অনুবাদ : আনিসুজ জামান

খুব দ্রুত মাতাল হয়ে গেছে। খুব কমই পান করত সে, তাই তার সহ্য করার সীমা যে কতটুকু সে-সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা ছিল না। তার ফেটে পড়ার মতো চরিত্র ছিল এবং এমনভাবে দেখাত যেন তার প্রয়োজনের অধিক জীবনীশক্তি ছিল। তারপরও সে-রাতের মতো এত সুখী সে কখনোই ছিল না, এবং পরদিন যে তার ভীষণ হ্যাংওভার হতে পারে এটা জানা থাকলেও এটা ওর কাছে গুরুত্ব পেত না। নাচের জন্য বের হওয়ার আগে, এক বিখ্যাত সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে জনির নতুন চাকরির খবর উদ্যাপন করতে তারা অ্যাপার্টমেন্টে রাতের খাবার তৈরি করছিল। ভালোবাসত জনিকে। এই ভালোবাসার মাত্রা পরিমাপ করার বিষয়ে ভীত সে, যেন ধারণাটি তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে। সেই রাতে সে সুখী ছিল কারণ অবশেষে, প্রায় এক বছর পরে, জনি চাকরি খুঁজে পেল।

টেবিলের প্রান্তে তার অসাড় বাঁকানো লম্বা হাতে কপাল ঠেকিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। সে নড়তে চাচ্ছিল না। ভয়ে ছিল, নড়াচড়া করায় যদি তার মাথা আবার ঘুরতে শুরু করে। সে জানত, তার বোন এবং যে-দুজন বন্ধু তাদের সঙ্গে বাইরে গিয়েছিল, তারা এখনো তার পাশে আড্ডা দিচ্ছে। জনি কিছুক্ষণ আগে উঠে গেছে, এখনো টেবিলে ফিরে আসেনি। জনিকে সে ডাকতে চেয়েছিল; কিন্তু ভাবল আরেকটু ঝিমিয়ে নিলে ভালো হয়। যতক্ষণ না মাতলামি দূর হয় ততক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া ভালো। কিন্তু সে সংগীতের তাল এড়িয়ে যেতে পারে না, যেহেতু সে নাচতে ভালোবাসে। ঘুমানোটা কাজ করার চেয়ে ভালো, যেমনটি তার সুদর্শন জনি বলত, যখন সে আনন্দে থাকত। অবশ্যই সে ভালো নাচতে পারত না। সে যা করতে পছন্দ করত তা ছিল, স্টেরিওর সামনে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনতে, অভিনিবেশের সঙ্গে যেন সে সুরের মূর্ছনায় প্রকৃত গোপন অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। একটা আয়না যেমন গিলে খায় তেমনিভাবে সে নিজেকে ওই ক্যাসেট প্লেয়ারের দিকে এগিয়ে দিত, যেন সেই প্লেয়ারটা ওকে গিলে খাচ্ছে, যদিও সব সময় ব্যর্থ সংগীতশিল্পীর মতো তার নিয়তি হতাশাজনক হয়ে উঠত। ঠিক তখনই এমে জনির কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরত আর তারা হাসত। যখন থেকে তারা একসঙ্গে থাকতে শুরু করেছে, নিজেদের সহজে হতাশায় ভেসে যেতে দেয়নি।

সে তার কনুই দিয়ে একটি বোতলের ওপর ধাক্কা মারে এবং কাচ ভাঙার শব্দে জেগে ওঠে। সে চোখ খুলল, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, এরপর মাথা তুলল। নাচের জন্য খুঁজে নেওয়া ছোট্ট একটি জায়গায় ওর বোন তার দুই বন্ধুর সঙ্গে নাচছিল। সে জনিকে খুঁজতে থাকে। ছোট বারের একপাশে দুজন ছেলের সঙ্গে কথা বলছে সে। মাঝেমধ্যে সে একটি বাহু তোলে যেন তর্কের মাঝখানে আছে। এমে তার হাবভাব দেখে ভাবল, তার মনে হচ্ছে জনিকে বিচলিত দেখাচ্ছে। তার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগের দিনগুলোতে জনি খুব সহজেই কলহতে জড়িয়ে পড়ত। সে তর্ক করতে এবং গালাগালি দিতে পছন্দ করত এবং প্রায় সময়ই মেজাজ হারিয়ে ফেলত। জনি এমেকে বলেছিল, সেই সময় সে প্রায়ই কোনো সামান্য জিনিসের জন্য অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে উঠত এবং মারামারির অজুহাত খোঁজাটা এক ধরনের শখে পরিণত হয়েছিল।

