ওরা এরকমই

হ রি শং ক র  জ ল দা স

রিকশাটা থামার সঙ্গে সঙ্গে একজন লালকোর্তার কুলি বলল, ‘কোন টেরেনে যাইবেন স্যার? সুবর্ণতে?’ বিরক্তি নিয়ে বাদল রহমান ওপরে-নিচে মাথা নাড়লেন।

বাদল রহমানের বিরক্ত হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। নির্ধারিত সময়ে তাঁর বাসার নিচে অফিসের গাড়ি আসার কথা ছিল। আসেনি। অফিস থেকে জানানো হলো – তাঁর জন্য নির্ধারিত গাড়িটি পথিমধ্যে বিকল হয়ে গেছে। ট্যাক্সি নিয়ে কমলাপুর রেলস্টেশনে চলে যান। ফিরে এলে টিএ দেওয়া হবে। ভারী ব্যাগটি নিয়ে গলির মুখ পর্যন্ত হেঁটে আসতে হলো বাদল সাহেবকে। দড়াম করে দরজা বাঁধার আগে পেছন থেকে বউ ঝামটা দিলো, ‘চিটাগাংয়ে অডিট করতে যাচ্ছে না, লীলা করতে যাচ্ছে। কদিন পরে আসে কে জানে?’

স্ত্রীর সঙ্গে দিনসাতেক বাদল রহমানের কথাবলাবলি বন্ধ। স্ত্রীটি ভীষণ সন্দেহপ্রবণ।

তেতো মন নিয়ে অনেক চেষ্টা করেও ট্যাক্সি জোগাড় করতে পারলেন না বাদল সাহেব। ওদিকে সময় দেড়টা পেরিয়ে গেছে। তিনটায় ট্রেন। না খেয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছেন তিনি। ইচ্ছা – একটু আগে পৌঁছাতে পারলে স্টেশনের দোতলায় বিরতি নামের রেস্টুরেন্টে খেয়ে নেবেন। ট্যাক্সি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত রিকশাতেই আসতে হয়েছে তাঁকে। অডিট অফিসের বড় অফিসার তিনি। রিকশায় চড়া ছেড়েছেন অনেকদিন। তাঁর মনে হলো – আনাড়ি বুঝে রিকশাওয়ালা বেশি ভাড়া আদায় করে নিয়েছে।

ঘড়ির দিকে তাকালেন বাদল রহমান। ঘড়িতে দুটো বেজে পাঁচ। এখনো পঞ্চান্ন মিনিট বাকি। সময় আছে হাতে। দুপুরের খাওয়াটা সেরে নেওয়া যাবে। লালকোর্তার কুলিকে বললেন, ‘সুবর্ণতেই যাব। তার আগে ‘বিরতি’তে ভাত খাব। ব্যাগ ওখানে তুলবে। তারপর বগিতে পৌঁছে দেবে। কত নেবে?’

‘দেড়শো টেহা দিয়েন স্যার।’ লালকোর্তা বলল।

ঠিক সময়ে স্টেশনে পৌঁছাতে পেরে মনে একটু খুশির হাওয়া লেগেছিল, লালকোর্তার কথা শুনে আবার খিঁচড়ে গেল মনটা।

ধমক দেবেন বলে ঠিক করেও ধমক দিলেন না বাদল সাহেব।  বললেন, ‘ত্রিশ টাকা নাও।’

কটকটিয়ে হেসে উঠল লালকোর্তা। ‘ত্রিশ টেহা খরচ কইরবেন কেলা? নিজে বইয়া লইয়া যান। টেহা আপনার বুকপকেটে থাইকা যাইব।’ বলে আরেকজন যাত্রীর দিকে এগিয়ে গেল লালকোর্তা।

সিঁড়ির গোড়ায় ভারী ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন বাদল রহমান। শতশত মানুষের মাঝখানে নিজেকে বড় অসহায় বলে মনে হতে লাগল তার।

‘স্যার, আমি লইয়া যাই আপনার ব্যাগ?’

চমকে তাকালেন বাদল সাহেব। দেখলেন – দশ-এগারো বছরের এক বালক তাকে উদ্দেশ করে কথাগুলো বলেছে।

‘তুই নিয়ে যাবি? কোথায়?’

‘পরথমে বিরতিতে, পরে সুবর্ণর বগিতে।’

‘তুই জানলি কী করে?’

