‘তারুণ্যের একটি শক্তি আছে, সব বাধায় পথ কেটে তারুণ্য সামনের দিকে অগ্রসর হয়। এই শক্তিকে সংবর্ধিত করা প্রয়োজন। এ বোধ থেকেই তরুণ লেখকদের পুরস্কারের জন্য বাছাই করা হয়েছে।’ কথাগুলো বলেছেন কালি ও কলমের সম্পাদকম-লীর সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। গত ২৯ জানুয়ারি ২০১৯, মঙ্গলবার, জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে আয়োজিত ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার-২০১৮’-এ সভাপতির ভাষণদানকালে তিনি এ-কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, ‘পুরস্কার পাওয়ার জন্য কেউ লেখে না, এ-কথা খুবই সত্য। তেমনি এ-কথাও সত্য পুরস্কার পেলে লেখক উৎসাহিত হন, তাঁর দায়িত্ববোধ আরো বাড়ে। এ থেকেই পুরস্কারের সার্থকতা।’ কালি ও কলমের পঞ্চদশ বর্ষ এবং ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কারে’র একাদশ বর্ষ উলেস্নখ করে আনিসুজ্জামান বলেন, ‘এই দীর্ঘ সময়ে কালি ও কলম একটি মানে গিয়ে পৌঁছেছে এবং এ-পুরস্কারও একটা মর্যাদা লাভ করেছে। সবাই স্বীকার করবেন এ-পুরস্কার যেভাবে দেওয়া হয় তাতে পুরস্কারপ্রাপকের আত্মশস্নাঘার সুযোগ আছে।’
সাহিত্য শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা কালি ও কলম ২০০৮ সাল থেকে ‘তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’ প্রদান করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে একাদশবারের মতো এ-পুরস্কার প্রদান করা হয়। পুরস্কার অর্জন করেন – কথাসাহিত্য বিভাগে যূথচারী আঁধারের গল্প গ্রন্থের জন্য নাহিদা নাহিদ ও তিস্তা গ্রন্থের জন্য হারুন পাশা; প্রবন্ধ গবেষণা ও নাটক বিভাগে হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র : চিরায়ত রসবোধ গ্রন্থের জন্য শাহাদৎ রুমন এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রবন্ধ ও গবেষণা বিভাগে একাত্তরের রমজান : গণহত্যা ও নির্যাতন গ্রন্থের জন্য আরাফাত তানিম।
যুগে যুগে নবীনরা সমাজকে ভেঙেচুরে নতুন সমাজ নির্মাণের পথে এগিয়েছে। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে কালে কালে জমা হওয়া পুরনো জঞ্জাল দুহাতে সাফ করে সত্য সুন্দর সঠিক পথের দিশা দেখিয়েছে। রাষ্ট্র সমাজ জাতি সর্বত্র ন্যায়নিষ্ঠার অনির্বাণ আলো জ্বেলেছে। একটি জাতির শিক্ষা, সংস্কৃতি এগিয়ে নেওয়ার ভারও সানন্দে নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে তরুণরা। সেই তরুণদের সাহিত্যচর্চাকে গতিশীল ও বেগবান করার লক্ষ্য নিয়ে মাসিক পত্রিকা কালি ও কলম প্রবর্তন করেছে ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’।
মাঘের হিম বিকেলে এ-আয়োজনে সম্মানীয় অতিথি ছিলেন বিশিষ্ট কবি ও গবেষক কায়সার হক। বিশেষ অতিথির আসন অলংকৃত করেন জনপ্রিয়
কথাসাহিত্যিক ও কবি আনিসুল হক। কালি ও কলমের সম্পাদকম-লীর সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানমঞ্চে আরো উপস্থিত ছিলেন পত্রিকাটির প্রকাশক আবুল খায়ের এবং সম্পাদক আবুল হাসনাত। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক এবং কালি ও কলম সম্পাদকম-লীর সদস্য লুভা নাহিদ চৌধুরী।
