে। শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি। এলএমজির দুটি ম্যাগাজিন শেষ করার পরে গুলি আটকে যায় চেম্বারে। ম্যাগাজিনসহ অন্যান্য জিনিস থাকত টোয়াইসির কাছে। টোয়াইসি ছিলেন শহিদুল। তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সহযোদ্ধা শাহজাহানও পাশে নেই। সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই ওদের গুলির মুখে। ফলে আর এগোতে পারিনি।’

‘কথা ছিল, এমনটা ঘটলে উইথড্র করে ওই গ্রামেই দূরে একটা বড় আমগাছের কাছে সবাই একত্রিত হবে। তাই করি সবাই। ওখানে শহিদুলকে নিয়ে আসে এক লোক। তার সারা শরীর কাদায় মাখা। অপারেশনের সময় সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। ফিরে এসে সে-ই জানাল, সহযোদ্ধা আরশাদ আলী মারা গেছে। তার লাশ পড়ে আছে ক্ষেতের ভেতরে। ‘আপনাদের এক লোক মরে পড়ে আছে’ – গ্রামের কয়েকজন লোক এসেও এমন খবর দেয়। আরশাদের বাড়ি ছিল লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলায়। সহযোদ্ধার মৃত্যুর খবরে বুকের ভেতরটা ধুপ্ করে ওঠে।’

‘সহযোদ্ধা হায়দারসহ আমরা আরশাদের লাশটা আনতে যাই। সকালে গুলি খেয়েই মারা গিয়েছে সে। পাকিস্তানিদের গুলি তার বুক ও গলা ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। ক্ষতস্থানের রক্ত তখন জমাট বেঁধে আছে। তার নিথর দেহ পড়ে আছে ধানক্ষেতের ভেতর। এখনো চোখের সামনে ভাসে ওই করুণ দৃশ্য। ভাবলেই বুকের ভেতরটায় চাপ অনুভব করি। তখন তো আমাদের মৃত্যুরও কোনো গ্যারান্টি ছিল না ভাই।’

‘আরশাদ আলীর লাশটা কাঁধে তুলে নিয়ে আমরা ওই গ্রামেই তাকে দাফন করি। তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আকাশের দিকেও গুলি ছুড়ি। ওই গ্রামের নাম ছিল বাদিয়াপাড়া। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পশ্চিম ছাতনাই ইউনিয়নে গ্রামটা। আরশাদকে কবর দেওয়ার পর আমরা ওই জায়গাটার নাম দিই আরশাদগঞ্জ। এভাবে শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা আরশাদ আলীর রক্ত মেখে গ্রামের নাম বাদিয়াপাড়া থেকে হয়ে যায় আরশাদগঞ্জ। গ্রামটি এখনো ওই নামেই আছে। আমরা কৃতজ্ঞ গ্রামের মানুষের প্রতিও। আরশাদ অন্য উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা একজন শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মান জানিয়েছেন। একাত্তরে আরশাদের মতো অনেক শহিদই শায়িত আছেন শত শত গ্রামের মাটিতে। তাঁদের অনেকের নাম ও পরিচয় এখনো অজানা।’

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া মানুষগুলি পৌরাণিক কোনো চরিত্র নয়, বরং বাঙালি বীর। তাঁদের রক্ত, ঘাম, ত্যাগে সৃষ্ট বাংলাদেশ আজ বিশ^দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। আজকের সবকিছুই আগামীর ইতিহাসের অংশ হবে তা নয়, কিন্তু একাত্তরের সকল কথা অনাদিকাল পর্যন্ত আমাদের আলোড়িত করবে।

সকল ছবি লেখকের