এস এম সুলতান স্বাস্থ্যবান কৃষকের সন্ধানে

৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫। নদীর মধ্য দিয়ে আমরা ছুটে চলেছি। ঘণ্টা তিনেক হয়েছে। সকাল সোয়া ৮টায় রওনা দিয়েছি। একটানা ট্রলার ইঞ্জিনের শব্দ বেজেই চলেছে। চিত্রা নদী দিয়ে ছুটে চলা। নড়াইল শহরের পাশঘেঁষে চিত্রা নদীর প্রবাহ। অনেকেই বলেন, এই নদীর দু’কূল চিত্র বা ছবির মতো সুন্দর বলেই এর নাম হয়েছে চিত্রা। চিত্রা নদীর সঙ্গে কেমন নিবিড়ভাবে এস এম সুলতানের নাম জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে তাঁর স্বপ্নের সেসব কৃষকের কথা। এক দুপুরে তাঁর সঙ্গে বসে আমি শুনেছিলাম মোজার্টের নবম সিম্ফনি। সেই সিম্ফনির শব্দই যেন ভেসে আসছে আর কানে বাজছে : বিজ্ঞানের প্রথম পথিকেরা হলেন কৃষক, নাবিক আর তাঁতিদের সন্তান; যাঁরা চাঁদ আর নক্ষত্রের অবস্থান দেখে জীবনের পথ চলতেন, ইজিয়ান সাগরের উপকূল, পাথরে আছড়ে-পড়া ঢেউয়ের শব্দ তাঁদের অনুরণিত করতো। শুধু চিত্রাই নয়, মধুমতী, সুগন্ধা, ধলেশ্বরী, রূপসার মধ্য দিয়ে গেলেও সে-শব্দ আমিও শুনতে পাই, কেননা সভ্যতা নির্মাণের মৌলিক শক্তির আধার হলো এসব পেশার মানুষ।

এস এম সুলতানের সঙ্গে আমার দেখা ১৯৮৭ সালে; এটা ঠিক পরিচয় নয়, এক ধরনের হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে ‘হাই-হ্যালো’ বলা। জায়গাটা ধানমন্ডির ২ নম্বর রোড। জার্মান কালচারাল সেন্টারের গ্রন্থাগারে যেতাম। গ্রন্থাগারের সামনের দিকটা স্বচ্ছ কাচ দিয়ে ঘেরা থাকায় ভেতরটা দেখা যেত। প্রথম যেদিন ঢুকেছিলাম বরফপড়া শীত ঘিরে ধরেছিল। তখনো এসির সঙ্গে আমাদের অভ্যস্ততা ছিল না। সেদিনটা ছিল তাতালো দুপুর। ঢুকেই প্রবল ঠান্ডায় একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। কোথাও কাউকে দেখছিলাম না। হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে আবির্ভূত হলেন কেউ একজন; পরে বুঝলাম গ্রন্থগারিক। জিজ্ঞেস করলে বললাম, পড়তে চাই। সদস্য ফরম পূরণ করে সদস্য হয়ে গেলাম আমি আর টুটুল। বয়স ১৮ বা ১৯-এর মতো হবে। প্রতি ১৫ দিনে আমরা একবার লাইব্রেরিতে যেতাম।

এরকম সময় আরেকদিন দুপুরে (১২টা কি ১টা), তবে আমি একা। জার্মান লাইব্রেরিতে ঢুকে এসির শীতল বাতাসে ঠান্ডা হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি। পাশেই একটি মিউজিক টেবিল ছিল, যেখানে বসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিউজিক শোনা যেত। ওই টেবিলটিতে বসে এক ধরনের তাপদাহে চাপ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় একটু অন্যমনস্ক ছিলাম। এমন সময় লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোক বললেন, মিস্টার জামান (আমার নামের শেষে ‘জামান’ ছিল তাই এ-নামে ডাকা)। আজ কী শুনবেন? আমি বললাম, মোজার্টের নাইন সিম্ফনি। কেননা, এই কম্পোজিশনটা সম্পর্কে আমি পড়েছিলাম, মাত্র ১৪ বছর বয়সে উলফ্যাঙ মোজার্ট সিম্ফনিটি রচনা করেছিলেন। হঠাৎ দেখলাম ওই টেবিলের চেয়ারে আরেকজন বসে আছেন। বড় বড় চুলওয়ালা লম্বাটে মুখের, বহু অভিজ্ঞতার ছাপ, মানুষটি বুড়ো আঙুল তুলে এমনভাবে হাসলেন যাতে মনে হলো তিনি যেন বলছেন, তোমার পছন্দ দারুণ!

