কবিতা কোথায়

প্রশ্নটা এই

কবিতা কোথায়

উত্তরে বলা যায়

যে যেখানে পায়।

আপনারা এই স্মারক বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে আমাকে সম্মানিত করেছেন। আমি  সে-সম্মান মাথা পেতে নিচ্ছি। অনেকেই এরকম প্রসঙ্গে নিজের অযোগ্যতার কথা তুলে কিছু বিনয়ের কথা বলেন। আমার ক্ষেত্রে সে-অযোগ্যতার প্রশ্ন তো আছেই, কিন্তু আমি আপাতত সে-প্রসঙ্গে কোনো কথা বলব না। কেননা, বিনয়বোধের চেয়েও এই মুহূর্তে আমার মধ্যে আরো জোরালোভাবে কাজ করছে এক অপরাধবোধ। আজ যাঁর স্মরণে আমাকে কথা বলতে হচ্ছে, তিনি বয়সে আক্ষরিক অর্থেই আমার সমত্মানতুল্য। সুবীর যে-বয়সে চলে গেছেন সে তো কারো যাবার বয়স নয়। কিন্তু তবু মানুষ যায়। আমাদের মতো যারা তার পরেও থেকে যায় তাদের এই বোধ থেকে সহজে মুক্তি জোটে না। আমরা যেন অন্যায়ভাবে থেকে যাচ্ছি, এই এক বোধ আমাদের তাড়া করে। এই আলো, এই অন্ধকার, এই রোদ, এই রাত্রি, এসবই তো তাদেরও ছিল। তবু এসবে আজ তাদের হয়তো-বা অংশ নেই। আমরা কি তাদের সামগ্রীতে অন্যায়ভাবে ভাগ নিচ্ছি? অন্তত তাদের সঙ্গে ভাগ করে তো নিচ্ছি না। জানি না কিছুই। হয়তো তারা আরো আলো পাচ্ছে, তাদের অন্ধকার হয়তো আরো নিবিড়, তাদের রোদ ও রাত্রি হয়তো আমাদের এই দরিদ্র পৃথিবীর মতো ক্লিন্ন নয়। এইরকম কোনো কোনো ভাবনা থেকে হয়তো আমরা নিজেদের সান্তবনা খুঁজি, হয়তো আমাদের অপরাধবোধের গস্নলানি মোচন করি। আছে, এসবই আছে, কী আর করা যাবে। এসব নিয়েই আমাদের চলতে হয়, চলতে হবে।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হয়েছে ছত্রিশ বছর হলো। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির চারিদিকে নানারকম দুর্নিমিত্ত দেখতে থাকলেন। কাঁকরবালির ঝড় বইছে চারিদিকে। পাখিরা দক্ষিণাবর্তে আকাশ পরিক্রমা করছে। স্রোতবিহীন নদীসমূহে জলধারা স্তব্ধ। দিকচক্রবাল তুষারকণায় সমাচ্ছন্ন। অগ্নিবর্ষী উল্কাপাতে আসন্ন মৃত্যুর সংকেত। সূর্যালোক ধুলোবালিতে নিষ্প্রভ, তদুপরি সূর্যম-লে বিচিত্রদর্শন কবন্ধের সমাহার। চন্দ্রম-ল শ্যাম, অরুণ ও ধূসর ত্রিবর্ণরঞ্জিত, অতি ভয়ানক দর্শন। ধর্মরাজ উদ্‌বিগ্ন।

বোঝাই যাচ্ছে মৌষলপর্বের এই দুর্লক্ষণে আজ চতুর্দিক পরিব্যাপ্ত। এখন সর্বব্যাপী মৃত্যু ও অবসানের জন্য প্রস্ত্ততির পালা। অশালীন বিশৃঙ্খলা ও নৈতিক অধঃপতন। মহর্ষি বিশ্বামিত্র, কণ্ব ও তপোধন দেবর্ষি নারদ ইতোমধ্যে প্রতারিত। বভ্রম্নপত্নীর ছদ্মবেশে শাম্বর পুত্রকামনা তাঁদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। মহর্ষির অভিশাপ বর্ষিত হলো : বৃষ্ণি ও অন্ধক বংশ বিনাশের জন্য বাসুদেব তনয় শাম্ব লোহার মুষল প্রসব করবে। ওই মুষল-প্রভাবে কৃষ্ণ ও বলদেব ছাড়া যদুবংশের আর সবাই এককালে উৎসন্নে যাবে। কালের প্রভাবে বলদেব যোগবলে কলেবর পরিত্যাগ করে সমুদ্রে প্রবিষ্ট হবেন আর জনার্দন কৃষ্ণ মাটিতে শোয়া অবস্থায় জরা নামে ব্যাধের তীরবিদ্ধ হয়ে ইহলোক ত্যাগ করবেন। এই জন্মের অবসান।

ক্রমে ক্রমে ধ্বংসসূচক উপদ্রব যাদবপুরের ঘরে ঘরে পরিলক্ষিত হতে থাকল। এক পিঙ্গলবর্ণ মু–তমস্তক বিকটাকার কালপুরুষ ক্ষণে ক্ষণে দেখা দেন আবার মিলিয়ে যান। অসংখ্য শরনিক্ষেপেও তিনি বিদ্ধ হন না। ওই সময়ে একদা ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা এই ত্রিতিথির সংযোগ হলো। বাসুদেব এই সংযোগকে নিতান্ত দুর্লক্ষণ বিবেচনা করে বৃষ্ণিগণের উদ্দেশে সাবধানবাণী উচ্চারণ করলেন। ভারত-যুদ্ধের সময়ে রাহু এমন একবার দিনের বেলায় দিবাকরকে গ্রাস করেছিলেন, আজ আমাদের ক্ষয়ের নিমিত্ত সেরকম অবসানের দিন সমুপস্থিত। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অবসানে পুত্রশোকে কাতর গান্ধারীর অভিশাপের কথা আজ ছত্রিশ বছর বাদে বাসুদেবের মনে এলো। এই ধ্বংস অনিবার্য। যদুপতি শান্তচিত্তে সবকিছু মেনে নিয়ে বার্ষ্ণেয়দের প্রভাসতীর্থে যাত্রা করতে আদেশ করলেন।

