চন্দন ট্রেন থেকে নেমেছে ভোর পাঁচটায়। শীতের ভোর পাঁচটা মানে ঘরের বিছানায় গভীর রাত। স্টেশনটাকে দেখে তাই মনে হচ্ছে। যাত্রী নামিয়ে ট্রেন চলে যাওয়া মাত্র স্টেশনে নেমে এলো নীরবতা। এতো কুয়াশা নেমেছে যে, স্টেশনের লাইটগুলি যেন ঘোলাটে চোখে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। অস্বচ্ছ ঘোলাটে একটা পরিত্যক্ত ভৌতিক স্টেশনের মতো লাগছে। এতো শীত করছে যে কান-মাথা ঢাকা উলের গরম টুপি না এনে কী যে ভুল করেছে চন্দন এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। মাফলার দিয়ে টুপির মতো কান-মাথা পেঁচিয়ে কোটের কলার উঁচিয়ে দিলো। ঠান্ডা আটকানোর সর্বপ্রকার চেষ্টা আর কী।

ব্যাকপ্যাক কাঁধে দু-হাত পকেটে ঢুকিয়ে ওয়েটিং রুমে এসে চন্দন হতাশ হলো।
শুয়ে-বসে যাত্রীসকল ঘুমিয়ে। বসার মতো কোনো জায়গাও খালি নেই। এমনকি সোফা বেঞ্চের গোপন ফাঁকে দুটি কুকুর জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। ওরা শুধু শংকিত দৃষ্টিতে চন্দনকে দেখলো।

ওয়েটিং রুম থেকে চন্দন বেরিয়ে এলো। খোলা প্ল্যাটফর্মে মাথার ওপর টিনের ছাউনি আছে। যাত্রীদের জন্য সারি সারি বেঞ্চ রয়েছে। সব জনমানবশূন্য। এমনকি স্টেশনের কুকুরদেরও কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

সকাল আটটায় ঢাকা মেইল। এখন বাজে ভোর ৫টা। তিন ঘণ্টার অপেক্ষা। চন্দন একটা বেঞ্চিতে বসে ব্যাকপ্যাক থেকে গায়ের শালটা বের করলো। শালটা যে সঙ্গে এনেছে সেজন্য নিজেকে ধন্যবাদ দিলো। ব্যাকপ্যাককে বালিশ বানিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে শুয়ে পড়লো।

ট্রেনের হুইসেল আর সাড়াশব্দে চন্দন চমকে উঠে বসে। সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘড়ি দেখে তার টেনশন দূর হয়। ৬টা ৩০। এখনো দেড় ঘণ্টা বাকি।

পাশের বেঞ্চে একজন মহিলা বসে বসে ঘুমাচ্ছেন। তার দিকে পেছন ফিরে। হাতে-পায়ে মোজা, গায়ে ফুলহাতা কার্ডিগান। শালে মুখ-মাথা মোড়া। মহিলার কোলে মাথা রেখে উলের টুপি-জ্যাকেট পরা নয়-দশ বছরের একটি ছেলে মায়ের শালে মুখ ঢেকে শুয়ে আছে। এরা কখন এসেছে চন্দন টের পায়নি। চন্দন আবার ঘুমের আয়োজন করছে, এমন সময় কুয়াশা ভেদ করে ভেসে এলো চা-ওয়ালার ডাক, চা চা চায়ে।

চন্দন ও মহিলা একই সঙ্গে ডাকলো, এই চা …। অপ্রস্তুত দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো, যা ঠান্ডা পড়েছে!

চায়ের দাম মিটিয়ে চন্দন চা খাওয়ার জন্য তার কান-মাথা ঢাকা মাফলার খুললো। চায়ের কাপে একটা  সুখচুমুকও দিয়েছে। বিস্মিত গলায় কেউ জিজ্ঞেস করলো, স্যার, আপনি!

চন্দন অবাক হয়ে মহিলার মুখের দিকে তাকালো। চিনতে পারলো না। ভাবলো অন্য কাউকে বলেছে। পেছন ফিরে দেখলো সে ছাড়া অন্য কোনো জনমানুষ নেই।

চন্দন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমাকে বলছেন?

মহিলা মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকালো। মাথা থেকে শাল নামিয়ে শরীরে জড়িয়ে নিল। চেনা চেনা মনে হয়, চেনা যায় না। কবে কোথায় কোনকালে দেখা হয়েছিল! স্মৃতিতে আছে, স্মরণে নেই। চন্দন দ্বিধায় পড়ে, বিব্রত বোধ করে।

মহিলা ব্যাকুল স্বরে বলল, স্যার, আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি পারমিতা, পারু। আপনার ছাত্রী।

– পারু তুমি! কী আশ্চর্য, হঠাৎ দেখা হয়ে গেল! তুমি এখানে? কোথায় থাকো? কোথায় যাচ্ছো?

