কবিতা ও কবির কোনো বয়স নেই

ছিয়ানব্বই বর্ষীয়া মুকুল দাস সম্পর্কে সবচেয়ে বিস্ময়কর তথ্য এই যে, নব্বই-উত্তীর্ণ বয়সে তিনি কবিতা রচনা শুরু করেন। কবি সুকান্তের জন্মেরও এক বছর আগে জন্ম তাঁর। ১৯২৫-এ। এবং এখনো আমাদের মধ্যে রয়েছেন। বাঙালি নারীদের মধ্যে রাসসুন্দরী দাসী প্রথম আত্মজীবনী লিখে খ্যাত, রাজা রামমোহনের সমসময়ে রূপমঞ্জরী চতুষ্পাঠীতে পাঠদান করে খ্যাতময়ী, কুমিল্লার ফয়জুন্নিসা নারী হয়েও ব্যতিক্রমী ‘নবাব’ উপাধি পেয়ে নতুন ইতিহাস গড়েন, বেগম রোকেয়া নারীমুক্তিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যান মূলত মুসলমান নারীদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন ও পরিচালনা করে, বেগম সুফিয়া কামাল এ-যুগের এক অগ্রগণ্য নারী হয়ে স্বাক্ষর রাখেন সারস্বত অঙ্গনে ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রের ব্যাধি নিরসনে। কবি মুকুল দাস তাঁর এই প্রবীণ বয়সের অর্ঘ্য নিয়ে কি এঁদের আসরে তাঁর বিনীত আসন গ্রহণ করতে পারেন না?

নব্বই বছর বয়সে কাব্যদেবী তাঁর হাতে ধরা দিয়েছেন বটে, তবে তার কিন্তু নেপথ্যবিধান ছিল সুদূরে। মুকুল দাস জন্মেছিলেন অবিভক্ত ভারতের ময়মনসিংহ জেলায়। পিতা অত্যন্ত উদারমনা ছিলেন বলে তাঁকে ভর্তি করে দেন নগরবাড়ি গার্লস হাই স্কুলে। সেখানে নবম মান পর্যন্ত তাঁর পড়াশোনা এবং তারপর টাঙ্গাইলের পাড়াস্থিত বীরেন্দ্র মোহন দাসের সঙ্গে তাঁর বিবাহ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর হয়নি তাঁর; কিন্তু আকৈশোর তিনি গ্রন্থপ্রিয়। তাঁর গ্রন্থ পাঠ, ছবি আঁকা, নানান শৈল্পিক কাজে তাঁর স্বামীর সমর্থন ছিল।

দেশভাগের ফলে তাঁরা কোচবিহারে চলে আসেন। যথারীতি অন্য বহু বাস্তুচ্যুতের মতো তাঁদেরও শুরু হয় সংগ্রামী জীবন। একে একে আট সন্তানের মা হন মুকুল এবং প্রত্যেকেই আজ (এক পুত্র মৃত) নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। কোনো মেয়ে ডাক্তার, কোনো ছেলে অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, আমলা। সংসার যাপনের বাইরে বই পড়া, ডায়েরি লেখা, বিভিন্ন সামাজিক বিষয়ে প্রবন্ধ রচনাতে তাঁর যাপিত হয় বছরের পর বছর। স্বামী বহুদিন গত। এখন বাস করছেন শিলিগুড়িতে তাঁর অন্যতর কৃতী পুত্র কবি ও বিজ্ঞানী নির্মলেন্দু দাসের বাড়িতে। নিয়ত পড়া চলে, লেখা চলে। এই করে তাঁর দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমটি গোপাগৃহে মুকুল ধরেছে জ্যোৎস্নাধারায় তাঁর ৯০-৯১ বছর বয়সের কবিতা নিয়ে প্রকাশিত। আমাদের আলোচ্য কাব্যগ্রন্থ মনে রেখোর কবিতাগুলো তাঁর ৯১-৯৩ বয়সের ফসল। দেখা যাক কেমন মুকুলিত সেগুলো।