‘এখন কেমন লাগছে?’ ওর পাশে বসা বন্ধু জিজ্ঞেস করে।

‘লেবু আর বরফ দিয়ে একটি পানীয় পেলে ভালো হয়।’

তার বোন টেবিলে ফিরে এসে তাকে জিজ্ঞাসা করে সে চলে যেতে চায় কি না। এমে তাদের আশ্বস্ত করে যে, সে এখন একটু ভালো বোধ করছে। সে একটি সিগারেট ধরালেও সঙ্গে সঙ্গে নিভিয়ে ফেলে। আবার জনিকে খোঁজে; কিন্তু যাদের সঙ্গে কথা বলছিল তাদের একজনের পিঠ তাকে আড়াল করে রাখে। সে তার পা প্রসারিত করে, তার প্রস্রাবের বেগ পায়। তার এবং বাথরুমের দরজার মধ্যে দূরত্ব আন্দাজ করে সে কোনো টেবিলে বাড়ি না খেয়ে সেখানে পৌঁছাতে পারবে কি না সন্দেহ জাগে। মাথাটা আরেকটু স্বাভাবিক হওয়ার জন্য সে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।

হঠাৎ করে সে জনিকে ঘিরে একটা গোলমাল লক্ষ করে। বারের লোকজন পেছন দিকে সরে যায়। যারা চিৎকার করছিল তাদের মধ্যে নীরব বিরতি লক্ষ করা যায় এবং তারপরে কিছু অপমানসূচক কথা শুনতে পাওয়া যায়। জেমির কণ্ঠ কি না এমে বুঝতে পারে না। বারের কাছাকাছি টেবিলে বসে থাকা লোকদের মধ্যে হঠাৎ দ্রুত চঞ্চলতা লক্ষ করে এমে ওঠে। সে কাছাকাছি গিয়ে দেখে কিছু লোক জনিকে গলায় হাত দিয়ে আটকে রেখেছে। জনি বাতাসে অর্থহীন থাপ্পড় ছুড়ে মারছিল, ঝলসানো পুতুলের মতো হাঁপিয়ে উঠছিল। এক মুহূর্তের জন্য তারা দুজনই নিশ্চল হয়ে পড়ে। তারা হাঁসফাঁস করছিল এবং যখন দ্বিতীয় লোকটি তার বন্ধন শিথিল করল, তখন জনি তার হাতের ভেতর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তার পেটে জোরে এক লাথি মারে। এমে কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে পেছন দিকে ধাক্কা দেওয়া হয় এবং সে তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সে তার বোনের জন্য উন্মত্তভাবে তাকায় এবং যখন সে ওঠার চেষ্টা করে, সে শুনতে পায় যে, লোকেরা ভয়ে চিৎকার করছে। তারপর সহসা মারামারি-ধাক্কাধাক্কির শব্দে ঘর ভরে ওঠে। কেউ তাকে হাত ধরে টেনে দরজার দিকে নিয়ে যায়।

