দুপুর বেলা এক ধামা রুটি আর ঝুড়িতে দুখানা বিশাল কাঁঠাল যায় মাঠে কাজ করা মুনিষদের জন্য। মাঠের একপাশে দুখানা বাবলা আর শিরিষের আধো ছায়ায় তাদের পেটচুক্তি খাওয়া চলে, জমিদারদের লাগানো দুধে কাঁঠাল আর নতুন গমের রুটি, অমৃত! সন্ধেয় প্রত্যেকে পাবে দশটা করে টাকা – আক্রার বাজারে এই টাকায় কিবা পাওয়া যায়! সকলেরই বাড়িতে বিশাল সংসার – বাপমাগেদাগুষ্টিসহ কমপক্ষে দুই গণ্ডা, কারো বা তিন গণ্ডা। গণ্ডার হিসাব দিতে এক রসঘন পরিবেশ হয়, এমন নয়, এটা বলা হয় দুঃখের সাগরে ভাসতে ভাসতে, অনাহারী একাহারী মানুষের কষ্ট নিয়ে।
আজকে যেন ঠাঠা পড়া রোদ, নিষ্করুণ, ক্ষমাহীন। গামছা দিয়ে ঘাম মোছা লাগে না, রোদের তাপ আপনি শুষে নিচ্ছে লবণের পানি। পিঠে আঁকাবাঁকা লবণের সারি, যেন অজস্র পিঁপড়া সারি বেঁধে চলেছে। খেতে বসে আক্কাসের আজকে হাত চলে না, কাঁঠালের রোয়া ফুটো করতে বুড়ো আঙুল দিয়ে অনেকগুলো খোঁচা দেওয়া লাগে। অনেক কষ্টে যেন বেরিয়ে আসে চকচকে পুষ্ট বিচি। কাঁঠালের রোয়াকে রুটিতে মুড়িয়ে মুখে পুরতেও বড্ড সময় লাগে তার। অন্যদিন চোখের নিমেষেই খেয়ে ফেলে, বড় বড় পাঁচ পাঁচটা রুটি খেতে সময় কিছুই যেন লাগে না। সবাই খাওয়ায় ব্যস্ত এখন, কেইবা আক্কাসের এই ম্রিয়মাণ শ্লথগতির দিকে খেয়াল করার সময় পায়! না, শরীর তার ভালোই আছে। রোদ কড়া হলেও বাতাস থাকায় ততটা অসহনীয় নয়, বাড়িতেও খাবার আছে আজ, বাড়ির লোক আজকে বরং ভালোই খেতে পাবে, হাতে ভাঙানো কলাইয়ের ডাল আর ভাত। বৃদ্ধ মা-বাপের বাড়ি থেকে তিনদিন আগে দশ সের ধান আর কলাই চেয়ে এনেছিল, তাতেই চলছে। বাগোয়ান তার বাপের বাড়ি, সম্পন্ন গেরস্ত, মাঠাল জমি বাগান সবই আছে তাদের, অভাব নাই বললেই চলে, বৃদ্ধ ভাইগুলো আর কত দেবে! তাদেরও পরিবারে গণ্ডায় গণ্ডায় সন্তান আর নাতি-নাতনি। খুব আকাল ছাড়া অবশ্য সেখানে কেউ যায় না বললেই চলে। অভাবী মানুষকে
কেই-বা সহ্য করে প্রত্যহ! চালের দর হু-হু করে বাড়ছে, এই সময় দান-খয়রাত কে করে! দানই তো, কোনো দিন ফেরত দিতে পারবে না যা! গ্রামের মহিলারা একটা নতুন পেশা আবিষ্কার করে এই সময়, পেটের দায়েই। ঘরে ঘরে গিয়ে ধান কিনে ঢেঁকিতে ভেঙে নয় মাইল দূরে মেহেরপুর সদরে বিক্রি করে আবার ফিরে আসে দিনে দিনে। পেটের দায় এমনই দায়!
