এ-ভূখণ্ড স্থাপত্যপেশার সূচনাপর্ব

সেলিম ইসমাইল

 

বাংলাদেশে স্থাপত্যপেশা আজ একটি উলেস্নখযোগ্য পর্যায়ে অধিষ্ঠিত হয়েছে। পেশার ব্যাপ্তি শুরুর দিকের তুলনায় সময়ের সঙ্গে দ্রুত বিসত্মৃতি লাভ করছে। বলা বাহুল্য, আদিতে বিষয়টি এমন কুসুমাসত্মীর্ণ ছিল না। বিভিন্ন বৈরী পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করে এ-পেশা বর্তমান অবস্থানে উপনীত হতে পেরেছে। তবে আত্মতুষ্টির কোনো কারণ নেই; উন্নত দেশের মতো স্থাপত্যবিদ্যার আবশ্যকীয়তা হৃদয়ঙ্গম করে মর্যাদাময় পর্যায়ে যেতে আরো বহুদিন হয়তো অপেক্ষা করতে হবে।

বাংলাদেশ তথা তদানীন্তন পূর্ব পাকিসত্মানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্থাপত্যপেশার সূত্রপাত বর্তমান স্থাপত্য অধিদপ্তরের পূর্বসূরি ‘অফিস অব দ্য কনসালটিং আর্কিটেক্ট’ দপ্তরের মাধ্যমে। ১৯৪৭-এর ভারত বিভাজন-পরবর্তী পূর্ব পাকিসত্মানের সিঅ্যান্ডবি দপ্তরের আওতাভুক্ত ‘অফিস অব দ্য কনসালটিং আর্কিটেক্ট’, ‘অফিস অব দ্য গভর্নমেন্ট আর্কিটেক্ট’, ‘অফিস অব দ্য চিফ আর্কিটেক্ট’ থেকে ১৯৭৭-এ এসে ‘স্থাপত্য পরিদপ্তর’ বা ‘Directorate of Architecture’ সৃষ্টি হয়। ১৯৮৩-তে ওই স্থাপত্য পরিদপ্তরের সঙ্গে অপর দুই সরকারি স্থাপত্যসেবা প্রতিষ্ঠান ‘গণপূর্ত স্থাপত্য বিভাগ’ এবং ‘গৃহসংস্থান স্থাপত্য শাখা’ একীভূত করে স্থাপত্য অধিদপ্তর গঠন করা হয়। উলেস্নখ্য যে, ’৪৭-এর বিভাগ-পূর্ব ভারতে প্রশাসনিক কার্যার্থে দিলিস্নতে একটি কেন্দ্রীয় সরকার এবং ভারতবর্ষব্যাপী তেরোটি প্রাদেশিক সরকার বিরাজমান ছিল। এই তেরোটির মধ্যে যথাক্রমে সম্পূর্ণ সাতটি ও বিভাজিত তিনটি প্রদেশ ভারতের এবং সম্পূর্ণ তিনটি ও বিভাজিত তিনটি প্রদেশ পাকিসত্মানের অন্তর্ভুক্ত হয়। সিন্ধু, বেলুচিসত্মান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ আর দ্বিখ–ত পাঞ্জাব নিয়ে গঠিত হয় পশ্চিম পাকিসত্মানের চারটি প্রদেশ; অন্যদিকে বিভাজিত বাংলা আর আসামের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত হয় পাকিসত্মানের পূর্বাংশে পূর্ব বাংলা প্রদেশ। বিভাগ-পূর্বকালে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োজনীয় ভবন, রাসত্মা ইত্যাদি ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পিডবিস্নউডি এবং প্রাদেশিক সরকারগুলোর ভৌত অবকাঠামোর জন্য সিঅ্যান্ডবি নামে দুটি সংস্থা চালু ছিল। পাকিসত্মানের কেন্দ্রীয় রাজধানী স্থাপিত হয় করাচিতে আর পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী স্থাপন করা হয় ঢাকায়। ভারত-পাকিসত্মান প্রতিষ্ঠার প্রশাসনিক ধারাবাহিকতায় দিলিস্নতে অবস্থিত কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন দপ্তর ভাগ করে করাচিতে এবং কলকাতায় বিদ্যমান অবিভক্ত বাংলা সরকারের দপ্তর ভাগ করে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। এভাবে যথাক্রমে যাত্রা শুরু হয় পাকিসত্মান পিডবিস্নউডি এবং সিঅ্যান্ডবি দপ্তরের। এই দুই দপ্তরের সঙ্গেই স্থাপত্য শাখা অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিসত্মান পিডবিস্নউডির স্থাপত্য শাখার কার্যক্রম পূর্ব পাকিসত্মানে বেশ সীমিত ছিল এবং ১৯৬৬-এর পূর্বে এখানে কোনো স্নাতক স্থপতি নিয়োজিত ছিলেন না।

