মন্ময় জাফর
হুমায়ূন আহমেদ পড়তে শুরু করেছিলাম ঠিক সে-বয়সেই, যখন বাঙালি কিশোর পড়ে শরৎচন্দ্র। শরৎচন্দ্রও পড়েছিলাম, সেইসঙ্গে বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। আমাদের বেড়ে ওঠার সময়টিতে এমন প্রাদুর্ভাব ছিল না টেলিভিশনের। বিবিধ দেশি-বিদেশি চ্যানেলের দৌরাত্ম্য থেকে মুক্ত বয়ঃসন্ধিক্ষণের আমরা সুখ খুঁজে নিতাম ক্রিকেটে, বন্ধুবাৎসল্যে কিংবা বইয়ের জগতে। বরাবরের পড়–য়া চৌদ্দ বছরের নবীন কিশোর সেই আমি স্কুলজীবনের দু-একটি ব্যর্থ প্রেমের পাশাপাশি নিমগ্ন ছিলাম সাহিত্যপাঠে। বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক। সে-সুবাদে বইয়ের সঙ্গেই ছিল ঘরবসতি – এমন একটি স্বভাব যা কিনা এখনো ছাড়তে পারিনি। সেই চৌদ্দ বছরের চৌহদ্দিতে হুমায়ূন আহমেদ দেখা দিয়েছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখকে ধারণ এবং রূপদানকারী এক অদ্ভুত জাদুকর হিসেবে, যাঁর কলমের নৈপুণ্যে বুঁদ হয়ে ছিলাম বেশ অনেকগুলো দিনদুপুর ও সন্ধ্যারাত। আশির দশকের শেষ দিকটিতে হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সাহিত্যজগতের এক দেবতাতুল্য মানুষ অবশ্য ছিলেন না। তবে তাঁর নন্দিত নরকে এবং শঙ্খনীল কারাগারের নাম শুনেছিলাম বইয়ের জগতে নিত্যবিনোদনপিয়াসী আমি। বাংলাদেশের সকল তরুণ-তরুণীর প্রিয় লেখকের অবিসংবাদিত তকমা তখনো হুমায়ূনের গায়ে লাগেনি। তার জন্য তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৮৫-র ধারাবাহিক নাটক এইসব দিনরাত্রির সাফল্যের জন্য। পুস্তকের শব্দশিল্পী এভাবেই ব্যাপক পরিচিতি পেলেন ছোট পর্দার হাত ধরে। বেশ মনে আছে, বিটিভিতে তখন চলছিল সকাল সন্ধ্যা – বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম এবং অবশ্যই সফল ধারাবাহিক নাটক। হুমায়ূন আহমেদ লিখলেন এইসব দিনরাত্রি, যা দেখতে ভিড় জমালেন এপার এবং ওপার বাংলার অনেক মুগ্ধ দূরদর্শন দর্শক, যার মধ্যে ছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। হুমায়ূন আহমেদকে তাই পড়েছি এমন একটি সময়ে, যখন ক্রমান্বয়ে উত্থান হচ্ছিল তাঁর, ব্যাপকরূপে, বাংলাদেশের বই প্রকাশনা এবং দৃশ্য বিনোদনের জগতে।
বিটিভিতে যখন সদর্পে প্রচারিত হচ্ছিল এইসব দিনরাত্রি, আমাদের বাড়িতে বেশ কবার এসেছিলেন হুমায়ূন। আমার মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের হাউস টিউটর হওয়ার সুবাদে কলা ভবনের ঠিক সম্মুখেই ছিল আমাদের বসতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষকদের রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ ‘গোলাপি দলে’র যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন আমার বাবা। সে-সুবাদে অধ্যাপক আহমদ শরীফ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কে এম সা’দউদ্দিন, মুনতাসীর মামুন, হুমায়ূন আহমেদ প্রমুখের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হয়েছিল। আমাদের বসার ঘরের বাঁ-প্রান্তে রক্ষিত কাঠের সোফায় বসতেন হুমায়ূন। ছোটোখাট, স্বল্পভাষী, শ্যামল বর্ণের এ-মানুষটি শিক্ষকদের রাজনৈতিক বিতর্কে অংশ নেওয়ার চেয়ে চুপচাপ অবলোকনেই উৎসাহী ছিলেন বেশি। ছোটদের জন্য লেখা ওঁর নীল হাতি ততদিনে পড়া শেষ। আড়ালে-আবডালে দুষ্টুমি করে লেখককে নির্দ্বিধায় আমরা ডাকতাম ‘নীল হুমায়ূন, হাতি আহমেদ’ বলে। বাবা প্রায়ই এ-তথ্য হুমায়ূনের কাছে ফাঁস করে দেওয়ার কথা বলে ভয় দেখাতেন। কিন্তু কিছুই আমাদের দমন করতে পারেনি।