বইয়ের প্রতি ভালোবাসা ব্যক্ত হয়েছে তাঁর ‘বইয়ের জন্য আকুতি’ কবিতায়, ‘বাবা বলে…/ বিয়েতে যা দিয়েছি ধনদৌলত, ওসব কিছু নয়,/ বই হল আসল সম্পদ, আসল পরিচয়।’ তাঁর কবিতায় ফুটে ওঠে তাঁর দেশকাল আর চারপাশের প্রকৃতি, কখনো আবার পারিবারিক ছবি। প্রবীণা এই কবি একালকে দেখছেন খানিক তির্যক চোখে, একালের স্বামী-স্ত্রী তাই কবির চোখে এভাবে ধরা পড়ে, ‘ঘরে বাইরে দুজনেই চাকরি করে/ বাড়ি এসে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।/ ভাষা নাই শ্রদ্ধা নাই চায় না গুরুজন/ এই হল আধুনিক জীবন।’ (‘পুরান বনাম বর্তমান’)

উত্তরবঙ্গের ভূপ্রকৃতির সঙ্গে বাস করতে হয়েছে, হচ্ছে তাঁকে দীর্ঘদিন। উত্তর বাংলার বন্যা যেমন দেখেছেন, তেমনি দেখেছেন তার বিচিত্র ভূপ্রকৃতি। ‘পাহাড়ের পরিবেশ’ কবিতায় তিনি লিখছেন, ‘এখানে একবেলা সূর্যদেবের হাসা,/ আবার অন্যবেলা বরুণ দেবের কাঁদা।/ … সন্ধ্যা হলো আঁধার এলো।/ জোনাকিরা খোলে নয়ন।’ এই শেষ পঙ্ক্তির চিত্রকল্প অপূর্ব কবিকৃতি হয়ে দেখা দেয়। আবার প্রকৃতির ভীষণতাকেও তিনি ছুঁয়েছেন ‘বন্যার তাণ্ডব’ কবিতায়, ‘পল্লীবধূর উনুন জ্বলে না,/ জলেভেজা পাট পাতা,/ চালা-ঘর

ডুবু-ডুবু,/ নৃত্য করে তরু বৃক্ষলতা।/ সাপ, মাছ, ব্যাঙ হাঁসেরা উল্লাসে মাতে।’

একালে চিঠি লেখা এক বিলুপ্ত-হতে-বসা শিল্প। এ নিয়ে নস্টালজিয়া কবির। ‘পিওন ও চিঠি’ কবিতাটি বেদনারসসিক্ত। তাঁর অন্য এক কবিতা ‘সেই সোনালী দিনগুলো হারিয়ে গেছে’তেও দেখি ‘হাতে লাঠি কাঁধে ঝোলাব্যাগ’ নিয়ে পিওনের অতীত-ছবি, যা এখন আর বিশেষ দেখা যায় না। কবির আক্ষেপ, পিয়নের স্থান নিয়েছে আজ মোবাইল। তবে ব্যক্তিগতভাবে কবি কিন্তু প্রায়শ মোবাইল ব্যবহার করেন, জানা আছে আমাদের। কখনো মোবাইলে কথা কন তিনি আমেরিকায় গবেষণারত নাতনির সঙ্গে, কখনো কলকাতায় মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে। তবে মোবাইল, ইন্টারনেট, কম্পিউটার, এসি মেশিন নিয়ে অস্বস্তি ব্যক্ত করেন তিনি তাঁর কবিতায়। আবার ভারতে ডিমনিটাইজেশন নিয়েও ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন তিনি একটি কবিতায়।

তাঁর কবিতায় ঘুরেফিরে বারবার রাধাকৃষ্ণের প্রসঙ্গ আসে। তাঁর  এ-জাতীয় কবিতাগুলো হলো – ১. ‘আবির রঙে মাখামাখি’, ২. ‘দেখা হবে কোন জনমে’, ৩. ‘কোমল কঠিন প্রেমের দোলা’ এবং ৪. ‘রাধার আকুলিত প্রেমগান’। কবিতাগুলিতে এক মেদুর আবহ, তদ্গত ভাব, বৈষ্ণবী বিনয় আর কখনো কখনো তাঁর আত্মনিবেদন লক্ষ করা যায়। মুকুল দাস যে এক ভক্ত কবি এবং তাঁর ভক্তি যে শ্রীকৃষ্ণ, বোঝা যাবে কবিতাগুলো পড়লে। শ্রীকৃষ্ণের অনুষঙ্গে রাধা তো বটেই, এসেছে সুবল, কৃষ্ণের সখীগণ, শ্রীদাম। চারটি কবিতায় তিনি শ্রীকৃষ্ণেরই একাধিক নামের সার্থক ব্যবহার করেছেন, – বনমালী, শ্যামরায়, ত্রিভঙ্গমুরারি, নন্দের বেটা, কানাই। আছে কামে, বাঁশি, যমুনা। আছে রাইকিশোরী। একটি কবিতায় কার্তিকী পূর্ণিমার উল্লেখ বড় শিল্পিত। দিনটি আসলে রাস উৎসবের। এখানেও মরমি  চিত্রকল্প রয়েছে একটি, ‘কামের পাতা পড়ে যমুনার অঙ্গে।’ পাঠক মুগ্ধ না হয়ে পারে না।

