কহর আলীর অলীক সুখ

আষাঢ় মাসের বরষার ধারা শ্রাবণেও বয়ে চলে; বৃষ্টির মেজাজমর্জি বোঝা বড় দায়। শুধু দিনভর বৃষ্টির ব্যাকুলতা। পথ, মাঠ ও খাল-বিল তলিয়ে যায়। বৃষ্টির দিনের সেসব সময় ভেজা কাকের মতো চুপসে থাকে। স্থবির হয়ে থাকে গ্রামীণজীবন। এমন সময় প্রায় নীরবে বিপ্লব ঘটায় প্রকৃতি। সতেজতা পায় গাছপালা, লকলকিয়ে ওঠে তাদের যৌবন। রমিজ খাঁ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ভাবেন, এবারের শ্রাবণ মাসের শেষের দিকটায় এসে যেন স্বস্তি মিললো খানিকটা। সকালে চৈত্র মাসের মতো চাঁদিফাটা রোদ তো বিকেল হতে না হতে বড় দানার টানা বৃষ্টি।

আকাশে চোখ রেখে তিনি তার পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে গিয়ে দেখেন, বিকেলেই মনে হয় সন্ধ্যা নামছে। বাঁ হাত দিয়ে তার গালের কালো চাপদাড়িতে হাত বুলান।

সাদা দাড়িতে কলপ মাখিয়ে কালো করার পর তার শরীর সুস্থতার আভাস পায় মনের মধ্যে। প্রায় মাসখানেক পর অশক্ত শরীরে বিছানা ছেড়ে দাঁড়ান সেখানে। মনের মধ্যে কী চলছে বোঝা না গেলেও কোড়া গেঞ্জির ভেতর দিয়ে ঘন ঘন শ্বাস হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে – সেটা বেশ বোঝা যায়। সকালের দিকে নাশতা খেয়ে ধীরপায়ে ঘরের আয়নার সামনে রাখা টুলটায় বসে ছিলেন একবার। চাকর কহর আলী রমিজ খাঁর চুল আর দাড়িতে
সে-সময় কলপ লাগিয়ে দিয়েছে। আগের রাতে জেগে থাকা সত্ত্বেও অশক্ত শরীরে দুর্বলতা থাকলেও মনের দিক দিয়ে তিনি কিছুটা সুস্থির বোধ করেন। এত বয়সে শরীরে উত্তেজনার পারদ না বাড়লেও মনের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে। ভাবেন, রাত শেষে ভোর হতেই বেরিয়ে পড়বেন বেদকাশীর উদ্দেশে। তিন ঘণ্টার পথের ঝক্কি সামলে নিতে পারবে – এমনটা মনে করেই শরীরের দুর্বলতা সরে যায় নিমিষে।

রমিজ খাঁ কহরকে ডাকলে সে সামনে দাঁড়ায়। এক মাস পর তার চোখেমুখে ফিকে হওয়া খুশি উপচে পড়ে। এই ডাকের অর্থ সকাল থেকেই বুঝতে পেরেছে কহর; তার মনেও খুশির ঝিলিক লাগে। শরীরে শিহরণ!কহর দাঁড়িয়ে জানতে চায়, কিছু বলবেন সাহেব?

– বহুদিন জমিজিরাত দেখাশোনা করা হয় না, পরের কাছে রেখে ভরসা করা যায় না। শরীরটা একটু ভালো লাগছে। জমির কাছে না গেলে শক্তি পাওয়া যায় না। ফজরের পরপর বের হয়ে বেদকাশী গেলে কেমন হয়?

কহর এসব কথার মানে বুঝতে পারে। তবু ছল করে বলে, কন কি বড় সাহেব, বৃষ্টি হওনের পর রাস্তার অবস্থা ভালো কি না কওন যায় না। প্যাঁক-কাদায় পা নামলেই ফসফস করে। আপনের শইলডাও তেমুন না। ধকল সইবো না। অনুমতি দেন তো আমিই গিয়া …।

কথা শেষ না করতেই ধমক দেন রমিজ খাঁ, যারপরনাই বিরক্ত। চাকরের এমন পরামর্শ নিতে তিনি ইচ্ছুক নন। বলেন, শোন কহর, তোরে দিয়া কোনো কাম করা আর মোরগ দিয়া হালচাষ করণ একই কথা। আর যদি কাম হইতো তাইলে মজুরই তো পাঠাইতে পারতাম। বেশি কথা কস তুই।

নুনপড়া জোঁকের মতো চুপসে যায় কহর। নিজের ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা লাফাতে থাকে। আজকাল সেও অস্থির। কাজে মন নেই, শরীরের ভেতরে কিসের যেন দামামা বাজে। কার মুখের ছবি যেন অস্থির করে তোলে। শরীর ম্যাজম্যাজ করে। কী জানি কী চায়।

বুঝতে পারে না কহর কীসের অশান্তি, মনের মধ্যে কী উচাটন করে।

সে নিজের কাজে মন দেয়। কিছু না বলে নিয়মমতো আলমারির কাছে এগিয়ে যায়। বড় সাহেবের পোশাক তাকেই সাজিয়ে রাখতে ও সহায়তা করতে হয়। রমিজ খাঁর স্ত্রী মমতাজ বেগম শয্যাশায়ী হওয়ার পর থেকেই এই বাড়তি কাজ কহরের জিম্মায় রয়েছে।

মমতাজ বেগম শুয়ে থেকেও পাশে থাকা রমিজের ছটফটানি টের পান। কোমর থেকে প্যারালাইজডের শরীর, অন্যের সহায়তা ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। কিন্তু মাথা তার সচল। টের পান তার স্বামী ছটফট করছেন। তিনি ওষুধের কারণে রাতভর জেগে থাকেন। ফজরের নামাজ কখনো কখনো পড়তে পারেন না। কারণ শেষরাত থেকে রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করে তার শরীরে। তবু চেয়েছিলেন কিছু কাজ করে স্বামীর সেবা করুক। নইলে পরপারে গিয়ে মালিকের কাছে কী জবাব দেবেন। রমিজ খাঁর পোশাক-পরিচ্ছেদে পরিবর্তন এসেছে।