জার্মান সংগীতটা শুরু হলে এমনভাবে সংগীতের সঙ্গে মাথা নাড়াতে লাগলেন, মনে হলো তিনি ভীষণভাবে উপভোগ করছেন। কিন্তু আমার যেন কেমন বিরক্ত লাগলো, একটু মেকিও মনে হলো। আমি কিছুক্ষণ পড়ে লাইব্রেরিয়ানের কাছে ব্যাপারটা বুঝতে গেলে, তার আগেই তিনি বললেন, মিস্টার জামান আপনার নির্বাচন এই ভদ্রলোক কেমন পছন্দ করেছে দেখছেন! আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে এই ভদ্রলোক? লাইব্রেরিয়ান দাঁড়িয়ে গেলেন। আপনি চেনেন না। আপনি এস এম সুলতানকে চেনেন না? এই না-চেনাটা যেন আমার অপরাধ ছিল। তিনি বলে চলেছেন, আমাদের দেশের প্রেসিডেন্ট আমেরিকাতে গেলে নাকি আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান তাঁকে প্রথম জিজ্ঞেস করেছিলেন – সুলতান কেমন আছেন?

ওইদিন আমার সঙ্গে টুটুল ছিল না। তাকে অভিজ্ঞতাটা বললে উত্তেজিত হয়ে সে বললো, ‘কী বলো তুমি তাঁকে চেন না?’ এস এম সুলতান। সেই বিখ্যাত শিল্পী। সালভাদর দালি, পাবলো পিকাসোর পাশাপাশি সুলতানকে পৃথিবীর মানুষ চেনে। যিনি ভবিষ্যতের কৃষকদের ছবি এঁকে চলেছেন। পরবর্তী সময়ে আমি তাঁর ছবি আঁকা দেখেছিলাম মাসব্যাপী সময় নিয়ে। আমরা কখনো সন্ধ্যায় কালচারাল সেন্টারের তিনতলার হলরুমে গিয়ে দাঁড়াতাম। দেখতাম, কী মনোযোগ দিয়ে তিনি এঁকে চলেছেন, বিশাল বিশাল সব ক্যানভাস। মাসলওয়ালা
কিষান-কিষানির ছবি, যারা এই মানব সভ্যতার আদি শক্তির গুরুত্বপূর্ণ আধার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই ছবিগুলো নিয়ে ১৯৮৭ সালে গ্যেটে ইনস্টিটিউট বা জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে এক প্রদর্শনী হয়। এ-প্রদর্শনীর উদ্বোধনী আয়োজনে ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা ও শিল্পবোদ্ধা পিটার জেভিটস সুলতান সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এই উপমহাদেশের গুটিকয়েক অনন্যসাধারণ চিত্রশিল্পীর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলেন এস এম সুলতান। তিনি এশিয়ার কণ্ঠস্বর। … তাঁর চিত্রকর্মের নায়ক ছিলেন বাংলার কৃষকেরা।’ আমার কাছে অবশ্য তাঁর ছবিগুলো দেখলে পৃথিবীর কৃষকদের কথাই মনে আসে।

ঢাকার  জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ১৯৮৭ সালের সময়কার বুকলেট থেকে জানা যায় : এই মানুষগুলো, যারা মাটির কাছাকাছি জীবনযাপন করতো এবং যাদের কাঁধে সভ্যতার বোঝা ছিল, সুলতানের কাছে তাদের দুর্বল, অবসন্ন বা করুণা করার মতো ক্ষুধার্ত প্রাণী বলে মনে হয়নি। বরং বিপরীতভাবে, তিনি তাদের ফুলে ওঠা পেশি, সবল দেহ, তেজস্বী প্রাণশক্তি, সুগঠিত নিতম্ব এবং স্ফীত বক্ষ দেখেছিলেন, যারা জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে প্রস্তুত ছিলেন। নিচের ছবিগুলোতে তারই প্রতিফলন দেখি।

জমি কর্ষণ-২ (১৯৮৭), ধানকাটা-১ (১৯৮৭) ছবিগুলো দেখলে মনে হয়, জীবনকে যাপনের উৎসবে রূপান্তরের প্রবল আকাক্সক্ষা। এ-ধারাবাহিকতায় পরবর্তী সময়ে তাঁর ছবিতে দেখা যায় গ্রামীণ রমণীদের সুডৌল ও সুঠাম গড়ন। নারীর মধ্যে উপস্থিত চিরাচরিত রূপলাবণ্যের সঙ্গে তিনি শক্তির সম্মিলন ঘটিয়েছেন। বেঁচে থাকার সংগ্রামে নারীর অংশগ্রহণের স্বতঃস্ফূর্ততার মধ্য দিয়ে তিনি নারী-পুরুষের জীবনকে আনন্দযজ্ঞে রূপান্তরিত করেছিলেন : মাছধরা-৩ (১৯৯১), ধানঝাড়া-২ (১৯৯৩), ধানভাঙা-২ (১৯৯৩) চিত্রগুলো তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তবে তাঁর এ-সময়কার ছবিগুলোতে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটের শ্রেণিদ্বন্দ্ব এবং গ্রামীণ অর্থনীতির কিছু ক্রূর বাস্তবতা উঠে এসেছে। এরকম দুটি বিখ্যাত ছবি হচ্ছে – হত্যাযজ্ঞ (১৯৮৬) এবং চরদখল (১৯৮৮)। সুলতান জয়নুলকে (জয়নুল আবেদিন) বলেছিলেন, ‘জয়নুল, তুমি আমার জাতিকে রুগ্ণ-ক্লিষ্ট রূপ দিয়েছ, আমি তাদের মাসলস দেব, ঐশ্বর্য ও শক্তি দেব।’

