কাঁটাতারের বেড়া

নবীন, শিশু হাসপাতালের কাছে যে গেস্টহাউসটা আছে – চেনো তো? ওখানে চলো।

– আজ আমাকে একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেবেন, কাকিমা। ছেলের স্কুলে ভর্তির জন্য ফর্ম তুলতে যেতে হবে।

– ঠিক আছে। ছেড়ে দেব। দেরি হবে না। চলো।

গাড়িটা দ্রম্নত ছুটে চলেছে। সামনের দিকে। সেইসঙ্গে ছুটছে শিরীনের মনটাও। পিছনপানে – অতীতে। একটার পর একটা ছবি মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। সজীব, স্পষ্ট। একাত্তরের দিনগুলির ফটোকপি। এক সময় সে-মন ফিরল সামনে – বর্তমানে। শিরীন নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকল।

– কেমন দেখব আজ তোমাকে? কী বলে তুমি আমাকে ডাকবে বলো তো আজ? সহজভাবে আজ আমি তোমার মুখোমুখি হতে পারব তো? শিরীনের মনে যেন আজো সেই প্রথমদিনের মতো দেখা হওয়ার টানটান উত্তেজনা, যেদিন সে শিরীনকে ডেকেছিল একামেত্ম কথা বলবে বলে। উত্তর-পঞ্চাশের শিরীনের হৃদয়ে আজ সেদিনের তরম্নণী-হৃদয়ের মতোই উথালপাথাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে। তবে বাইরে সে ধীরস্থির-শামত্ম।

এই বাড়িটাই তো কাকিমা। এসে গেছি।

ভাবতে ভাবতে গাড়ি কখন এসে পৌঁছে গেছে গেস্টহাউসটির সামনে, কলকাতায় এসে যেখানে সে উঠেছে। অচঞ্চল পায়ে নেমে গিয়ে অফিসে তার নাম বলতেই বেয়ারা ঘর দেখিয়ে দিয়ে চলে গেল।

দীর্ঘদেহী ঋজু সৌম্যদর্শন মানুষটি দরজা খুলে হাসিমুখে সামনে দাঁড়াল। ঠিক সেদিনের মতো। একাত্তরের একটি দিন। এমন ভঙ্গিতেই মিমিদের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল সেদিনের সুন্দরকামিত্ম তরম্নণ অধ্যাপক। পুব বাংলা থেকে আগত শরণার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিনিবাসে আশ্রিত তার সহকর্মী অধ্যাপকের পরিবারেই সে থাকত। মিমিদের সঙ্গে। মিমিরা দুবোন পাশেই ছাত্রীনিবাসে প্রায় প্রতিদিন এসে আবাসিক মেয়েদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে যেত বেশ কিছুক্ষণ। বিকেলের দিকে। মেয়েরা তাদের শরণার্থী পরিবারের বালিকা বলে আদর-যত্ন-আত্তি করত এবং প্রশ্রয় দিত। মিমির সঙ্গে শিরীনের তো বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। একদিন সে তাই কোনো কথা শুনল না। তার দুটি হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল তাদের ঘরে। সেদিনই প্রথম আলাপ ঘটেছিল তরম্নণ অধ্যাপকের সঙ্গে।

– সোহরাব মির্জা। আপনাদের মানে ভারতের অতিথি। বিজ্ঞান পড়াই। আমাদের দেশে, মানে বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

– আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না। আমি এখনো ছাত্রী। এবার এমএসসি ফাইনাল দেব। পদার্থবিদ্যা আমার বিষয়। আমি শিরীন বানু। গাঁয়ের মেয়ে। হোস্টেলে থাকি। পাশেই।

একটানা এতগুলো কথা বলে ফেলে সেদিন লজ্জা পেয়েছিল স্বল্পভাষী শিরীন। মুখ নামিয়ে ফেলেছিল সংকোচে। আলাপ হয়েছিল তারপর মিমির মা-বাবার সঙ্গে। ওদের দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হলো। ওরা ভালো নেই। দেশ নিয়ে দুর্ভাবনায় কাটছে দিন। কবে যে দেশে ফিরতে পারবে! ফিরে গিয়ে আগের দেশকে আর পাবে কি! এমন সময় মিমি আবদার ধরল –

– চাচা, তুমি শিরীন মাসিকে একটা গান শোনাও। জানো মাসি, সোহরাব চাচা কী সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত করে!

