কবি মাকিদ হায়দার ও অসীম সাহার চিরপ্রস্থান

বাংলাদেশের কবিতাঙ্গনের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র মাকিদ হায়দার ও অসীম সাহা। মাত্র ২২ দিনের ব্যবধানে অনন্তের পথে পাড়ি জমিয়েছেন এই দুই প্রথিতযশা কবি ও লেখক।

গত ১৮ই জুন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন কবি অসীম সাহা। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি অসীম সাহা গত ২১ মে থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন অসুস্থতায় ভুগছিলেন।

বাংলা সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য অসীম সাহা ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। এছাড়া তিনি আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা পেয়েছেন।

অসীম সাহার জন্ম ১৯৪৯ সালে নেত্রকোনা শহরে মামাবাড়িতে। তাঁর পিতৃপুরুষের ভিটে মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় থানার তেওতা গ্রামে। তবে পিতার চাকরির সূত্রে মাদারীপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে তাঁদের পরিবার। সেখানেই বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।

তাঁর লেখালেখি-জীবনের শুরু ১৯৬৪ সালে। ১৯৬৫ সালে প্রথম তাঁর জাতীয় দৈনিকে লেখা প্রকাশিত হয়।

তিনি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছড়া, কিশোর সাহিত্য প্রভৃতি রচনা করেছেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত।

অসীম সাহা যা কিছু করেছেন তার মধ্যে একটা নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি ছিল, নিজস্ব মেজাজ ছিল। তিনি ধ্যানমগ্ন জীবন পার করেছেন। লেখালেখিকে তিনি নিবিড় চর্চা ও সাধনার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এবং তা করতে গিয়ে নিরন্তর লড়াই-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁকে।

লেখালেখি ঘিরে বহুবিধ বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে নিবেদন করলেও অসীম সাহা শেষ পর্যন্ত কবিই ছিলেন। তাঁর সকল উপস্থিতি মনে করিয়ে দিত, জাগিয়েও তুলতো এই বোধ যে, অসীম সাহা একজন কবি।

লেখালেখির পাশাপাশি তিনি দেশের মূলধারার পত্রিকাসমূহে সাংবাদিকতাও করেছেন। এছাড়া তিনি চলচ্চিত্রে গীতিকার, সুরকার, অভিনেতা ও টিভি চ্যানেলের উপস্থাপক হিসেবেও কাজ করেছেন। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

কবি মাকিদ হায়দার গত ১০ই জুলাই রাজধানীর উত্তরার নিজ বাসায় পরলোকগমন করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।

পরিবার সূত্রে জানা যায়, তিনি উচ্চ ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে কিছুটা সুস্থ হলে তাঁকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়।

মাকিদ হায়দারের জন্ম ১৯৪৭ সালে পাবনার দোহারপাড়া গ্রামে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। গণসংযোগ ও গণমাধ্যম বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কর্মজীবনে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার (বিসিক) মহাব্যবস্থাপক ছিলেন তিনি।

সাহিত্যচর্চার শুরু ছড়া দিয়ে। গল্প ও নাটক লিখলেও শেষ পর্যন্ত বিশেষভাবে নিবেদিত ছিলেন কাব্যচর্চায়। আটপৌরে ভাষা, নির্মাণশৈলী ও যাপিত জীবনের সহজ উপলব্ধি তাঁর কবিতাকে স্বতন্ত্র মহিমা প্রদান করে। চলমান জীবন ও সময়ের বহুভঙ্গিম স্রোত থেকে আত্মীকৃত কাব্য-উপাদান তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নারীপ্রেম, রাজনীতি ও নন্দনতত্ত্বের সংশ্লেষ তাঁর কবিতায় নিয়ে এসেছে নতুন মাত্রা। ‘প্রিয় রোকোনালী’ তাঁর কবিতার বিশেষ এক চরিত্র।

মাকিদ হায়দার ছিলেন সর্বজনীন কবি। কোনো ভণ্ডামি কিংবা সাহিত্যের রাজনীতি তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। যে কারণে তিনি অতি সরল ও সহজ জীবনযাপন করতে পেরেছেন। অতি সহজ-সরল ভাষাশৈলীতে সাজিয়ে তুলেছেন কবিতার শরীরকাঠামো। তবে কবিতার অন্তরে সহজ ভাবের আদলে তিনি আমাদের ইতিহাস-সামাজিকতা-নৈতিকতা বা সমাজের অবক্ষয়ের কথা বলে গেছেন। তাঁর ভেতরে সব সময় থেকেছে রোমান্টিকতা। তাঁর কবিতা পাঠে এই কথার সত্যতা মেলে।

তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ ‘রোদে ভিজে বাড়ি ফেরা’, ‘আপন আঁধারে একদিন’, ‘ও পার্থ ও প্রতিম’, ‘কফিনের লোকটি’, ‘প্রিয় রোকোনালী’, ‘মুমুর সাথে সারা দুপুর’, ‘অদৃশ্য মুখগুলো’, ‘যে আমাকে দুঃখ দিলো সে যেন আজ সুখেই থাকে’, ‘পাকশী লোকাল এক্সপ্রেস’ প্রভৃতি। তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘বিপরীতে অন্য কেউ’ এবং ‘মাকিদ হায়দারের গল্প’। তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘রবীন্দ্রনাথ : নদীগুলো’।

২০১৯ সালে কবিতায় বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান মাকিদ হায়দার। এছাড়া তিনি পেয়েছেন দেশের উল্লেখযোগ্য আরো অনেক সাহিত্য পুরস্কার।