কাশফুল এবং একটি নদীর গল্প

এক

পরিণতি

ওসমান পড়ার পর একগাল হেসে বললো, ফিল গুড স্টোরি। কিন্তু খাবে না।

কে খাবে না? আমি বুঝতে না পেরে তার দিকে তাকাই।

ওসমান চেয়ারের পিছনে হেলান দিয়ে বললো, কে আবার? যাদের খাবার। পাঠক।

কেন খাবে না? আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাই তার দিকে।

ওসমান আগের মতোই  মুচকি  হাসতে হাসতে বললো, ফিল গুড, বাট ফ্যান্টাসি। এমন হয় নাকি? ভেরি ইউটোপিয়ান। তারপর সামনে ঝুঁকে বলে, ইউটোপিয়া একটা গ্রিক শব্দ। এর মানে জানিস?

না।

মানে হলো ‘নো প্লেস’। অর্থাৎ ইউটোপিয়া বলে কোনো জায়গা নেই। নেভার নেভারল্যান্ড। তারপর বললো, অবশ্য হলিউড আজকাল অনেক ফেয়ারিটেলের রিমেক করছে। অডিও-ভিজ্যুয়াল ন্যারেশনে এসব চলে। কিন্তু প্রিন্টে? নাহ। এটা ছাপলে তোর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। আর আমার চাকরি যাওয়ার সম্ভাবনা।

আমি বুঝতে না পেরে বলি, আমার ভাবমূর্তির ব্যাপারটা না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু তোর চাকরি যাবে কেন?

বিজ্ঞাপন আসা বন্ধ হয়ে যাবে। মালিকপক্ষ ক্ষেপে ছাঁটাইয়ের নোটিশ দেবে।

বন্ধুর এমন ক্ষতি আমি হতে দিতে পারি না। টেবিলের ওপর রাখা গল্পটা নিয়ে নিলাম। আমি এখনো হাতে লিখি। কম্পিউটার ইল্লিটারেট। ল্যাপটপ, ট্যাব, এসব আমার আয়ত্তের বাইরে। টেকনিক্যালি তো বটেই, এখন মনে হচ্ছে ক্রিয়েটিভলিও আমি আনফিট। এন্টিকুয়েটেড। ওল্ড ফাডি-ডাডি।

ওসমান আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে অনুকম্পা। সে মনে হয় একটা ডায়নোসরকে দেখছে। টেবিলে কলম ঠুকতে ঠুকতে বললো, চা খাবি? গরম শিঙাড়া?

দুই

শুরু

হলঘরভর্তি মানুষ, সবাই কথা বলছে। গমগম করছে মেঝে থেকে সিলিং আর চার দেয়ালের ভেতর আয়তাকার স্পেস। সবার হাতে পানীয়, নানা রঙের। পাগড়িপরা সাদা ইউনিফর্মে বেয়ারাদের দেখা যাচ্ছে হাতে পানীয়ভর্তি গ্লাস নিয়ে ঘুরতে।

কফিলুদ্দিন খুব গর্বের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে অতিথিদের সঙ্গে সাঈদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, হার্বার্ড থেকে মাস্টার্স করে এসেছে। হার্বার্ড বিজনেস স্কুল।

সাঈদ বাবার ভুল উচ্চারণে লজ্জা পাচ্ছে। ভাগ্যিস খুব কম অতিথিই ধরতে পারছেন ভুলটা।

অতিথিদের মধ্যে শহরের এলিট শ্রেণির সবাই আছে। পলিটিশিয়ান, বিজনেসমেন, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট, সিভিল সার্ভেন্ট, আর্মি ব্র্যাসট্যাক। এটা-সেটারা। রিসেপশনে আসার আগেই কফিলুদ্দিন জানিয়েছেন সাঈদকে। শুনে সাঈদ হেসে বলেছে, এসব হোমড়া-চোমড়ার সঙ্গে আমার পরিচয়ের দরকার আছে? কেন যে এসব করো তুমি বাবা।

– আছে, আছে। বিজনেস আর ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো করতে হলে ক্ষমতাশীলদের সঙ্গে জানাশুনা থাকতে হয়। তারপর দরোজা থেকে হলঘরভর্তি অতিথিদের দেখিয়ে তিনি বলেন, দেশ বলতে এরাই। সব ক্ষমতা এদের হাতে। দেশ চালাচ্ছেন এরাই।

সাঈদ হেসে বললো, ওয়ান পার্সেন্ট?