কবিতা কোথায়। যে যেখানে পায়। সবাই জানেন এই প্রভাসে কবিতা খুঁজে পেয়েছিলেন নবীনচন্দ্র সেন। এ-নাম আমরা হয়তো এখন প্রায় ভুলতে বসেছি। অন্তত কবিতার সন্ধানে বেরিয়ে ওঁর দরজায় খুব কড়া নাড়ি না আমরা এখন। কিন্তু তিনি একদিন রৈবতক – কুরুক্ষেত্র – প্রভাস এই ট্রিলজি রচনা করেছিলেন। নবীনচন্দ্রের ভাষায় ‘রৈবতক কাব্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদিলীলা, কুরুক্ষেত্র কাব্য মধ্যলীলা, এবং প্রভাস কাব্য অন্তিমলীলা লইয়া রচিত।’ রৈবতক কাব্যের উন্মেষ, কুরুক্ষেত্রে বিকাশ, এবং প্রভাস শেষ। বোঝাই যাচ্ছে প্রভাস অবসানের কাব্য। ছায়াপাতে এই কাব্যের শুরু। তারপর একটা একটা করে সর্গ পেরিয়ে সপ্তম সর্গে এসে ‘লীলা শেষ’। এই সর্গে

প্রভাস উৎসবক্ষেত্র শবক্ষেত্র এবে

যাদবের, প্রভাসের মহা পারাবার

এবে হায়! যাদবের শোক পারাবার!

এই সর্গের এই অন্তিম পর্বে ‘লীলা শেষ’ এই বাক্যবন্ধ একেবারে ধ্রম্নবপদের মতো কাজ করে। হরির শান্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হয় :

‘‘… ধরাতলে ধর্মরাজ্য হয়েছে স্থাপিত।

যুগ শেষ!  –  লীলা শেষ’’  –

উঠিল কাঁপিয়া

ধরাতল। ‘‘লীলা শেষ’’ –  উঠিল গর্জ্জিয়া

মহাসিন্ধু। ‘‘লীলা শেষ’’  –  হইল অঙ্কিত

সুনীল আকাশপটে অরুণ আভায়

সুশীতল সমুজ্জ্বল। লভিয়া উদ্ধার

‘‘লীলা শেষ’’ মহাকণ্ঠে গাহিল মানব।

‘‘লীলা শেষ’’  –  দুষ্কৃতের ভীষণ শ্মশান

মহাকণ্ঠে কুরুক্ষেত্র, গাহিল প্রভাস।

‘‘লীলা শেষ’’  –  পাদপদ্মে হইয়া মূর্চ্ছিত

পড়িল দারুক শোকে। ‘লীলা শেষ’  –  শৈল

পড়িতে মূর্চ্ছিতা পদে লইলেন হরি

আপন ত্রিদিব বক্ষে, – পূর্ণ শৈলজার

তপস্যা, জীবনব্রত কোমল কঠোর।

কবিতা কোথায়। ‘লীলা শেষ’ এই ধ্রম্নবপদে নবীনচন্দ্র কবিতা খুঁজে পাচ্ছেন এখানে, প্রভাস কাব্যের এই সপ্তম সর্গে। আমরা আরো একটু এগোব। ‘লীলা শেষে’র কবিতা ফুরোয়নি এখনো। এর ঠিক পরেই মহাপ্রস্থান। যাঁরা ধ্বংসপ্রাপ্ত তাঁরা নেই, যাঁরা বিনষ্ট তাঁরাও নেই। কিন্তু তারও পরে থেকেও যান যাঁরা, তাঁরা তো আছেন, তাঁদের থাকতেই হয়। বাসুদেবের পরেও থেকে যান বসুদেব, থেকে যান সত্যভামা, রুক্মিণী আর আরো অনেকে। আর আছেন দ্রষ্টা কবি ব্যাস।

রৈবতক যোগশৃঙ্গে, বিটপি-ছায়ায়,

বসিয়া মহর্ষি ব্যাস অজিন আসনে।                                                                    (দ্বাদশ সর্গ, কর্ম্মফল)

আছেন হৃতবল অর্জুন। ব্যাসদেবের উপদেশ আজ তাঁর প্রার্থনীয়। ব্যাস। গা-ীবীর পরাভব, যাদবী হরণ –

সকলি তাঁহার লীলা! মহিমাপূরিত

দুই ভাবী ইতিহাস, পার্থ! নিরুপম

এই দুই ঘটনায় হয়েছে সূচিত।

যাদবী হরণে আশু হইয়া মিশ্রিত

রক্ত আর্য্য অনার্য্যের, ব্যাপিয়া ভারত

কিছুদিন পরে হবে কি শান্তি স্থাপিত

ধর্ম্মরাজ্য ছায়াতলে! আলোকি জগৎ

দর্শনের বিজ্ঞানের নক্ষত্র অমর

শান্তির আকাশে কত উঠিবে ভাসিয়া!

শিল্প বাণিজ্যের কুঞ্জে পিক মধুকর

সাহিত্যের সঙ্গীতের, উঠিবে গাহিয়া।

আর্য্য অনার্য্যের রক্ত হইয়া মিশ্রিত

কত নব জাতি, কত সাম্রাজ্য মহান

করিবে সৃজন পার্থ! যুগ যুগান্তর!

ভারতের মরুস্থান হবে রাজস্থান!

(দ্বা.স., কর্ম্মফল)

 

রক্তশুদ্ধির ব্রতে আমরা আজ যে-তীব্রতায় নিবেদিত ব্যাসদেবের ধ্যানদৃষ্টিতে অর্জুন সে-বার্তা পাননি। ব্যাসদেব ভেবেছিলেন      আর্য-অনার্যের মিশ্রিত রক্তে ভারত একদিন সমৃদ্ধ হবে। এবারের মতো লীলা শেষ।

গা-ীবীর গা-ীবের নাহি কার্য্য আর

এ ভারতে; নাহি কার্য্য ভারতে আমার!

আমরা সলিল-বিম্ব যে মহালীলার,

সেই লীলা শেষ, বিম্ব কি করিবে আর!

