এই চওড়া সড়ক ধরে হাঁটার সময় বহুদিন ডান-বাম পাশে তরুসারির নাম মনে করতে আমরা প্রায়ই ঝগড়ার মতো করে বসি; অনিন্দ্য কোনো গাছের নাম ঠিক বলতে পারে না, তবু সে স্বরচিত নাম দেয় গাছের : আমরা বড়জোর মেহগনি চিনতে পারি, দেবদারু চিনতে পারি তবে তার পাশে বড় বড় পাতার শাল কিংবা কদমগাছ চিনতে পারি না। সৈকত হঠাৎ করে বলে, ‘এটা কদম, আশপাশে নিশ্চয় হিজল বা তমাল আছে।’ সে তার বইয়ে পড়া জ্ঞান বাস্তবে কাজে লাগানোর জন্য কসরত করে, তবে বাস্তবতা হলো, গাছকে চিনতে হয় গভীর থেকে, হৃদয় থেকে। সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা গান আওড়ায়, ‘আকাশ আমার ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে’; সুর ঠিক থাকলেও তালে ঠিক গাইতে পারে না। অনিন্দ্য বলে, ‘ভাইয়া, তাল শেখো, তোমার গলা তো ভালোই, তো ওস্তাদ ধরলেই হয়ে যাবে, ছোট ছোট করে স্টেজ পার করবে, বেশি বেশি শুনবে আর গাইবে।’ সৈকত কোনো মন্তব্য করে না, সে কেন জানি খানিকটা উৎসাহ পায় এবং পরের অন্তরার দিকে যায় : ‘ওরে পলাশ, ওরে পলাশ, রাঙা রঙের শিখায় শিখায় দিকে দিকে আগুন জ্বালাস …।’ সে দ্বিতীয় অন্তরায় যাওয়ার আগে আমি বলি, ‘তোরা কী শিরীষ চিনিস?’ অনিন্দ্য হো-হো করে হেসে উঠে বলে, উঠে বলে, ‘কেন ওই যে, প্যারিস রোডের সব গাছই তো শিরীষ।’ সৈকত খানিকটা অনুত্তেজিত গলায় বলে, ‘ও তো গগনশিরীষ।’ সে পুরো নিশ্চিত নয় যে শিরীষ আর গগনশিরীষ এক কিনা? আমি বলি, ‘তোরা একদিন বোটানির কোনো প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করিস; একজন টিচার ছিলেন, গোটা ক্যাম্পাসের গাছপালা দেখাশোনা করতেন আর নতুন নতুন গাছ লাগাতেন। বোটানিক্যাল গার্ডেন তো তাঁর তত্ত্বাবধানে করা।’ অনিন্দ্য এসব কথায় মজা পায় না, সে বলে, ‘ভাইয়া, গানটা শেষ করো না।’ সে বলে, ‘না, আর গাইতে ইচ্ছে করছে না, বরং আমরা শিরীষ পাতার বাতাস বুকে করে চলে যাবো সোজা উত্তর দিকে।’ অনিন্দ্য বলে, ‘কী সব কথাবার্তা দেখেছো?’ আমি বলি, ‘ও তো মশকরা করছে। মশকরা বোঝো না? ধরো, এটা যদি শিরীষ হয়, ধরে নিলাম বিলাতি শিরীষ, তাহলে এর উচ্চতা কত? ১০০-১৬০ ফুট, নাকি আরো বেশি?’ অনিন্দ্য বলে, ‘বেশি।’ ‘তাহলে ওর বাতাস কার বুকে যাচ্ছে?’ সৈকত বলে, ‘রবীন্দ্রনাথের বুকে।’ হো-হো করে অনিন্দ্য হাসতে যায়, এক পর্ব হেসে থেমে যায়। সে মুখ ভার করে থাকে, ওর চোখ খানিকটা লাল হয়ে যায়। চিকন মুখে পাতলা ভ্রম্ন আর ঈষৎ কমলা রঙের জামায় তাকে অন্য পৃথিবীর প্রাণী বলে মনে হতে থাকে। সৈকত বলে, ‘কী হলো? তোর কোনো পদ মনে পড়ল?’ আমি বলি, ‘সব বাদ। আমরা এখন সামনের দিকে হাঁটব।’ আমরা জোহার গোলচত্বরের দিকে মুখ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাই সূর্যটা কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনের পাশ দিয়ে ক্যাফেটেরিয়ার মাথার কাছে উঁকি দিচ্ছে, অর্থাৎ আর বেশিক্ষণ আমাদের হণ্টনপর্ব চলতে পারবে না। তো ডানে মোড় নিতেই মেইন গেট থেকে দু-সারি প্রাচীন বৃক্ষক্ষর সামনে পড়ে যাই। এদের চেহারা এই বৃষ্টিবিধৌত অঞ্চলেও মরা মরা মনে হচ্ছে। এই বিদেশি গাছগুলো ষাটের দশকের প্রথম পাদে সম্ভবত লাগানো হয়েছিল। শুনেছি একজন ফরাসি ভদ্রলোক, নাকি অস্ট্রেলিয়ান ভদ্রলোক, ক্যাম্পাসের টপোগ্রাফি ঠিক করেছিলেন। পরে অবশ্য আমাদের দেশি অনেক বিশেষজ্ঞ এসেছিলেন। দ্বিজেন শর্মা নাকি তখনকার উপাচার্যের আমন্ত্রণে এখানে এসেছিলেন। তো তিনি গাছপালার একটা খতিয়ান নিয়েছিলেন, কোথায় কোন গাছ থাকবে, কোথায় জলাশয়, কোথায় খোলা চত্বর। বাতাসের প্রবাহ দেখে গোটা জমিনকে বিন্যস্ত করেছিলেন। উঁচু গাছ, নিচু গাছ, ফলদ, ঔষধি, বনজ ও বড় বড় গুল্মবনের কথাও তিনি বোধহয় বলেছিলেন। আমরা সবটা জানি না। এই বিদ্যায়তনের অনেকে এসব খবর রাখে না। রাখার কোনো প্রয়োজন আছে কিনা তা নিয়ে কেউ কেউ হয়তো তাদের মস্তিষ্ক কখনো চঞ্চল করে তোলে। তো আকাশমুখো মুখ মলিন করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটির গায়ে ছোট একটা নেমপেস্নট, তাতে সাদা কালি দিয়ে লেখা ফিস টেইল পাম। সৈকত বা অনিন্দ্য সেদিকে খেয়াল করেনি। ওরা জোহার ছোট স্ট্যাচুর দিকে গভীরভাবে দেখে। কী যেন কবিতার মতো করে লেখা হয়েছে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি সাহস করে ছাত্রদের বাঁচাতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নিহত হন। অনিন্দ্য বলে, ‘আর একটু সুন্দর করে লেখা যেত।’ সৈকত বলে, ‘যার যা ক্ষমতা সে তাই লেখে, মন খারাপ করার কী আছে?’ আমি ওদের মন অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করে বলি, ‘বলো তো এই সারি সারি গাছের নাম কী?’ আমরা জানতাম ওগুলো পাম গাছ, কখনো ভুল করে সৈকত বা অনিন্দ্য বলে সাইকাস। তো সাইকাস যে নয় তা আমি জানি। ও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আচ্ছা, বলো তো, এই গাছ আর কোথায় কোথায় আছে?’ প্রশ্নের উত্তরে পালটা প্রশ্ন করলে আমি ক্ষণিকের জন্য থতমত খাই। আমার স্মরণশক্তির টেস্ট কেউ করে না। কারণ সবাই জানে সেটা ভয়ংকর রকমের খারাপ। তবু হঠাৎ কোনো কথা মনে পড়ে। আমি বলতে পারলাম, ‘তাহের স্যারের বাসার পূর্বপাশে কয়েক প্রকার পামগাছ রয়েছে, মেইন গেটের সীমানা বরাবর পূর্ব-পশ্চিমে বেশকিছু গাছ রয়েছে; জুবেরির মাঠেও কয়েকটি থাকার কথা। আরো কয়েক জায়গায় রয়েছে, ভালো করে দেখতে হবে।’ সৈকত বলে, ‘হ্যাঁ, তোমার কথা ঠিক, জুবেরির মাঠের ধারে ক্লাবের ডি-বক্সের কাছে কয়েকটা পাম তো ছিল, নিশ্চয় আছে।’ আমি অনিন্দ্যকে বলি, ‘বলো, এই গাছের প্রকৃত নাম কী?’ সে তার পাতলা চুলে তর্জনী দিয়ে মাথা চুলকায়। সৈকত দাঁতের সঙ্গে দাঁত ঘষে, মনে মনে ভাবে, ইস, নামটা তো জানি। আমি যে নাম গোপনে পড়ে নিয়েছি সেটা ওদের বলি না, আগে তো নাম দেওয়া ছিল না, কে নাম লাগাল গাছের গায়ে? আমি দুজনের দিকে ইশারা করে ছোট্ট নেমপেস্নটের দিকে ওদের দৃষ্টি প্রসারিত করতে ইশারা করলাম; ওরা একটু কাছে গিয়ে আনন্দে চিৎকার করে পড়ল ‘ফিস টেইল পাম’। তবে অনিন্দ্য আবার বিমর্ষ হয়ে গেল, সে কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, ‘গাছের নাম জানা জরুরি, তাই বলে পেরেক ঠুকে গাছের গায়ে টিনের পোস্টার লাগাতে হবে? যার জানার কথা সে ঠিকই জানবে। ভাবতে কষ্ট লাগে এই দেশে জগদীশচন্দ্র জন্মেছিলেন। আর আমরা সেই দেশের মানুষ হয়ে গাছে পেরেক ঠুকছি, চুনকাম করছি। সেন্স দেখো।’ আমি বুঝতে পারি এটা ওর বিমর্ষতারই বিস্তারিত রূপ – এই বয়ান থামাতে হবে। গাছ হয়তো ওর আপাত বিষয়, ও হয়তো অন্য কোনো কষ্ট চাপা দিতে এরকম করে কথা বলছে। ফুকো সাহেবের বয়ানের ব্যাখ্যা মনে পড়লে আমি খানিকটা বল পাই। বলি, ‘দেখো কদিন  আগেও তুমি গাছের নাম জানো না বলে কত আফসোস করতে, মনে আছে নিশ্চয়, হরীতকী আর বহেরা নিয়ে তোমার কি দুশ্চিন্তা, সারাক্ষণ কপালে ভাঁজ নিয়ে সেদিন গোটা সময় প্রায় কাটিয়ে দিলে। নিশ্চয় প্রশাসনে বোটানির কোনো প্রফেসর দায়িত্ব নিয়েছে আর তার মনে হয়েছে মানুষ গাছগুলোর নাম জানুক, তারা নামহীন-গোত্রহীন থাকবে কেন?’ সৈকত বলে, ‘পেরেক মারা ঠিক না, তবে, দুটো- তিনটে ছোট পেরেক মারলে ও তো বড় গাছের ক্ষতি হবে না। তবে ছোটগাছের বেলায় সাবধান হতে হবে।’