এস এম সুলতানের এই কথাটির তাৎপর্য এভাবে বর্ণনা করা যায় : যে-শক্তি যুদ্ধ করে, ধ্বংস করে, সেই শক্তি কৃষকদের শ্রমে সভ্যতাকে নির্মাণ করে। এ-কথা আমাকে ২৫০০ বছর আগে আয়োনীয় বিজ্ঞানী ও গ্রিক চিন্তাবিদ অ্যানাক্সিমেন্ডারের কাছে নিয়ে যায়, যিনি লম্বভাবে রাখা একটি লাঠির অপস্রিয়মাণ ছায়ার ওপর নির্ভর করে নিখুঁতভাবে বছরের দৈর্ঘ্য ও বিভিন্ন ঋতুর সময় নির্ণয় করেছিলেন। যুগ যুগ ধরে যে-লাঠি অন্যের মাথায় আঘাত করা, বল্লম তৈরি করে মানুষকে বিদ্ধ করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, অ্যানাক্সিমেন্ডার তা ‘সময় পরিমাপ’-এ ব্যবহার করেছিলেন। এই প্রাকৃতিক সৌরঘড়ি সমাজসভ্যতার সময় পরিমাপে সূক্ষ্মতাই আনেনি, তা সমাজকে কৃষিসৃজনেও উদ্দীপনা জুগিয়েছিল, গড়ে উঠেছিল সমাজসভ্যতা। সুলতান ইতিহাসের সেই আমোঘ সত্যতা দ্বারা আলোড়িত হয়েছেন এই ভেবে, যে-কৃষিকাজ সভ্যতার মৌলিক ভিত্তিভূমি হিসেবে কাজ করেছে, সেই কৃষক ক্ষীণকায়, নিষ্পেষিত, তাহলে জীবনের উচ্ছ্বাস কীভাবে বিকশিত হবে, কীভাবে জীবনের উন্মোচন ঘটবে? তাই তাদের হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতা, বেদনাকে দূরীকরণের স্বপ্ন নিয়ে সুলতান বলেছেন : ‘আমার ছবির ব্যাপার হচ্ছে সিম্বল অফ এনার্জি, এই যে মাসলটা, এটা সংগ্রামের কাজে ব্যবহার হচ্ছে, মাটির উর্বরতার জন্য সংগ্রাম। তার বাহুর শক্তিতে লাঙলটা মাটির নিচে যাচ্ছে, ফসল ফলাচ্ছে। শ্রমটা হলো ভিত্তি। আমাদের অঞ্চল হাজার বছর ধরে এই কৃষকের শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। অথচ সেই কৃষকদের হাজার বছর ধরে মারা হয়েছে। … আমার কৃষকদের মধ্যে সেই হাজার বছরের এনার্জিকে, ওদের ইনার স্ট্রেন্থকে এক্সজারেট করে দেখিয়েছি।’

এভাবে তিনি পরিণত হয়েছেন ফিলোসফার অফ আর্টে। তাঁর ‘ফার্স্ট প্লান্টেশন’ বা ‘প্রথম রোপণ’ (১৯৭৫) শীর্ষক চিত্রের মাধ্যমে তা স্পষ্ট করেছেন।

ষোলো হাজার বছর আগে শিকারি জীবন থেকে মানুষের কৃষিকাজের সূচনা। ইউভ্যাল হারারি তাঁর সেপিয়েন্স বইয়ে সে-সম্পর্কে একটা মজার কথা লিখেছেন। মানুষ ধানগমকে গার্হস্থ্যায়ন করেছে, না ধান-গম মানুষকে গার্হস্থ্যায়ন করেছে তা একটা ধাঁধা। কিন্তু কৃষি উদ্ভাবনে ঘর আর পথের মাঝখানে যে-বিশ্রামের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল তা কৃষককে সৃজনশীলতার পরিবর্তে অন্তহীন পরিশ্রম মানুষকে কৃতদাসত্বের স্বাদ দিয়েছে। স্বস্তি মিলেছে খুব কম। এর কারণ কী? সুলতান যেন বিষয়টাকে এভাবে বলেছেন, ‘আমাদের দেশের মানুষ তো অনেক রুগ্ণ, কৃশকায়। একেবারে কৃষক যে সেও খুব রোগা, তার গরু দুটো, বলদ দুটো – সেটাও রোগা …। [আমার ছবিতে তাদের বলিষ্ঠ হওয়াটা] মনের ব্যাপার। মন থেকে ওদের যেমনভাবে আমি ভালোবাসি যে আমাদের দেশের কৃষক সম্প্রদায়ই তো ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়েছিল। অর্থবিত্ত ওরাই তো জোগান দেয়। … আর এই যত জমিদার, রাজা-মহারাজা আমাদের দেশের কম কেউ না। সবাই তো কৃষিনির্ভর একই জাতির ছেলে। আমার অতিকায় ছবিগুলোর কৃষকের অতিকায় অতিকায় দেহটা এই প্রশ্নই জাগায় যে, ওরা কৃশ কেন? ওরা রুগ্ণ কেন? – যারা আমাদের অন্ন জোগায়, ফসল ফলায়।’