অপরদিকে কলকাতা থেকে বিভাজিত হয়ে আসা সিঅ্যান্ডবি এবং তৎসংশিস্ন­ষ্ট কনসালটিং আর্কিটেক্টের দপ্তর ১৯৪৭-পরবর্তীর শুরু থেকেই ব্যস্ত সরকারি দপ্তরে পরিণত হয়। ঢাকার মতো একসময়ের মফস্বল শহরকে প্রাদেশিক রাজধানীর উপযোগী চাহিদা অনুযায়ী সচিবালয় থেকে শুরু করে সকল সরকারি দপ্তরের ভবন ও বাসভবন নির্মাণসহ সব ধরনের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ এবং প্রদেশের অন্যান্য শহরে সাধারণ প্রশাসন, কোর্ট-কাছারি-আদালত, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, থানা, কারাগার স্থাপনের বৃহৎ কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত হতে হয় সিঅ্যান্ডবি এবং আর্কিটেক্ট দপ্তরকে।

আগস্টে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই ১৯৪৭-এর সেপ্টেম্বরে পূর্ব বাংলা সরকারের প্রথম প্রধান স্থপতি (সে-সময়ে পদবিটি ছিল কনসালটিং আর্কিটেক্ট, যা পরবর্তীকালে গভর্নমেন্ট আর্কিটেক্ট এবং চূড়ান্তভাবে প্রধান স্থপতি নির্ধারিত হয়) হিসেবে নিযুক্ত হন ব্রিটিশ স্থপতি ই. সি. হিকস (Edward Coleman Hicks, জন্ম ১৯১০)। রয়েল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস (RIBA) এবং রয়েল টাউন পস্ন্যানিং ইনস্টিটিউটের (RTPI) সদস্য ই. সি. হিকস ঢাকায় আসার আগে দিলিস্নতে অবিভক্ত ভারতের কেন্দ্রীয় পিডবিস্নউডিতে সিনিয়র আর্কিটেক্ট পদে আসীন ছিলেন; কিন্তু পূর্ব বাংলা সরকারের অধীনে চাকরির আগ্রহ ব্যক্ত করে ঢাকায় চলে আসেন। সম্ভবত সে-সময়ে দিলিস্নতে পিডবিস্নউডির শীর্ষ কর্মকর্তা তথা প্রধান প্রকৌশলী খান বাহাদুর মো. সুলেমানের ঢাকায় পূর্ব বাংলা সরকারের অধীনে চাকরি নেওয়ার ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে হিকস ঢাকায় আসেন। প্রসঙ্গত উলেস্ন­খ করা যায়, চাকরিস্থল পরিবর্তন করে ঢাকায় আসার আগে সুলেমান দিলিস্নতে যথেষ্ট মর্যাদাপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। অবিভক্ত ভারতে তাঁর কর্ম-অভিজ্ঞতা ছিল সমীহ করার মতো। (২০০০ খ্রিষ্টাব্দে এই লেখকের সুযোগ হয়েছিল দিলিস্নতে সেন্ট্রাল পিডবিস্ন­উডির প্রধান কার্যালয় পরিদর্শনের; সেখানে ১৮৫৪-তে প্রতিষ্ঠিত দপ্তরটির প্রধান প্রকৌশলীর দীর্ঘ তালিকায় ব্রিটিশ ও ভারতীয়দের ভিড়ে ১৯৪৬-এ একটি মাত্র মুসলমান নাম প্রত্যক্ষ করি, সেটি খান বাহাদুর মো. সুলেমানের)। হিকস আগ্রহভরে দিলিস্ন থেকে ঢাকায় যোগদান করলেও তিন বছর চাকরির পর নিযুক্তিকালে দেওয়া আশ্বাসমতে বেতন প্রদানে আমলাদের অনীহার কারণে চাকরি ছেড়ে বিলেতে ফিরে যান। হিকসের সঙ্গে একই সময়ে অধীনস্থ স্থপতি হিসেবে অ্যাসিস্ট্যান্ট গভর্নমেন্ট আর্কিটেক্ট পদে যোগদান করেন কলকাতার দপ্তর থেকে আসা রেমন্ড ম্যাক্কনেল (Raymond McConnel, জন্ম ১৯১৭) এবং এস.এ. আজগার। হিকসের প্রস্থানের পর ম্যাক্কনেল গভর্নমেন্ট আর্কিটেক্ট পদে নিযুক্তি লাভ করেন। ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত ম্যাক্কনেল ছিলেন RIBA-এর সহযোগী সদস্য এবং নগর পরিকল্পনায় সার্টিফিকেটধারী। তিনি ১৯৫১ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত পূর্ব পাকিসত্মান সরকারের প্রধান স্থপতি হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন (পরবর্তীকালে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা অধ্যাপক শাহ আলাম জাহির উদ্দিন)।