বেশ মনে আছে, কৈশোরের সে-দিনগুলোতে বাংলা একাডেমীর বইমেলার ধূসর চত্বর ঘুরে ঘুরে বই কিনতাম আমি, প্রিয় বন্ধু নাবিলসহ। নাবিল এখন আমেরিকায় প্রকৌশলী হয়েছে। বই পড়ার সময় কিংবা সুযোগ তার আর আছে কি-না জানা নেই। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে একাডেমীর মেলা এখনকার মতো এমন ব্যাপক পরিধির ছিল না; লেখকদের দেখা মিলত এবং কাছে গিয়ে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করার সুযোগও ছিল। জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি পড়ে ভক্ত পাঠক হিসেবে ওঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম স্কুলপড়–য়া ক্ষুদে আমি। তসলিমার নির্বাচিত কলামও পড়েছিলাম প্রথম প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই, এবং অবশ্যই নন্দিত নরকে। অধ্যাপক আহমদ শরীফের সে-প্রশংসাসংবলিত উপন্যাস পড়ে চেতনার একটি নতুন জগৎ উন্মোচিত হয়েছিল। বাক্যগঠনের জটাজটিলতা থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিদায়গ্রহণকারী হুমায়ূন আহমেদ সহজ প্রকাশভঙ্গি, অসামান্য কৌতুকরস এবং বিয়োগব্যথাকে সম্বল করে রচনা করেছিলেন বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের অনুভব-অনুভূতির নানা পর্যায়। একজন সুদক্ষ জাদুকর যেমন করে বাস্তব এবং বিভ্রমের অসাধারণ ধূম্রজাল সৃষ্টি করে দর্শকদের সংস্থাপিত করেন বোধের অতীত অন্য এক জগতে, যেখানে মানুষ কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে যায় দৈনন্দিন জীবনযাপনের যাবতীয় ক্লেদ, পরাজয়, আবর্জনা এবং দুঃখকে, হুমায়ূন আহমেদ তেমনি করে তাঁর পাঠকদের নিয়ে যেতেন ভিন্ন এক পৃথিবীতে। হুমায়ূনের এ-পৃথিবীতে দুঃখ আছে বইকি, আছে বিচ্ছেদ, প্রেম, প্রেমভঙ্গের যাতনা, এবং এক আকাশভরা জল। সেইসঙ্গে ভর করেছে নরক বাসের যন্ত্রণা, দিবারাত্রির জটাজটিলতার কাব্য। এ-পৃথিবীতে অপূর্ব জোছনা প্রায়শই ঝরে, এমনকি তখনো যখন কোনো এক বিষাদগ্রস্ত পিতা জেলগেটে অপেক্ষমাণ থাকেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পুত্রের প্রাণহীন দেহ গ্রহণের নিমিত্তে। হুমায়ূনের বই কেনা ছিল যেন পয়সা দিয়ে একরাশ দুঃখ কেনা, কিছু ক্ষণিক আনন্দের জন্যে। হুমায়ূন-বর্ণিত বিবিধ দুঃখময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা অসীম সুখের অতল স্পর্শ পেতে চেয়েছি। এই সুখ অন্য কারো দুঃখ অবলোকনের সুখ নয়। এ সুখ ক্ষণিকের জন্য হলেও অপরের জীবনে অনধিকার প্রবেশের সুখ। এই সুখ পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো অন্যের জীবনকে খুলে খুলে দেখার, চাখবার, উপভোগের সুখ। অপরের জীবনে এই না বলে ঢুকে পড়ার চাবিকাঠিটি ছিল হুমায়ূনের হাতেই। পাশের বাড়ির সুন্দরী মেয়েটির রসুইঘরের তিনি ছিলেন দক্ষ রাঁধুনি। একজন পাকা গৃহিণীর মতোই বারো ছটাক চালের সঙ্গে চার ছটাক বিভিন্ন ব্যঞ্জন মিশিয়ে তিনি তৈরি করতেন অসাধারণ সব খোরাক। তাঁর মতো একাধারে জনপ্রিয় এবং সার্থক শব্দশিল্পী বিরল বটে, উভয় বাংলায়।