সবকিছু আগেও পরিপাটি করে বাইরে বের হতেন। জুতা আর হাতের সম্বল লাঠির পাশাপাশি ইদানীং চোখে সুরমা, কানের লতি আর হাতের কবজিতে আতর লাগানোটা বাড়তি যোগ হয়েছে। মমতাজ বেগম মনে মনে ভাবেন, তাদের বিয়ের পরপর এমন সাজ দিতেন খাঁ সাহেব। দীর্ঘ বছর পর আবার একই বেশ। শুধু তফাৎ তখন মমতাজ বেগম সব গুছিয়ে দিতেন, এখন চাকরের সহায়তায় কাজ হয়। গভীর একটা দীর্ঘশ^াস ভেতর থেকে এলেও কিছু সন্দেহ আসে না তার মনে। গত কয়েক মাসে তার স্বামীর এমন পরিবর্তন চোখে পড়লেও আমলে নেন না মমতাজ। সে-সময় তিন-চার মাস রমিজ খাঁর হাঁকডাকে বাড়ির সবাই তটস্থ থাকতো। শুধু এমনসব পরিবর্তন নীরবে পর্যবেক্ষণ করতেন তার স্ত্রী। মাসের শেষদিকে দামি সুবাসিত আতরের গন্ধে শোবার ঘর ম-ম করে, ভাঁজ খোলা গিলে করা পাঞ্জাবি-পাজামা আর আচকানে ফিটফাট হয়ে বের হতেন ঘটা করে। সঙ্গে তার দেখভালের চাকর কহর আলী। দিন পার করে পরের দিন বাড়িতে ফিরলে ক্লান্ত রমিজ খাঁর আচ্ছন্নভাব চোখ এড়াতো না মমতাজ বেগমের।

রমিজ খাঁ কয়েকবার তার স্ত্রীকে কিছু জরুরি কথা বলবেন বলে জানালেও তা নিয়ে কথা হয়নি।  সব কথা বলার পক্ষপাতি নন তিনি। ঘরের বউ ঘর সামলালেও তার স্বার্থে কিছু আলোচনা করা যেতেই পারে – এমন নীতিতে বিশ্বাস করেন তিনি। বাড়িতে একজন খাস কাজের লোকের কথা বেশ কয়েকবার প্রসঙ্গক্রমে বলেছেনও রমিজ খাঁ; কিন্তু মমতাজের অনাগ্রহের কারণে তা আর হয়নি। তার স্ত্রীর ব্যক্তিত্বের কারণে সাহস করেননি। এই শরীরে পড়ে থাকলেও তার বনেদিয়ানা আর সৌন্দর্যে এতটুকু ভাটা পড়েনি। সংসারের অশান্তি এই বয়সে তিনি নিতে চান না।

রাতের খাবারে কয়েক টুকরো আপেল, পাতলা ঝোলের মুরগির মাংস আর ঝাউভাত নিয়ে খাওয়ার টেবিলে বসেন মমতাজ। পাশে রমিজ খাঁর পাতে একই খাবার দিয়ে জরিনা দাঁড়িয়ে থাকে। এ-বাড়ির বহু বছরের পুরনো কাজের লোক। রমিজ খাঁ মমতাজের উদ্দেশে বলেন, জরিনার কামকাইজে মনোযোগ নাই, ঠিকঠাক দেখভাল করতেও পারছে না তোমারে। ওরে ভিন্ন কামে লাগাও। নতুন একজনরে আইন্যা দিমু। তোমার বান্দি হিসেবে থাকবো আর সংসারও সামলাইবো।

– না? মমতাজ বেগম ঘাড় কাত করে প্রশ্নসূচক চোখে তাকাতেই বলেন, এ্যাই জরিনা চোখে কি কম দেহস আজকাল?

ভয়ে জরিনা হাতজোড় করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

এমনিতেই বড়সাহেবকে দেখলে ভূত দেখার মতো ছিটকে যায় সে। একটু কাঁটা হয়ে থাকে, একটু জোরে কথা বললে কলিজায় ঘাই মারে।

আমতা আমতা করে সে মমতাজের দিকে তাকিয়ে থাকে।

রমিজ খাঁ হাতের আঙুলে একটা লম্বা চুল পেঁচিয়ে নিয়ে বলেন, কাজে তো আর মন নাই, বয়স হইছে, চোখেও কম দেহস। সংসারটা উচ্ছন্নে যায়; চারদিকে শ্মশান সব, চোখ বন্ধ করলেই বারো ভূতে লুটে নিয়ে যাবে। এত সম্পত্তি দেখার কেউ নাই।

রমিজ খাঁর আচমকা এই আচরণে মমতাজ বেগম ভড়কে যায়, তার মনটা এমনিতেই খারাপ থাকে পরনির্ভরশীলতার জন্যে। তার ওপর এমন কথায় কঠিন চোখে তিনি তাকিয়ে থাকেন জরিনার দিকে।

রমিজ খাঁ মনে মনে একটু আরাম বোধ করেন। তিনি ভাবেন, ভবিষ্যতের একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছে।

রমিজ খাঁর রাতের আচরণ আর এমন পরিবর্তন অসহায় করে তোলে মমতাজকে।

এবার ফেরার পর রমিজ খাঁর শরীর ভাঙতে থাকে। এরপর শরীর জুত পায়নি আর, শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।

সারাদিন শুয়েই থাকেন মমতাজ বেগমের বিছানার উল্টোদিকের পেল্লায় সাইজের দ্বিতল পালংকে। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে তার চোখজোড়া কখনো কখনো চিকচিক করে ওঠে। শরীরে কোনো পরিবর্তন না এলেও মনে পুলক জাগায় কিশোরী হুরবানুর সারল্যে ভরা মুখটা। তার সঙ্গে কাটানো সময়ের স্মৃতি।

বেশ কয়েক মাস ভালো চললেও শরীরের ক্রমশ অবনতি হতে থাকে। বিছানায় শুয়ে থাকা রমিজ খাঁর ক্রমবর্ধমান গতিতে বাড়তে থাকা ভাবনা পৌঁছায় ফিসফিস করে কহরের কানে। কহর পরদিন সকালে ছোটে হুরবানুর কাছে মাসিক খরচের টাকা নিয়ে। বেলাশেষে বাড়িতে ফেরে কহর। চোখে আনন্দ থইথই করে।

সদর দরজার বাইরে-ভেতরে নানা বয়সী মানুষের চলাফেরা আর কথাবার্তায় গমগম পরিবেশ। জেয়াফতের বাড়িতে নানা খুচরো কাজ থাকে।

ফাই-ফরমায়েশ খাটতে এসেছে গ্রামের কিছু দরিদ্র মানুষ। বৈঠকখানায় আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত নিশ্চিত হলে তারা পেটে-ভাতে খেয়ে কোনো কোনো বাড়ির নানা অনুষ্ঠান গুছিয়ে দেয় দৈনিক মজুরির বিনিময়ে নয়, যে যা দেয় সেই চুক্তিতে। মজু মন্ডলের ঈশারার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে তারা।

এমন সময় মাথায় হিজাবপট্টি বেঁধে সবার চোখের সামনে দিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে বাঁধানো দুটো সিঁড়ি পার হয়ে দাঁড়ায় আগন্তুক। পরনের সুতির জংলা ছাপার শাড়ির আঁচল দিয়ে শরীরটা ঢেকেঢুকে ঘেমে ওঠা মুখ মুছে নেয় সে। ঘরের দরজায় দাঁড়ানো শ্রমিকগোছের কয়েকজন তাকে দেখে সরে দাঁড়ায়। প্রায় ঠেলে বৈঠকখানার মাঝখানটায় চলে আসে সে।

– এ্যাই কী চাও?