সুলতান প্রাথমিক জীবনে কৃষির কৃশকায় মানুষগুলোর আনন্দহীন স্বপ্নহীন কাজ করাতে পীড়িত হয়েছেন। যে-কৃষিকাজ সমাজসভ্যতা বিনির্মাণের সবচেয়ে বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে, যে কৃষক আগামীকালের খাদ্য নিশ্চিত করেছে, সে তো আসলে সভ্যতার বীজ বপন করেছে, সেই কৃষক কেন কৃশকায় থাকবে। তাদেরই তো হয়ে ওঠা উচিত সকল নির্মাণের কেন্দ্রবিন্দু। সেই কারণেই হয়তো কৃষককে কেন্দ্র করে তাঁর স্বপ্নেরা ডানা মেলেছে। তাঁর ছবিগুলোতে বিশ্বসভ্যতার কেন্দ্র হিসেবে কৃষকদের বাস করা গ্রামের মহিমাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। গুহাচিত্রকরেরা অতীতের অভিজ্ঞতা আর পূর্বানুমান থেকে যে-ছবি আঁকতো তিনিও ভবিষ্যতের সেইসব কৃষকের জীবনাচরণের প্রতিফলন রেখেছেন তাঁর চিত্রে। তিনি দেখানোর চেষ্টা করেছেন, মহাজাগতিক সাগরের বেলাভূমি ছোট্ট পৃথিবী স্বাস্থ্যবান, উচ্ছলতার মানবিক আস্তরণে উদ্ভাসিত, যেন জীবনের ফসল বপনে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে।

তাই খ্যাতনামা লেখক আহমদ ছফা বলেছেন – ‘এ মানুষগুলোর পাখা থাকলে দেবদূতের মতো আকাশের অভিমুখে উড়াল পাড়তো। কিন্তু একটা বিশেষ ব্রতে, একটি বিশেষ অঙ্গীকারে আবদ্ধ বলেই তারা মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ে আছে। সে-অঙ্গীকারটি, সে-ব্রতটি মাটিকে গর্ভবতী ও ফসলশালিনী করা।’

এই কৃষি-উদ্ভাবনই মানুষকে প্রেরণা জুগিয়েছিল ঘর বাঁধার, বহু প্রজন্মের স্বপ্ন নিয়ে তা পরিণত হয়েছিল, ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর পথে-প্রান্তরে। পৃথিবী পরিণত হয়েছিল মানবজাতির বসতগৃহে। ঘর তৈরি করেছিল স্থিতিশীলতা, জন্ম দিয়েছিল অনুভবের, নির্ভাবনার পথের আরো এক ধাপ। ঘর হলো সাময়িক বিরতি আর দূরযাত্রার প্রস্তুতি, গ্রহান্তরের পথে!

সভ্যতার বিকাশে যারা মৌলিক শক্তির উৎস – সেই

কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ কেন এত স্বাস্থ্যহীন ও অবহেলিত? এই গভীর প্রশ্নটিই ছিল কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের শিল্পদর্শনের চালিকাশক্তি, তাঁকে তাড়িতও করেছে। এই সত্যের অনুসন্ধানেই তিনি আজীবন ঘুরে বেড়িয়েছেন উপমহাদেশের পথে-প্রান্তরে, এমনকি বিশে^র শিল্পরাজধানীগুলোতেও।

প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণা থেকে ১৯৪৩ সালে সুলতান খাকসার আন্দোলনে যোগ দেন। এ সময় তিনি জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান ও সফিউদ্দীন আহমেদের মতো ভবিষ্যতের দিকপাল সতীর্থদের রেখে কলকাতা আর্ট কলেজ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন। শুরু হয় তাঁর বোহেমিয়ান জীবন। প্রদেশ থেকে প্রদেশে, এক সংস্কৃতি থেকে আরেক

সংস্কৃতিতে ঘুরে ঘুরে কেটে যায় তাঁর অনেকটা সময়। এই পর্বে তিনি মূলত প্রকৃতির নৈসর্গিক দৃশ্য (ল্যান্ডস্কেপ) এবং সাধারণ মানুষের প্রতিকৃতি (পোর্ট্রেট) আঁকতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ভারতে অবস্থানরত আমেরিকান ও ব্রিটিশ সৈন্যদের কাছে ছবি বিক্রি করেই তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। মাঝে মাঝে আয়োজিত ছবির প্রদর্শনীর মাধ্যমে শিল্পী হিসেবে তিনি অল্পবিস্তর পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৪৬ সালে সিমলায় তাঁর জীবনের প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, যা ছিল তাঁর শিল্পীজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