আমরা ব্যাংকের সামনে দিয়ে সোজা শেরেবাংলার দিকে না গিয়ে আজ বাঁয়ে ঘুরি। প্রথমেই দেখি বিশাল বড় গাছটার গায়ে আরেকটা নেমপেস্নট; লেখা আছে হলুদ কৃষ্ণচূড়া, অনিন্দ্য তাকায় না। সৈকত বেশ পুলকিত। আরো একটু এগিয়ে গিয়ে মাঝারি সাইজের একটা গাছ, ছোট ছোট পাতা। আমরা গাছটাকে আধো আধো চিনতাম, ভুলভাল নামে ডাকতাম। সেখানে লেখা রক্তচন্দন; এবার অনিন্দ্য খুব উৎসাহিত হয় – সে বলে, ‘এই তো রক্তচন্দন, স্যান্ডাল – দ্য ইন্ডিয়ান স্যান্ডাল, আমি কতদিন মনে মনে খুঁজছি।’ সে গাছের গায়ে তার বাঁ হাত ঘষে, ওপরের দিকে তাকায়, কারা যেন তার গা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটেছে, ভেতরে রক্তের মতো লাল রং দেখা যাচ্ছে। সে বলে, ‘দেখো, দেখো শয়তানগুলোর কা- দেখো, আরে বাবা একটা গাছ লাগাতে পারিস না, কাটতে আসিস কেন, গাছকেই চেনে না, মানুষ হবে কী করে।’ সে আবার উত্তেজিত হতে থাকে। সৈকত বুঝতে পারে। সে বলে, ‘ওই গাছটা দেখো, দেখছো, এর নাম জীবনেও শোনোনি।’ সেখানে লেখা লোহাকাঠ। আমরা সবাই মিলে দেখি সত্যি সত্যি ইলেকট্রিক পোলের মতো গাছটা দাঁড়িয়ে আছে একা, নিঃসঙ্গ। অনেক ওপরে ডালপালা, সে কাউকে তার ডালপাতা দেখাতে চায় না। লালচে রঙের দেহ, বলিষ্ঠ পুরুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে। সব গাছই তো আকাশের দিকে মুখ করে, চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথের তালগাছও এক পায়ে আকাশের দিকে উঁকি মারে। আমি বললাম, ‘সৈকত, দেখো, সব গাছই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, এমনকি ছোট তৃণলতাও। তোমরা রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র পড়েছো নিশ্চয়। ইন্দিরা দেবীকে লেখা গাছপালা-নিসর্গ-নদী নিয়ে কবির অসামান্য সেই দার্শনিক ব্যাখ্যাগুলো পড়েছো? উপনিষদ থেকেই নাকি কবি এই বোধ পেয়েছিলেন, আর বাবার সঙ্গে বাল্যকালে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন প্রকৃতির রাজ্যে। আর বাংলার এই নিস্তরঙ্গ প্রকৃতির মুখেই ভাষা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ সৈকত হাতিশুঁড়ের দিকে, তার নানারঙের চিরলপাতার দিকে তাকাতে তাকাতে বলে, ‘পড়েছি, গভীরভাবে পড়েছি, আমার তো মনে হয় কবি কবিতার মূলসূত্রই পেয়েছেন বাংলার প্রকৃতি থেকে। উপনিষদের সুক্তোগুলোকে তিনি প্রাণে ধারণ করেছিলেন, সেখানে রয়েছে বৃক্ষ আর মানুষের মধ্যে সম্পর্ক তৈরির নানা রসায়ন; আমার তো মনে হয় এই আবিষ্কার রবীন্দ্রনাথ করতে পেরেছিলেন বলেই তাঁর প্রাণের ভেতর এত মানবিক গভীরতা তৈরি হয়েছিল।’ অনিন্দ্য সৈকতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে কিছুটা বিস্মিত, সে বুঝতে পারে না, কবি না হয়েও সে এসব বিষয়ের এত গভীরে কীভাবে ঢুকে পড়েছে। সে মুখ ফুটে বলেই ফেলে, ‘ভাইয়া, তুমি তো কবিতা লেখো না। কবিতা বিষয়ে তোমার আগ্রহ আছে বুঝলাম, তো এই গভীরতা তো ভেতরের বিষয়। কীভাবে তুমি পেয়ে গেলে এসব?’ সৈকত কিছু বলে না, সে ডানপাশে ক্ষতবিক্ষত অর্জুনগাছটার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকে। অর্জুন গাছের গোড়া থেকে মানুষের নাগাল পাওয়া পর্যন্ত ক্ষতবিক্ষত। গাছের ছাল কেটে কেটে গাছের শরীরে অজস্র বড়-ছোট আব তৈরি হয়েছে; প্রায় সাদা রঙের গাছটাকে চেনা যাচ্ছে না। ওর বাকল খুব উপকারি, প্রায় সব ভেষজ ওষুধে অর্জুনের ছাল জরুরি। তাই বলে এ-অবস্থা করতে হবে! আমি জানি, সৈকত এখন অনিন্দ্যের প্রশ্নের জবাব দেবে না, সে এগিয়ে যায়। বাঁ-পাশে বহেরা হরীতকীর একটা বড় বাগান। আর সামনে ফিজিক্স ভবনের চত্বরে নানা প্রজাতির ফুল। আমরা ওদিকে প্রায়ই যাই আজ আর যাবো না বোধহয়। সৈকত সারি সারি আমলকী গাছের নিচে দাঁড়িয়ে যায়। ঘন সবুজ চিকন ধারালো পাতায় সকালের বাতাসে একটা মৃদুগুঞ্জন দেখা যাচ্ছে, তার খানিকটা আন্দোলন সৈকতের চোখে-মুখে, সে যে প্রাণের আনন্দে আর অনুভবের প্রগাঢ় বৈভবে জেগে উঠছে সেটা কাউকে আলাদা করে বলে দিতে হয় না। আমি অনিন্দ্যকে বলি, ‘শোনো, জীবনানন্দ বলেছিলেন, সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। আমি বলব, সকলের মধ্যে কবিত্ব থাকে, সবাই  প্রকৃতির বিভূতির শব্দ-স্পর্শ-বর্ণ-গন্ধ-আলো পায় আর তার প্রাণ জেগে ওঠে অনির্বচনীয় আনন্দে, তবে প্রকাশক্ষমতা সবার থাকে না, বা প্রত্যক্ষ করার মতো সব সম্ভাবনাকে সে কাজে লাগাতে পারে না, যে সেসব অনুভবকে কলমে তুলে আনতে পারে তাকেই আমরা কবি বলি। পরিপূর্ণভাবে তুলে আনতে না পারলে কবি হতে পারবে না। আর সৈকত তো গোপনে কবিতা লেখে, আমি জানি, আমি কিছু পড়েছি, সে হয়তো এখনই সবাইকে বলতে চায় না, সংকোচের বিহবলতায় এখনো খানিকটা অপ্রস্ত্তত।’ সৈকতের দিকে তাকাতেই সে খানিকটা চাপা হাসির মধ্যে কথা লুকিয়ে ফেলে। অনিন্দ্য বলে, ‘আমি মাঝে মাঝে আবিষ্কার করেছি, বলতেও চেয়েছি, বলা হয়নি। তবে, ভাইয়ার, পোয়েটিক ভিশন খুব স্ট্রং। আমি তো বিস্মিত। তবে, আমরা জীবন-প্রকৃতি এই মানবজন্মের খুব কম বিষয়ই গভীরভাবে জানি; কখনো কখনো আমরা আমাদের মতো ব্যাখ্যা দিয়ে যাই।’