গস্নাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য স্নাতক অবাঙালি আজগার ’৪৭-এ যোগদান করলেও সম্ভবত বছর-দুয়েকের মাথায় অন্যত্র চলে যান।

হিকস সদ্য প্রতিষ্ঠিত প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাসহ পূর্ব পাকিসত্মানের নগরাঞ্চল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন। তৎকালীন নতুন ঢাকার কিছু এলাকা, আজিমপুর হাউজিং এস্টেট, নিউ মার্কেট, অধুনালুপ্ত শাহবাগ হোটেল, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, জিন্নাহ অ্যাভিনিউ বাণিজ্যিক এলাকা, ইডেন ভবন সম্প্রসারণ প্রভৃতি হিকসের পরিকল্পনা অনুসারে বাস্তবায়িত হয়।

ফেব্রম্নয়ারি ১৯৪৯-এ জহির উদ্দীন খাজা (জন্ম ১৯২২) সরকারি স্থাপত্য অফিসে জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট আর্কিটেক্ট হিসেবে যোগ দেন এবং তাঁকে চট্টগ্রামের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি বোম্বের (বর্তমানে মুম্বাই) মর্যাদাপূর্ণ জে জে স্কুল অব আর্টস থেকে স্থাপত্যে ডিপেস্নামাপ্রাপ্ত  এবং লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিক ডিজাইনে স্নাতকোত্তর ছিলেন। ১৯৪৬-এ তিনি RIBA এবং ১৯৪৮-এ RTPI-এর সদস্যপদ অর্জন করেন। জহির উদ্দীন চট্টগ্রামের প্রাথমিক নগর পরিকল্পনাসহ  আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা, বায়েজীদ বোসত্মামী শিল্প এলাকা, স্টেডিয়াম, বিভাগীয় কমিশনারের বাংলো প্রভৃতির ডিজাইন প্রণয়ন করেন। ১৯৫২-এর শুরুতে জহির উদ্দীন এখানকার চাকরি ছেড়ে পশ্চিম পাকিসত্মানে চলে যান এবং মুখ্য স্থপতি ও নগর-পরিকল্পনাবিদ হিসেবে যথাক্রমে পাঞ্জাবের থল ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (TDA), করাচি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (KDA) ও ক্যাপিটাল ডেভেলপমেন্ট অথরিটিতে (CDA) দায়িত্ব পালনশেষে ১৯৬৫ থেকে সরকারি চাকরি ছেড়ে বেসরকারি উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান গড়ার মাধ্যমে পেশা অনুশীলনে ব্যাপৃত হন। বিশেষ করে সিডিএর স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনা বিভাগের প্রথম পরিচালক হিসেবে জহির উদ্দীন পাকিসত্মানের নতুন রাজধানী ইসলামাবাদ শহর গড়ে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৭-তে তিনি ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস পাকিসত্মান   (IAP) গঠনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন এবং প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে কয়েকবার তিনি IAP-এর সভাপতির পদ অলংকৃত করেন।