আলাচনার মধ্যমণি বক্তৃতারত ব্যক্তিটির চোখের ঈশারায় তার সামনে দাঁড়ানো মজু মন্ডল জানতে চায়।

 ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে দাঁড়ায় হুরবানু।

মজুর মেজাজ খারাপ হয়, খেঁকিয়ে উঠে বলে, কারণ কী? কাজের বেটি লাগবে না মোগো। আগেই ঠিক হইছে।

হুরবানু কোলের শিশুটির নাকে শুকিয়ে থাকা গ্লিসারিনের মতো বর্ণহীন সিকনি মুছে দেয়।

গভীর একটি আলোচনা সহসা থামিয়ে দেয় বক্তা ও শ্রোতা। খাঁ বাড়ির খাজাঞ্চি মজু এগিয়ে এসে আগন্তুক নারীর দিকে প্রায় ঝাঁঝিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে জানতে চায়, কী চাস?

নারীটি ঠায় দাঁড়িয়ে উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে নিজের ওপরের ঠোঁট চেপে ধরে নিচের ঠোঁট দিয়ে। পলকে দেখে নেয় শিশুটির চেটে খেতে থাকা নোনতা তরল সিকনি।

রমিজ খাঁর বড় ছেলে সোলেমান খাঁর চোখের ইশারায় মজু মন্ডল গম্ভীর স্বরে সোজাসুজি বলে, এই ছেমড়ি, কী চাও? উপস্থিত সবাই চুপ থাকলেও তাদের কারো কারো চোখ কিশোরীর মুখ আর স্তনের দিকে চরকির মতো ঘোরে। বৈঠকখানায় বাড়ে ফিসফিসানি।

সোলেমান খাঁর দিকে তেরছাভাবে তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ চোখ নামিয়ে সে বলে, আমি হুরবানু বেগম। সাকিন …

কী চাও বলেই সোলেমান ঘরের সবার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে মজুকে ইশারা করে চোখের, যার অর্থ – খবর নিতে হবে।

রমিজ খাঁর চেহলামের দিন  গ্রামের নিমন্ত্রিত সবাই ছিল। দিন কয়েক আগে ঢ্যাঁরা পিটিয়ে কয়েক দফায় রমিজ খাঁর চেহলাম খাওয়ানোর খবর পৌঁছে দিয়েছে খাঁ বাড়ির চাকর কহর আলী। গোটা দশটা মহিষ আর পঞ্চাশটা ছাগল জবেহ হয়েছে। কথা ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে, লোকমুখে। মৃত বাবার আত্মার শান্তির জন্য দান-খয়রাতেরও খামতি রাখেনি ছেলেরা। সকাল দশটা থেকেই অনেকে আগে এসে জায়গা করে নিয়েছে। কারো বোঁচকা-বাটিও জায়গা বন্ধক রেখে ইতিউতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। পূর্বাভিজ্ঞতার জেরে অতিসতর্কতায় কেউবা জেয়াফতে খেতে এসে নিজেকে তরকারির গামলা উপচানো তেলঝোল থেকে বাঁচাতে এককোণে বসে দোয়া-দরুদ পড়ছে। সকাল থেকেই মাইকে মাদ্রাসার ছাত্রদের দিয়ে কোরআন তেলাওয়াত করানো হয়।

চৌদ্দ গ্রামের আশপাশের মানুষ আসছে। জেয়াফতের দিন নানা কথা ছড়ায় বাতাসে, কেউ কেউ তার দীর্ঘদিনের শয্যাশায়ী স্ত্রীর মৃত্যু হয়নি অথচ এক বছর বিছানায় থেকে মৃত্যু হয়েছে রমিজ খাঁর – এসব নিয়েও আফসোস করে। আলোচনায় উঠে আসে রমিজ খাঁ। কেউ কেউ উঁহু-আহা করল, কেউ কেউ বলল – আহা বড় ভালো মানুষ ছিল। কেউ বা বলল, মাটির মানুষ হলে কী হবে, পোলাপাইনরে  মানুষ করতে পারে নাই। কেউবা আফসোসের সুরে বলল, আহা দীর্ঘ রোগভোগের পর কষ্ট পেয়ে ইন্তেকাল করছেন।

মজমা করে নানা অছিলায় আলোচনা খাঁ বাড়ির আঙিনা ডিঙিয়ে ঘুরে বেড়ায় গ্রাম ছাড়িয়ে সমাজ ছাড়িয়ে
রাষ্ট্র-বিশ্বভাবনায়।

সার্মথ্যমতো ধোয়া-কাচা পোশাক পরে, কেউবা ক্ষেতে কাজ করে,

লাঠি-বাটি-গামছা নিয়ে নানান কিছিমের মানুষ আসতে থাকে খাঁ বাড়িতে। প্রভাব ও প্রতিপত্তিতে শান লাগিয়ে ক্ষমতাধরও ছিলেন রমিজ খাঁ। ফলে সুহৃদের অভাব যেমন ছিল না, বিরোধী যারা ছিল তারাও রমিজ খাঁর কাছে তো বটেই, তার ছায়াও মাড়াতে ভয় পেত। 

আগত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তদারকি করছিল রমিজ খাঁর ছেলেরা। জেয়াফতে আসা মানুষগুলো আপ্লুত হয়ে পড়ে। তারা সবাই শিক্ষিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত – এমন কথা বলা হলেও তাদের নাক উঁচু ভাবের কথা লোকমুখে চর্চিত। পাশের গ্রাম থেকে আসা করিম জোতদারকে ঘিরে, খাবার কেমন হয়েছে, কিছু লাগবে কি না – এসব আর রমিজ খাঁর ছেলেমেয়েরা কেমন, তাদের হালহকিকত – এসব প্রসঙ্গেও চলে কথা। নব্য ধনী কাদের শেখ একটা প্রসঙ্গ তুলে নিজের দিকে মনোযোগ এনে বলেন, বুঝলেন মিয়াভাইসব, কয়দিন আগে এক মরার বাড়িতে পোলাও, রোস্ট আর গরুর গোশত খাওন দিছে। বিয়াবাড়ির আয়োজন। ওইহানে থাকতেই দেখলাম কেউ একজন আবার বিরিয়ানির প্যাকেট পাঠাইছে। কারবারডা দেহেন একবার। মরার বাড়ি কি মুরোদ দেহানের জায়গা? কার কত দেওয়ার মুরোদ, পেছনে চলে এমন তুলনা। কে কী করে তার প্রতিযোগিতা।

উপস্থিতিদের কেউ বলে, কথাডা কিন্তু ঠিকই। অন্যরা মাথা নাড়িয়ে তাতে সম্মতি জানায়।

খাঁ বাড়ির উল্টোদিকে রাস্তার ওপারে প্রতিষ্ঠা পাওয়া প্রাইমারি বিদ্যালয়ের বেঞ্চ আর টুল পেতে দেওয়া হয়েছে বাড়ির উঠোনে। উঁচু-নিচু বলে কোনো কথা নেই, আসন পূর্ণ হলেই খাওয়া শুরু হয়। কয়েক দফা খাওয়া চলছিল। খাঁ বাড়ির ভেতরের এক অংশে নারী ও শিশুদের জন্য মেঝেতে বিছানার চাদর পেতে খাবার পরিবেশন করা হয়েছে।