এ আশ্রম সিন্ধু-গর্ভে হবে নিমজ্জিত;

হিমাচলে মহাধ্যানে হব নিমগন।

রাখি বজ্রে ইন্দ্রপ্রস্থে, রাখি পরীক্ষিৎ

হসিত্মনায়, কর মহাপ্রস্থান এখন

পঞ্চ ভ্রাতা, সহ ভোজ অন্ধক কুক্কুর –

হত-শেষ যদুকুল।

এখানে এখন সব অবসান। ব্যাসবাক্যেই ইঙ্গিত আছে এর পরে ‘লোহিত সাগর’, ‘বন্ধুর মরু’ ও ‘লবণ সিন্ধু’র। এখন থাক।

এ-ইঙ্গিতের কথা অন্য সময়ে।

আপাতত এই ব্যাসদেবের আশ্রমেই খুঁজে পাওয়া আর এক কবিতা। অনুজ কবির হাতে। বুদ্ধদেব বসুর ‘কালসন্ধ্যা’। তাঁর আশ্রমে ব্যাসদেব ভূর্জপত্র ও লেখনী নিয়ে গ্রন্থরচনায় রত। শস্নথ চরণে গা-ীবধারীর প্রবেশ। এখন সব শেষ। শৌর্যবীর্যের সীমা পেরিয়ে এসেছি আমরা। অর্জুনের ভাষাও এখন ক্লান্ত।

 

পিতামহ, ব্যাসদেব,

আমার প্রণাম নিন।

আমি পার্থ, স্বনামের অযোগ্য যদিও আজ,

অকৃতার্থ ও ক্ষমাভিক্ষু

 

এত পরিতাপ কেন, ব্যাসের এই স্বাভাবিক প্রশ্নের উত্তরে অর্জুন একটা লম্বা বক্তৃতা করেন। আজ তার বর্ণে বর্ণে বিষাদের সুর। অবিরাম অপারগতার কথা। নিজেকে আজ তার মনে হয় জীবন্মৃত। তার বর্তমান অসামর্থ্যের কথায় মৃত্যু মনে হয় ‘শত গুণে বরণীয়’। সে জানে তার ক্লীবত্ব আজ অচিকিৎস্য। কিন্তু যে-অর্জুনকে সে তার ‘আমি’ বলে জেনে এসেছে এতকাল সে

ছিলো স্বাধীন, বিচিত্রগতি, ভ্রাম্যমাণ,

বনবাসী, ব্রহ্মচারী, তীর্থপর্যটক,

শত্রম্নর সংহারকর্তা, নারীর প্রেমিক।

 

অর্জুনের ব্যর্থতাবোধের গস্নলানি আজ তাকে আচ্ছন্ন করেছে। তার উত্তরে ব্যাসদেব তাকে কোনো সান্তবনার বাণী শোনাননি। কোনো অলীক স্বপ্নকথায় তাকে মোহাবিষ্ট করে তুলতে চাননি। তিনি তাকে শুনিয়েছেন জীবনের কিছু গূঢ় বার্তা।

 

পার্থ, তুমি দূষ্য নও, শস্নাঘ্য নও।

তুমি জয় করোনি অলোকজাতা

দ্রৌপদীকে, কুরুক্ষেত্রে সংহার করোনি শত্রম্ন।

সব দেবতার দান।

 

অর্জুন নামে মাত্র অর্জুন। কিছুই করেননি তিনি। প্রকৃত অর্থে তিনি নিমিত্ত মাত্র। আমরা যে করি বলে মনে করি তা কোনো প্রকৃত অর্থে আমরা করি কি? না কি পূর্বোলেস্নখিত কোনো চিত্রনাট্যে আমরা শুধু কিছুক্ষণের জন্য অভিনয় করে যাই কেবল। All the world’s a stage. মহাকবি হয়তো গীতার বাণীতে ভাবেননি কথাটা, তিনি হয়তো ভেবেছিলেন মঞ্চেরই রূপকল্পে। এই তো মাত্র এক সন্ধ্যার দু-আড়াই ঘণ্টা সময়, তার পরেই মোহভঙ্গের পালা। মদনের বরেও না-হয় বড়োজোর এক বছরের মোহ আবরণ। সেই বা কালখ–র বিচারে আর কতটুকু। চিত্রাঙ্গদার সে কী তীব্র দহনজ্বালা। বৎসরশেষে নিরাবরণ সত্যের মুখোমুখি হওয়ার কঠিন ব্রতের পথে আসতেই হয় তাকে। অর্জুনকে সেই কঠিন শিক্ষাই দিচ্ছেন ‘সকলের সমানবয়সী’ ব্যাসদেব। অর্জুন হয়তো কখনো হবেন না প্রাজ্ঞ।

তবু শেখো

অন্তত বিনয়, দৈন্য, আত্মসমর্পণ।

শেখোঃ

অনাচার, সদাচার, ধর্মাধর্ম, সব আপতিক।

যা-কিছু সময়োচিত তা-ই যথাযথ।

শেখোঃ

অসামান্য প্রতিভাও দ-নীয়, বিনামূল্যে লভ্য কিছু নেই,

সব দান ছদ্মবেশী ঋণ।

শেখোঃ

কাল সেই গর্ভ, বীজ, ধাত্রী ও শ্মশান,

 

কাল, অর্থাৎ সময়। এই সময়ের কথায় কবিতা খুঁজে পাওয়া যায় বাইবেলের একলেসিয়াস্টিস পর্বেও। সেখানেও আছে অবসানের কথা, ফিরিয়ে দেবার কথা। সবকিছুরই সময় আছে নির্ধারিত।

 

আলিঙ্গনের সময়, আবার সে-আশেস্নষ

মুক্ত করারও সময়।

কখনো খোঁজার সময়, আবার কখনো সে খোঁজা

ছেড়ে দেবারও সময়, হারিয়েই গেছে

মেনে নিতে হয়। সব জমিয়ে রাখার সময়,

আবার দু-হাত খালি করে

শূন্য করে দেবারও সময়।

 

এই যে সবকিছুর নির্দিষ্ট সময় আছে, সময় আছে নির্ধারিত, এই সরল কথাটা আমরা মেনে নিতে পারি না সহজে। মেনে নিতে কষ্ট হয় আমাদের। সংসারী মানুষের ক্ষেত্রে তাকেই হয়তো বলে মায়ার বাঁধন। অর্জুনের মন বীরত্বের মন, একটু কি বেশি সংসারী। তাই কি প্রপিতামহকে উপদেশ দিতে হচ্ছে স্পষ্ট ভাষায় …