আমরা আমলকীর চিরলপাতার বাতাস বুকে করে সামনের দিকে হাঁটতে থাকি, ডানপাশে একটা মরা বকুলগাছ। এতো বড় ফাঁকা জায়গায় বকুলটা মরলো কীভাবে? কেউ কী দেখতে পায়নি? তার সামনে আর একটা বিবর্ণ খেজুর গাছ। কোনো এক কালে সে প্রকৃত চেহারায় ছিল। মন খারাপ করে আমরা এগোতে থাকি। ভবনের গা ঘেঁষে আরো কিছু গাছের দিকে আমরা তাকাতে গিয়েই লক্ষ করি, মাহমুদভাই আর অতনু একটা কাঁঠালিচাঁপার গাছের পাশে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। ওরা আমাদের সঙ্গে হাঁটে না সাধারণত। সাধারণত বের হয় সন্ধেবেলায়। মাঝেমধ্যে সকালে বের হয়, তো আমরা বেশ উৎফুল্ল হই। মাহমুদভাই তো রীতিমতো তার চিরাচরিত স্যাটায়ারের ভঙ্গিতে বলেন, ‘কী ব্যাপার, তোমরা ভূ-পর্যটনে বের হয়েছ, নাকি প্রকৃতিবিজ্ঞানে পিএইচ.ডি করবা।’ আমি বলি, ‘কিছু তো একটা করব, তো আপনি কাঁঠালিচাঁপা নিয়ে পড়লেন কেন?’

