কবি ও সম্পাদক আবুল হাসনাত

কবি মাহমুদ আল জামান নামটি ছদ্মাবরণ হলেও খুব কি অচেনা?

নিশ্চয় নয়। নিভৃতচারী এই কবিকে ছদ্মনামেই চেনে বাংলাভাষার কাব্যবিশ্ব।

অপরদিকে আদর্শবান এক সাহিত্য-সম্পাদক, যিনি আবুল হাসনাত নামে অধিক পরিচিত। অত্যন্ত বাক-প্রমিতি, নির্মোহ ও নিরপেক্ষ মননের এক অসাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি দেশের কবি, লেখক, সাহিত্যিকদের মনে স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছিলেন সগৌরবে। ফলে পোশাকি নামটি পরিচিতি পেয়েছে অধিক।

প্রথম জীবনে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক, পরবর্তী সময়ে সাহিত্য শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা কালি ও কলমের বিচক্ষণ সম্পাদক হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। কালি ও কলম   সাহিত্য-শিল্পের অগ্রগণ্য এই বাংলা মাসিক পত্রিকাটি ২০০৪ সাল থেকে মাসিক ভিত্তিতে প্রকাশিত হচ্ছিল। প্রকাশক আবুল খায়ের এবং সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন শিক্ষাবিদ ও লেখক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এছাড়াও সম্পাদকমণ্ডলীর মধ্যে রয়েছেন আমার অত্যন্ত প্রিয় কবি রুবী রহমান, কথাসাহিত্যিক সুব্রত বড়ুয়া এবং প্রিয়জন লুভা নাহিদ চৌধুরী।

আত্মঘাতী এ-বছরই ১৪ মে করোনায় আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন সভাপতিমণ্ডলীর সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান স্যার। সেই শোকের ছায়াতলে পাঁচ মাসের ব্যবধানে সম্পাদক আবুল হাসনাতেরও শেষ বিদায়ের পতাকাটি নমিত হলো ১ নভেম্বর ২০২০ সালে। এমন দুঃখের রাত্রি, বিষাদের পল্লব আর তমসাঘন অন্ধকার যে-অন্ধকার থেকে ফেরে না কেউ। মাঝে মাঝে মনে হয় আমৃত্যু দুঃখের তপস্যারত এই জীবনের কোনো মানে নেই যেন। যেদিকে তাকাই দেখতে পাই ‘মৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে পড়েছে ঢাকা। সকল সৃষ্টির পথ আত্মঘাতী করোনা রেখেছে যেন আকীর্ণ করে।

ছদ্মনামে সাহিত্যসৃষ্টির ইতিহাস এদেশের বহু পুরনো, বলা চলে সাহিত্যের ঐতিহ্যবাহী এক রূপক-সংস্কৃতি। আঠারো শতকে রাজা রামমোহন রায় লিখতেন শিবপ্রসাদ নামে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত টি মোথি পেনপোয়েম নামে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম ছিল কমলাকান্ত। প্যারীচাঁদ মিত্র ব্যবহার করতেন টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ভানুসিংহ, কখনো বা আন্নাকালী পাকড়াশী। কাজী নজরুল ইসলাম নাম নিয়েছিলেন ধূমকেতু এবং ব্যাঙাচি। এছাড়া সবুজপত্র পত্রিকায় প্রমথ চৌধুরী নিজেই ‘বীরবল’ ছদ্মনামে চলিত ভাষায় ‘বীরবলের হালখাতা’ নামক কলাম লিখে ১৯১৪ সালের মধ্যে সাধু ভাষার পরিবর্তে সাহিত্যিক ভাষা হিসেবে চলিত ভাষাকে প্রতিষ্ঠিতও করেছিলেন আজ থেকে প্রায় ১০৬ বছর আগে। তিরিশের কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন ‘শ্রী’ ছদ্মনামে। সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন সত্যপীর নামে, হালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম হিসেবে নীললোহিত খুবই পরিচিত সবার কাছে। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘রূপচাঁদ পক্ষী’ হয়ে উড়েছেন কাব্যের আকাশময়। কবি শামসুর রাহমান আবার বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে নানা ছদ্মনাম নিয়েছেন, যেমন সিন্দবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিক, মৈনাক প্রভৃতি।