শিরীন সোহরাবের মুখের দিকে তাকাল। সে-চোখের ভাষা আগে আর কারো চোখে দেখেনি মনে হলো। সোহরাব দ্বিধা না করে গেয়ে উঠল –

– জানি তোমার অজানা নাহি গো/ কী আছে আমার মনে/ আমি গোপন করিতে চাহি গো/ ধরা পড়ে দুনয়নে…

তারপর তারা একে অপরের কাছে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল নতুন বন্ধনে। কোন অদৃশ্য সুতোর টানে দুটি প্রাণ কাছে এসেছিল। হাতে হাত রেখে পরস্পরকে অনুভবে পাওয়া। অচেনা-অজানা ভিন্ন দেশের কাঁটাতারের বিধিনিষেধের কোনো কথাই সেদিন মনে ঠাঁই পায়নি। একে অপরকে তাদের মনে হয়েছিল চিরচেনা। শিরীনের মনে হয়েছিল, সোহরাব যেন কেবল তার দেশের শরণার্থী হয়েই আসেনি। সে তার হৃদয়ের গোপন আসনখানিরও প্রার্থী হয়ে এসেছে এদেশে। তাই তো প্রথম দিনেই গান থেমে গেলে একজোড়া অাঁখিতে আরেকজোড়া যেন হারিয়ে গিয়েছিল স্থান-কাল-দেশ ভুলে। প্রতিদিন দেখা হতে থাকল তাদের। প্রতিদিনই বিদায়-মুহূর্তে সোহরাব জানতে চাইত একই প্রশ্নের উত্তর।

– কাল আসছো তো? কখন আসবে?

– ঠিক এই সময়। কেন রোজ একই প্রশ্ন করো বলো তো?

– ভয় করে। ভয় করে কেন জানি না। মনে হয়, তোমাকে পাব তো?

শিরীন মৃদু হেসে নিরম্নত্তরে বিদায় নিত। যেন অনমত্মকালের ভেলায় ভেসে চলেছিল তারা দুজনে সেদিন। ভালোবাসার

কূল-ভাসানো স্রোতে। তার স্বাদ অপার্থিব। সেই স্বাদের আস্বাদনে শিরীন আজো দিনের কাজ ভুলে কখনো কখনো উদাসী হয়ে যায়। উন্মনা এক মানবী বনে যায় সে তখন। ডাকলেও তার সাড়া মেলে না। কাছের মানুষজন ভাবে, সে কোনো গবেষণাবিষয়ক চিমত্মায় মগ্ন।

– দরজাতেই দাঁড়িয়ে থাকবে? ভিতরে আসবে না?

বাক্যহারা তাকে দরজার সামনে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সোহরাব ঘরে আহবান জানাল। শিরীন ফিরল বর্তমানে। যেন বহুক্ষণ অচৈতন্য অবস্থায় থেকে এইমাত্র তার জ্ঞান ফিরেছে। ধীর পায়ে ঘরে ঢুকল। সোহরাব তার হাত ধরে সোফায় বসাল। গভীর অনুরাগ ঝরে পড়ল তার কণ্ঠস্বরে।

– শিরী! কী ভাবছ বলো তো তখন থেকে? এসে পর্যমত্ম একটা কথাও বলোনি। আমি যে ছুটে এসেছি কেবল তোমাকে একযুগ বাদে একটু দেখব বলে। তোমার কথা শুনব বলে। কিছু বলবে না? আমার দিকে তাকাও। শিরী!

শিরীনের বুকের মধ্যে কাঁপন-ধরানো সেই ডাক – শিরী! একেবারে সেদিনের স্বর। বদলায়নি একটুও। যেন ইতোমধ্যে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়নি। তারা যেন কদিন মাত্র আলাদা হয়েছিল। সোহরাবের কথা ও আচরণে কোনো বদল নেই। শিরীন, সোহরাবের

আদরের শিরী, এবার মুখ তুলল। দুচোখে পানি। টলটল করছে ভোরের পাতার ওপরে জ্বলজ্বল করা শিশিরের মতো। সোহরাব দুহাত প্রসারিত করে এগিয়ে এলো তার দিকে। সেই দুহাতের মাঝে নিজেকে সঁপে দিয়ে বহু বছর ধরে জমে-ওঠা ব্যথার বরফকে মুক্তি দিলো যেন শিরীন। সোহরাব এসেছে কলকাতায় আমত্মর্জাতিক বিজ্ঞান সম্মেলনে পেপার পড়তে। শিরীন ভারতের বিজ্ঞান-গবেষণাকেন্দ্রে কর্মরত। সেই সূত্রে সেও এই সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়েছে। এভাবে তাদের পুনর্মিলন ঘটল যেন এক যুগের বিরহ-অবসানে।

তারা দশটি সোনা-ঝরা দিন কাটাল একসঙ্গে। পথ হাঁটল একসঙ্গে। মুখোমুখি বসে গল্প করল। মান-অভিমানও বাদ গেল না।

– তুমিই তো বিয়ে করে ফেললে! প্রতীক্ষা করতে পারোনি!