তিনি বলেন, ‘না, এখন তো ভাদ্র, কাঁঠালিচাঁপার ফুলের মৌসুম না, তবে গাছটাকে চিনিয়ে দিচ্ছিলাম অতনুকে। এই গাছ আরো আছে বোটানিক্যাল গার্ডেনে। তো তোমরা এখন কোন দিকে যাবে? শোনো, আমরা মূলত সন্ধেবেলা আসব। এখন এসেছি রেকি করতে। ধরো, কোনো দিকে জঙ্গল ঘন হয়ে গেছে, জঙ্গল জিনমের বাইরে অগোছালোভাবে বেড়ে ওঠা জঙ্গলে যেমন সেরিকালচার বা এপিকালচার প্রজেক্টের পশ্চিম পাশে তুতবাগানের দক্ষক্ষণে ঘন অরণ্য; ওইদিকে কিংবা রোকেয়ার ঠিক পেছনের দিকে সোজা পশ্চিমদিকে গেলে লেকের ধার দিয়ে জঙ্গলে বোধহয় গন্ধগোকুল পাওয়া যাবে। অতনু চেনে না। ওর খুব শখ, ও দেখবে।’ আমি বলি, ‘শুনুন, গন্ধগোকুল সহজে দেখা যায় না, আপনি পোলাওয়ের চালের গন্ধ পাবেন। তখন বুঝবেন ব্যাটা আশপাশে কোথাও আছে। আর সাপ, বেজি, শিয়াল, কুকুরের যন্ত্রণায় ওরা তো একটা সেফে থাকার চেষ্টা করে।’ তিনি বলেন, ‘ঠিক, অন্তত গন্ধটা শোকানোর চেষ্টা করা যাক। সন্ধেবেলা আমরা পুরনো ফোকলোর চত্বর থেকে রওনা দেবো। আপনারা আসুন।’

সবাই মিলে আমরা হবিবুরের দিকে হাঁটতে থাকলে বাঁ-পাশে কয়েকটি বিলেতি শিরীষ ও কড়ই গাছ দেখতে পাই। বাঁয়ে ঘুরে শিরীষের নিচে এসে সৈকত এতক্ষণে নিজে নিজেই আগের গানের দ্বিতীয় অন্তরা শুরু করে, ‘ওরে শিরীষ, ওরে শিরীষ, মৃদু হাসির অন্তরালে, গন্ধজালে শূন্য ঘিরিস -’

মাহমুদভাই সৈকতের মুখের দিকে তাকায়, অনিন্দ্য তাকায়, অতনু তাকায়। সে আবার প্রথমে ফিরে আসে – ‘আকাশ আমার ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে, সুরের আবীর হানব হাওয়ায়, নাচের আবীর হাওয়ায় হানে।’ অনিন্দ্য বলে, ‘মাহমুদভাই, এসবের অর্থ কী, এই পাগলামির অর্থ কী? শিরীষের পাতায় মৃদু হাসি, দুঃখ, বুড়ো, এইসব কী বলে?’ মাহমুদভাই খানিকটা নিশ্বাস নেয়; সম্ভবত গুছিয়ে কথা বলার জন্য।

‘ধরো, তোমার ভেতরে অনেক আকাঙক্ষার জন্ম হলো। অনেক গভীর প্রশান্তি আর বোধের ব্যঞ্জনা, তুমি খানিকটা উত্তেজিত করতে পেরেছ তোমার সংবেদ, তখন হয় কী, নতুন নতুন উপলব্ধির রেখা তৈরি হয় সেরিব্রামে – মুখে কথা আসে, চোখে নতুন আলো আসে – নতুন নতুন আবিষ্কারের নেশায় পাগল হয়ে ওঠে মন। ওই পর্যন্ত তো সবাই পৌঁছায় না, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৌঁছেছিলেন। ধরে নেওয়া হয়, বাংলার মানুষের হার্দিক জগতের চেয়ে প্রকৃতিকে তিনি ভালোভাবে চিনেছিলেন – আর তাঁর নিজস্বতাকে, মানবিক এষণাকে প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন, এই যে যুগলবন্দি, যখন বেজে ওঠে, ঝংকৃত হয়, তখন নতুন পদ পাই আমরা গানে, বা কবিতায়। দেখো, আমরা যা ভাবি, যেভাবে কাব্য করি তার বেশিরভাগ রবিময়, কারণ তিনি আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এই হিরণ্ময় সকালে আমরা খানিকটা পুলকিত হচ্ছি, গাছের পাতায় নাচন দেখে হর্ষ উৎপাদন করছি, এটা আবিষ্কার করার কাজ প্রথমে তিনি করেছিলেন; এই সব সূক্ষ্ম নরিতসু ভাবনারাজি যা আপাতভাবে বিলাস কারো কারো কাছে সেটা মূলত গভীর বিস্ময়কর অনুভূতির ভিন্ন ভিন্ন নাম। এই দেখার রাজ্যের মধ্যে অদেখার স্বর্গ আমাদের বিমোহিত করে রাখে।’ সৈকত বলে, ‘আচ্ছা, তিনি কি পজিটিভ মানুষ ছিলেন? নাকি, তাঁর অনেক গানে যেমন দুঃখবোধ কাজ করে, সেরকম দুঃখবাদী ছিলেন।’ মাহমুদভাই একটা অশথ গাছের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এখানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিজ্ঞান ভবনের মাঝ দিয়ে একটা লেক; লেকের পশ্চিমপাশে নানা জাতের ফুলগাছ। শুরু হয়েছে পান্থপাদপ দিয়ে। এপারে বড় বড় গাছ। অশথের পরেই একটা বড় বটগাছও আছে। মাহমুদভাই বলে, ‘জমিদার রবীন্দ্রনাথের জীবনে, কবি রবীন্দ্রনাথের জীবনে অজস্র দুঃখের ঘটনা ছিল, ব্যর্থতা, কষ্ট, দুঃখ, গস্নানি এবং অবিরাম অন্য মানুষের বিরোধিতাও ছিল, তবু তিনি পজিটিভ ছিলেন। আর এই সদর্থক চেতনার মূলে ছিল প্রকৃতি নিসর্গের বাংলা।’