সে অবিশ্বাস্য জটলার সঙ্গে ধাক্কা খায় এবং হুড়োহুড়ির মধ্যে পড়ে মুখে আঘাত পেয়ে ফের নিচে পড়ে যায়। রাস্তায় পৌঁছানোর আগে সে আরো দুটি গুলির শব্দ শুনতে পেল। বাইরে এসে একবার তার মনে হলো, জনি ওকে ডাকছে, ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করে। ধরে থাকা হাতটি থেকে সে নিজেকে মুক্ত করে। সে দুজন লোকের কাছে দৌড়ে গিয়েছিল, যারা দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসছিল। অন্ধকারের ভেতরেও সে তার বোনের কণ্ঠস্বরকে ভালো করেই চিনতে পারে, সে তাকে বলছে যাতে সে পালিয়ে যায়। চিৎকারটা থেকে বোঝা যাচ্ছে ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছে সে। এমে কোনো তর্ক না করেই মেনে নিল; কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সে দৌড়াতে শুরু করল, পায়ের নিচের মাটি যেন তাকে ধরে রেখেছে এবং সে তার হাঁটুর কাছে পড়ে যায়। ব্যথা ক্ষণিকের জন্য তার বোধ জাগিয়ে তোলে। সে বুঝতে পারছিল, যা করার দ্রুত করতে হবে। সে তার বোনকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে দেয়। তারা রাস্তায় বাঁক নেয়, তাড়াহুড়ো করে রাস্তার মাঝখানে চলে আসে।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর তারা থামে। এমে তার মুখভরা ঝোলা গুড়ের মতো পাতলা তরল কষ্টের সঙ্গে গিলে ফেলে। সে অনুমান করে যে, শেষ আঘাতে তার মুখের ভেতরটা ছিঁড়ে গেছে, যা এখন ছোট ছোট টুকরো হয়ে জমা হচ্ছে। সে একটি খুঁটির দিকে ঝোঁকে, বমিটা ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। উন্মত্ত স্রোত তাকে কাঁপিয়ে দেয় এবং তাকে ফুটপাতের ওপর বসে পড়তে হয়। তার বোন তার গায়ে হাত রেখে জোরে পিঠ ডলতে থাকে। এমে তার পা প্রসারিত করে এবং সাবধানে তার দাগযুক্ত, ফাটা প্যান্ট দেখে। সে তার বাঁ পা বাঁকিয়ে আহত হাঁটুর ওপর তার আঙুল বোলায়। হাঁটুটা কাপড়ের ভেতর দিয়ে কাদা মাখানো মাথার মতো বেরিয়ে আছে।

‘আয় এখানে এক মিনিট অপেক্ষা করি’, তার বোন এমের পাশে বসে বলে।

‘ফিরে যাওয়াটাই কি ভালো হবে না?’ এমে জিজ্ঞেস করল। সে বুঝতে পারে বৃষ্টি শুরু হচ্ছে।

‘জর্জ এবং মিগেল তাদের জন্য অপেক্ষা করতে বলেছিল।’

‘জনির কী হয়েছে?’ এমে হাঁটুর মাঝখানে মাথা রেখে বিড়বিড় করে  বলল।  হাত  দিয়ে  নিজেকে  আবৃত  করে  শরীরের  কাঁপুনি থামানোর চেষ্টা করে।

মাত্রই কী ঘটেছে সেটা বোঝার চেষ্টা করে; কিন্তু ভেতর থেকে বমিটা বিদ্যুচ্চমকের মতো বের হয়ে আসে। উঠে বসার সময় না  থাকায় তার প্যান্টের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে যায়। প্রচণ্ড এক ঘৃণা এসে ওর অস্তিত্বকে কাঁপিয়ে দেয়। রাগের সঙ্গে পিচঢালা পথে বাড়ি দিয়ে তার জুতার তলা ছিঁড়ে ফেলে। হেঁচকি তোলে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে সে, নতুন এক মিশ্র অনুভূতি তার শরীরকে বাঁকা করে দেয়।

‘আমার দাঁত’, এমে তার নিশ্বাস পুনরুদ্ধার করে বলে।

‘কী?’

‘তারা আমার একটি দাঁত ভেঙে দিয়েছে।’

‘একটি দাঁত?’

‘হ্যাঁ, নিচেরটা। মনে হয় গিলে ফেলেছি।’

বোন কিছু বলে না।

‘নিচের দাঁতগুলোর নাম কী?’ এমে জিজ্ঞাসা করল।

‘জানি না।’

‘কিন্তু তাদের নাম কী?’ এমে প্রায় চিৎকার করে বলে।

‘জানি না। ওপরেরগুলোর মতো একই জিনিস। এটা কোনো ব্যাপার নয়!’