কফিলুদ্দিন বুঝতে না পেরে বললেন, ওয়ান পার্সেন্ট? মানে?

সাঈদ হেসে বললো, আমেরিকায় এই কথা এখন খুব চালু। তোমাকে পরে ব্যাখ্যা করে বলবো। ইউ মে নট লাইক ইট।

কফিলুদ্দিন বলেন, আমার লগে ইংরেজি বলিস না। বুঝি না। মিস মেরিকে ডাকতে হবে। বাবা মাঝে মাঝেই কথ্যভাষা বলেন।

মিস মেরি কফিলুদ্দিনের সেক্রেটারি। বিদেশিরা এলে তিনি তার মুখ থেকে তর্জমা শুনে কথা বলেন।

এক শিল্পপতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর তিনি বললেন, হারবার্ড কোন দেশে?

কফিলুদ্দিন গর্বের সঙ্গে সাঈদের দিকে তাকালেন। সে বললো, জি হার্ভার্ড আমেরিকায়।

এক মন্ত্রী সাঈদের কাঁধে হাত রেখে হেসে বললেন, তোমরাই দেশের  ভবিষ্যৎ। তুমি দেশে ফিরে এসে খুব ভালো করেছো। তোমার বাবার জেনারেশন বিজনেস-ইন্ডাস্ট্রির পত্তন করেছেন। তাঁরা উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না। আমিও উচ্চশিক্ষিত না। কিন্তু তোমরা বিদেশে গিয়ে পড়েছো। অনেক কিছু জানো। তোমরা আমাদের জেনারেশনের চেয়ে ভালো করবে। দেশে ফিরে এসেছো, এখন বাবার এম্পায়ারকে আরো বড় করো। প্রাইভেট সেক্টর বড় হওয়া মানেই দেশের প্রবৃদ্ধির হার দ্রুত হওয়া। বাংলাদেশ এখন মিডল ইনকাম কান্ট্রির শ্রেণিতে  প্রবেশ করতে যাচ্ছে। উই নিড ইয়াং মেন লাইক ইউ ইন বিজনেস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। উইশ ইউ গুডলাক।

কফিলুদ্দিন মন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিয়ে সাঈদকে নিয়ে পরবর্তী অতিথিদের দিকে যেতে  যেতে বললেন, কামালকে দেখছি না। সে গেল কই? তারপর স্বগতোক্তির মতো বললেন, বড় চঞ্চল। আর মদ একটু বেশি খায়। আমি নিজে খাই না, কিন্তু আমার ছেলেরা খাবে না, তা বলি না। হাই সোসাইটিতে চলতে গেলে মদ খাওয়া লাগে। পার্টিকে খাওয়াইতে হয়। ভিয়াইপিদের বাড়ি মাঝেমধ্যে প্রিমিয়াম মদের ক্রেট পাঠাইতে হয়। ব্লু লেবেল। গোল্ড লেবেল। কত কিসিমের লেবেল আছে আল্লাহই জানেন। যা কইতেছিলাম, কালামটা একটু বেশি মদ খায়। আমি তারে কইছি কম খাইতে। সে কইছে কম খাইবো। কিন্তু মনে হয় না কম খায়। পোলাডার মাথা খুব ভালো। বিজনেস পরিষ্কার বুঝে। কিন্তু মদ আর …। তুমি আইছো। বড় ভাই মানে বন্ধু। তারে বুঝায়া কও।

কথ্যভাষায় কথা বলতে বলতে কফিলুদ্দিন এক ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের কাছে পৌঁছে গেলেন। সাঈদকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করানোর পর তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন, আর ইউ ইন্টারেস্টেড ইন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং? আমরা আমাদের ব্যাংকের ইনভেস্টমেন্ট উইং বড় করছি। বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের শেয়ার মার্কেটে ইনভেস্ট করার সিলিং বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের ব্রাইট ইয়াংম্যান দরকার।

বলার পর তিনি কফিলুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, দেবেন নাকি আপনার ছেলেকে আমাদের ব্যাংকে জয়েন করতে?

কফিলুদ্দিন বললেন, তা হলে আমার বিজনেস, ইন্ডাস্ট্রি চালাবে কে?