তবে সুলতানের খামখেয়ালি ও ভবঘুরে স্বভাবের কারণে সে-সময়ের আঁকা অমূল্য চিত্রকর্মগুলো রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় তিনি ছিলেন কাশ্মিরের শ্রীনগরে। সেখান থেকে ফেরার সময় তাঁর আঁকা সকল ছবি ও সৃষ্টি সেখানেই রয়ে যায়। এ-প্রসঙ্গে শিল্পী নিজে বলেন : ‘শ্রীনগরে থাকাকালীন পাকিস্তান হয়ে গেল। ’৪৮-এ সেখান থেকে ফিরে এলাম। কোনো জিনিসই তো সেখান থেকে আনতে পারিনি। … আমার সমস্ত কাজই সেখানে রয়ে গেল। দেশে দেশে ঘুরেছি। সেখানে এঁকেছি। আর সেখানেই রেখে চলে এসেছি।’

এই হারানো অধ্যায়ের কারণে তাঁর প্রাথমিক পর্বের শিল্পকর্মের কোনো চাক্ষুষ নিদর্শন আজ অবশিষ্ট নেই।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সুলতান নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) ফিরে আসেন। তবে কিছুদিন এখানে থাকার পরই তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে চলে যান। সেখানে তিনি একটি পারসি স্কুলে শিল্প-শিক্ষকের পদে প্রায় দুই বছর কর্মরত ছিলেন। করাচিতে অবস্থানকালে পাকিস্তানের আধুনিক চিত্রকলার পুরোধা শিল্পী আবদুর রহমান চুঘতাই এবং শাকের আলির মতো বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও সখ্য গড়ে ওঠে। ১৯৫০ সালে সুলতানের শিল্পজীবন আন্তর্জাতিক রূপ পায়। তিনি চিত্রশিল্পীদের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে আমেরিকা যান। ১৯৫১ সালে নিউইয়র্কে ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন (আইআইই) আয়োজিত একটি সেমিনারে তিনি পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। এরপর তাঁর চিত্রকর্মের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, শিকাগো এবং বোস্টনের মতো আমেরিকার প্রধান শহরগুলোতে। পরবর্তী সময়ে লন্ডনেও তিনি একটি সফল প্রদর্শনী করেন, যা পশ্চিমা বিশে^ তাঁর পরিচিতি ছড়িয়ে দেয়। শিল্প-সমালোচক মোস্তফা জামান সুলতানের এই ভ্রমণ ও অভিজ্ঞতাকে তাঁর শিল্পীসত্তার প্রস্তুতির পর্ব হিসেবে দেখেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘তাঁর সাবলীল গতিবিধি নানা সামাজিক ভূগোলের মধ্য দিয়ে … আল্লামা মাশরিকির খাকসার আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা … এবং আমেরিকা ও ইউরোপে তাঁর ভ্রমণ তাঁকে ক্যানভাসের জন্য প্রস্তুত করেছিল, যা শিগগির শক্তিশালী নারী ও পুরুষ দিয়ে পূর্ণ হতে থাকে।’

সুলতানের জীবন ছিল এক দীর্ঘ যাত্রার মতো – বাংলার গ্রাম থেকে কলকাতার আর্ট কলেজ, সেখান থেকে উপমহাদেশের ধুলোমাখা পথ পেরিয়ে করাচি এবং অবশেষে নিউইয়র্ক ও লন্ডনের ঝলমলে গ্যালারি। এই বিশাল অভিজ্ঞতা ও ভ্রমণই তাঁকে তাঁর মূল প্রশ্নের কাছে ফিরিয়ে এনেছিল। পৃথিবীর নানা প্রান্ত ঘুরে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, তাঁর শিল্পের শেকড় প্রোথিত রয়েছে বাংলার মাটিতে, আর তাঁর ছবির নায়ক হলো পেশিবহুল, কর্মঠ কৃষক-শ্রমিক, যারা বিভিন্ন অঞ্চলে সভ্যতার নির্মাতাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

এস এম সুলতানের জীবন ছিল স্রোতের বিপরীতে চলা এক শিল্পীর কাব্যগাথা। তাঁর শিল্প ও দর্শনকে বুঝতে হলে ফিরে তাকাতে হয় তাঁর শৈশব আর বেড়ে ওঠার দিনগুলোর দিকে, যা ছিল প্রতিকূলতায় পূর্ণ, কিন্তু প্রতিভায় উজ্জ্বল। শিকড়ের টান ও প্রাতিষ্ঠানিকতার ঊর্ধ্বে এক জীবনপ্রবাহ। ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট, ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত তৎকালীন পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) নড়াইল জেলার মাছিমদিয়া গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে এস এম সুলতান জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা শেখ মোহাম্মদ মেসের আলী পেশায় ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রি, যদিও পরিবারের মূল অবলম্বন ছিল কৃষি। সুলতান ছিলেন তাঁর বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। শৈশবে আদর করে সবাই তাঁকে ‘লাল মিয়া’ নামে ডাকতো। পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তাঁর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চালিয়ে যাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। তবু ১৯২৮ সালে তাঁকে নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করা হয়। এখানেই তাঁর অসামান্য প্রতিভার প্রথম স্ফুরণ ঘটে।