– এখানেই থাকি। কুয়াশা কমলে রওনা দেবো। ওর বাবা এসে নিয়ে যাবে।

শায়িত ছেলেকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমার ছেলে?

পারু মাথা ঝাঁকালো।

– কার মতো দেখতে হয়েছে? তোমার মতো, না ওর বাবার মতো?

পারু চন্দনের চোখে দৃষ্টি স্থির রেখে রহস্যের মৃদু হাসি হেসে বলল, ওর বাবার মতো।

চন্দন অস্বস্তি বোধ করে। পারুর চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। বলল, আমার ট্রেন  সকাল আটটায়, ঢাকা মেইল। কিছু মনে করো না। আমি খানিক বিশ্রাম নিই। চন্দন শাল মুড়ি দিয়ে মাখা ঢেকে শুয়ে পড়লো। 

পারু মৃদু স্বরে বলল, আমি জেগে  আছি। ঢাকা মেইল এলে আপনাকে জাগিয়ে দেবো স্যার।

চন্দন কোনো উত্তর দিলো না। আসলে পারুর কাছ থেকে সে পালাতে চাইছে। চোখ বন্ধ করে সে ঘুমাতে চাইলো। যেন ঘুম এলেই তার মুক্তি। পারুর মুখোমুখি হতে হবে না। কোনো সওয়াল-জবাব তাকে করতে হবে না। সে ভুলে থাকতে চায়।

সেই  ঘটনার পর কত বছর পার হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম কষ্ট হতো। তার সুখের জন্য ভাইবোন বাবা-মায়ের দায়িত্ব সে এড়াতে পারে না। তার আত্মত্যাগে তার ভাইবোনরা আজ সুশিক্ষিক, স্বনির্ভর এবং সুখী সংসারজীবন যাপন করছে।

বাবা-মা মৃত্যুর আগে সকল ছেলেমেয়েকে দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত দেখে গেছেন। 

– কিন্তু তুমি? তোমার কথা কিছু বললে না। তুমি সুখী তো?

মনে মনে হেসে ওঠে চন্দন, নিশ্চয়ই। আমার ভাইবোনদের কৃতিত্ব আমাকে গর্বিত করে। ওদের সাফল্য আনন্দময় সংসার দেখে আমি সুখীতম মানুষ!

– তুমি কাপুরুষ। সুখের বর্মে নিজেকে তুমি দুঃখের ঘরে বন্দি করে রেখেছো। বাইরের আনন্দ মুখোশটা তোমার সুখ।

– আমি পিতার বড় সন্তান। দায়িত্ববান বড় ভাই। পিতার  অবর্তমানে সকলের আস্থা ও ভরসার আশ্রয়কেন্দ্র। আমি দায়িত্বসচেতন। তাদের স্বপ্ন বিশ্বাস ভঙ্গ করতে পারি না।

জনান্তিকে হেসে উঠলো কেউ, পারু তোমাকে বিশ্বাস করেছিল। আশ্রয় চেয়েছিল। তার দায়িত্ব নিলে না কেন?

সংসারের চাকা সচল রাখতে সেই কলেজজীবন থেকে চন্দন টিউশনি বেছে নিয়েছে। গৃহশিক্ষক হিসেবে তার সুনামও আছে। এমএসসি পাশ করে প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার পদে চাকরি পেয়েও চন্দন টিউশনি করা ছেড়ে দেয়নি। ভাইবোনেরা বড় হয়েছে। সকলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। সংসারের খরচ বেড়েছে। তার দায় চন্দনকে বহন করতে হয়। অফিস শেষ করে পারুদের বাসায়। পারুকে পড়িয়ে তবে বাসায় ফেরে।

পারুর বাবা পুলিশের এসপি। এক ভাই তিন বোন।

পারু সবার ছোট। বড় ভাই ও দু-বোনের বিয়ে হয়েছে। পারু  এসএসসি পাশ করে সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে।

যেদিন পারুর বাবা ও বড় ভাই বাসায় থাকে না, সেদিন পারু অদ্ভুত এক কাণ্ড করবে। বইয়ের ব্যাগের পরিবর্তে খাবারের থালা হাতে পড়তে আসে। চন্দন বিব্রত বোধ করে। বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে, এসব কী? বইখাতা বের করো।