আমরা দুই ভবনের মাঝবরাবর হাঁটতে থাকি। অতনু বলে, ‘অনিন্দ্য, তুমি কিছু বলতে চাও মনে হয়।’ অনিন্দ্য বলে, ‘আমি আসলে সবটা ধরতে পারি না। আমাদের বিশাল আকাশ, উদার প্রকৃতি, নির্মল সূর্য-চাঁদ-তারা সব মিলিয়ে তো আনন্দধারা প্রবাহিত হওয়ার কথা, সেখানে দুঃখবাদিতা আসে কীভাবে, আমাদের সব গানে, কবিতায় দুঃখ যেভাবে বাসা বেঁধে থাকে, তাতে তো মনে হয় আমরা আনন্দকে বুঝতে পারি না। ইউরোপ বা আমেরিকা যেভাবে জীবনকে দেখেছে আনন্দময় করে আমরা তো সেভাবে পারিনি।’ মাহমুদভাই চম্পা ফুলের পাতার খানিকটা ছিঁড়ে নিয়ে বলে, ‘শোনো, রবীন্দ্রনাথ কোথায় যেন লিখেছিলেন, হুবহু মনে নেই : ভারতবর্ষের যেমন বাধাহীন পরিষ্কার আকাশ, বহুবিসত্মৃত সমতলভূমি আছে, এমন ইউরোপের কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। এই জন্য আমাদের জাতি যেন বৃহৎ পৃথিবীর সেই অসীম ঔদাস্য আবিষ্কার করতে পেরেছে। এই জন্য আমাদের ভৈরবীতে কিংবা টোড়িতে সমস্ত বিশাল জগতের অন্তরের হাহাধ্বনি যেন ব্যক্ত করছে; পৃথিবীর একটা অংশ আছে সেটা কর্মপটু, স্নেহশীল, সীমাবদ্ধ, তার ভাবটা আমাদের মনে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে আমরা পারিনি। পৃথিবীতে যে-ভাবটা নির্জন, বিরল অসীম সেই আমাদের উদাসীন করে দিয়েছে।’ অনিন্দ্য মাথা নাড়ায়। আমি বলি, ‘সেই সাথে এই গাছপালা আমাদের জগতের তাপ রোদ থেকে দূরে রাখে, আমাদের তাদের দলভুক্ত করে, তাই গাছেদেরও একটা প্রতিবাদী শক্তি আছে – তারা সব অন্যায় ও ক্রূরতার বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়।’ সৈকত বলে, ‘আমি কিছুটা বুঝতে পারি। আমার মনে আছে, অনেক আগে, আমার তখন বৃক্ষপ্রেম ছিল না, আমি মহানন্দা নদীর ধারে বিশাল এক তমালগাছের নিচে দাঁড়িয়েছিলাম। সম্ভবত, বর্ষাকাল ছিল, গাছের নিচের দিকের অংশ পানিতে ডুবে আছে, মহানন্দা পদ্মার সঙ্গে মিলে গেছে – সামনে সমুদ্রের মতো – আমি প্রায় কালো রঙের বিশাল কা–র তমালের নিচে তার বাতাসের ঘ্রাণ নিচ্ছি। মনে হলো, এত গভীরভাবে আমি কখনো নিশ্বাস নিইনি।’ অতনু অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিল, সেটা তার স্বভাববিরুদ্ধ। সে বলে, ‘আপনাদের মধ্যে আমাকে খুব বেমানান মনে হচ্ছে, আমি গাছপালার মতলব বুঝি না, কবিতার কারসাজিও বুঝি না। তবে, প্রাণীরা আমাকে উত্তেজিত করে। তবু আজ মনে হচ্ছে, আমি তমালগাছ দেখতে চাই। ভীষণভাবে দেখতে চাই। এখানে কী কোথাও তমালগাছ আছে?’

আমি বলি, ‘শোনো, তোমাকে তমাল, হিজল, পলাশ, শিমুল ছাতিম দেখাবো আজ। আর তোমার প্রাণিকুলেরা তো নিজেরাই গায়ের জোরে অভয়ারণ্য তৈরি করেছে, সেটা কি জানো?’ সে বলে, ‘আগে রুয়েটের গেটে বড় একটা গাছে হাজারখানেক বাদুড় ছিল, ওদের রাজধানী বলা চলে, এখন তো দেখতে পাচ্ছি না।’ আমি বলি, ‘সেটার কথা বলতে পারছি না, তবে ক্যাম্পাসে বার্ড স্যাংচুয়ারি একটা পাখিরা নিজেরাই করেছে। দেশি-বিদেশি পাখি মিলে খালেদা আর তাপসীর মাঝখানে সব গাছপালা দখল করে নিয়েছে, রোকেয়ার সামনের গাছগুলোও দখলের আপেক্ষায়। এখনো গেলে দেখতে পাবে ওদের ভোরের আসরে কত বক, সারস, হাড়গিলা, মদনটাক আর শালিক ফিঙে শ্যামা ঘুঘু বুলবুলি তো রয়েছে।’ সে বলে, ‘সত্যি! কবে হলো, এটা আমি তো জানি না।’ সে আফসোস করতে থাকে দেখে মাহমুদভাই বলে, ‘আফসোস করো না, বৎস! এইখানে বারোশো একর জমির লাখ লাখ উদ্ভিদকুলে অজস্র পাখি তাদের গানের আসর বসায়, ওটা রাজধানী হতে পারে, তবে বড় বড় শহর আরো আছে, তোমাকে আশ্চর্য করে দেওয়ার জন্য পৃথিবীর সেরা প্রজাতির বিষাক্ত গোখরাও এখানে আছে – চাইলে দেখতে পারো। সে-মহাশয় বেশিরভাগ সময় জঙ্গলে শুয়ে থাকে; মাঝেমধ্যে ক্যাম্পাস প্রদক্ষক্ষণে বের হয়।’