কানে-মুখে কথা চালাচালি করে উত্তরদিকের খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে-বসে থাকা আগত নারী ও শিশু।  গ্রামের মানুষের অদম্য কৌতূহল থাকে অচেনা কাউকে দেখতে পেলে। বারান্দার পাশেই এক কোনায় জনা পনেরো নানা বয়সী নারী কৌতূহলী চোখে কোলে বছরখানেকের শিশু নিয়ে বসে থাকা নারীকে দেখছে। ঘুমন্ত শিশুর মাই খাওয়া ঠোঁটের কাছে একটা মাছি বারকয়েক ঘুরে দূরে সরে গিয়ে আবার ফিরে আসে। নিজের মনেই সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে হুস হুস করে তাড়ানোর চেষ্টা করে ক্ষান্ত দেয় হুরবানু। কিন্তু অচেনা নারীর পরিচয় পেতে তাদের তলপেট ভারী হয়ে ওঠে। মনোযোগ অন্যদিকে রাখতে পরিচিত কহরকে ডাকতে গিয়ে টের পায় সবাইকে চেনে, উৎসুকদের আগ্রহ দেখে হুরবানু ভেবে পায় না, ঠিক পরিচয়টা কী দেবে। নাকি কিছুই বলবে না। তার তলপেটের চাপ সবকিছুকে ভুলিয়ে দেয়। সমবয়সী একজন মেয়ের সাহায্যে অদূরে কলতলার পাশে থাকা পায়খানায় শিশুটিকে নিয়ে হুরবানু ঢোকে। সে মনে মনে সাজিয়ে নেয় তাকে খেতে হবে, এ-বাড়িতে তার অবস্থান জানান দিতে এটাই উপযুক্ত সময়। হুরবানুর স্বামীর বাড়িতে আসার সময় মায়ের দেওয়া উপদেশ কানে বাজে। সে ঠিক করে কোনো একজন মেয়েমানুষের কাছে নিজের পরিচয় তুলে ধরবে।  স্বামীর বড় ছেলে সোলেমান খাঁর গনগনে আগুনের মতো ঠিকরে পড়া চোখ দেখে পথে আসতে গিয়ে যা সাজিয়েছিল জনসমক্ষে তা আর বলা হয় না। ভাবে, যে-মানুষটা এই অকূল পাথার থেকে বাঁচাতে পারতো সেই কহরের দেখাও মেলে না।

নিজের ও ছেলের শরীর হালকা করে সামনের কলতলা থেকে মুখে পানি দিয়ে হুরবানু বসে শানের চাতালে। ভাবে, গরিবকে বড় স্বপ্ন দেখতে নাই। বামুন হইয়া চান্দে হাত দেওনে যে কপালডা পুড়বো – এইটা সবাই জানে।  তার রাগ গিয়ে পড়ে লোভী মা আর বাপের ওপর। লোভে চকচক করা চোখগুলোকে প্রায় কোটরের বাইরে নিয়ে এসে হুরবানুর বাপ তার মায়ের মুখের ওপর বলেছিল, ক্যাঁ মোর মাইয়া কি দ্যাখতে খারাপ? খাঁ সাহেবের ঘরে ভালোই মানাইবো! পটের বিবি হইয়া থাকবো। খাওনের অভাব থাকবো না।

অভিমানে চোখে পানি আসে হুরবানুর। তার নাকি জোছনার মতো রূপ? পেটে তো দানা নাই। এ্যাই রূপ দিয়া কি মুই পানি খামু? বুইড়ার কাছে বিয়া বমু না মুই – চিৎকার করে মায়ের মুখের ওপর কথাগুলো বলেছিল সে।

তার কথা আমলে নেয়নি কেউ। সন্ধ্যা হতেই কহরকে সাক্ষী করে গ্রামের এক মৌলভি বিয়ে পড়ান, কেউ সেই বিয়ের আসরে শামিল হয়নি। গোপনে সব করা হয়। মৌলভির শেখানো কবুল না বলেই দৌড়ে ঘরে গিয়ে গোলপাতার বিছানায় শুয়ে পড়ে হুরবানু। তার শরীরে কি যেন নড়াচড়া করে, ঘুমের মধ্যে টের পায়। কিন্তু অন্ধকার ঘরে ঠাহর করা যায় না। মা মা অ মা … অস্ফুষ্ট কণ্ঠের সে-ডাক থেমে যায় কারো ভারী হাতের চাপে। টের পায় শরীরে তারচেয়েও বেশি চাপ আর ব্যথার উপস্থিতি।

হুরবানুর গলা শুকিয়ে আসে ভয়ে। গ্রামের মুখরা মেয়েটা যে-সাহস নিয়ে এ-বাড়িতে এসেছিল তার এই অবস্থা জোঁকের মুখে নুন পড়ার মতোই। তার মায়ের শিখিয়ে দেওয়া কথাটাই মনে পড়ে, বারবার করে বলে দিয়েছেন, যেন সবাইকে বলে, কোলের শিশুটির বাপ রমিজ খাঁ। কতশত বিঘা জমির মালিক তার স্বামী জানে না। কিন্তু এই বয়সে এতটুকু বুঝেছে, বিয়ের সময় মায়ের দেখানো স্বপ্নের তিন বেলা চিকন চালের ভাত আর মাছ-মাংস-দুধ খেতে পারবে না। পরনে থাকবে জরির শাড়ি, গা-ভর্তি সোনার গয়না – সেটাও হবে না। ছেঁড়া কাঁথায় মোড়ানো গোলপাতার বিছানায় নয়, ঘুমাবে তুলোর নরম বালিশ-বিছানায় – সেসবও স্বপ্নমাত্র।

দুপুরে জমায়েতে খাবার জুটেছিল। রাতে জরিনা এসে জানতে চেয়েছে তার পরিচয়। রাতে স্বামীর নাম মুখে আনতে চায়নি। ভোর হলেই চলে যাবে নাকি ছেলের অস্তিত্ব রাখবে, তা বুঝতে পারছিল না।

শেষ দিনগুলোতে জমিজিরাত থেকে বাৎসরিক টাকা আদায় করতে কহর আলীকেই যেতে হতো। হুরবানুর জন্য তার মন খারাপ হয়, গরিবের ঘরের চাঁদ তার জীবনে এনে অমাবস্যায় ঘিরে দিয়েছে।

অজুহাত নিয়ে এসে দাঁড়ায় মমতাজ বেগমের সামনে। কহর বলে, বড় আম্মা, কতদিন হয়ে গেল বড় সাহেব নাই। আপনের দেখভালের লেইগ্যা বেদকাশীতে দুজন মাইয়্যা রাখছেলেন সাহেব।