পারু সকরুণ কণ্ঠে বলে, স্যার, আপনি সারাদিন অফিস করে ফিরেছেন। এগুলো না খেলে আমি পড়তে বসবো না।

চন্দন কঠিন গলায় বললো, আমি তোমার প্রাইভেট টিউটর। তোমাকে পড়াতে আসি। এসব আমার পছন্দ না। যাও, বই নিয়ে এসো।

পারুর চোখে জল টলমল করে। করুণ কণ্ঠে বলে, স্যার,  আপনি এতো নিষ্ঠুর কেন? একটু না খেলে পড়ায় আমার মন বসবে না।

চন্দন বাধ্য হয়ে কঠিন মুখে একটি মিষ্টি মুখে পুরে  ঢকঢক করে এক গ্লাস পানিতে গিলে ফেলে। কঠিন মুখে বলে, এগুলো সরাও। বই নিয়ে পড়তে বসো।

পারুর চোখে জল, মুখে হাসি। দ্রুতই সে বই নিয়ে পড়তে বসে। অন্যান্য দিনের তুলনায় সেদিন সে অধিক মনোযোগী ছাত্রী। দ্রুত বুঝতে পারে। পরীক্ষায় ভালো করে। যেমন ছাত্রী পেলে চন্দন সুখী হতে পারে পারু আজ তেমন ছাত্রী।

কোনো কোনো দিন পড়া থেকে মুখ তুলে পারু হঠাৎই জিজ্ঞেস করে,  স্যার, আপনার চুলগুলি কী সুন্দর কোঁকড়ানো! আমার চুলের ছিরি দেখেন। আপনি চুলে কী দেন?

চন্দন কোনো উত্তর না দিয়ে কঠিন চোখে তাকায়। পারু সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে পড়ায় মনোযোগী হয়।

পারুর আচার-আচরণে চন্দন শুধু বিব্রত বোধ করে না, এখন ভয়ের চোখে দেখে। সে মনস্থির করে, এ মাসের পর  টিউশনিটি সে ছেড়ে দেবে। তার আগেই এক অঘটন ঘটে গেল।

রোববার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। চন্দনের অফিস-টিউশনি দুই-ই বন্ধ। প্রতিদিনের মতো তাড়া নেই। চন্দন জেগে ছিল, বিছানা না ছেড়ে আলসেমির আনন্দ উপভোগ করছিল। এমন সময় ডোরবেলের শব্দ শোনা গেল। সবার ছোট শিপলু ছুটে এসে গভীর উত্তেজনায় চন্দনকে জানিয়ে গেল, পুলিশ এসেছে।

ড্রইংরুমে এসে চন্দন পারুর বাবা আর বড় ভাইকে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। নিশ্চয়ই ভয়ানক কোনো বিপদ হয়েছে।  চন্দনকে দেখে পারুর বাবা কিছুটা শান্ত হলেন। যা ভেবেছেন তা নয়। তবু পেশাসুলভ মেজাজে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলেন, পারু কোথায়?

– মানে! ভয়ে চন্দনের কথা আটকে যায়। উদ্ভ্রান্ত এলোমেলো হয়ে পড়ে।

– পারু কোথায় আমি জানি না, সত্যি জানি না।  আমি কী করে বলবো? পারুর কী হয়েছে?

পারুর বড় ভাই প্রবল ক্রোধে সবে উচ্চারণ করেছেন, বাস্টার্ড … সঙ্গে সঙ্গে পারুর বাবা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। তিনি নরম কণ্ঠে বললেন, সকাল থেকে পারুকে বাড়িতে দেখছি না। ভাবলাম তোমার ছাত্রী, কোনো কারণে তোমার কাছে আসতে পারে। তারপর বাবার দিকে মুখ করে জিজ্ঞেস করলেন, বাড়িটা আপনার?

বাবা বিগলিত হয়ে বললেন, না স্যার। ভাড়া থাকি।

– কোথায়  চাকরি করেন?

– স্যার, খাদ্য মন্ত্রণালয়ে। হেড অ্যাসিস্ট্যান্ট।

চন্দন খুব অপমানিত বোধ করে। পারুর বাবা-ভাই চলে যেতে সব রাগ জমা হয় বাবার ওপর। কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলো, তুমি এত স্যার স্যার করছিলে কেন? উনি কি তোমার বস হন?