১৯৫২-এর আগস্টে চট্টগ্রামে জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট আর্কিটেক্ট হিসেবে যোগদান করেন এডিনবরা থেকে স্থাপত্যে স্নাতক হায়দরাবাদের অধিবাসী এ. রহমান হাই (জন্ম ১৯১৯)। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের শহর পরিকল্পনায় তিনি দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। হাই ১৯৫৬ পর্যন্ত এদেশে অবস্থান করেন এবং পরবর্তীকালে পশ্চিম পাকিসত্মানে গমন করেও সরকারি স্থপতি হিসেবে নিয়োজিত হন। সেখানে যথাক্রমে পশ্চিম পাকিসত্মান ও পাঞ্জাব সরকারের প্রধান স্থপতি হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। কার্যকালে পাকিসত্মানের বহু স্থানে অন্যান্য প্রকল্পের পাশাপাশি বেশকিছু মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ডিজাইন প্রণয়নের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫৩-তে ম্যাক্কনেলের অধীনে প্রথম স্নাতক বাঙালি স্থপতি হিসেবে জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট আর্কিটেক্ট পদে যোগদান করেন মাজহারুল ইসলাম (জন্ম ১৯২৩)। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ১৯৪৬ সালে পুরকৌশলে স্নাতক মাজহারুল ইসলাম ’৪৭ থেকে ’৫০ পর্যন্ত সিঅ্যান্ডবি দপ্তরে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করেন এবং সরকারি বৃত্তিতে ১৯৫০-৫৩ সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে স্নাতক শিক্ষা সমাপন করে নতুন পদে যোগ দেন। উলেস্নখ্য, বৃত্তি নিয়ে আমেরিকায় স্থাপত্য অধ্যয়নের জন্য তিনি ১৯৪৭ সালেই মনোনীত হন; কিন্তু ভারত-পাকিসত্মান সৃষ্টিজনিত কারণে তা স্থগিত হয়ে যায় এবং পরবর্তীকালে ১৯৫০-এ তাঁর পক্ষে বৃত্তিটি পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হয়। (উলেস্নখ্য যে, চলিস্নশের দশকে তৎকালীন ভারত সরকার যেসব বিজ্ঞান বা কারিগরি বিষয়ের শিক্ষাদানের সুযোগ ভারতবর্ষে নেই বা সীমিত সেসব বিষয়ে স্থানীয়দের প্রশিক্ষিত করার জন্য পোস্ট-ওয়ার স্কলারশিপ নামে একটি কর্মসূচি গ্রহণ করে; তারই আওতায় মাজহারুল ইসলাম মনোনীত হন। একই বৃত্তিতে তাঁর পূর্বে জে জে স্কুল অব আর্টসের স্নাতক অচ্যুত কানভিন্দে ও জহির উদ্দীন খাজা যথাক্রমে হার্ভার্ড ও লিভারপুল থেকে এম. আর্ক  ও এমসিডি ডিগ্রি এবং শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে যন্ত্রকৌশলে স্নাতক হাবিব রহমান এমআইটি থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় বি. আর্ক/এম.আর্ক অর্জন করেন। হাবিব রহমান সিপিডবিস্নউডিতে ভারত সরকারের প্রধান স্থপতি হিসেবে ১৯৭৪-এ অবসরগ্রহণ করেন। ভারত সরকার তাঁকে ১৯৫৫-তে পদ্মশ্রী এবং ১৯৭৪-এ পদ্মভূষণ খেতাবে ভূষিত করে।