সে বলে, গরিব ঘরের একজনকে বড় সাহেব পছন্দ করে গেছেন, কাজের জন্য, তিনি অনুমতি দিলেই আনতে পারে।

রমিজ খাঁর জায়গাজমির আদায় নিয়ে না জানলেও এ-সম্পর্কে সে ওয়াকিবহাল।

বিছানায় এলিয়ে শুয়ে থাকা মমতাজ ওর দুরভিসন্ধিটা বুঝতে না পেরে জানতে চাইল বাৎসরিক কী পরিমাণ টাকা ওইখান থেকে পাওয়া যায়। মাসিক খোরপোশ নিয়মিত কহরের হাতে দিয়ে পাঠাতো খাঁ সাহেব। দরকারে-বেদরকারে নানা ছুঁতোয় কহর ছুটে গেছে।

বেদকাশী। আংটি হারা গ্রামের কিছুটা ভারী গড়নের ফর্সা চৌদ্দ বছরের হুরবানুকে দেখে মুগ্ধ বৃদ্ধ রমিজ খাঁর থিতিয়ে যাওয়া চোখ যেমন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল, তেমনি কহরের মনেও রঙের পরত ছড়িয়েছিল। গভীর দীর্ঘশ^াস মেখে কহরের মনে হলো, এই মেয়ে জোনাকপোকার মতো জ¦লে আর অনুচ্চ স্বরে কথা বলে।

কহরের মনে পড়ে হুরবানুর বিয়ের প্রস্তাব নয়, কাজে সহায়তা করার প্রস্তাবটা এসেছিল। রমিজ খাঁর কাছে হুরবানুর বাপের বিয়ের প্রস্তাবটা যেন আকাশের চাঁদ হাতে এসে ধরা দিয়েছিল। পাঁচ বিঘার ওই খাসজমি হুরবানুর নামে মোহরানা দেওয়ার শর্তে মৌখিকভাবে ধার্য করে বিয়ে করে। মুখে মুখে বাড়িতে মসজিদের হুজুর ডেকে বিয়ে করেন তিনি কিন্তু শর্ত রাখে বিষয়টা গোপন রাখতে হবে। সময় ও সুযোগ পেলে তিনি ছেলেমেয়েদের কাছে প্রস্তাবটা রাখবেন। তারা অসুস্থ মায়ের জন্য সেবাদাসী পেলে অমত করবে না, এমন শর্তের ভিত্তিতে।

কয়েকবার রমিজ খাঁ হুরবানুদের বাড়িতে যেতে পেরেছিল। বিছানায় পড়লে তিনি না গিয়ে কহর আলীকে দিয়ে খোরপোশের টাকা পাঠাতেন। খোঁজ রাখতেন। তার অজান্তে গোপনে বাড়তে থাকে কহর আর হুরবানুর ঘনিষ্ঠতা। হুরবানু গর্ভবতীর খবর কহর মারফত জানার পর থেকে বৃদ্ধ রমিজ খাঁ লোকলজ্জার ভয়ে আর আতঙ্কে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।

সবাই বিদায় নিলে হুরবানু চারপাশে তাকায়। ঘরগুলো তাদের গোলপাতা ছাউনি দেওয়া ঘরের মতো নয়, খুশিতে আর আনন্দে হুরবানুর দীর্ঘপথ শঙ্কা, ভয় আর উৎকণ্ঠা নিয়ে হেঁটে আসার ক্লান্তিকে ভুলিয়ে দেয়। কল্পনায় দেখে এই পুরো বাড়ির মালকিন সে। আসতে পথে যতদূর যায় সব জমিজিরেত তার, হিরে-জহরতে মোড়ানো থাকবে তার শরীর। দাসী-বান্দি পায়ের কাছে লুটিয়ে থাকবে। যা খেতে চাইবে সব মনে মনে বলতেই হাজির হয়ে যাবে সামনে – সুখ আর সুখ। বেহেশতখানা তো এই দুনিয়াতেই পাকাপোক্ত করে দিয়েছে খোদাতায়ালা। মনে মনে শোকরানা আদায় করতে ভোলে না সে।

দুধের ছেলেটাও বিরক্ত করে নাই। খায় আর ঘুমায়। রাতে কেউ এসে খাবার দেয়নি।

এ-বাড়ির কতশত সুনাম লোকমুখে শুনেছিল। রমিজ খাঁ ইন্তেকাল করেছেন। কেউ খোঁজ দেয়নি। বাপ আর মায়ের পরামর্শে একাই অধিকার আদায় করতে, স্বীকৃতি পেতে এসেছে। এখানে এই স্বীকৃতি সনদ দেওয়ার একমাত্র সাক্ষী কহর আলী। তাকে একবারও চোখে পড়েনি।

সোলেমান খাঁ রমিজ খাঁর নয় ছেলেমেয়ের মধ্যে বড়। চেহলাম সুষ্ঠুভাবে আয়োজন নিয়ে, কে কীভাবে সামলাবে, কার কী দায়িত্ব – তা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত সবাইকে দায়িত্ব দিয়ে নিজের ঘরে বিশ্রাম নিতে গিয়েছিল। আগন্তুকের উপস্থিতি আর চাহনি সে ভালোভাবে নেয়নি। এমনিতেই তাদের সম্পত্তি চারদিকে ছড়ানো-ছিটানো। শত্রুরও কমতি নেই।

অনেকে হাঁ বাড়িয়ে আছে সম্পত্তি লুটে নিতে। সবসময়ই তার ভয় ছিল বৃদ্ধ রমিজ খাঁর অসুস্থতার সুযোগে তার সর্বনাশ হয়ে যায় কি না।

প্রথমটায় রমিজ খাঁর এতসব জমিজমা সম্পত্তির ভাগ বসাতে তাদের কোনো শত্রুপক্ষ এই নারীকে এখানে এনে নাটক তৈরি করার চেষ্টা করেছিল – এমনটাই মনে করেছিল সোলেমান খাঁ। কিন্তু সন্ধ্যার পর তার মায়ের রুমে তার ডাক পড়ায় পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল সব। দিনের আলোতে বুঝেছিল একটা রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। সে চায়নি এটা নিয়ে হল্লা হোক, কথার ডালপালা ছড়াক। মজুকে দিয়ে পরিবারের সবার অগোচরে সোলেমান খাঁর রুমে ডেকে আনায় হুরবানুকে।

সোলেমান তাকাতেই কলিজা কেঁপে ওঠে হুরবানুর। ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এখানে আসার কারণ জানতে চাইলে আস্তে করে জানায়, কিসলু এই বাড়ির বংশধর। মুহূর্তে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে বিশাল ঘরটায়। বাইরের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে হুংকার দিতে গিয়েও দেয় না সোলেমান। সে বাইরে থাকা মজুকে দিয়ে সরিয়ে দেয় তাকে।