– শিরী! আমার সেদিনের অবস্থা জানলে তুমি এমন কথা বলতে পারতে না। তোমার বাবার প্রবল আপত্তির কথা জেনে আর তুমিও দেশ ছাড়ার ভাবনা নিয়ে দোটানায় পড়েছো বুঝে আমি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। তোমাকে ভুলতেই বিয়ে করে ফেললাম। কিন্তু তা যে কত বড় ভুল ছিল দিন যেতেই বুঝলাম। এখন সে-কথা ভেবে নিজেকে ক্ষমা করতে পারি না। এ কী হলো!

– এই ভালো হয়েছে। সেদিন জানো, আমার শেষের কবিতা বড় সত্য মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, আমাকে পাওয়া হয়ে গেলে তোমার ভালোবাসা যদি ফুরিয়ে যায়! তাহলে সকলকে ছেড়ে ভিন্ন দেশে গিয়ে আমি বাঁচব কীভাবে? তুমি বিয়ে করে আমাকে বাঁচিয়ে দিলে। আজ আমার কী মনে হয় জানো? এ-ই বেশ! তোমার আমার ভালোবাসা বেঁচে রইল। থাকবে।

– না শিরী! তোমাকে না পেয়ে আমি ভালো নেই। তুমি কেন সে-কথা বোঝ না? তবু তারা হঠাৎ পাওয়া দিনগুলোকে বৃথা যেতে দিলো না। যেন তারা পরিবারহীন দুটি প্রাণ একে অপরেরই কেবল! দুটি প্রাণের একটি পৃথিবী গড়ে তুলল কটি দিন। তারপর এলো বিদায়-বেলা। পাখির ডানায় ভর করে কেটে গেল দিনগুলো। উড়ে উড়ে। সুদূরপানে। এবার কুলায় ফেরার পালা। মাটিতে। সোহরাব ফিরে যাবে তার দেশে। আত্মজনদের মাঝে। শিরীনও মুখ ফেরাবে তার সংসারে। মনের মধ্যে যেন আরেক মন গুমরে ওঠে। ফোঁপায়। অভিমানী বালিকার মতো। সোহরাব কথা হারিয়ে গান শোনায়।

– তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম…

গান শেষে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে আসে সোহরাব। বেজে উঠল কলিংবেল। শিরীন সরে দাঁড়িয়ে নীরবতা ভাঙল।

– মনে হয়, সৌম্য এসে গেছে। আমার খুব ভালো স্কুলজীবনের বন্ধু। ওকে আসতে বলেছিলাম তোমাকে জিনিসপত্র নিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসব বলে। তুমি রাগ করলে না তো?

সোহরাবকে একলা বিদায় দিতে সাহস হয়নি শিরীনের। কী জানি, সোহরাব কী করে বসে। তাই সৌম্যদীপকে মাঝখানে রাখার পরিকল্পনা করেছিল সে। সোহরাবকে বলেনি। সোহরাব একটু থমকে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি মেখে দরজা খুলে দাঁড়াল। দুহাত জোড় করে বলল –

– নমস্কার। আমি সোহরাব। আপনি সৌম্যদীপ। আসুন। ভিতরে আসুন, পিস্নজ।

– নমস্কার। বিলক্ষণ। বিলক্ষণ। আপনি তো মশাই এই বয়সেও এক্কেবারে তরতাজা তরম্নণ দেখছি। শিরীনের পছন্দ আছে দেখি। ভাগ্যিস, শিরীন ডাকল। তাই আপনার সঙ্গে আলাপ করার সৌভাগ্য হলো। কী শিরীন, মুখ ভার মনে হচ্ছে। সব রেডি তো? চলো, এবার বেরিয়ে পড়া যাক। কী বলো? কলকাতার রাসত্মায় যা জ্যাম হয়! আপনাদের ঢাকায় মনে হয় এসব বালাই নেই। এই দেখুন মশাই ‘আপনাদের ঢাকা’ বললাম! ঢাকা তো আমারও দ্যাশ! তবু মুখে এসে যায় ‘আপনাদের’। এই দ্যাশ-ভাগ ব্যাপারটা আর পিছু ছাড়ে না দেখি! থাকগে ওসব কথা। চলুন। চলুন। এবার যাওয়া যাক। শিরীন ওঠো। চলো।