সৈকত অনিন্দ্য অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিল। তারা মাহমুদভাইয়ের দার্শনিক অথচ রসালো কথা শুনে নিজের কথা প্রায়শ ভুলে যায়। তবু সৈকত বলতে পারে, ‘আমি তমালগাছটা দেখতে চাই। যদি হিজল একটা পাওয়া যায় তবে আরো ভালো হয়।’ আমরা কার্যত বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে যাচ্ছিলাম। বিশ-ত্রিশ একরের
পূর্ব-পশ্চিম রেললাইনের ধার দিয়ে বিশাল বোটানিক্যাল গার্ডেন। ১৯৬২ সালের দিকে তৈরি হয়েছিল। দুটো পুকুর আছে। একটা বড় আর একটা ছোট। নানা জাতের দেশি-বিদেশি বৃক্ষ-লতা-ফল-গুল্মে ভরা বাগান। হাঁটাচলার জন্য বেশ ঘাসের গালিচাসমৃদ্ধ পথঘাট রয়েছে। তবে, এর পাশ দিয়ে রাস্তাটা বন্ধ হওয়ার পর বিশেষত জুটিদের অত্যাচারে গেট বন্ধ রাখার কারণে ভেতরটা জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। কর্তৃপক্ষ এদিকে আর তাকাতে পারে না। একটা গ্রিনহাউস করেছিল, তার এখন মাথায় কিছু নেই। শুরুতেই ফুলের বাগান ঘাসে পরিপূর্ণ। আমরা গার্ডকে বলেকয়ে ঢুকে পড়ি। ডানদিকে একটা বড় চন্দ্রবোড়া সাপ সূর্যের আলোয় আলসেমি করছে। আর একটু এগিয়ে দেখা গেল, শেয়ালরা লাইন দিয়ে যাচ্ছে ভেতরের দিকে। বড় একটা মেহগনি গাছের গোড়ায় একটা বড় গুইসাপ শুয়ে আছে। মাহমুদভাই আবারো কথা বলা শুরু করেন, ‘তাহলে, সৈকত, অতনু, রাজকীয় অভ্যর্থনা হলো আমাদের। কী বলো? ওই চন্দ্রবোড়া কিংবা খাটাস (তিনি বরাবরই শেয়ালকে খাটাস বলেন) আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছে বাগানে প্রবেশের। শোনো, আমরা যখন রামেকে পড়তাম, আমার বন্ধুরা তখন এখানে, ধরো স্বদেশ বা দীনবন্ধু কিংবা কৌশিক তখন নতুন গাঁজায় টান দেওয়া শিখেছে। আমরা বড় পুকুরটায় পাশ দিয়ে ইউক্যালিপ্টাস গাছটার পাশ দিয়ে ভাঁটফুলের বাগান উজিয়ে ট্রেনলাইনের পাশে গিয়ে বসতাম; বড় একটা ড্রেন ছিল খালের মতো দেখতে, ডানকানা মাছ পর্যন্ত ছিল। তো তোমরা আমাকে সেই পুরনো স্মৃতির রাজ্যে নিয়ে গেলে, সেই উনিশ-কুড়ি-একুশের যৌবন আর গাছপালার নিশ্বাস-প্রশ্বাস কিংবা ধরো আমরা হাঁটতে হাঁটতে মেয়েদের হলের সামনে কৃষ্ণচূড়ার পাশে গিয়ে বান্ধবীদের কল দিতাম। তো চার-পাঁচটা সিস্নপ দিয়েও বান্ধবীরা আসে না; তখনই প্রথম আবিষ্কার করি, যে-মেয়েটাকে রুম আর নাম দিয়ে যে-সিস্নপ দিই সে গেটে ঢুকেই সিস্নপটা চারভাগ করে পস্নাস্টিকের বিনে ছুড়ে ফেলে দেয়। তো আমাদের কোনো দুঃখ বা রাগ তখনো পর্যন্ত হতো না। এই ক্যাম্পাসের ক্ষমতা অনেক, এই গাছপালা পুকুর ডোবা দিঘি পক্ষেকুল প্রাণিকুল মিলে যে-আনন্দযজ্ঞ তৈরি করেছে তার ক্ষমতা ভিসি সাহেবের চেয়ে বেশি, তিনি তো ক্ষণস্থায়ী আর এরা চিরস্থায়ী। তাই আমরা যৌবনে আরো পুলকিত হতে সারা ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়াতাম। তোমরা তো সব চেনো না।’ আমরা গ্রিনহাউসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হৈমমত্মী ফুলের দিকে একবার নজর দিই। সৈকত বলে, ‘তমালগাছ কই, হিজলই বা কোথায়?’ মাহমুদভাই আবার শুরু করেন, ‘শোনো, প্রকৃত হিজলের আনন্দঘন পরিবেশ পাওয়ার জন্য তোমাকে বিক্রমপুর বা নবাবগঞ্জ যেতে হবে। রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তুমি সারি সারি হিজল দেখতে পাবে, ঘন হিজলের ওপর দিয়ে বিসত্মৃত দিগন্ত দেখে, বিশেষত বিকেলবেলা তোমার মাথা খারাপ হয়ে যেতে পারে। রমনায় ঢুকেছো কখনো, ঢোকোনি মনে হয়, সেখানে দেখবে অনেক জাতের প্রাচীন বৃক্ষ। তুমি ধরো, জগদীশবাবু বা শর্মাবাবুর গন্ধ পাবে। বলধা গার্ডেনে রবীন্দ্রনাথের গন্ধ পাবে।’ মাহমুদভাই একটু এগিয়ে গিয়ে বলেন, ‘এই দেখ, নাগলিঙ্গম, এটা ছোট, সবচেয়ে প্রাচীন গাছটা আছে রমনায়।’ অতনু নাগলিঙ্গমের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তাকে বোকা বোকা মনে হয়; অনিন্দ্যও গাছটার কাছে যায়। বোঝা যায় ওরা এর নাম শোনেনি কখনো।