কহর আলী সেই দুপুরবেলা থেকে ঘুরতে থাকে বনবন করে। কখনো বাড়ির ভেতরে কখনো বাইরে। সব জায়গা মানুষে গিজগিজ করছে। চেহলাম থাকায় বাড়তি কামলা এসেছে, আবার রমিজ খাঁর ছেলেমেয়েদের ব্যক্তিগত দাসীবাঁদিরও আনাগোনা আছে। তাই কহর পৌঁছাতে পারে নাই হুরবানুর কাছে। ওর বুকের ভেতরে হৃদপিণ্ডটা ঢাক্ ঢাক্ করে শব্দ করছে। কানের ভেতর ভোঁ-ভোঁ শব্দ করছে থেমে থেমে। চোখে ভাসছে – একটা বড় গর্ত করা হয়েছে খাঁ বাড়ির পেছনে থাকা খড়ের গাঁদার কাছে। আর হাতজোড় করে বেঁধে, গরুর তুরি দিয়ে মুখ বাঁধা কহরকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হচ্ছে।

সন্ধ্যা গড়াতেই জমজমাট খাঁ বাড়িতে লোক কমে আসে। নিয়মিতভাবে যার যার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে পরিবারের সদস্যরাও। এতবড় বাড়িতে পরিচিত কাজের সহায়তাকারীদের কাছে মমতাজ বেগমকে রেখে যাওয়া দস্তুর নয় বলে পারিবারিক বৈঠক ডেকেছে সোলেমান। টাকা ছিটালে লোকের অভাব হবে না। কিন্তু সোলেমান এ-তল্লাটে কাউকে তিল পরিমাণ বিশ^াস করতে পারে না। তার মনে হয়, সবাই স্বার্থের জন্য কাছে আসে। সে বিশ^াস করে, সম্পত্তি ও বনেদিয়ানা রক্ষা করতে কঠোর ব্যক্তিত্ব দরকার। পাশাপাশি শক্ত হাতে ধরতে হবে বংশ ও সম্পত্তির হাল। সে বৈঠকে যায়নি। আপস করতে হবে জেনেও এ-ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে মেনে যাবেন পরিবারের সিদ্ধান্ত।

সারাদিন নাওয়া-খাওয়া হয়নি, অপরাধীর মতো বাড়ির পেছনের বাগানে ঘুরেফিরে এসেছিল কহর। খাঁ বাড়ির পেছন দিকের পুকুরপাড় ঘুরে নিজের ডেরায় ঢুকতেই ডাক পড়ল সোলেমান খাঁর ঘরে। খাঁ বাড়ির ইজ্জতে হামলা করতে যে হুজ্জত হিসেবে এসেছে এর পেছনের রহস্য আর কেউ না জানলেও কহর আলী সব জানে।

কহর আলী হাতজোড় করে দাঁড়ায় সোলেমান খাঁর সামনে। রমিজ খাঁর এই ছেলেকে যমের মতো ভয় করে সে। একবার ডাক শুনলেই মনে হয় পিলে চমকে যায়। বুক দুরুদুরু কাঁপতে থাকে অন্য সময়। দরকার না পড়লে সোলেমান খাঁর সামনে পড়তে চায় না  কহর। সকালের দিকে আসা আগন্তুকের বিষয়ে জানতে চায় সোলেমান খাঁ। এই ঘটনার সাক্ষী থাকলেও কোনোভাবেই এর স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না। কহরের দিকে তাকিয়ে বলে, সকালে যে বিষের দানা আর গাছ আসছে তারা কারা? বুড়া বয়সে বাপে এমন বিছন রেখে যাবে কস্মিনকালেও ভাবেনি সোলেমান। তার বিরক্তিতে মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যায়। গলা খাকাড়ি দিয়ে বলে, বিষদাঁত ভাইঙ্গা ফালাইলে কেউ কি জানবো কহর? কিছু সময় নীরবতা নামে ঘরের কোনায়, আগন্তুকের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে, রমিজ খাঁ তার বাৎসরিক বর্গাদার কৃষক ও মৌসুমি জেলে ইয়াকুব আলীর মেয়েকে বিয়ে করেছে। সেই গ্রামের অধিকাংশ মানুষের জীবিকা এরকমই। ইয়াকুবের মেয়ে হুরবানুকে চোখে পড়তেই স্ত্রীর খেদমতের জন্য নিয়ে যেতে চাইলে চতুর ইয়াকুব সমাজের দোহাই দিয়ে বিয়ে করে দাসীর মতো রাখার প্রস্তাব দিয়ে বসে। এটাই সঠিক মনে করে তার দীর্ঘদিনের উপোস শরীরের চাহিদাকেও সায় দেয়। ইয়াকুবের কৌশলে সহসাই রাজি হয়ে যান রমিজ খাঁ।

রাত বাড়তেই ঝিল্লি আর জোনাক পোকার স্বাধীনতা বাড়ে খাঁ বাড়ির ভেতরবাড়িতে। নীরবতা বাড়ে। কহর আলী ডেরায় নয়, সবার অগোচরে ঠাঁই নেয় বর্ষাকালে রান্নার আপৎকালীন স্তূপ করে রাখা খড়িবোঝাই মাচাংয়ে। কাঠের সিঁড়িটা তুলে নেয় ওপরে। ঘুমাতে নয়, সেখানে তার লুকিয়ে থাকার আশ্রয় মনে করে সে। বেলা ওঠার আগেই পালাতে চায় খাঁ বাড়ি থেকে। তার ভয় হতে থাকে নির্যাতনের চোটে হুরবানু তাদের সম্পর্কের কথা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। এ-বাড়িতে দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে জানে, স্বয়ং খোদাও মৃত্যুর হাত থেকে কহরকে বাঁচাতে পারবে না। এ-বাড়িতে গুমের ঘটনাও জানে সে। বুঝতে পারে, তার মরণ খুব নিকটে। আজ রাতটা তার শেষ রাত হতে পারে। কান খাড়া করে বসে থাকতে থাকতেই ক্লান্তিতে ঝিমুনি আসে তার। রক্তচোষা বাদুরের মতো চুপটি করে কহরের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বসে থাকে মশা। ভিমরুলের চাকের মতো মশার ঝাঁক ঝাপসা আলোয় বৃত্তাকার হয়ে ভনভন করে।

রাত যত গভীর হয়, তত সে চমকে ওঠে। উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে মড়ার মতো। নট নড়নচড়ন, হঠাৎ সড়সড় করে কিছু একটা তার শরীর বেয়ে চলে যায় ওপাশে, সে নড়ে না। একবার মনে হয়, চালা ঘরটা প্রচণ্ড দুলছে। তার পিলে চমকে ওঠে। সে মনে করে, আল্লাহর গজব তার ওপর নাজিল হয়েছে। অতিশিগগির আজরাইল তার জান কবজ করার জন্য চলে আসবে। হকচকিত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই তার মাথা দোচালা ছাদে ঠেকে গিয়ে জোরে শব্দ হয়। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় কহরের। টের পায় টিনের চালে বিছিয়ে থাকা গাছের ডাল বাতাসের তোড়ে কটকট করে ওঠে। একটা মৃত্যুগন্ধী বাতাস তার নাকে এসে ধাক্কা মারে। ভয়ে আর আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে খেই হারিয়ে ফেলে হঠাৎ করে মাটিতে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।

