কিস্সা বলেন শেহ্রজাদে

রবিশংকর বল

\ ৮ \

ম ধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেল রঘুপতির। অন্ধকারে পাশের ঘর থেকে মৃত্তিকার গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। সিঙ্গম কোথায় কে জানে! সারারাত সে শহরের আকাশে উড়ে বেড়ায়। আলো জ্বেলে একটা বই খুঁজে বার করল রঘুপতি। পুরনো একটা গল্প পড়তে শুরু করল :

 

অত ঘণ্টা ধরে হাঁটছি, সারা পথটায় কোথাও কোনো গাছের ছায়া নেই, নেই কোনো গাছের চারা কিংবা কোনোরকম শেকড়বাকড়, তারপর এখন আমরা শুনতে পাই কুকুরের ডাক।

মাঝে মাঝে এই যে রাসত্মাটা যার কোনো কিনার নেই, মনে হয় ফাটল-ধরা শুকনো নালায় ভরা এই প্রান্তরের শেষে বুঝি আর কিছুই নেই, বুঝি অন্য পাশে গিয়ে কিছুই দেখা যাবে না। কিন্তু আছে তো একটা কিছু। শহর আছে। তুমি শুনতে পাও কুকুর ডাকছে, হাওয়ায় গন্ধ পাও ধোঁয়ার, আর তুমি তারিয়ে তারিয়ে চাখো লোকজনের এই গন্ধ, যেন এটা কোনো একটা আশা।

কিন্তু শহর এখনো অনেক দূরে। শুধু হাওয়ার ঝাপটাই তাকে কাছে নিয়ে আসে। আমরা সেই ভোর থেকে হাঁটছি। এখন বিকেল চারটে হবে বোধহয়। কেউ একজন আকাশের দিকে তাকায়, সূর্য যেখানটায় ঝুলে আছে চোখ কুঁচকে তাকায় সেদিকে, আর বলে : ‘বেলা চারটে হবে বোধহয়’।

সে হল মেলিতান। ফাউসিত্মনো, এস্তেবান আর আমি তার সঙ্গে আছি। আমরা সবসুদ্ধ চারজন। আমি গুনি : সামনে দুজন, পেছনে দুজন। আরো পেছনে তাকিয়ে দেখি, কাউকেই দেখতে পাই না। তারপর আমি নিজেকে বলি : ‘আমরা সবসুদ্ধ চারজন’। বেশিক্ষণ আগে নয়, তখন বোধহয় বেলা এগারোটা হবে, ছিল কুড়িজনেরও বেশি, কিন্তু একটু-একটু করে তারা খসে পড়েছে, রয়ে গেছে শুধু আমাদের এই জটটা। ফাউসিত্মনো বলে : ‘বৃষ্টি হবে বোধহয়।’

আমরা সবাই মুখ তুলে তাকাই, দেখতে পাই মাথার ওপর দিয়ে ভারী কালো মেঘ ভেসে যাচ্ছে। আর আমরা ভাবি : ‘হয়তো বৃষ্টি নামবে।’

আমরা কে কী ভাবছি কিছুই বলি না। বেশ কিছুক্ষণ হলো কথা বলার আর কোনো চাড় নেই আমাদের। গরমের জন্য। অন্য কোথাও হলে আমরা খুশি হয়েই আলাপ চালাতাম, কিন্তু এখানে কথাবার্তা চালানো কঠিন। এখানে যদি কিছু বলতে চাও, বাইরের গরমে কথাগুলো তোমার মুখের মধ্যে তেতে ওঠে, তোমার জিভের ওপর তারা শুকিয়ে যায়, তোমার দম আটকে দেয়। ব্যাপারটা এখানে এই রকমই। সেজন্যই কারো মধ্যেই আর কথা বলার কোনো ইচ্ছা নেই।

