কামেল দাউদ ও আলবেয়ার কামুর বস্ত্রহরণ

মনজুরুল হক

সাহিত্যে অ্যাবসার্ড বা অবাস্তব ভাবনা ও সেইসঙ্গে অস্তিত্ববাদী চিন্তার প্রতিফলনের গুরু হিসেবে যাকে গণ্য করা হয়, সেই আলবেয়ার কামু সন্দেহাতীতভাবেই ঋষিতুল্য ব্যক্তিত্ব। নিজ স্বদেশ-ভূমি ফ্রান্সের গন্ডি ছাড়িয়ে তাঁর খ্যাতি অনেক আগেই বিশ্বজুড়ে পাখা মেলেছে এবং আমরা যারা কামুর রচনা অর্ধেক পাঠ করে এবং এক-চতুর্থাংশের অর্থ উদ্ধার করে রীতিমতো তাঁর অন্ধ অনুসারীতে পরিণত হয়েছি, তাদের চোখে কামু ঋষিতুল্য ব্যক্তিত্বের চাইতেও আরো অনেক বেশি কিছু। ফলে দুবছর আগে কামুর জন্মশতবার্ষিকী সেই অনুরাগীদের জন্য ছিল প্রয়াত কামুকে আবারো স্মরণ করে তাঁর বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের একটি বছর। বিশ্বের অনেক দেশেই কামুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে নতুন অনুবাদে তাঁর পুরনো অনেক লেখা প্রকাশিত হওয়া ছাড়াও এ-পর্যন্ত অপ্রকাশিত থেকে যাওয়া তাঁর কিছু কিছু রচনাও আলোর মুখ দেখেছে। সেরকম একটি গ্রন্থ হচ্ছে আলজিয়ার্স ক্রনিকল।

আলজেরিয়ায় বসবাসের দিনগুলোতে সাংবাদিকতায় জড়িত থাকার সূত্রে যেসব লেখা তিনি লিখেছিলেন, সেগুলোর একটি সংকলন হচ্ছে এ-গ্রন্থ। তবে অন্যদিক থেকে আলজিয়ার্স ক্রনিকলে অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি অবস্থানরত কামুর দেখা মেলে। হয়তোবা এ-কারণে যে, কমিউনিস্ট মতাদর্শ থেকে তখনো তিনি পুরোপুরি লাইনচ্যুত হননি এবং হয়তোবা সেজন্যেই তাঁর অবস্থান তখনো ছিল মানুষের জীবনের চাওয়া-পাওয়া, সুখ-দুঃখ আর আনন্দ-বেদনার অনেক কাছাকাছি। পরবর্তীকালে খ্যাতি আর প্রাপ্তির মোহ কামুকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ায় যে কামুর দেখা আমরা পাই তিনি হচ্ছেন অনেক বেশি জটিল এবং পরস্পরবিরোধী নানারকম ভাবনাচিন্তার মিলন থেকে উঠে আসা এমন একজন মানুষ, নিজের উল্লেখ করে যাওয়া বর্ণনার মতোই নিজ-হাতে পর্বতচূড়ায় পাথর বহন করে নিয়ে যাওয়ার পরমুহূর্তে যে পাথর তাঁর নিজেরই হাত ফসকে আবারো গড়িয়ে চলে গেছে পাহাড়ের একেবারে নিচে। পরবর্তী জীবনে প্রাপ্তির ভাগে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ও ফ্রান্সের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রকাশনা কোম্পানি গালিমারের সঙ্গে স্থায়ী সখ্য বস্ত্তগত প্রাপ্তির দিক থেকে সফল একজন মানুষে তাঁকে পরিণত করলেও বিভ্রান্তির গোলকধাঁধা থেকে বের হয়ে আসা তাঁর পক্ষে যেন আর সম্ভব হয়নি। তবে তা সত্ত্বেও জীবনের অর্থহীনতা নিয়ে আমাদের গভীরভাবে যা ভাবিয়ে তুলতে সমর্থ, সেরকম অনেক কীর্তি তিনি তাঁর ঐতিহ্যের ভান্ডারে রেখে গেছেন, যা কিনা তাঁকে দিয়েছে বিংশ শতাব্দীর নেতৃস্থানীয় একজন ঔপন্যাসিক, সমাজ-গবেষক ও দার্শনিকের মর্যাদা। ফলে ২০১৩ সালে কামুর জন্মশতবার্ষিকী যেন সত্যিকার অর্থে হয়ে উঠেছিল বছরজুড়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের এক সময়ে। সাহিত্যের বিশ্লেষক ও গবেষকেরা তাঁকে স্মরণ করেছেন তাঁর সৃষ্টির গভীরতার মূল্যায়নের আলোকে, সমাজ-গবেষকরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন তাঁর আলজেরীয় উৎস ও কামুর জীবনে তা কতটা প্রভাব ফেলেছে, সেই বাস্তবতা। তবে পাশাপাশি আবার ব্যক্তি কামু ও তাঁরচিন্তাভাবনায় ফুটে ওঠা নানারকম বৈপরীত্যও অবশ্য শতবার্ষিকীকে সামনে রেখে লেখক-দার্শনিক কামুর মূল্যায়নের চুলচেরা হিসাবে উঠে এসেছে, যদিও ব্যাপ্তি ও প্রচারের দিক থেকে সেরকম বিস্তৃতি কিংবা গভীর কোনো আবেদন সেগুলোর তেমন ছিল না।