মাত্র দশ বছর বয়সে, স্কুল পরিদর্শনে আসা আশুতোষ মুখার্জির পুত্র ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির একটি পেনসিল স্কেচ এঁকে সুলতান সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। কিশোর সুলতানের আঁকা সেই প্রতিকৃতি দেখে শ্যামাপ্রসাদ মুগ্ধ হন এবং ভূয়সী প্রশংসা করেন। এই ঘটনাই ছিল শিল্পী হিসেবে সুলতানের প্রথম আত্মপ্রকাশ। তবে স্কুলের বাঁধাধরা জীবন তাঁকে বেশিদিন আটকে রাখতে পারেনি। পড়াশোনা ছেড়ে তিনি বাড়িতে ফিরে বাবার সহযোগী হিসেবে রাজমিস্ত্রির কাজে যোগ দেন। কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের ফাঁকেও তাঁর ভেতরের শিল্পীসত্তা দমেনি। অবসরে চিত্রা নদীর তীরে এসে দাঁড়াতেন আর আপনঘোরে বিভোর থাকতেন। নদীর শান্ত ও ধীর প্রবাহ তাঁর শিল্পীমনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। জীবনে চলার পথে বারবার তিনি ফিরে এসেছেন মৃদুমন্দ বাতাসে বয়ে চলা চিত্রানদীর তীরে, দূর ভবিষ্যতের সমাজ বিকাশের ধারা অনুভবের চেষ্টা করেছেন।

এলাকার জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের স্নেহ ও পৃষ্ঠপোষকতা তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। জমিদারের ভাইপো অরুণ রায়, যিনি নিজে কলকাতার আর্ট স্কুলের ছাত্র ছিলেন, তাঁর সান্নিধ্যে এসে সুলতান ছবি আঁকার প্রণালিবদ্ধ শিক্ষা শুরু করেন। ১৯৩৮ সালে, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ইতি টেনে কলকাতার উদ্দেশে পাড়ি জমান। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি। তবে তিনি দমে যাননি। কখনো ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের বাড়ি, কখনো তাঁর ভাই সত্যেন রায়ের বাড়ি, কখনো তাঁদের অন্য ভাইদের বাড়িতে থেকে সুলতান পরবর্তী তিন বছর ছবি আঁকার নিবিড় চর্চা চালিয়ে যান।

১৯৪১ সালে সুলতান কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। প্রায় চারশো পরীক্ষার্থীকে মাত্র পনেরো মিনিটে ভেনাস দে মিলো’র প্রতিকৃতি আঁকতে দেওয়া হয়। সুলতান সেই পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। কিন্তু ম্যাট্রিকুলেশন পাশ না করায় তাঁর ভর্তি নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। এই সংকটময় মুহূর্তে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন প্রখ্যাত শিল্প-সমালোচক এবং আর্ট স্কুলের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য শাহেদ সোহরাওয়ার্দী। ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের মাধ্যমে খবর পেয়ে তিনি সুলতানের পাশে দাঁড়ান। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সুলতানের ভর্তির সমস্ত বাধা দূর হয়। তিনিই ‘লাল মিয়া’কে তাঁর আনুষ্ঠানিক নাম ‘শেখ মোহাম্মদ সুলতান’ ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। সোহরাওয়ার্দীর বিশাল গ্রন্থাগার সুলতানের জন্য উন্মুক্ত ছিল এবং তাঁর মেন্টরশিপ সুলতানের শিল্পবোধ গঠনে গভীর প্রভাব ফেলে। এই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সুলতান পরবর্তীকালে বলেছিলেন : ‘এক হিসেবে তিনি (শাহেদ সোহরাওয়ার্দী) ছিলেন আমার জন্মদাতা।’

কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তির পর সুলতান এক নতুন জগতের সন্ধান পান। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কঠোর নিয়মকানুন ও বাঁধাধরা জীবন তাঁর স্বাধীনচেতা স্বভাবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না। ফলে ১৯৪৩ সালে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময়ই তিনি আর্ট স্কুল ছেড়ে দেন এবং এক বোহেমিয়ান জীবন বেছে নিয়ে দেশ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। বলা যায়, সুলতান দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে দীক্ষা লাভ করেছিলেন – একটি শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর বাড়ির জ্ঞানসমৃদ্ধ গ্রন্থাগার এবং অন্যটি কলকাতা আর্ট স্কুল। এই দুইয়ের শিক্ষাই তাঁর ভবিষ্যৎ পথচলার ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। সুলতান কবির আবেগ দিয়ে ভালোবেসেছেন জীবনকে। আবার যান্ত্রিক নগরজীবনকে সেরকমই ঘৃণা করে গেছেন।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিচিতি লাভের পর বিশ্বনাগরিক সুলতানের মন বারবার ফিরে আসতে চেয়েছে তাঁর শৈশবের চিত্রা নদীর তীরে, বাংলার কাদামাটির সোঁদা গন্ধে। এই শেকড়ের টানেই ১৯৫৩ সালে তিনি চূড়ান্তভাবে নড়াইলে ফিরে আসেন। ১৯৫৩ সালের অক্টোবরে নড়াইলে ফিরে আসার কিছুদিন পর সুলতান চাচুড়ি-পুরুলিয়া গ্রামে যান। সেখানে কৈলাসটিলা নামক এক পরিত্যক্ত জমিদারবাড়ি পরিষ্কার করে তিনি দুটি প্রতিষ্ঠান গড়েন – নন্দনকানন প্রাইমারি স্কুল এবং নন্দনকানন ফাইন আর্টস স্কুল। পরবর্তী সময়ে এই প্রতিষ্ঠান দুটি একীভূত হয়ে চাচুড়ি-পুরুলিয়া হাইস্কুলে পরিণত হয়। ঢাকার শিল্পজগৎ যখন আধুনিকতার চর্চায় মুখর, সুলতান তখন সেই জৌলুস থেকে দূরে নড়াইলের নিভৃত পল্লিতে নিজের ভুবন গড়ায় মগ্ন। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তাঁর এই স্বেচ্ছানির্বাসনের কারণে তিনি শিল্পরসিক ও সমালোচকদের চোখের আড়ালেই থেকে যান।