সৌম্য সুরসিক। মজার মজার কথায় ভুলিয়ে রাখল কিছুক্ষণ। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। ট্রেন ছাড়ার আগের কয়েকটি মুহূর্ত বাহ্যজ্ঞানরহিত হয়ে তাকিয়ে ছিল সোহরাব শিরীনের দুচোখের পানে। যেমন তীব্র তেমনি বিষাদমাখা সে-চোখের দৃষ্টি। শিরীনের বুকের মধ্যেটা চুরমার হয়ে যাচ্ছিল একাত্তরের বিদায়ের দিনটির মতোই। আজো সেই একই আঘাত বুকের মাঝে দ্বিগুণ হয়ে বিঁধল।

কখন ট্রেন স্টেশন ছেড়েছে। সোহরাবের তীব্র চাহনিও সরে গেছে। যেন কিছুই দেখেনি সেসব শিরীন। দাঁড়িয়ে ছিল চলৎশক্তিহীনের মতো। সৌম্যর ডাকে ঘোর কাটল।

– আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? এবার চলো। পস্ন্যাটফর্মে ভিড় বাড়ছে। শিরীন এতক্ষণ কান পেতে শুনছিল সোহরাবের আর্তস্বর।

– ওরা আমাদের মহাশত্রম্ন। কেন ওরা একটা দেশকে দুভাগ করে ফেলল এভাবে? তাই তো আমি তোমাকে পেলাম না জীবনে। কী করব এখন আমি, শিরী? একাত্তরের বিলাপ। তখনো শিরীন চোখ বন্ধ করলেই শুনতে পায়। এখনো শুনছিল। সৌম্য ফিরিয়ে আনল তাকে বর্তমানে।

– এই যে বিবিসাহেব! তুমি যে একেবারে মূর্তি বনে গেলে!

ওরা পা বাড়াল স্টেশনের বাইরে। সৌম্য বকবক করতে থাকল মজার স্বরে।

– এপারে পঞ্চাশ পেরনো শিরীন বিবি আর ওপারে ষাট পেরনো সোহরাব মিঞা। এখনো দেখছি তোমরা কপোত-কপোতীর মতো প্রেমে পাগল! কী হে শিরীন? কিছু বলো।

সৌম্যর বাচালতা শুনতে শুনতে শিরীন খানিকটা হুঁশ ফিরে পেয়েছে যেন। তাই হালকা স্বরে বলল –

– ঠাট্টা করছ সৌম্য?

– তোবা! তোবা। কইছো কী তুমি শিরীন? প্রেম নিয়ে

ঠাট্টা-মশকরা তা কি হয়? তাও কি হয় বিবিসাহেব?

কথা বলতে বলতে গাড়িতে উঠে বসল ওরা। শিরীন এবার মুখ খুলল সৌম্যর রসিকতাকে পাত্তা না দিয়ে গম্ভীর স্বরে।

–  সোহরাব আজো একাত্তরের প্রেমকে ভুলতে পারেনি। ও বলে, শত্রম্নর দল দেশটাকে টুকরো করেছে কিন্তু টুকরো করা দেশের মানুষদের ভালোবাসাকে নষ্ট করার সাধ্য ওদের নেই। এবারো সে আমাকে বলে গেল, ওরা আমাদের প্রেমকেও দু-টুকরো করতে পারেনি, শিরী। কোনোদিন তা হতে দেবো না।

বলতে বলতে সে দুচোখের ছাপিয়ে পড়া পানি ঢাকতে ওড়নায় মুখ ঢেকে ফেলল। সৌম্য হতবিহবল। এ যেন এক অচেনা

শিরীন। তার বাল্যবন্ধু নয়। রাশভারী হিসাবরক্ষক হলেও বাকচাপল্যে-লঘু আচরণে অভ্যসত্ম সৌম্যদীপ বসু অবাক চোখে তাকিয়ে থাকল শিরীনের দিকে। কথা হারিয়ে ফেলল। সামনের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিতে চাইল।

গাড়িটা তখন ছুটে চলেছে দ্রম্নতবেগে।