ঝরনা আমার প্রতিবেশী পাড়াতো বোন। একটি শহিদ পরিবারের অসহায় সন্তান। প্রায় সময় সে মোবাইলে ফোন করে। সে কখনো কুশলাদি জানাতে বা জানতে ফোন করে না। নিরুপায় হলে ফোন করে। এ নিয়ে তার কোনো সংকোচ বা দ্বিধা নেই। যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, তার ফোন পেলে বিবেকের তাড়নায় ফোন ধরি, কথা শুনি। অধিকাংশ সময় ফোন ধরার পর অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে কান্নার শব্দ। কিছুটা মুহূর্ত পার হলে, প্রয়োজনীয় কথা হয়। একদিন অনেকটা সময় কাঁদার পর যা জানায় তার সারমর্ম হলো : সে একজন উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিক রোগী, দুদিন যাবত তার ঘরে কোনো খাবার নেই। আর একদিন একইভাবে জানায়, তার একমাত্র জীবিত ভাইটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তার পাশে দাঁড়ানো জরুরি, কিন্তু যাওয়ার উপায় নেই। এ-ধরনের নানাবিধ সমস্যায় সে আমার শরণাপন্ন হয়ে থাকে। এখন সে ফোন করলেই বলে দিই, কিছু একটা করব। কান্নার সূচনা পর্বেই কথাবার্তার সমাপ্তি হয়, কারণ ঝরনার কথা আমার ভেতরে রক্তপাত ঘটায়। তার প্রতি সহমর্মিতার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। তবে তার ফোন এলেই বিবেক আমাকে দাঁড় করায় সময়ের কাঠগড়ায়। একই পাড়ায় বাস করে সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছি। ত্রিশ লাখ শহিদ ও তিন লাখ সর্বস্ব হারানো বীর নারীর ত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্ত স্বাধীনতার সুফল ভোগ করেছি, এখনো করছি। অথচ স্বাধীনতা যুদ্ধে ভাই ও বাবাকে হারিয়ে ঝরনা আরো অনেক শহিদ সন্তানের মতো জীবনযুদ্ধে হেরে গেছে। স্বাধীনতার সুফল কখনো দোলায়িত হয়নি ঝরনার আঙিনায়। ঝরনার বাবা সরদার মকবুল হোসেন আর দশজন কেরানির মতো ছয়দফার দাবিতে কণ্ঠ মিলিয়েছেন, উচ্ছ্বসিত চিত্তে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর দু-সন্তান ছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একনিষ্ঠ কর্মী। ঊনসত্তরের অসহযোগ আন্দোলনকালে প্রায় সময় তিনি বলতেন, ‘শেখ সাহেব (সে-সময় আমাদের বাবা-চাচারা বঙ্গবন্ধুকে মুজিবভাই অথবা শেখ সাহেব বলে সম্বোধন করতেন) এবার পাকিস্তানিদের ভালোমতো টাইট দিবে। পাকিস্তানি শোষণের শেকল ভেঙে দেশ এবার স্বাধীন হবেই হবে।’ তাঁর লালিত স্বপ্ন সত্য হয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে; কিন্তু সেই স্বাধীন দেশ দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। এপ্রিলের চার তারিখে (১৯৭১) আমাদের শহরে (লালমনিরহাট) হানাদার বাহিনী অনুপ্রবেশের পরপরই ভয়াবহ গণহত্যায় মেতে ওঠে। একই সময়ে তাদের অবাঙালি (বিহারি) দোসররা ছুরি-চাকু-তরবারি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর। পাড়ায় হানাদাররা পদার্পণের পর স্থানীয় বিহারিরা ঝরনাদের কোয়ার্টারে চড়াও হয়ে চোখের পলকে পরনের কাপড় ছাড়া সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়। কোয়ার্টারগুলো থেকে লোকজনকে ধরে রেলস্টেশন সংলগ্ন বধ্যভূমিতে নিয়ে হানাদারদের দিয়ে হত্যা করাতে থাকে।(এ-সময় শুধু আমাদের পাড়াতেই নারী-পুরুষ-বয়স নির্বিশেষে ৪৮ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয়), এ-ধরনের সন্ত্রস্ত পরিস্থিতির মুখে পড়ে ঝরনার বাবা অনেকটা বিচলিত হয়ে লুণ্ঠকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেঞ্জি-লুঙ্গিপরিহিত অবস্থায় পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান। হয়তোবা তাঁর পরিকল্পনা ছিল ঘাতকদের নজর এড়িয়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে যাবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। শহরের মিশনপাড়ার কাছাকাছি যাওয়ার পর বিহারি ঘাতকরা পথ রোধ করে দাঁড়ায়। অতঃপর ছুরি-চাকু নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর ওপর। ঘাতকদের আক্রমণে মুহূর্তের মধ্যে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তাঁর মরদেহটি দুদিন অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকে মিশনপাড়ার উত্তর পাশের রেললাইন সংলগ্ন একটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে। পরবর্তী সময়ে সুইপাররা মহান শহিদের মরদেহটি স্থানীয় এক গণশবাধারে রেখে আসেন। ঝরনারা বাবার হত্যার সংবাদটি জানার পর বাসায় নেমে আসে শোকের ছায়া – ওঠে কান্নার রোল। ওই শোকাহত পরিবেশে স্থানীয় বিহারি ঘাতকরা বন্য হায়েনার মতো হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে ঝরনার ভাই সাকিউজ্জামান দারাকে। পাকিস্তানকে জিন্দা রাখার জন্য তাঁকে হত্যা করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে তাদের কাছে। তাঁর অপরাধ – তিনি পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন।