একটু এগিয়ে আমরা একমাত্র হিজলগাছটা দেখতে পেলাম। একা। বিমূর্ত। মাত্র একটা গাছ এরা কীভাবে লাগায়? কোন যুক্তিতে? পুকুরের ডানপাশে দেখা গেল ছাতিমগাছটাকে। একা। হতভম্ব। আমরা আরো এগিয়ে জঙ্গলের মধ্যে আবিষ্কার করলাম তমালগাছটাকে। ‘এরা এই গাছকে এখানে কেন লাগিয়েছে’ – সৈকত প্রশ্ন করে। সে বলে, ‘পুকুরের পাশেই থাকবে তমাল, হিজল, পানির গন্ধ স্পর্শ ছাড়া ওরা বাঁচতে পারে না।’ অনিন্দ্য আর অতনু গাছটার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকে। মাহমুদভাই পুকুরের দিকে তাকিয়ে আছেন অনেকক্ষণ। মাহমুদভাই বলেন, ‘দেখছো তোমরা কা-, এই পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে, রাসায়নিক সার আর মুরগির বিষ্ঠা দিয়ে পানির মাটি সব নষ্ট করে ফেলেছে। বোটানিক্যাল গার্ডেনের পুকুর থেকে কর্তৃপক্ষ বছরে কত টাকা পায়? খুব কী প্রয়োজন আছিল! এত গাছপালা প্রাণিদের জন্য নির্মল স্বচ্ছ পানি রাখার কোনো ইচছা আপনাদের হলো না।’ মাহমুদভাই আমাদের দিকে একবার তাকান। আমি কিছু বলি না, জানি, মহাশয়েরা ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর আসন টিকিয়ে রাখতেই দিনের আঠারো ঘণ্টা ব্যয় করেন, সেখানে গাছপালা-পুকুর-সর্প তো নস্যি। আর ডানদিকে ঘন জঙ্গলের ভেতর অনেক প্রাচীন বৃক্ষকে দেখা গেল নীরবতা পালন করছে। এবার বাঁয়ে যেতে হবে। সরু চিকন ঘাসের পথ মাড়িয়ে আমরা ছোট পুকুরটার কাছে কোনোমতে পৌঁছলাম। কোনো ব্যক্তি এখানে তার স্নেহের বা শাসনের হাত দেন না বোঝা যায়। অবশ্য প্রকৃতির নিজের একটা বিন্যাস ব্যবস্থাপনা বোধহয় আছে। তাই আমাদের খারাপ লাগে না। পুকুরটার চারপাশ দিয়ে অজস্র গাছের সারি – মেহগনি, জারুল, অর্জুন, শাল, শিশু, কড়ই – শালের বড় বড় পাতার আড়ালে অজস্র কাঠবিড়ালি দেখে আমরা শৈশবের দিনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করি।

বড় একখ- মেঘ বিজ্ঞান ভবনের কাছে আমাদের মাথার ওপর ছিল। আমরা সেদিকে অনেকক্ষণ খেয়াল করিনি। এখন দেখা যাচ্ছে, পূর্বদিকের বিশাল আকাশ জুড়ে সান্দ্র মেঘের আয়োজন। একদল মেঘের পেছনে পেছনে আরেকদল মেঘ, কেউ খুব কালো, কেউ ফ্যাকাশে। সৈকত গান ধরে অনুচ্চ স্বরে – ‘মেঘ বলেছে ‘যাব যাব’, রাত বলেছে ‘যাই’, সাগর বলে ‘কুল মিলেছে’ – আমি তো আর নাই’। মাহমুদভাই সৈকতকে বলেন, ‘জোরে, আরো জোরে।’ সে আরো জোরে ধরলে অতনু ওর সঙ্গে যোগ দেয়। অনিন্দ্যের গান আমরা কখনো শুনিনি – সে দেখি গলা ছেড়ে সুরে তালে বেশ গাইছে।

আমি মাহমুদভাইয়ের দিকে তাকালে তিনি তার প্রথাবশত       প্রথামতো অনুচ্চস্বরে শুরু করেন। আমি আর বাদ যাই কেন – ‘দুঃখ বলে, রইনু চুপে, তাহার পায়ের চিহ্নরূপে, আমি বলি, মিলাই আমি আর কিছু না চাই। ভুবন বলে, তোমার তরে আছে বরণমালা, গগন বলে, তোমার তরে লক্ষ প্রদীপ জ্বালা। প্রেম বলে যে যুগে যুগে তোমার লাগি আছি জেগে, মরণ বলে, আমি তোমার জীবনতরী বাই।’ এমন কা- ঘটবে আমরা কেউ বুঝতে পারি না, গান গাইতে গাইতে একদম কোনো ভূমিকা না করেই জোরে জোরে ষাঁড়ের মতো বৃষ্টি তেড়ে আসে। সৈকত বড়জোরে গাছের আড়ালে পালাতে গেলে মাহমুদভাই বলেন, ‘শোনো, বৎস, কচি বয়স, এতো ভয় কিসের? মনে করো এখন হাফপ্যান্ট পরার বয়স। যা বৃষ্টি তখন পড়ত মাথার ওপর, কোনো সমস্যা তো হইনি, এখনো হবে না। অবগাহন করো – কালিদাস হয়ে যাও। রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাও, বৃষ্টির জন্য চাতকের হাহাকার শুনেছ, গলা ফেটে তার রক্ত বের হয়ে যায় জল জল করে, বৃষ্টির জল ছাড়া সে খাবে না। আরো দেখো, বৃষ্টি তুমি কী উপভোগ করবে, আসল ভোক্তা তো গাছপালা আর প্রাণীরা – হিজল তমাল – তাকিয়ে দেখো, এক ফোঁটা করে বৃষ্টি পড়ছে পাতায় আর পাতা লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছে। ভেতরে তার অমৃতসুধা ঢুকে যাচ্ছে জলের ঘ্রাণে, বৃষ্টির নূপুরে তার তন্ত্রী দুলে দুলে উঠছে, কেউ মাথা নিচু করে বৃষ্টির জল নিচ্ছে, কেউ বা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ আবার ঠুনঠুন করছে, কাঁপছে, মাতাল হয়ে যাচ্ছে কেউ। আমরা বৃষ্টির কী বুঝব। আসো, লাইন দিয়ে দাঁড়াও। এই জারুলগুচ্ছের সামনে, দেখো সে কীভাবে বৃষ্টিকে গ্রহণ করছে, ধীরে ধীরে, বৃষ্টিময় হয়ে উঠছে।’