আবুল হাসনাতভাইয়ের ছদ্মনামটি কোনো প্রতীকী নাম নয়, কেবল ধুলো-মাটি-কাদায় সিদ্ধ নিজের প্রকৃত নামের আড়ালে অন্য এক অশরীরী কবিসত্তার স্পর্শ পেতেই বোধকরি মাহমুদ আল জামানের বুকে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিলেন পলায়নপর এই কবি।

‘মাহমুদ আল জামান’-এর রূপকে কবিসত্তা বিনির্মাণে সঞ্চরণশীল এই নামটির প্রতি তাঁর কোনো মানুষি দুর্বলতা ছিল কি না আজ আর তা জানার কোনো অবকাশ নেই।

এই ছদ্মনামেই প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো যথাক্রমে জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক, কোনো একদিন ভুবনডাঙায়, ভুবনডাঙার মেঘ ও নধর কালো বেড়ালনির্বাচিত কবিতা। তাঁর সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের কবিতাগল্প সংকলন দুটি ঐতিহাসিক দলিল।

আবুল হাসনাতের আত্মস্মৃতি হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে ২০২০ সালের একুশে গ্রন্থমেলার শেষ দিনে প্রকাশিত হয়েছে কবি তারিক সুজাতের জার্নিম্যান বুকস থেকে। বইটি পড়ার সুযোগ হয়নি আমার। ধারণা করি, কবির আত্মজীবনীমূলক বইটিতে লুকানো রয়েছে তাঁর সারাজীবনের সঞ্চয় কিংবা পাওয়া না-পাওয়া ধনরত্নের সেই মহাসিন্দুক, যা খুললেই বেরিয়ে আসবে কোহিনুরের দ্যুতি, নয়তো শতসহস্র দীর্ঘশ্বাসের দহন।

এই সবকিছু ছাড়িয়ে তিনি আজ যে-অনন্তলোকের বাসিন্দা হয়েছেন, সেখানে এসব বাহুল্য কথার কানাকড়ি মূল্য নেই।

একজন সম্পাদক হিসেবেই মৃদুভাষী হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। আশির দশকে সেই দৈনিক সংবাদের অফিসে। নবীন কবি হিসেবে লেখা দিতে যেতাম খুব ভীরু পায়ে। সন্তোষদাকে দেখেছি, তাঁর সঙ্গে কথা বলব, তার সাহস সঞ্চয় করতে পারিনি। কবিতাটি কোনো রকম হাসনাতভাইয়ের হাতে গছিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসতাম। এরপর অনেক জল গড়িয়ে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা পেরিয়ে আমি পৌঁছে গেছি ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে। উত্তরাধিকার পত্রিকার অপর বিখ্যাত সম্পাদক রফিক আজাদ আমার কবিতা ছাড়াও জীবন সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছেন। তখন এক ঋজু ভঙ্গিমায় জীবনসংগ্রাম ও কাব্যযাত্রা দুই-ই এগিয়ে চলছিল। এই সময়টায় সম্পাদক হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে বিভিন্ন সেমিনার, কবিতার অনুষ্ঠানে দেখা হয়, কুশল বিনিময় কখনো রবিদার বাসার নিমন্ত্রণে, কখনো আবার বেঙ্গলের কোনো অনুষ্ঠানে দেখা উপলক্ষে মৃদুভাষায় কুশলবিনিময়। এভাবেই গড়িয়ে গড়িয়ে চলে গেছে সময়।

অনেক পরে জেনেছি আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের ছাত্রনেত্রী নাসিমুন আরা হক হাসনাতভাইয়ের স্ত্রী।

কবি ও মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদের প্রয়াণের পরে আক্ষরিক অর্থেই নিজেকে মনে হয় অকূল সমুদ্রপথের একলা যাত্রী যেন, নোঙরবিহীন জাহাজে।

