কথায় কথায় পরিহাস

হাবিবুল্লাহ রাসেল

হরিশংকর জলদাসের কথাসাহিত্যে চরিত্র হয়ে আসে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। যেমন – কৈবর্ত, বারাঙ্গনা, মেথর, ধোপা, ব্যাধ, মুচি, কোটনা প্রভৃতি। তাঁর উপন্যাস রঙ্গশালা প্রধান চরিত্র একজন ভিক্ষুক। ভিক্ষুক বক্তা, শ্রোতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। ভিক্ষুকের বলার জাদুময়তায় দিনের পর দিন অধ্যাপক আসেন পার্কে, শিরীষ গাছের তলে, কেবল রূপময় গল্প-কাহিনি শোনার জন্য। ঢাকা শহরে ভিক্ষুকটির চল্লিশ বছর কেটে গেল, আর শিরীষ গাছের তলে জীবন কাটল বিশ বছর।

উপন্যাসটি সাজানো হয়েছে ১৪টি পর্বে। পর্বগুলো হলো  –  জন্ম, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, মৃত্যু, কুহেলিকা। এক একটি পর্ব এক একদিনের বলার বিষয়। ভিক্ষুকটি প্রতিটি শব্দের ব্যাখ্যা দিলেন ভেঙে ভেঙে অভিধানের আলোকে। আর গল্পের পর গল্প বললেন, গল্পের ভেতরে গল্প বললেন, জীবনাভিজ্ঞতার গল্প। কথায় কথায় ফুটে উঠল – সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, শিক্ষা, চিকিৎসার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসঙ্গতির রূপময় চিত্র।

ভিক্ষুকের কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারে না অধ্যাপক। ভিক্ষুকই উত্তর দেয় যুক্তি দিয়ে। আর সমাজকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সমাজের বিশৃঙ্খলা, ভুল, অপরাধগুলো। ভিক্ষুক বলে, ‘আপনারাও একধরনের মানুষ স্যার। চোর-বাটপার-খুনি-বেশ্যার কথা মনোযোগ দিয়ে পড়েন। কে কার বউ নিয়ে পালাল, কোন নায়িকা কোন নায়কের কোলে মাথা রেখে সমুদ্রে হাওয়া খেল, কোন ঋণখেলাপি কোন মডেলের গাড়ি কিনল – এসব আপনাদের চোখ এড়িয়ে যায় না। সকালে বেড-টি হাতে নিয়ে প্রতিটি অক্ষর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। কিন্তু রমা চৌধুরীদের জীবনকথা আপনাদের চোখ এড়িয়ে যায় স্যার।’

কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য মানুষের এই ছয় শত্রু বা রিপু নিয়ে কথা বলে ভিক্ষুক। এগুলো দমন করতে হলে মনের জোর বা সাধনার দরকার। ভিক্ষুক বলে, ‘চোখ বন্ধ করে, যোগাসনে বসে জপতপ করাকে সাধনা বলে না। সাধনার নাম হলো প্রচেষ্টা।’

দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলে ভিক্ষুক। প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দেয় – ‘শিক্ষা না কি জাতীর মেরুদ-! মেরুদ- তো পেছনে। পৃষ্ঠদেশে। পৃষ্ঠদেশ কী করে জাতির মেধার জায়গা হয়? শিক্ষা জাতির মস্তক নয় কেন স্যার? মানুষের মাথাই তো সারাৎসার।’

আমরা প্রধান শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তের লাঞ্ছনার কথা জানি। এই নিন্দনীয় ঘটনার পর এ-দেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন ভিক্ষুক – ‘সবাই রাস্তায় নামল – ছাত্র-শিক্ষক-জনতা। কিন্তু রাস্তায় নামা তো দূরের কথা, একটা মন্তব্যও করলেন না বুদ্ধিজীবীরা। … যাঁদের মুখের একটা লাইনের যথেষ্ট মূল্য  আছে, যাঁরা বাংলাদেশের শিক্ষা সিস্টেমটাকে আগাগোড়া পাল্টে দিতে চান, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ শ্যামলকান্তির মতো শিক্ষকের অবমাননায় উদাসীন থাকেন। কী অসাধারণ বুদ্ধিজীবী স্যার! এই ধরনের বুদ্ধিজীবীরা গাছেরটাও খান, তলারটাও কুড়ান।’

শিক্ষা পর্বে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি ফুটে উঠলেও চিকিৎসা পর্বে সেভাবে চিকিৎসাব্যবস্থার ত্রুটি ফুটে ওঠেনি। শিক্ষকরা ক্লাসের চেয়ে কোচিংয়ে বেশি মগ্ন, তা এসেছে; কিন্তু সরকারি চিকিৎসকরা হাসপাতালের নির্ধারিত সময়েও যে প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়ে পড়ে থাকেন, তা ফুটে ওঠেনি। মানুষ চিকিৎসাব্যবস্থার কাছে জিম্মি, চিকিৎসার নামে চলে টেস্ট বাণিজ্য, ক্লিনিকে চলে ডাকাতি। বড় বড় হাসপাতালও যেখানে মরণ ফাঁদ; মানুষ যাবে কোথায়! এই অরাজকতা তো উঠে আসেনি।