কামুর শতবর্ষেই আলজেরিয়ার সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন লেখক-সাংবাদিক প্রকাশ করেছিলেন ফরাসি ভাষায় লেখা প্রায় ১৪০ পৃষ্ঠার ছোট একটি উপন্যাস, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আঙ্গিকেলেখা যে-উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন কামুর প্রতি আলজেরীয়দের ক্ষোভ আর দুঃখের প্রকাশকে। লেখক নিজে যদিও উল্লেখ করেছেন সেই উপন্যাস হচ্ছে শতবার্ষিকীতে কামুর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধারপ্রকাশ, তবে উপন্যাস পাঠ করে যে-কোনো পাঠক সহজেই বুঝে নিতে পারবেন কামুর প্রতি ক্ষোভের জ্বালাকেই তিনি বরং নিংড়ে বের করে এনেছেন তাঁর সেই ছোট অথচ অর্থবহুল উপন্যাসে।

কামুর বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অনাহূত বা আগন্তুক, ইংরেজি অনুবাদের কল্যাণে যেটাকে আমরা Outsider বা Stranger হিসেবে জানি। সাহিত্যের তাত্ত্বিকেরা সেই উপন্যাসে খুঁজে পান কামুর সাড়া-জাগানো তাত্ত্বিক মতবাদ Absurdity বা জীবনের অর্থহীনতার গভীর উপাদান, যা কিনা তাঁদের ভাবিয়ে তোলে চাওয়া-পাওয়ার এই জগতে মানুষের সত্যিকার অবস্থান নিয়ে। ১৯৩৮ সালে কামুর বয়স যখন ২৫ বছর, একটি আনন্দময় মৃত্যু নামের একটি উপন্যাস তখন তিনি লিখেছিলেন, যেটা প্রকাশিত হয়েছিল লেখকের মৃত্যুর পর। মনে করা হয়, তরুণ বয়সে লেখা সে-উপন্যাস নিয়ে নিজে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না বলেই বাক্সবন্দি অবস্থায় সেই উপন্যাসের পান্ডুলিপি তিনি রেখে দিয়েছিলেন। ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বন্ধুকে দেখানোর পর তাদের কাছ থেকে পাওয়া বিরূপ মতামত লেখকের সেই  সিদ্ধান্তের পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। তবে উপন্যাস বাক্সবন্দি অবস্থায় রেখে দেওয়া হলেও এর পটভূমি কামুর মনে বাসা বেঁধেছিল এবং পরবর্তীকালে নতুন উদ্যোগে ভিন্ন ধরনের তিনটি গ্রন্থ রচনায় একই সময়ে নিয়োজিত থাকার সময় সেই কাহিনির সূত্র ধরে তিন রচনার মধ্যে একমাত্র উপন্যাস অনাহূত তিনি লিখেছিলেন। সেই তিনটি গ্রন্থকে তাঁর অবাস্তব ধারণার নেতৃস্থানীয় প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়। অনাহূত ছাড়া অন্য দুটি গ্রন্থ এখানে হচ্ছে কালিগুলা নাটক এবং দর্শনগত ভাবনাচিন্তার প্রকাশ তুলে ধরা রচনা সিসিফাসের রহস্য। তিনটি গ্রন্থ ভিন্ন ধারার রচনা হলেও পরোক্ষ এক যোগসূত্র এদের মধ্যে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়, যার মূলেও রয়ে গেছে কামুর তাত্ত্বিক জগতে বিচরণের প্রতিফলন। আর এ-কারণেই কামুর সব উপন্যাসের মধ্যে সবচেয়ে প্রতিনিধিত্বশীল হিসেবে যেটাকে সাধারণত দেখা হয় সেটা হচ্ছে আমাদের এই আলোচনার অনাহূত।