– কেন আপনার আরেক ছেলে আছে। সে-ই তো আপনার  ডান হাত হয়ে কাজ করছে। বিজনেস খুব ভালো বোঝে। তাকেও কি হার্ভার্ড থেকে পড়িয়ে এনেছেন?

– না। পড়াশুনায় তার মন নাই। বড় ভাইয়ের মতো ব্রিলিয়ান্ট না সে। নিজেই বলে। কিন্তু বিজনেস ভালো বোঝে। আপনি ঠিকই ধরেছেন।

ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলেন, বিজনেসে ভালো করার জন্য ডিগ্রি লাগে না। আপনার নিজের কথাই ধরেন। আপনি কলেজেও পড়েন নাই। কম বয়সে জর্দার ব্যবসা শুরু করেছেন। সামান্য জর্দার ব্যবসা। সেখান থেকে কত কিছু করে ফেলেছেন একা একা। বিজনেসের জন্য ডিগ্রি লাগে না। কিন্তু ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকে ডিগ্রিয়ালা মানুষ দরকার। আপনি আমার প্রস্তাবটা মাথায় রাখবেন।

তারপর তিনি সাঈদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কাম টু মাই অফিস টু হ্যাভ এ কাপ অফ টি ইয়াংম্যান।

তিনি আরেক অতিথির দিকে চলে গেলে কফিলুদ্দিন  সাঈদকে বললেন, যাইতে কইছে যাইবা। তিনি আমাদের ব্যাংকার। অনেক লোন দিছেন। বুঝাইয়া কইবা তুমি আমার হাত শক্ত করনের লাগি আইছো। অন্য কোথাও যাইবার ইচ্ছা নাই। কইলে বুঝবেন। তারপর হেসে বলেন, তোমার এহন  অনেক কদর। হার্বার্ড-ফেরত। আগে কইতো বিলাত-ফেরত।

সাঈদ স্বর নামিয়ে বললো, বাবা হার্বার্ড না। হার্ভার্ড।

কফিলুদ্দিন হেসে বললেন, হার্ভার্ড। হইছে?

রিসেপশনে সবচেয়ে বেশি বিব্রত বোধ করলো সাঈদ এক শিল্পপতি আর তার স্ত্রীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর। ভদ্রমহিলা বারবার স্বামীকে বলতে থাকলেন, আমাদের আইভির সঙ্গে দারুণ মানাবে। তাই না? তারপর কফিলুদ্দিনকে বললেন, ওকে নিয়ে আসবেন আমাদের বাড়ি।

কামালকে পাওয়া গেল কয়েকজন কম বয়েসি অতিথির সঙ্গে এক কোনায় বসে মদ খাচ্ছে আর কী সব বলে জোরে হেসে উঠছে। সাঈদকে দেখে বললো, এসো, এসো। আমার বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। তারপর সে তার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বললো, মিট দ্য ব্লু-আইড বয় অফ মাই ফাদার। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের প্রাউড প্রোডাক্ট। এখন কফিলুদ্দিন  গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের হাল ধরবে।

সাঈদ কামালের বন্ধুদের সঙ্গে করমর্দন করে বললো, কামাল সব সময় মজা করে। সেই ছোটবেলা থেকে। আর ওর মতো এত ডার্টি জোকস কেউ জানে বলে মনে হয় না। এতক্ষণ নিশ্চয় সে তোমাদের খুব হাসাচ্ছিল। তারপর কামালের কানের কাছে মুখ নিয়ে স্বর নিচু করে বললো, স্লো ডাউন বাডি। এত খেও না। ড্যাড ইজ নট হ্যাপি। ডোন্ট মেক দ্য ওল্ডম্যান আনহ্যাপি।

কালাম গম্ভীর হয়ে বললো, তুমি এসে গিয়েছো। এখন তাকে হ্যাপি করার দায়িত্ব তোমার।

তিন

কফিলুদ্দিন গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ

সকালে নাস্তা করে সাঈদকে নিয়ে বের হলেন কফিলুদ্দিন। প্রথমে গেলেন রিভারসাইড টাউনের কাজ দেখতে। বিএমডব্লিউ সাভ থেকে রাস্তায় নেমে হেঁটে গেট পার হয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন দেয়াল দিয়ে ঘেরা জমিতে। সেখানে ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে মাটি এনে নিচু জমি ভরাট করা হচ্ছে। ফলে নদী এখন শুকিয়ে খালের মতো দেখাচ্ছে। মাটিতে ইট ফেলে হেঁটে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। যেতে যেতে কফিলুদ্দিন বললেন, বুঝলা সাঈদ, এইডা আমাদের তিন নম্বর টাউনশিপ প্রজেক্ট।

ইট-বিছানো রাস্তার পাশে কয়েকটা কাশফুলের গাছ বাতাসে হেলছে, দুলছে। দেখে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল সাঈদ। মাথা উঁচু করে দেখে বললো, বাহ! খুব সুন্দর। কী নাম এর?