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আহমদ ছফাসহ বেশ কিছু শুভানুধ্যায়ীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সুলতানকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনা হয়। দীর্ঘ বিরতির পর তিনি আবার ছবি আঁকায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর আঁকা নতুন ছবিগুলো নিয়ে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এই প্রদর্শনীটিই ছিল তাঁর রাজকীয় প্রত্যাবর্তন। এর মাধ্যমে তিনি নতুন করে দেশের শিল্পসমাজে তাঁর আসন ফিরে পান এবং তাঁর শক্তিশালী শিল্পদর্শন নতুন করে মূল্যায়িত হতে শুরু করে।

তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি সুন্দর ও মানবিক পৃথিবীর ভিত্তি স্থাপনে সক্ষম একমাত্র শিশুরাই। চাচুড়ি-পুরুলিয়া হাইস্কুলে যখন ছবি আঁকার ক্লাসটি বন্ধ হয়ে যায়, তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন এবং শিশুদের জন্য একটি আদর্শ জগৎ গড়ার স্বপ্নে আরো নিবিষ্ট হন। তিনি মনে করতেন, শৈশবে শিল্পের মাধ্যমে বেড়ে ওঠা শিশুরা আজীবন সুন্দরের পূজারি হয় এবং তারাই একদিন পৃথিবীবাসী বা ‘আর্দিয়ান’ (বধৎফরধহ) হয়ে উঠবে, যারা বিশ্ব থেকে যুদ্ধ ও হানাহানি দূর করবে। না হলে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধংদেহী মনোভাব পৃথিবী থেকে অপসারিত হবে না। তাঁর এই দর্শন বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের চিন্তার সঙ্গে অনুরণিত হয়, যিনি বলেছিলেন – পৃথিবীর অস্থিরতা ও আগ্রাসী মনোভাব মূলত মানুষের শৈশবকালীন অসুস্থতারই বহিঃপ্রকাশ।

আমি নিজেও ভাবি, এই যে এত শিক্ষালয়, এদের মধ্যে থেকে কেউ হবে শিল্পী, কেউ হবে বিজ্ঞানী, কেউ হবে রাজনীতিক; কিন্তু কেউ মানুষ হয়ে উঠছে না। যদি আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের পরস্পরের মধ্যকার সম্পর্ককে মানবিক গুণাবলিতে বিকশিত করতে না পারে, তাহলে এই সমস্যা কখনোই যাবে না। অতএব ভবিষ্যৎ মানবিক পৃথিবীর জন্য শিশুদের মানুষ করার দিকে মনেযোগ দেওয়ার বিকল্প নেই। কেননা, শৈশকালীন অসুস্থতা নিয়ে যে-সমাজে শিশুরা বড় হয়, তার ভবিষ্যৎ খুব একটা স্বস্তিদায়ক হওয়ার কথা নয়। তাই হয়তো করাচি থেকে আমেরিকান সরকারের আমন্ত্রণে আমেরিকা হয়ে লন্ডন, প্যারিসসহ পশ্চিমে তাঁর প্রদর্শনী ও নামযশ ছড়িয়ে পড়লেও শিশুদের যথাযথ উপায়ে মানুষ করার বিষয়টি তাঁকে ভীষণভাবে তাড়িত করেছিল।