যে-কজন ব্যক্তি-মানুষের নির্ভরতা, যাঁদের কেউ কেউ মাথায় বৃক্ষপত্রের ছায়া হয়ে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে কবি আসাদ চৌধুরী ছাড়া যেমন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান স্যার দুজনেই চলে গেছেন। আরো যাঁরা পাশে ছিলেন অভয়াশ্রমের মতো, তাঁদের মধ্যে কবি রবিউল হুসাইন এবং সর্বশেষ চলে গেলেন কবি ও সম্পাদক আবুল হাসনাত।

এই দুজনই কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদের জন্যে ছিলেন অঙ্গীকারবদ্ধ ভালোবাসার অপর নাম।

এছাড়াও বাংলার শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের মননশীল সব নক্ষত্র পতনের শূন্যতা আমাদের অসহায় করে তুলেছে।

একাকিত্বের ঘোর কেটে আলোর মৃদু উদ্ভাসন দেখতে পেতাম যাঁদের মুখ দেখে, তাঁরাও সব এক এক করে সময়ে-অসময়ে চলে যাচ্ছেন দ্রুত।

সর্বশেষ হাসনাতভাইয়ের অন্তর্ধানের খবর শোনার পর থেকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসেছিলাম কতক্ষণ মনে নেই। কিছু লেখার কথা মনে হলেও হাত কাঁপছিল। কোনো কোনো শোক সংবাদ বিস্ময়ে বিমূঢ় করে তোলে, উদাসীন আকাশের দিকে তাকিয়ে তখন অসীমের হাত-পা, নাক-মুখ খুঁজতে থাকি যেন কেবলি।

শোকাগ্নিতে আচ্ছন্ন করে রাখে দুচোখের নিদ্রা। তখন ঘুমঘোরের আশ্রয়ে পালাতে চেয়েও কিন্তু পারি না। গতরাতে বারবার মনে পড়ছিল বীরবাহুর শক্তিধর পিতা রাবণের সেই আহাজারি।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের আধুনিক মহাকাব্য মেঘনাদবধ কাব্যে বর্ণিত রণক্ষেত্রে পুত্র বীরবাহুর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে পিতা রাবণ তীব্র আহাজারি আর আক্ষেপে ভেঙে পড়েছিলেন। বলেছিলেন নমিত কণ্ঠে,

এ মোর সুন্দরী পুরী!

কিন্তু একে একে শুখাইছে ফুল এবে,

                                   নিবিছে দেউটি।

মেসেঞ্জারে প্রথম কবি পিয়াস মজিদের টেক্সটের লেখাটির দিকে তাকিয়ে সেদিন আবারো মনে হলো, আরো একটি দেউটি নিভে গেল এইমাত্র! ‘কবি আবুল হাসনাত’ যার নাম।

দুঃসংবাদটি শোনামাত্র আমার হার্ট দ্রুত লাফাতে শুরু করল। কী করি? পিয়াসের পরেই কথা বললাম প্রিয় দুজন মানুষের সঙ্গে আনোয়ারা সৈয়দ হক ও রুবী রহমান। রুবী আপা আমার মুখেই প্রথম শুনে যেন চমকে উঠলেন ভয়াবহভাবে।

কী বলো দিলারা?

জি আপা, সত্যি খবর এটি।

দুদিন আগে মিনু আপার সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা হলো।

মিনু আপাকে কী করে বলব, আমরা তো হাসনাতভাইয়ের জন্যে প্রার্থনার হাত তুলেই অপেক্ষার প্রহর গুনছিলাম, বাড়িতে ফিরে আসার সংবাদ পাবো বলে। যেহেতু করোনা নয়, সেজন্যে আশা ছিল কিছুতেই তিনি হারাবেন না।