ভুলে যাও বীরত্ব, যুদ্ধ ও জয়। এ মুহূর্তে

আছেন হৃতাবশিষ্ট মহিলারা –

সুভদ্রা, রুক্সিণী, সত্যভামা,

বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, শিশুগণ।

তাঁদের স্থাপন করো অভিপ্রেত রাজ্যে বা আশ্রমে

হোন পরীক্ষিৎ রাজা হসিত্মনায়।

তারপর পঞ্চভ্রাতা তোমরা বেরিয়ে পড়ো

পাঞ্চালীকে সঙ্গে নিয়ে। প্রস্থান সুন্দর হোক তোমাদের।

ব্যাসের এই নিরাসক্ত প্রসন্নতা। কালে কালে কবিদের টানছে। টেনেছে নবীনচন্দ্র ও বুদ্ধদেব বসুকে। নিশ্চয়ই এক টানে টানেনি। আর নিরাসক্ত জীবনসত্য জিনিস হিসেবে অবশ্যই আলাদা। কিন্তু তার চেয়েও বেশি আলাদা কবিতা হিসেবে। নবীনচন্দ্র ও বুদ্ধদেব তাঁদের কবিতা পেয়েছেন হয়তো একই জায়গায়। রহস্য এই যে, একই জায়গায় খুঁজে পেলেন যে-কবিতা সে-কবিতা জাদুবলে যেন আলাদা হয়ে গেল, যিনি পেলেন তাঁর হাতের স্পর্শে। তাঁর ভাষাস্পর্শে। এই যে ভাষার কথা তুলছি তা কি শুধুই নবীনচন্দ্রের ভাষা বা বুদ্ধদেব বসুর ভাষা। আমি বলতে চাই যে-ভাষাস্পর্শে কবিতা বদলে যাচ্ছে যিনি খুঁজে পাচ্ছেন তাঁর হাতের জাদুতে       সে-ভাষা কি শুধু সেই কবির ব্যক্তিভাষা। কবিদের এই ভাষায় আছে একটা কালেরও মাত্রা। অর্থাৎ আমরা সবাই কালের সমত্মানও যেমন, তেমনি আমরা কালবেষ্টিতও বটে। আমরা এক নিহিত অর্থে কথা বলি কালেরই ভাষায়। আমরা যে যে-কালের মানুষ সে সেই কালের ছাপ বহন করে চলি আমাদের চলনে-বলনে ও পোশাক-পরিচ্ছদে। তেমনি আমরা সেই ছাপ বয়ে চলি আমাদের ভাষাতেও। নবীনচন্দ্র ও বুদ্ধদেবের ভাষায় সেই ছাপ এতই স্পষ্ট যে, তা আলাদা করে বিশেস্নষণ করে বুঝে নেবারও তেমন দরকার পড়ে না।

কিন্তু ভাষার এই কালের মাত্রাই সবটুকু বলে না। বা শুধু সেটুকুতেই কবিতার সবটুকু চলে না। কবিতার ভাষার আছে একটা ব্যক্তিমাত্রাও। তা না হলে একই কালের দুই কবি যখন একই জায়গায় তাঁদের কবিতা খুঁজে পান কেন সেই কবিতা তখন দুই ভিন্ন জগতের কথা বলে বা বলতে পারে। কেন-র চেয়েও প্রশ্ন বোধহয় কেমন করে। বড় রহস্য আছে এই ভাষার মধ্যে। শেষমেশ ভাষা তো একটা কোড বই আর কিছু নয়। অর্থাৎ বিভিন্ন সংকেতচিহ্ন দিয়ে তৈরি একটা সংকেততন্ত্র মাত্র। মুখের ভাষার কথা যদি ভাবি, তাহলে গলা দিয়ে যেসব আওয়াজ বেরোয় তারা মিলেমিশে, এর সঙ্গে সে জোড় বেঁধে বেঁধে একটা গোটা তন্ত্র তৈরি করে। তাকেই আমরা ভাষা বলে থাকি। সেই ভাষা দিয়েই আমরা আমাদের মনের কথা আর একজনের মনে পৌঁছে দিতে পারি। শুধুই মনের কথা পৌঁছে দিই তাই নয়। মনের ভাবও এক জনের থেকে আর এক জনের দিকে সঞ্চারিত হয়। সেই সঞ্চারের অনেক কলাকৌশল। ওই গলার স্বরেই যেমন ওঠানামা আছে, ধীর উদাত্ত এসব নানা রকম আছে, তেমনি আছে ধ্বনিতন্ত্রেরও নানা রকমফের। সেসবের ছাপ পড়ে ভাষায় উচ্চারিত শব্দের গায়ে। সমাজ সমবায়ে দিন দিন সেসব শব্দের গায়ে অর্থের রস জমে। ভাব প্রকাশের দিক থেকে তখন আরো অনেক দরজা খুলে যায়। শব্দার্থের নানা যোগ-বিয়োগ, কমানো-বাড়ানো এসবের মধ্য দিয়ে আমরা গড়ে তুলি ভাষার এক একটা স্তর। হামেশাই দেখা যায় যে, কোনো একটা ভাষায় আমরা সেই ভাষা অঞ্চলের মধ্যেও কথাবার্তা চালাচালি করছি নানা স্তরে। সামাজিক মানুষের সমাজ চরিত্রভেদের জন্য গোষ্ঠীভেদ তৈরি হয়। এক কথায় গোষ্ঠীভুক্ত মানুষের জীবনযাপনে এক ধরনের একটা সমতা থাকে। নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর মধ্যেকার মানুষ যখন পারস্পরিক কথাবার্তা বলে, তখন তারা কথা বলে এক নির্দিষ্ট ধরনে। অন্য গোষ্ঠীর ধরনের সঙ্গে তার কিছু ভেদ থাকতেই পারে। এই ভেদ হতে পারে ব্যবহৃত ধ্বনিতন্ত্রে, ব্যবহৃত শব্দের প্রয়োগে, হয়তো-বা আরো অন্যান্য নানা পরতে। বৃহদর্থে একই ভাষা অঞ্চলের মধ্যে এই যে নানা বৈচিত্র্য, একে আমরা বলতে পারি ভাষা প্রয়োগের নানা স্তর। এই স্তরভেদে নানা সূক্ষ্মতা। আসলে সমাজ-সংস্কৃতি, মন মেজাজ, ও রুচি শিক্ষার অনেক কিছুই ধরা পড়ে ওই ব্যবহৃত ভাষাস্তরে, কখনো-বা শুধু ধ্বনিতন্ত্রে, কখনো-বা উচ্চারণভঙ্গিতে। জীবনেরই অনেকটা ছায়া যেহেতু ধরা থাকে ভাষান্তরে তাই কবিরাও এই স্তরভেদ ব্যবহার করে থাকেন তাকমতো। মহাভারতের জীবনের যে ছন্নছাড়া পর্ব নিয়ে অবসানের কবিতা লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু, সেই পর্বে শ্রীহীনতার কবিতা খুঁজে পাচ্ছেন আমাদের কালের কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত। কৃষ্ণ, বলরাম, দ্রৌপদী ও সুভদ্রা, এই পাত্রপাত্রীদের নিয়ে প্রণবেন্দু সাজিয়েছেন তাঁর কাব্যনাটক সুভদ্রা। এই নাটকের ঘটনা ঘটে দ্বারকা ও ইন্দ্রপ্রস্থে। আমি অন্যত্র এইসব লেখা নিয়ে কিছুটা বিস্তারে কথা বলেছি বলে এখানে শুধু একটু নজির উপস্থিত করব। সুভদ্রা এই নাটকে বস্নু-জিন্স পরে ডিসকোয় নাচানাচি করে। অর্জুনের সঙ্গে তার একটা সংলাপ এইরকম :