উপন্যাসের মূল চরিত্র মুরসাউ আলজিয়ার্সের একটি অফিসে কেরানির কাজে নিয়োজিত। আলজেরিয়া তখন ছিল ফরাসি উপনিবেশ এবং শ্বেতাঙ্গ অনেক ফরাসি নাগরিক তখন সহজ সাফল্যের হাতছানিতে সেখানে গিয়ে বসতি গড়ে নিয়েছিলেন। কামু নিজেও ছিলেন সেরকম এক বসতি গড়ে নেওয়া পরিবারের সন্তান, যদিও সচ্ছলতা তাদের পরিবারে কখনো আসেনি। ফ্রান্সের কাছের উপনিবেশে দারিদ্রে্যর কাছাকাছি পর্যায়ে শ্বেতাঙ্গ একটি পরিবারের বসবাসের সেই বাস্তব অবস্থা আজীবন তাঁকে প্রভাবিত করে গেছে। উপন্যাসের নায়ক মুরসাউও এসেছে সেরকম এক পরিবার থেকে। হয়তো জীবনের এই বিচ্ছিন্নতাই তাকে পরিণত করেছে এমন এক মানুষে, চারপাশের কোনো কিছুর সঙ্গেই যার নেই কোনোরকম সংশ্লিষ্টতা। কিছুই তাকে প্রভাবিত করে না, কিছুই তাকে আন্দোলিত করে না – এতটাই নিরাসক্ত ব্যক্তি এই মুরসাউ। মায়ের মৃত্যুসংবাদেও আবেগতাড়িত হওয়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ তার মধ্যে দেখা যায় না। উপন্যাস শুরু হয়েছে এভাবে :

মা আজ মারা গেছেন। কিংবা সেটা হয়তো গতকাল। আমার জানা নেই। বাড়ি থেকে টেলিগ্রাম এসেছে :                ‘মা মারা গেছেন। আগামীকাল অন্ত্যেষ্টি। তোমার  একান্ত…।’ আমার কাছে এর সবটাই হচ্ছে অর্থহীন।

এরপর দেখা যায়, গল্পের সেই নায়ককে আলজিয়ার্সের পঞ্চাশ মাইল দূরের শহর মারেঙ্গোর উদ্দেশে বাসে যাত্রা করতে। সেখানে মায়ের কফিনের পাশে আরব এক নার্সের উপস্থিতি আমাদের প্রথমবারের মতো আভাস দেয়, ঘটনা ঘটে চলেছে এরকম এক পটভূমিতে, মুরসাউয়ের মতো মানুষেরা যেখানে নিজেদের দখলে রাখা এক ভূখন্ডে সেখানকার স্থানীয়দের সেবার ওপর নির্ভরশীল। তবে স্থানীয় সেই অন্য মানুষদের কোনোরকম পরিচিতি কামু কোথাও দেননি, এদেরকে শুধু আরব আখ্যায়িত করার বাইরে। আরো অনেক পরে মুরসাউকে আমরা যখন দেখি নির্জন সমুদ্রতীরে দুপুরের কড়া রোদে পিস্তলের গুলি ছুড়ে এক ব্যক্তিকে হত্যা করতে, সেই ব্যক্তির পরিচয়ও আমরা জানতে পারি কেবল আরব হিসেবে। যেন নামহীন-গোত্রহীন এক মানুষ, জাতিসত্তার বাইরে যার পরিচয়ের নেই কোনো প্রয়োজন। এরকম বর্ণনার ভেতর দিয়ে বিভাজনের যে-দেয়াল কামু তাঁর উপন্যাসে শুরু থেকে গড়ে তুলেছেন, সেই গন্ডি থেকে তিনি কখনোই বের হননি। জগদ্বিখ্যাত এক উপন্যাসের এখানেই হচ্ছে সবচেয়ে বড় স্খলন, তাত্ত্বিক বুলি আউড়ে যাওয়ার কচকচানিতে যার সবটাই চাপা পড়ে ছিল ১৯৪২ সালে উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পরের পুরো সময়জুড়ে। আমরা কেবল চোখ বুলিয়ে গেছি অবাস্তব ধারণার তত্ত্বগত প্রয়োগ কতটা সফলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে উপন্যাসে, সেই দিকটায়। অবাস্তব ধারণা যে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে পারে না, সেদিকে আমরা মোটেও আলোকপাত করিনি। আমাদের সেই সম্মিলিত স্খলনকেই অনেকটা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন আলজেরিয়ার এক নবীন লেখক, কামুর শতবার্ষিকীতে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস মুরসাউ তদন্তে।