বাবা বললেন, পুলিশদের আমার খুব ভয়। প্রবাদ আছে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশ ছুঁলে ছত্রিশ খা। এখন দেখো কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।

চন্দন ভয় পাচ্ছে আবার অস্থির বোধ করছে। পারু কোথায় যেতে পারে? বাচ্চা একটা মেয়ে, আবেগের তাড়নায় কী না কী করে বসে। অনাকাক্সিক্ষত বিপদও তাড়া করতে পারে। কী দুঃসাহসী মেয়ে! বাড়ি ফিরলে পারুর কী অবস্থা হবে একবার ভেবে দেখলো না। চন্দনের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।

শিক্ষক হিসেবে পারুর জন্য আমার কি কোনো দায়িত্ব আছে? চন্দন ভাবলো। তার অস্থিরতা বাড়ছে। হঠাৎ মনে পড়লো পারু তাকে একটা টেলিফোন নম্বর দিয়ে বলেছিল, আমার বান্ধবীর নম্বর। আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে ফোন করতে পারেন।

চন্দন কঠিন চোখে তাকালে পারু বলল, পড়াশোনার ব্যাপারে প্রয়োজন হতে পারে। তাছাড়া আপনার কোনো অসুবিধা থাকলে, কোনোদিন আসতে না পারলে জানিয়ে  দেবেন। আপনার যে-কোনো মেসেজ ওকে জানালে আমি পেয়ে যাব।

মানিব্যাগে নম্বরটি পাওয়া গেল। পাড়ার দোকান থেকে সে ফোন করলো। চন্দন কিছু বলার আগে একটি মেয়ের কণ্ঠ ভেসে এলো, সøামাইকুম স্যার, আমি পিংকি। পারুর বান্ধবী।

– পারুর কোনো খোঁজ জানো?

– জানি স্যার। পারু চিঠি লিখে গৃহত্যাগ করেছে। এখন ময়মনসিংহে ওর বড় বোনের কাছে আছে।

– পারু এমন কাজ করলো কেন? কলেজে পড়ে, তার কোনো দায়িত্ববোধ নেই?

– স্যার, পারুর দায়িত্ববোধ আছে বলেই তার বাবাকে চিঠি লিখে জানিয়ে এসেছে। একটা মেয়ে কেন গৃহত্যাগ করে সে আপনি জানেন না?

– না।

– পারু আপনার জন্য ঘর ছেড়েছে।

বিকেলে পারুর বাবার কাছ থেকে ডাক এলো। তিনি করুণ গলায় চন্দনকে বললেন, পারু আমার মা মরা মেয়ে। খুব জেদী আর অভিমানী। ওর বড়বোন ওকে সামলে রেখেছে। ও জেদ ধরেছে তুমি না গেলে পারু ঢাকায় ফিরবে না। বলো, এখন আমি কী করি?

চন্দন বলল, আপনি বললে আমি নিয়ে আসতে পারি।

পারু চন্দনকে পেয়ে আনন্দে থইথই  করতে লাগলো। পারু যা করে সবটাতে তার বড় বোন সমর্থন জোগায়। চন্দনকে নির্জনে নিয়ে আনন্দে ভাসতে ভাসতে পারু বলল, স্যার, এখন তো আপনি বন্দি হয়ে গেছেন। আর পালাতে পারবেন না।

– তার মানে? চন্দনের দৃষ্টি কঠিন হয়ে ওঠে। 

পারু বলল, কেন, আমার চিঠি আপনি পড়েননি?

– না।

পারু লজ্জায় চোখ নামিয়ে চন্দনের চোখের সামনে একটা কাগজ মেলে ধরে। সেখানে লেখা আছে :

আব্বা,

আমি স্যারকে বিয়ে করবো। স্যারকে না পেলে আমি বাঁচবো না।

পারু প্রবল আবেগে চন্দনকে সজোরে আঁকড়ে ধরলো। পাগলের মতো তার বুকে নাক ঘসে ফিসফিস করে প্রলাপ বকছিল, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না।

ভয়ে বিস্ময়ে কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত আবেগে চন্দন স্তম্ভিত। পাথরের মূর্তির মতো সে নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল।

চন্দনের মনে হলো পারুকে তার বাবার কাছে পৌঁছে দিয়ে তার দায়িত্ব শেষ হবে। তার মুক্তি। সে এমন কিছু করবে না যাতে পারু তার ওপর চটে যায়। তার মতে মতে থাকাই ভালো।