– কাশফুল। বর্ষার পর এই সিজনে দেখা যায়। নদী, খাল-বিলের পাড়ে হয়।

– তাহলে মনে হয় আরো ছিল এখানে। এখন মাটিচাপা পড়েছে। সাঈদ চারদিক দেখে বলে।

– তা হইতে পারে। বুনো গাছ। এমনিতেই হয়। দেহো না, এহানে পানি নাই, মাটি আইনা ফেলান হইছে। তাও আছে।

সাঈদ কিছু না বলে মোবাইলে কাশফুলের ছবি তোলে কয়েকটা। তারপর বাবার পিছু পিছু হাঁটতে থাকে।

হঠাৎ মানুষের চিৎকারে তাদের হাঁটা বন্ধ হয়ে যায়। সাঈদ দেখে পেছনে, দেয়ালে গেটের কাছে বেশ কিছু মানুষ এসে জড়ো হয়েছে। তাদের মাথার ওপরে লম্বা ব্যানার। সেখানে লেখা : নদী বাঁচাও। পরিবেশ বাঁচাও। তারা স্লোগান দিচ্ছে।

তাদের দেখে কফিলুদ্দিন বিরক্ত হলেন। সাঈদের হাত ধরে বললেন, চলো, তাড়াতাড়ি। ঝামেলাকারীরা আইছে।

সাঈদ সামনে যেতে যেতে বলে, কারা এরা? কী চায়?

কফিলুদ্দিন বলেন, আরে বইলো না। বিদেশ থাইকা টাকা পায় আর এই সব করে। আরে নদী দিয়া কি হইবো অহন? আগে রাস্তা-ব্রিজ ছিল না। তহন নদীর দরকার ছিল। এইডা না বুইঝা কয় কি না, নদী বাঁচাও। তামসা আর কী।

কিছুদূর যাওয়ার পর থামেন কফিলুদ্দিন। পেছনে গেটের কাছে তখনো স্লোগান শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মানুষের সংখ্যা  বাড়ছে। কফিলুদ্দিন সঙ্গের সিকিউরিটিকে বললেন, থানার ওসিকে লাগা।

সিকিউরিটি নম্বর পেয়ে মোবাইল কফিলুদ্দিনের হাতে দিলো। কফিলুদ্দিন  বিরক্ত স্বরে বললেন, ওসি সাহেব, আমার রিভারসাইড প্রজেক্টে হামলা হইতাছে। আপনার লোক  পাঠান। কিছু ধরপাকড় করেন। জেলে পাঠান। না হইলে এই রকম আইতেই থাকবো।

বলে তিনি কিছুক্ষণ মোবাইলে  শোনেন। তারপর বলেন, এত ছোটখাটো ব্যাপারে কমিশনাররে কইতে চাই না। যা করার আপনি করেন। আর কত কমু আপনারে? এরপর কিন্তু আপনারে ফোন করুম না। আপনি ততদিনে থাঞ্চি বদলি হইয়া যাইবেন।

কথা শেষ করে তিনি ফোন সিকিউরিটিকে দিয়ে দেন। তার মুখে একরাশ বিরক্তি।

ড্রেজিংয়ের কাজ দেখে আরো বিরক্ত হন কফিলুদ্দিন। সুপারভাইজারকে বকেন কাজ ধীরে হওয়ার জন্য। তারপর সিকিউরিটিকে বলেন, অন্য গেটে গাড়ি আনতে বলো। ওদিকে পুলিশে একটু পর অ্যাকশনে যাবে। ওখান থেইকা গাড়িতে ওঠন যাইবো না। তারপর বিরক্তির সঙ্গে বলেন, ঝামেলা। অকারণে সব ঝামেলা।

একটু পর গাড়ি তাদের নিয়ে রওনা হয়। এক ঘণ্টা পর তারা এসে পৌঁছায় দেয়ালঘেরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সে। গাড়ি থেকে নেমে কফিলুদ্দিন বলেন, এইখানে চারটা ইন্ডাস্ট্রি আছে আমাদের। তোমারে দেখাইতে আনলাম। আস্তে আস্তে তোমারে সব দেখামু। তুমি তাড়াতাড়ি বুইঝা ফালাইবা। হার্ভার্ডে পড়ছো কি এমনে এমনে?