 

দুই

কামেল দাউদ পেশায় সাংবাদিক, থাকেন আলজেরিয়ার ওরান শহরে এবং নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক কলাম লেখেন ওরান থেকে প্রকাশিত ফরাসি ভাষার দৈনিক কোতদিয়েন দ্য’ওরানে। ওরানের প্রসঙ্গ আলোচনায় আসায় পাঠকদের নিশ্চয় মনে পড়ে যাবে কামুর আরো একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘লে’পেস্ত বা প্লেগের কথা। সেই উপন্যাসেও ঘটনা ঘটে চলেছে ওরান শহরে, উপন্যাসের প্রধান চরিত্র যেখানে প্লেগের বিস্তার সামাল দেওয়ায় চালাচ্ছেন সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। এ-উপন্যাসেও কিন্তু সম্পূর্ণ অনুপস্থিত আলজেরিয়ার আরব অধিবাসীরা, যে-শহরটি তাদের পূর্বপুরুষের গড়ে নেওয়া এবং যেখানে কামুর বর্ণনার সেই বেদনা আর প্রতিকূলতার মুখে সাহসিকতার প্রতীক ফরাসি বংশোদ্ভূত চিকিৎসক তো কেবলই হচ্ছেন একজন অনাহূত বসতি-স্থাপনকারী। মনে পড়ে ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে গ্রীষ্মের ছুটিতে বিদেশ থেকে এসে সেই সময়ে ঘটে যাওয়া আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাবলিতে হতবিহবল দিনগুলোয় মনের অবসাদ দূর করে নেওয়ার তাগিদ থেকে প্লেগ উপন্যাসটি অনেকটা একটানে পড়ে নেওয়ার সময় আমারও মনে কিন্তু দেখা দেয়নি অবশ্যম্ভাবী সেই প্রশ্ন – কেন নেই সেখানে সেই মানুষদের কথা, যারা সেখানকার মূল বাসিন্দা, সংখ্যায় যারা নিশ্চিতভাবে অনেক বেশি এবং বিত্তের মাপকাঠিতে সামাজিক অবস্থানের অনেক নিচের দিকের মানুষ হওয়ায় প্রাণঘাতী কোনো রোগের জীবাণু দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ার মুখে যাদের দুর্ভোগ বিত্তবান বসতি-স্থাপনকারীদের চাইতে অনেকগুণ বেশি হওয়ার কথা। হতে পারে তাত্ত্বিক কামুর প্রভাব অনেকাংশেই আমার মতো আমাদের যৌবনের পাঠকদের বড় এক অংশকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বলেই হয়তোবা উপন্যাসের সহজে চোখে পড়ার মতো এই ত্রুটি কিংবা দুর্বলতা আমাদের অনেকের চোখ এড়িয়ে গিয়ে থাকবে।

বাস্তবে কিন্তু কামুর সবরকম গল্প-উপন্যাসেই ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলে আবদ্ধ মানুষের যন্ত্রণা আর দীর্ঘশ্বাসের কোনোরকম প্রতিফলন একেবারেই অনুপস্থিত, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটে চলেছে এদের যেখানে বসবাস তারই চারপাশ ঘিরে। কামুর লেখায় স্থানীয়দের সমস্যার বিষয়টি একেবারে পুরোপুরি মুছে ফেলার এই প্রবণতা অবশ্য প্রথম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন কোনার ক্রুজ ও’ব্রায়ান ১৯৭০ সালে লেখা তাঁর এক রচনায়। প্লেগের প্রসঙ্গটি বিশেষভাবে উল্লেখ করে তাঁর সেই সমালোচনায় তিনি লিখেছিলেন, ‘প্লেগের কোথাও এদের নেই কোনোরকম অস্তিত্ব এবং অনাহূততে এসে আমরা যা দেখি তা হলো, স্থানীয় লোকজনের অস্তিত্বের বিষয়টি উঠে এসেছে একজন শ্বেতাঙ্গ বসতি-স্থাপনকারীর গুলিতে এদেরই একজন নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে।’

