কবিতার আদিগন্ত স্বপ্নভুমিতে

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

শামসুর রাহমান
কবিতার মানচিত্র

রিয়া চক্রবর্তী
বঙ্ঘীয় সাহিত্য সংসদ
কলকাতা, ২০১১
১০০ টাকা
আমাদের অবাধ্য কৈশোরে গদ্য আর পদ্যের নানা জাল যখন ঘিরে ধরার চেষ্টা করছিল চারপাশ, তখন হঠাৎই চমকে দিয়েছিল একটা কবিতার লাইন – ‘বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকান উঠানে ঝরে রোদ/ বারানদায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন…।’ তখন চিনতাম না এ-কবিতার কবিকে। তাঁর অন্য কোনো লেখারও স্পর্শ পাইনি আগে। তবু আমাদের সেই মফস্বল শহরে মাঠ পেরিয়ে সকালবেলায় স্কুলে যাওয়ার পথে আশপাশের মাটির বাড়ি আর তাদের লতায় আচ্ছন্ন চালা ছুঁয়ে যেন স্পন্দন পেতাম সেই কবির। বড়রা বলতেন, বাংলাদেশ খুব দূরে নয় এখান থেকে। দূরের প্রকান্ড বটগাছের পেছনে, আরো আরো একটু দূরে যেখানটা আর দেখা যায় না, কল্পনা করে নিয়েছিলাম – ওই বোধহয় বাংলাদেশের আকাশ। এ কবির দেখা জগৎ তাহলে আমাদের খুব কাছাকাছি! মনের গোপনে তৈরি করে নিয়েছিলাম এক নতুন দিগন্ত।
ও বয়সে যেমন হয়, ভালোলাগাটা কিছুকাল থেকে ফের বাঁক নেয় অন্য অনুষঙ্গে। তাই হলো। শুধু ওই লাইনগুলো মনের রাস্তায় যেন দাঁড়িয়ে রইল একই জায়গায়। পরে কখনো প্রয়োজনে, কখনো স্রেফ ভালোবেসে যখন শামসুর রাহমানের লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, তখন তাঁর লেখার ভেতর চলাচলটা ধরার চেষ্টা করেও ফিরতে চেয়েছি ওই কৈশোরে। মাটি, রোদ, অন্তহীন ভালোবাসা আর স্বদেশ, স্বভাষাই চিনিয়ে দিয়েছে তাঁর লেখা। সেই কৈশোরে কল্পনার যে-মানুষটিকে বুকের ভেতর বানিয়ে তুলেছিলাম, তার থেকে বাস্তবের শামসুর যে কত আলাদা, জেনেছি পরে। দেখেছি কত কষ্ট আর যন্ত্রণায় পুড়তে পুড়তে এগোতে হয়েছে তাঁকে। সাতাত্তর বছর ধরে কী অমোঘ, অনিবার্য দহন সামলে যেতে হয়েছে এই কবিকে।
অনন্যসাধারণ কবি শামসুর আর মানুষ শামসুরকে ফিরে দেখার সুযোগ এলো রিয়া চক্রবর্তীর শামসুর রাহমান : কবিতার মানচিত্র বইটি পড়ে। আশ্চর্য দক্ষতায় রিয়া এ-বইয়ে এক পূর্ণাঙ্গ শামসুরকে উপস্থিত করেছেন। শিল্প – সে কবিতা হোক বা অন্য কলা, একার্থে আত্মজৈবনিক। নিজেকেই ভেঙে ভেঙে শিল্পী গড়ে নেন তাঁর নির্মাণপথ। ভয়ংকর দহনে পুড়তে-পুড়তে জন্ম দেন এক একটি সৃষ্টির। এ-বইয়ে লেখক শামসুরের জীবনের সঙ্গে তাঁর সৃষ্টিকে মিলিয়ে দেখার আয়োজন করেছেন। শামসুরের পাঠক মাত্রই জানেন, মাতৃভাষা আর স্বদেশ তাঁর কবিতায় তৈরি করে দেয় আশ্চর্য দ্যোতনা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এবং ’৭১-পরবর্তী বাংলাদেশকেও ছুঁয়েছেন, দেখেছেন শামসুর। রিয়া লিখেছেন – ‘এই সময়, কালপ্রবাহেরই সন্তান হলেন শামসুর। তাই শহরের বুকে কৃষ্ণচূড়ার মাতম তাঁকে মনে করিয়ে দেয় চাপ চাপ রক্তের স্মৃতি। নীরবে মনের প্রান্তে এসে দাঁড়ায় সালাম, বরকতেরা। কবি দেখতে পান বাঙালির চেতনাজুড়ে জেগে থাকে ভাষা আন্দোলনে সেইসব বন্ধুর পথগুলোর ছবি, সেদিনের বিরূপ সময়কে অতিক্রম করার প্রয়াসে এগিয়ে চলা একদল অভিযাত্রীর প্রতিবিম্ব।’ (পৃ ২৯)
কবিরা তো রক্ত-মাংসের মানুষও। এ বই জানিয়ে দেয় চতুর্থ সন্তান প্রিয়তম পুত্র মতিনের অকালমৃত্যু, সাংবাদিক জীবনের ক্লান্তি কীভাবে ভাষা পায় তাঁর লেখায়। আটটি অধ্যায়ে জীবন থেকে কবিতায় শামসুরকে ধরতে চেয়েছেন লেখক। পাশাপাশি নটি অধ্যায়ে কবির নটি উল্লেখযোগ্য কবিতার নিবিড়-বিশ্লেষণী পাঠ জায়গা করে নিয়েছে, যা পাঠককে নতুন করে ভাববার সুযোগ করে দেয়।
‘শামসুরের শব্দের মধ্যে ধরা আছে এক কবির আত্মকথা, তাঁর মনন, তাঁর সমকাল, স্বদেশ, ঈশ্বর, প্রিয় মানুষের ছায়াগুলি। যে সময় গঠন করেছে শামসুরকে, তারই খন্ড খন্ড দিনলিপি ধরা আছে তাঁর কবিতার শব্দ, পঙ্ক্তি ও নীরব দূরত্বগুলোর মধ্যে।’ (পৃ ৭৫) সেই আদ্যন্ত শামসুরকে পাওয়া গেল এ-বইয়ে। ঝরঝরে গদ্য আর তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণে।
এ-বাংলায় শামসুর-চর্চার ক্ষীণ আলোটিকে নিশ্চিতভাবেই উসকে দেবে এ-বই। প্রকাশকও তাই ধন্যবাদার্হ।