লোভ, মোহ মানুষকে অমানুষ করে দেয়। যুগ যুগ ধরে সমাজ পরিচালনা করে আসছে পুরুষ। পুরুষের ব্যবহার সামগ্রী হয়েছে নারী। লোভ-মোহে পড়ে অপরাধ করে পুরুষ, অপবাদ সইতে হয় নারীকে। ভিক্ষুক বলে, ‘রমণীদের লোভ নয়, রমণীলোভের কথা বলি। অহল্যার কথা বলেছি। রাবণের সীতালোভের কথা জানেন আপনি। ট্রয় নগরী যে ধ্বংস হলো স্যার, কার জন্য? অনেকে চোখ বন্ধ করে বলে ফেলে, কেন, হেলেনের জন্য? আদৌ কি হেলেনের জন্য? পেরিসের হেলেনলোভের জন্য নয় কি?’

ডাস্টবিন ধনীদের কাছে ধ্রুপদি ব্যাপার, ময়লা রাখার জায়গা যেমন, তেমন পেটের সন্তান রেখে কলঙ্ক ঢাকার জায়গাও। ভিক্ষুক বলে, ‘ভদ্রলোকের মেয়েরা কেচ্ছাকাহিনি করে, কলঙ্ক সইতে হয় বেচারা ডাস্টবিনকে।’ মানুষ ডাস্টবিনের কাছ থেকে নাক বন্ধ করে হাঁটে আবার এই ডাস্টবিনই অনাহারীদের খাদ্য জোগায়। ভিক্ষুক বলে, ‘আমাদের কাছে সেরেফ হোটেল, ডাস্টবিন হোটেল। হোটেল না হলে কি ওখানে মানুষ পাত পাতে?’

সূচনা পর্ব ‘জন্ম’ থেকে ‘মৃত্যু’ পর্যন্ত পাঠক প্রচলিত উপন্যাসের গঠন পাবেন না। প্রচলিত উপন্যাস যেমন স্থায়ী কয়েকটি চরিত্রের কাহিনি নিয়ে এগোয়, এখানে তা নয়। বক্তা বলছে, একের পর এক কথা বলে যাচ্ছে, ছোট ছোট ঘটনা। মনে হবে, এই কথা ব্যক্ত করার জন্য লেখক উপন্যাসের আশ্রয় নিলেন কেন? একটি প্রবন্ধের বই লিখলেই তো পারতেন? এই প্রশ্নের জট খুলবে শেষ পর্ব ‘কুহেলিকা’য়। ‘কুহেলিকা’য় কথকই হয়ে যাবে প্রধান চরিত্র। বিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল এই ভিক্ষুক। তারপর জীবনের ট্র্যাজেডি। সব হারিয়ে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায়। শুরু হলো ভিক্ষার জীবন। তারপর ঢাকা শহরেই কেটে গেল চল্লিশ বছর।

নিঃসন্দেহে ভিক্ষুকের জীবন কঠিন ট্র্যাজেডিপূর্ণ। তবু কেন একজন শিক্ষিত, সুস্থ মানুষ ভিক্ষার জীবন বেছে নিল? ভিক্ষুক জানায়, প্রতিশোধ নিতে সে যে ছোট মিয়াজির ছেলে শহীদুলকে খুন করেছে তা কেউ দেখেনি এবং বুঝতেও পারেনি। সবাই মনে করে বাদশা মিয়ার কাজ।

ছোট মিয়াজির সঙ্গে বাদশা মিয়ার দ্বন্দ্ব হাঙ্গামায় রূপ নেয়। তাহলে তাকে পালিয়ে আসতে হলো কেন? যদি ঢাকায়ই এলো তবে ধরা পড়ার ভয় কেন? আর এজন্য ভিক্ষার জীবন বেছে নিতে হবে? ভিক্ষুক তার যুক্তি দিয়েছে। কিন্তু সমগ্র উপন্যাসে সে যেভাবে যুক্তি দিয়ে সমাজ-রাষ্ট্রের অসঙ্গতি তুলে ধরেছে, সেখানে এই যুক্তি একেবারেই অসার।

বিদেশিরা আমাদের দেশে আসে আর আমাদের দীনতা, দারিদ্র্য, জীর্ণতাকে পুঁজি করে নিয়ে যায়। ভিক্ষুক বলে, ‘আমাদের গরিবিয়ানাতেই ওদের যত সুখ।’ ভিক্ষুকের উপলব্ধির শক্তি আছে – ভিক্ষা ত্যাগ করার শক্তি নেই। ভিক্ষুক শিক্ষায়, মেধায়, অনুভূতিতে সবল; কিন্তু কর্মে একটি দুর্বল চরিত্র।

উপন্যাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় যেমন ফুটে উঠেছে ভিক্ষুক, বেশ্যা-ভূমিদস্যু, তেমনি ফুটে উঠেছে সাহিত্যিক, অধ্যাপক, সমাজপতির রঙ্গ; কাম, ক্রোধ, লোভ, মাৎসর্যে জর্জরিত সমাজছবি। রঙ্গশালা পড়তে পড়তে পাঠকের কখনো মনে হবে অভিধান, কখনো মনে হবে ব্যাকরণ, কখনো ধর্ম, কখনো দর্শন, আবার কখনো মনে হবে ইতিহাস পড়ছেন।