১৯৫৩-৬৩ সময়কালে মাজহারুল ইসলাম প্রধান স্থপতির দপ্তরে কর্মরত ছিলেন – ১৯৬৪-তে সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ‘বাস্ত্তকলাবিদ’ নামে উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। সরকারি স্থপতি হিসেবে তিনি ঢাকা আর্ট কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি, সায়েন্স ল্যাবরেটরি ঢাকা, আজিমপুর এস্টেটে ডুপেস্নক্স ও সিমপেস্ন­ক্স অ্যাপার্টমেন্ট, ঢাকা স্টেডিয়াম, খিলগাঁও পুনর্বাসন এলাকা এবং রাঙামাটি শহরের মহাপরিকল্পনাসহ ছোটখাটো আরো প্রকল্পের স্থপতির দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষ করে আর্ট কলেজ ও লাইব্রেরি ভবনের অনুপম স্থাপত্যের জন্য মাজহারুল ইসলামকে এদেশে আধুনিক স্থাপত্যধারার পথিকৃৎ গণ্য করা হয়। তিনি ১৯৬৭-৬৮-তে IAP-এর সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। ১৯৭২-এ ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট বাংলাদেশ (IAB) প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকাসহ প্রথম সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন।

১৯৫৭-তে ডেনমার্কের অধিবাসী স্থপতি জ্যঁ ডেলোরা (Jean Pierre Louis Delouran, জন্ম ১৯১১) সরকারি স্থাপত্য দপ্তরে স্পেশাল অফিসার আর্কিটেকচার পদবিতে যোগদান করেন। তিনি তাঁর দেশের রয়েল অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস থেকে স্থাপত্যে স্নাতক এবং হাসপাতাল পরিকল্পনায় উচ্চতর প্রশিক্ষিত ছিলেন। ঢাকায় চাকরিতে যোগদানের আগে তাঁর ডেনমার্কে ১৪ বছর এবং স্পেনে চার বছরের কর্ম-অভিজ্ঞতা ছিল। আমার ধারণা, দ্বিপক্ষীয় কোনো কারিগরি সহায়তা কর্মসূচির আওতায় তিনি এখানে নিযুক্ত হয়েছিলেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ সীমানায় পূর্বে নির্মিত ডেন্টাল কলেজ ও ফার্মেসি ভবনসহ সিলেট, বরিশাল ও রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডিজাইন প্রণয়ন করেন ডেলোরা। এছাড়া রমনা পার্কের রেসেত্মারাঁ এবং কক্সবাজারে হিলটপ সার্কিট হাউসের ডিজাইন তাঁর প্রণীত। তবে তাঁর সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য কাজ ছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আর্কিটেকচারাল নকশা প্রণয়ন। শহিদ মিনারের মূল নকশাকার হিসেবে শিল্পী হামিদুর রহমান সর্বজনস্বীকৃত হলেও বাস্তবতা এই যে, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রাপ্ত ডিজাইনটির সাইট ও নির্মাণ নকশা প্রণয়নকালে বর্তমানের আনুপাতিক ও পরিশীলিত অবয়বটির রূপদান করেন স্থপতি ডেলোরা। তিনি ১৯৬২ পর্যন্ত এদেশে অবস্থান করেন।

উপরোক্ত উপস্থাপনা থেকে দেখা যায়, ১৯৪৭-পরবর্তী দুই দশক পর্যন্ত মাজহারুল ইসলাম ছাড়া সরকারি পর্যায়ে স্থাপত্য পেশার অনুশীলন ও লালন হয়েছে ভিনদেশি বা অস্থানীয়দের হাতে। ১৯৬৭-তে নিজস্ব ভূখ–র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থানীয় স্থাপক সৃষ্টি শুরু হওয়ার পর দেশীয় পরিবেশ, জলবায়ু, নির্মাণ-কুশলতা ও আর্থ-সামাজিক কাঠামোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল স্থাপত্য উদ্ভাবনে ক্রিয়াশীল হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