ভেতরে ঢুকে দেখা গেল কারখানার সামনে
বিশ-পঁচিশজন মেয়েলোক বসে আছে মাটিতে। কারো কারো সঙ্গে বাচ্চা।

কফিলুদ্দিন বিরক্ত হয়ে ম্যানেজারকে বলেন, এরা কী চায়? ভিতরে আইলো কেমনে?

ম্যানেজার বললো, এদের স্বামীদের কেউ কারখানার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে। কেউ হাসপাতালে। তারা ক্ষতিপূরণের জন্য এসেছে।

কফিলুদ্দিন রেগে গিয়ে বলেন, কেন ক্ষতিপূরণ তো দেওয়া হইছে। আবার কিসের ক্ষতিপূরণ?

ম্যানেজার হাত কচলে বলে, তাদের ইউনিয়ন  বলেছে ক্ষতিপূরণের টাকা কম হয়েছে।

শুনে বোমা ফাটার মতো শব্দ করে কফিলুদ্দিন  বলেন, ইউনিয়নের গুষ্টি মারি। লাগাও থানায়।

থানার সঙ্গে কথা বলার পর তিনি ম্যানেজারকে বলেন, এতগুলা গার্ড থাকতে এরা ভিতরে ঢোকে ক্যামনে? আপনি অ্যাকশন নেন নাই ক্যান? আমারে সব করতে হইবো?

সাঈদ আগেও দেখেছে তার বাবা মাঝে মাঝে, বিশেষ করে নিজের মহলের মানুষ হলে, কথ্যভাষায় কথা বলেন। তাই এই শুদ্ধ ভাষা, এই কথ্যভাষা ব্যবহারে সে এখন আর অবাক হচ্ছে না। বরং তিনি যখন কথ্যভাষায় কথা বলেন, তাকে খুব আন্তরিক আর সরল মনে হয়।

শ্রমিকদের স্ত্রীদের ব্যাপারে মোবাইলে থানার সঙ্গে কথা বলা আর মুখোমুখি ম্যানেজারকে বকুনি দেওয়ার পর তিনি সাঈদকে নিয়ে প্রশাসনিক ভবনে দোতলায় নিজের কামরায় ঢুকলেন। তিনি টেবিলের ওপাশে গদিআটা চেয়ারে বসলেন। সাঈদ বসলো একপাশে রাখা সোফায়। বসার পর তার বাবা পিওনকে চা দিতে বললেন।

চা আনার  পর  কফিলুদ্দিন সাঈদের পাশের সোফায় বসে বললেন, আমার পাশেই তোমার অফিস হইবো। ডেকরেটর কাজ করতাছে। তুমি চা খাওয়া শেষে দেইখা আইতে পারো একবার।

তাঁর কথা শেষ হতে না হতে বাইরে নিচে মেয়েদের আর্তচিৎকার আর কান্নাকাটির শব্দ শোনা গেল। সাঈদ  ঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখার জন্য ত্রস্তে উঠে দাঁড়ালো। কফিলুদ্দিন  বললেন, কই যাও?

সাঈদ জানালার বাইরে দেখিয়ে বললো, নিচে কিসের যেন  হইচই হচ্ছে।

কফিলুদ্দীন বললেন, কিছু না। গার্ড কিংবা পুলিশ মাইয়াদের বাইর কইরা দিতাছে। তুমি বসো, চা খাও। প্রথম দিনেই ম্যালা মেন্নত কইরা ফালাইছো।

সাঈদ ফিরে এসে বাবার সঙ্গে চা খেতে থাকল।

সেই দিন রাতের খাবার সময় সাঈদ বললো, বাবা, আপনি রাগ না করলে একটা কথা বলি? 