মস্ত একটা জলের ফোঁটা পড়ে, মাটির ওপর গর্ত করে দেয়, আর থুতুর দলার মতো দাগ রেখে যায় বালিতে। একটাই ফোঁটা পড়ে শুধু। আমরা অপেক্ষা করে থাকি। আরো সব জলের ফোঁটার জন্য, চোখ ঘুরিয়ে দেখি তাদের খোঁজে। কিন্তু আর কোনো জলের ফোঁটা নেই। বৃষ্টি পড়ছে না। এখন যদি তুমি আকাশে তাকাও, দেখতে পাবে দূরে হুড়মুড় করে বাদল-মেঘ পালিয়ে যাচ্ছে। শহর থেকে যে-হাওয়া আসছে, সে পাহাড়গুলোর নীল ছায়ার দিকে ঠেলে নিয়ে যায় মেঘ। আর জলের যে ফোঁটাটা ভুল করে এখানে পড়েছিল, তৃষাতুর মাটি তাকে চেটে খায়।

কোন সে শয়তান এই প্রান্তরকে এমন বিশাল করে তৈরি করেছিল? কোন কাজেই বা সে লাগবে, শুনি?

আমরা আবার হাঁটতে শুরু করে দিয়েছি, বৃষ্টি দেখব বলে আমরা থেমে পড়েছিলাম। বৃষ্টি পড়েনি। এখন আমরা আবার হাঁটতে শুরু করে দিই। যতটা জমি হেঁটে পেরিয়েছি, তার চেয়েও বেশি হেঁটেছি বলে আমার মনে হয়। এমনিই, হঠাৎই মনে হয় আমার। যদি বৃষ্টি নামত, তবে হয়তো আরো সব বিষয় আমার মনে পড়ত। যা-ই হোক, আমি সেই ছেলেবেলা থেকে জানি কখনো এই প্রান্তরে আমি বৃষ্টি পড়তে দেখিনি – যাকে তুমি সত্যি সত্যি বৃষ্টি বলতে পারো।

না, এই প্রান্তর কোনো কাজেই লাগে না। কোনো খরগোশ, কোনো পাখি নেই। কিছুই নেই। শুধু কতকগুলো শুটকো উইজাচে গাছ ছাড়া, আর এক-আধ টুকরো জমি দেখা যায় মাঝে মাঝে, যেখানে ঘাসের ফলা কুঁচকে গুটিয়ে গেছে; তা যদি না থাকত, তবে কিছুই থাকত না এখানে।

আর এই যে আমরা এখন, এখানে। পায়দলে চারজন। আগে আমরা ঘোড়ায় চড়ে বেরোতাম, কাঁধে ঝোলাতাম রাইফেল। এখন আমরা রাইফেলও আর সঙ্গে নিই না।

আমি সব সময় ভেবেছি রাইফেলগুলো কেড়ে নেওয়া ভালই হয়েছে আসলে। এসব তলস্নাটে সশস্ত্র হয়ে বেরোনো বিপজ্জনক। কোনো হুমকি-টুমকি ছাড়াই তুমি খুন হয়ে যেতে পারো, যদি দেখা যায় তোমার কাঁধে বন্দুক ঝুলছে। তবে ঘোড়াগুলো অন্য ব্যাপার। আমরা যদি ঘোড়ায় চড়ে বেরোতাম তবে এতক্ষণে আমরা চাখতে পেতাম সবুজ নদীর জল, আর শহরের রাসত্মায় ভরা-পেটে হেঁটে আমরা রাত্তিরের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারতাম। যদি এখনো আমাদের ওই ঘোড়াগুলো থাকত, তবে আমরা তা-ই করতে পারতাম। কিন্তু ওরা রাইফেলগুলোর সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াগুলোও কেড়ে নিয়ে গেছে।