এরকম আরো কিছু অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তি আছে তাঁর। যেমন, ‘আকাশ পরেছে ধূসর রঙের নীলাভ বস্ত্র’ (‘সন্ধ্যার নিস্তব্ধতা’), কিংবা ‘ওপারে পাহাড় পথে চলে সারি সারি গাড়ি/ দেখে যেন মনে হয় দেশলাইয়ের বাক্স/ … ফুল রাতভর থাকে মায়ের বুকে’ (‘সূর্য না করে সময়কে অবহেলা’)। একটি কবিতায় তাঁর আশাবাদ স্পষ্ট, (‘মাটি ও গাছ’), ‘মরবো না কিছুতেই … যদি মাটির সাথে নুয়ে পড়ি,/ আস্তে আস্তে বাঁচতে পারি ঐ মাটি ধরে।’ অন্য কবিতা ‘বয়সকালের ঠান্ডা’। সেখানে তাঁর স্ব-উপলব্ধি, ‘আমি একজন

৯৪-এর বুড়ি/ ঠোঁটে আঠার মত কথা আটকে থাকে, কি করি?’ আছে মাতৃভাষা নিয়ে বক্তব্য ‘মিষ্টি মধুর বাংলা ভাষা’ কবিতায়, ‘এই ভাষায় রাজা রবি, মন্ত্রী নজরুল/ আছে সাথে সুকান্ত, জীবনানন্দ, অতুল/ সেকাল একালের কবিরা সব ওদের সেনাপতি।’

অন্যদিকে ‘বিড়ালতপস্বী’ কবিতাটি হাস্যরসের।

অবশেষে গাঢ় সমাচার তাঁর, ‘আমার দেশ’ কবিতায়, ‘যে দেশে জন্মেছিলাম … সেটাই আমার দেশ/ স্বাধীনতাযুদ্ধে তাড়া খেয়ে এলাম বিদেশ/ এখন এটাই আমার দেশ।’ বড় শীতার্ত

শব-ব্যবচ্ছেদ। যে দেশে জন্ম তাঁর, ‘ঘরে থাকত হাঁসের ডিম, দুধ, দই, ঘি/ যারা দেখে নাই, তারা বুঝবে কি? … / বেড়া ভেঙ্গে ভেঙ্গে গরু নিত বাঘে,/ সেই বাঘ দেখেছি নিজের চোখে।’ আর এখন যেখানে তাঁর দেশ, সেখানে ‘ভীত দুর্গা’, কেননা ‘মায়ের হাতের ত্রিশূল থাকে ছুরির মত, দেখে না শয়তানকে,/ … দুর্গার বিপদের নেই শেষ,/ ফাঁকা ময়দান পেলে দানব ধরে যুদ্ধের বেশ।’

ড. আনিসুজ্জামান ২০১৫-তে পশ্চিমবঙ্গের দিনহাটায় (জেলা কোচবিহার) আন্তর্জাতিক সাহিত্য সভায় যোগ দেওয়ার পথে কয়েক ঘণ্টার জন্য কবি মুকুল দাসের বাড়ির আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তিনি কবির সঙ্গে কথোপকথনে মুগ্ধ হন। পরে ই-মেইলে তাঁকে তাঁর মুগ্ধতার কথা এইভাবে ব্যক্ত করেন, ‘আপনার শুভেচ্ছা আমার পক্ষে আশীর্বাদস্বরূপ। আপনি যে উদার বাণী শুনিয়েছেন, তা যদি সকলের অন্তরে স্থান পেতো, তাহলে পৃথিবী অনেক সুখের স্থান হত। আপনি সুস্থ থাকুন, আপনার মন সর্বদা প্রসন্ন থাকুক, এই প্রার্থনা।’

কাব্যগ্রন্থটি কবি তাঁর প্রয়াত স্বামী বীরেন্দ্র মোহন দাসকে উৎসর্গ করেছেন।