তার বোন নরম সুরে উত্তর দিলো, নাজুকভাবে তার মাথা ঘষছে।

পরে সে একটি রুমাল দিয়ে এমের নাক মোছে এবং এমে লক্ষ করে, তার ঠোঁট ফুলে গেছে আর গরম হয়ে আছে। অপ্রত্যাশিত এক বাতাস বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ভাসিয়ে দিচ্ছে এবং মনে হলো, গাছের দিকে তুলে দিচ্ছে। রাস্তাটি ছিল মরুভূমি এবং আশ্চর্যজনকভাবে অন্য কেউ এদিকে আসেনি। এমে আবার জনির মারামারির দৃশ্যটি পরিষ্কারভাবে মনে করতে থাকল। কী বিশ্রী! ভাবল।

জনি নিশ্চিত করেছিল, সে আর কখনো মারামারি করবে না। শহরে যখন থাকত তখন সে ছিল এক গোয়ার, হিংস্র, অবাধ্য, সবসময় আবোল-তাবোল উপদেশ দিয়ে যেত; কিন্তু বেদনাদায়ক প্রেমের মতো ওগুলোকে পেছনে রেখে সে নিশ্চিত করেছিল যে, আর মারামারি করবে না। সে তার বোনের ছায়া উঠতে দেখে তাকে সময় জিজ্ঞেস করে।

‘দুটো।’

‘এখানে আর থাকা যায় না।’

‘হর্হে এবং মিগেল …’, তার বোন কোনার দিকে তাকিয়ে বলে।

‘আমাদের জনিকে খুঁজতে যেতে হবে’, জনি মারা যাওয়ার ভয়ংকর চিন্তায় ভীত হয়ে এমে বলে।

ভীষণভাবে মাথা ঝাঁকায় যেন ভীতিকর ঘটনাটি সে তার মাথা থেকে ফেলে দিতে পারে। এটি ছিল একটি ভুল চিন্তা, জল্পনা যা সে সবসময় এড়ানোর চেষ্টা করছিল।

তাছাড়া কেউ তাকে কখনো শেখায়নি কীভাবে কাউকে চিরতরে হারানোর অপূরণীয় বিপর্যয় স্বাভাবিকভাবে মোকাবিলা করতে হয়। না তার বাবা-মা, তার স্কুল, বা তার বন্ধুরা – ওকে এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি করেনি। এমনকি একটি নগণ্য মুহূর্তের জন্য, সেদিন আসবে যখন, তাকে এই সত্যের সামনে উপস্থিত হতে হবে এক মুহূর্ত থেকে অন্য মুহূর্তে, এক শূন্যতায় ডুবে গিয়ে জনি আর আসবে না ফিরে। সে বাতাসের জন্য মুখ খোলে এবং বোনকে বলে উঠতে সাহায্য করতে।

‘আমাদের ফিরে যেতে হবে’, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে নাক মুছতে মুছতে অনুনয় করে এমে।

‘যাওয়া কি ঠিক হবে?’ তার বোন দোটানা থেকে বলে। ‘যাওয়াটা বিপজ্জনক হতে পারে।’

‘কিন্তু জনিকে তো খুঁজতে হবে’, এমে পুনরাবৃত্তি করে। ফোঁপানোকে নিয়ন্ত্রণ করে সে ফের নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করে। তারা হাত ধরাধরি করে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটতে থাকে। এমে অবাক হয়, সবকিছু এত শান্ত যেন কেউ বারের ঘটনাটিকে কোনো এক জায়গায় মাটির কয়েক মিটার গভীরে পুঁতে ফেলেছে। তাকে থামতে হয়। বোন থেকে আলাদা হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঝুঁকে গভীরভাবে নিশ্বাস নেয়। চোখ বন্ধ করে।

‘তুই ঠিক আছিস তো?’ তার বোন তার দিকে এগিয়ে জিজ্ঞেস করে।

সে মাথা নেড়ে কপাল থেকে ঠান্ডা ঘাম মুছে দেয়। তার বোন কোনার দিকে তাকায় এবং এমে খেয়াল করে তারও পুরো শরীর কাঁপছে। সে ভাবে, যে-কোনো মুহূর্তে তারা দুজনেই শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাবে।

‘কী ব্যাপার?’ কোনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার বোন  বিড়বিড় করে।

এমে কিছু বলে না। তার মনে হয়, তার বোনের কথাগুলো অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। জ্যাকেটের হাতা দিয়ে চোখ মোছে সে।

গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি একটু একটু করে থেমে আসে, যতক্ষণ না একেবারে উধাও হয়ে যায়। এমে তার হাতদুটো বগলের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় গরম করার জন্য।

‘কটা বাজে?’ সে আবার জিজ্ঞেস করে।

‘আড়াইটার থেকে একটু বেশি’, তার বোন ঘড়ির দিকে না তাকিয়ে জানায়।

হঠাৎ তারা সাইরেন শুনতে পায়। তারা দেখে, একটি পুলিশের গাড়ি ওদের থেকে দুটি রাস্তা পর দিয়ে বারের উল্টোদিকে যাচ্ছে। তারা মনোযোগ দিয়ে অপেক্ষা করে যতক্ষণ না শোরগোল পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায়, নড়াচড়া করে না, কথাও বলে না।

‘গেল কোথায় সব?’ তার বোন বলল। এরপর যে কী করবে সেটা বুঝতে না পেরে খুব সম্ভবত ভয় পেয়েছে। এমে ঠোঁট কামড়ে ধরে জনির কথা আবার চিন্তা করে। তার গলা শুকিয়ে আসে এবং সে অনুভব করে, তার মাথার মধ্যে রক্ত চলাচল বেড়ে গেছে। সে এমনভাবে কেঁপে ওঠে, তার মনে হয় যে-কোনো মুহূর্তে তার শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খুলে রাস্তার মাঝখানে ছড়িয়ে পড়বে।

‘ব্যাপারটা তখনই ঘটল যখন ব্যাপারটা একেবারে নিখুঁত ছিল।’ তার বোন বিড়বিড় করে।

‘কী?’ মোড়ের যেদিকে পুলিশের গাড়ি চলে গেছে সেদিক থেকে চোখ না ফিরিয়ে অন্যমনস্কভাবে বোনের বাহুতে হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করে। হাঁটতে থাকে ওরা; কিন্তু মোড়ে এসে আবার থামে। স্থির থাকে কিছুক্ষণ, কেউই যেন এগিয়ে যেতে চাচ্ছে না। এমে তার কপাল বোনের কাঁধে রাখে। আরো কিছুক্ষণ স্থির থাকে সাজানো এক আলোকচিত্রের মতো। এমে হঠাৎ তার বাবা-মায়ের বাড়িতে অনেক আগের একটি বিকেলের কথা মনে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তখন সে একা একজন মহিলার গল্প পড়ছিল, যে একজন লোকের কাছ থেকে একটি ফোনের অপেক্ষায় ছিল, যাকে সে খুব ভালোবাসত। কয়েকদিন আগে লোকটি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে সন্ধ্যায় একটি নির্দিষ্ট সময়ে ফোন করবে। দুই ঘণ্টারও বেশি যন্ত্রণাদায়ক সময় কেটে যায় এবং ফোনটি আর আসেনি। লোকটি শপথ করে নিশ্চিত করেছিল যে, সে ফোন করবে। তাকে কল করার কোনো উপায় মহিলার ছিল না। ঈশ্বরের কাছে করুণা প্রার্থনা করে, যেন দেরি হওয়ার আগে ফোনটি বেজে ওঠে। তার প্রার্থনাটি এতই সামান্য ছিল যে, ঈশ্বর চাইলে সেটি করে দিতে পারতেন। তিনি যদি তার প্রার্থনা শুনতেন, তাহলে মহিলাটি তাঁর কাছে আর কিছু চাইত না। সে তার অতীতের সব ভুল সংশোধন করার চেষ্টা করবে, যে সমস্ত পাপ তাকে ধার্মিক হওয়ার পথ থেকে দূরে নিয়ে এসেছে। সে তার কাছে ভিক্ষা চেয়েছিল কারণ সে অত্যন্ত কষ্ট পাচ্ছিল। সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, মিষ্টি মানুষ হয়ে উঠবে, তার মা, তার বোন সকলকে বুঝবে; কিন্তু বিনিময়ে দয়া করে ঈশ্বর যেন তার প্রার্থনা কবুল করেন এবং ফোনটি বেজে ওঠে। এত সহজে পূরণ করা যায় এরকম আকুতির সামনে ঈশ্বর কখনোই এত নিষ্ঠুর এবং কঠোর হতে পারেন না। কিন্তু সময় থেমে থাকে না, ফোনটিও বাজে না। ঈশ্বরের কি আজ রাতে এমের কথা মনে আছে? উনি জানেন যে, এই জঘন্য শহরে প্রতিরাতে ভয়ংকর কিছু না কিছু ঘটনা ঘটে, মানুষ মারা যায় এবং সবচেয়ে ভয়ংকর উপায়ে অদৃশ্য হয়ে যায়; কিন্তু জনি কখনো এত খারাপ লোক ছিল না যে সে এরকমভাবে শেষ হয়ে যাবে। তারা দুজনেই সঠিক কাজগুলো করছিল। এমন সময় ছিল যখন অন্য মানুষের কষ্ট তাদের আন্দোলিত করত; কিন্তু সর্বোপরি তারা সুখে এবং শান্তিতে বসবাস করতে চেয়েছিল। সে আবার প্রার্থনা করে, এরকম ভয়াবহ যন্ত্রণা আমাদের কারোই প্রাপ্য নয়, দয়া করো ঈশ্বর। সে মনে মনে অন্যভাবে ঈশ্বরের কাছে আকুতি  জানাতে থাকে।