আমি চারপাশে ঘুরে ঘুরে তাকাই, প্রান্তরটাকে দেখি। এত জমি, অথচ কোনো কাজেই লাগে না। তোমার চোখ পিছলে পিছলে সরে যায়, যখন কিছুই দেখার মতো পায় না। শুধু গুটিকয় গিরগিটি মাথা বার করে উঁকি দেয় গর্ত থেকে, আর রোদ যখন পোড়াতে শুরু করে, চট করে তারা পাথরের আড়ালে ছোট্ট ছায়ায় লুকিয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের যখন এখানে কাজ করতেই হবে, এই রোদের তাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কিই বা করব আমরা? – কারণ ওরা আমাদের চাষ করার জন্য শুধু এই পাথুরে পোড়ো জমিই দিয়েছে।

ওরা বলেছে : ‘শহর থেকে এই অবধি – সব জমি তোমাদের।’

আমরা জিজ্ঞেস করেছি : ‘এই প্রান্তর?’

‘হ্যাঁ, এই প্রান্তর এই মস্ত বিশাল প্রান্তর।’

আমরা মুখ খুলেছিলাম এই কথাই বলতে যে, প্রান্তরটা আমরা চাই না, আমরা চাই নদীর পাশের জমি। নদী থেকে জলাভূমি পেরিয়ে যেখানে কাজুবাদামের গাছ গজিয়েছে, আর সবুজ মাঠ, আর ভাল জমি। এই শক্ত বলদের চামড়াটা নয়, যাকে ওরা বলে প্রান্তর।

কিন্তু ওরা আমাদের এসব কথা বলতেই দেয়নি। পদস্থ আমলাটি আমাদের সঙ্গে কোনো আলাপ-আলোচনা করতে আসেনি। সে দলিলপত্তর আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে আর বলেছে : ‘অত জমি শুধু নিজেদের বলে ভয় পেয়ো না -’

‘কিন্তু সেনিওর, প্রান্তরটা যে -’

‘হাজার হাজার জমির পস্নট আছে এখানে।’

‘কিন্তু জল নেই, এক ফোঁটাও। এক ঢোকও জল নেই।’

‘বর্ষাকাল তবে কী করতে আছে? কেউ তো তোমাদের কথা দেয়নি যে তোমরা সেচের জমি পাবে। বর্ষাকাল এলেই দেখবে ভুট্টা আর জনার গজিয়েছে, যেন তোমরা মাটি থেকে টান দিয়ে বার করে এনেছো।’

‘কিন্তু, সেনিওর, জমি থেকে সব জল বেরিয়ে যায়। শক্ত জমি। আমাদের মনে হয় না এই প্রান্তরের জমিতে হাল দেওয়া যাবে – পাথুরে ইটের ভাটির মত জমি। কোদাল দিয়ে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে তবেই বীজ বুনতে হবে, আর তখনো নিশ্চিত হওয়া যাবে না কিছু গজাবে কিনা – ভুট্টা বা আর কিছু গজাবে কি না।’

‘তোমরা সেটা দরখাস্ত লিখে জানাতে পারো। এখন তোমরা যেতে পারো। তোমাদের বরং মস্ত সব আসিয়েন্দার মালিকদের আক্রমণ করা উচিত – যে সরকার তোমাদের জমি দিচ্ছে তাকে নয়।’

‘সবুর করুন, সেনিওর। আমরা কেন্দ্রের বিরুদ্ধে কিছু বলিনি। বলেছি এই প্রান্তরের বিরুদ্ধে। কাজের কিছু যদি না-ই থাকে তবে আপনি কাজটা করবেনই বা কী করে – আমরা শুধু এই দরবারটাই করতে চাচ্ছি। একটু সবুর করে শুনুন আমরা কী বলতে চাচ্ছি। দেখুন, আমরা যেখানে আগে ছিলাম সেখান থেকেই শুরু -’