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আগ্রহের বদল ঘটে। সাহিত্যের একজন নিয়ত পাঠক অবিরাম পরিবর্তনশীল। দু-চার বছর নিবিষ্ট হুমায়ূন পাঠের পরে ক্ষান্ত দিয়েছিলাম। কারণ, সে-সময় মনে হয়েছিল, হুমায়ুন কিছুটা হলেও পুনরাবৃত্তিদোষে দুষ্ট। বইমেলার প্রকাশকদের অবিরাম তাগিদকে উপেক্ষায় অপারগ ঔপন্যাসিক নিজসৃষ্ট নরকের কারাগারে যেন ক্রমশ বন্দি হয়ে পড়ছেন। তাঁর চরিত্ররাও লীলাবতী কিংবা নিশীথিনীর ঘেরাটোপ থেকে পালানোর পথ খুঁজে পাচ্ছে না। তাঁর কলমের জাদু অব্যাহত আছে বইকি; কিন্তু সাহিত্যের কাছে পাঠক হিসেবে আমার যে আরো চাহিদা জমা হচ্ছিল তা মেটাতে হুমায়ূন ছিলেন অসমর্থ। আঠারো বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য বিষয়ে পড়ার সুবাদে এবং পরবর্তীকালে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ও বিলেতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে যথাক্রমে মাস্টার্স ও পিএইচ-ডি গবেষণার ব্যস্ততায় হুমায়ূন থেকে দূরে সরে আসা এভাবেই আমার সম্পূর্ণ হয়।
তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, আজকের এ-লেখাটির অবতারণা কেন। প্রথমত এই জন্য যে, হুমায়ূন আহমেদের অকালমৃত্যু দুঃখবোধের সৃষ্টি করেছে, যার উপশমের কিছুটা চেষ্টা করেছি তাঁর সমীপে নিবেদিত এ-পঙ্ক্তিমালায়। দ্বিতীয়ত, বিগত কমাসে পত্রপত্রিকায় হুমায়ূন সম্পর্কে স্তোত্রবাক্য শুনেছি এমন কজন বিদগ্ধ জনের মুখে, যাঁরা তাঁর জীবদ্দশায় তাঁকে লেখক হিসেবে জ্ঞান করতে দ্বিধাবোধ করতেন। তৃতীয়ত, আমার মনে হয়েছে, হুমায়ূন প্রয়াণে ওঁর এক সময়কার পাঠক হিসেবে আমার একটি দায়বদ্ধতা আছে। দায়বদ্ধতাটি হলো এই, ঋণটুকু স্বীকার করে নেওয়া যে, আমার বয়ঃসন্ধিক্ষণের দিনগুলোতে, যখন সাহিত্য-সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গির তির্যকতা আমাকে বিদ্ধ করেনি, হুমায়ূন আহমেদ সত্যিকার অর্থেই দেখা দিয়েছিলেন অজানা পৃথিবীর এক অদ্ভুত জাদুকর হিসেবে। সে-সময়ে যে-মোহাবিষ্টতা আমি অনুভব করেছিলাম তা নিশ্চয়ই অনুভব করেছেন আমার পরবর্তী দশকগুলোর স্কুলপড়–য়া, কলেজগামী, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচরণরত অসংখ্য কিশোর, তরুণ এবং যুবতী। তাদের কাছে এবং আমরা যারা বাংলাদেশের প্রায় সমান বয়সী অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হুমায়ূন একজন প্রিয় লেখক হিসেবে বর্তমান থাকবেন। তাঁর জনপ্রিয় লেখাসমূহ সত্যিকার অর্থে সাহিত্য হয়ে উঠেছে কি-না তা নিয়ে সমালোচনা ছিল এবং অব্যাহত থাকবে। কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্তের ছোট ছোট দুঃখকথা এ-বাংলায় হুমায়ূন এবং ওই বাংলায় শরৎচন্দ্র ছাড়া এমন সফল বর্ণে, বাক্যে ও ভাষায় আর কে-ই বা বলতে পেরেছেন?
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.