আলজেরিয়া এবং আরববিশ্বে অবশ্য আরবদের নিয়ে কামুর এই শীতল নিস্পৃহতা অনেক দিন থেকেই কঠোরভাবে সমালোচিত। ২০১০ সালে কামুর পঞ্চাশতম মৃত্যুবার্ষিকীতে ‘নোবেল সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী আলজেরিয়ার সন্তান কামুর স্মরণে’ দেশজুড়ে একটি শোভাযাত্রা আয়োজনের প্রস্তাব উত্থাপিত হওয়ার পর সমালোচনা আরো তীব্র হয়ে ওঠে এবং শোভাযাত্রার ফরাসি ও আলজেরীয় আয়োজকরা শেষ পর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিতে বাধ্য হন। কামেল দাউদের উপন্যাস হচ্ছে সেই ধারাবাহিকতারই একটি অংশ, তরুণ আলজেরীয় ঔপন্যাসিক যেখানে কামুর স্খলনকে আরো বেশি স্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরে জগদ্বিখ্যাত এক লেখককে অনেকটা যেন দিগম্বর অবস্থায় আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

নাটকীয় যে-সংলাপের মধ্য দিয়ে কামেল দাউদ তাঁর উপন্যাস শুরু করেছেন, সেই প্রথম বাক্য থেকেই মূল উপন্যাসের বিপরীতে এর অবস্থান খুব সহজে আমরা ধরে নিতে পারি। কামু যেখানে তাঁর অনাহূত শুরু করছেন মায়ের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার মধ্যে দিয়ে, কামেল দাউদের উপন্যাস সেখানে শুরু হয়েছে ‘মা আজো জীবিত আছেন’ – এই বাক্য দিয়ে। এরপর দ্রুতই তিনি আমাদের নিয়ে গেছেন উপন্যাসের ভেতরে, যেখানে আমরা দেখি নামহীন নিহত আরবের একটি নাম তিনি দিয়েছেন এবং মুসা নামের সেই আরবের ছোট ভাই হারুনের মুখ দিয়ে আমাদের শোনাচ্ছেন কাহিনির বর্ণনা। এর মধ্যে দীর্ঘ এক সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং প্রৌঢ় হারুন অনেকটা যেন একক সংলাপে আমাদের শুনিয়ে চলেছেন মুসার মৃত্যুর পরের ঘটনাবলি।

হারুনের বয়ান থেকে আমরা জানতে পারি, মৃত্যুর পর মুসার মৃতদেহের সন্ধান আদৌ পাওয়া যায়নি। মুসার মা শুরুতে সন্তানের জীবিত অবস্থায় ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে অন্তত মৃত সন্তানকে দেখার বাসনা নিয়ে সম্ভাব্য সব জায়গায় তিনি গিয়েছেন – হাসপাতালে, মর্গে, থানায়, এমনকি প্রতিটি বাড়ির সদর দরজায় করাঘাত করে জানতে চেয়েছেন জীবিত অথবা মৃত মুসাকে তাঁরা কেউ দেখেছেন কিনা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেই হালও তাঁকে ছেড়ে দিতে হয় এবং মৃত্যুর চল্লিশ দিন পর মৃতদেহবিহীন সৎকারের আয়োজন বাড়িতে করা হয়। তবে মুসার যে মৃত্যু হয়েছে, মায়ের মনে তা নিয়ে সন্দেহ থেকে গেলেও হারুন কিন্তু একেবারেই নিশ্চিত। ঘটনা যখন ঘটে তখন তো সেখানে ছিল মাত্র দুজন, মুসা আর তার হত্যাকারী। ঘাতক সম্পর্কে কেবল এটুকুই হারুনের জানা যে, ঘাতক হচ্ছে একজন এল রুমি, অর্থাৎ বিদেশি বা অনাহূত। পাঠক লক্ষ করবেন, কামেল দাউদ এই অনাহূতের প্রসঙ্গ টেনে আমাদের কিন্তু ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন আলবেয়ার কামুতে। শুধু তাই নয়, হারুনের বর্ণনার ঘাতকের সঙ্গে আমরা খুঁজে পাই কামুর চেহারার নানারকম মিল। হারুন যেমন বলছে :