কিন্তু আমলাটি আমাদের কোনো কথাকেই আমল দেয়নি।

তো, ওরা আমাদের এই জমি দিয়েছে। আর এই জ্বলন্ত তাওয়ায় ওরা চায় আমরা যেন কিছু বুনি, শুধু এই দেখতেই যে কোনো শেকড়বাকড় গজায় কি না, শীষ বেরোয় কি না মাটি ফুঁড়ে। কিন্তু এ-মাটি থেকে কিছুই বেরোবে না। এমনকি কোনো গৃধিনীও না। তাদের তুমি ক্বচিৎ দেখতে পাও, খুব উঁচুতে, হুড়মুড় করে উড়ে যাচ্ছে, এই কঠিন সাদা জমি থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালিয়ে যেতে চাচ্ছে – এই জমি, যেখানে কিছুই নড়াচড়া করে না। যেখানে তুমি সারাক্ষণ এমনভাবে হাঁটো যেন এক পাও এগোতে পারছ না।

মেলিতোন বলে, ‘এই জমি ওরা আমাদের দিয়েছে।’

ফাউসিত্মনো শুধোয়, ‘কী?’

আমি কিছুই বলি না। শুধু ভাবি, মেলিতোনের মাথার কলকব্জাগুলো ঠিকমত আঁটা নেই। নিশ্চয়ই রোদের তাতই ওকে দিয়ে এভাবে কথা কওয়াচ্ছে – রোদের আঁচ নিশ্চয়ই টুপি-ফুঁড়ে গিয়ে ওর মাথাটা তাতিয়ে দিয়েছে। আর তাই যদি না হবে তো ও বলছে কেন এ-কথা? ওরা আমাদের কোন্ জমি দিয়েছে, মেলিতোন? এমনকি হাওয়াদের জন্যও এখানে কিছু নেই যে ধুলোর মেঘ ওড়াবে।

মেলিতোন আবার বলে : ‘একটা কোনো কাজে লাগবে তো এই জমি – অন্তত একটা কিছু করা যাবে, নিদেন ঘোড়া ছোটানো যাবে।’

‘কোন্ ঘোড়া?’ এস্তেবান ওকে শুধোয়।

আমি খুব একটা খুঁটিয়ে দেখিনি এস্তেবানকে। এখন যখন ও কথা বলল, আমি ওকে খেয়াল করে দেখি। একটা কুর্তা পরে আছে ও, জুলটা নাভি অবধি নেমেছে, আর কুর্তার তলা থেকে উঁকি দিচ্ছে মুরগির মাথার মত কিছু একটা।

হ্যাঁ, মুরগির মাথাই, এস্তেবান তার কুর্তার আড়ালে একটা মুরগি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তুমি তার ঢুলু-ঢুলু চোখ আর হাঁ করা ঠোঁট দেখতে পাবে, যেন সেটা হাই তুলছে। আমি তাকে শুধোই : ‘আরে, এস্তেবান, এ-মুরগিটাকে আবার কোত্থেকে বাগালে?’

‘মুরগিটা আমার!’ সে বলে।

‘আগে তো ছিল না। কোত্থেকে জোটালে, শুনি?’

‘কিনিনি, আমার মুরগির খোঁয়াড় থেকে এনেছি।’

‘তাহলে ওকে খাবে বলে এনেছো, তাই না?’

‘না, ওর দেখাশুনো করব বলে সঙ্গে এনেছি। কেউ বাড়ি নেই যে ওকে একমুঠো দানা দেবে; সেজন্যই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। দূরে কোথাও গেলে সব সময় আমি ওকে সঙ্গে নিয়ে আসি।’

‘ওভাবে ঢাকা দিয়ে রাখলে দম আটকে মরবে যে। বরং বার করে নিয়ে এসো হাওয়ায়।’

সে মুরগিটাকে বগলদাবা করে, মুখ দিয়ে তার গায়ে ফুঁ দেয়, গরম হাওয়া, তারপর বলে : ‘আমরা ঢিলায় পৌঁছে যাচ্ছি।’