তরুণদের সৃজনশীলতাকে উজ্জীবিত ও গতিশীল করার লক্ষ্যে ২০০৮ সালে প্রবর্তন করা হয় ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার’। সে-বছর দুটি বিভাগে (কবিতা এবং প্রবন্ধ গবেষণা ও নাটক) এ-পুরস্কার প্রদান করা হয়। ২০০৯ সালে বিভাগ বেড়ে দাঁড়ায় তিনটি (কবিতা; কথাসাহিত্য এবং প্রবন্ধ গবেষণা ও নাটক)। ২০১০ সালে যোগ করা হয় আরো দুটি বিভাগ (কবিতা; কথাসাহিত্য; প্রবন্ধ গবেষণা ও নাটক; মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা ও প্রবন্ধ এবং শিশু-কিশোর সাহিত্য)। ফলে ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাঁচটি বিভাগেই বই চাওয়া হয়। মাঝে ২০১৪ সালে তিনটি বিভাগে বই চাওয়া হলেও ২০১৫ সালে ফের পাঁচটি বিভাগেই পুরস্কার প্রবর্তন করে কালি ও কলম। প্রতিটি বিভাগে পুরস্কার বিজয়ীকে এক লাখ টাকা, একটি ক্রেস্ট ও সনদপত্র প্রদান করা হয়ে থাকে।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই উপস্থিত সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন লুভা নাহিদ চৌধুরী। তিনি ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কারে’র বিচারকম-লী প্রাবন্ধিক অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ, কবি অধ্যাপক মাহবুব সাদিক এবং কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনকে সবিশেষ ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘আগামী ১ ফাল্গুন কালি ও কলম ১৬ বছরে পদার্পণ করবে। এ-উপলক্ষে পত্রিকাটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করছে।’
লুভা নাহিদ চৌধুরীর বক্তব্য শেষে বিচারকম-লীর পক্ষে পুরস্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করেন অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ। পরে ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেওয়া এ-পুরস্কার নিয়ে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। ২০১৮ সালের বিজয়ীদের উদ্দেশে শংসাবচন পাঠ করেন অধ্যাপক মাহবুব সাদিক ও কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন।
শংসাবচন পাঠশেষে বক্তব্য রাখেন অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি আনিসুল হক। কালি ও কলমের ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৪৩ জন নতুন কবি ও লেখককে এ-পুরস্কার প্রদান একটি বিশেষ ঘটনা উলেস্নখ করে তিনি বলেন, ‘তরুণ লেখক এবং প্রবীণ লেখক দুজনেই যখন সাদা কাগজের সামনে বসেন, তখন দুজনেরই বেদনা অভিন্ন। একজন প্রবীণ কবি বা লেখক যে সৃষ্টির বেদনায় দগ্ধ হতে থাকেন, নতুন কবিও সেই কষ্টের মধ্যে দিয়ে যান।’ মিরোসস্নাভ হুলভের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘শিল্পী হওয়া মানেই ব্যর্থ হওয়া এবং শিল্প মাত্রই ব্যর্থতার বশংবদ।’
আনিসুল হকের পর বক্তব্য রাখেন কালি ও কলমের প্রকাশক আবুল খায়ের। তিনি বলেন, ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের অনেকগুলো কাজের অন্যতম হচ্ছে কালি ও কলম প্রকাশ। গত ১৫ বছর ধরে কালি ও কলম ঠিক সময়ে প্রকাশের জন্য আমার অনেক কষ্ট কমে যায়।’ এ-সময় তিনি কালি ও কলমের সঙ্গে সংশিস্নষ্ট, বিশেষ করে পত্রিকাটির সম্পাদকম-লীর সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, পত্রিকাটির সম্পাদক আবুল হাসনাত, সম্পাদকম-লীর সদস্য লুভা নাহিদ চৌধুরীসহ সবাইকে ধন্যবাদ জানান।
এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পুরস্কার বিজয়ী চার নবীন সাহিত্যিকের হাতে একটি করে ক্রেস্ট, সনদপত্র ও শংসাবচন তুলে দেন মঞ্চে উপস্থিত বিশিষ্টজনেরা।
আনন্দঘন পরিবেশে পুরস্কার গ্রহণের পর একে একে নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন বিজয়ীরা। কথাসাহিত্যিক নাহিদা নাহিদ বলেন, ‘আমরা অনেকেই নারী সাহিত্যিক শব্দটি শুনতে পাই। অর্থাৎ রান্ধন, বাড়ন, চুল বান্ধন, পরে সাহিত্যচর্চা। অনেকেই ভাবেন, এত কিছু করে সাহিত্যচর্চা কতটুকু হয়, বা এর মূল্যই বা কতটুকু? কিন্তু আমার মনে হয়, আমরা (নারীরা) পারি এবং আমরা তার প্রমাণও রেখেছি।’ সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার পর পুরস্কৃত বই নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি হয় উলেস্নখ করে তিনি বলেন, ‘এটা হোক, কিন্তু আমি এই ভেবে আনন্দিত যে, আমার বইটি নিয়ে সমালোচনা হলেও এটি আরো অধিক পঠিত হবে।’ হারুন পাশা বলেন, ‘আমি লিখি আমার পিতার সম্মানের জন্য।’ চাকরি না-থাকা পুত্রের জন্য পিতার কষ্টের কথা উলেস্নখ করে তিনি বলেন, তাঁর পিতা আজ নিশ্চয়ই গর্বিত হবেন তাঁর চাকরিহীন সমন্তানটির জন্য।