১৯৭২-৭৩ সালে মিনু আপা আমাদের শামসুন্নাহার হলে কী দাপুটে ছাত্রনেত্রী। ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী আমরা, দূর থেকে তাকিয়ে দেখি তার মায়াবী চোখ-মুখের অঙ্গীকার। সারাজীবন একই পথে হাঁটলেন। কতজন কতভাবে বদলে গেল আমাদের চোখের ওপর দিয়ে। তাঁরা দুজন রয়ে গেলেন একই চিন্তা-চেতনায়। দেশ, দেশপ্রেম, অসাম্প্রদায়িক চেতনার নবরূপায়ণ ও বাস্তবায়নে সাহিত্য ও সংস্কৃতির কর্মক্ষেত্রকে লক্ষ্য করে দুজনেই দুর্মরভাবে কাজ করে গেলেন সারাজীবন।

দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী পাতার সম্পাদক কবি মাহমুদ আল জামান ওরফে হাসনাতভাইকে পেলাম সাহিত্য শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা কালি ও কলমের অভিনব যাত্রার সারথি হিসেবে। একজন মেধাবী, দক্ষ ও বিচক্ষণ সম্পাদক হিসেবে হাসনাতভাই সেই মাসিক কালি ও কলমকে নিয়ে গেলেন এমন এক উচ্চতায় যে, মননশীল শিল্প-সাহিত্যের পত্রিকার নাম বলতে হলে প্রথম বলতে হয়, কালি ও কলমের নাম। প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে করলেন বিশেষ সংখ্যা, যিনি ছিলেন এই পত্রিকাটির সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি। আর হাসনাতভাই ছিলেন তাঁর আস্থার নুন।

মাসখানেক আগেও হাসনাতভাইকে একটা লেখা পাঠিয়ে ফোনে কথা বলে জানলাম, স্যারকে নিয়ে যে-সংখ্যাটি হচ্ছে, কাগজে পত্রস্থ এটি আপাতত করোনাকালে শেষ সংখ্যা। এরপর যে-সংখ্যাটি বেরুবে, সেখানেই আমার লেখাটি ছাপবেন বলে জানালেন। লেখাটির শিরোনাম ছিলো ‘দুই দেশ এক মঞ্চ’। কলকাতায় অনুষ্ঠিত এই আয়োজন করেছিল কবি বীথি চট্টোপাধ্যায়। এই অনুষ্ঠানে ড. আনিসুজ্জামান স্যারকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে সর্বশেষ।

কবি রবিউল হুসাইন, আবুল হাসনাত, আনোয়ারা সৈয়দ হক, তারিক সুজাত, মাহমুদ হাফিজ এবং আমিও আমন্ত্রিত কবি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম সেখানে। কবি বীথি চট্টোপাধ্যায়ের আতিথেয়তায় একই হোটেলে সবাই মিলে আড্ডা দিয়ে যে চমৎকার সময় কাটিয়েছিলাম তিনদিন সেইসব স্মৃতিকথন নিয়ে লেখাটি পাখা মেলেছিল উড়বে বলে।

২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পর্ষদের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন হাসনাতভাই। তিনি ছিলেন গবেষণা সম্পাদক। ২০২১ সাল থেকে কবি রফিক আজাদ স্মৃতি পুরস্কার প্রদানের যে প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে স্মৃতি পর্ষদ, তার নেপথ্য সহায়ক শক্তি ছিলেন হাসনাতভাই। তাঁকে আহ্বায়ক করেই তিন বা পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়ে আছে।

পুরস্কারের নিয়মাবলি কেমন হবে, সবই তিনি ঠিক করে দিয়েছেন। বিশেষভাবে কালি ও কলম পুরস্কার প্রদানের ব্যাপক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি পুরস্কারের মর্যাদা ও মানদণ্ডকে কীভাবে নিরপেক্ষ রাখা যায়, সেই বিষয়ে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন, এই সেদিনও।

‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কারে’র জন্যে গঠিত পাঁচ সদস্যের একজন বিচারক হিসেবে বেশ কবার দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পেয়েছি। ধারণা করি, তিনি হয়তো সাহিত্যবিচারের যোগ্য মানুষ হিসেবে আমাকে শনাক্ত করেছিলেন। কিন্ত কোনোদিনও তাঁকে তা জিজ্ঞেস করা হয়নি।

তিনি এতটাই নিভৃতচারী এবং প্রয়োজনীয় কথা বলার মানুষ যে, তাঁর সঙ্গে কখনো সেই প্রচুর বৃষ্টির মতো ব্যাপক আলাপ হয়নি।