আশির দশকে সুলতান স্থায়ীভাবে নড়াইলে বসবাস শুরু করেন। তাঁর বাড়িটি হয়ে ওঠে শিশু ও আশ্রয়হীনদের অভয়ারণ্য। জীবজন্তুর প্রতি তাঁর ছিল অসীম ভালোবাসা, যা থেকে তিনি বাড়িতে একটি ছোট চিড়িয়াখানা গড়ে তোলেন। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তিনি শিশুদের জন্য সুন্দরী কাঠ দিয়ে একটি বিশাল নৌকা তৈরি করেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল, এই নৌকায় চড়ে শিশুরা সমুদ্র পরিভ্রমণে বের হবে আর শিল্পচর্চার উপকরণ খুঁজে পাবে। তারেক মাসুদ পরিচালিত আদম সুরত শিরোনামের প্রামাণ্যচিত্রে শিশুদের সুকুমারবৃত্তির বিকাশ ঘটানোর প্রসঙ্গে সুলতান বলেছেন, ‘আমার শেখানোর কোনো উদ্দেশ্য কাজ করে না, বরং ওরা কীভাবে কী প্রকাশ করে, সেটিই আমি পছন্দ করি, উৎসাহিত করি।’

সুলতানের শিল্পকর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বাংলার কৃষক। কৃষকের পেশিবহুল শরীর ছিল তাঁর কাছে হাজার বছরের সংগ্রামের ও টিকে থাকার প্রতীক। তিনি বলতেন : ‘আমার চিত্রকর্মের বিষয়বস্তু শক্তির প্রতীক নিয়ে। পেশি … মাটির সঙ্গে সংগ্রামে ব্যবহার হচ্ছে। সেই বাহুর শক্তি হালকে মাটিতে প্রবাহিত করে এবং ফসল ফলায়। শ্রমই ভিত্তি, এবং আমাদের কৃষকদের সেই শ্রমের কারণে এই ভূমি হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে।’

আশির দশকের শেষদিকে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে শুরু করে। ১৯৯৪ সালে ঢাকার গ্যালারি টেনে তাঁর জীবনের সর্বশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সে-বছরের আগস্ট মাসে নড়াইলে আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে তাঁর শেষ জন্মদিন পালিত হয়। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি নড়াইলে ছিলেন। এখানেই তিনি শিশুদের জন্য ‘শিশুস্বর্গ’ এবং যশোরের ‘চারুপীঠ’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর এই কিংবদন্তি শিল্পী ও দার্শনিক নড়াইলে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন আর আমাদের জন্য রেখে যান অসাধারণ শিল্পদর্শন ও মানবিক

পৃথিবীর স্বপ্ন।

তিনি ছিলেন একজন খ্যাতিমান সুরসাধক এবং বংশীবাদক। সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি দেশ-বিদেশে বিভিন্ন সম্মাননা লাভ করেন। আশির দশকে তিনি আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের কাছ থেকে শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার গ্রহণ করেন। এটি তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতির একটি বড় উদাহরণ। ১৯৮২ সালটি ছিল তাঁর জীবনে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই বছর তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ম্যান অফ অ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কার লাভ করেন। একই বছর তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন। এছাড়াও ১৯৮১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে তিনি আন্তর্জাতিক জুরি কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন।

আদম সুরতে (অফধস ঝঁৎধঃ) এস এম সুলতানের একটি বক্তব্য আমাদের চিন্তার খোরাক জোগায় : ‘কোনো সভ্যতার মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে সেই সভ্যতার বিনাশ অবশ্যম্ভাবী।’ বর্তমান পৃথিবীও যেন সেই সত্যের মুখোমুখি, প্রায় সর্ব ক্ষেত্রেই। অথচ সুলতান তাঁর চিত্রকর্মের মাধ্যমে এমন এক সমাজের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি সংযোগ রেখে মৌলিক জীবনযাপন করবে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত থাকবে। 

সুলতানের আঁকা চিত্রকর্মগুলো দেখলে আমার মনে পড়ে যায় প্রাচীন শিকারি ও সংগ্রাহকদের কথা। বিশেষ করে, মানুষের আরেক প্রজাতি নিয়ান্ডারথালদের পেশিবহুল শিকারের ছবিগুলোর সঙ্গে সুলতানের আঁকা শক্তিশালী মানুষের এক অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। শুধু নিয়ান্ডারথালরা নয়, আদিম মানুষেরা তাদের অদম্য গতি, প্রাণশক্তি আর সাহস দিয়ে টিকে থাকার সংগ্রামে নিজেদের নিয়োজিত করেছিল। আদিম মানুষেরা স্থিতিশীলতার জন্য চেয়েছিল একটি ঘর, যা তাদের অনুভব আর বিমূর্ত চিন্তার অধিকারী করে তোলে। তাই তারা মাইগ্রেশনের পথ খুঁজেছিল; হয়তো সে-কারণেই কৃষিকাজ সেপিয়েন্সদের ভূমি কর্ষণে মনোনিবেশ করতে শেখায়। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, জীবনের এই নতুন আবর্তে এসে সেই গতি আর সাহস কেন পথ হারালো? কেন ক্রীতদাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়লো? সুলতান শুধু ছবি আঁকেননি, বরং তাঁর শিল্পের মাধ্যমে সভ্যতার এই বিচ্যুতিকে তুলে ধরেছেন। সুলতানের জীবনব্যাপী প্রচেষ্টা যেন কৃষকদের মতো মৌলিক পেশাজীবীদের সেই ক্রীতদাসত্ব থেকে উত্তরণের অবিরাম সংগ্রাম।