তা সত্ত্বেও এ-কথা অনস্বীকার্য, আজকের অবস্থানে আসার অন্তরালে ভিনদেশি বা অস্থানীয়দের অবদান অভিবাদনেয়।

 

ইডেন ভবন কাহিনি

বাংলাদেশ সরকারের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্রের সাধারণভাবে প্রচারিত নাম ‘সচিবালয়’ বা সম্পূর্ণ উচ্চারণে ‘বাংলাদেশ সচিবালয়’। এই স্থানটির আদি ইতিহাস হয়তো অনেকেরই অজানা। স্বাধীন বাংলাদেশের সচিবালয়ে রূপান্তরিত হওয়ার আগে এটি ছিল তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিসত্মান সরকারের প্রশাসনিক কেন্দ্র তথা প্রাদেশিক সচিবালয়। সাধারণ্যে অধিক প্রচারিত ছিল ‘ইডেন বিল্ডিং’ নামে। বোধ করি অবিভক্ত বাংলার সচিবালয় কলকাতার ‘রাইটার্স বিল্ডিং’-য়ের ঐতিহ্য অনুসরণে।

১৯৪৭-এর স্বাধীনতা ও ভারত বিভাজনের প্রেক্ষাপটে ‘পূর্ব বাংলা’ নামীয় প্রদেশের জন্ম হয়। এখানে উলেস্নখ্য, পাকিসত্মানের পূর্ব অংশ ১৯৪৭-এর আগস্ট থেকে ১৯৫৫-এর অক্টোবর পর্যন্ত পূর্ব বাংলা নামে অভিহিত হতো। ১৯৫৫-তে পাকিসত্মানের পশ্চিম অংশের চারটি প্রদেশ একীভূত করে পশ্চিম পাকিসত্মান নামকরণ করা হয় এবং একই সঙ্গে পূর্ব বাংলার নাম পূর্ব পাকিসত্মান হিসেবে পরিবর্তন করা হয়।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর স্বাভাবিক কারণেই এ-অঞ্চলে নবসৃষ্ট প্রদেশের বৃহত্তম শহর ঢাকা রাজধানী হিসেবে নির্ধারিত হয়। কিন্তু ১৯৪৭-এর ঢাকায় রাজধানীর জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি দপ্তরা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বাসস্থান স্থাপনের জন্য ন্যূনতম অবকাঠামো এবং ভবনা ছিল না। অথচ তৎকালীন নব্য স্বাধীন দেশের প্রাদেশিক সরকারের কার্যক্রম শুরু করার জন্য এগুলোর অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। বিশেষ করে পাকিসত্মানের বৃহত্তর পশ্চিমাংশের তুলনায় ক্ষুদ্রতর এই অনগ্রসর পূর্ব বাংলা প্রদেশটির হাজার মাইলের বিচ্ছিন্নতা এই প্রয়োজনীয়তাকে আরো অত্যাবশ্যক করে তোলে। সে-সময়কার নীতিনির্ধারকগণ বাস্তবতার আলোকে এই বাস্ত্ত সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার ফলে ঢাকার নবাব আবদুল গনি রোড ও তোপখানা রোডের মধ্যবর্তী এলাকায় সদ্য নির্মিত ইডেন স্কুল ও কলেজ ভবনগুলোকে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক সরকারের সদর দপ্তর হিসেবে সচিবালয় আর পলাশীসহ শহরের কিছু কিছু স্থানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে মিত্র বাহিনী-নির্মিত আধা-পাকা মিলিটারি ব্যারাকে সংস্থান করা হয় সরকারি কর্মচারীদের জরুরি আবাসন। এভাবেই কলকাতা থেকে ভাগ হয়ে আসা সরকারি দপ্তর ও বাসস্থানের তাৎক্ষণিক চাহিদা সামাল দেওয়া হয়। এমনকি স্থানাভাবে ঢাকায় সব দপ্তর সংস্থান সম্ভব না হওয়ায় নিকটবর্তী অন্য শহরেও কিছু দপ্তরের আপাত সংস্থান করা হয়।