না, না, না, সুরা নয়, সুরা না,

ওসব জিনিস সব কবে হয়ে গেছে পুরানা,

নিয়ে এসো Mandrex, নিয়ে এসো hashish

তখন দেখব পার্থ, তুই কত ভালোবাসিস।

এদিকে ভালোবাসাবাসির ভাষায় তুই-তোকারি অর্জুন অতটা নিতে পারে না। তার পৌরুষে এটা একটু লাগে। সে বলে :

আমি তোমার মতো মেয়ে,

একটা কেন একশোটা

এখুনি যাব পেয়ে।

ইন্দ্রপ্রস্থের শেষ দৃশ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, এখানকার কেষ্টদা, শোনান ছন্দের কথা, সমন্বয়ের কথা, জীবনের শ্রী-ছাঁদের কথা …

আমি তোমাদের সবাইকে ভালবাসি

সুভদ্রা, পার্থ, দ্রৌপদী,

আর ভালবাসি ছন্দ,

মাত্রাবৃত্ত, পয়ার, দ্বিপদী।

ছন্দ ছাড়া জীবন মানেই

ছন্নছাড়া জীবন –

ফিরে আসা যাক গোড়ার প্রশ্নে : কবিতা কোথায়? প্রশ্নটাকে যদি ভূগোলের প্রশ্ন হিসেবে দেখি, তাহলে ওপরের উদাহরণগুলি মাথায় রেখে বলা চলে, কেন এই তো মহাভারতে, মহাভারতের অন্তিম পর্বে, হয়তো মৌষল পর্বে, হয়তো মহাপ্রস্থানিক পর্বে, এরকম। ঠিক। এই উত্তরে MCQ ধাঁচের প্রশ্নপত্রে হয়তো নম্বরও পাওয়া যাবে, যদি অবশ্য কম্পিউটারের সফটওয়ারে সেই উত্তরটাকেই ঠিক উত্তর বলে আগে থেকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। ধরা গেল তাই আছে। সেই সুবাদে আমরা হয়তো ভূগোল পরীক্ষায় পাশ করে গেলাম। কিন্তু তাতে আমাদের কবিতার ঘরে কতটুকু এগোবে। ভূপৃষ্ঠের ওই একই ভূগোলে আমরা কত আলাদা জাতের কবিতাই না খুঁজে পাচ্ছি। সত্যি কথা বলতে কী, আলাদা জাতের কবিতা খুঁজে পাচ্ছি, না তা আমরা বানিয়ে তুলছি। ওখানেই আছে সেই অলৌকিক রহস্য। কবিতা কোথায়। যে যেখানে খুঁজে পায়। আসলে খুঁজে পাওয়া কাজটাই বানিয়ে তোলা। তা-ই আমাদের রচনাকর্ম। সব শিল্পই রচনাকর্ম। রচনাকর্মের উপাদান নানা শিল্পের নানারকম। ইট, কাঠ, নুড়ি পাথর, লতাপাতা, ধ্বনি ও আলোছায়া থেকে আরম্ভ করে ছেঁড়া কাগজ, রং তুলি, সবই উপাদান আর উপকরণ। কবির উপকরণ শব্দ, ভাষা, ব্যাকরণ, পুনরুচ্চারণ ও এমনকি নীরবতা। শিশিরকুমার দাশ এক কবিতায় লেখেন …

 

আমি কোনো প্রাচীন কবির কাছে

গিয়েছিলাম নবীন অহঙ্কারে,

বসেছিলাম একেবারেই একা

অমরত্বের আদিম অন্ধকারে।

ছুড়ে দিলাম কবির মুখে সজোরে এই কথা।

‘আমাকে তাঁর দেবার কিছু আছে?’

আসনখানি এগিয়ে দিয়ে হেসে

বলেছিলেন তিনি

‘নীরবতা’।

প্রাচীন কোনো কবির আশ্রম। অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ দিয়ে মানচিত্রে ভূগোলের স্থান কিছু নির্দিষ্ট করা নেই। হতেই পারে এ-আশ্রম তমসার তীরে বা গ্রিসের পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত। সে-অঞ্চল বিষয়ে এই কবির এক ধরনের প্রাচীনতার মায়ার টান সুবিদিত।