এস্তেবান কী বলে, আমি আর শুনতে পাই না। আমরা নয়ানজুলি থেকে নেমে যাওয়ার জন্য সার বেঁধেছি, সে আছে সবার আগে। মুরগিটার ঠ্যাং ধরে আছে সে, তাকে এদিক-ওদিক নড়াচ্ছে, যাতে পাথরে তার মাথা ঠুকে না যায়।

যেই আমরা নামতে শুরু করি, জমি ধারালো হয়ে ওঠে। ধুলোর একটা আস্তর ওড়ে আমাদের পা থেকে যেন আমরা একদঙ্গল খচ্চর নেমে আসছি। কিন্তু আমরা যে ধুলোয় ধূসর হয়ে যাচ্ছি। তা আমাদের ভাল লাগে। শক্ত পাথুরের জমিতে এগারো ঘণ্টা ধরে ধুপধাপ করে পা ফেলার পর, আমরা সেই জিনিসে গা-ঢাকা দিয়ে খুশি, ‘যা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে আমাদের গায়ে, যার স্বাদ মাটির।’

নদীর ঠিক ওপরে, কাজুবাদাম গাছগুলোর সবুজ ডগার ওপর, উড়ে যাচ্ছে একঝাঁক সবুজ চাচালাকা। সেও আমাদের ভাল লাগে। এখন আমরা শুনতে পাই কুকুরের ঘেউ ঘেউ, আমাদের কাছেই, কারণ শহর থেকে আসা হাওয়া নয়ানজুলিতে গমগম করে প্রতিধ্বনি তোলে, তাকে ভরে তোলে তার সব শোরগোলে।

এস্তেবান গায়ে জড়িয়ে ধরে তার মুরগি যখন আমরা প্রথম বাড়িগুলোর কাছে পৌঁছুই। সে মুরগিটার পা খুলে দেয়, যাতে মুরগিটা তার পায়ের অবশ ভাবটা ঝেড়ে ফেলতে পারে, তারপর সে আর তার মুরগি উধাও হয়ে যায় কতগুলো তেপেমেস্কিতে গাছের আড়ালে।

‘এখানেই আমি থামছি’, এস্তেবান আমাদের জানায়।

আমরা শহরের আরো ভেতরে ঢুকে পড়ি।

ওরা আমাদের যে-জমি দিয়েছে, তা পড়ে আছে পেছনে, দূরে।

‘ওরা আমাদের জমি দিয়েছে’, হুয়ান রুলফো; অনুবাদ : মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

 

যেন গল্প নয়, এই ঘরের ভেতরেই অনেকে কথা বলছিল। রক্তমাংসের শরীর নয়, কয়েকটা ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তারা হেঁটে যাচ্ছিল, আর এই ঘরই যেন এক প্রান্তর হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল।

হ্যাঁ, প্রান্তরই তো। বইটার নাম জ্বলন্ত প্রান্তর যার ভেতর থেকে উঠে এসেছে ছায়া-অসিত্মত্বেরা। রঘুপতি জানে, এরা কেউ আর বেঁচে নেই। কখনো কি বেঁচে ছিল? মৃত্যুর গর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে তারা জ্বলন্ত প্রান্তরে একদিন ফিসফিস করে কথা বলেছিল, অনেক কাহিনির বীজ ছড়িয়ে দিয়ে আবার মৃত্যুর কৃষ্ণগহবরেই
ফিরে গেছে।