অতনু গভীরভাবে মাহমুদভাইয়ের তাকিয়ে থাকে। বৃষ্টিতে ভিজে তার ফর্সা ত্বকে আরো লাবণ্য ধরেছে। আর বিমোহিত হয়ে ওঠার ফলে চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। এই মুখ সে কখনো দেখেনি। সে হতভম্বের মতো প্রশ্ন করে, ‘এইসব আপনি কোথায় পেয়েছেন, আপনারা সবাই যেভাবে বোঝেন আমি তো সেভাবে বুঝি না, কবিতা আমার মাথায় ঢোকে না, প্রকৃতি বুঝি না, প্রাণিকুলের কিছু আকুতি বুঝি।’ মাহমুদভাই বলেন, ‘তুমিও এখন কবি। এই বৃষ্টিমাখা অরণ্যানীর মাঝে, তুমুল বৃষ্টির মাঝে আর গাছেদের আশেস্নষে তুমিও কবি, তোমার ভালো লাগছে, উপভোগ করছ, বলতে পারছ না। যারা কবিদের বোকা ভাবে তারা খানিকটা ভোঁতা, বস্ত্তগত পৃথিবীর দিকে থেকে থেকে তারা সংবেদহীন হয়ে পড়ে, পৃথিবীকে বস্ত্তময় করার তোমার কোনো দরকার নেই; পৃথিবীকে করে তোলো প্রাণময়, তাহলে এতো হাহাকার থাকবে না, জটিলতা থাকবে না, লোভ থাকবে না। গাছেদের কাছে শেখো, সিদ্ধার্থের মতো বোধিদ্রুমের তলায় গিয়ে বসো, এই বৃক্ষরাজি তোমাকে স্নেহ-মায়া-ভালোবাসা থেকে সভ্যতা পর্যন্ত শেখাবে। বাহ্য পৃথিবীকে তোমার সুন্দর মনে হবে, যার মাথার মধ্যে সব শান্ত সমাহিত গোছানো তারাই পৃথিবীকে পরিপাটি মনে করে, অবিমিশ্র শান্তি সে এমনিতেই পায়, তার মধ্যে ডুবে যায়।’

আমরা আর কিছু ভাবতে পারি না, মাহমুদভাইয়ের কথাবার্তায় পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয় আমাদের। বৃষ্টি থামে না – আমরা বড় ঘাসের চত্বর পেরিয়ে গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করি। চারিদিকে সবকিছু শান্ত, শুধু রাজত্ব বৃষ্টির, টানা বৃষ্টির পতনের শব্দ একটা ঐকতান তৈরি করে ফেলেছে এতক্ষণে – শালগাছের বড় পাতার আড়ালে একটা শালিক আশ্রয় নিয়েছে জবুথবু হয়ে আর বিরহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। সৈকত বলে, ‘দেখেছেন, পাখিটার অবস্থা।’ আমি বলি, ‘ওর কোনো সমস্যা নেই। এভাবে প্রকৃতির মধ্যে ওর বেড়ে ওঠায় ও অভ্যস্ত। দেখো, বৃষ্টির পর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে কেঁচো খাবার উৎসবে মাতবে।’ গেটের কাছে পৌঁছাতেই অনিন্দ্য পেছনের দিকে তাকায়, আমরাও তাকাই। সমস্ত বোটানিক্যাল গার্ডেন বৃষ্টির মাদকতায় নতুনভাবে জেগে উঠেছে। এরই ফাঁকে সূর্যটা মেঘের আড়াল থেকে সাময়িক মুক্তি পেয়েছে বলে তার কিছু আলো পড়েছে গাছেদের ওপর। বৃষ্টিধৌত গাছপালার এই দীপ্তি আমরা আগে কখনো দেখেছি বলে মনে করতে পারি না। অনিন্দ্য বুদ্ধদেবের থেকে ধার নিয়ে বলে, ‘চারিদিকে অসহ্য সুন্দর।’ অতনু বলে, ‘তাহলে আমরা সন্ধেবেলা আর আসব না? আমার তো অনেক কাজ ছিল।’ মাহমুদভাই ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আসবো, নিশ্চয় আমরা শেষ বিকেলের আলোয় জোহা হলের পাশে শুয়ে থাকা শহিদ নরকংকালের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সরোবরের পাশ দিয়ে দীর্ঘক্ষণ হাঁটব। বধ্যভূমির পাশ দিয়ে আধাপাকা রাস্তা দিয়ে সোজা পূর্বদিকে চলে যাবো – আবার ফিরবো অরণ্যের ভেতর দিয়ে। বধ্যভূমির কোনা থেকে জোহা হলের মাথার ওপর দিয়ে আবিরমাখা আকাশ দেখব, বুঝলে বৎস। এত উতলা হওয়ার তো কিছু নেই।’

সৈকত ততক্ষণে রাস্তা থেকে ঘন আস্তরণের ঘাসে নেমে গেছে – ওকে দেখে অনিন্দ্যও নেমে পড়ে। বৃষ্টির উত্তেজনায় ঘাসেরা যৌবন পেয়েছে বোঝা যায়। সৈকত-অনিন্দ্য পাগলের মতো ঘাসের ডগায় হাত বোলায় – অতনু ওদিকে তাকিয়ে থাকে। মাহমুদভাই দেখেন সকালের সূর্য ঘাস জলের সঙ্গে কিছু যুবক শিশুতে পরিণত হয়েছে – কোনো কথা মুখে তার দেখি না, আমার মনে হতে থাকে আমার যা ছিল অনাস্বাদিত তার স্বাদ পেলাম এই গাছের কাছে, পাতার কাছে, বৃষ্টির কাছে। এই সকালটাকে মনে রাখতে পারবো কি অনেকদিন? এই যে আমাদের হারিয়ে যাওয়া বিলীন হয়ে যাওয়া অবগাহিত হওয়ার মুহূর্তগুলোকে আমরা জমা রাখতে পারব? হঠাৎ শুনি সৈকত গান শুরু করেছে, ‘এই আকাশে, আমার মুক্তি আলোয় আলোয়, আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে।’ পরের অন্তরা অনিন্দ্য শুরু করে : ‘দেহমনের সুদূর পারে, হারিয়ে ফেলি আপনারে।’ গানের সুরে আমার মুক্তি ঊর্ধ্বে ভাসে। অতনুও যোগ দেয়। আমরা দুজন আধপাকা রাস্তা থেকে নামি না, তিনজনের দিকে তাকিয়ে থাকি, তারা তখন নাচতে শুরু করেছে – বৃষ্টিবিধৌত সকালে আমাদের আমন্ত্রণে জীবনের অর্গল তাদের খুলে গেছে – সীমাহীন আনন্দে ওরা গান গাইতে থাকে আর মৃদুতালে নাচতে থাকে। মাহমুদভাই, অনেকক্ষণ নীরব থেকে বলেন, ‘এই হলো আসল মুক্তি, কোনো পিছুটান ছাড়া সম্পূর্ণ হৃদয় ভরে আনন্দ উপভোগ করার মধ্য দিয়ে মুক্তি।’

মাহমুদভাই, বোটানিক্যাল গার্ডেনের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকেন। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, দেখি, আনন্দ, বিস্ময় আর লাবণ্য ঘিরে ধরেছে তার সমস্ত চোখ।