ফিরে আসি ইডেন স্কুল প্রসঙ্গে – ব্রিটিশ শাসনামলের গোড়ার দিকে এদেশে বিদ্যাশিক্ষার প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত ছিল – একথা বলা যাবে না। তৎকালীন ঢাকায় ছেলেদের স্কুল-কলেজ কিছু থাকলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে তা ছিল একরকম অনুপস্থিত। তাছাড়া সেকালে সহ-শিক্ষা ছিল অকল্পনীয়। আর এ-কথা অনস্বীকার্য বাঙালি মুসলমানদের তুলনায় বাঙালি হিন্দুরা শিক্ষা-দীক্ষার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। ঢাকায় মেয়েদের শিক্ষা-দীক্ষার এই শোচনীয় অবস্থা থেকে বের করে আনার লক্ষ্যে সমাজের অগ্রসর মন-মানসিকতার অনুসারী গুটিকয় মহৎপ্রাণ এ-সময়ে আগ্রহী মেয়েদের বিদ্যাশিক্ষা লাভের পথ সৃষ্টির জন্য এলাকাবিশেষে ঘরোয়া পর্যায়ে কিছু পাঠশালা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এসব পাঠশালার পাঠদান কার্যক্রম সাধারণত বিত্তবান কোনো গৃহস্বামীর বাসভবনের চৌহদ্দির কাছারি জাতীয় ঘরে পরিচালিত হতো। এ-প্রক্রিয়াতেই ঊনবিংশ শতকের সত্তরের দশকে গোড়াপত্তন ঘটেছিল ইডেন স্কুল-কলেজের পূর্বসূরির। মূলত ব্রাহ্মসমাজের বিশিষ্ট কয়েকজনের পৃষ্ঠপোষকতায় ফরাশগঞ্জ এলাকায় সরু গলির এক বাড়িতে ছয়-সাতজন ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় এই গার্লস মিড্ল ভার্নাকুলার স্কুলের। তৎকালীন বাংলার ব্রিটিশ সরকার স্থানীয় মেয়েদের বিদ্যাশিক্ষায় আগ্রহের বিষয়ে অবগত হয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। তারই ফলে ওপরে বর্ণিত স্কুলের সঙ্গে আরো কয়েকটি ক্ষুদ্র স্কুলের সম্মিলন ঘটিয়ে ১৮৭৮ সালে লক্ষ্মীবাজার এলাকায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকা শহরে প্রথম মেয়েদের স্কুল চালু হয়। তৎকালীন বাংলা প্রদেশের বিদ্যোৎসাহী ছোটলাট (লেফটেন্যান্ট গভর্নর) স্যার অ্যাশলে ইডেনের নামানুসারে স্কুলটির নামকরণ করা হয় ঢাকা ইডেন ফিমেল স্কুল।