কিন্তু এখানে কিছুই নির্দিষ্ট করা নেই, করার দরকারও নেই। অন্তত উদ্ধৃতাংশে জানা যাবে তাঁর অমরত্বের আদিম অন্ধকারের কথা। সেই অন্ধকারে তিনি বসেছিলেন একেবারে একা। তিনি কি তাঁর প্রাচীনতায় একা, না অমরত্বে একা, সবাই তো আর অমরত্ব পায় না, নাকি তাঁর আদিমতায় একা। এই প্রাচীন কবির ভৌগোলিক অবস্থান যেখানেই হোক না কেন, অহংকারী নবীন কবি তাঁকে খুঁজে নিচ্ছেন নিজের ভাষায়। এবং সেই নিজের ভাষার জোরেই রচিত হচ্ছে নতুন কবিতা। তাহলে কবিতা কোথায় … শেষ পর্যন্ত এ-প্রশ্নের উত্তরে কি আমরা পৌঁছে যাব সেই গোড়াকার কথাটাতেই … কবিতা কোথায়, তা কবিতায়। অর্থাৎ ভূগোলে পাশ-ফেলে কবিতার কিছু এসে যায় না। কবিতা কোথায় খুঁজে পাওয়া গেল, আদিম অরণ্যে, না নদীতীরে, না খড়ের কুটিরে, না হাহাকার শূন্যতায় তাতে সত্যিই বোধহয় কিছু এসে যায় না। সেই জন্যই সম্ভবত বলা হয়ে থাকে মহৎ কবিতার বিষয় কিছু একটা হতে পারে, কবিতার মহৎ বিষয় বলে কিছু হয় না। হয় না মানে, যাকে আমরা ‘মহৎ’ বিষয় বলে ভাবি তা ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান মানবসভ্যতা ও মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণের বিচারে মহৎ বিষয় হতেও বা পারে, কিন্তু তা নিয়ে অত্যন্ত অকিঞ্চিৎকর কবিতা যে হতে পারে তার ভূরি ভূরি নজির সবারই জানা আছে। উল্টোটাও সম্ভবত একই রকম সত্যি। মানুষের, কোন মানুষের কখন কী যে কাজে লাগবে তা নিয়ে যথেষ্ট দ্বিধা সন্দেহ বা লোকলজ্জার সংকোচ সবই থাকতে পারে, কিন্তু হাড়-কাঁপানো কবিতা নিংড়ে যে নেওয়া যায় সেখান থেকে তারও অনেক নজির কবিতা পাঠকের জিভে ঠোঁটে লেগেই থাকে। ‘তুমি যখন চুল খুলে দাও আমি ভয়ে কাঁপি’, কিংবা ‘আধ ঘণ্টা নারীর আলস্যে তার ঢের বেশি পাবে’। এইসব সেই জাতের কবিতা যে-কবিতার বিষয় নির্দিষ্ট করাই শক্ত, এবং কোনোমতে তা কিছু একটা করতে পারলেও প্রশ্ন একটা থেকেই যাবে, এসব বিষয় কার কী কাজে লাগবে। কাজে লাগুক বা না-ই লাগুক কবিতা পাঠকের রক্তে ঢেউ ওঠে, অন্তত অনেক সময়ে ওঠে তা বলাই চলে। তবে কবিতা-বধির কানের কথা তুললে কিছু বলার থাকে না। এবং সেরকম কানের অসিত্মত্ব আছে, এ কথা মেনে নিয়েই আমাদের কাজকর্ম চালাতে হয়। এ নিয়ে খুব বেশি ঝগড়াঝাঁটি করে কোনো লাভ নেই।

তাহলে কবিতা কোথায় এই পথে খুঁজতে খুঁজতে আমরা ভূগোল ছাড়িয়ে ভাষার প্রান্তরে এসে পড়েছি। আসতে আসতে এও দেখেছি যে, একই ভূগোলে একই রকমের বিষয়ে দিব্যি আলাদা জাতের কবিতা লেখা সম্ভব। আর তা সম্ভব হচ্ছে ভাষার দৌলতেই। কেননা ভুললে চলবে না যে, শেষ পর্যন্ত কবিতা ভাষা দিয়েই লেখা হয়। ভাষায় শব্দ থাকে, যা হোক এক রকমের ব্যাকরণ থাকে এবং শব্দের গায়ে লেগে থাকে না-ছোড় অর্থের পিছুটান। এই সমস্ত ভার নিয়েই কবিকে পথ চলতে হয়, কবিকে এগোতে হয় পদে পদে এই বোঝা টেনে টেনে। অথচ তাঁকে চলতে হবে হালকা পায়ে, পদক্ষেপে বেচাল হলে তাঁর চলবে না। ওই যে ভাষার বোঝা তাঁকে টেনে চলতে হবে, তার আছে সময়মাত্রা এবং ব্যক্তিমাত্রা দুইই। সময়ের মাত্রা বা কালের মাত্রায় আছে সমাজের হাতের ছোঁয়া, আর ব্যক্তিমাত্রায় আছে কবির নিজের খেয়ালখুশি বা মর্জি। তাও বাঁধা আছে ভাষা ব্যাকরণ ও বাগধারার বিধিবিধানে, এইসব মেনেই তাঁকে বেছে নিতে হয় ভাষাব্যবহারের স্তর। সব কবিকেই তাই ভাষার দাঁড়ে ঠোকরাতে হয়। তাই আমরা পাই এরকম পঙ্ক্তি : কাব্যকে খুঁজেছি আমি গরুখোঁজা করে খিদিরপুর ডকের অঞ্চলে। কবিতার ত্রিকালদর্শী পাঠক নিশ্চিত শনাক্ত করবে কবিতায় নতুন ভোর আসছে। কোনো একজন কবির কবিতা কোন ভাষায় কথা বলবে, এই নির্বাচন কবিকে করতে হবে অত্যন্ত সচেতনভাবে। ক্রিকেট খেলায় ব্যাটসম্যানের শট নির্বাচনের মতো। সেখানে ভুল হলে সমূহ সর্বনাশ।

কবিতার রহস্য অনেকটাই নিহিত থাকে ভাষায়। ভাষা সরে সরে যায়। সবাই জানেন চলমান ভাষা দাঁড়িয়ে থাকে না। তার যাওয়ার পথে অনেক পাড় ভাঙে, অনেক চর জেগে ওঠে, অনেক লোক ভেসে যায়, অনেক লোক ঠাঁই পায়। চলমান জীবনে এমন কত কা- ঘটে। জেগে-ওঠা চরে যে-উটকো লোকেরা বসতি করে তাদেরও ভূমিকা কিন্তু নগণ্য নয়। আমাদের এই পাথুরে গ্রহটা যে একদিন শ্যামলে সবুজে ভরে গেল সে তো প্রাণেরই স্পর্শে। প্রাণই শুধু প্রকৃতি থেকে তার পুষ্টি আহরণ করে তা নয়, প্রকৃতিকেও হাত বাড়াতে হয় প্রাণের দিকে। পাথর ক্ষয় হতে হতে একদিন মাটির দেখা মেলে, আর সে-মাটিতে অন্য অনেক উপাদানের সঙ্গে মিশে থাকে নানাবিধ অণুজীব। এদেরই ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় এই গ্রহ ক্রমে ক্রমে এত প্রাণ ধারণে সক্ষম হয়েছে।