পাট কাটার মরসুম বলে কাজ মাঠে, এরপর লম্বা একটা সময় মাঠাল কাজও থাকবে না। সে যাক, আক্কাসের আজকে কী হয়েছে! কে যেন সুরাই থেকে গলায় পানি ঢালতে ঢালতে বলে, আক্কাসভাই শরীলডা কি খারাপ? আক্কাস মাথা নাড়ে, না, শরীর তার ভালোই আছে। জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল মনের, যদিও মনের খবর খুব হাস্যকর এখানে।
পাট কাটতে কাটতে একবার মাথাটা কেমন করে ওঠে, সামলে নিতে নিতে দেখে দূরে আলের কাছে রাজা মণ্ডল তার ইয়ারবন্ধু নিয়ে এয়ারগান কাঁধে নাজিরাকোনার জঙ্গলের দিকে চলেছে। আক্কাস মাথা নামায়, আরেকবার দেখার ইচ্ছা করে না। নাজিরাকোনার জঙ্গল একসময় তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল, কত যে সে গুলতি বানাতে পারত! গাছের ডালের সন্ধি খুঁজে গুলতি বানানোর এক আশ্চর্য আনন্দ! গুলতি দিয়ে পাখি মারায় সে ছিল ওস্তাদ, কত রকমের পাখি সেখানে! মারত ঘুঘু, ডাহুক, হরিয়াল, বক। মেরে হাতে ঝুলিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই মায়ের যে কী আনন্দ, আজ তো অনেক পাকি মেরি এনিচিস বাপ! মজা কইরি রান্না কইরি দবো, রাতে খাস। সেসব তার এখন মনে পড়ছে না। শেষ পর্যন্ত সে আরেকবার মাথাটা তোলে, না নেই, চলে গেছে রাজা মণ্ডল। ওইটুকু ছেলে, সেদিনও তাকে ভৈরবে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছে, মণ্ডলবাড়িতে বেড়া বাঁধতে কি ঝোড় পরিষ্কার করতে গেলে উঠানে ডাঙ্গুলি খেলতে খেলতে গুলি হারিয়ে এসে বলেছে, আক্কাস চাচা গুলিডা একটু খুঁইজি দাও, ওদিক পানে পড়লু!
সন্ধ্যা নাগাদ মণ্ডলবাড়ি থেকে মজুরির টাকা কয়টা নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে জ¦র আসে আক্কাসের। তার মনে হয়, এটা মৃত্যুর আগাম বার্তা। তার আর বাঁচার কোনো উপায় নাই, সে আর বাঁচতে চায়ও না। এক চিলতে উঠানে তখন সন্ধ্যা নামছে ধীরে। পশ্চিমদিকে কমলা রঙের রেখা মিলিয়ে ছায়া ঘন হয়ে আসছে। বাঁশঝাড় থেকে কি একটা পাখি কুব কুব আওয়াজ করেই চলেছে। আক্কাসের মনে হয় সে অন্য কোনো বাড়ি চলে এসেছে, এই বাড়ি সে চেনে না। সারাদিনের তাপ ক্রমশ কমতে শুরু করলে দক্ষিণা হাওয়া ছোটে। বাঁশঝাড় থেকে দক্ষিণা হাওয়া কাঁচা গুয়ের গন্ধ বয়ে আনে, বস্তুত বাঁশঝাড়ই তাদের পায়খানা, সে সকাল দুপুর রাত যে-বেলাই হোক না কেন! তো এই দক্ষিণা হাওয়ায় ভেসে আসা গন্ধ তার মাথাটা বাস্তবিকই এলোমেলো করে দিলে সে ঘরে ঢুকতে চায়। ঘর কই, অপরিসর উঠানে সে পড়ে যেতে যেতে সামলে নিয়ে দাঁড়ায়, শোনে কিছু চাপা কথা, মর্জিনার গলা, রোষ, রাগ আর ঘৃণা একসঙ্গে গলগল করে বেরুচ্ছে, যেন গনগনে লাভা। কেনে তুই রাজি হলি হারামজাদি, কেনে তুই কাঁটাল নিইতি গেলি, কাঁটাল খাওয়ার জন্যি কি তোর জানডা বেড়িয়ি যাচ্ছিলু, শয়তান বললু আর তুই কাপড় তুইলি দিলি আর কে খেইতি চেয়িছি তোর কাঁটাল! মাগি, একা রাজার দোষ দিচ্চিস, আমি জানি না তোর কুটকুটানি।
– মা, সে বলিচে কিছু হইলি আমাকে বিয়ি করবি।
– বিয়ি! সে করবি তোর মতো ফকিন্নিরে বিয়ি! বমি হইচি, তারে বইলিচিস! হাভাতে, কাঙাল! গলায় কলসি নিইয়ি ভৈরবে যা, আমার জীবন শেষ, গুষ্টির মুখে চুনকালি মেইকি তুই এখন কাঁটালের গল্প করচু!