সামনের দেয়ালটা এই মুহূর্তে যেন পুরনো সিনেমা হলের মলিন পর্দা। এটা কি রূপায়ণ হল, যেখানে ছোটবেলার সে মা ও পাড়ার অন্যান্য মহিলার সঙ্গে সিনেমা দেখতে যেত। দোতলায় শুধু মেয়েদের বসার জায়গা, চার আনা টিকিটের দাম। এসব কতদিন আগের কথা? সেই যখন পাড়ায়-পাড়ায় বোমা পড়ছে, রাসত্মায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ কিশোর-যুবকদের লাশ কাশীপুর-বরানগরের গণহত্যা। রূপায়ণের ভেতরে তখন ঝুল জমছে, ছড়িয়ে পড়ছে মাকড়সার জাল, দিনের পর দিন সাদা পর্দা কালো হয়ে যাচ্ছে। আর আটের দশক থেকেই শহরের পুরনো সিনেমা হলগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাবে, ছড়িয়ে পড়বে মাল্টিপেস্নক্সের থাবা।

রূপায়ণের বাড়িটা নেই, হাউজিং কমপেস্নক্স হয়ে গেছে, কিন্তু আজ রাতে, এই মধ্যরাত্রিতে, রঘুপতির ঘরে কে টাঙিয়ে দিয়ে গেল গরিব মানুষের কাফনের মতো সেই পর্দা? ভেসে উঠছে ছায়াছবি – লরির পর লরি আসছে, বোঝাই করা বেওয়ারিশ মৃতদেহ, প্রান্তরজুড়ে জেগে উঠছে লরি থেকে উগড়ে দেওয়া লাশের সত্মূপ, এবার পরপর জ্বলে উঠবে গণচিতা, একটি মৃতদেহের ওপর আরেকটি মৃতদেহ, তার ওপর আরেকটি, আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে, ছড়িয়ে আছে হাত-পা-মু-ু, আগুন জ্বলে উঠেছে, হাওয়ায় শিখা লেলিহান হয়ে উঠছে, মাংস পোড়ার গন্ধ, কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। রঘুপতি তো এরকম দৃশ্য দেখেনি, যেমন হিরোশিমায় বিস্ফোরণ দেখেনি, আউশভিৎশ-দাহাউ দেখেনি, সাইবেরিয়ার লেবার ক্যাম্প দেখেনি, ড্রেসডেনের ধ্বংস দেখেনি, কিন্তু দৃশ্যগুলো আসে, কোথা থেকে কীভাবে সে জানে না, আর শুনতে পায় কথা, ফিসফিস করে কারা কথা বলে যায়, কোথাও বিড়াল কেঁদে ওঠে, নারীদের ভাঙা-ভাঙা বিলাপ শোনা যায়।

সে শুনতে পায়, কারা চাপাস্বরে কথা বলতে-বলতে হেঁটে যাচ্ছে।

– তুমি সব দেখেছিলে?

– সব। আগুন ছড়িয়ে পড়ছে… তার ডানা সব ঢেকে দিচ্ছে… আমি সব শুনেছি, সব পড়েছি…

– কী?

– রেডিওতে যা-যা বলা হচ্ছিল, খবরের কাগজে ওরা যা ছাপছিল… দগ্ধ দিনরাতের সব সব ছবি দেখেছি… কিন্তু…

– আর কী দেখেছিলে?

– না, দেখিনি। ওরা দেখাতে পারেনি।

– কী?

– একটা প্রজাপতি উড়ছিল। ওর ডানায় আগুন ধরে গেছে। পাগলের মত উড়ছিল, লাট খাচ্ছিল… ওরা দেখাতে পারেনি… হিরোশিমার সবচেয়ে নৃশংস হত্যা।

আর তখনই একটা কুকুর মৃত্যুযন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। তার ঘরের পর্দায় একটা জ্বলন্ত কুকুর, এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে, তার চিৎকার ও যন্ত্রণার কান্না মিলেমিশে গেছে। কীভাবে ওর গায়ে আগুন লাগল? কে আগুন ধরিয়ে দিল কুকুরটার শরীরে? এই কি তিতওয়ালের কুকুর, ভারত আর পাকিসত্মানের সৈন্যরা যাকে নিয়ে নারকীয় খেলায় মেতে উঠেছিল, তারপর কুকুরটাকে গুলি করে হত্যা করেছিল জমাদার হরনাম সিং।