চলমান ভাষাপ্রবাহও ঠিক সেই ছোটো নদীর মতো চলে আঁকেবাঁকে। কবিতার ভাষার জন্য উপযুক্ত ভাষাস্তর খুঁজে নিতে হয় বললাম, তা তো এই কারণেই জরুরি যে, যে-কোনো নির্দিষ্ট ভাষা গোষ্ঠীতে জীবনযাপনের বাস্তব ফারাকের উপরে নির্ভর করে গড়ে ওঠে নানা ভাষাস্তর। তা ছাড়া আছে ব্যবহারিকতারও বহু স্তর। আমরা খোশগল্প যে-ভাষা চৌহদ্দিতে করি, ঝগড়া সে-ভাষায় আঁটে না। তাকে অন্য গ–তে পা বাড়াতে হয়। এইসব বিবেচনা করলে বুঝতে পারা যায় যে-কোনো ভাষাগোষ্ঠীর ভেতরের চেহারাটা কত বৈচিত্র্যে ভরা। তাই কবিতার জন্য খেলার মাঠ সত্যিই খুব প্রশস্ত। এখন এত বড়ো একটা মাঠে খেলা সাজাতে গেলে সবাই বলবেন হিম্মত লাগে। লাগেই তো। কিন্তু কোনো একলা ব্যক্তির হিম্মতের ব্যাপার কি এটা। আমরা শক্তিশালী কবির কথা বলে থাকি। নিশ্চয়ই কবির কলমের জোরে অনেক অসাধ্য সাধন করা যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও খেয়াল করা ভালো যে, শক্তিমান কবিকে বা তাঁর অসামান্য কাব্যসৃষ্টিকে ধারণ করার জন্য চাই আরো বিস্তারিত একটা ক্ষেত্র। কবিতা যেহেতু ভাষাক্ষেত্রের সৃষ্টিকর্ম, তাই সে-সৃষ্টিক্ষেত্রকে ধারণ করার জন্য লাগে প্রশস্ততর এক ভাষাক্ষেত্র। নদীর যেমন অববাহিকা। সেই ঢাল দিয়ে জল এসে গড়িয়ে পড়ে নদীতে। বহতা নদীর স্রোত নইলে অক্ষুণ্ণ থাকে না। চারপাশের বহু মানুষের মুখের কথায়, লেখার ভাষায় ভাষার চলার পথ কাটা হয়। ভাষারীতি কোন পথে কোন দিকে মোড় নিচ্ছে তা টের পাওয়া যায় ওই অববাহিকার দিকে নজর করতে পারলে। দু-একটি শক্তিমান মহীরুহই আমাদের চোখে পড়ে, তাদের গলার স্বরই কেবল আমাদের কানে যায়। অশ্রম্নত ধ্বনির মতো আরো অনেক কণ্ঠস্বর থাকে চারপাশে, কান পাততে জানলে শোনা যায় সেসব। এই সবের মধ্য দিয়ে অববাহিকার মাটি সজল থাকে, তবে না নদীতে জল জমে, স্রোত বইতে পারে। ভাষা অববাহিকায় সবাই হয়তো কবি নন, সবাই এমনকি হয়তো লেখকও নন কোনো অর্থে। কিন্তু ভূমিকা আছে প্রত্যেকের। মাটিটা ভিজিয়ে রাখা খুব জরুরি। নইলে জমি তৈরি হবে না। জমি তৈরি না হলে মহীরুহ দূরে থাক, তৃণগুল্মও গজাবে না। এই অববাহিকায় এমন অনেক ভাষাসেবী থাকবেন ভাবীকাল যাদের কথা মনে রাখবে বড়জোর শুধু গৌণ কবি হিসেবে। গৌণ কবির বেলায় আমাদের মনোযোগ সাধারণভাবে কিছু কম। অস্বাভাবিক নয়। তাঁদের নিয়ে অনেক সময়ে আমরা চাপা হাসিঠাট্টাও করে থাকি। ‘বরঞ্চ নিজেই তুমি লেখনাকো একটি কবিতা’। কবিদের তরফে এরকম চেনা লাইন, অভিমানী পঙ্ক্তি আমরা প্রায়শ পেয়ে থাকি। আর তখন অববাহিকার সবুজের কথাটা আমরা দিব্যি ভুলে থাকি। অথচ জমির উর্বরতায় তাঁদের স্বেদ ও রক্তও মিশে থাকে।