সে তাড়াতাড়ি করতে চেয়েছিল। সে তার বোনের হাত ছেড়ে দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। সে বুঝতে পারছিল না তার বোন কী বলে চিৎকার করছে, কিন্তু সেও তার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছিল। তারা দেখতে পেল বারটি বন্ধ। রাস্তার ওপারে ফুটপাতে কিছু লোক ফিসফিস করে কথা বলছে। এমে অবাক হয়, সবকিছু এত শান্ত যে সে বিশ্বাস করতে চেষ্টা করছিল যা ঘটেছে তা হ্যালুসিনেশন, নাকি তার নিজের ব্যঙ্গাত্মক অস্থির মনের তৈরি করা। সম্বিত ফিরে পেয়ে সে পুলিশের কাছাকাছি যায়, যেন তারা নতুন কোনো নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছে।

লোকজনের হয়েছেটা কী? এমে জিজ্ঞেস করে। তারা কোনো জবাব দেয়  না।

ওর বোন অন্যদের সঙ্গে কথা বলছিল। এমে কাঠের ওপর কপাল ঠেকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। সে তার পায়ের ডগা দিয়ে দরজায় আলতো টোকা দেয়। পুলিশদের মধ্যে একজন নির্দেশ করে ওদের ওখান থেকে সরে যেতে। এমে চিন্তা করে, যা ঘটছে খুবই অযৌক্তিক। এই ধরনের অযৌক্তিকতা কারো পক্ষেই এত বেশি সময় সহ্য করা সম্ভব নয়। সে কাঁদতে শুরু করে। জনি সবসময় বলে সে কান্নাপ্রিয়, সবকিছুতেই নাটকীয়তা নিয়ে আসে। কিন্তু এটা সত্য নয়। সে কেবল তখনই কাঁদে যখন কোনো কিছু তাকে কষ্ট দেয়, যখন ব্যথা অসহনীয় হয়ে ওঠে। সে জানে, জনি কান্নাপ্রিয় নয়, বরং এর উল্টো। সে সবকিছু নিয়ে হাসতে পছন্দ করে, যতক্ষণ না সে ক্লান্ত হয়ে ওঠে।

‘তারা বলল তারা সত্যিই জানে না কী হয়েছে’, তার বোন বলল। ‘স্পষ্টতই পুলিশ এসে কয়েকজন লোককে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে।’

জনি আহত হতে পারে, তাকে ওভাবে রেখে মরিয়া হয়ে পালিয়ে আসার জন্য নিজেকেই দায়ী মনে করে এমে তার মুষ্টিবদ্ধ হাত দিয়ে আবার দরজায় আঘাত করে।

‘আমাদের কী করা উচিত?’ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বোনকে জিজ্ঞেস করে। এমে রাগ করে দরজায় লাথি মারতে থাকে, তার বোন তাকে থামায়।

‘শান্ত হ। আমরা জানি না কী হয়েছে এবং মিগেল আর হোর্হে ফিরে আসতে পারে। আয় অপেক্ষা করি।’