– কও। এত ফর্মালিটির কি আছে। কও কী কইতে চাও।

সাঈদ বলে, আমাকে দিয়ে এসব হবে না। মানে বিজনেস, রিয়েল এস্টেট, ইন্ডাস্ট্রি, এইসব চালানো। আজ আপনার  সঙ্গে ঘুরে সব কাজকর্ম দেখে আমার এই কথা মনে হলো।

তার কথা শুনে তার বাবা, মা আর কামাল খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে থাকলো। কফিলুদ্দিন বললেন, তাহলে কি করবা? হার্বার্ড ফিরা যাবা।

সাঈদ দেখলো বাবা আবার ভুল উচ্চারণ করছেন। সে আর শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করলো না। বললো, দেশেই থাকবো। একসঙ্গে থাকবো। শিক্ষকতা করবো।
যে-কোনো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। তবে আপনার কাছে একটা অনুরোধ আছে।

– কী অনুরোধ? কও। কফিলুদ্দিন প্লেট থেকে এখনো হাত গুটিয়ে আছেন। অন্য দুজনও খাচ্ছে না।

সাঈদ বললো, আমাকে আপনি রিভারভিউ প্রকল্পের জমিটা দিয়ে দেন। আর কিছু দিতে হবে না। ইন্ডাস্ট্রি, বিজনেস সব  কামালকে দিয়ে দেন। সে ভালো চালাতে পারবে।

কফিলুদ্দীন স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, আরো একটু ভাইবা দেখো। তাড়াহুড়ার কিছু নাই।

চার

তিন বছর পর

রাস্তা থেকে লাল ইটের দেয়াল নদী পর্যন্ত চলে গিয়েছে। দেয়ালের ওপর থেকে ঝুলছে মাধবীলতার ঝাড়। ফুল ফুটেছে  লাল-সাদা। আমরা একেবারে শেষের গেটের কাছে গিয়ে একটু ভেতরটা দেখবো। গেট খোলা আছে। লেখা আছে : প্রাইভেট প্রপার্টি। কিন্তু জনসাধারণ সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৬টা (গ্রীষ্মকাল)  পর্যন্ত  পার্কে থাকতে পারবে। ময়লা না ফেলা  আর জোরে শব্দ না করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

আমরা একটু ভেতরে গিয়ে দেখতে পারবো ছোট নদীর এই তীরে গাছপালা লাগিয়ে সবুজ বেষ্টনী করা হয়েছে। কিছু মরশুমি ফুলের গাছও আছে। আর নদীতীর জুড়ে আছে সাদা কাশফুলের গাছ। বাতাসে হেলছে-দুলছে। যেন নদীর দিকে তাকিয়ে হেসে কথা বলছে। কাছেই একটু পরপর রাখা হয়েছে বসার জন্য কংক্রিটের বেঞ্চ। নদীতীরে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সোডিয়াম বাল্ব জ্বালানোর জন্য আর্ট নোভোর আদলে ল্যাম্পপোস্ট।

আমরা ভেতরে  বসবো না। গেট দিয়ে বেরিয়ে এসে দেখবো দ্বিতীয় গেটের পাশে লেখা আছে : সাঈদ কফিল, অধ্যাপক, ইউনিক ইউনিভার্সিটি, ঢাকা। আমরা দেখবো গেটের দুপাশে লাগানো বেগনভেলিয়ার ঝাড়ে ফুটে আছে উজ্জ্বল লাল রঙের ফুল। বিকালের রোদে ঝলমল করছে গাছের ফুল আর পাতা।

এরপর আমরা যাবো রাস্তা থেকে প্রথম যে গেট আছে, সেখানে। আমরা দেখবো গেট দিয়ে বের হয়ে আসছে ইউনিফর্ম পরা ছেলেমেয়েরা। তাদের বাবা-মা এসেছে নিয়ে যেতে। সবার জন্য স্কুলের হলুদ বাস অপেক্ষা করছে। অভিভাবকরাও বাসে উঠেছেন।

একটু পর একটা টয়োটা প্রিমিও গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলো। গাড়ির পেছনের সিটে সাঈদ বসে আছে। পাশে একগাদা বই।

আমরা গেটে দাঁড়িয়ে কল্পনার চোখে দেখতে পাবো সাঈদ স্কুলের গাড়িবারান্দায় গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠছে। দোতলার করিডর দিয়ে হেঁটে সে টিচার্স রুমে ঢুকলো। সেখানে চারজন মেয়ে শিক্ষক বসে আছে। পঁচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে হবে তাদের বয়স। সাঈদ ঘরে ঢুকতেই তারা একসঙ্গে উঠে দাঁড়ালো। হাত তুলে সালাম দিলো তাকে।

সাঈদ হেসে বললো, বসে বসে সালাম দেওয়া যায় না? উঠতে হবে কেন?