গৌণকবি ব্যাপারটায় আমার নজর পড়েছিল আজ থেকে প্রায় আটান্ন বছর আগে এক অসামান্য ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে। এঁর কথা আমি ঠারেঠোরে একটু-আধটু আগেও লিখেছি। তাঁর নাম দিলীপকুমার সান্যাল। ইংরেজির অধ্যাপক। এক সময়ে পড়াতেন, আমি যতদূর জানি, বিদ্যাসাগর কলেজে। পরে দিল্লি পলিটেকনিক ইত্যাদি নানাক্ষেত্র ঘুরে শেষদিকে ছিলেন কালিম্পং কলেজের অধ্যক্ষ। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের সুযোগ হয়েছিল ওই দিল্লি পর্বে। উনি সম্ভবত এক সময়ে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর সহকারী হিসেবে শনিবারের চিঠিতেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৬০-৬১-তে আমি তখন দিল্লির একটা কলেজে পড়াই। কী আর বয়স আমাদের তখন। ঘুরে ঘুরে বেড়াই বন্ধুবান্ধবেরা দল বেঁধে। শুনেছিলাম, কেননা আমি সেদিন সঙ্গে ছিলাম না, আমাদের দল নতুন এক ব্যক্তিকে আবিষ্কার করেছে। তিনি বাসস্টপে দাঁড়িয়ে একটু বিড়বিড় করে বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন ইংরেজিতে। দিল্লিতে বাসে যাতায়াত তখন এক ঝকমারি। আমরা বলতাম এক একটা রুটে মাসে একটা করে বাস চলে। বাসস্টপে গিয়ে আমরা বুঝে নেবার চেষ্টা করতাম এ-মাসের বাসটা চলে গেছে কি না, তাহলে আর অপেক্ষা করে কোনো লাভ হবে না। তা এরকম অবস্থায় উনি বাস পাচ্ছিলেন না, তাই নিজের মনে ইংরেজিতে বকাবকি করছিলেন। সেই বকুনি আমাদের ওই বন্ধুদের কারো কানে যায়। গিয়ে উপযাচক হয়ে ওঁর সঙ্গে আলাপ করে। জানা যায় আমরা যে-আস্তানায় থাকি তখন উনিও থাকেন তারই খুব কাছে কোনো একটা বাড়িতে। সেখানে আমরা ওঁর উপর চড়াও হই, আলাপ করি, আড্ডা জমাই, বেশ কিছুদিন ওঁর সান্নিধ্য পাই। মনে আছে প্রথম দিনের আলাপে উনি আমাকে বলেছিলেন খেরোর খাতা, কেননা আমি পড়াই অর্থনীতি। পাছে আমার মন খারাপ হয় তাই সঙ্গে যোগ করেছিলেন, আমার ছেলেকেও আমি বলি মিস্ত্রি, কেননা সে ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের মধ্যে একজন ছিল নৃতাত্ত্বিক। সে ওঁর বিচারে ঠিকঠাক, কেননা সে ফ্রেজারের গোল্ডেন বাউয়ের লোক। আমরা ঝড়তিপড়তি। এহেন দিলীপকুমার
যখন-তখন কথায় কথায় পড়া ধরতেন। বলা বাহুল্য, তার বেশিরভাগই আমরা পারতাম না। এই পড়া ধরার একটা বড়ো অংশ ছিল মাইনর পোয়েট্‌স। ভিকটোরিয়ান মাইনর পোয়েট‌দের কথা খুব বলতেন। বলতেন, এসব কবির তোমরা নামই শোননি। তা শুনবে কেন। শোন … গড়গড় করে বলে যেতেন এই ধরনের লাইন …

He knows not why nor whence he sings,

Nor whither goes his warbled song;

As Joy itself delights in joy,

His soul finds strength in its employ,

And grows by utterance strong.

 

কবির নামও বলতেন। তবে অচেনা নাম তো, তাই আমাদের মাথায় দানা বাঁধতে পারত না। পরে মাইনর ভিক্টোরিয়ান পোয়েটদের সংকলনে এসব টুকরো পেয়েছি। সেসব খোঁজাখুঁজি করতে গেয়ে লুই ম্যাকি্নসের এলিজি ফর মাইনর পোয়েটদের সন্ধান পেয়ে যাই একদিন। আশ্চর্য নয় যে, এ-কবিতার শেষদিকে একটু করুণ সুর বাজে।

Their ghosts are gagged, their books are

library flotsam

Some of their names  – not all  – we learnt

in school

But, life being short, we rarely read their

poems,

Mere source-books now to point or except

a rule,

While those opinions which rank them

high are based

On a wish to be different or on lack of taste.

 

এই মাইনর পোয়েটরা জমি তৈরি রাখেন। সত্যি বলতে কী, কবিতার বিদ্যুৎশক্তির বিচারে এঁরা অনেকেই ভালো কবি; কিন্তু নানাবিধ সামাজিক সাংস্কৃতিক সংযোগে ও অন্যান্য কারণেও তাঁরা গৌণ থেকে যান। ওই গৌণতাই তাঁদের ভূমিকা। সেই পটভূমিতেই তাঁদের চিনে নিতে হবে। কেননা তাঁদের প্রেতাত্মাদের কণ্ঠস্বরও রুদ্ধ। তাঁরা মিলিয়ে থাকেন সমূহে। সেই সমূহের সুবাদে তাঁরা বস্ত্তত একরকমের প্রান্তিকতায় নির্বাসিত। এই প্রান্তিক অসিত্মত্বকে আবার সমাজের অন্য সমস্ত প্রান্তিক বাসিন্দাদের সঙ্গে মিলিয়ে আরো একরকমের যৌথতা নির্মাণের একটা প্রক্রিয়া খুব ক্ষীণভাবে হলেও কিছুটা টের পাওয়া যায়। আমাদের বোধের জগতে এসব ভাবনা জরুরি। মাইনর শব্দের থেকে মাইনরিটিতে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগবে কেন। আমাদের এই দারুণ অসম পৃথিবীতে ভাবনার এসব দিগ্বিদিক স্পর্শ করতে হবে বইকি।

আজ সুবীর ম-লের স্মরণে কথা বলছি আমরা। তাঁর কবিতার দু-চার পঙ্ক্তি উদ্ধার করে কথা শেষ করি।

 

মেয়ের ঘুমের পাশে চুপ করে বসে থাকি আমি

আহা ঘুম, এই ভাবি, তাকে যদি লিখে রাখা যেত

কিছুতে ছুঁই না তবু  – ওই মুখ ও মুখের ডৌল

ভয় হয় – হাত খসে পড়ে যাবে, হাতের আঙুল।

তাই ঝুঁকি, ঝুঁকে দেখি, কী যে হয় মনের ভিতর

একটি সহজ পাখি, অবেলায় ডেকে ওঠে খুব

বনে বনে ফুল ফোটে, ঘাসে ঘাসে শিশিরের রেণু

শীতের সোনালি রোদ ঝিকিমিকি আর সুরধুনী।

কী হবে অফিসে গিয়ে, ঠেলা-গুঁতো, ট্রেনের জীবন

হলুদ হয়েছে দিন … দিন দিন অতি ব্যবহারে

পাঁজরের হাড় ভেঙে রাজপথ … অবস্থা করুণ

বাতাসে মৃতের হাসি, আকাশের মুখ পুড়ে গেছে।

কোথাও যাব না তবে, মেয়ের ঘুমের পাশে বসে

যে মাধুরী অপরূপ – আঁচটুকু মেখে নেব তার।

(‘পাখিদের মেয়ে তুই’, ১১নং, মাটিতে পায়ের ছাপ)