তার মনে পড়ে, সোলেমান খাঁ যখন রমিজ খাঁর ব্যবহার করা আরাম কেদারায় বসে চুরুট মুখে দিয়ে কায়দা করে ঠোঁটের বাঁ-দিকে নিয়ে টান দিতে দিতে ডাকে, কহর …। কহর আলী বিষম খাওয়ার পূর্বে গলার ভেতর সুড়সুড়ি ওঠার মতো কাশি দিতে থাকে অনবরত। খরচোখে তার দিকে তাকিয়ে সোলেমান খাঁ নিশ্চিত হয়, মনে মনে বলে, সবকিছু জানে হারামজাদা। ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে কাঠের তৈরি মোটা আর ভারী থামের দিকে তাকিয়ে জানতে চায়, কহর আমার বাপের নিমক খাইছিস তুই। যখন লঞ্চঘাটে কুত্তার পাশে শুয়ে থাকতি, খিদার চোটে ভিক্ষা করতি, তোকে এই খাঁ বাড়িতে ঠাঁই দিয়েছিলাম আমি। মনে আছে তোর? হংকার দিয়ে কথাগুলো বলে সোলেমান খাঁ।

কাঁপতে কাঁপতে কহর বলে, জি হুজুর, সব মনে আছে।

– তাহলে?

– হুজুর, মোর কোনো দোষ নাই। বড় হুজুরের লগে মুই যাইতাম, সত্য; কিন্তু মোরে বড় হুজুর কিছু জানান নাই। চামড়ার চোক্ষে মুই দেহিও নাই কিছু।  

ক্রোধে সোলেমান খাঁ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বাঁ হাত দিয়ে কহরের ঘাড় ধরে এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে দেয়। জবাই করা গরুর মতো চোখ বড় বড় করে তাকায় বছর ত্রিশের কহর। কহর প্রমাদ গোনে, তার মনে হয়, এখানেই তার মৃত্যু হবে।

সোলেমান খাঁর বাঁ পা জড়িয়ে বলে, হুজুর সত্যই মুই কইতে আছি, মুই কিচ্ছু জানি না।

সোলেমান খাঁ হুঙ্কার দিয়ে বলে, সত্য কথা ক হারামজাদা। আমাদের বংশের সম্মানে যা কিছু বদ সামনে আসবে তা বিনাশ করে দেবো; নির্বংশ করে দেবো।

কহর তোতলাতে তোতলাতে বলে, বড় হুজুররে ফাঁসায় দিছে এই মাগির বাপ। হেয় বান্ধা জমি হাসিল করতে মাইয়ারে বিয়া দিছে। বলেই কহরের হৃৎপিণ্ডের ধড়াস ধড়াস শব্দ তার পায়ের পাতা পর্যন্ত জানান দিয়ে যায়। লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালেমিন। মনে মনে বলে, এইবারের মতো বাঁচতে পারলে জীবনে কোনোদিন আর মিথ্যা কথা বলবে না সে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে। যদি হুরবানু তার সন্তানকে বাঁচাতে পারে – মান্নত থাকল ষাটগম্বুজ মসজিদে পাঁচশো টাকা।

সোলেমান খাঁ ফুঁসতে থাকে, হারামজাদা, তুই সব জানোস, আমাদের জানালি না কেন? তোরেসহ এই বাড়ির মাটিতে পুঁতে রাখবো ওই ছেনাল মাগি আর ওর পোলারেও।

রাত যেন থমকে রয়েছে। টিনের চালে সরসর আওয়াজ হয়, কহর ঝিমুচ্ছিল, ধড়ফড় করে নড়ে চোখ মেলে। মনে পড়ে, সোলেমান খাঁর হাতের চাপে তার ঘাড় ছিঁড়ে যাচ্ছিল। চাবুকটা অজগর সাপের মতো দুলতে থাকে সোলেমান খাঁর হাতে। এলোপাতাড়ি চাবুক পড়ছিল শরীরের নানা স্থানে। ভোর হওয়ার আগেই হুরবানু আর তার শিশুকে বাড়ির পেছন দিকে জ্যান্ত কবর দেওয়ার আদেশ দিয়ে মৃতপ্রায় কহরকে লাথি মেরে উঠানে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। কতক্ষণ উঠানে পড়ে ছিল, জানে না কহর। জ্ঞান ফেরার পর প্রথমে বুঝতে পারে না – বেঁচে আছে কি না। যেভাবে চাবুকের মার খেয়েছে, তাতে বাঁচার আশা করেনি কহর। তার শরীরের হাড় ও মাংসের কোষে কোষে অসহ্য ব্যথা অনুভব করে সে।

সময় কত তা জানে না। হঠাৎ চিমটি কাটতে গিয়ে হাতে নখের অগ্রভাগ খানিকটা দেবে গিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়া অনুভব করে কহর। হৃৎপিণ্ডটা বন্ধের উপক্রম হয় তার। দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার পাশ দিয়ে উল্টে রঙ্গন গাছে ঘেরা বাগানের ঝোপে নিজেকে সরিয়ে নেয়। তখনই চিৎ হয়ে আকাশের দিকে চোখ পড়ে তার। স্থির হয়ে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয়, বাঁচতেই হবে যে কোনো মূল্যে।

হুরবানুর শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে থাকা ছেলেটা কঁকিয়ে ওঠে। ঘোঁৎ শব্দে একটা ব্যাঙের ডাক রাতের নিস্তব্ধতা কিছুটা চিড়ে দেয়। কহর কান্নার শব্দ শুনে ঠাহর করে তাদের অস্তিত্ব। চোয়াল শক্ত হয়ে ফুলে ওঠে গলার শিরা। চোখের কোণে নোনা জলের উপস্থিতি টের পায়। তার মনে হয়, মরলে শহিদ, বাঁচলে গাজি। ক্ষিপ্রতার সঙ্গে লাফ দিয়ে নামে সে। খানিকটা গিয়ে দু-হাতের তালুতে ভর দিয়ে লাফ দেয় ঘরের জানালা লাগোয়া মাটির ভিটিতে। দেখে ঘরের দরজার পাশে থাকা বিছানায় আলুথালু হয়ে বসে আছে হুরবানু। দরজার মাঝামাঝি আড়াআড়ি করে শুয়ে রয়েছে হাসনা বানু – এ-বাড়ির রান্নার ঝি। কয়েকবার কু-উ-উ করে খুব নিচু স্বরে ডাক দেয়।