১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে লক্ষ্মীবাজারের ভবনটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে স্কুলের কার্যক্রম সদর পূর্বপাশে এক পর্তুগিজ ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন ভবনে স্থানান্তর করা হয়। ১৯২৬-২৭ সালে এখানেই ম্যাট্রিকের (মাধ্যমিক) পাশাপাশি ইন্টারমিডিয়েট (উচ্চমাধ্যমিক) শিক্ষাক্রম যোগ করাতে এটি পরিণত হয় ইডেন স্কুল ও কলেজে। সদরঘাটের সেই ক্ষুদ্র পরিসরে আঙিনার দীনতা থাকলেও পাঠদানে কিংবা ছাত্রীসংখ্যায় দীনতা ছিল না। নারীশিক্ষায় প্রতিষ্ঠানটির অবদান বিষয়ে এর অভিভাবকগণ একসময়ে দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন সেকালের একচ্ছত্র বাঙালি নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের। ১৯৩৭-৪৩ সময়কালে শেরে বাংলা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তার মধ্যে প্রথম দুই বছর ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রকের সরাসরি দায়িত্বে। তাঁরই আনুকূল্য ও ভালোবাসায় অপরিসর স্কুলটির ঠিকানা, আঙিনা, অবয়ব আর ব্যাপ্তির পরিবর্তন ঘটে। শেরে বাংলা তথা মুখ্যমন্ত্রীর আদেশে বাংলা সরকারের পূর্ত দপ্তর তোপখানা রোড এলাকায় গড়ে তোলে বোর্ডিংসহ একটি আদর্শ স্কুল এবং কলেজের আধুনিক ক্যাম্পাস। পরিবর্তিত স্থানে স্কুলের সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে কলেজ সংযোজিত হয়। ১৯৪৫ সালে নবনির্মিত ভবনাদির আদর্শ পরিবেশে অধিষ্ঠিত হয় ইডেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ। (তৎকালে কলকাতার পূর্ত দপ্তরে নিয়োজিত ব্রিটিশ আর্কিটেক্ট কর্তৃক প্রণীত স্বয়ংসম্পূর্ণ এই ক্যাম্পাসের বিশদ স্থাপত্য নকশা একটি দর্শনযোগ্য অভিজ্ঞতা)। বর্তমান সচিবালয়ের বিংশ তলা, প্রথম ও দ্বিতীয় নয়তলা, ক্লিনিক ভবন, গেস্ট হাউস এবং মসজিদ ছাড়া বাকি সবই ইডেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ হিসেবে নির্মিত কাঠামোর অংশ। এখনো সচিবালয়ের অভ্যন্তরে এগুলোকে স্কুলভবন অথবা কলেজভবন হিসেবে উলেস্নখ করা হয়।

১৯৪৭ পর্যন্ত ইডেনের ভবনগুলো প্রধানত দোতলা পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিল। ’৪৭-পরবর্তীকালে দাপ্তরিক চাহিদার প্রেক্ষাপটে চারতলা সম্পন্ন হয়। সে-সময় এটিই ছিল ঢাকার সর্ববৃহৎ ক্ষেত্রফলবিশিষ্ট ইমারত সমাহার। রাতারাতি প্রশাসনিক দপ্তর স্থাপনের জন্য দ্বিতীয় কোনো উপযুক্ত পাকা ভবন সে-মুহূর্তে ছিলও না, তাই শিক্ষা প্রদান কেন্দ্রের উদ্দেশ্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে গড়তে হয় আমলাকেন্দ্র!

‘ইডেন বিল্ডিং’ সচিবালয়ের সূত্রপাত ও নামকরণ এভাবেই। অন্যদিকে ইডেন স্কুল ও কলেজকে আবার হতে হয় বাস্ত্তহারা!

স্কুল অংশকে টিকাটুলির কামরুন্নেসা গার্লস স্কুলের সঙ্গে একীভূত এবং কলেজ অংশকে বক্শীবাজার এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। ১৯৬২-তে আজিমপুর এলাকায় নতুনভাবে ইডেন কলেজটি স্থানান্তরিত হলেও ইডেন স্কুলটি স্বনামে আর বিকশিত হতে পারেনি। স্কুল বিল্ডিং নামে পরোক্ষে এটি বেঁচে আছে হয়তো পিডবিস্নউডির ইডেন ভবন বিভাগের নথি আর পুরনো কর্মীদের উচ্চারণে!

আজ যাঁরা সচিবালয় চৌহদ্দিতে কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে অল্পসংখ্যক হয়তো এই অতীত বিষয়ে অবগত। তবু সকলেই এই ইতিহাসের অংশ নিঃসন্দেহে।