আরাফাত তানিম বলেন, ‘আমরা যারা তরুণ, মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকারের ওপর, তথ্যের ওপর ভিত্তি করে, সে-সময়কার দলিলপত্র ঘেঁটে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা করি। কিন্তু আমাদের পরের প্রজন্ম সে-সুযোগ হয়তো পাবে না। কারণ তখন বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধাই হয়তো বেঁচে থাকবেন না। তাই আমাদের উচিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংগ্রহ করে পরের প্রজন্মের জন্য রেখে যাওয়া।’ শাহাদৎ রুমন বলেন, ‘কালি ও কলম পুরস্কারের মাধ্যমে আমাকে লেখালেখির জন্য যাঁরা প্রশ্রয় দেন তাঁরা আরো বেশি প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ পেয়ে গেলেন, এইজন্য আমি কালি ও কলমকে ধন্যবাদ জানাই।’
পুরস্কার বিজয়ীদের অনুভূতি-প্রকাশের পর বক্তব্য রাখেন অনুষ্ঠানের সম্মানীয় অতিথি অধ্যাপক কায়সার হক। তিনি বলেন, ‘তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার – এখানে তরুণ কথাটি ব্র্যাকেটে রাখলে ভালো হয়। কারণ এখানে যাঁরা পুরস্কার পেয়েছেন তাঁরা কেউই আমার মতে নবীন নন, সবাই পরিপক্ব এবং সেজন্যই তাঁরা পুরস্কৃত হয়েছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমানে মানুষে মানুষে দূরত্ব বেড়ে গেছে; কবি-সাহিত্যিক ও পাঠকের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে গেছে। এই দূরত্ব কমানোর জন্য সাহিত্য পুরস্কার প্রদান একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এতে নবীন লেখক অনুপ্রাণিত হন।’ কায়সার হক প্রস্তাব রেখে বলেন, ‘আমি আবেদন করব যেন পুরস্কার ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে একটি শর্টলিস্ট প্রকাশ করা হয়, অন্তত পাঁচজনের। যেন সবাই জানতে পারেন যে, এঁরা পুরস্কার না পেলেও পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য।’
সবশেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য রাখেন কালি ও কলমের সম্পাদক আবুল হাসনাত। তিনি বলেন, পনেরো বছর ধরে বিরতিহীনভাবে প্রতিমাসে কালি ও কলম প্রকাশিত হয়ে আসছে। এ পর্যন্ত পত্রিকাটির ১৭৩টি সংখ্যা ও সতেরোটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের যে-কোনো সংকটকালে এদেশের যুব সম্প্রদায় ও তরুণ লেখকরাই অগ্রণী হয়ে ওঠেন। তাঁদের বিদ্রোহ ও অনুভবশীলতা নতুন পথ নির্মাণ করে। এই বোধকে বিবেচনায় নিয়েই কালি ও কলম হয়ে উঠেছে তরুণদেরও পত্রিকা। প্রতিষ্ঠিত ও প্রবীণ লেখকরাও এই পত্রিকায় মর্যাদার সঙ্গে উপস্থিত।’
ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পর শেষ হয় অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব। এরপর শুরু হয় অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব – সরোদ ও কবিতার যুগলবন্দি। বিশ্বখ্যাত সরোদবাদক প–ত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের সরোদ-বাদনের সঙ্গে বিশিষ্ট আবৃত্তিকার হাসান আরিফের কবিতা আবৃত্তি। সরোদের টুংটাং বাজনার সঙ্গে হাসান আরিফ দরাজ কণ্ঠে আবৃত্তি করে চলেন বরেণ্য কবিদের কবিতা। কখনো কবিতা থেমে গেলে চলে সরোদের মূর্ছনা। হলজুড়ে তখন এক গভীর নিমগ্নতা। এ ঘোর যখন কাটল তখন ঘড়ির কাঁটা রাত আটটার ঘর পেরিয়ে গেছে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.