শিশুটির মুতে ভিজে যাওয়া আঁচলের শুকনো জায়গা বের করতে ব্যস্ত হুরবানুর মনে পড়ে কহরের কথা। সারারাত বৃষ্টি ঝরেছিল। বাড়ি ফিরতে পারেনি কহর। রাতে সবার চোখ আড়াল করে যেদিন তাকে পাশে শুইয়ে তার সালোয়ার-কামিজ পরা শরীর খর হাত দিয়ে স্পর্শ করেছিল, সেদিন ছিল শ্রাবণ মাসের পহেলা দিন। ভেতরের শরীরের কপাট খোলেনি তার, তবে মনে হচ্ছিল শুকনো খড়ের গাঁদার বিছানায় শুয়ে ক্লান্ত কহর। কোনো স্বপ্নের কথা বলেনি। কিন্তু রমিজ খাঁ তাকে কতশত স্বপ্নের কথা বলেছিল। হুরবানুর চোখে খুশির ঝিলিক নতুন এক জীবনের। চোখে ভাসে লাল টুকটুকে শাড়ি আর স্বর্ণালংকারে মোড়া নতুন বউয়ের সামনে তিনবেলা থালাভর্তি ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, গামলাভর্তি মাছ আর মাংসের সালুন। হাতপাখা নিয়ে বসা দাসী। 

খাঁ বাড়ির এদিকটায় কাঠের দ্বিতল বাড়ির নিচতলায় কাঠের প্রাচীর ঘেঁষে বসে থাকে কহর। কান্নার তোড়ে তার দু-চোখ ভাসে। কহরের আবারো মনে হয়, এ-রাতটা পৃথিবীর শেষ রাত। ঘুচুর ঘুচুর শব্দে কহরের কোমর বেয়ে দৌড়ে পালায় দুটি ইঁদুর। বিড়বিড় করে সুরা-কালাম পড়তে থাকে সে। নিজেকে অভিশাপ দিয়ে ভাবে, সেবার কহরের কুত্তা মেজাজে শান লাগে, মাথার চাঁদি গরম হয়, শরীরের ভেতরে দামামা বাজে। হুরবানুর রং আর ঢংয়ের অভাব নাই। দেখতে মন আর শরীর ছটফট করে তার, মনে হয় হুরবানু তাকে চাইছে। মনিবের বউয়ের দিকে চোখ দেওয়াও পাপ। নেমকহারামি হয়ে যায়। মনকে বোঝায়, সন্দেশখালির পাশের গ্রাম মিনরতপুরের হুরবানুর বারো হাত শাড়ির ভেতরের ক্ষীণকায় শরীরটা কুঁচকে থাকে ভয়ে আর শংকায়। আনন্দ আর শংকায় গোপনে মিলন। মাস অন্তর কহর এলে গরিবের ঘরে জামাই আদর চলে, মালিকপক্ষের লোক হিসেবে। কী  বোঝায় হুরবানুর বাপকে। প্রতিবেশীরা কানাঘুষা করলেও পাত্তা দেয় না কহর। ফিরতি পথে ফুরসত পেলে বুক ঢিপ ঢিপ করলেও জানে রমিজ খাঁ আর কত দিন! হুরবানুও আশ্বাস দেয়, আর কয় দিন সবুর, মোগো হেতে কী অইবে, বুইড়া গোরে একখান পাও দিয়া রাখছে, মোরা মিল্লা থাকলে খাঁ বাড়ির কাকপক্ষীতেও টের পাইবো না। ভরসার জায়গা এইটা – মনে মনে ভাবে কহর। নৌকায় হুরবানুকে চড়িয়ে লোকচোখের আড়ালে কখনো পানের বরজে, কখনো বনবাঁদাড়ে বসে সুখ-দুঃখের গল্প করে। খুনসুটি করতে গিয়ে বলে, বুইড়াডা মরলে মোরাই খাঁ বাড়িতে রাজারানী হইয়া থাকমু, মোগো পোলায় খাঁ বাড়িতে বাতি দিবো। মোগো খালি সুখ আর সুখের জীবন হইবে।  

কহর আলীর মাথা এলোমেলো হয়ে যায়, ভাবে – হুরবানু আর ওর ছেলেকে খালের পানিতে চুবিয়ে মেরে ও বাবলার গাছে ঝুলে যাবে। আবার ভাবে, পালিয়ে গেলেই তো হয়। দূরের কোনো গ্রামে নাম-পরিচয় বদলে থাকবে। সুখের সংসার হবে।  মনে  জোর পায়, খুব নিশ্চুপে কেউ যেন টের না পায় এমন করে শব্দ উপেক্ষা করে সামনের দিকে গিয়ে বাড়ির পিছন দিকটায় ওই ঘরের উঁচু পিঁড়ায় পা রেখে জানালায় উঁকি মারলে দেখতে পায় হুরবানুকে, কী ভেবে সেও তাকায় জানালার দিকে। উঠে দাঁড়ায় ঘুমন্ত শিশুটিকে বুকে নিয়ে। কহর ইশারায় দেখায় নৌকা রাখা আছে কোথায়। বের হয়ে আসতে তাড়া দিয়ে। পিছলে নেমে দৌড় দেয়, প্যাঁকের মধ্যে পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে। হুরবানু দ্রুত পা চালিয়ে আসতে গিয়ে দেখে পেছনে চিৎকার করে দৌড়ে আসছে জরিনা। হুরবানুর শরীর নিস্তেজ হলেও ছুটতে থাকে সামনের দিকে। ভাটায় খালের কাদামাটি প্যাঁকে পরিণত হয়। প্যাঁকে পা ডুবিয়ে চলতে কষ্ট হয়, কহর আলী বৈঠা হাতেই নৌকা থেকে লাফ মেরে প্রায় ছোবল দিয়ে হুরবানুর কোলের শিশুটিকে ডান হাতে বুকে নিয়ে বাঁ হাতে তাকে ধরে প্যাঁকের মধ্যে ছুটতে থাকে বড় বড় পা ফেলে, জরিনার চিৎকার আর চেঁচামেচিতে বাড়ির কয়েকজন খাঁ বাড়ির পেছনে উঁচু ভিটি থেকে নামতে থাকে। জরিনাও চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান মারে হুরবানুকে।

পাটাতনে শিশুটিকে রেখে কতক্ষণ নৌকা চালিয়েছে তা জানে না কহর। বড় নদীতে নৌকাটা পড়তেই পানির তোড়ে লাফিয়ে ওঠে। সম্বিৎ ফিরে সে টের পায় হাজার বছরের দীর্ঘ  রাতের পর সে ফিরে পেয়েছে একটা কাঙ্ক্ষিত ভোর। নরম রোদের আভা শিশুর চোখে পড়তেই সে নড়ে ওঠে কচি পত্রপল্লবের মতো। 

ডানদিকে বৈঠা সরিয়ে শিশুটিকে কোলে নিতেই তার নিমিষে মনে হয়, হুরবানুর কবোষ্ণ বুকে মুখ রেখে গন্ধ শুঁকছে কহর। কঁকিয়ে ওঠা নরম শরীরের নড়াচড়ায় দেখে কোলের শিশুটি কহরের দিকে কুঞ্চিত কপালের নিচে অর্ধনিমীলিত একজোড়া চোখ তাকিয়ে রয়েছে।