সাঈদ লম্বা টেবিলে বসার পর মেয়েরাও বসলো। তাদের একজন বললো, বাহ! দাঁড়াবো না? স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানকে সম্মান দেখাবো না?

সাঈদ বলে, আমি প্রতিষ্ঠাতা বটে কিন্তু স্কুলটা চালাচ্ছেন আপনারাই। আমি আর কতটুকু করি? এখন বলুন স্কুলের সমস্যা কী? আমি অনেকবার একই প্রশ্ন করি। আপনারা পরিষ্কার করে কিছু বলেন না। আজ বলুন।

হেড টিচার লুতফা বলেন, দারিদ্র্য।

সাঈদ অবাক হয়ে বলে, দারিদ্র্য? কিসের দারিদ্র্য? কার দারিদ্র্য?

লুতফা বলেন, ছাত্রছাত্রীদের। বস্তিবাসীদের ছেলেমেয়ে হিসেবে তাদের ওপর অনেক চাপ।

– চাপ? কিসের চাপ? হোম টাস্কের? বই, খাতা কেনার সমস্যা?

– হেড টিচার বলেন, ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা চায় যে তারা একটা কিছু করে আয় করুক। সংসারের জন্য কিছু আনুক।

– মানে তারা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়াতে চায় না? ফ্রি টিউশন, ফ্রি ড্রেস, ফ্রি লাঞ্চ। এসবের পরও তাদের অভিভাবকরা সন্তুষ্ট না?

– না স্যার। এবারে সব টিচার একসঙ্গে বলে।

শুনে সাঈদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, এক কাপ চা হতে পারে?

– অবশ্যই স্যার। বলে ম্যাথের টিচার সিলভিয়া চলে যায়।

কিছু পর স্কুলের পিওন সবার জন্য চা নিয়ে আসে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সাঈদ বলে, বিজনেসে অনেক মডেল আছে। সব ফ্যাক্টর বিবেচনায় এনে একটা মডেল তৈরি করা হয়। আমি হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে পড়ার সময় এমন কয়েকটা  মডেল তৈরি করেছি। তা যে কোনো বিজনেস ফার্ম কিনে নিয়েছে তা না। কিন্তু আমাদের মডেল তৈরি করতে হতো। আমাদের স্কুলের জন্যও একটা মডেল বের করতে হবে আমাকে। মনে হচ্ছে পারবো। কি করতে হবে জানেন?

– কী স্যার? এবারো সবাই একসঙ্গে বলে উঠলো।

– আমাদের স্কুলের মডেলে ছাত্রছাত্রীর আয় করার জন্য সময় রাখা হবে, আর তার সঙ্গে যোগ করা হবে পড়াশোনা।

– খুব চাপ পড়বে না তাদের ওপর? হেড টিচার লুতফা বলেন।

– তা পড়বে। সেই জন্য কারিকুলাম একটু লাইট করতে হবে ।

– কারিকুলাম তো আমরা করলে হবে না, স্যার। এটা সরকার সবার জন্য ইউনিফর্মভাবে করে।

– তাহলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে কথা বলতে হবে। দেখি তারা কি বলেন। তার আগে আমাকে মডেলটা ঠিক করে নিতে হবে।

হেড টিচার বলেন, আর একটা মডেল লাগবে স্যার।

– আরেকটা মডেল? কিসের জন্য?

– স্যার, আমরা আপনার বাড়ি যেতে পারি না। লাঞ্চ ডিনার খেতে পাই না। আমাদের একটা ভাবি দরকার। সেই মডেল।

শুনে হো হো করে হাসে সাঈদ। তারপর বলে, আরে সে মডেল তো হয়েই আছে।

– তাই? কে স্যার? কে সেই মডেল ভাগ্যবতী মেয়ে?

– কেন, আপনাদের একজন। সাঈদ গম্ভীর হয়ে বলে।

ঘরের মধ্যে যে হাসির কলরোল ওঠে, আমরা তা রাস্তা থেকে শুনতে পাই।