পাড়ার লোকজন সংবাদপত্রে প্রকাশিত ঘাতকের ছবি মাকে দেখিয়েছিল, তবে আমাদের কাছে সেই ছবি ছিল অন্য সব উপনিবেশবাদী লোকজনের মানুষের মতোই ঘৃণার এক ছবি, আমরা যাদেরকে চিনি আমাদের চুরির ফসল খেয়ে মোটা-তাগড়া হয়ে ওঠা মানুষ হিসেবে। ঘাতকের বেলায় মনে রাখার মতো বিশেষ কোনো আকর্ষণ একেবারেই ছিল না, শুধুমাত্র মুখের এক কোনায় ঝুলে থাকা সিগারেট ছাড়া।

পাঠক, এখানেও কামুকে খুঁজে পাচ্ছেন কি? পুরো উপন্যাসে হারুনের বলে যাওয়া বর্ণনার মধ্য দিয়ে ফিরে এসেছেন কামু; অবশ্য কামু পরিচয়ে নয়, বরং অনেকটা যেন ঘাতক মুরসাউয়ের ছদ্মবেশে।

সাহিত্যে একই গল্প নতুন আঙ্গিকে ভিন্ন অবস্থান থেকে বলা নতুন কিছু নয়। বাংলা সাহিত্যে সেরকম সুনিশ্চিত কিছু আমার জানা নেই। তবে ইউরোপের বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যে এটা একেবারে দুর্লভ কিছু নয়। তবে পুরনো কাহিনির নতুন পরিবেশনা তখনই সফল হয়ে ওঠে, যখন কিনা বিশ্বাসযোগ্য ও পাঠকের মনে তৃপ্তির বোধ এনে দিতে পারার উপায়ে তা করা হয়। পাঠকের যখন মনে হতে পারে, পুরনো গল্প তাকে বলা হচ্ছে না, বরং আগের সে-গল্পে ফুটে ওঠা সত্যকেই যেন এর মধ্য দিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ঠিক এ-কাজটিই খুব সাফল্যের সঙ্গে করতে পেরেছেন কামেল দাউদ এবং পেরেছেন বলেই তাঁর সেই উপন্যাস পাঠক এবং সুধীজনের নজর কাড়তে পেরেছে। তবে উপন্যাসের সবচেয়ে সফল দিকটি মনে হয় সময়ের গন্ডিতে আবদ্ধ না থেকে সমকালীন পারিপার্শ্বিকতার দিকে লেখকের চোখ বুলিয়ে যাওয়া এবং পাঠককেও সেদিকে টেনে নিয়ে যাওয়া।