২০১৮ সালে মুক্তধারা বইমেলায় নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে তিনি এলেন বাংলাদেশ থেকে। বাংলাদেশ থেকে সে-বছর আরো এলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খান, শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সয়ীদ, নাট্যশিল্পী রামেন্দু মজুমদার, ছড়াশিল্পী আমিরুল, সংগীতশিল্পী লিলি ইসলামসহ প্রকাশকদের অনেকেই।

আমি গেলাম টরন্টো থেকে। লন্ডন থেকে এলেন আনোয়ারা সৈয়দ হক। অটোয়া থেকে লুৎফর রহমান রিটন। চমৎকার প্রাণবন্ত আড্ডায় ও আয়োজনে কেটেছে বেশকটা দিন। হাসনাতভাইকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় উঠেছেন আপনি?

বললেন, আমি তো সবসময় আমার মেয়ের বাসায় থাকি।

তাই নাকি?

আমি এই প্রথম জানলাম, হাসনাতভাইয়ের একমাত্র কন্যা দিঠি যে নিউইয়র্কে থাকে।

সেদিন জাহাজভ্রমণে এক টেবিলে অনেকক্ষণ আড্ডা হলো, সেই টেবিলে হাসনাতভাইয়ের পাশে বসে অন্য অনেকের অনেক কথাই শুনেছি, কিন্তু মৃদুভাষী হাসনাতভাইয়ের কথা কচিৎ জলতরঙ্গের মতো শ্রবণ ছুঁয়েছে সামান্যই।

কবি রবিউল হুসাইনভাইয়ের বাসায় যতদিন দেখেছি, নীরব দর্শকের মতো, অন্যদের কথা শ্রবণে ধারণ করেছেন শুধু, বলেছেন খু-উ-ব কম। তবে এ-কথা মানতেই হবে যে, মুখে বলেছেন কম, কর্মে দেখিয়েছেন ঢের বেশি।

চীনা এক প্রবাদে জেনেছিলাম যে, বেশি কথা যারা বলে, তারা রৌপ্য সমান। যিনি কেবল শোনেন তিনি স্বর্ণের বার।

অসাম্প্রদায়িক চেতনাবিধৌত শিল্প- সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের অসাধারণ এক স্বর্ণহৃদয়ের মানুষকে হারালাম আমরা আজ। অপূরণীয় এই ক্ষতির কোনো শেষ নেই।

অনন্তে শান্তিতে বাস করুন কবি। মৃত্যুর ভেতর দিয়ে সকল দেনা যেন শেষ হলো, এখন কেবলই শান্তির অক্ষয় অধিকার।

পরিশেষে এ-কথাই বলতে হয় যে, আমাদের সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামল বাংলাদেশের মতো সুন্দরী পুরীর আজ কেবলি জীর্ণদশা ‘একে একে শুখাইছে ফুল এবে, নিবিছে দেউটি’।

এই অপূরণীয় ক্ষতি যেমন জাতির, তেমনি একটি পরিবারেরও। একমাত্র কন্যা দিঠি প্রবাসে, শেষ সময়ে পিতার সঙ্গে আর দেখা হলো না তার; এতকালের সঙ্গী হারিয়ে একাকী ও নিঃস্ব হলেন প্রিয় মিনু আপা।

মিনু আপা, আপনাকে সান্ত্বনা দেওয়ার সাহস নেই, শুধু বলি, একই দহনে দীর্ণ আমিও। ২০১৬ সালের ১২ মার্চ কবি রফিক আজাদকে হারিয়ে আপনার মতো আমিও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলাম, সেই দিনটি পুনরায় আজ শোকাগ্নিময় ভিসুভিয়াসের মতো যেন লাভা উদ্গিরণ করেছে, সেটি বুঝতে পারছি। মর্মের এই বেদনাবিধুর সহমর্মিতার আঁচলে জড়িয়ে আপনার মুখখানাকে সারাক্ষণই আমি বুকের মধ্যে আগলে রাখি যে!