এমে একটা টেনে নিশ্বাস নেয়, কিছুক্ষণ পর দরজার পিঠ দিয়ে ফুটপাতে বসে পড়ে।

‘হ্যাঁ, অপেক্ষা করি। কেউ না কেউ ফিরে আসবে। জনিও নিশ্চয় আমাকে খুঁজছে’, এমে শান্ত হয়ে বলে। সে সাবধানে তার ফোলা ঠোঁট অনুভব করে আর পড়ে যাওয়া দাঁতের ফাঁকা স্থানটি জিহ্বা দিয়ে স্পর্শ করে। যতক্ষণ না জনি আসে এবং তাকে দীর্ঘ এক আলিঙ্গন দিয়ে উষ্ণ করে তোলে, ততক্ষণ সে সেখানে থাকবে। যতক্ষণ প্রয়োজন কোনো নড়াচড়া না করে অপেক্ষা করবে। সে অন্য কিছু নিয়ে ভাববে। রাত পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। ডানদিকে কোথাও পানি পড়ার শব্দের সঙ্গে সে কুকুরের বিরতিহীন ঘেউ ঘেউ শব্দে মনোযোগ দেবে। সে প্রতিটি ফোঁটার মধ্যকার সেকেন্ড গুনে যাবে। সে জনির নতুন চাকরি নিয়ে ভাববে। সে জানে, লোকজন জনিকে পছন্দ করবে। সে ছিল আকর্ষণীয় এবং সুন্দর। বই পড়ত, বিশ্বে যা ঘটে তা নিয়ে আগ্রহী ছিল এবং ওর একটি সংবেদনশীল মন ছিল। জনি একটি বিড়াল চেয়েছিল; কিন্তু অ্যাপার্টমেন্টটি খুব ছোট, কোনো সন্দেহ নেই বেড়াল রাখলে সেটা পালিয়ে যেত। জনি ভ্রমণ করতে চেয়েছিল, স্ক্যান্ডিনেভিয়া বা ব্রাজিলের মরুভূমির মতো এমন জায়গায় যেতে চেয়েছিল যেখানে কেউ যায় না। এমে তার স্যাঁতসেঁতে, অগোছালো চুলের মধ্যে দুটি আঙুল বোলাতে থাকে। তার শরীর আবার নতুন করে কাঁপতে শুরু করে। বোন দাঁড়িয়ে সিগারেট টেনে ধোঁয়া ওপরের দিকে উড়িয়ে দিচ্ছিল। হ্যাঁ, সে স্থির থাকবে, কাঠের দরজার সামনে এমন করে বসে থাকবে যেন একটি পেইন্টিংয়ের ফ্রেমের ভেতর চিরকালের মতো আটকে গেছে। অপেক্ষা করবে ঈশ্বর যতক্ষণ না জনিকে ফিরিয়ে দেন।

পুলিশ আসার পর মানুষ আর মনে করতে পারে না সত্যিকার অর্থে কী ঘটেছে।

লেখক পরিচিত

হুলিও পারেদেস সমকালীন কলম্বীয় কথাসাহিত্যিক। তাঁর দুটি উপন্যাস, ছোটগল্পের তিনটি সংকলন এবং একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গল্পগুলো ভাবনাপ্রধান। এতে মানবিক সম্পর্কের সমস্যা ও সংকট উঠে আসে। চরিত্রগুলো পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবনের অর্থ অনুসন্ধান করে। পারেদেসের সাহিত্যে অজানার ওপর জোর দেওয়া হয় – এই কারণে তাঁর অনেক গল্পের সমাপ্তি উন্মুক্ত। তাঁর চরিত্রগুলো প্রায়শই অস্তিত্ববাদী প্রশ্নের সঙ্গে লড়াই করে, অভ্যন্তরীণ চিন্তাভাবনার মধ্যে আটকে থাকে। পারেদেস এই সত্যটি তুলে ধরেন যে, তাঁর চরিত্রগুলো দ্বারা অনুভূত ক্ষোভের ধরন বৈষম্যমূলক নয়; বিভিন্ন বয়স এবং পটভূমির মানুষ একই রকম অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নেয়। যেহেতু এই গল্পগুলো চরিত্রের মনোজগতের ওপর আলো ফেলে তাই সেগুলো ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিক সীমানা অতিক্রম করে যায়।