‘ওই যে, ওইখানে দাঁড়াই আছিলাম আমি। আপনাগো হগল কথা হুনছি। আমারে তিরিশ ট্যাকাই দিয়েন স্যার।’ বলে ব্যাগটা মাথায় তুলে নিল ছেলেটি।

কী বলবেন – ঠিক করতে পারলেন না বাদল রহমান। নীরবে ছেলেটির পিছু নিলেন। যেতে যেতে ছেলেটি  বগির নাম জেনে নিল।

 

‘স্যার, আপনি খাইয়া লন। ব্যাগ এইখানে রাখলাম। আমি বাইরে অপেক্ষা কইরতাছি। আড়াইটার সোময় লইয়া যামু। একটু আগে যাইতে হইবে স্যার। আপনার বগি ও-ই একেবারে মাথার দিকে। অনেক হাঁটা পইড়ব।’ রেস্টুরেন্টের ভেতরে কাউন্টারের পাশে ব্যাগটি রাখতে রাখতে বলল ছেলেটি।

‘তোর নাম কী রে?’ বগির দিকে এগোতে এগোতে বাদল রহমান জিজ্ঞেস করলেন।

‘আকাশ।’ কাঁধ নামানো চুল দুলিয়ে কালাকোলা ছেলেটি উত্তর দিলো।

‘তুই এইখানে ব্যাগবুগ টানিস?’

‘সবসোময় না। সকালের দিকে দুই-তিনবার।’

‘কেন? সকালের দিকে কেন? দুই-তিনবার কেন? বেশি নয় কেন?

‘সকালে মায় বাসায় কাম কইরতে যায়। দুপুরে মা ফিইরা আসার আগে যা পারি টানি।’

‘কেন তোর মা কুলিগিরি করা পছন্দ করে না?’

‘না। বলে কুলির পোলা কুলি হইস না।’

‘তোর বাপ কোথায়?’

‘এইখানে কুলিগিরি কইরত। আরেকজনরে বিয়া করি আলাদা সংসার কইরছে।’

‘তারপর?’

‘আমি এই স্টেশনে পান বেচতাম। দশদিন আগে ডালাটা চুরি হইয়া গেল। আরেকটা ডালা কিনতে ছয়শো ট্যাকা লাইগব। ব্যাগ টাইনা তিনশো ট্যাকা জোগাড় হইছে। গোপনে জমাইতাছি। ছয়শো ট্যাকা জোগাড় হইলে মায়ের হাতে দিমু। খুশি হইব মায়। আবার ডালায় কইরে পান বেচুম। কুলিগিরি করুম না তহন। লন স্যার আপনার বগি আইয়া পড়ছে। আপনার কত নম্বর স্যার?

‘একত্রিশ।’

ব্যাগটা মাথার ওপরের বাংকারে যথাস্থানে যত্ন করে রাখল আকাশ। বাদল রহমান আকাশের হাতে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট দিয়ে বললেন, ‘গোটাটা রাখ আকাশ।’

আকাশ একটু অবাক চোখে বাদল সাহেবের দিকে তাকাল। সে মুহূর্তের জন্য। তারপর পেছন ফিরল।

‘আকাশ।’ পেছন থেকে ডাকলেন বাদল রহমান। ভ্রূ তুলে তাকাল আকাশ।

‘তুই কি আমাকে একটা প্রথম আলো এনে দিতে পারবি?’ সম্মতির মাথা দোলাল আকাশ।

মানিব্যাগে খুচরো টাকা থাকা সত্ত্বেও একশ টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলেন আকাশের দিকে।

নোটটি দেখে আকাশের চোখদুটো কি চকচক করে উঠল? বুঝতে পারলেন না বাদল রহমান। ঘড়ি দেখলেন তিনটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি।

পাঁচ মিনিট যায়, সাত মিনিট যায়। পেপার নিয়ে আকাশ আসে না। বগিতে ইঞ্জিন লাগানো হলো। বগির বাতিগুলো জ্বলে উঠল। টেলিভিশনের স্ক্রিনে কী-কী সব বলা শুরু হলো। দুই-চার-ছয় করে করে যাত্রীরাও নিজ নিজ সিটে বসে পড়ল। আকাশ আসে না।

ঘড়ি দেখলেন বাদল সাহেব – তিনটা বাজতে চার মিনিট বাকি। তারপর তিন মিনিট বাকি। বাদল রহমানের মুখে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। টাকার লোভ কি আর চাট্টিখানি কথা! ওরা এরকমই…। ভাবনায় ছেদ পড়ল বাদল সাহেবের।

‘এই নেন স্যার। এইখানে পাই নাই। ওই একেবারে সিঁড়ির গোড়া থেকে আনছি। একশ টাকা ভাঙতি দিতে চায় নাই। তাই দেরি হইয়ে গেছে। দৌড়াইতে দৌড়াইতে আইছি।’ ভাঙতি টাকা আর পেপারটা বাদল রহমানের হাতে দিয়ে দ্রুত নেমে গেল আকাশ। ট্রেন তখন চলতে শুরু করেছে। r