আলবেয়ার কামুর অনাহূত প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪২ সালে, আলজেরিয়া যখন ফ্রান্সের উপনিবেশ এবং উপনিবেশবাদবিরোধী আন্দোলন তখনো দেশজুড়ে সেভাবে দানা বেঁধে ওঠেনি। অন্যদিকে হারুন তার ভাইয়ের মৃত্যুর কথা আমাদের শোনাচ্ছেন এর অনেক পরে, তিনি নিজে যখন বার্ধক্যের সীমানায় উপস্থিত। আলজেরিয়া ততদিনে কেবল স্বাধীন অস্তিত্ব নিয়েই টিকে নেই, বরং ১৯৬২ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে নানারকম চড়াই-উতরাই পার হয়ে ততদিনে দেশটিকে যেতে হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট স্বাধীনতা লাভের অর্ধশতক পর আজো আলজেরিয়ায় ক্ষমতাসীন, যদিও সমতাপূর্ণ সমাজ গড়ার অঙ্গীকার থেকে অনেক আগেই ফ্রন্টের বিচ্যুতি পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। অন্যদিকে আবার নববইয়ের দশকের শুরুতে ইসলামি মৌলবাদের উত্থানের মোকাবিলা জাতীয় মুক্তিফ্রন্টকে করতে হয়। মৌলবাদী উত্থানের সবচেয়ে কঠিন দিনগুলো আলজেরিয়া পেছনে ফেলে এলেও পশ্চাৎমুখী সেই অভিযাত্রার প্রভাব এখনো দেশটিতে রয়ে গেছে। সচেতন কোনো লেখকের পক্ষে দেশের সেরকম বাস্তব ছবি এড়িয়ে যাওয়া অবশ্যই মিথ্যার সঙ্গে সমঝোতার আশ্রয় নেওয়া বুঝিয়ে থাকবে। কামেল দাউদ তাঁর এই উপন্যাসে তা কোনো অবস্থাতেই করেননি। হারুন যখন তার ভাইয়ের মৃত্যুর বর্ণনা আমাদের শুনিয়ে চলেছে, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আলজেরিয়া তখন আমাদের সামনে উপস্থিত। একদিকে মুক্তির যুদ্ধে অংশগ্রহণের দাবিদার দলটি দুর্নীতির চোরাবালিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, অন্যদিকে মৌলবাদীরা হুমকি দিচ্ছে ইসলামের দোহাই দিয়ে কল্লা কাটার। সেরকম এক পরিস্থিতিতে প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এক পানশালায় হারুনের নিয়মিত যাতায়াত। হারুনের মতে, সেরকম জায়গায় তখনই আপনার যাতায়াত যখন কিনা আপনি পেছনে ধাবমান বয়স, ঈশ্বর কিংবা স্ত্রীর হাত থেকে পালিয়ে বেড়াতে চান। তবে কথা হচ্ছে সারা দেশজুড়ে পানশালাগুলো সব একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং সেখানে যাদের নিয়মিত যাতায়াত, তারা যেন হয়ে পড়ছেন ডুবন্ত জাহাজের ইঁদুর, একটি ডুবন্ত জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়ছেন আরেকটি ডুবন্ত জাহাজে। হারুনের স্বগতোক্তি আমাদের জানান দিচ্ছে, ‘অবশেষে আমরা যখন শেষ জাহাজটিতে উঠব, তখন কিন্তু আমাদের মতো বুড়োদের হাতে হাত লেগে যাওয়ার মতো বেশ ভালো ভিড় সেখানে দেখা যাবে। আর সেই মুহূর্তটি হবে প্রকৃত অর্থে শেষ বিচারের মুহূর্ত।’

ফলে হারুনের মুখ দিয়ে যে-গল্প কামেল দাউদ আমাদের শোনাচ্ছেন, পেছনে তাকিয়ে দেখার গল্প সেটা পুরোপুরি নয়। একই সঙ্গে সেটা হচ্ছে সমকালীন আলজেরিয়ার এরকম বাস্তব এক ছবি, আগামীর দুর্ভাবনাপূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের যা ভাবায়। হারুন তো হচ্ছে আরব আর মুসলিম বিশ্বের সেরকম লক্ষ কোটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি, কঠিন এক সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকা সমুন্নত রাখার চেষ্টায় ক্রমশই যাদের স্থানচ্যুত হতে হচ্ছে। তবে তারপরও থেমে নেই তারা। কামেল দাউদের বর্ণনাতেই আমরা জানতে পারি বৃদ্ধ হারুন কল্পনা করছে শহরের মসজিদের সবচেয়ে উঁচু মিনারে উঠে চিৎকার করে একথা সবাইকে শুনিয়ে বলে দিতে, ‘আমি স্বাধীন, আমি মুক্ত; সৃষ্টিকর্তা তো হচ্ছেন কেবলই একটি প্রশ্ন, কোনো উত্তর নয়। আমার মৃত্যুর সময়ে একা আমি পেতে চাই তাঁর সাক্ষাৎ, ঠিক জন্ম নেওয়ার সময়ের মতোই।’

অবাক হওয়ার কিছু নেই, আলজেরিয়ার ধর্মান্ধ এক মাওলানা গত বছর মৃত্যুদন্ড দাবি করেছেন কামেল দাউদের। জীবনের ওপর হুমকি সত্ত্বেও আলজেরিয়া ছেড়ে চলে যেতে অস্বীকার করেছেন লেখক। তবে আমরা জানি একা তিনি কোনো অবস্থাতেই নন। তাঁর হারুন এখন হয়ে উঠেছে আরব আর ইসলামি বিশ্বের সেই অস্তিত্ববাদী নায়ক, চিৎকার করে যে বলছে, ‘আমি স্বাধীন, আমি মুক্ত…।’ আর সেই চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, করাঘাত করছে আমাদের বিবেকের দুয়ারে। r

(টোকিও, ১১ জুলাই ২০১৫)