কান্নার শব্দ, চুল ধরে ধ্বস্তাধস্তির শব্দ, তারপর কিছু চড়থাপ্পড়। আক্কাস সবটাই জানে, এখন জানল ভালো করে। মণ্ডলবাড়ির দোতলায় কাঠালের স্তূপ থাকে, যেমন থাকে আমের দিনে আম। ছাদে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় দেখেছে, দুধে কাঁঠাল, বউভোলানো কাঁঠাল কি বেনারসি কাঁঠাল নাকি অন্য কোনো নাম, সুবাসে চিলেকোঠা ম ম, সেখানে মেয়েটাকে কাঁঠাল দেওয়ার নাম করে …
আক্কাস আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরের দরোজা খোঁজে। আজকে দরোজাটা দক্ষিণের বদলে অন্যদিকে ঘুরে গেছে, এরকম তো কখনো হয়নি আগে, দরোজা তো সেই ছোটবেলা থেকে দক্ষিণেই ছিল, এমনকি এক চিলতে উঠোনের আশা বাদ দিয়ে বাপজান দক্ষিণ দিকেই মুখ করে ঘর করেছিল। অন্ধকার আরো ঘন হয়ে এলে সে যেন চিরতরে দরোজা হারায়। এভাবে কতক্ষণ কে জানে, সম্বিত ফিরে এলে সে ফের দরোজা খোঁজে, খুঁজে পায়। ঘরের সর্বশেষ তক্তপোশটা তার আর ছোট ছেলের জন্য বরাদ্দ। এমন না যে দুজনেই রাজার হালে শোয়, চাপাচাপি করে শোয়, ছোট ছেলে যে বাপকে ছাড়া ঘুমাতে পারে না! বাকি ছয়জন শোয় মেঝেতে খেজুর পাতায় বোনা পাটিতে।
ঘুমাতে ঘুমাতে সে মণ্ডল বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘোরে, গুলি খুঁজে দেয় রাজাকে, ডাঙ্গুলি খেলার গজ মাপে, এড়ি দুড়ি ঘুন্নরি চম্পা জাগর লঙ্কা! মাপতে মাপতে রাজা মণ্ডলের ঘরে পৌঁছে যায়। কাঁঠালের সুবাসে তার পেট ফুলে ওঠে, তারপর হাতের লাঠিটা প্রাণপণ শক্তিতে নেমে আসে রাজার মাথা বরাবর।
পরদিন সকালে ঘাম দিয়ে ঘুম ভাঙে। আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখে আজো সূর্য তেড়িয়ে উঠছে, কালকের মতোই নির্দয়। গাছের পাতার নড়াচড়া পর্যন্ত নেই। একটা চাপা কান্না যেন, যেন বুক ফাটলেও গলা চেপে ধরা কান্না। আক্কাস গতকাল রাতের কথা মনে করতে চায়, খুব কিছু মনে পড়ে না। বরঞ্চ এখন সে অনেকটাই সুস্থ জ¦র নেমে যাওয়ায়, শুধু কান্নাটার কারণ খুঁজতে সে বিছানা ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। শিশু কাঁঠাল গাছটার নিচে বসে মর্জিনা কাঁদছে, কান্নারত মর্জিনাকে দেখে আক্কাসের বরং রাগই হয়। আক্কাস আরো কিছু খোঁজে, তারপর নেমে আসে উঠানে। অনতিদূরে মেয়েটা টানটান হয়ে শুয়ে আছে, আক্কাস নিরিখ করে দেখতে চায় কিছু, কিছু কি বোঝা যায়, কোনো চিহ্ন, কোনো নমুনা!
তারপর বাড়ি ভরে যায় পাড়া-প্রতিবেশী-আগন্তুকে। মাথা বরাবর লাঠির বাড়িতে মৃত্যু হয়েছে আক্কাসের একমাত্র মেয়েটার। গ্রামবাসী এখন ক্ষুধা-দারিদ্র্য জরা-ব্যাধির সঙ্গে লড়তেই ক্লান্ত, আক্কাসের মেয়ের মৃত্যু নিয়ে বেশিদিন ভাবনা করার সময় নেই।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.