একাত্তরের মার্চে জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদের নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিত ঘোষিত হলে, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সারাদেশে সূচিত হয় অসহযোগ আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ৩রা মার্চ ১৯৭১ সালে প্রচারিত ইশতাহারের ৩-এর এ-তে বিধৃত ‘উপনিবেশবাদী পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ব্যবহার করতে হবে’ মর্মে যে-নির্দেশনা দেওয়া হয় তার আলোকে আমাদের শহরেও স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো এবং পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানোর মাধ্যমে প্রতিরোধ দিবস এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এদিন অফিস-আদালতে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে, এমনকি পাড়া-মহল্লার বাসাবাড়িতেও খুব ঘটা করে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানো হয়। এখনকার পতাকার সঙ্গে সেই পতাকার কিছু পার্থক্যও ছিল, তখন যে-পতাকা ওড়ানো হয় তার লালবৃত্তে ছিল হলদে রঙের বাংলাদেশের মানচিত্র। এদিন সোহ্রাওয়ার্দী ময়দানে (তখনকার জিন্নাহ ময়দান) ও স্থানীয় শহিদ মিনারে শত শত ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে খুব উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পতাকা ওড়ানোর আয়োজন করা হয়। বয়েজ স্কাউট সদস্যদের বাদ্য-বাজনার ধ্বনিতে পুরো এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। সেখানে নতুন দেশের নতুন জাতীয় সংগীতও পরিবেশিত হয়। শত শত নারী-পুরুষ-ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে সম্পন্ন হয় ওই মহোৎসব। আগামীদিনের অনিশ্চিত শঙ্কা সত্ত্বেও সে-সময় চারদিকে বিরাজ করতে থাকে আনন্দ ও উদ্দীপনাময় এক প্রশান্তির পরিবেশ। একই সময় আমাদের পাড়ায় (সাহেবপাড়া) সাকিউজ্জামান দারার নেতৃত্বে শিশু-কিশোররাও খুব ঘটা করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিল। তাঁদের বাসার পশ্চিমের লাগোয়া মাঠে সে-সময় এই পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠান হয়েছিল (স্থানটি এখন বস্তিবাসীর দখলে)। সেদিন শুধু স্বাধীন দেশের পতাকাই ওড়ানো হয়নি, সেইসঙ্গে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানের চাঁদ-তারা খচিত পতাকা। সুসজ্জিত অঙ্গনে একটি উঁচু টুলের ওপর দাঁড়িয়ে বিশালাকৃতির ওই পতাকাটি পুড়িয়েছিলেন সাকিউজ্জামান দারা। পতাকায় কোরোসিন তেল মেখে ম্যাচের কাঠি ঠুকেছিলেন সংগ্রাম পরিষদ কর্মী বেলাল সুজা। (পরবর্তী সময়ে পিতার সঙ্গে তাঁকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়)। পতাকা পোড়ানোর ওই দৃশ্য পাড়ার বিহারিরা খুব সন্তর্পণে ক্যামেরায় ধারণ করে রেখেছিল। হানাদাররা পাড়ায় প্রবেশের পরপরই বিহারিরা তাই তাঁকে হত্যা করার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে সে-সময় তিনি বিভিন্ন কোয়ার্টারে ও টয়লেটে আত্মগোপন করে থাকার পর একসময় আমাদের বাসায় আশ্রয় নেন। আমরা তাঁকে ঘরের চৌকির এক প্রান্তে একটি লেপের ভেতর মুড়িয়ে লুকিয়ে রাখি। সারা পাড়া চষে বেড়ানোর পর অবশেষে বিহারি যুবক সাল্লান ও তার ভাইয়ের নেতৃত্বে একদল ঘাতক আমাদের বাসায় ব্যাপক তল্লাশি চালিয়ে তাঁকে লেপের ভেতর থেকে বের করে আনে। অতঃপর তাঁকে কিল-ঘুষি মারতে মারতে ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসে। বাসার সামনের সিঁড়ির গোড়ায় তখন কয়েকজন হানাদার সেনা রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের কাছে দারাকে হস্তান্তর করার পর একজন হানাদার সৈন্য তাঁকে পাকিস্তানের পতাকা পোড়ানোর এবং বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানোর ছবি দেখিয়ে বলে, ‘এই ছবি তোমার?’ নির্বাক দারা কোনো উত্তর না দিয়ে অশ্রুসজল চোখে ঘাতকদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এরপর কয়েকজন বিহারি এবং হানাদার সেনা পাকিস্তানি পতাকা পোড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করে অকথ্য ভাষায় তাঁকে গালাগাল করতে থাকে। একপর্যায়ে চুলের মুঠি ধরে রাইফেলের বাঁট ও বুট দিয়ে লাথি মারতে মারতে তাঁকে বড় রাস্তার দিকে নিয়ে যায়, পেছন থেকে প্রতিবেশী বিহারি সাল্লান চপ্পল দিয়ে মারতে থাকে। দারার ‘মাগো-মাগো’ আর্তচিৎকারে পাড়ার পরিবেশ থমকে দাঁড়ায়। তাঁর মা ও ভাই-বোনদের কান্নায় পুরো পাড়া আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে শোকের ছায়ায়। আমরা হতবাক হয়ে অশ্রুসজল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। মায়ের শত আকুতিতেও গলেনি নিষ্ঠুর ঘাতকদের মন।
মায়ের কোল শূন্য করে দারাকে সেদিন ওরা এভাবেই আমাদের সামনে দিয়ে ধরে নিয়ে যায়। তারপর হানাদাররা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত এই বিপ্লবী তরুণ যোদ্ধাকে হত্যা করে। প্রত্যক্ষদর্শী সুইপার জমাদার লছমির মুখে পরদিন জানতে পারি, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করার পর ওই মহান বিপ্লবীর নিথর শরীরটি ব্রাশফায়ারের মাধ্যমে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছিল। চোখের পলকে চিরতরে হারিয়ে যায় আমাদের খেলার সাথি, স্বাধীন দেশের পতাকা ওড়ানোর এক খুদে মহানায়ক। লক্ষ শহিদের কাতারে শামিল হয় স্বাধীনতার অমিত যোদ্ধা, স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনকারী আমাদের প্রিয় সাকিউজ্জামান দারা। তাঁকে কোথাও মাটিচাপা দেওয়া হয়নি, সমাহিতও করা হয়নি। অন্যান্য শহিদের মতো তাঁকেও পরবর্তী সময়ে রেলওয়ের বিভাগীয় অফিস সংলগ্ন গণশবাধারের খোলা জলাভূমিতে ফেলে রাখা হয়েছিল। আজ স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসের পাতার কোথাও তাঁর নামটি নেই। স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক নির্মিত কোনো স্মৃতিস্তম্ভেও নেই তাঁর নাম। অনভিপ্রেত হলেও বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে শহিদ সাকিউজ্জামান।
বাবা ও ভাইকে হারানোর দুদিন পর ঝরনাদের নিঃস্ব পরিবারটি ভারতে চলে যায়। যুদ্ধের পুরোটা সময় তাঁরা সেখানকার শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করেন। স্বাধীনতার পর ফিরে এসে পিতৃহীন পরিবারটি নিমজ্জিত হয় অনিশ্চিত জীবনের অতল গহ্বরে। ঝরনারা ছিল পাঁচ বোন ও ছয় ভাই। পরবর্তী সময়ে দুই বোন ও তিন ভাই অকালে প্রয়াত হয়। ঝরনার ভাই শহিদ দারা ও বাকি ছিলেন স্বাধীনতা পূর্বকালে একনিষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামী। হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য তাঁরা স্থানীয়ভাবে অনেক পেট্রোল বোমাও বানিয়েছিলেন, বাস্তব ক্ষেত্রে যা কোনো কাজে লাগেনি। স্বাধীনতার পর অন্যান্য শহিদ পরিবারের মতো ঝরনাদের পরিবারকেও বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে নগদ দু-হাজার টাকা ও একটি সমবেদনাপত্র দেওয়া হয়। এরপর কেউ আর তাদের খোঁজ নেয়নি। খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। বিশেষত ’৭৫-এর পর স্বাধীনতাবিরোধী শাসকচক্র অনাবশ্যক মনে করে শহিদ পরিবারগুলোর দিকে ফিরেও তাকায়নি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ-বিষয়ে আন্তরিক হলেও তাঁর আমলাগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিলেন নিস্পৃহ। প্রকাশ থাকে যে, পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর ১৫ই জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা যুদ্ধে শহিদ তথা গণহত্যায় নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা ১৫ দিনের মধ্যে প্রণয়ন ও প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এ-বিষয়ে ১৬ই জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে পূর্বদেশ পত্রিকায় ‘১৫ দিনের মধ্যে গণহত্যার রিপোর্ট দাও’ শিরোনাম সংবলিত প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ তাঁর দলকর্মী ও গণপরিষদের সদস্যদের (এমএনএ) যার যার এলাকায় চলে যেতে এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করেছে তার রিপোর্ট পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে পেশ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আজ বিকালে আওয়ামী লীগ অফিসে দলীয় কর্মীদের এক সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।’ (একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর, সুকুমার বিশ^াস, পৃ ১৭৬)। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের আলোকে পরবর্তী সময়ে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ওই ধরনের কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল কি না সে-সম্পর্কে কিছু আর জানা যায়নি। সে-সময় যদি ওই নির্দেশনার আলোকে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো, তাহলে আজ হয়তো অনেক অনাহূত বিতর্কেরও অবকাশ থাকত না। মহান শহিদগণ পেতে পারতেন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্বীকৃতি। এছাড়াও সে-ধরনের তথ্য সংগ্রহকালে দেশবিরোধী ঘাতক-দালালদের মুখোশও জনগণের সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়ত, সেইসঙ্গে শানিত হতো নব প্রজন্মের চেতনালোক।
এছাড়াও সে-সময় বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক বধ্যভূমিসমূহের শহিদদের কঙ্কাল মর্যাদার সঙ্গে সৎকারের জন্য জেলার অধিকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এ-বিষয়ক একটি প্রতিবেদন ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২ সালে পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ‘বধ্যভূমির কঙ্কাল সৎকারের নির্দেশ’ শিরোনাম-সংবলিত প্রতিবেদনটিতে লেখা হয়েছিল, ‘হানাদার বাহিনীর হত্যার নিদর্শন হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় যে সকল বধ্যভূমি আবিষ্কৃত হচ্ছে, তার কঙ্কালগুলো যথাবিহিত মর্যাদার সাথে সৎকার করার জন্য সরকার বিভিন্ন জেলার অধিকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে এই ব্যাপারে একটি জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ করে সুপরিকল্পিত ও সু-সমন্বিতভাবে বধ্যভূমিগুলোর হাড়গোড়ের সৎকার করার প্রয়োজনীয়তা অনেকেই অনুভব করছেন। জাতীয়ভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করা হলে শহিদদের প্রতি সম্মান দেখানো হবে এবং সাথে সাথে বর্বর হানাদার-বাহিনীর নির্যাতন সম্পর্কে ইতিহাস তৈরী করতেও সুবিধা হবে।’ (একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর, সুকুমার বিশ^াস, পৃ ১৭৬)
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এ-বিষয়ক আদেশের কিছুই প্রতিপালিত হয়নি। স্বাধীনতার পরপর সামরিক-বেসামরিক আমলা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যত দ্রুততার সঙ্গে সাফল্যের সোপানে উপনীত হতে সমর্থ হয়েছিলেন, ততো দ্রুততার সঙ্গে দক্ষতা, সততা ও দেশপ্রেমের সক্ষমতা প্রমাণ করতে পারেননি। ফলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর এ-বিষয়ক নির্দেশনাসমূহ বাস্তবায়িত হয়নি। পরবর্তী পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ঔপনিবেশিক মানসিকতাসম্পন্ন এ-ধারা অব্যাহতভাবে স্ফীত হয়েছে। হারিয়ে গেছে স্বাধীনতার চেতনাধারা, সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ও মানবিক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন। যে-কারণে দেখা যায়, একজন শহিদ পুলিশ অফিসারের স্ত্রীকে স্বামীর পেনশনের সুবিধা পেতে মাত্র ত্রিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়। শহিদের সন্তান নজরুলকে একটি চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়েও ব্যর্থ হতে হয়। আজ দেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত, আর্থিক দিক দিয়ে সাফল্যের চূড়ান্ত সোপানের দিকে অগ্রসরমান, স্বাধীনতার চেতনাধারা সংরক্ষণে সচেষ্ট। তদুপরি কিছু প্রশ্ন আমাদের দাঁড় করায় বিবেকের কাঠগড়ায়। আমরা কি ঝরনার মতো শহিদ সন্তানদের জন্য কিছু করেছি?
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.