কালিঘাটে গলির পর গলির গোলকধাঁধা পেরিয়ে যে টিনের বাড়িতে (রঘুপতির বাবা সারাজীবন ‘বাসা’ বলত : বাড়ি তো হয় নিজের, আর ‘বাসা’ শুধুই মাথা গোঁজার আসত্মানা) তারা থাকত, তার সিলিংয়ে টাঙানো ছিল বিবর্ণ, নীল পস্নাস্টিক। গ্রীষ্মের দুপুরে তা সিনেমার পর্দাই হয়ে যেত। অন্ধকার ঘরে সেই পর্দায় প্রতিফলিত হতো বাইরে চলাফেরা করা মানুষ-কুকুর-বিড়ালদের ছায়া। রঘুপতি বিছানায় শুয়ে সেইসব ছায়াপুতুলের খেলা দেখত।

খাটের নিচে সাদা কাপড় টাঙিয়ে সে সিনেমা হল তৈরি করত। পর্দার পেছনে নানারকম পুতুল সাজিয়ে, মোমবাতি জ্বেলে তাদের ছায়া ছোট-বড় করে দেখাত। বন্ধুদের কোলাহল আর হাততালিতে ভরে উঠত, তাদের এখানে-ওখানে ভেঙে যাওয়া ঘর। একদিন সেই পর্দায় ভেসে উঠল তারই মত এক বালকের মুখ, মাথায় রাঙতার মুকুট। সে চোখ বড়-বড় করে বলল, ‘রেলগাড়ি দেখেছিস রঘু?’

– না।

– রেলগাড়ি দেখতে যাবি?

– কোথায়?

– চল, আমার সঙ্গে।

সেখানে ডোমদের বসিত্ম, ছোট-ছোট সব মাটির বাড়ি, নোংরার সত্মূপ, চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে শুয়োর, লোকগুলো সব কুচকুচে কালো, হা-হা করে হাসছে, মজা করছে, কেউ টালমাটাল হয়ে নাচছে। বসিত্মর পাশেই লোহার ব্রিজ; সেই ব্রিজের ওপর দিয়ে রেলগাড়ি যায়। ব্রিজের কালো ডানা মেলে বসে আছে বড়-বড় সব পাখি। শকুন। ওরা মরা খেয়ে বেঁচে থাকে। ব্রিজের ওপর ঝমঝম আওয়াজ তুলে একসময় চলে গেল রেলগাড়ি।

– দেখলি? পানু জিগ্যেস করেছিল।

রঘুপতি অবাক হয়ে পানুর দিকে তাকিয়েছিল। সেই ছেলেটা কোথায় গেল, যার মাথায় রাঙতার মুকুট?

– ধোঁয়া নেই?

– ধোঁয়া? পানু হাসে।

– রেলগাড়ি তো ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে যায়। ছবিতে দেখেছি।

– এটার নাম ট্রেন। ইলেকটিরিতে চলে।

রঘুপতি হতাশ হয়েছিল। ছেলেটা হঠাৎ উধাও হয়ে গেল, রেলগাড়ির বদলে পানু তাকে ট্রেন দেখাল।

তার জীবনের পথের পাঁচালী এভাবেই শুরু হয়েছিল। ভেবে নিজের মনেই হাসল রঘুপতি।

সিঙ্গমের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে, ‘জাঁহাপনা -’

জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে তাকে দেখছে সিঙ্গম। একসময় সিঙ্গম হেসে বলল, ‘দুঃখ হচ্ছে, হুজুর? কষ্ট পাবেন না। আমাদের এই গল্পটার কিছুই সত্যি নয়।’

– মানে?

– সব মিথ্যে, তবে ক্ষতিকর নয়। একেবারে নির্লজ্জ মিথ্যে। এই কিস্সা শুনলে আপনার স্বাস্থ্য ভাল থাকবে, আপনি সুখী
হবেন। r