বিকেলে পারু যখন তার বড় বোনের কাছে আবদার করলো, স্যারকে নিয়ে সে তার বান্ধবী শর্মিষ্ঠার বাড়িতে যাবে তিনি সহজে রাজি হলেন। ফিরতে রাত হলো। দুজনের মুখে কোনো কথা নেই। অনাস্বাদিত পরম প্রাপ্তির আনন্দে পারু ভাসছে! সেই বিবশ-বিহ্বল তীব্র আনন্দ-যাতনার মুহূর্ত স্মরণ করে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে। চন্দন এক ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত। কী ঘটেছে কেন হয়েছে কিছুই সে বুঝতে পারছে না। তার মনে  প্রশ্নবোধক জেগে রইল।

ঢাকায় ফিরে পারুদের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব এলে চন্দনদের সংসারে মৃত্যুশোক নেমে এলো। সকলে কথা বলতে ভুলে গেল। যন্ত্রের মতো চলাফেরা করে। চন্দন চোখ তুলে তাকাতে পারে না। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। সকল দায় তার ওপর ভর করে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল এদের অন্ধকারে রেখে সে একা আনন্দভুবনে ফিরতে পারে না। মা-বাবা, ভাইবোন সকলকে নিয়েই হবে তার অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনন্দযাত্রা।

স্যার … স্যার … কোনো সাড়া না পেয়ে পারু চন্দনের শরীর নাড়া দিয়ে ডাকলো, স্যার …

চন্দন উঠে বসলো, ট্রেন কি এসে গেছে?

– না। সময় হয়েছে।

চা-ওয়ালা কাছে এসে দাঁড়ালো, স্যার, চা লাগবে?

দাও। চা-ওয়ালা দু-কাপ চা দিয়ে অন্য ক্রেতার কাছে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে পারু জিজ্ঞেস করলো, স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?

– করো।

– ভাবি, ছেলেমেয়েরা কেমন আছে?

চন্দন শব্দ করে হেসে উঠলো, আমার সংসার হয়নি। ভাইবোনদের দাঁড় করাতে করাতে আমার বেলা যে শেষ। শেষ বেলাতে বিয়ে-সংসার এসব ঝামেলা বাড়িয়ে কী লাভ? এই তো বেশ আছি।

পারু বেদনার সঙ্গে বলল, সবাই যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। আপনি কেন একা থাকবেন? দায়িত্ব পালন তো শেষ হয়েছে।

চন্দন নীরব রইলো। গভীর এক দীর্ঘশ্বাস কুয়াশায় মিলিয়ে গেল।

– স্যার, জীবন দীর্ঘ সময়। কথা বলার জন্যও একজন মানুষ দরকার হয়। আপনি বিয়ে করলে আমি শান্তি পেতাম।

এমন সময় শ্যামলবরণ এক দীর্ঘ পুরুষ ফর্সা মাথাভর্তি ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল এক বালকের হাত ধরে কাছে এসে দাঁড়ালো। পারু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, আমার হাসবেন্ড আর দুষ্টুটা আমার ছেলে।

ছেলেটি মাকে জড়িয়ে চন্দনকে দেখতে লাগলো।

পারুর হাসবেন্ড হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলো, পারুর মুখে আপনার কথা শুনেছি। এসে যখন পড়েছেন, ছাত্রীর বাসায় দুটা দিন বেড়িয়ে যান।

চন্দন বারবার ছেলেটিকে দেখছিল। তার কিশোরবেলার ছবি কী? চমকে তাকালো তার বাবার দিকে।

পারু বলল, স্যার, দুটা দিন রেস্ট নিয়ে যান। আপনাকে যা ভয় পেতাম, কী রাগী আর গম্ভীর ছিলেন! হেড স্যারদের মতো।  এখন অনেক হাসিখুশি হয়েছেন।

চন্দন বললো, এবার হবে না। সময় করে তোমার বাড়িতে একবার বেড়াতে আসবো।

পারুর স্বামী তাঁর ভিজিটিং কার্ড বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, স্যার, আপনি এলে আমরা খুব খুশি হবো। সম্মানিত বোধ করবো।

পারুর পরিবার, একটি সুখী সংসার ধীরে ধীরে চন্দনের দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে। কিছুদূর গিয়ে ছেলেটি ফিরে তাকালো। চন্দনের মুখে হাসি ফুটলো। ছেলেটি হেসে মায়ের আঁচলে মুখ লুকালো।

পারু বলেছে, ছেলে দেখতে তার বাবার মতো। চন্দন তার কোনো মিল খুঁজে পেল না। আবার সে ধাঁধায় পড়লো। মনে জেগে উঠলো প্রশ্নবোধক চিহ্ন। আর এক রহস্য।